গোপনে পর্ব-০৮

0
637

#গল্পঃ_গোপনে |০৮|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক

শেষমেষ মামলাটা আমি করলাম।নাঈম বললো,’ তোর ভয় নাই। বাসায় আন্টির কাছে দুজন কনস্টেবল রাখছি।কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবে না তার।আর তুই সব সময় আমার পাশে থাকবি।’
তারপর নাঈম সঙ্গে করে স্টাফ না নিয়ে শুধুমাত্র আমায় নিয়েই গেল অলকা ভাবীর সঙ্গে দেখা করতে। তার গায়ে পুলিশের কোন পোশাক নেই। একেবারে আর দশটা মানুষের মতোই। সাদামাটা হয়ে।দেখে কোন ভাবেই চিনবার উপায় নেই যে সে একজন পুলিশের লোক।
অলকা ভাবীর ঘরে এসে দরজায় টোকা দিতেই ভাবী দরজা খুলে দিলো।দেরি করলো না।
আমায় দেখে ভাবী হাসলো। বললো,’ আমার ঘরের সামনে শিহাব! এ যে আমার সৌভাগ্য!’
আমি মুখ শক্ত করে রাখলাম। রাগে আমার শরীর কাঁপছে। ইচ্ছে করছে থা*প্পর দিয়ে এই মহিলার সবগুলো দাঁত ফে*লে দেই।গোপনে এতো কিছু করে এখন এমন বাহানা করছে যেন জগতে তার চেয়ে ভালো কোন মানুষ আর নেই!যেন সে এসবের কিছুই জানে না।
নাঈম বললো,’ আমি একটু ভেতরে যাবো। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।’
অলকা ভাবী নাঈমের পরিচয় জানতে চাইলো না। বললো,’ জ্বি, আসুন।বসুন এসে।’
নাঈম গিয়ে ঘরের ভেতর বসলো। আমিও তার পাশে বসলাম। তারপর নাঈম অলকা ভাবীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললো,’ আপনাকে দেখতে তো খুব ভালো ঘরের মেয়ে বলে মনে হয়। কিন্তু গোপনে এসব কি করে বেড়াচ্ছেন আপনি?’
অলকা ভাবী যেন কিছুই বুঝতে পারলো না। তাই চুপ করে রইলো।নাকি ইচ্ছে করেই চুপ করে আছে কে জানে! বাহানা করছে হয়তো।
নাঈম এবার শক্ত গলায় কথাটা বললো।বললো,’ অলকা, আমি সাধারণ কেউ না।আমি পুলিশের লোক।আপনার নামে নারী পা*চারের মামলা হয়েছে। আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করতে এসেছি। আপনি নারী পা*চারের সঙ্গে যুক্ত এর প্রমাণ আমার কাছে আছে।’
অলকা ভাবী এদিক ওদিক তাকালো। তারপর হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
নাঈম তার পকেট থেকে পি*স্তল বের করলো। তারপর বললো,’ চালাকি করলে একটা বুলেট খরচ করবো অলকা।আর সত্য বলে দিলে বেঁচে যাবেন।’
অলকা কান্না থামিয়ে বললো,’ আমি কিছু জানি না।সত্যি কিছু জানি না স্যার।’
নাঈম খুব জোরে একটা ধমক দিলো।বললো,’ আপনি শানু ভাবীকে অ*পহরণ করেছেন। অ*পহরণ করে কার কাছে তুলে দিয়েছেন তা বলুন। কোথায় আছে এখন শানু ভাবী? ঠিকানা বলুন।’
অলকা ভাবী বললো,’ ভগবানের দিব্যি আমি কিছু জানি না। আমার মরা বাপের দিব্যি স্যার।’
তারপর সে আলমারির কাছে গেল। আলমারি থেকে এক জোড়া দোল বের করে দিয়ে বললো,’ এই যে কানের দোল। এইগুলো আমি চুরি করেছিলাম।আর কিছু করিনি আমি।আর কিচ্ছু করিনি। শুধু এই দোল দুটিই চুরি করেছিলাম।পাপে ধরেছিল আমায়। ভুল করেছিলাম আমি।’
অলকার দিকে তাকালাম আমি। ওর দিকে তাকাতেও ঘেন্না হচ্ছে। সেদিন যখন সে হাসপাতালে গেল মাকে দেখতে, তার কথা শুনে তাকে আমি বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম।আমি ভেবেছিলাম শানু তার উপর মিছিমিছি চুরির অভিযোগে দিয়েছিল। কিন্তু এখন দেখি সে পুরোদস্তুর চোর। শুধু চোর না, আমি নিশ্চিত সে সবকিছুর সঙ্গেই জড়িত।
নাঈম দোল জোড়া হাতে তুলে নিল। তারপর বললো,’ এই তো আস্তে আস্তে সব তথ্য বেরুচ্ছে। আগে আপনি ছোট ছোট পাপ করেছেন।আর এখন বড় বড় করছেন। এই তো। আচ্ছা এবার বলুন, শানুকে কার হাতে তুলে দিয়েছেন। কোথায় আছে শানু? ঠিকানা বলুন।’
অলকা আবার কেঁদে ফেললো।বললো,’ বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানি না।আমি কিচ্ছু জানি না।আমি না জানলে কিভাবে বলবো বলুন।’
নাঈমের এবার রাগ লাগলো। সে রাগের গলায় বললো,’ আপনি কিছুই জানেন না তবে গত পরশু রাতে হোয়াটসঅ্যাপে শানুর ছবি পাঠিয়ে শিহাবকে হুমকি দিলেন কিভাবে? ‘
অলকা বললো,’ কি বলছেন এসব আপনি? আমার তো কোন এন্ড্রোয়েড ফোনই নাই।’
অলকা দেখালো, তার একটা অ্যানালগ ফোন আছে।
নাঈম ওই নম্বরটা বললো।নম্বর বলে তারপর বললো,’ এই নম্বরটা আপনার না?’
অলকা বললো,’ না। আমার না।’
নাঈম হাসলো। হেসে বললো,’ এই যে একটার পর একটা মিথ্যে বলছেন এসব করে কি বাঁচতে পারবেন বলুন? আপনি কি ভাবেন আমি এতোই বোকা যে আপনি যা বলবেন তাই বিশ্বাস করবো? এসব কাঁচা অভিনয় করে কোন লাভ হবে না।কারণ নম্বরটা আপনার।সিমটা আপনার নামেই রেজিস্ট্রেশন করা আছে।’
অলকা বললো,’ এটা কিভাবে সম্ভব? আমি জানি না।আমি কিছুই জানি না।’
নাঈম নিজেই লেগে গেল ঘর তল্লাশি করতে। প্রথমে আলমারির ড্রয়ার খুঁজে দেখলো। তারপর সোকেশের।সোকেশের একটা ড্রয়ার টেনে খুলতেই একটা ছোট্ট বক্স পেলো নাঈম। সেই বক্সের ছিপি খুলতেই অনেক গুলো সিম পাওয়া গেল। নাঈমের ঠোঁটে রহস্যময় এক হাসি।
সে এক এক করে সিম গুলো নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলো। চারটা সিম পরীক্ষা করা শেষে পঞ্চম নম্বর সিমটা যখন ফোনের ভেতরে ঢুকিয়ে চেক করলো তখনই চিৎকার করে উঠলো সে। বললো,’ এই তো এটা।পেয়েছি। পেয়েছি।’
বলেই সে উঠে দাঁড়ালো।অলকা দৌড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু নাঈম ততোক্ষণে পি*স্তল তাক করে ওদিকে ধরে বললো,’ আরেক পা সামনে এগিয়ে গেলেই লা*শ পড়বে তোমার অলকা! সাবধানে পদক্ষেপ নাও।’
অলকা দাঁড়িয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
নাঈম তার কাছে গেল। তারপর বললো,’ সব স্বীকার করো তুমি।’
অলকা এখনও সেই এক কথায় বলছে।বলছে,’ আমি কিছু জানি না।’
নাঈম ধমকে উঠলো।ধমক দিয়ে সে বললো,’ তুমি কিছু জানো না তবে দৌড়ালে কেন হ্যা? সিম খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ালে কেন?’
অলকা কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই আমার ফোন বেজে উঠলো। একটা আননোন নম্বর।
নাঈম আমার দিকে তাকালো। তারপর বললো,’ আমার কাছে দে।’
নাঈম ফোন নিয়ে রিসিভ করে ফোনে লাউড দিলো।ওপাশ থেকে কোন একটা পুরুষ কন্ঠ বললো,’ ভুল লোকের কাছে গিয়েছো তোমরা। শুধু শুধু একজন নিরপরাধ মানুষকে কষ্ট দিও না। বুদ্ধি থাকলে তোমার পুলিশ বন্ধুকে বলো আসল লোককে খুঁজে বের করতে।’
বলে ওপাশ থেকে হাসলো।
নাঈম বললো,’ তোকে আমি দুই দিনের মধ্যে অ্যারেস্ট করতে না পারলে আমি এই চাকরিই ছেড়ে দিবো। শপথ করলাম।’
বলে ফোন কেটে দিলো।
তারপর নাঈম খানিক সময় চুপচাপ বসে রইলো।
অলকা এবার একটু স্বস্তি পেলো। সে কেঁদে কেঁদে বললো,’ বলেছিলাম তো আমি কিছু জানি না।আমি এসবের কেউ না। আপনি বিশ্বাস করেননি আমায়!’
নাঈম বললো,’ অলকা, আপনার হাসব্যান্ডের কি নাম যেন?’
অলকা বললো,’ কেন? এবার তাকেও দোষী মনে হচ্ছে নাকি? আপনি শুধু পারেন নিরপরাধ লোকদের দোষারোপ করতে!’
নাঈম আবার ধমকে উঠলো।ধমক দিয়ে সে বললো,’ তুমি কি নিরপরাধ লোক অলকা? লজ্জা করে না তোমার নিজেকে নিরপরাধ বলতে? তুমি নিজেই তো স্বীকার করলে যে তুমি শানুর কানের দোল চুরি করেছো। সেই দোল আমার হাতেও দিলে একটু আগে। এখন আবার নিজেকে নিরপরাধ দাবি করছো।এ তো দেখি চোরের মায়ের বিরাট বড় গলা!’
অলকা এবার দমে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে।
নাঈম বললো,’ যা যা জিজ্ঞেস করবো এর সঠিক উত্তর দিবে তুমি।সত্য বলবা। মিথ্যে বললে তোমায় অনেক বড় শাস্তি পেতে হবে অলকা।’
অলকা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকালো।
নাঈম বললো,’ সিমটা পাওয়ার পর এভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেন তুমি?’
অলকা বললো,’ ভয়ে স্যার।’
নাঈম হাসলো।বললো,’ ভয় পাওয়া ভালো। কিন্তু মানুষকে ভয় পেয়ে কি লাভ বলো? ভয় পেতে হবে ঈশ্বরকে। ঈশ্বরকে ভয় পেলে কেউ কোন অপরাধ করতে পারে না। এই যে তুমি শানুর কানের দোল চুরি করলে। ঈশ্বরকে ভয় পেলে কিন্তু তুমি এই পাপ কখনোই করতে না!’
অলকার চেহারা কেমন মলিন হয়ে উঠলো।
আর ঠিক তখনই ঘরে বাচ্চা শিশুটা কেঁদে উঠলো।ঘুম থেকে উঠেছে হয়তো।
নাঈম বললো,’ এখনও প্রায়শ্চিত্যের সময় আছে। নিজের সন্তানের সুন্দর একটা ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও শুদ্ধ হয়ে উঠো। এই জীবনে একটা ভালো কাজ অন্তত তুমি করো। এই উসিলায় ঈশ্বর হয়তো তোমায় ক্ষমা করে দিবেন।’
অলকা কাঁদছিল। চোখের জল মুছে সে বাচ্চাটাকে কোলে করে নিয়ে এখানে এলো। তারপর বললো,’ কি কাজ করতে হবে আমায় বলুন।আমি করবো।’
নাঈম বললো,’ এই সিম গুলো তোমার না তাই না?’
অলকা বললো,’ জ্বি না।’
‘কার এইগুলো?’
অলকা বললো,’ আমার স্বামীর। আমার ন্যাশনাল আইডি কার্ড দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছে এইগুলো সে।’
নাঈম বললো,’ গতকাল রাতেও সে ড্রয়ার খুলে সিম নিয়েছিল। খানিক পর আবার এসে সেই সিম রেখে গেছে তাই তো?’
অলকা লম্বা সময় ধরে চুপ করে রইলো।তারপর বললো,’ হুম।’
‘সে কি কাজ করে?’
অলকা বললো,’ সিএনজি আছে কয়েকটা।ভাড়া দেয়।আর মাঝেমধ্যে নিজেও চালায়।’
নাঈম বললো,’কিন্তু এর আড়ালে তোমার স্বামী যা করে তা সম্ভবত তুমি জানো না অলকা। সিএনজি টা চালায় মুখোশ হিসেবে। মুখোশের আড়ালে তোমার স্বামী ভীষণ খারাপ লোক। খারাপ জগতের লোক। তাকে বাঁচাও।নিজেও বাঁচো।সন্তানটাকেও বাঁচাও।’
অলকা উদগ্রীব হয়ে উঠলো। সে বোধহয় অনুশোচনা করছে।অথবা তার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব ভাবছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,’ আমায় কি করতে হবে তা বলুন।আমি করবো।সত্যি করবো।’
কথাটা বলে আঁচলে চোখ মুছলো অলকা।
নাঈম বললো,’ তোমার স্বামীকে ধরিয়ে দিতে হবে।আমি জানি তুমি এটা পারবে।’

(চলবে)…
#গোপনে