#গল্পঃ_গোপনে |০১|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক
দুপুর বারোটা।আমি অফিসে।ফরেন ক্লায়েন্টদের সঙ্গে জরুরি মিটিংয়ে। তখনই শানু কল করলো।পরপর তিনবার। ফোন ভাইব্রেট করে রাখা।আমি শুধু এক নজর দেখলাম কে কল দিচ্ছে। দেখলাম আমার স্ত্রী শানু কল দিচ্ছে।
রিসিভ করতে না পারলে কখনোই একবারের বেশি কল দেয় না শানু। আজ পর পর তিনবার কল দিলো কেন? কোন সমস্যা না তো? মায়ের কদিন ধরেই শরীর খারাপ। হার্টের সমস্যা বেড়েছে।সব সময় একটা আতংকের মধ্যে থাকি! ভয় করে, কখন জানি কি হয়ে যায়!
তাড়াহুড়ো করে চেয়ার থেকে উঠে বসের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বসকে বললাম,
– ‘স্যার, একটা জরুরী কল এসেছে।একটু যদি — ‘
কথা শেষ করার আগেই বস আমার দিকে রাগী চোখে তাকালেন। তারপর বললেন,
– ‘এই মিটিংয়ের চেয়ে জরুরি আর কিছু যদি আপনার কাছে থেকে থাকে তবে আপনি নিয়মিত তাই করুন। এই জবটা ছেড়ে দিন।’
নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে আমার।আমি অনুনয়ের গলায় বললাম,
– ‘স্যার, আমার মা ভীষণ অসুস্থ!’
এবার বসের মন নরম হলো। তিনি তাড়াহুড়ো করে বললেন,
– ‘শিহাব, আপনি বিষয়টা পরিষ্কার করে বলবেন না আমায়? জগতে মায়ের চেয়ে আপন কেউ আছে? মায়ের চেয়ে বেশি জরুরি কিছু আছে? আপনি এক্ষুনি যান। কথা বলুন গিয়ে। সমস্যা হলে আমায় বলতে হবে না কিছু। সোজা বাসায় চলে যাবেন।’
আমার চোখে জল এসে গেল। সেই জল কাউকে দেখতে দেইনি আমি।অফিস থেকে বেরিয়েই তাড়াহুড়ো করে শানুকে কল করলাম।শানু প্রথমবার রিসিভ করলো না। দ্বিতীয় বার কল রিসিভ করলো। তারপর বললো,
– ‘কোথায় তুমি?’
আমি তার কথার উত্তর দিলাম না। আমি জিজ্ঞেস করলাম মায়ের বিষয়ে। বললাম,
– ‘মা কেমন আছে শানু?’
শানু বললো,
– ‘মা ভালোই আছে। বুকের ব্যথা এখন নাই। ঘুমাচ্ছেন। তুমি কোথায় আছো তা বলো?’
আমার মন এবার শান্ত হলো। বললাম,
– ‘মিটিংয়ে।’
শানু বললো,
– ‘তোমার মেয়ে কলিগটা কোথায়? তোমার পাশে নাকি?’
আমি বললাম,
– ‘সে আসেনি আজ।অসুখ তার।’
শানু বললো,
– ‘আহারে! ওর জন্য তোমার খারাপ লাগছে তাই না?’
আমি বললাম,
– ‘কি সব বলছো তুমি? ফালতু কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছো তাই না?’
শানু রাগের গলায় বললো,
– ‘ফালতু কথা বলি আমি?আমি ফালতু? আমি কি কিছু বুঝি না নাকি? এই মেয়ে ডিভোর্স নিয়েছে কার জন্য হ্যা? তোমার জন্য।তুমিই ওকে বলেছো ডিভোর্স নিতে। আরেকটা কথা। এই যে আমার বাচ্চা কাচ্চা হয় না।
আমার তো এখন মনে হয় তুমি আমায় কিছু খাইয়ে দিয়েছো। আমার সব শেষ করে দিয়েছো তুমি। কদিন পর বাচ্চা না হবার অভিযোগে আমায় ডিভোর্স দিবে তুমি। এরপর তোমার কলিগ জেবাকে বিয়ে করবা। সুখের সংসার করবা।বিরাট প্লান করেছো তুমি!’
ওপাশ থেকে শব্দ করে হাসলো শানু।আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে সে।সব বানোয়াট। তার নিজের মনগড়া।আমি আর কোন কথাই বললাম না।কুট করে এপাশ থেকে ফোন কেটে দিলাম।
শানু এরপর আরো কয়েকবার ফোন দিয়েছে।আমি রিসিভ করিনি। রাগে আমার শরীর কাঁপছে। ক’দিন আগে আমার কলিগ জেবা ডিভোর্স নিয়েছে। শুনেছি তার হাসব্যান্ড অবৈধ সব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।মদের কারবার, নারী পা*চার, বড় বড় পয়সাওয়ালা, ক্ষমতাধর লোকদের কাছে মেয়েদের টাকার বিনিময়ে তোলে দেয়া এসব তার কাজ।খু*ন টুনও নাকি করে বেড়ায়।জেবা আগে এসব জানতো না।পরে জেনেছে। আমি উপরে উপরে শুনেছি জেবার স্বামী জেবাকেও নাকি জোর করেছিল দেশের এক প্রভাবশালী লোকের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে। রাতে থাকতে বলেছিল জেবাকে। এরপরই নাকি জেবা ওখান থেকে চলে আসে।ডিভোর্স নেয়।
জেবার সঙ্গে আমার আলাদা কোন সম্পর্ক নাই।আর দশজন কলিগের সঙ্গে যেমন, তার সঙ্গেও তেমন। এমনকি আমরা ফোনেও কোনদিন কথা বলিনি। ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে এড থাকলেও কোনদিন কেউ কাউকে নক করিনি। তবুও শানু এমন করছে কেন আমার সঙ্গে? আমি বুঝতে পারি না!
ওয়াশরুমে গিয়ে ‘ মুখে জল ছিটিয়ে এসে বসি আবার মিটিংয়ে।আমি বসার পরেই অদ্ভুত কান্ড ঘটে।বস নিজে বসা থেকে উঠে আমার কাছে আসেন। এসে জিজ্ঞেস করেন,
– ‘মায়ের শরীর কেমন এখন? কোন সমস্যা না তো?’
আমি বললাম,
– ‘জ্বি না। এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’
বস আমার পিঠে হাত চাপড়ে দেন।বলেন,
– ‘ঠিক হয়ে যাবে। মায়ের জন্য সব সময় দোয়া করবেন। আলাদা করে নফল নামাজ পড়বেন।বাবা মায়ের জন্য সন্তানের দোয়া সঙ্গে সঙ্গে কবুল হয়।’
আমি কৃতজ্ঞতার গলায় বললাম,
– ‘আচ্ছা স্যার।’
.
এর আরো এক ঘন্টা পর মিটিং শেষ হলো।সবার ভাগে অনেক গুলো কাজ পড়েছে। আমার ভাগেও।আজ মিটিংয়ে যা যা নিয়ে কথা হয়েছে তার সবকিছু ফাইলে তালিকা করতে হবে। বিরাট ঝামেলা!
আমি বসে বসে এসব করছি। এরমধ্যে চা এসেছে। চায়ের কাপ তুলতে যাবো তখন আবারো শানুর ফোন।মেয়েটা বিরক্ত করে ছাড়ছে আমায়। এবার ফোন রিসিভ করলাম। বললাম,
– ‘কি সমস্যা তোমার? এভাবে বিরক্ত করছো কেন? আমি তো অফিসে নাকি? আমার তো কাজ আছে।নাকি জবটা করতে দিবে না আমায়? আচ্ছা জবটা ছুটে গেলে খাওয়া পরা চলবে কিভাবে? ভিক্ষা করতে হবে আমার বুঝলা?’
শানু আর কিছুই বললো না। ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলো।
.
রাতে বাসায় ফিরে অবাক হলাম।শানুকে ভীষণ শান্ত দেখাচ্ছে। সে বললো,
– ‘তুমি রেগে যাও কেন শিহাব? আমি তোমায় ভালোবাসি বলে এরকম করি! তুমি ছাড়া আমার কি আর কেউ আছে? তাই তোমায় নিয়ে আমার সব সময় ভয় কাজ করে।সব সময় মনে হয়, কেউ যদি আমার থেকে তোমায় কেড়ে নেয়। আজকালকার যুগ তো খারাপ।কতো দিকেই তো কতো কি ঘটছে। এই জন্য আমার মন মাঝেমধ্যে অস্থির হয়ে উঠে। তখন আমি এরকম পাগলামি করি।’
শানু আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে এসব বললো। আমার রাগ আর জিইয়ে রাখলাম না। তার একটা হাত ধরে বললাম,
– ‘আমায় আর দশ জনের মতো ভেবো না।আমি নোংরা লোক না। নিজের চরিত্রে কোনদিনই কালি পড়তে দিবো না।’
শানু খুশি হলো।বললো,
– ‘হাতমুখ ধুয়ে আসো। খেতে দেই।’
আমি বললাম,
– ‘না। এখন না। আগে মাকে দেখে আসি।’
শানু বললো,
– ‘কি দেখবে গিয়ে? মা তো ঘুমাচ্ছেন।’
আমি বললাম,
– ‘ঘুমাচ্ছেন মানে? যখন ফোন করলে দুপুর বেলা। তখন বললে ঘুমাচ্ছেন। এখনও ঘুমাচ্ছেন।এতো লম্বা সময় ঘুমাবেন কেন?’
শানু বললো,
– ‘কি জানি! শরীর দূর্বল তো তাই হয়তো।এসব নিয়ে টেনশন করো না।পরে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়বে তুমি।’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। মায়ের ঘরে গেলাম হেঁটে হেঁটে। গিয়ে দেখি মা তখনও ঘুমাচ্ছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। খুব দূর্বল দেখাচ্ছে মাকে।ডাকবো কি না মাকে বুঝতে পারছি না।এই ঘর থেকেই শানুকে জিজ্ঞেস করলাম,
– ‘শানু, মা কি কিছু খেয়েছেন? খাওয়া দাওয়া হয়েছে মায়ের?’
শানু বললো,
– ‘না তো।ঘুম থেকেই তো উঠেননি এখনও। খাবেন কি করে?’
আমি বললাম,
– ‘তুমি ডেকেছিলে মাকে?’
শানু বললো,
– ‘না।ডাকিনি।ডাকলে ঘুমের ডিস্টার্ব হবে না? আমি ভাবলাম, ভালো করে একটা ঘুম হোক। ভালো ঘুম হলে শরীরটা এমনিতেই ভালো লাগবে।তাই ডাকিনি।’
আমি মাকে ডাকলাম।মা ঘুমে কাতর চোখে একটু তাকালেন। ঘুমে আচ্ছন্ন থেকেই যেন বললেন, ঘুম হয়নি।আরো ঘুমাবেন। খাবেন না।
আমি খানিক সময় ধরে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। তারপর মশারিটা খাটিয়ে দিয়ে এসে পড়লাম। এসে হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিলাম।শানু খেলো আমার পরে। তার অভ্যেস এটা।স্ত্রীর নাকি স্বামীর পরে খেতে হয়।তাই সে আমার খাওয়া হলে পরে খায়।আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই নিয়ম সে কোথায় পেয়েছে? সে বলেছিল, তাদের বাড়িতে এরকম নিয়ম।আমি বলেছিলাম, এসব কুসংস্কার।এসব আর করবা না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! শানু পুরনো নিয়মই আঁকড়ে ধরে আছে।
.
পরদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সবচেয়ে বেশি চমকালাম।মা তখনও ঘুমাচ্ছে।আমি ডাকলাম।মা ঘুমে তলিয়ে থেকেই বলেন, আরো ঘুমাবেন তিনি। তার ঘুম হয়নি।
আমার কেমন খটকা লাগছে এবার।এটা তো স্বাভাবিক কিছু না।
আমি শানুকে বললাম,
– ‘এরকম তো হবার কথা না শানু? মা তো এতো ঘুমাবার লোক না!’
শানু বললো, তার দাদির নাকি হার্টের সমস্যা ছিল।তিনিও এরকম ঘুমাতেন।
শানুর কথাবার্তা আমি বুঝি না। পড়াশোনা আছে তার। কিন্তু বিজ্ঞানের জ্ঞান তার একেবারেই নাই।থাকলেও তা সে বিশ্বাস করে না। হার্টের সমস্যা থাকলে এভাবে রাতদিন ঘুমাবেন এটা আবার কেমন ধরনের কথা!
আমি বললাম,
– ‘মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।’
শানু বললো,
– ‘তুমি কি পাগল? মাথা খারাপ তোমার? একটা মানুষ ঘুমাচ্ছে।ঘুম বেশি হয় বলে কেউ কাউকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় নাকি?’
শানু খুব করে চাইলো আমি যেন ডাক্তারের কাছে না যাই মাকে নিয়ে। কিন্তু আমি তার কোন রকম কথাই শুনলাম না।ডাক্তারের কাছে নিয়ে এলাম মাকে । কিন্তু এখানে এসে সবচেয়ে বেশি চমকাবার মতো বিষয়টা জানতে পারলাম।ডাক্তার বললেন, ‘সে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। অনেক দিন ধরেই নাকি তিনি এই ওষুধ খাচ্ছেন।’
(চলবে)…
(ভুল ক্রটি মার্জনীয়,সবাই রেসপন্স করবেন কমেন্টে।)