#গল্পঃ_গোপনে |১৩|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক
—
নাঈম খানিক সময় চুপচাপ বসে থেকে ভাবলো। তারপর হঠাৎ করেই সে বললো,’ ওই বাসাটায় চল।শানু যে বাসাটা তৈরি করছে ওখানে।’
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
আমরা হেঁটে হেঁটেই ওখানে গেলাম। গিয়ে দেখি ওখানেও একই অবস্থা।গেট শুদ্ধ লক করা। বাড়ির নির্মাণ কাজ ইস্তফা দিয়ে রেখেছে।
কারণটা কি? ওরা কোথায় গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল?
সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি?
নাঈম তার চেষ্টা ছাড়লো না।ক্লান্তি তাকে কখনোই কাবু করতে পারে না। তার সারা জীবন আগ্রহ ছিল চোর পুলিশ খেলার। শৈশবে সে মিছে মিছির চোর পুলিশ খেলতো। এখন বাস্তবে খেলছে। তাই সে এইসব ক্লান্তিকেও তাই আনন্দ হিসেবেই নেয়।
নাঈম বললো,’ হাসানের নম্বর আছে না তোর কাছে?’
আমি বললাম,’ আছে। কল দিবো নাকি?’
নাঈম বললো,’ নাহ। কল দিতে হবে না।কল দিলে বোঝে ফেলবে।ওর নম্বরটা আমি ট্র্যাক করবো।’
নাঈম সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলো কোথায় যেন। ফোন করে হাসানের নম্বরটা বললো। তারপর ওই লোককে বললো, নম্বরটা একজেক্ট কোথায় আছে মানে লোকেশন টা তাকে মুহুর্তের মধ্যে জানাতে।
এরপর নাঈম একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেট টেনে টেনে সে পাগলের মতো ধুয়ো ছাড়ছে। কিছুক্ষণ পরেই নাঈমের নম্বরে কল এলো।নাঈম রিসিভ করে কথা বললো। তারপর আধ খাওয়া সিগারেট টা দূরে ছুঁড়ে ফেলে গলায় প্রবল উত্তেজনা নিয়ে সে বললো,’ গৌরিপুর। গৌরিপুর আছে হাসান। আচ্ছা গৌরিপুর ওদের কোন আত্মীয় আছে রে? তুই জানিস কিছু?’
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম,’ জানি। শানুর খালার বাড়ি ওখানে। শানুর সঙ্গে একবার গিয়েছিলাম আমি।’
নাঈম বললো,’ চল। ওখানেই যাচ্ছি আমরা।’
আমি কিছুই বললাম না।এর আধ ঘন্টা পর ঢাকাগামী একটা ট্রেন যাবে নেত্রকোনা থেকে।নাঈম বললো, এই ট্রেনে করেই আমরা যাবো। গৌরীপুরে নেমে পড়বো। তারপর সোজা শানুর খালার বাসায়।’
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
‘
সকাল হবার আগেই আমরা গৌরিপুর পৌঁছে গেলাম। তারপর সোজা চলে গেলাম শানুর খালার বাসায়। গিয়ে দেখি ওখানে কান্নাকাটি।বাড়ি ভর্তি মানুষ। শানুর খালু মারা গিয়েছেন।
আমরা আড়ালে খানিক সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। এরমধ্যে শানুকে হঠাৎ করেই দেখা গেল। তার হাতে ফোন। কেউ কল দিয়েছে হয়তো। ফোন রিসিভ করে সে মানুষের কোলাহল থেকে একটু নির্জনের দিকে এসেছে কথা বলতে।কথা বলছেও হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে।আর ঠিক তখনই নাঈম গিয়ে ওর পিঠ বরাবর পি*স্তলটা ধরলো পেছন থেকে। ভয়ে কেঁপে উঠলো শানু। চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেল। হয়তো ভয়ে গলা থেকে কোন আওয়াজ নামেনি। নাঈম ফিসফিস করে তাকে বললো,’ কোন রকম সাড়া শব্দ না করে চলুন। একটুও যদি সাউন্ড করেন তবে গু*লি করবো আমি।’
শানু কিছুই করলো না। চুপচাপ হাঁটতে লাগলো আমাদের সঙ্গে।
নাঈম বললো,’ আপনার ফোনটা দিন আমার কাছে।’
শানু জেবার মতো ফোন না দেয়ার কোন চেষ্টাই করলো না। সে সঙ্গে ফোন দিয়ে দিলো নাঈমের কাছে।
‘
শানুকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে গেল।নাঈম কোন রকম বিশ্রাম নিলো না। সে শানুকে জেরা করার জন্য সামনে নিয়ে বসলো। তারপর বললো,’ খুব তো লাফালাফি করলেন আপনি। গতরাতে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়ে বললেন, আমি আরো দশবার জন্ম নিলেও তোমায় ধরতে পারবো না।অতো বড় বড় কথা। এখন কোথায় গেল এসব কথা? ধরে তো ফেললাম আপনাকে!’
নাঈম হাসলো।
শানু কোন কথাই বললো না।
নাঈম বললো,’ এখন কোন কথা বলছেন না কেন? কথা বলুন। বলুন, কতো জন মেয়ের সর্বনাশ আপনি করিয়েছেন?’
শানু এবারও কোন কথা বললো না।
নাঈম বললো,’ শানু, আপনাকে অনেক সম্মান করতাম আমি।আর এই আপনিই কি না! ছিঃ ছিঃ! ‘
শানু তখনও চুপ। সে সম্ভবত পণ করেছে কোন কথা বলবে না।চুপ করে থাকবে। কিন্তু সে চুপ করে থাকলে তো হবে না।
নাঈম বললো,’ মুখ খুলুন। বলুন, কতোজন মেয়ের ক্ষতি আপনি করেছেন? কেন করেছেন এসব? ‘
শানু এবার কথা বললো। বললো,’ আমি কোন মেয়ের ক্ষতিই করিনি।আমি আমার নিজের ক্ষতি করেছি।আর কারোর না।’
নাঈম হাসলো। বললো,’ সবার কথা বাদ দিলাম।জেবার কথাই বলি শুধু। জেবাকে দিয়ে এসব কে করিয়েছে?’
শানু বললো,’ তা আমার কাছে জিজ্ঞেস করছেন কেন? জেবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। তার বিষয়ে আমি কিভাবে বলবো? ‘
নাঈম বললো,’ জেবা আপনার নাম বলেছে।বলেছে, আপনি তাকে দিয়ে এসব করিয়েছেন।’
শানু এবার বললো,’ জেবা বললেই কেন আপনি তার কথা বিশ্বাস করবেন? এখন আমি যদি বলি জেবা আমায় দিয়ে জোর করে এসব করিয়েছে।জেবা আমায় এই লাইনে নিয়েছে। তখন কি হবে? ‘
নাঈম কথা বললো না সঙ্গে সঙ্গেই। সে কি যেন চুপচাপ ভাবলো। তারপর বললো,’ আচ্ছা মেনে নিলাম আপনি জেবা কিংবা কারোর জীবন নষ্ট করেননি। নিজের জীবন নিজেই নষ্ট করেছেন। কিন্তু কার জন্য জীবন নষ্ট করেছেন? কে নিয়েছে আপনাকে এই পথে?’
শানুর মনে বিন্দুমাত্র ভয়ডর নাই। এবং এই শানুকে এর আগে কখনো যেন আমি দেখিনি। সে খুব সাবলীল ভাবেই কথা বলে যাচ্ছে। সে বললো,’ আপনি আমায় এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? কিংবা আপনি আমায় এখানে ধরেই বা আনলেন কেন? আমার অপরাধ কি? আমি কি কাউকে খু*ন করেছি? নাকি কারোর সহায় সম্বল চুরি করে নিয়ে পালিয়েছি?’
নাঈমের চোখে মুখে তাকানো যাচ্ছে না। সে রাগে কটমট করছে।চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে তার। এছাড়া শানুকে ধরতে কম পরিশ্রম করেনি সে! গতরাত থেকে এখন পর্যন্ত একটুও বিশ্রাম নেয়নি সে।
নাঈম এবার বললো,’ এসব করে পাড় পাবেন শানু? আপনি কাউকে খু*ন করেননি তা আমি জানি। কিন্তু খু*ন যে শুধু অপরাধ তা তো না। অসহায় মেয়েদের টার্গেট করে তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের অসৎ পথে নিয়ে যাওয়া কি অপরাধ না? তারপর ক্লায়েন্টদের ভিডিও রেখে তাদের ব্লা*কমেইল করে করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা তাও কি অপরাধের মধ্যে পড়ে না? ‘
শানু বললো,’ আপনি এসব আমায় বলছেন কেন? আপনার কথাতে তো স্পষ্ট বোঝা যায় আপনি আমায় সরাসরি এসবের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে ফেলেছেন। কিন্তু আমি তো এসবের কিছুই করিনি।’
নাঈম বললো,’ আপনি করেননি তো করেছে কে? শিহাবের হোয়াটসঅ্যাপে যে আপনার আর জেবার ছবি একসঙ্গে পাঠালেন এখন কি বলবেন এটাও আপনি পাঠাননি? আর গতরাতে যে হোয়াটসঅ্যাপে ওই নম্বর থেকেই আবার মেসেজ দিয়ে বললেন, আপনাকে খোঁজাখুঁজি করে লাভ হবে না। আমি দশবার জন্ম নিলেও আপনাকে খুঁজে পাবো না। আপনি যদি এসবের মূল হোতা না হয়ে থাকেন তবে আপনি হোয়াটসঅ্যাপে এসব পাঠালেন কেন? ‘
শানু অবাক হবার মতো করে চেহারা করে বললো,’ আপনি আমার উপর মিথ্যাচার করছেন কেন? আমি যা করেছি তা অবশ্যই স্বীকার করবো। শিহাবকে ফাঁকি দিয়েছি আমি। তার সঙ্গে সংসারে থাকা অবস্থাতেই আমি আমার শরীর বিকিয়ে দিয়েছি ভিন্ন মানুষদের কাছে। তার মাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি রোজ। ঘুমের ওষুধ দিয়েছি এই জন্য যে দিনের বেলায় আমি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে উনি যেন টের না পান। বুঝতে যেন না পারেন। আমার অপরাধের জন্য আমি শিহাবের কাছে ক্ষমা চাইবো। তার মার কাছে ক্ষমা চাইবো।এর জন্য তো আমার জেলহাজতে নিয়ে আসার কথা না তাই না? আর আপনি কিসের হোয়াটসঅ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপ করছেন? আমি কাউকে কোন রকম মেসেজ করিনি।’
নাঈম দমে গেল না মোটেও। সে বিপুল উৎসাহে বললো,’ আপনার ফোনটি কিন্তু আমার কাছে। তবুও এতো সাহস করে নিজেকে ডিফাইন করে যাচ্ছেন এভাবে? বাহ্!’
বলেই সে ফোন চেক করতে শুরু করলো।এক এক করে সব দেখে কপাল ভাঁজ করতে শুরু করলো। তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে একেবারে আশাহত হয়ে গিয়েছে।সব দেখে সে বললো,’ সেইম জেবার অবস্থা।ওর ফোন থেকেও তো ওই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে শানু নিজের সব ভিডিও পাঠিয়েছে। আবার ওই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকেই শানুকে গতকাল রাতেই মেসেজ দিয়েছে, সাবধান। শিহাবের বন্ধু পাগলা কুকুরের মতো তোমায় খুঁজছে। কিছুতেই তুমি ধরা দিও না।সতর্ক থাকো।’
শানু নিজের মুখ থেকে কিছুই বললো না।নাঈম ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,’ শানু, আপনি সত্যিটা বলুন। বলুন, আপনি বা জেবা আপনারা কার মাধ্যমে এই জগতে এসেছেন? আপনাদের মূলহোতা কে? এই হোয়াটসঅ্যাপ আইডিটা কে ইউজ করে?’
শানুর উত্তর দেবার আগেই নাঈমের ফোনে একটা কল এলো।নাঈম পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করে কথা বলার পর তাড়াহুড়ো করে একজন মহিলা পুলিশকে ডাকলো। মহিলা পুলিশ এলে বললো,’ শানুকে অন্য একটা সেলে রেখে আসো।’
তারপর সে বারান্দায় যেতে যেতে আমায় বললো,’ বিষয়টা তো খুব জটিল হয়ে গেছে রে!’
আমি বললাম,’ কি হয়েছে?’
নাঈম বললো,’ তোর বস আশফাক সুমন ফোন করলো সরাসরি আমায়।কারো থেকে হয়তো নম্বর সংগ্রহ করেছে। সে বললো, তার কয়েকটা গোপন ভিডিও দিয়ে নাকি একজন তাকে হুমকি দিচ্ছে।বলছে, দশ কোটি টাকা না দিলে সব ভিডিও তার স্ত্রীর কাছে, মেয়েদের কাছে , এমনকি মেয়েদের হাসব্যান্ডের কাছেও নাকি পাঠিয়ে দিবে। বেচারার অবস্থা ভয়াবহ খারাপ।’
আমি বললাম,’ এখন কি করবি?’
নাঈম বললো,’ আশফাক সুমনের সঙ্গে দেখা করবো এক্ষুনি।আমি যতোটা বুঝেছি সবকিছুর মূলে একজনই আছে যে কি না জেবাকে, শানুকে এসবে টেনে এনেছে। এখন আশফাক
সুমনের সঙ্গে দেখা করলেই থলের বিড়াল টা সুরসুর করে বেরিয়ে আসবে।’
‘
(চলবে)…
#গোপনে
‘