গোপনে রাঙানো প্রেম পর্ব-০৫

0
972

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৫

স্রোত দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামছে। হাতে ফোন। ওপাশ থেকে অনবরত গলা শোনা যাচ্ছে,
“ আস্তে নাম..”
স্রোত শুনল তবে মানলনা। সে দ্রুত বেগে নামছে। হোস্টেলে থাকে সে তিন তলায়। নিচ তলায় নেমেই সে এক ছুটে গেল গেটের পাশে।
সন্ধ্যা সাতটা। গেট বন্ধ হয় আরো পরে। গেটের বাইরে বেরিয়ে এদিক-সেদিক তাকালো স্রোত। ওইতো..রাস্তার ওপারে দেখা যাচ্ছে কালো রঙের একটা টয়োটা গাড়ি। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চিকচিক করছে গাড়ির গ্লাসগুলো। সে রাস্তা পার হয়ে কাছে যেতেই ডোর খুলে গেল। গাড়িতে চড়ে বসল স্রোত। এরপরই সেকেন্ড খানেক গড়াতেই ঝাপিয়ে পড়ল প্রশস্ত বুকটায়। সুহাদ দু’হাতে আগলে নিল তাকে। আঙুল চালালো চুলের ফাঁকে। মাথায় সামান্য ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
“ পাখি,কেমন আছিস? কত্ত মিস করেছি তোকে! কবে বাড়ি আসবি!”

স্রোত গুটিসুটি মে রে রইল। আনমনা হয়ে বলল,
“ আমার ভালো লাগেনা ভাইয়া, শুধু মন পড়ে থাকে গ্রামে, তোমাদের কাছে। ওখানে কোনো ভার্সিটি নেই কেনো?”

সুহাদ চমৎকার হাসল। দুনিয়ার সামনে কঠিন রুপ ধারণকৃত মেয়েটার মুখে বোকা বোকা এমন কথা মানায়? তাও সুহাদ মিছে মিছে সান্ত্বনা ছুঁড়ল,
“ বাবা বলেছে শীঘ্রই কলেজ-ভার্সিটি, সব বানাবে। তুই ওখানে পড়বি নাহয় পড়াবি। ”

সাঈম রহমান গ্রামের চেয়ারম্যান। সুহাদও বাবার দেখানো পথেই হাঁটছে। রাজনীতি, তাদের কাছে আরেক আবেগের স্থান। সব ঠিক-ঠাক থাকলে সুহাদও এসবে জড়াবে। নাহলে ব্যবসা বাণিজ্য তো আছেই। বছর কয়েক হলো পড়াশোনা শেষ করে সে গ্রামে থাকছে। বাবার ব্যবসা দেখছে।
সাঈম সাহেব কখনো তাদের পড়াশোনায় বাঁধা দেননি। মেয়েকেও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত বানাতে চান তিনি। চেয়ারম্যানের মেয়ে হবে তার মত। শিক্ষায়-দীক্ষায় সবকিছুতে টক্কর দেয়ার বাইরে। স্রোত জানেনা, সে পুরোপুরি বাবার মনের মত কীনা, তবে সে চেষ্টা করে বাবার আদর্শ ধরে রাখার, বাবাকে নিরাশ না করার। বাবা-মায়ের পর তার ভরসার স্থান বলতে এই কাঠখোট্টা ভাইটাই!

মিনিট খানেক গড়ালো। সুহাদ হাত সরিয়ে পেছন থেকে দু’টো ব্যাগ আনল। স্রোত সোজা হয়ে বসতেই সেগুলো ওর কোলের ওপর রাখল সুহাদ। বেশ ভারী। ব্যাগ সামান্য খুলে মুখ হা হয়ে গেল স্রোতের। এত জিনিসপত্র! নিশ্চয়ই মা পাঠিয়েছে!

“ বেশি ভারী নাকি, পাখি? দিয়ে আসব আমি?”
“না, লাগবেনা। নিতে পারব। কোথায় থাকবে তুমি?”
“ বন্ধুর বাসায়। দু’দিন আছি। কাল পুরো দিন ঘুরব, কেমন?”
বলতে বলতে এগোয় সুহাদ। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“ যা, এখন। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
স্রোতের মন খারাপ হলো সামান্য। তবে ভাই তো থাকবে দুদিন! তাই অনেক!
স্রোত গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই গাড়ি ঘুরালো সুহাদ।

… …

মধ্যদুপুর। মার্কেট এরিয়ায় থমথমে অবস্থা। পুলিশের তিনটা গাড়ি, মিডিয়ার কিছু সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়েছে। জিহাদ রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে। সোনার দোকানটায় দিন দুপুরে লুটপাট হয়েছে। বাকি দোকানে ডাকাত ঢোকার আগেই পুলিশ চলে এসেছে। ওরা তাই সুযোগ বুঝে লাফিয়ে-ঝাফিয়ে পালিয়েছে। নায়ীবের চোখ-মুখ গম্ভীর। ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো এড়িয়ে এগোলো ও। সব জুয়েলারিই মোটামুটি গায়েব। যা দুই-একটা আংটি ফেলে গেছে। এটা মূলত একটা মল। ফার্স্ট ফ্লোরের একটা দোকান এটা। ডাকাত মোটে একটা দোকান থেকে জিনিস সরিয়েছে? অবিশ্বাস্য! নিশ্চয়ই পার্সোনাল শ ত্রুতা—এটাই মনে হচ্ছে জিহাদের। তবে এত মানুষের সামনে নিজের চিন্তা জানানো গেলনা স্যারকে। নায়ীব ঘুরে-ঘুরে দেখল। এরপর গেল সিসিটিভি খুঁজতে। ফুটেজ কালেক্ট করতে বলে আবার ফিরে এল। এত মানুষ মলে! সবাই মিলে আটক করলে ডাকাতের বাপও এমন অকাজ দিন দুপুরে করার সাহস পেতনা। মানুষ গুলোও কি বোকা!
নায়ীব বের হলো মল থেকে। বুকে ঝুলানো রোদচশমাটা চট করে চোখ ঢেকে ফেলল। জিহাদ এখনও মলের ভেতর। নায়ীব গাড়িতে উঠে বসল। জানলার কনুই রেখে হাত ঠেকালো মুখে। চিন্তিত চোখ-মুখ। কপালে আঙুল ঘ-ষে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। এরপরই একটা দৃশ্য দেখতে পায়। মল থেকে বেরোচ্ছে এক তরুণী। স্রোত! নায়ীব থমকানো দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। সাথে কে? মেয়ে মানুষের সঙ্গে আর কে থাকবে? বাপ? ভাই? বয়ফ্রেন্ড/হাজবেন্ড? আর কে! হবে কেউ একজন! তাতে নায়ীবের কি আসে যায়। তবে ‘আসে না’ বললেও সম্পূর্ণ ভুল হবে। কেননা তার বেহায়া নজর বারবার সেদিকেই যাচ্ছে। মেয়েটার হাতটা অন্যপাশের মানুষটার হাতের ভাঁজে। বড্ড যত্নশীল দেখাচ্ছে সেই মানুষটাকে! চোখ-মুখ থমথমে। উজ্জ্বল চেহারা, শক্ত চোয়াল। অন্যদিকে স্রোতের চেহারা থমথমে। ভীতগ্রস্থ নাকি বোঝা গেলনা।
নায়ীবের চোখের সামনে দিয়েই ওরা উঠল গাড়িতে। এরপর ধুলো উড়িয়ে মিলিয়ে গেল কোথাও। নায়ীব নিরস মুখে ঘড়ি দেখে। দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করে জিহাদের। হাদারামটার আসার নাম নেই!

স্রোত গাড়িতে উঠে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। সেকেন্ড ফ্লোরের ফুড কর্ণারে ছিল তারা। ডাকাত এসেছে শুনে সবাই শাটার নামিয়ে ফেলেছিল। সময় পেলে হয়তো একে একে সব জায়গায়ই হা না দিত ডাকাতরা।

সুহাদ পানির বোতলটা এগিয়ে দেয় ওর দিকে। সেটা হাতে নিয়ে একবার ফের মলের দিকে তাকায় স্রোত। নামার সময় জিহাদকে দেখেছে সে। মন-মস্তিষ্ক বলছিল, অন্য কেউ-ও এসেছে। কিন্তু তার দেখা মিলেনি।
… …

সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীতে। নিশাত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা করছে ভাইয়ের। ইদানীং আগের তুলনায় নায়ীব অনেক আগে বাড়ি আসে। তবে দরকার হলে বের হয় মাঝেমধ্যে। নিশাতের ভালো লাগে। ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করা যায়। রোজ-রোজ কি কি কেস আসে, তাও নায়ীব তাকে জানায়। অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা শুনে নিশাত হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়।

নায়ীব গলির মুখ থেকে হেঁটেই আসে। আজও তাই। দোতলাটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। লাইট নষ্ট বোধহয়। ফ্ল্যাশ জ্বালানোর প্রয়োজনবোধ করলনা ও। সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠতে গেলেই বা হাতে বাড়ি লাগল। নায়ীব হতভম্ব চোখে অন্ধকারে তাকাল। মিষ্টিভাষী এক স্বর শোনা গেল,
“ সরি, সরি।”

এরপর..এরপর অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সে। পিনপতন নীরবতায় কেবল ঠাই পেল হিলের ঠকঠক আওয়াজ। নায়ীব রেলিং এ হাত দিয়ে উঁকি দিল নিচে। ওহ! অবয়বটি তাহলে অপরিচিত নয়..
পরপরই ধুপধাও পা ফেলে উপরে উঠে ও। কপালে দুটো আঙুল ঘষে অন্যহাতে কলিং বেল চেপে ধরে। আসার সময় গলির মুখে কালো রঙের সেই টয়োটা গাড়ি দাঁড়িয়ে, খেয়াল করেছে সে।

নিশাতকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিয়ে নায়ীব চলে গেছে। নিশাত দ্রুত কদম এগোচ্ছে। দশ মিনিট আছে ক্লাস শুরু হওয়ার। মিষ্টি হয়তো চলে এসেছে এতক্ষণে। ও যখন বড় বড় কদমে এগোচ্ছিল, তক্ষুনি কোত্থেকে পায়ে এসে একটা বল লাগল। ক্রিকেট বল! জোরে মা রেনি কেউ। কেবল মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য মাটি ঘেষে ছুঁড়েছে। নিশাত ঝুঁকে সেটা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাল।
সেদিনের মত আজও গেটের ধারে বখাটেদের মত দাঁড়িয়ে ওয়াহিদ। গায়ে কালো টিশার্ট,ব্রাউন প্যান্ট। চুলগুলো কেমন এলোমেলো। ফর্সাটে মুখের আদল। ভ্রু গুলো কুঁচকানো। না! আজ হাতে সিগা রেট নেই। নিশাতের দিকে তাকিয়ে সে খেয়াল, মেয়েটা দ্বিধা নিয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চেহারা একটু অন্যরকম। ভীষণ মিষ্টি বোধহয়। বেবি ফেইসও বলা যায়।
ওয়াহিদের পাশে ওর এক বন্ধু দাঁড়িয়েছে। সে খানিকটা দূরে বাইকের কাছে বসা। ধ্যান এদিকে ওতো নেই। সে নিজের ফোনে ব্যস্ত। ওয়াহিদ ভ্রু নাঁচায়। উচ্চস্বরে বলে,
“ বলটা আমার, দাও।”

তার বলতে দেরী, বলটা উড়ন্ত অবস্থায় আসতে দেরী নেই। ভ্যাবাচেকা খেয়ে কোনোমতে সেটা ক্যাচ করল ও। এরপরই এক রামধমক ছুঁড়ল,
“ এই মেয়ে! আস্তে ছুঁড়বে তো!”

নিশাত থতমত খেয়ে তাকাল। ভাবল, এবার ক্লাসে যাওয়া উচিত। পা বাড়ালো তাই ভেবে। কিন্তু পেছন পেছনে যে ওয়াহিদও আসছে, তা খেয়াল হলোনা তার। খেয়াল যতক্ষণে হয়েছে, ততক্ষণে ওয়াহিদ তার সঙ্গ ধরেছে। প্রায় পাশাপাশি হাঁটছে। নিশাত বড়বড় কদম ফেলছে। তাতেও সায় জানাচ্ছে ওয়াহিদ। চট করে ও জিজ্ঞেস করে বলল,
“ ফার্স্ট ইয়ারে তুমি?”
নিশাত কাঁধের ব্যাগ আরেকটু চেপে খানিকটা সরল। বলল,
“ জ্বি!”

“ তোমার নাম নিশাত ইফরাহ্ না? তা কি নামে ডাকব তোমাকে? নিশাত না ইফরাহ্?”

চলবে.