#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—২
তপ্ত রোদমোখর দিন। এমন দিন বিরক্তিকরই বটে। সূর্যের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। অক্টোবর চলে এলো। সূর্যের তেজ কমার নাম নেই! অদ্ভুত! স্রোত ভীষণ রেগে আছে। রাগের কারণ অবশ্য অনেক গুলো। প্রথমত, সে ক্লাসে ঢুকেছে লেট করে। দ্বিতীয়ত, মা ভীষণ বকেছে ফোন হারানোয়। স্রোত ভেবে পেলনা এখানে তার দোষ কোথায়! সে কি চো রকে বলেছে চু রি করতে? তৃতীয়ত, আজ দু’দিন পেরিয়ে গেছে। থানা থেকে কল আসেনি। অসহ্য! আবার থানায় গেলে ওরা বড়বড় লেকচার ছাড়বে, ‘আমাদের কাজের ধারা আছে, ব্লা ব্লা ব্লা’
সেসব শুনলে নির্ঘাত স্রোতের মাথায় আরো রাগ চড়বে।
সূর্যের তীর্যক ঝলকানি তার মুখের একাংশে পড়ছে। গরম লাগলেও সে সরছেনা পিলারের পাশ থেকে।
দূর থেকে তা দেখে চঞ্চল পায়ে এগিয়ে এল শুভ্রা। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে কাঁধে হাত রেখে ডাকল,
“ গরম লাগছেনা তোর? সরে দাঁড়া!”
স্রোতের ধ্যান ছুটল। কপালের সূক্ষ্ণ ভাঁজ বিলীন হলো মুহুর্তেই। তৎক্ষনাৎ সরে দাঁড়াল পিলারের পেছনে। মুখে ঘাম চিকচিক করছে। শুভ্রা টিস্যু বের করে দিল। বলল,
“ কি ভাবছিস?”
“ তেমন কিছু না।”
“ থানায় যাবি একবার?”
শুভ্রার প্রশ্নে ভাবুক হলো স্রোত। যাবে কি একবার? কিন্তু ফলাফল শূন্য হলে! চোখ-মুখ ভীষণ চিন্তিত, ভাবুক দেখাল ওর। কনফিউশান কাজ করছে মস্তিষ্কে। শুভ্রা খানিকটা হেসে সহজ করতে চাইল ওকে। বলল,
“ চল, আমিও যাব। আসার পথে একটু ঘুরে আসবো।”
স্রোত না করতে পারলনা। খুব কাছের বন্ধুদের লিস্টে শুভ্রা সবার উপরে। বাকিদের সঙ্গে ফর্মালিটি মেইনটেইন করে চললেও শুভ্রার নিকট তা চলেনা। মেয়েটা ভীষণ আপন কিনা।
…
রাস্তায় জ্যাম। গরমের তাপদাহ অদ্ভুত ভাবে একটু হলেও কমেছে। রোদের তেজও তুলনামূলক কম। তবুও জ্যামে বসে থাকতে কার ভালো লাগে?
রিকশার হুড নামিয়ে ফেলল শুভ্রা। অসহ্যরকমের বিরক্তি ঝেঁকে বসল। এই শহরে এত জ্যাম কেন? পাশে চেয়ে দেখল স্রোত আনমনা হয়ে বসে আছে। কোনো ভাবাবেগ নেই। মৃদু ধাক্কা দিতেই সে নড়েচড়ে বসল। হুডের একপাশ ধরে বলল,
“ ফেলে দিবি নাকি?”
শুভ্রা হেসে ফেলল অকারণে। স্রোত ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
“ হয়েছে কি? হাসছিস কেন?”
“ এমনি। টিউশনি ছেড়ে দিয়েছিস?”
“ না, ছুটি নিয়েছি দুদিনের।”
ক্লাস নাইনের একটা মেয়েকে পড়ায় স্রোত। এসব টিউশনিতে ওর আগ্রহ কম। বাড়ি থেকে যথেষ্ট টাকাই পাঠানো হয়। তবুও স্রোত চায় কিছু জমিয়ে রাখতে। শখের বশে এই টিউশনিটা ধরা।
“ আসার সময় ক্যাফেতে ঢুকব।”
শুভ্রা আগ্রহের সহিত বলে উঠল। মেয়েটা প্রচন্ড ঘুরতে ভালোবাসে। তার সঙ্গে সঙ্গে এখন স্রোতেরও ঘুরতে আগ্রহ বাড়ছে। ছুটি পেলে হোস্টেলে থাকতে ভালো লাগেনা এখন আর।
স্রোত কেবল মাথা নাড়াল। জ্যাম ছুটলো সামান্য। তারপরই আটকালো আবার। পাশে চোখ ফিরতেই নজর আটকে গেল। পুলিশের গাড়ি। সিভিল ড্রেসে জানলার ধারে একজন বসা। তাকে স্রোত চেনে! স্রোত অদ্ভুত চোখে পরখ করল তাকে। শুভ্রা তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজেও অবাক হলো। হাত ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ কি দেখছিস?”
স্রোত চোখ সরাল। বলল,
“এইযে পুলিশ! এর কাছেই তো রিপোর্ট লিখাতে গেছিলাম।”
“ তাহলে আমরা এতদূর যাচ্ছি কেন? এখান থেকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নেই..”
“ ম্যানারলেসের মত দেখাবে। ছাড় তো।”
খানিক পরেই জ্যাম ছাড়ল। গাড়িটা সাঁ সাঁ করে সবার আগে ছুটে গেল। প্যাডেল রিকশাটা এগোলো ধীরে ধীরে। থানার দূরত্ব আহামরি না হলেও একদম কাছে যে তা ও না। বেশ ভালোই দূরত্ব। তবে এদিকটায় স্রোতের স্টুডেন্টের বাসা ও। তাই চেনা জানা আছে।
… …
লকাপে সিরিয়ালে কয়েকজন দাঁড়ানো। এরা প্রত্যেকেই চো-র। এলাকায় ক’দিন ধরে চু রি একটু বেশিই হচ্ছে। লোকাল চোর ছাড়া আর কে ই বা এসব করবে? তাই সব ক’টাকে ধরে আনা হয়েছে। জিহাদ বড্ড বিরক্ত হলো। এরা জেল খাটে, বের হয়। ফের একই কাজ করে। ওর কাছে মনে হয়, এরা জেলে থাকতে পছন্দ করে। তাই একই কাজ বারবার করে জেলে আসতে চায়। বিড়বিড় করে কয়েকটা গা লি ছুঁড়ে লাঠি হাতে তুলে নেয় ও।
“ কে কয়টা চু-রি করেছিস এই মাসে? সত্যি বলবি কিন্তু নাহলে দশদিন হাঁটার মত শক্তি পাবিনা বলে দিলাম।”
কয়েকজন স্বীকার করল, কয়েকজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। জিহাদ লাঠি দিয়ে বাড়ি দিল কয়েকবার। এরা একটাও তো শুধরাবার নয়!
নায়ীব ক্লান্ত বরাবরের মতন। ইদানীং অল্পতেই ক্লান্তি ঝেঁকে বসে। কতদিন ঠিকঠাক ঘুম হয়নি! সে হিসাব নেই। ফোনটা ঝংকার তুলতেই সেটা হাতে তুলে নেয় ও। রিসিভ করে স্পিকার অন করে একপাশে রাখে। সঙ্গে সঙ্গে রিনরিনে মেয়েলি স্বর শোনা যায়,
“ ভাইয়া..কোথায় তুমি?”
“ কাজে আছি, নিশু।”
“ কখন ফিরবে?”
“ দশটার আগে চেষ্টা করব।”
শেষ দু’টো শব্দতে যারপরনাই বিরক্ত হলো নিশাত। বলল,
“ নতুন বাসায় সব সেট করতে কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া। আব্বু একা পারবেনা।”
“ সন্ধ্যার আগে মানুষ চলে আসবে, নিশু। এ নিয়ে টেনশন করিস না।”
নিশাত চুপ থাকে। কিছু বলতে চায় হয়তো, এর পূর্বেই নায়ীবের চোখ যায় দরজার পাশে। দু’জন রমণী দাঁড়িয়ে। সহসা ভ্রু কুঁচকে ও স্পিকার অফ করে। কানে ঠেকিয়ে বলে,
“ পরে কল দিচ্ছি।”
এরপরই সামনে তাকিয়ে বলে,
“ আসুন।”
শুভ্রা-ই আগে আগে যায়। দুজনে বসে চেয়ারে। স্রোত গম্ভীর গলায় শুধায়,
“ কিছু খোঁজ পেলেন?”
জবাব না দিয়ে নায়ীব সরাসরি জিহাদকে ডাকল। জিহাদ এসে তাকে নিয়ে গেল লকাপে। ভাগ্যক্রমে সেখানে সেই চো র টাও ছিল। স্রোত সামান্য চেঁচাল,
“ আরে, এ-ই তো! এটাই সেই চো র! বেয়া দব! ফোন আর পার্স কোথায় আমার?”
জিহাদ হতভম্ব হলো। সেই সঙ্গে থতমত খেল শুভ্রাও। স্রোতকে টেনে বাইরে আনল। জিহাদ বলল,
“ ম্যাডাম, একটু বসুন, দেখছি আমি।”
স্রোত অধৈর্য! তবুও বসল। কিন্তু চো রটা পার্স ফিরত দিলেও ফোন ফেরত দিতে পারবেনা। মার্কেটে সেটা চালান হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সেটার রুপ-টুপ পালটে বিক্রিও করা হয়ে গেছে বোধহয়। তাই অযথাই ফোনের আশা করে লাভ নেই। কিন্তু আইডিকার্ডটা পার্সেই ছিল। ক্যাশ টাকা যদিও নেই। এমনিতেও ওরা পার্স থেকে ক্যাশ, কার্ড নিয়ে পার্স একজায়গায় জমিয়ে রাখে। জিহাদ তাদের হাতেনাতে ধরে এনেছে। সেগুলোও সাথে জব্দ করেছে। স্রোত হতাশ চোখে একবার শুভ্রার দিকে চাইল। ফোনে কত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, ছবি ছিল!
শুভ্রা চোখে ইশারা দিল। তক্ষুনি বেরিয়ে এল নায়ীব। শান্ত পায়ে হেঁটে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। পেটানো শরীরে সি গ্রিন রঙের একটা শার্ট চাপানো। সেই সঙ্গে ফর্মাল ব্ল্যাক প্যান্ট আর একটা কালো ঘড়ি।
স্রোত চোখ তুলে তাকাতেই চার দৃষ্টি মিলিত হলো। নায়ীব সামান্য সময় নিয়ে প্রশ্ন করে বসল,
“ পেয়েছেন? ”
“ ফোন পাইনি।”
“ এগুলো ওরা সাথে সাথেই চালান করে দেয়, মিস। পরের বার থেকে একটু সাবধান থাকবেন। ”
এবার আর সম্বোধনে ভুল হলোনা তার। নায়ীবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঠোঁটে সামান্য হাসির রেখা। স্রোতের চোখ-মুখ অন্ধকার। জবাবে কেবল বলল,
“ জ্বী, ধন্যবাদ।”
পরপরই শুভ্রাকে নিয়ে ও বেরিয়ে পড়ল। দুজনে পুরো সন্ধ্যা ঘুরল বেশ। এরপর স্রোত ফিরল হোস্টেলে আর শুভ্রা বাড়িতে।
… …
নিশাত একপলক অগোছালো রুমটার দিকে তাকাল। রুম মোট চারটা। ভালোই বড় বাসা। ভার্সিটি থেকে কাছাকাছিও। ভাইয়া দারুণ একটা জায়গায় বাসা নিয়েছে! নিশাত এ নিয়ে খুশি হলেও আপাতত সে ভীষণ চিন্তিত। ফার্ণিচার ঠিকঠাক ভাবে রাখলেও কাঁচের জিনিসপাতি, বাসন, কাপড়চোপড় তো তাদেরই ঠিক করতে হবে! মা থাকলে বোধহয় তার এসব নিয়ে চিন্তা করতে হতনা! নিশাত চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
কলিংবেল বেজে উঠতেই ছুটল। দরজা খুলতেই তার মুখে হাসি দেখা দেল। নায়ীবও চওড়া হাসল। সারাদিনের ক্লান্তি চাপা পড়ল হাসির নিচে। হাতে খাবারের প্যাকেট।
কলিংবেলের শব্দে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন নাবিদ খানও। খানিক হেসে ছেলে-মেয়ে দু’টোকে দেখে নিলেন। এরপর তিনি আর নিশাত লাগলেন ডিনার সাজাতে। নায়ীব গেল ফ্রেশ হতে।
…
স্রোত গালে হাতে দিয়ে বসা। সামনে বসা ষোড়শী কন্যাকে বড্ড অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে। সময় গড়াল কিছুটা। স্রোত একভাবেই বসা। চোখের দৃষ্টি ক্রমশ তীক্ষ্ণ হচ্ছে তার। জোহা ঢোক গিলে। খাতা এগিয়ে দেয়। বলে,
“ পারছিনা,আপু। কাল থেকে সিওর পড়া কমপ্লিট পাবেন, প্রমিস।”
স্রোত তাকে ম্যাথ ছাড়া বাকিসব টুকটাক দেখিয়ে দেয়। ম্যাথের আলাদা টিচার রাখা আছে। ইংরেজিতে মেয়েটা মা রাত্মক দুর্বল। অলসও বটে।
স্রোত হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। গম্ভীর চোখ-মুখে বলে,
“ কালকেই শেষ। আর ছাড় দিবনা। সোজা হেড কোয়ার্টারে বিচার যাবে।”
‘হেড কোয়ার্টার’ শুনে হাসতে গিয়েও হাসলনা জোহা। মায়ের কাছে বিচার যাবে! এর চেয়ে বড় ভয়ানক জিনিস আর কি আছে!
উপর থেকে জিনিসপত্র টানাটানির শব্দ আসছে। স্রোত পড়াতে পড়াতে জিজ্ঞেস করল,
“ নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে?”
“জ্বি, আপু।”
স্রোত আরো আধঘন্টা পড়াল। এরপর বেরিয়ে পড়ল। সিঁড়ির কাছটায় আসতেই মনে পড়ল ছোট্ট সেই ফোনটা সে ভুলে এসেছে। ফোনটার কথা তার মাথায়ই থাকেনা। ভুলেও যায় যে এটা ওর ফোন! বিরক্তিতে মাথা ধরে যায় তার। উল্টো ফিরতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে খেয়ে যায়। প্রচন্ড চমকে সামনে তাকাতেই ওপাশে থাকা ব্যক্তি অত্যন্ত গম্ভীর, অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“ আপনি?”
চলবে.