গোপনে রাঙানো প্রেম পর্ব-০৩

0
1150

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩

পড়ন্ত বিকেল। বিল্ডিং-এর আশেপাশে বেশ গাছগাছালি আছে। নীরব, শান্তিমুখোর একটা স্থান। মানুষজনের যাতায়াতও কম। সূর্যের তীর্যক রশ্মির একফালি ঝলকানি আছড়ে পড়েছে স্রোতের শুভ্র বদনে। অদ্ভুত! মেয়েটার চোখ দু’টো গাঢ় বাদামী দেখাচ্ছে তাতে। নায়ীব থমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার পুরুষালী ধারা লো সেই দৃষ্টিতে কাবু হয়ে স্রোত আচমকাই নতজানু হল। এতেই ধ্যান ছুটল নায়ীবের। নিজের কঠিন ব্যাক্তিত্ববোধ নায়ীবকে প্রশ্ন করে বসল যেন। নায়ীব পস্তালো বেশ। ভ্যাবলার মত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিল সে? ছিহ!
স্রোত কি ভেবে একবার মাথা তুলল। তীব্র কৌতুহল বোধ থেকে, ঠোঁট চেপে জড়তা নিয়ে প্রশ্ন করেই বসল,
“ আপনি এখানে?”
“ আমার বাসা এখানে, আপনি এখানে কি করছেন?”
“ আমি সেকেন্ড ফ্লোরে টিউশনি করাই।”

নায়ীব আর মেয়েটার কথার প্রেক্ষিতে প্রত্যুত্তর দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলনা। অবশ্য প্রত্যুত্তরের আশাও বোধহয় রাখলোনা স্রোত। দুজনের মধ্যে যতটুকু কথা হয়েছে, তা কেবলই কৌতুহলবোধ থেকে।
স্রোত দ্রুত বেগে পাশ কাটিয়ে যেতে নিল। উদ্দেশ্য দু’তলায় গিয়ে ফোনটা আনবে। যেতে যেতে একবার নায়ীবের পানে তাকাতে চাইল। তাতেই আরেক বিপত্তি ঘটল। মেয়েটা ধপাস করে হোঁচট খেল লোহার গেটের সঙ্গে। মেইন গেটের আগে বিল্ডিং এ আরেকটি গেটও দেয়া। নায়ীব মেইন গেটের পাশটায় চলেই গেছিল, শব্দ শুনে তড়াক করে তাকাতেই দেখল মেয়েটা মাটিতে বসা। পা চেপে ধরে মুখ কুঁচকে আছে। সে তৎক্ষনাৎ বড় বড় কদম ফেলে ফিরে এল। শুকনো মাটিতে হাঁটতে হাঁটতে কেউ এমন হোঁচট খায়? আশ্চর্য!

নায়ীব কাছে এসে দাঁড়াল। সামান্য ঝুঁকে, বেশ ভাবুক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ ইউ অলরাইট?”

স্রোতের মন চাইল কড়া ভাষায় ক’টা গা লি দিতে। দেখছেই তো মেয়েটা পড়ে গেছে! সে অলরাইট থাকবে কীভাবে? পা ঝাড়া দিয়ে উঠতে চাইল স্রোত। একটু ভর দিতেই আবার বসে পড়ল মাটিতে। আশেপাশে দেয়ালও নেই যে ধরে উঠবে। স্রোত এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকাল এদিক-সেদিক। বড্ড নাজুক দেখাচ্ছে তাকে। নায়ীব আচমকাই হাত বাড়িয়ে দিল। দ্বিধা নেই, জড়তা নেই। চোখমুখে কোনো প্রকার আড়ষ্টতা নেই। হাত বাড়িয়ে দিয়েই সে বলল,
“ উঠুন। দেখুন বেশি ব্যথা পেয়েছেন নাকি?”
স্রোতের দৃষ্টি নত। সেকেন্ড কয়েকেই মস্তিষ্ক কিসব হাবিজাবি ভাবনা আসলো। শেষমেশ সেসব ভাবনাকে ঠেলে বিদায় করতেই হলো। এরপর..তার নরম-সরম হাতটা ঠাই খুঁজে নিল সেই খসখসে, শক্তপোক্ত হাতে।

শক্তপোক্ত হাতটা খুব সাবধানে তাকে টেনে তুলল। পরমুহূর্তেই দুজনের একজনও হাত সরিয়ে নিতে সেকেন্ড গড়াতে দিলনা। স্রোত অপ্রস্তুত হচ্ছে অকারণেই। ব্যথাটা আহামরি না হলেও হাঁটতে বেশ বেগ পোহাতে হবে। দু কদম এগোলো ও পায়ের অবস্থা বুঝতে। নায়ীব সন্দিহান চোখে ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে। তাতেই নাজুক অবস্থা মেয়েটার। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে, পুরুষালী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা তার পানেই স্থির। এতেই সে কাবু হচ্ছে। নায়ীব হঠাৎ মুখ খুলল,
“ সাবধানে আসুন। রিকশা ডেকে দিব?”

কি ভীষণ দায়িত্ববান মানুষ! দেশের আর দেশের মানুষের সেবা করার ব্যাপারটাকে এত সিরিয়াসলি নিয়েছে নাকি?— স্রোতের মনে প্রশ্ন জাগে। প্রশ্ন আর করা হয়না। নায়ীব প্রত্যুত্তরের আশা ছেড়ে গেটের দিকে এগোয়।

“ আপু, আপনার ফোন!”
জোহার গলা। তড়াক করে তাকালো স্রোত। জোহা এগিয়ে আসে। হাত বাড়িয়ে দেয়। স্রোত ফোন নেয়। বলে,
“ থ্যাংকিউ, আমি ভুলেই গেছিলাম ফোনের কথা।”
জোহা হাসে। বলে,
“ সমস্যা নেই আপু।”
বলেই মেয়েটা বড়-সড় হাসি ঝুলালো ঠোঁটে। মিনিট খানেক দাঁড়াল স্রোত। ব্যাগে ফোন ঢুকিয়ে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটার হাসি যেন উধাও হচ্ছেনা ঠোঁট থেকে। আশ্চর্য! স্রোত ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এরপর বিদায় নেয়। জোহা এর আগে একবার নায়ীবের গমন পথে তাকাল। এতক্ষণ সে সিঁড়ির পাশটায় লুকিয়ে ছিল। কি দারুণ রোমান্টিক মুহুর্তই না চোখের সামনে ঘটলো! আহহা!

গলি পেরিয়ে মেইন রোডে গেলে তবেই রিকশা মিলে। স্রোত ধীরে ধীরেই এগুলো। নায়ীব অনেক টুকু এগিয়ে। বড় বড় কদম ফেলে এগোচ্ছে। স্রোত একধ্যানে সেদিকে চেয়ে রইল।
মেইন রোডে এসে রিকশা খোঁজে নায়ীব। পেয়েও যায়। পেছনে তাকিয়ে দেখে স্রোত এখনও আসেনি। স্রোত আসতেই চোখের ইশারায় উঠতে বলে। স্রোত উঠে। ঠিকানাটা বলে হুড ধরে বসে। চেয়ে দেখে নায়ীব এখনও দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতেই স্রোত অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় বলে,
“ ধন্যবাদ।”
নায়ীব কেবল গম্ভীর চোখ-মুখে তাকিয়ে রয়। পিছু হটে কয়েক কদম। রিকশা চলতে শুরু করে। তারপর? তারপর স্রোত কয়েকবার পিছু ফিরেও নায়ীব নামের মানবটির দেখা পায়না।

… …

নিশাতের ভার্সিটির প্রথম দিন আজ। খুব বড়-সড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আশেপাশে কত শাড়ি-পাঞ্জাবি পরিহিত নর-নারী। অনেকে নতুন, অনেকে সিনিয়র। চেনাই যাচ্ছেনা কাউকে। এমনিতেও নিশাতের পরিচিত, এমন মানুষ নেই। তবে ভর্তির দিন একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। একই ডিপার্টমেন্টের। মেয়েটাকে সে খুঁজে চলেছে। অনেক্ষণ খুঁজে ব্যর্থ হয়ে সে গিয়ে বসল একটা চেয়ারে। অদ্ভুত ভাবে, খানিক পরেই তার কাঁধে কেউ হাত রাখে। চমকে পিছু ফিরতেই চমৎকার হাসি খেলে যায় ওষ্ঠে।

মিষ্টিও বেশ বড় একটা হাসি ঠোঁটে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। বলল,
“ ফাইনালি তোমাকে পেলাম! কতক্ষণ ধরে খুঁজছি।”
“ সে কি! আমিও তো তোমাকেই খুঁজছিলাম।”
নিশাত গল্প জুড়ে দেয় এরপর। মেয়েটা বরাবরই বাকপটু। বাসায় বাবার সঙ্গে আর ভাই এলে ভাইয়ের সঙ্গে বকবকানি তার দিন-রাত চলেই।

অনুষ্ঠান শুরু হলো। বেশ খানিক্ষণ পর নিশাতের ফোনটা বেজে উঠল। এত উচ্চশব্দে স্টেজে গান-বাজনা হচ্ছে যে কিছুই শোনা যাবে না কল রিসিভ করলে। সে মিষ্টিকে ইশারা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সরে আসলো অন্যপাশে।
কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে দারুণ গম্ভীর স্বর শোনা গেল,
“ নিশু, ঠিক আছিস?”
“ হ্যাঁ, ভাইয়া।”
এক কানে আঙুল ঢুকিয়ে বলে উঠে নিশাত।

“ সমস্যা হচ্ছে না তো? সমস্যা হলে বাসায় চলে যা। থাকতে হবেনা।”
“ হচ্ছেনা সমস্যা ভাইয়া। খামোখা টেনশন করোনা তো!”
“ একা বসে আছিস? বোর হচ্ছিস না?”
“ সেদিনের মেয়েটা আছে তো। আমার নিউ ফ্রেন্ড, মিষ্টি। ওর সঙ্গে আছি। টেনশন করোনা। রাখছি।”

নিশাত কল রাখতেই নায়ীব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। বোনকে নিয়ে দুনিয়ার চিন্তা তার। বাসায় নাহয় যেমন-তেমন, বাইরের দুনিয়াটা তো সম্পূর্ণ আলাদা! সেটা তার বোকা বোন থোড়াই চিনে!

নিশাত ঘুরতেই দেখতে পেল ক’টা ছেলে অদূরে দাঁড়িয়ে গাছের নিচে। একজনের হাতে সিগা রেট। দৃষ্টি ওর পানেই স্থির। নিশাত ঢোক গিলে। মানুষজন কম এদিকে। চঞ্চল পায়ে এগোতে গেলেই ছেলেটি কয়েক কদম এগোয়। এতেই দাঁড়িয়ে পড়ে নিশাত। শিরদাঁড়া বেয়ে যেন শীতল স্রোত নেমে যায়। বরফের ন্যায় জমে যায় দু’টো পা। ছেলেটি যদিও খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে। সে গভীর চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“ নিউ?”
নিশাত ‘ হ্যাঁ/না’ কিছুই বললনা। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলোনা। ছেলেটা সিগা রেট ফেলে দিল। বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে বলল,
“ বোবা নাকি?”
নিশাত তাতেও প্রত্যুত্তর করলনা। পালানোর উপায় খুঁজছে তার মন-মস্তিষ্ক। এদিকে ওদিক ছুটে চলেছে এলোমেলো দৃষ্টি।

স্রোত অকারণেই হাঁটছিলো। এসেছে দেরীতে। অনুষ্ঠানের কয়েকটা দায়িত্ব তাদের কাঁধেও ছিল। কিন্তু মুখ্য দায়িত্ব ছিলো লাস্ট ইয়ারের ব্যাচের কাঁধে। তাই তার ওপর ওত চাপ নেই। সে কেবল ওদিক-সেদিক ঘুরছে। শুভ্রাও আছে কোথাও। হাঁটতে হাঁটতে ও দেখল একটা মেয়ে বিল্ডিং এর পাশে দাঁড়িয়ে। খানিকটা অপ্রস্তুত, ভীত দেখাচ্ছে তাকে। সামান্য দূরত্বে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই চোখ-মুখ শক্ত হলো স্রোতের। বড়বড় কদম ফেলে এগিয়ে সেখানে গেল ও।

“ এখানে কি হচ্ছে?”
মেয়েলি আওয়াজ। নিশাতের কলিজায় পানি এলো যেন। সে বড়বড় দু’টো কদম ফেলে মেয়েটার কাছে গেল। স্রোত অ গ্নি চোখে তাকাল ওয়াহিদের দিকে। প্রশ্ন করল,
“ কি করছিলি?”
“ তুই এমন রাগছিস কেনো? আশ্চর্য! আমি শুধু জিজ্ঞেস করছিলাম, ও নিউ কিনা!”
“ তো একা একা জিজ্ঞেস করছিস কেন? সাথের গুলো এত দূরে দাঁড়িয়ে কেন?”

ওয়াহিদ বিরক্ত চোখে দেখল ওকে। বলল,
“ অদ্ভুত মেয়ে মানুষ! সামান্য ব্যাপার..”
“ তোর কাছে সামান্য হলেও মেয়ে মানুষের কাছে এসব সামান্য না। আবার দেখলে ডিপার্টমেন্ট হেডকে জানাবো, মাথায় রাখিস।”

ওয়াহিদ সহ ওর বন্ধুরা হতবাক হয়। ওয়াহিদের চোয়াল শক্ত হয়। সে তো মেয়েটাকে র‍্যাগ দেয়নি। না অন্য কিছু করেছে। তাহলে স্রোত মাঝখানে তামাশা করলো কেন, সে বুঝে উঠতে পারল না।

নিশাতের হাত চেপে ধরে স্রোত। বড়বড় কদম ফেলে এগোয় দু’জনে। স্টেজের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে হাত ছেড়ে বলল,
“ নতুন না তুমি?”
“ জ্বি, আপু।”
“ ভয় পেয়োনা, কেউ কিছু করতে আসলে বা বললে আশেপাশের কাউকে ডেকে নিও। একা একা ওদিকে যেওনা।”
নিশাত চমৎকার হেসে ‘ধন্যবাদ’ জানায়। এরপর চলে আসে মিষ্টির কাছে।

ওয়াহিদ স্রোতের ক্লাসমেট। পড়াশোনার ব্যাপারে দুজনের মধ্যে একটা চাপা আক্রোশ কাজ করে। ওয়াহিদ বড্ড আনন্দ পায় স্রোতকে খুঁ চিয়ে। এজন্য হয়তো স্রোতও তাকে দেখতে পারেনা। সে জানে কিন্তু কখনো বিশেষ ধ্যান দেয়নি। তবে আজ মেয়েটা একটু বেশি করে ফেলল।

চলবে.