#গল্পঃ_গোপনে |০৪|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক
‘
কানন ফার্মেসি পাওয়া গেল অনেক খোঁজাখুঁজির পর। আমাদের বাসা থেকে অনেক দূরে।প্রায় চার কিলোমিটার হবে, শহরের একেবারে পশ্চিমে।
বিরাট জমজমাট ফার্মেসি! অনেক ভীড় জমে থাকে। এই ভীড়ের মধ্যে যেখানে ওষুধ কিনতে পারাটায় কষ্টকর সেখানে ওদের কারোর সঙ্গে কথা বলবো কি করে? এখান থেকে আসলে কোন তথ্যই জানা যাবে না। এখানে রোজ শতো শতো লোক এসে ওষুধ কিনে।ওরা কাকে মনে রাখবে?
এরপরেও অনেক চেষ্টা করে একজন কর্মচারীর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, কোন বৃদ্ধা এসে তাদের কাছ থেকে ঘুমের ওষুধ নিতো কি না!
সে বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘এইখানে রোজ পাঁচশো প্লাস কাস্টমার আসে।কাস্টমারদের মধ্যে অনেকেই বৃদ্ধ থাকে। কোন একজনের সম্পর্কে কিভাবে তথ্য দিবো আমরা বলুন?’
বলে তার কাজে মনোযোগ দিলো সে।
কিন্তু এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় চোখে পড়লো।আর এটা চোখে পড়ার পর আমার মাথা সত্যি সত্যিই এলোমেলো হয়ে গেল।
কানন ফার্মেসির উপরে বিশাল সাইনবোর্ডে লিখা আছে এই ফার্মেসির মালিকের নাম। আশফাক সুমন। আবার আমার অফিসের বসের নামও আশফাক সুমন। তবে কি এই ফার্মেসির মালিক আশফাক সুমন এবং আমার অফিসের বস আশফাক সুমন দু’জনই একই ব্যক্তি?
ফার্মেসির কারোর কাছ থেকে এই বিষয়ে সঠিক তথ্যটা জানতেও পারলাম না। জানতে চেয়েছিলাম। একটা ছেলেকে কাছে ডাকলাম। কিন্তু সে কাছে আসার আগেই আমার ফোনে কল এলো। হাসপাতাল থেকে।নার্স কল দিয়ে এক রকম ধমকি দিয়েই বললেন,’ আপনি কেমন মানুষ বলুন তো? আচ্ছা হসপিটালে যে বৃদ্ধা মহিলাকে আপনি ভর্তি করিয়েছেন তিনি কি আপনার আপন মা? মানে ইনি আপনাকে জন্ম দিয়েছিলেন?’
আমি বড় অবাক হলাম।এ আবার কোন ধরনের কথা? আমি বললাম,’ আপনি কি জানেন না উনি আমার মা? আপনাকে তো আমি বলেছি। কিন্তু কেন? কি সমস্যা?’
নার্স বললেন,’ আপনার নিজের মা হলে তাকে কিভাবে হসপিটালে ফেলে রেখে চলে গেলেন? মরণাপন্ন একটা রোগীকে একা ফেলে কি তার সন্তান কখনো চলে যেতে পারে?’
আমি বললাম,’ না বোন, আমি একা রেখে আসিনি মাকে।আমি বাইরে এসেছি জরুরি এক প্রয়োজনে।আর মায়ের পাশে আমার স্ত্রীকে রেখে এসেছি আমি।’
নার্স চমকে যাওয়া গলায় বললেন,’আপনার স্ত্রী? কোথায় সে? ‘
আমি বললাম,’ মার কাছেই তো। হয়তো ওয়াশরুমে গিয়ে থাকবে।’
নার্স বললেন,’ দু ঘন্টা ধরে আপনার মায়ের কাছে আমি বসা।উনি একা, কেউ নাই, এমন অসুস্থ মানুষ তাই উনাকে ছেড়ে আমি যেতে পারছিলাম না। আমার ডিউটি শেষ। কিন্তু বার বার মনে হচ্ছিল, আমার নিজের মা যদি হতেন তবে কি আমি এভাবে একা ফেলে রেখে চলে যেতে পারতাম! তাই যাইনি। কিন্তু আপনার স্ত্রী এখানে নেই।ওয়াশরুমে গিয়ে কেউ দু ঘন্টা থাকবে না নিশ্চয়।’
শুনে মাথা ঘুরতে লাগলো আমার। এসব কি হচ্ছে আমার সঙ্গে?
তবে কি কাউকেই বিশ্বাস করবো না আমি?
তবে কি সত্যি সত্যিই এইসব কিছুর পেছনে শানু জড়িত? আর শানুর পেছনে আশফাক সুমন?
আশফাক সুমন জড়িত কি না এখনও আমি জানি না। কিংবা এই ফার্মেসির মালিক আমার বস আশফাক সুমনই কি না তাও জানতে পারিনি। আমার হাতে একটুও সময় নেই।মা একা পড়ে আছেন হাসপাতালে। আমার দুঃখী মা। আমাকে এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে! এক্ষুনি!
‘
সিএনজি করে হাসপাতালে যাচ্ছি।যেতে যেতে ফোন হাতে নিয়ে শানুকে কল দিলাম। প্রথমবার রিং হলো। কিন্তু রিসিভ না করে ওপাশ থেকে কেটে দিলো। কিন্তু দ্বিতীয়বার কল দেয়ার পর দেখা গেল তার ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন।বন্ধ করে রেখেছে।
অদ্ভুত বিষয় হলো তখন আমার পাশের ফ্ল্যাটের অলকা ভাবী ফোন করলেন।অলকা ভাবীদের সঙ্গে এক সময় আমাদের পরিবারের খুব মহব্বত ছিল।তারাও আমাদের ঘরে আসতো, আমরাও যেতাম। খাওয়া দাওয়া হতো। ভালো খাবার রান্না হলে একে অন্যের পরিবারে দেয়ার রীতি ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন শানু বললো, তার কানের দোল দুটি খুঁজে পাচ্ছে না।এর সপ্তাহ খানেক পর সে বললো, দোল দুটি অলকা ভাবী চুরি করেছেন।কি সর্বনাশের কথা! যাদের এতো আপন লোক ভাবতাম।যাদের এতো কাছে রাখতাম।তারাই কি না শেষে পিঠে চা*কু বসিয়ে দিলো! এ যেন দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষা। সেদিন থেকেই অলকা ভাবীর সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কিন্তু আজ এতো বছর পর অলকা ভাবী কেন কল দিলেন আমায়?
প্রথমবার ইচ্ছে করেই কল রিসিভ করলাম না। দ্বিতীয় বার কল রিসিভ করতেই অলকা ভাবী বললেন,’ শিহাব, মাসির শরীর কেমন?’
আমি বললাম,’ শরীর খারাপ ভাবী।’
অলকা ভাবী বললেন,’ আমি মাসিকে দেখতে আসবো। কোন হসপিটালে তোমরা বল তো?’
আমি হাসপাতালের নাম বললাম।
তিনি ফোন রেখে দিলেন।
‘
হাসপাতালে এসে দেখি সত্যি সত্যি শানু নাই এখানে।আয়া আছে। বারান্দায় ঝাড়ু দিচ্ছে।
আমি তার কাছে জিজ্ঞেস করলাম,শানু কখন চলে গিয়েছিল?
আয়া বললো, আমি যাবার মিনিট দশেক পরেই চলে গিয়েছিল।
এরপর ভেতরে গেলাম। গিয়ে দেখি নার্স বসে আছেন।আর মা তখনও ঘুমে।
আমায় দেখে নার্স রাগী রাগী চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন,’ আপনার স্ত্রীর কি মাথায় সমস্যা আছে?’
আমি বললাম,’ কেন? মাথায় সমস্যা থাকবে কেন?’
নার্স বললেন,’ কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কি এমন একটা রোগীকে এভাবে ফেলে রেখে চলে যেতে পারে? তাও উনার নিজের শাশুড়ি! ‘
আমি তার কাছে লজ্জিত হলাম। কোন উত্তর করতে পারলাম না।
নার্স এবার বললেন,’ আপনার মা একটু আগে জেগে উঠেছিলেন। সুস্থ মানুষের মতোই আচরণ করেছেন। কিন্তু আমায় তিনি চিনতে পারেননি। তিনি ভেবেছেন আমি আপনার স্ত্রী। তিনি আমায় বলেছেন, বউ, কি ওষুধ খাওয়াইলা আমারে, আমার ঘুম যায় না। আমার শরীর দূর্বল হয়ে গেছে।আমি এখন আর উঠতে পারি না! ও বউ? কথা বলো বউ?
আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি উনার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার শরীর একটু ভালো লাগছে কি এখন?
আপনার মা রেগে গেলেন। বললেন,’ তুমি আমারে বি*ষ খাইয়ে দিয়ে এখন বলো আমার শরীর কেমন আছে! তুমি আমারে মেরে ফেলতে চাও বউ।কেন আমারে মেরে ফেলতে চাও? তোমার লাভ কি এতে বউ?
এসব বলে বলে আবার তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
নার্সের মুখ থেকে এসব শুনে আমার মাথা আর কাজ করছে না।আমি অবশ হয়ে বসে পড়লাম বিছানার একপাশে। নার্স বললেন,’ আমায় যেতে হবে। আমার বাবা অসুস্থ।মা নাই।ঘরে ছোট বোন। সে ছোট মানুষ। কিছু বোঝে না।তারা হয়তো আমার জন্য টেনশন করছে খুব! আপনি থাকুন।কাল দেখা হবে আবার! ‘
নার্স চলে গেলেন।
এর খানিক পরেই এলেন অলকা ভাবী। তার সাথে তার ছোট্ট শিশু পলক। অলকা ভাবী এসে মার পাশে বসলেন। চুপচাপ দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। তারপর মার আসলে কি হয়েছে তা জানতে চাইলেন। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার বিষয়টি আমি এড়িয়ে গেলাম।আমি হার্টের সমস্যা বেড়েছে এটাই বললাম।মার প্রসঙ্গ শেষ হলে তিনি হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করলেন,’ শিহাব, শানু কোথায়? ওকে দেখছি না যে?’
আমি বললাম,’ সে তো বাসায় ভাবী।’
তিনি বললেন,’ আমি আসার সময় দেখে এসেছি তোমাদের ঘরের দরজায় তালা দেয়া।ও বাসায় নাই। আরেকটা কথা দীর্ঘদিন ধরে তোমায় বলতাম শিহাব।আমি ভয়ে বলি না কি থেকে কি ভাবো কে জানে! ‘
বলে থামলেন ভাবী।
আমি বললাম,’ বলুন। সমস্যা নাই ভাবী।’
অলকা ভাবী এবার বললেন,’ গত কয়েক মাস ধরে তোমাদের ঘরে একটা পুরুষ লোক আসা যাওয়া করে।’
এইটুকু বলেই থেমে গেলেন তিনি।
‘
(চলবে)…
#গোপনে