গোপনে পর্ব-১০

0
497

#গল্পঃ_গোপনে |১০|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক

জেবাকে বাসায় পাওয়া গেল না। তার মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলে তার মা বললেন, তিনি জানেন না জেবা কোথায় আছে।
নাঈম জিজ্ঞেস করলো,’ সে বাসায় আসে না?’
জেবার মা বললো,’ আসে না।’
নাঈম ঘরের ভেতরটায় চোখ বুলিয়ে দেখলো। টেবিলের উপর ওষুধের প্যাকেট। ওষুধের মেমো।এসবে সে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।
তারপর বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে সে বললো,’ শিহাব, জেবার মা মিথ্যে বলেছে।’
আমি বললাম,’ কোন কথাটা মিথ্যে বলেছে?’
নাঈম বললো,’ ওই যে বললো, জেবা বাসায় আসে না।’
আমি বললাম,’ সম্ভবত এটা মিথ্যে না রে! জেবা তো আটক। আমার পুরো বিশ্বাস আশফাক সুমন এসবের মূল। এই লোকটা সবচেয়ে বড় ক্রিমিনাল।ওর কাছেই জেবা, শানু বন্দী। সেদিনের ছবিটা দেখলি না তুই? আমার হোয়াটসঅ্যাপে যে পাঠালো।’
নাঈম হাসলো। হেসে বললো,’ তুই একটা ছাগল। মারাত্মক লেভেলের ছাগল। তুই ছাগল বলেই তোর বউ গোপনে এতো সব করেছে। তোর ঘরে পুরুষ লোক এনেছে। সেই লোকের সঙ্গে যা ইচ্ছে তাই করেছে। তোর বউ বাইরে যেখানে ইচ্ছে সেখানে গিয়েছে। আরেকটা শহরে গিয়ে জমি কিনেছে। বাসা করছে। তুই এসবের কিচ্ছু জানতে পারিস নি।টের পাসনি একটিবার! তুই ছাগল না তো ছাগল কে? ‘
আমি কোন কথা বললাম না। লজ্জা এবং একটা শীতল কষ্ট আমার বুকে বয়ে গেল।মনে মনে আমি বললাম, আমি ছাগল না নাঈম।আমি সহজ সরল একটা মানুষ।আমি আমার স্ত্রীকে বিশ্বাস করতাম। বিশ্বাস করাটা দোষের কিছু না। বিশ্বাস না থাকলে সংসার হয় না। বিশ্বাসের আড়ালে যদি কেউ গোপন কিছু করে। সেই বিশ্বাস ভাঙে। তবে এই দোষ তো তার! আমার না!
মনে মনে কথাগুলো বললেও নাঈমকে সরাসরি এসব বললাম না। সব কথা বলতে হয় না।নাঈম এখনও সংসার করেনি। কাউকে ভালোবাসেনি। সংসার হলে, ভালোবাসা হলে তখন আপনা থেকেই সব বুঝে নিবে না হয়!
আমায় চুপ করে থাকতে দেখে নাঈম আবার কথাটা তুললো। বললো,’ জেবাকে আজ যেভাবেই হোক আমি ধরবোই।একশো পার্সেন্ট গ্যারেন্টি! ‘
আমি অবাক হলাম। বললাম,’ কিভাবে ধরবি?’
নাঈম বললো,’ তোরে সাথে রেখে রেখে আমার চিকন বুদ্ধি সুদ্ধি সব তো তোকে শিখিয়ে ফেলতেছি রে! তুই আমার পাশে থাক। কিছু বলতে হবে না। এমনিতেই দেখতে পারবি কিভাবে জেবাকে ধরি।’
নাঈম আমায় নিয়ে থানায় গেল। গিয়ে অসীমকে ছেড়ে দিলো। তারপর থানায় গাড়ি রেখে একটা রিক্সা নিলো।রিক্সা ওয়ালাকে জেবাদের এলাকার ঠিকানা বললো।বললো, ওখানে নিয়ে যাও মামা!
আমি অবাক হয়ে বললাম,’ আবার ওখানে কেন? তাছাড়া এখন সন্ধ্যা হয়েছে। মাত্রই তো ওখান থেকে এলাম। আবার যাচ্ছি কেন? তাছাড়া গাড়ি রেখে রিক্সা দিয়েই বা কেন?’
নাঈম আমার মাথায় কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে হাসলো। তারপর বললো,’ গাড়ি করে আগে এসেছিলাম। এরপর আবার থানায় চলে এলাম।জেবা সব খবরাখবর রাখছে। সে দূরে কোথাও নেই।আশে পাশেই আছে।ক্যান্সারে আক্রান্ত মাকে রেখে দূরে কোথাও সে যাবে না। তাছাড়া আমি টেবিলের উপর ওষুধ পত্র কেন ঘাঁটাঘাঁটি করলাম দেখিসনি? ওখানে একটা মেমো ছিল ।মেমোতে গত রাতের তারিখ লিখা। তাছাড়া মেমোতে আর কারোর নাম না।জেবার নিজের নাম।এর মানে সবকিছু পরিষ্কার না? জেবা গতরাতেও ওষুধ কিনে বাসায় এসেছিল। আজকেও আসবে। রেগুলার আসবে। মাকে বাঁচাতে যে মেয়ে ওরকম ভয়ংকর একটা পথে পা দিতে পারে, সে মার কাছে না এসে কিভাবে পারবে? মায়ের জন্যই তার এসব করা।’
আমি নাঈমের এসব ভার বিদ্যে কথা বুঝি না।চুপ করে থাকি।

রিক্সা গিয়ে থামে জেবাদের বাসা থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে। ওখানে দুটো বড় শিরিষ গাছ।গাছের নিচে চায়ের দোকান।রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে আমরা বসি ওখানে।
ততোক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। কার্তিক মাসের শেষ সময়।আস্তে আস্তে শীত পড়তে শুরু করেছে। সন্ধ্যার পর পরই সবকিছু অন্ধকার হতে শুরু করে।কুয়াশাও পড়ে। তবুও এখান থেকেই জেবাদের বাসার গেটটা পরিষ্কার দেখা যায়। গেটে বাতি আছে। হয়তো এজন্যই।

আমরা আধ ঘন্টার মতো বসে রইলাম। কোন খোঁজ খবর নাই। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,’ ও আসবে না নাঈম। শুধু শুধু বসে আছি আমরা।’
এরিমধ্যে নাঈম বললো,’ এই দেখ। ওদিকে তাকিয়ে দেখ। বোরখা পরে কেউ একজন ভেতরে ঢুকছে!’
আমি তাকালাম।জেবা এটা।যদিও জেবাকে কোনদিন বোরখা পরতে দেখিনি।বিপদ থেকে বাঁচতে হয়তো বোরখা ধরেছে। কিন্তু দূর থেকেও তার উচ্চতার জন্য তাকে আমি স্পষ্ট চিনতে পারছি।
আমি বললাম,’ জেবা।এটা জেবা।’
নাঈম মুচকি হাসলো। তারপর বললো,’ চল।’
আমরা দোকান থেকে উঠে সরাসরি চলে গেলাম জেবাদের বাসায়।
অদ্ভুত বিষয় হলো বাসায় গিয়ে দেখি জেবার মা ছাড়া কেউই নাই বাসায়। নাঈম জিজ্ঞেস করলো,’ জেবা কোথায়?’
জেবার মা বললো,’ আমি কিভাবে বলবো বাবা? এর আগেও তোমরা আসছিলা! আমি বলেছি জানি না সে কোথায়।আমি অসুস্থ মানুষ। কেন বার বার এসে আমায় বিরক্ত করছো তোমরা?’
নাঈম বললো,’ খালা, আপনি আমায় চেনেন নি তাই বোকা বানাতে চাচ্ছেন! আমায় চিনতে পারলে আমার সঙ্গে কথা বলার আগে গায়ে কাঁপুনি দিতো আপনার!’
হাসলো নাঈম।
জেবার মা বললো,’ কে তুমি? কে? তোমার পরিচয় কি?’
নাঈম বললো,’ আমি একজন দারোগা।জেবা যেহেতু নাই তাইলে আপনারেই ধরে নিয়ে যাই থানায় কি বলেন খালা? ‘
বলে সে প্যান্টের পকেট থেকে পি*স্তল বের করলো।আমি অনেক বার দেখেছি। সাধারণ মানুষেরা এই পি*স্তল দেখলেই ভয়ে হড়বড় করে সব বলতে শুরু করে।জেবার মা কিছু বললো না। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো।
অদ্ভুত বিষয় হলো তখন হুট করেই বাথরুমের দরজা খুলে জেবা বেরিয়ে এলো।এসে রাগের গলায় বললো,’ আপনি মানুষ? কোন মানুষের আচরণ এরকম হতে পারে? একজন অসুস্থ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী।যে নাকি জীবন মরণের মাঝখানে কাতরাচ্ছে। আপনি এসে তাকে হুমকি ধামকি দিচ্ছেন। ধরে নিয়ে যাবার ভয় দেখাচ্ছেন।’
নাঈম বললো,’ এই জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। কিন্তু এটা করেছি আমি প্লান করেই। আপনার মায়ের সঙ্গে এমন কর্কশ আচরণ না করলে আপনি কিছুতেই বেরিয়ে আসতেন না। সহজে ধরা দিতেন না!’
জেবা কিছু বললো না। চুপ করে রইলো।
নাঈম বললো,’ আপনি আমার সঙ্গে চলুন।’
জেবা বললো,’ কোথায়?’
নাঈম বললো,’ থানায়। আপনাকে আমি অ্যারেস্ট দেখাচ্ছি।’

থানায় আসতে আধ ঘন্টা সময় লাগলো।আসার পর নাঈম জেবাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,’ শানু কোথায়? ‘
জেবা শব্দ করে হাসলো। বললো,’ শানু কি আমার আপন বোন নাকি আমার রক্তের কেউ? ‘
নাঈম বললো,’ তা তো আমি বলিনি।’
জেবা বললো,’ তাহলে তার খবর আমি কিভাবে জানবো?’
নাঈম হাসলো। বললো,’ তাহলে আপনার সঙ্গে জেবার কোন ধরনের সম্পর্ক নাই বলছেন?’
জেবা বললো,’ না নাই। তাকে আমি চিনিই না।’
নাঈম বললো,’ এটা একেবারে মাত্রাতিরিক্ত মিথ্যে বলা হয়ে গেল না জেবা? ‘
বলে নাঈম আমার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ওই ছবিটা বের করে ওর সামনে ধরলো। তারপর বললো,’ শানুকে চেনেন না কিন্তু তার সঙ্গে এক রকমের ড্রেস পরে হাতে ম*দের বোতল নিয়ে বড়লোক পুরুষদের সঙ্গে নাচানাচি ঠিকই করেন তাই না? ‘
জেবা ছবিটা দেখে মুখ বিকৃত করে ফেললো একেবারে। তারপর বললো,’ এটা আমার ছবি না।’
নাঈম বললো,’ তাহলে কার ছবি এটা? ‘
জেবা বললো,’ এটা ইডিট করা।দেখেই বোঝা যায়।’
নাঈম বললো,’ ও আচ্ছা। তাহলে আপনার ফোনটা দিন তো।’
জেবা বললো,’ ওটা আমার পার্সোনাল জিনিস।আমি আপনাকে দিবো কেন?’
নাঈম ধমকে উঠলো।এতো জোরে ধমক দিলো যে জেবা ভয়ে কেঁপে উঠলো। তারপর বললো,’ এটা আপনার ঘর না জেবা।এটা থানা। আপনাকে মেহমানদারি করতে এখানে নিয়ে আসা হয় নাই। ফোন দেন বলছি।’
জেবা তার ফোন তবুও দিতে চায় না। ফোন হাতে ছিল। তাড়াহুড়ো করে হাত থেকে ফোন কাপড়ের ভেতর দিয়ে বুকে চালান করে দিলো।
নাঈম মুচকি হাসলো। তারপর দুজন মহিলা পুলিশকে ডাকলো। মহিলা পুলিশ দুজন এলে বললো, ওর কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিতে । মজার বিষয় হলো জেবা মহিলা পুলিশ দুজনের সঙ্গে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিয়েছে। কিছুতেই ফোন সে দিবে না। কিন্তু পুলিশদের সঙ্গে জোরাজুরি করে কি সে পারবে?
ফোন তারা কেড়ে নিয়ে নাঈমের হাতে দিতেই জেবা দু হাত জোড় করে বললো,’ আপনি এর ভেতরে ঢুকবেন না প্লিজ! এখানে আমার সিক্রেট অনেক কিছু আছে। আপনি কি জানতে চান বলুন।যা যা জানতে চান আমি সব বলবো। এমনকি শানু কোথায় আছে তাও বলবো। তবুও ফোনে ঢুকবেন না প্লিজ!’
জেবা একেবারে কেঁদে ফেললো।

(চলবে)..