গোপনে রাঙানো প্রেম পর্ব-০৪

0
1052

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৪

নিশাত উৎফুল্ল মনে বাসায় প্রবেশ করল। নাবিদ সাহেব সারাদিনই বাসায় থাকেন। তিনি একজন রিটায়ার্ড মেজর। স্ত্রী গত হওয়ার প্রায় ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। ভদ্রলোক আর দ্বিতীয় বিবাহের চিন্তা মাথায় আনেননি। আনার প্রশ্নও আসেনা। জীবিত থাকতে যাকে ভালোবেসেছেন, তার মৃ ত্যুর পর কেন আরেকজনের কাছে শান্তি খুঁজতে হবে? শান্তি কি আদোও মিলবে অন্য কারোর কাছে?
ভাই-বোনেরা বেশ কয়েকবার জোর করলেও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নাবিদ সাহেব একচুলও নরেননি। এরপর আজ বেশ কয়েক বছর হলো এ নিয়ে কথা উঠেনা। এতে নাবিদ সাহেব খুশিই বটে।

নিশাত বাসায় ঢোকে দেখল নাবিদ সাহেব সোফায় বসে টিভি দেখছেন। বিকাল গড়িয়েছে। সে সোজা রুমে গিয়ে গোসল করল। নাবিদ সাহেব সবে ফোন নিয়েছিলেন ছেলেকে কল করে জানাবেন, নিশাত এসেছে। তার পূর্বেই কলিং বেল বেজে উঠল। নাবিদ সাহেবের উঠা লাগলোনা। রুম থেকে রকেটের গতিতে বেরিয়ে এল নিশাত। হুড়মুড় করে দরজা খুলল। নাবিদ সাহেব চশমা খুলে হেসে ফেললেন। তাতে ভ্রু কুঁচকে তাকাল নায়ীব। ভেতরে ঢুকে জুতো জোড়া খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল,
“ হাসছো কেন আব্বু?”
“ নিশাতকে দেখে একসেকেন্ডের জন্য মনে হলো কোনো রকেট ছুটছে।”
নায়ীব হাসল। তবে খানিকপর চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল,
“ বলেছি না ছুটাছুটি কম করতে?”
নিশাত নাবিদ সাহেবের দিকে তাকাল। ভ্রু কুঁচকানো তার। নাবিদ সাহেব আরও হাসলেন। নিশাত ধুপধাপ পা ফেলে ভেতরে চলে গেল।

নায়ীব এসে বসল নাবিদ সাহেবের পাশে। বড্ড ক্লান্ত সে। আজ পুরোটা দিন দৌঁড়ের উপরে কেটেছে। কোথায় কি ঝামেলা হয়েছে, তড়িঘড়ি করে গাড়ি নিয়ে গিয়ে সেসব সামাল দিতে হলো। এরপর আর থানায় গেলনা ও। আর কাজ নেই আজ। ইমার্জেন্সি হলে বাসা থেকেই বেরোবে। আজ আর শক্তিতে কুলোচ্ছেনা।

“ আজ কে রান্না করল?”
“ আর কে! দ্যা ওয়ান এন্ড অনলি বেস্ট শেফ রান্না করেছে..” বুক ফুলিয়ে বলে উঠলেন নাবিদ সাহেব। কথায় তিনি নিজেকেই ইঙ্গিত করেছেন। নায়ীব গা এলিয়ে বসল। বলল,
“ হেল্পিং হ্যান্ড পাওয়া খুব টাফ, আব্বু। তাও আশা করি পেয়ে যাব শীঘ্রই।”
“ দরকার নেই ওসবের। আমার ভালো লাগে নতুন নতুন রেসিপি ট্রাই করতে, তোরা খেতে পারলেই হলো।”
নায়ীব উচ্চস্বরে হেসে ফেলল। নাবিদ সাহেব চোখ ভরে দেখলেন ছেলের হাসি। নায়ীব দেখতে তার মায়ের মত খানিকটা। পুরোপুরি না হলেও নাক, চোখ একদম অবিকল। আবার নিশাতের চেহারায় স্ত্রীর কোনো ছাপই নেই যেন। সে দেখতে নাবিদ সাহেবের মতন। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি। রান্না-বান্না করার শখ তার স্ত্রী-এর ছিল। এখন সেই শখ তাকেও ঝেঁকে বসেছে। রান্নার হাত ক্রমশ ভালো হচ্ছে তার।

… …

বাংলা দ্বিতীয় পত্র— জোহার কাছে মায়ের পর সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম। এমসিকিউ এ সর্বোচ্চ মার্কই তার বারো-তেরো। এজন্যই সে পিছিয়ে যায় সর্বদা। স্রোত বাংলা বিভাগের ছাত্রী। বাংলায় দুর্দান্ত একটা মার্ক তার স্কুল-কলেজ লাইফে সর্বদাই ছিল। নাইনটি ফাইভ এর নিচে সে কখনো পায়ই নি। আর তারই স্টুডেন্ট কিনা এমসিকিউ এ টেনে-টুনে পাশ করে? ভারী লজ্জার ব্যাপার-স্যাপার। জোহার মা এমনিতেও বাংলা, ইংলিশ বেশি পড়াতে বলেছেন। সে তা-ই করে। সপ্তাহে যে চারদিন আসে, বেশিরভাগই এসব পড়ায়। জোহার তাতেই দমবন্ধ লাগে। এত পড়া গিলবে কীভাবে সে? সে টেনে-টুনে পাশ করা নিয়েই তো হ্যাপি আছে। আবার এত চাপ কেনো?

জোহা হাই তুলতেই স্টিলের স্কেলের বাড়ি পড়ে টেবিলে। সে ধরফরিয়ে উঠে। গায়ে হাত বুলোয় একবার। আজব! সামান্য হাই তোলায় এমন বাড়ি দেয়ার কি আছে?

“ কি হয়েছে জোহা? মনোযোগ কোথায় তোমার?”
“ এইতো, আপু। এখানেই। পড়ান না আপনি!”
“ এত হাই তুলছো কেনো? ঘুম-টুম এমনিতেই ছেড়ে দিতে হবে ক’দিন পর। মনোযোগ দিয়ে পড়ো।”
“ বিকেলে ঘুমানোর অভ্যাস আছে তো আপু, তাই..”

বলতে বলতে আবার হাই তুলে সে। স্রোত তীক্ষ্ণ, বিরক্তিকর চোখে তাকায়। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই সে হোস্টেলে ফিরেছে। তারপর গোসল, খাওয়া-দাওয়া সেড়ে কাটায় কাটায় এসেছে পড়াতে। ক্লান্তিও লাগছে অবশ্য। তবুও সে সোজা হয়ে বসে আছে। আর এই মেয়ে?
সে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে পড়াতে মনোযোগ দেয়।

বিল্ডিংটা চার তলা। তিন তলায় নায়ীব ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। পাঁচ তলায় ছাদ। নিশাত সন্ধ্যার হওয়ার আগে জেদ ধরল ছাদে যাবে। ছাদ দেখা হয়নি তার। নায়ীব তার জেদ পূরণ করল। দু’জনে উঠল ছাদে।
তখন সন্ধ্যার পূর্বক্ষণ। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। এক ঝাঁক পাখিরা খানিক পরপর নীড়ে ফিরছে। আকাশ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। মনোরম পরিবেশ।
নিশাত ঘুরঘুর করল। নায়ীব রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে রইল।

খানিক পরেই কোত্থেকে ছাদে উদয় হলো আরেকটি মেয়ে। নিশাত চমকে তাকালো। মেয়েটা জোহা, যদিও নিশাত তার নাম জানেনা। স্রোত পড়ানো শেষ করতেই তার সঙ্গে বেরিয়েছে জোহা। এসেছে সে কাপড় তুলতে। নিশাতের দিকে চেয়ে জোহা স্বভাবতই হাসলো। অচেনা মানুষজন দেখলে দূর থেকে হেসে তাকে বিভ্রান্ত করতে জোহার ভালো লাগে। ভীষণ পাজি কিনা সে! তবে নিশাত বিভ্রান্ত হলোনা। বরং নিজেও একটা ফিরতি হাসি উপহার দিল। এতেই জোহা উৎফুল্ল হলো। দূর থেকেই জিজ্ঞেস করল,
“ আপনারা নতুন এসেছেন না আপু?”
নিশাত বলে,
“ হ্যাঁ।”
“ তিন তলায়, তাইনা?”
“ হু, তুমি কয় তালায় থাকো?”
বলতে বলতে নিশাত রেলিং এর কাছে গেল। বড় রেলিং এর একধারে নায়ীব। ফোন স্ক্রল করার ফাঁকে একবার দেখে নিল নিশাত আর মালিকের মেয়েটাকে। জোহাকে সে চেনে। বাসায় উঠার দিন দেখেছে।

নিশাতের পাশাপাশি এসে দাঁড়াল জোহা। রেলিং ছুঁয়ে বলল,
“ দুই তলায় থাকি।”
বলতে বলতে সে ঝুঁকল। দেখল, স্রোত কানে ফোন ঠেকিয়ে গেটের পাশটায় গেছে সবে। এতক্ষণেও যায়নি! কলে কথা বলছে বোধহয়। জোহা ঝুঁকল আরেকটু। নিশাত ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,
“ এই, পড়ে যাবে তো।”

জোহা পাত্তা দিলনা। সে জানে সে পড়বেনা। তার মনোযোগ আপাতত অন্য কাজে। একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখল সে নায়ীবকে। বাবার থেকে শুনেছে এ লোক পুলিশ। নিশাত তার বোন। তাছাড়া সেদিনও তো স্রোতের সঙ্গে তাকেই দেখল জোহা। ভাবতেই দাঁত কেলিয়ে হাসল সে। হাত নাড়িয়ে চিৎকার করে ডাকল,
“ আপু, আপু…এই স্রোত আপু!”

নিশাত ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকে দেখল। একবার নিচে তাকাল। গেটের পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। গায়ে গোলাপি রঙের ড্রেস। সে চোখ সরিয়ে জোহার দিকে তাকাল। জোহা আরেকবার ডাকল। তার চিৎকারে এবার আরেকজন ফিরে চাইল। ঘাড় কাত করে নিচের দিকে তাকাল নায়ীব।
রমণী তখন তড়াক করে মোড়ল। উপরের দিকে তাকাল। না! জোহার দিকে সে তাকায়নি! তবে তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরে জোহা হাসল। হাসিটা আরো বাড়ল, যখন দেখল স্রোত নায়ীবের দিকে চেয়ে আছে। নায়ীবও তাই। সে আরো চওড়া হাসল। নিশাত অবাক স্বরে জানতে চাইল,
“ কাকে ডাকছো?”
“ আমার টিউটরকে।”
নিশাত আর জানতে চাইলনা। জোহা মুখ আবার নুয়ালো রেলিং এর ধারে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় তখন নায়ীব মুখ ফিরিয়েছে। এরপরই গটগট পায়ে ছাদ থেকে নেমে যেতে যেতে বলল,
“ নিশাত, বাসায় আয়।”

নিশাত ইশারায় জোহাকে বিদায় জানিয়ে নামল। জোহা হাত নাড়িয়ে তাকে বিদায় দিয়ে আবার স্রোতকে দেখিয়ে হাত নাড়ল। চেঁচিয়ে বলল,
“ টাটা আপু..”

ওয়াহিদের আঙুলের ফাঁকে সিগা রেটটা স্থান পেল পায়ের তলায়। স্রোত ক্যান্টিনে যাচ্ছিল। সঙ্গে শুভ্রা। দূর থেকেই দেখল গাছের কাছটায় ওয়াহিদ দাঁড়িয়ে। বরাবরের মত ধোঁয়া উড়িয়ে সিগা রেট খাচ্ছিলো বোধহয় লুকিয়ে। স্রোত ভেবে পায়না, সারাবছর কলমের জায়গায় যে সিগা রেট নিয়ে ঘুরে, সে কিকরে পরীক্ষার ক’দিন আগে পড়ে স্রোতের সঙ্গে টক্কর দেয়?
শুভ্রা মৃদু ধাক্কা দিতেই তার ধ্যান ভাঙে। শুভ্রা বিরক্ত গলায় বলে,
“ এত অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে কেন তোকে?”
“ এমনিই। চল তো..”

ক্যান্টিনে গিয়ে বসল ওরা দুজনে। মিনিট কয়েক গড়াতেই ওয়াহিদ হাজির হল। বুক ফুলিয়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল স্রোতদের টেবিলের কাছটায়। স্রোতের হাতে নোটস। সবেই হাতে তুলেছে ব্যাগে ঢুকাবে বলে। তা দেখেই ওয়াহিদ সামান্য শব্দ করে হাসল।
ধপ করে বসলো শুভ্রার পাশের চেয়ারটায়। শুভ্রা বিরক্তি চোখে তাকিয়েও কিছু বললনা। তবে স্রোত কঠিন চোখ-মুখে তাকাল, শুভ্রা খেয়াল করল তা। ওয়াহিদের সামনে স্রোতের কড়া ভাষা, কঠিন চাহনি এমনিতেই বের হয়ে আসে। ওয়াহিদ তাতে মজা পায়, সেটাও শুভ্রা জানে।

“ নিউটনের কিছু লাগিস নাকি? এত পড়া পড়া করলে তো মাথা ধরে যাবে।”

স্রোত জবাব দিলনা। কঠিন চোখে তাকিয়ে ব্যাগে নোটস ভরল। টেবিলের উপর রাখা দুই কাপ চা! খাওয়া হয়নি। ওয়াহিদ চেয়ে দেখল। এরপর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শুভ্রার দিকে,
“ মে আই?”

শুভ্রা বুঝলনা। ভ্রু কুঁচকাতেই ওয়াহিদ চায়ের কাপ হাতে তুলে তাতে চুমুক বসাল। কপাল কুঁচকে বলল,
“ উহু, চিনি বেশি।”
এরপর একটানেই তা গিলে ফেলল। শুভ্রা বুঝল, এখন এখানে থাকা বিপদ। ওয়াহিদ এখানে স্রোতকে কেবল তেঁতিয়ে দিতে এসেছে। তার উদ্দেশ্য সফল। স্রোত যেকোনো সময় রাগ উগড়াবে। সিন ক্রিয়েট হবে! শুভ্রা চট করে উঠে দাঁড়াল। স্রোতের হাত টেনে ধরল। এগিয়ে গেল বিল দিতে। কিন্তু না! স্রোত ক্যান্টিন থেকে বেরোনোর আগে আরেক কাজ করল। ক্যান্টিন বয়কে বলল,
“ বিলটা ও পে করবে।”

ওয়াহিদ যেন জানত, এটাই হবে। সে তাই টেবিলের ওপর রাখা আরেক কাপ চা হাতে তুলল। তার বন্ধুরা এসে দখল করল বাকি চেয়ার গুলো। স্রোত আর শুভ্রা চলে গেছে। আরেক কাপ চা ফের একটানে গিলে ফেলল ওয়াহিদ। চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“ শা-লার! চল্লিশ টাকা এমনি এমনি যেতে দিব নাকি!”

চলবে.