গোপনে পর্ব-০২

0
1239

#গল্পঃ_গোপনে |০২|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক



হাসপাতালে এসে চিকিৎসার পরেও মা স্বাভাবিক হচ্ছেন না। আগের মতো ঘুমে মগ্ন না থাকলেও বিছানায় তিনি নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকেন।চোখ বুজে রাখেন সব সময়।কাছে গিয়ে ডাকলে কেমন আঁতকে উঠেন তিনি।দেখে মনে হয় হঠাৎ ডাকায় প্রচন্ড ভয় পেয়েছেন তিনি। তারপর খানিকটা সময় গেলে চোখ খুলে বলেন,’ কে? কে? ‘
আমি মায়ের হাতটা ধরি। তারপর বলি,’ আমি শিহাব।আমায় চিনেছো মা?’
মা খানিক সময় চেয়ে তাকেন।দেখেন আমায়। তারপর চোখ বন্ধ করে ফেলেন আবার।
আমি আবার ডাকি।
‘ মা, মা মাগো!’
মা চোখ বন্ধ রেখেই ঘুম কাতর গলায় বলেন, ‘ তুই কোন শিহাব? আমারে মারার জন্য তোকে ভাড়া করা হয়েছে নাকি?’
আমি চমকে উঠলাম। বললাম,’ মা এসব কি বলছো তুমি? ওমা? মাগো?’
মা আমার হাতটা তার দূর্বল হাতে দূরে সরাবার চেষ্টা করে বলেন,’ আমায় বিরক্ত করবি না ।যা এখান থেকে।দূর হয়ে যা। না গেলে আমার ম*রা মুখ দেখবি!’
এসব কি কথা! আমার মাথা খারাপ হয়ে যেতে থাকে! চোখে জল আসে। মায়ের এমন অবস্থা হলো কেন?
আমি কিছুই ভেবে পাই না।মা ঘুমের ওষুধ পেলেন কোথায়? শানুকে কি সন্দেহ করা যায়?
না। তাকে কিভাবে সন্দেহ করবো? শানুর নিজের মা নাই ছোট থেকেই। সে বড় হয়েছে সৎ মায়ের ঘরে। শানু মায়ের দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের মেয়ে। শানুর উপর তার সৎ মায়ের এসব অ*ত্যাচার অ*নাচার দেখেই মায়ের মায়া হয়। এরপর মা আমায় ধরেন, শানুকে বিয়ে করার জন্য। তিনি শানুকে ঘরে এনে নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখতে চান।
আমি প্রথম প্রথম না করেছিলাম।শানু উচ্চ মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা করেনি। এই জন্যই। আমি বলেছিলাম, একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও মা। সেটাই ভালো হবে।মা রাজি হননি। তিনি বলেন,তোর চেয়ে ভালো ছেলে আমি কোথায় পাবো বল?
শেষমেষ মায়ের জোরাজুরিতে আমি রাজি হলাম। শানুর সঙ্গে আমার বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে। এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই আমি দেখেছি। আমার আর শানুর মধ্যে মাঝেমধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সামান্য ঝগড়া হবে, আবার ঝগড়া ঠেলে দিয়ে মধুর সম্পর্ক হবে এটাই তো স্বাভাবিক।হয়েছেও মাঝেমধ্যে এমন। কিন্তু মায়ের সঙ্গে কোনদিন অভিমানও করেনি শানু।মাও তাকে কোনদিন তুচ্ছ করে, তার সঙ্গে রাগ দেখিয়ে একটা কথা বলেননি।এতো মিষ্টি একটা সম্পর্কের মধ্যে শানুকে কিভাবে সন্দেহ করতে পারি আমি?
কিন্তু মা কিভাবে ঘুমের ওষুধ পেলেন তাই তো বুঝতে পারছি না আমি। কিচ্ছু মাথায় আসছে না আমার!
নাকি ডাক্তার ভুল বলছেন এসব?
মানুষ মাত্রই ভুল হয়।ডাক্তাররাও মানুষ।তাদেরও ভুল হতে পারে।
আমি ভাবলাম, ডাক্তারের সঙ্গে আরেকবার কথা বলবো গিয়ে।

ডাক্তারের সঙ্গে কথা হলো আরো এক ঘন্টা পর।ডাক্তার মাকে আবার দেখতে এলেন।দেখে তারপর বললেন, ‘রোগীর অবস্থা সুবিধার না।উনি পরিমাণে অনেক বেশি ওষুধ খেয়েছেন। আল্লাহ না করুন, উনার প্যারালাইসিস হয়ে যায় কি না কে জানে!’
শুনে আমার আত্মা কেঁপে উঠলো।
ডাক্তার আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ আপনার মায়ের ঘুম কেমন হতো?’
আমি বললাম,’ কম। মায়ের ঘুম কম হতো।’
ডাক্তার এবার বললেন,’ উনি তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ খেয়েছেন। নিজের সর্বনাশ নিজেই করেছেন!’
আমি কি বলবো বা কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না!
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার বড় অবাক লাগছে, শানু এখন পর্যন্ত একটা কল দেয়নি আমায়। মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেনি।অথচ ওর উচিৎ ছিল আমাদের সঙ্গে হাসপাতালে আসা। মায়ের পাশে থাকা।মা ওর জন্য কি না করেছে? মায়ের জন্য যে সুখের একটা সংসার পেলো শানু, তবুও সে কি না –!
বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিলাম, ঠিক তখন জেবার নম্বর থেকে কলটা এলো।জেবার নম্বর আমার ফোনে অনেক আগে থেকেই সেভ করা। কিন্তু আমাদের দুজনের কেউ কাউকে কোনদিন কল করিনি। প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই জেবা কল করলো কেন? মায়ের অসুখের কথা কি সে শুনেছে? হয়তো মায়ের কুশল জানতেই কলটা করেছে।
প্রথমবার কল রিসিভ করলাম না।কারোর সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
কিন্তু জেবা আবার কল করলো।আমি তখনও রিসিভ করলাম না।
অদ্ভুত বিষয় হলো, তৃতীয়বারের মতো কল করলো জেবা। এবার রিসিভ করতে বাধ্য হলাম। রিসিভ করে ফোন কানে চেপে ধরতেই জেবার রাগী গলা শোনা গেল।কি অদ্ভুত কান্ড।জেবা আমার সঙ্গে রাগে কথা বলছে কেন?
জেবা বললো,’ শিহাব ভাই, আপনার সমস্যা কি? আপনি এমন বাজে লোক তা তো আগে জানতাম না!’
আমি বড় অবাক হলাম।এসব কি বলছে জেবা আমায়?
আমি বললাম,’ জেবা এসব কি বলছো তুমি?’
জেবা তার গলা আরো ঝাঁজালো করে বললো,’ আপনার গালে জুতো দিয়ে দুইটা দি*লেই সব বুঝবেন। সামনে থাকলে ঠিক তাই করতাম।’
রাগে ফুসফুস করছে জেবা।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।তাই চুপ করে রইলাম।
জেবা নিজ থেকেই আবার কথা বললো।বললো,’ আপনি বসের কাছে কি বলেছেন?’
আমি বললাম,’ কি বলেছি?’
জেবা বললো,’ আমায় নাকি আপনি বিয়ে করবেন। বিয়ের সবকিছু পাকাপাকি।আট লাখ টাকা কাবিন দিচ্ছেন আমায়। আপনার প্রথম স্ত্রীর বাচ্চা হয় না তাই এই বিয়ে করছেন। বিয়ের পর আমি আপনাকে বাচ্চা দিবো। সুখের সংসার হবে আপনার।এসব কথা কিভাবে বানিয়ে বানিয়ে বললেন আপনি? তাও বসের কাছে? ছিঃ! আপনি এমন ল*ম্পট কখনোই কল্পনা করিনি আমি!’
জেবার মুখ থেকে এসব শুনে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে।মাথা কেমন ভনভন করে ঘুরছে।এসব কি বলছে জেবা? বস কেন তাকে এসব বলবে? আমি মনে মনেও তো কোনদিন কোন সময় এরকম কিছু ভাবিনি। তাহলে বস কিভাবে জানলো এসব? আর জেবার কাছেই বা কিভাবে বললো এসব?
আমি বললাম,’ জেবা, এসব মিথ্যা।আমি —
কথাটা শেষ করতে পারলাম না আমি।এর আগেই জেবা ধমক দিয়ে আমায় থামিয়ে দিলো। তারপর বললো,’ আপনার বিরুদ্ধে আমি মানহানির মামলা করবো শিহাব ভাই। শায়েস্তা করে ছাড়বো আপনাকে।ডিভোর্স হয়ে গেছে বলে কি ভেবেছেন আমায় মন যা চায় তাই করতে পারবেন আমার সঙ্গে? অসহায় মনে করে আমার সঙ্গে যা তা করবেন আর আমি চুপচাপ সহ্য করবো? আর দশটা মেয়ের মতো ভেবেছেন আমায়? আপনাকে উচিৎ শিক্ষা না দিলে আমার নাম জেবা না!’
আমি কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। তবুও বলতে চাইলাম, জেবা আল্লাহ জানেন, আমি এসব কিছু বলিনি।সব মিথ্যে।
কিন্তু এসব বলার আগেই হাসপাতালের একজন আয়া আমার কাছে তাড়াহুড়ো করে এলো।এসে দমের উপর দম ফেলতে ফেলতে বললো, ‘ ভাই, আপনার মা কেমন জানি করছেন! হাসপাতালে ডাক্তার নাই।নার্স আপা আছেন। কিন্তু তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না! ‘

(চলবে)…
#গোপনে