#গল্পঃ_গোপনে |১২|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক
—
আমি বড় অবাক হলাম। তবে যে হাসান নিজেই তার বোনের বিরুদ্ধে কতো সব কথা বললো সেসব কেন বললো? কেন নানান তথ্য দিলো তার বোনের বিষয়ে? নাকি এসব এমনি এমনি? আমায় বোকা বানাতে?
কি জানি!
নাঈম জেবার কাছে জিজ্ঞেস করলো।বললো,’ ওখানে গেলেই পাওয়া যাবে শানুকে?’
জেবা বললো,’ পাওয়া যাবে।’
নাঈম বললো,’ আমায় ধোঁকা দিলে এর পরিণাম কিন্তু খারাপ হবে জেবা! ভেবেচিন্তে সত্যিটা বলুন আপনি।’
জেবা বললো,’ আমি যা জানি তাই বলেছি। আপনার বিশ্বাস না হলে আমার কিছুই করার নাই। এছাড়া আপাতত আমি আমার কি হবে না হবে এসব নিয়ে কিছুই ভাবছি না।যে ভুল আমি করেছি।যে পাপ আমি করেছি। নিজের শরীর যেভাবে আমি অপবিত্র করেছি।এর শাস্তি আমায় ফাঁ*সি দিলেও যথোপযুক্ত হবে না।আমি মিথ্যে বলছি না আপনাকে। আমি জানি সে ওখানেই থাকে। তার সঙ্গে ওখানে আমি দুইদিন থেকেছিও।’
নাঈম বললো,’ শিহাব বললো, ওখানে একটা বাসা তৈরি করছে শানু।ওই বাসার একটা ঘরে নাচ গান করার নানান সরঞ্জাম। আপনি ওই ঘরে গিয়েছিলেন কি?’
জেবা বললো,’ হ্যা। শানুর অল্প বয়সী কোন ক্লায়েন্ট নাই।সব মাঝবয়সী। বৃদ্ধও আছে। ওদের টাকা পয়সার কোন অভাব নাই। ওদের একেকজন একেক রাতে ওই ঘরে আসে।টাকা দিয়ে একেকজন পুরো এক রাতের জন্য সেই ঘর, মেয়েদের, এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক যা আছে সব ভাড়া করে।যে লোক ভাড়া করে তাকে পুরনো দিনের জমিদারদের মতো করে রাজকীয় পোষাকে সাজানো হয়। তারপর রাজ আসনে বসে সে।আর দুজন তিনজন বা টাকা পে করার পরিমাণ অনুযায়ী অধিক সংখ্যক মেয়ে আগেকার দিনের রাজার রঙমহলের নাচনেওয়ালিদের মতো সব বসন পরে ওই লোকের মনোরঞ্জন করে।’
শুনে আমি চমকালাম। এরকমও বুঝি হতে পারে!
নাঈম বললো,’ ওখানে নাকি ম*দের বোতল টোতলও দেখেছে শিহাব। তাহলে সবাই মদ্যপানও করে?’
জেবা বললো,’ হ্যা করে। আসলে ওখানে যেসব মেয়েরা যায় তাদের বেশিরভাগই বিপদে পড়ে যায়। আমাকেই দেখুন না, আমার তো সারা জীবন মদের নাম শুনলেও ঘেন্না করেছে। আমার স্বামী সিগারেট খেতো।এটা আমার অপছন্দের ছিল।জোর করে তাকে সিগারেট খাওয়া ছাড়িয়ে ছিলাম আমি। কিন্তু শানুর বাসায় গিয়ে এই আমিই মদ, সিগারেট সব খেয়েছি। এছাড়া আমার স্পষ্ট মনে আছে একবার বাসের ভেতর একটা ছেলে আমার গায়ে হাত রেখেছিল। সঙ্গে সঙ্গে আমি ওর গালে একটা চ*ড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। সেই আমিই কিন্তু শানুর ওখানে গিয়ে অনেক পুরুষকেই নিজের শরীর ভোগ করতে দিয়েছি। অন্য সব মেয়েরাও হয়তো আমার মতোই।কেউ ওখানে শখ থেকে যায়নি। আমার বিশ্বাস।সবাই আমার মতোই বিপদে পড়েই গিয়েছে।’
নাঈম আর কথা বললো না।সেল থেকে বেরিয়ে এলো।
‘
জেবার কাছ থেকে এসে নাঈম আমায় বললো,’ চল যাই।’
আমি বললাম,’ কোথায়?’
নাঈম বললো,’ কোথায় আবার! শানুকে ধরতে।’
আমি বললাম,’ আমি পারবো না যেতে। আমার সহ্য হবে না।ওর সম্মুখীন আমি হতে চাই না ভাই!’
নাঈম বললো,’ তোকে যেতে হবে।আমি ওখানকার কিছুই চিনি না। তুই চিনিস। তাছাড়া আমরা যাবো একেবারে সিভিল বেশে।কেউ যেন কোন ভাবেই ঠাহর করতে না পারে।কেউ যেন না চিনে আমাদের।’
আমি মনের বিরুদ্ধে গিয়েই রাজি হলাম যাওয়ার জন্য।
ওখানে যাবার আগে নাঈমকে বললাম,’ নাঈম, একবার বাসায় যাবো। মায়ের কাছে যাবো। মায়ের বড় অযত্ন হচ্ছে।মা কি অবস্থায় আছে এখন কে জানে!’
নাঈম বললো,’ যা।তোর সঙ্গে একজন কনস্টেবল যাবে। তোকে এই সময়ে একা যেতে দেয়াও বিপদ। ওরা যদি লোক দিয়ে তোর ক্ষতি করায়!’
আমি বললাম,’ কিছু হবে না। কনস্টেবল দিয়ে দে সঙ্গে একজন।’
নাঈম কনস্টেবল দিয়ে দিলো একজন। উনি গাড়ি করে বাসায় দিয়ে গেলেন আমায়। আমি বাসায় আসার পর মা অস্থির হয়ে বললেন,’ কোথায় থাকিস সারাটা দিন? আমার মন ছটফট করে শুধু। ওদিকে শানুটা কোথায় যে চলে গেল। তোদের মধ্যে কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে বল তো? ও এখন কোথায় আছে? কার কাছে আছে কিছু জানিস?’
মা এখনও শানুর সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাকে মিথ্যে বলা হয়েছে।বলা হয়েছে, শানুর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে।তাই সে রাগে কোথায় যেন চলে গেছে।আসল বিষয়টা জানলে মায়ের শরীর আবার খারাপ করবে বলে তা জানানো হয়নি। এমনকি পুলিশ দুজন যে বাসায় পাহারায় ছিল আগে।তাদেরকেও এখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। মায়ের জন্যই
সরিয়ে নেয়া হয়েছে।মা বার বার জিজ্ঞেস করেন, এখানে পুলিশ কেন? খু*ন টুন হয়েছে নাকি। শুধু শুধু এসব জপাজপি করে। তাছাড়া অলকা আর অসীম যেহেতু এসবের সঙ্গে যুক্ত না। তাহলে তো আর ভয়ের কিছু নাই। এখানে পুলিশ থাকার প্রয়োজনও নাই।
‘
অনেক দিন বারান্দায় দাঁড়ানো হয় না।ঘর থেকে বেরিয়ে একটু বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।আর তখনই দেখলাম অলকাদের দরজায় মস্ত একটা তালা লাগানো।
ঘরে ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ ওরা কোথায় মা? ওদের দরজায় তালা লাগানো কেন?’
মা বললেন,’ ওরা তো নাই দুদিন ধরেই। মালিক বললো, ওরা বাসা ছেড়ে দিয়েছে।’
আমি ভীষণ রকম অবাক হলাম। মাসের মাঝখানে হঠাৎ করে বাসা ছেড়ে দিলো কেন ওরা? সমস্যা কি?
আমার কেমন জানি খটকা লাগছে। কেন খটকা লাগছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
মাকে বললাম, ‘ ওরা চলে যাবার সময় তোমায় বলে যায়নি? অলকা ভাবী তোমার কাছে আসেনি?’
মা বললেন,’ মালিক না বললে তো জানতেই পারতাম না যে ওরা বাসা ছেড়ে দিয়েছে।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে নিচ তলায় গেলাম। বাসার মালিকের অফিস ঘর আছে নিচে। ওখানে বসে তিনি তার ব্যবসা বাণিজ্যের কারবার করেন। তার যে ইটের ভাটা আছে আর চালের পাইকারি ব্যবসা আছে। এখানে বসে থেকেই তিনি সেসব নিয়ন্ত্রন করেন।
মালিকের অফিসে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,’ অসীমরা নাকি বাসা ছেড়ে দিলো?’
মালিক বললো,’ হ্যা। ছেড়ে দিছে।’
আমি বললাম,’ হঠাৎ করে বাসা ছাড়লো কেন? কোন সমস্যা নাকি?’
মালিক বললো,’ কি জানি! শুনলাম, তার সব কয়টা সিএনজিও বিক্রি করে দিছে। সম্ভবত শহর ছেড়ে দিছে।’
আমি বললাম,’ এর বেশি কিছু জানেন না?’
মালিক বিরক্তি নিয়ে বললো,’ আমার অতো কিছু জানবার সময় আছে বাবা? আমার এখানকার নিয়ম হলো বাসা ছাড়ার দু মাস আগে বলতে হবে আমায়।ওরা বলেনি। কিন্তু সামনের দু মাসের ভাড়ার টাকা অগ্রীম পরিশোধ করে গেছে।ওই এক কথায় তো হলো। তাহলে আর ওদের ঘাঁটাঘাঁটি করার দরকার কি? আমি ব্যবসায়ী মানুষ। আমার কাজ ব্যবসা করা। কারোর পারিবারিক ইতিহাস জানা তো আমার কাজ না রে বাবা! ‘
আমি আর কথা বাড়ালাম না। মনে মনে মালিককে বললাম,ফকিরের বাচ্চা!
‘
ঘরে এসে নাঈমকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম। বললাম সবকিছু।নাঈম শুনে বললো,’ আরে বেটা ওরা ভয়ে পালিয়েছে। সেদিন দেখলি না অসীমের কান্ড। ভয়ে হিসু করে দিলো বেটা!’
হা হা করে হাসলো নাঈম। হাসি আমারও পেলো। হাসলাম আমিও।
‘
সন্ধ্যা সময় আমরা নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।নাঈম সঙ্গে করে পি*স্তল নিয়েছে। বিপদে পড়লে কাজে লাগাবে এটা।এসব কাজে খুব ঝুঁকি। জীবন মরণ থাকে হাতের মুঠোয় ।সে খুব গোপনে এসব কাজ করছে। এভাবে অন্য জেলায় গিয়ে ওখানকার থানায় না জানিয়ে এসব করা আইনত নিষিদ্ধ।ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া বিষয়টা ওখানকার ওসি বা দারোগা পছন্দ করবে না। কিন্তু নাঈম এসব বিষয়ে খুব সতর্ক। সে কাউকে বিশ্বাস করে না সহজে। এইসব কাজে পুলিশদের সাহায্য থাকে। ওখানকার পুলিশেরা যে শানুকে সাহায্য করে না এর গ্যারেন্টি কে দিবে!
তাই নাঈম নিজের মতো করে খুব গোপনে এটা শেষ করতে চায়। ও খুব জেদিও।আমি জানি এটা শেষ না করে সে কান্ত হবে না কিছুতেই।
‘
হাসানদের বাড়ি যেতে যেতে মধ্যরাত হয়ে এলো। খুব সাবধানে ওদের বাড়ির পেছন পর্যন্ত এলাম আমরা।পেছন দিকের ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে আসতে হয়েছে।যেন কেউ টের না পায় তাই এই কাজ করতে হয়েছে।
কিন্তু ওদের বাড়ি এসে চমকে গেলাম আমরা। বাড়ির সবকটা দরজাতেই বড় বড় তালা ঝুলিয়ে রাখা। বাইরের বৈদ্যুতিক লাইট গুলোও অফ করে রাখা।দেখেই বোঝা যায় এই বাড়িতে কোনো মানুষ নেই।
আমি বললাম,’ নাঈম, ওরা কি কোন ভাবে টের পেয়ে গেল নাকি?’
নাঈম আমার কথার কোন উত্তর দিলো না। সে
সবকটা দরজার কাছে গেল।কান পেতে ভেতরে কেউ আছে কি না তা বোঝার চেষ্টা করলো। শেষমেষ দরজায় নক করে দেখলো কেউ আছে কি না!
কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
নাঈম হতাশ হয়ে বারান্দার মাটিতে বসে পড়লো দপ করে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললো,’ ডেনজারাস! ‘
আমি বললাম,’ ডেনজারাস মানে?’
নাঈম বললো,’ শানু। শানুর কথা বলছি।আমি ভেবেছিলাম ওকে খুব সহজেই ধরে ফেলা যাবে। কিন্তু ও দেখি আমাদের চিন্তা ভাবনার চেয়েও বেশি চতুর।বেশি সতর্ক! ওকে ধরাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে! ‘
আমি কোন কথা বললাম না। চুপচাপ বসে রইলাম।
নাঈম বললো,’ একটা মফস্বলে বেড়ে ওঠা মেয়ে, যে ছিল খুবই সাদামাটা। সে কিভাবে এরকম ক্রিমিনাল হয়ে গেল।এটা ভাবতেও পারছি না আমি।’
আমি বললাম,’ এতো গুলো দিন একসঙ্গে সংসার করলাম। তবুও ওকে চিনতে পারলাম না আমি! ও তো সব সময়ই সহজ সরল ছিল।’
নাঈম বললো,’ এই জন্যই বললাম ডেনজারাস।শানু মুখোশ পরা শয়তান। এরা ভয়াবহ রকমের হয়। এদের চেনা অতো সহজ না!’
নাঈমের সঙ্গে এসব নিয়েই গল্প করতে করতে ডাটা অন করলাম ফোনের।আর তখন ওই যে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ছবি পাঠিয়েছিল যে নম্বরে ওই নম্বর থেকে আরেকটা মেসেজ এলো।লিখলো –
শিহাব, তোমার বন্ধু নাঈমকে বলো, সে আরো সাতবার জন্ম নিলেও আমায় খুঁজে বের করতে পারবে না কোনদিন। শুধু শুধু ব্যর্থ চেষ্টা করা বন্ধ করতে বলো তাকে।আর তুমিও ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। মায়ের কাছে থাকো গিয়ে। আরেকটা চাকরি জুটিয়ে নাও। এসব খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো গিয়ে।
লিখে নিচে একটা হাসির ইমুজি দিলো।ওই যে আগে যেরকম দিয়েছিল ঠিক ওরকমই।
আমি সঙ্গে সঙ্গে মেসেজটা নাঈমকে দেখালাম। এই মেসেজ দেখার পর সঙ্গে সঙ্গে নাঈমের গায়ে আগুন ধরে গেল। সে বললো,’ আমি যদি শানুকে ধরতে না পারি তবে খোদার কসম পুলিশের চাকরি টা ছেড়ে দিয়ে রিকশা চালাবো আমি।শপথ করলাম! ‘
(চলবে)…