#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—১৩
জোহা বাসার নিচে রাখা গাছ-গুলোয় পানি ঢালছিল। তক্ষুনি কোত্থেকে নিশাত হাজির হল। তিন তলা থেকে সে নেমেছে এক মিনিটের চেয়েও কম সময়ে। হাঁপিয়ে গেছে তাই। হাঁটুতে ভর দিয়ে সে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল প্রথমে। তারপর তাকাল জোহার দিকে। জোহা আড়চোখে তাকে খেয়াল করে বলল,
“ আপু আপনি হাঁপানি রোগীর মত করছেন কেন?”
কপট রাগ দেখাল নিশাত। বলল,
“ ছুটে এসেছি বলে এমন করছি। তাই বলে সোজা হাঁপানি রোগী বানিয়ে দিলে তুমি আমাকে?”
জোহা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। বলল,
“ দেখে মনে হলো আরকি।”
“ সেসব ছাড়ো। তোমার মিস কই?”
“ গেছে এক জায়গায়!”
“ কোন জায়গায়?”
“ উহু, বলতে মানা।”
“ আশ্চর্য! বলতে মানা মানে কি? পরীক্ষা তো শেষ হলো ষোলো তারিখ। আজ বিশ। সে তোমায় পড়াতে এলোনা কেন?”
জোহা পানির পাত্রটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল,
“ আপুর পরীক্ষা কবে শেষ সেটা তো আমিই জানিনা। আপনি জানলেন কি করে?”
নিশাত হতাশ চোখে তাকিয়ে বলল,
“ বলোনা রে বাপ! কই সে?”
“ গেছে বিয়েতে!”
“ কার বিয়ে?”
“ হতে পারে তার!”
“ কিহ!” নিশাতের সহসা চিৎকারে প্রাণটা ছিলকে উঠলো জোহার। বুকে হাত চেপে ও আতঙ্কিত চোখে তাকাতেই নিশাত লজ্জা পেল খানিকটা। বলল,
“ সরি, সরি। মিথ্যা বলোনা, জোহা!”
“ ভাইয়ের বিয়ে ঠিকঠাক করতে গেছে মনে হয়। নিজেরটাও ঠিকঠাক করে আসতে পারে, বলা যায়না।” বানোয়াট কথাবার্তা বলে জোহা কুটিল হাসল।
“ ধ্যাত! মোটেও না! এইটুকুন মেয়েকে এখনই বিয়ে দিবে কেন?” নিশাতের অবাক স্বর। জোহা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ আমার সাথের বেশিরভাগ মেয়েগুলোরই তো বিয়ে হয়ে গেছে আপু, আর উনার বয়স তো তেইশ!”
নিশাত মুখ বাঁকাল। এরপরই মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। জোহার সঙ্গে আলাপ সেড়ে সে সোজা চলে এল বাসায়।
..
জানলার গ্রিল গলিয়ে নরম রোদ্দুর মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। বিশাল বেডটা একপাশে ঠাই পাওয়ায় রোদের কারণে ঘুমের বিশেষ ব্যাঘাত হচ্ছেনা।
আশা আস্তে করে দরজা ঠেললেন। এরপর এই অর্ধ আলোকিত রুমটায় নিশ্চুপে খানিক্ষণ ঘুরঘুর করলেন। এতটা দিন ঘরটা আসলেই ম’রা-ম’রা ছিল। এইযে, মেয়েলি একটা মিষ্টি সুবাস এখন ঘরে বিরাজ করছে। ঘরে তাকালেই মনে হচ্ছে, তার প্রাণোচ্ছল মেয়েটা ঘরেই আছে। আশা চপল পায়ে বেডের কাছে আসলেন। মাথার নিচে একটা বালিশ, মাথার ওপর আরেকটা বালিশ চেপে মেয়েটা শুয়ে আছে। আশা দ্রুত হাত বাড়িয়ে মাথার ওপর থেকে বালিশ সরালেন। এভাবে শুলে তো নিঃশ্বাস আটকে যাবে যেকোনো সময়! মেয়েটা বুঝেনা কিছুই।
আশা তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়তেই স্রোত নড়েচড়ে উঠল। ঘুম ভালোভাবেই পূরণ হয়েছে তার। কালকে সন্ধ্যায়ই বাড়ি এসেছে। আড়মোড়া ভেঙে পিটপিট করে তাকাতেই স্রোত মিষ্টি হাসল। আশা বেডের কাছে বসে আছেন। ভ্রু সামান্য কুঞ্চিত, ঠোঁটে কেমন আদুরে হাসি। স্রোত উঠে বসে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে নাক ঘষল গালে। বলল,
“ গুড মর্নিং!”
আশা উত্তর দিলেন না। একহাত আপনা আপনি চলে গেল মেয়েটার মাথায়। সাঈম সাহেব কঠোরতার সঙ্গে বাড়ির প্রত্যেকটা বাচ্চাকে মানুষ বানিয়েছেন। এমনকি ইফাদ, ইনানকেও। সাহিদ সাহেবও এতটা জোর খাটাননি তাদের ওপর। বাড়ির একমাত্র মেয়ে বলেই হয়তো স্রোত অনেকখানি ছাড় পেয়েছে কড়া শাসনের। কিছু করলেও দুই বড় ভাই তাকে আগলে রেখেছে।
তবে আশা এতটাও আহ্লাদ করতেন না আগে। যেই না মেয়েটা দূরে গেল, হোস্টেলে উঠল। ওমনি যেন তার বুকটা হাহাকারে ভর্তি হল। কবে মেয়ে বাড়ি আসবে,সেই আশায়ই তার দিন কাটে।
“ তোর আব্বু ডাকার আগে ফ্রেশ হয়ে যা। বিকালে যেতে হবে না?”
“ ওদের বাড়ি কোথায়?”
“ এইতো শহরের দিকটায়। আসার সময় তিনটা বড় বড় বিল্ডিং দেখা যায় যে? ওগুলো ওদেরই।”
স্রোত শুনল। প্রত্যুত্তর দিলনা। আশাকে রেখে সে চলে গেল ওয়াশরুমে। এই ফাঁকে আশা রুমটা গুছিয়ে ফেললেন। সাঈম রহমানের বাল্যকালের বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছেন উনারা। ঘুরতে নয়, পাত্রী দেখতে। হুট করেই এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাঈম সাহেব। তাই কালই সুহাদ গিয়ে নিয়ে এসেছে স্রোতকে। সুহাদের এসবে বিশেষ ভাবাবেগ নেই। বিকালবেলা পাত্রী দেখতে যাবে অথচ সে এখনও বাইরে। বাবা যা বলবে, তাতেই চোখ বুজে সম্মতি আছে তার।
..
সুহাদের গায়ে ধূসর রঙের একটা পাঞ্জাবি। ফর্সা কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সেট করতে করতে সে নামলো দু’তলা থেকে। নিচে বসার ঘরে সবাই রেডি। সাঈম সাহেব আর সাহিদ সাহেব ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছেন। গাড়িতে উঠে না জানি কখন হাঁক ছাড়েন।
ইফাদ উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝাড়ল। গায়ে তার আর ইনানেরও পাঞ্জাবি। তবে অন্য রঙের। সুহাদকে পরখ করে ও বলল,
“ আমার যাওয়ার কি দরকার? পাত্র আসলে কে, সেটা নিয়ে সবাই কনফিউজড হয়ে যাবে, আ’ম প্রিটি সিওর।”
স্রোত আর ইনান একদফা হেসে কুটিকুটি হলো। ইনান বলেই ফেলল,
“ এটাতো আমি বললে খাটতো! তোমার সঙ্গে এসব যায় নাকি?”
সুহাদ ফিক করে হেসে ফেলল। ইফাদ চোখ উল্টিয়ে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করল। স্রোত ইনানের মুখ চেপে ধরল। ইফাদের রাগ ভয়া বহ। তবে তা শুধু ইনানের ক্ষেত্রে। একবার ক্ষেপলে আর রক্ষে নেই।
ইফাদ আজ আর ধমকালোনা। ধুপধাপ শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল। ইমা, আশা দুজনেই তৈরি হয়ে এলেন। আশার কপালে সুক্ষ্ণ ভাঁজ। পাত্রী আগের থেকেই চেনা-জানা। সাঈম সাহেব আগেই দেখিয়েছেন ছবি, সঙ্গে বায়োডাটাও।
তবে সুহাদ ওতশত জানেনা। শুধু নামটাই জানে।
সবাই একে একে বেরোলো। বিকালের শেষ ভাগ। রাতের আগে ফিরতেও হবে।
দূরত্ব ওতটাও না। আধ ঘন্টা বা তার চেয়ে একটু বেশি। জয়পুর নামে গ্রাম হলেও শহর থেকে আহামরি দূরত্ব নেই।
..
নায়ীব সবে গোসল সেড়ে বেরিয়েছে। খাবার টেবিল থেকে তখন হাঁক ছাড়ছেন নাবিদ সাহেব। তিন পদের তরকারি সাজিয়ে রাখা টেবিলে। দুই পদ নাবিদ সাহেবের তৈরি। আরেকটা হেল্পিং হ্যান্ড রান্না করেছে। তাকে মূলত আনাই হয়েছে রান্না-বান্নার জন্য। তবে রান্নাঘরের দায়িত্ব সেই মহিলাকে পুরোপুরি সঁপে দিতে নারাজ নাবিদ সাহেব। নায়ীব বাবার এসব কাজে বেশ বিরক্ত।
নায়ীব গা ঝাড়া দিয়ে এসে বসল চেয়ারে। নিশাতকে এর মধ্যে আরো দু’বার ডাকলেন নাবিদ সাহেব। শেষমেশ নায়ীব হাঁক ছাড়তেই হাজির হলো। চোখ-মুখ তার বড্ড উদাসীন। একটা চেয়ার টেনে বসতেই ভাত ভর্তি প্লেট এগিয়ে দিলেন নাবিদ সাহেব। আগ্রহ নিয়ে বললেন,
“ মাংস আর মাছটা মাস্ট খাবি, আর সবজিটাও। খেয়ে বলতো কোনটা সবচেয়ে বেশি মজা?”
একই কথা তিনি নায়ীবকেও বললেন। মাংস, মাছ নাবিদ সাহেবের রান্না করা। তরকারিটা নতুন আসা মহিলা; রাবেয়ার। তিনি সন্ধ্যায়ই বিদায় নিয়েছেন।
নায়ীব বেশ বুঝতে পারল বাবার প্রশ্নের কারণ। সে সবই খেল। মাঝখানে বলল,
“ তরকারিটা বেশি মজা। শীতকাল আসছে, এ সময় শাক-সবজি বেশি খাওয়া উচিত। খালার রান্না এত খারাপ না,আব্বু!”
নিশাত মাথা নাড়ে কিঞ্চিৎ। বলে,
“ খালার রান্নাটা তো সেই লেভেলের।”
“ আমার রান্নার প্রশংসা তো এভাবে কোনোদিনই করিস নি তোরা!” কাটকাট গলায় বললেন নাবিদ সাহেব। নিশাত অবাক চোখে তাকাল। বলল,
“ আগে এভাবে জিজ্ঞেস করেছো বুঝি?”
নাবিদ সাহেবের মুখ থমথমে। নিশাত কথা বাড়ালোনা এ বিষয়ে। তবে ফের মুখ খুলল,
“ বুঝলে, আজ জোহার সঙ্গে দেখা হলো। খবর পেলাম একটা! স্রোত আপুর নাকি বিয়ে টিয়ে হয়ে যেতে পারে! ভেরি ভেরি স্যাড নিউজ! এত তাড়াতাড়ি বিয়ে? ইশ!”
নায়ীব ভাত মাখিয়ে সবেই লোকমাটা মুখের সামনে হাত উঁচিয়ে ধরেছিল। নিশাতের কথায় হাত নেমে এল আপনাআপনি। বিস্ফো রিত নয়নে নিশাতের দিকে তাকাতেই দেখল নিশাত দুঃখী মুখে ওর দিকেই চেয়ে আছে। চোখ দু’টোয় কি ভীষণ দুঃখ!
নায়ীবের হা করা মুখের দিকে চেয়ে নিশাত মনে মনে কুটিল হাসে। একবার আড়চোখে পরখ করে নেয় নাবিদ সাহেবকেও। তিনি প্রথমে অবাক না হলেও নায়ীবের হতবাক, নির্বাক বনে যাওয়া চোখের ভাষ্য দেখে চরম পর্যায়ের অবাক হলেন। খাওয়া তারও থেমে গেছে। নিশাত দুজনের দিকে পরপর নজর ঘুরিয়ে এক লোকমা মুখে তুলল। চিবানোর মাঝেই হেসে হেসে বলল,
“ কি হলো তোমাদের? খাচ্ছো না কেন?”
নাবিদ সাহেব ভাবনায় ছেদ পড়তেই হাত চালালেন। তবে নায়ীব খুবই ধীরগতিতে খেল। মাঝে আবার প্লেটে আঁকিবুঁকি করল কতক্ষণ। তার ভাবমূর্তির এই অকস্মাৎ পরিবর্তন ফের নজর কাড়লো নাবিদ সাহেবের। নিশাত মুখে ভাত গুঁজে হাসি লুকালো। এরপর তড়িঘড়ি করে হাত ধুঁয়ে উঠে গেল। এরপর উঠল নায়ীব। প্লেট ধুঁয়ে সোজা রুমে চলে গেল। সচরাচর সে খাওয়া শেষ করে বসে যায় টিভি দেখতে। সারাদিনের নিউজ দেখে দেখে বাবার সঙ্গে আলাপ করাই মূলত খাওয়ার পর মুখ্য কাজ। সারাটা দিনের এই এইটুকুন সময় বাবার জন্য বরাদ্দ রাখা তার। অথচ আজ হলো উলটো! নাবিদ সাহেব খাওয়া শেষ করে সোফায় বসে অপেক্ষা করলেন অনেক্ষণ। তারপর নায়ীব না আসায় টিভিতে আর তার মন বসলোনা। উঠে আবার চলে গেলেন শুতে।
..
নায়ীবের দরজা ভিড়িয়ে রাখা ছিল। নিশাত, নাবিদ সাহেব এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছেন হয়তো। নায়ীব তবুও ফিরে এসে দরজা লক করল। এরপর চলে গেল বারান্দায়। আশ্চর্য! নিশাতের কথায় তার মনটা ছলাৎ মে রে উঠল কেন! নায়ীব বেশ বুঝতে পারল তার ফুরফুরা মেজাজ বিগড়ে গেছে অনেক আগেই। অসহ্য রকমের মন খারাপও হচ্ছে। অদ্ভুত! এই ঠান্ডা আবহাওয়াকেও সে পাত্তা দিচ্ছেনা। গায়ে পাতলা টিশার্ট জড়ানো। অথচ শীতল, গা হিম করা হাওয়া বয়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে। ঘরে সিগা রেটও অবশিষ্ট নেই। বারান্দা জুড়ে খানিক্ষণ চপল পায়ে রাউন্ড দিলো ও। এরপর কি ভেবে ফোন বের করল। রাত বাজে প্রায় বারোটা। মানুষটা জেগে থাকবে তো? সেদিন তো ছিল! ওতশত ভাবনারা আর ঠাই করতে পারলনা মস্তিষ্কে। নায়ীব কল লাগাল সোজা। এরপর ফোন চেপে ধরল কানে।
চলবে.
#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—১৪
আজ গগনে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। থালার মত গোল। ঝকঝকে আলো ছড়াচ্ছে। বিন্দু পরিমাণ মেঘ নেই চারপাশে। অথচ বিকেলেই আবহাওয়া কেমন বৃষ্টিমুখোর ছিল। স্রোত বিরস মুখে বিছানার এক কোণায় বসে আছে। জানলার একটা কপাট খোলা। রাত বিরাতে জানলা খোলা নিয়ে ঘোর নিষেধ আছে ইমার। নিশির ডাক না কি নিয়ে তিনি প্রায়ই ভীত থাকেন। সেসবে তিনি বাদে কেউই বিশ্বাস করেন না। আশাও না। রাতেও জানলা খুলতে নিষেধ করে গেছেন ইমা। অথচ এই রাত-দুপুরেই তার কথা অমান্য করল স্রোত। মনটা আজকাল বেশ অন্যমনস্ক থাকে। আনচান করে। বিকাল অব্দি তো সবই ঠিক-ঠাক ছিল। রাতে হলো সব গোল-মাল!
..
রাতের খাবারটা আলিফ শেখ অর্থাৎ সাঈম রহমানের সেই বন্ধুর বাড়িতেই খাওয়া হয়েছে। রাত ন’টার আগেই বাড়ি ফেরা হয়েছে। এরপর যে যার রুমে চলে গেলেও সাঈম সাহেব আর সাহিদ সাহেব এসে বসেন বিশাল বসার ঘরটায়। এই বিশালাকার বাড়িটা প্রায় সময়ই নিস্তব্ধতায় ঘেরা থাকে। মানুষ আর কজনই বা!
শহরে পাড়ি দেয়ার আগে এখানে একটা কারখানা আছে। পোশাক কারখানা। দিনদিন সেখানকার উন্নতি হচ্ছে। সাঈম রহমানের প্রথম কারখানা এটাই! আরো একটা আছে, তবে সেটা পৈত্রিক বলা যায়। সাহিদ সাহেবও অংশিদার। তবে এখানের টায় তাদের সঙ্গে আরেকজনও সামিল! আলিফ শেখ! তিনি ভালো বন্ধুর পাশাপাশি বিজনেস পার্টনারও। এবার বোধহয় সম্পর্কটা একদম পাকাপোক্ত হয়ে যাবে সারাজীবনের জন্য। আলিফ শেখের একমাত্র মেয়ে; রোজ। পড়ালেখা করে বাবার বিজনেসে যোগ দিতে চাইছে ঠিক সুহাদের মতই। অনলাইনেও তার ব্যবসা আছে নিজস্ব। এই ব্যাপারটা সুহাদের নজর কেড়েছে। সে বরাবরই এমন কাউকে প্রাধান্য দিবে, যে তাকে বুঝবে। তার কাজকে বুঝবে। অলস-টলস সুহাদ দেখতে পারেনা বলতে গেলে। মেয়েটাকে আজ দেখেছে সে। মিষ্টি ভাষী, শালীন খুব। মার্জিত কথা বলার ভঙ্গিমা! আকৃষ্ট করে সকলেই। সর্বপ্রথমেই আকৃষ্ট করেছে আশাকে। চোখ-মুখে শহুরে ছাপ আবার মার্জিত আচার-আচরণ! সোনায় সোহাগা একেবারে! ইমা খুশিতে গদগদ হয়েছেন তাতেই! আশাকে কতবার ঠ্যালা দিয়েছেন হিসেব নেই।
সাঈম রহমান বসেই ছিলেন। কালকে বোধহয় কোথাও যাবেন। এসব বলতে বলতে হঠাৎ চোখ গেল সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা সুহাদের দিকে। হাতে পানির জগ। গায়ে পাতলা টিশার্ট আর ট্রাউজার। কাপড়-চোপড় এসেই পালটে ফেলেছে। চোখে-মুখে ঘুমের রেশ। সাঈম সাহেব ডাকতেই ঘুম হুড়মুড় করে পালালো। তাড়াহুড়ো করে আসার ক্ষণে পানিও ছিটকে পড়ল জিগ থেকে। সেসবও তোয়াক্কা করলনা সে। সাঈম সাহেব আহাম্মক বনে কেঁশে উঠলেন। মুহুর্তের মাঝেই হাজির হল সুহাদ। প্রশ্ন নিয়ে তাকাতেই সাঈম রহমান বললেন,
“ বস, জগটা রাখ।”
সুহাদ বসল সোফায়। মনোযোগ দিল বাবার পানে। কপাল সামান্য কুঞ্চিত তার। অথচ সাঈম সাহেব স্বাভাবিক চিত্তে বসা। অত্যন্ত ঠান্ডায় গলায় তিনি বলা শুরু করলেন,
“ আলিফ বলছিল, বিয়ে-শাদির ব্যাপারটা একটু ঠিকঠাক করে রাখতে। যেহেতু ওদেরও একটা প্রস্তুতির ব্যাপার আছে আর সাথে আমাদেরও। তুমি বাড়ির বড় ছেলে আর ও বাড়ির একমাত্র মেয়ে রোজ! বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই! কেবল দুই পরিবারই না, আমার রাজনৈতিক-ব্যবসায়ীক অনেক ব্যক্তিদেরই দাওয়াত আছে। তোমার মায়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা শেষ। তুমি যা বলবে তার উপরই ডিপেন্ড করবে বাকিসব।”
সাহিদ সাহেব কথার মাঝে নিরবে সম্মতি দেন। সুহাদের কি হলো কে জানে! ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে হুট করে বলে উঠল,
“ আব্বু! আমার একটু হলেও সময় প্রয়োজন। আমার আপত্তি নেই এ ব্যাপারে। তবে আমার এসব ব্যাপারের আগে স্রোতের একটা গতি করলে হয়না?”
কথাটা বলেছে সে একদম ফাটাফাটি সময়ে। স্রোত আশার রুম থেকে বেরিয়েছে সবে। বাড়িটা ডুপ্লেক্স হলেও সিঁড়িটা মূল ফটকের দিকে। নিচ তলায় বড়দের রুম। উপরে একে একে সুহাদ, ইফাদ, স্রোত আর ইনানের রুমসহ আরো তিনটা রুম। খালিই থাকে সেগুলো।
স্রোতের কানে সুহাদের কথা পৌঁছাতেই মস্তিষ্কের গতি কমে গেল। ওষ্টদ্বয় সামান্য ফাঁকও হয়ে গেল বিষ্ময়ে। স্রোতের গতি করবে মানে কি? ব্যাপারটা আরো খোলসা হলো যখন সুহাদ মৃদু স্বরে ফের বলতে লাগল,
“ স্রোত বংশের একমাত্র মেয়ে, আব্বু। আমি ব্যবসা দেখছি, ইফাদও চাকরি পেয়ে যাবে সামনের বছর। ইনানের অনেক দেরী। কিন্তু স্রোত? চাকরি-বাকরির প্রতি ওর বিশেষ আগ্রহ আমি দেখিনা। আমাদের ব্যবসার চাপ ও সামলাতে হিমশিম খাবে। ও চাইলে অবশ্যই করতে পারবে। কিন্তু ওর বিশেষ আগ্রহ এতেও আমি দেখিনি কখনো।”
সুহাদ স্রোতকে স্রোতের চেয়েও বেশি চিনে। স্রোত গুনে গুনে তার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। ছোট থেকে কোলে পিঠে করে সে-ও মানুষ করেছে স্রোতকে। স্রোত ভীষণ ভাবুক হয়ে পড়ে এবার। সত্যিই তো! পড়ালেখা শেষ করে করবেটা কি সে? টপ তো করেই গেল সবসময়। এইম ইন লাইফ প্যারাগ্রাফে একেকবার একেক পেশা দিয়ে এসেছিল স্কুল লাইফে। এই সময় এসে মনে পড়লো, তার লাইফে এইমের খুব অভাব। সে করবেটা কি? নতুন চিন্তা মাথায় চেপে বসলো তার!
চাকরির ইন্টারভিউ শুনলেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তার ভ্রান্ত ধারণা,এই ক্ষণ পাত্রী দেখতে আসার ক্ষণের মতই। নার্ভারনেস বেশি কাজ করে। ব্যবসার কথা স্বপ্নেও ভাবেনা সে। এতেও তার ভ্রান্ত ধারণা; লস খেলে মুখ দেখানো যাবেনা। আচ্ছা, কোনোভাবে কি টিউশনিকে ফুল টাইম জব হিসেবে নেয়া যায়ন? যদি যায়, তবে সে সারাজীবনই জোহাকে পড়িয়ে যাবে!
ধ্যান ছুটে স্রোতের। পেছনে আশা এসে দাঁড়িয়েছেন। তার অস্তিত্ব টের পেতেই হনহন পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল স্রোত।
..
বর্তমানে মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে স্রোতের। একে মস্তিষ্ক এসব কিছুর সঙ্গেই তাল মেলাতে পারছেনা। অন্যদিকে আবার মনে ভাইয়ের প্রতি পাহাড় সম অভিমান জমে গেছে! ভাই কি তার সঙ্গে এসব আলোচনা করতে পারতোনা আগে? সোজা বাবার কাছে যেতে হলো? বাবার কানে যাওয়া মানে গুরুতর ব্যাপার সেটা। সাঈম রহমান কিছুতেই ক্ষান্ত হবেন না এ ব্যাপার মিটমাট না করে। পারলে কালই না কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন! মনটা উশখুশ করে উঠল স্রোতের। যদি বাবা বিয়ের কথা বলে? কি বলবে স্রোত! হ্যাঁ-না, জবাব তো একটা দিতেই হবে। স্রোতের দৃঢ় বিশ্বাস, বাবা তার অনুমতি ব্যতীত কিছুই করবেন না। তবে স্রোতকে জিজ্ঞেস যদি করা হয়, সে অনুমতি দিবেই বা কি? বিয়ের কথা ভাবতেই স্রোতের শরীর হিম শীতল হয়ে গেল। শরীর কেমন ভার ছেড়ে দিচ্ছে। শুভ্রাকে ভীষণ মনে পড়ছে তার! ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চয়ই এতরাতে! সেই সাথে আরেকজনকেও খুব মনে পড়ছে! নায়ীব! ইশ! কি অদ্ভুত! এই ক্ষণে তার ওই পাষা ণ লোককে মনে পড়ছে কেন! কোনো কারণই তো নেই মনে পড়ার! তাকে ঘুরে ফিরে একবারও খেয়াল করেনা! যা খেয়াল করার স্রোত একাই করেছে। আর করবেনা। চোয়াল শক্ত করে ফোঁস শব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেই ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠল। হকচকিয়ে উঠল স্রোত। সামান্য ভয়ও পেল। এক ধ্যানে বাইরে চেয়ে ছিল! তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে তুলে নিল। ওমনি চক্ষুদ্বয় চড়কগাছ! চোয়াল ঝুলে পড়ার উপক্রম। ফোন রিসিভ করেও আবার সেভ করা নাম্বারটায় চোখ বুলালো স্রোত। ওপাশ থেকে তখন রাশভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। স্রোত কানে ঠেকাতেই শোনা গেল কণ্ঠও,
“ স্রোত?”
সমুদ্রের শান্ত, শীতল স্রোতের মতন কণ্ঠ। অথচ তাতেই বিপরীতটা ঘটলো। বক্ষে উথাল-পাথাল শুরু হলো। স্রোতের গলা শুকিয়ে এল। কণ্ঠ রোধ হলো। মনে হলো এমন আকুল বানানো, প্রাণনা;শকারী কণ্ঠ সে আগে শুনেনি। এমন গলার ডাক তবুও উপেক্ষা করতে পারলনা ও। ওষ্ঠ ফাঁক হলো সামান্য, বের হলো একটি শব্দ,
“ জ্বি?”
“ শুনলাম বিয়ে করছেন?”
কেঁশে উঠল স্রোত। শুকনো গলার আওয়াজ শুনতে পেল ওপাশের মানুষটা। ভেতরের চরম উদ্বিগ্নতা না দেখাতে গিয়েও যেন বাধ্য হয়ে বলল,
“ পানি খান!”
স্রোত তা-ই করল। উঠে টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাস মুহুর্তেই খালি করল। এর মধ্যে ভুলেও ফোন সরালোনা কান থেকে। এরপর আবার এসে বসল বিছানায় পা দুলিয়ে।
এরপরই ভাবতে লাগল, এই লোক এ ব্যাপারে জানল কি করে? ঘরে স্পাই-টাই লাগানো নাকি? সাংঘা তিক! কস্মিনকালেও তা সম্ভব নয়! আবার মস্তিষ্ক হইহই করে জানাল, সম্ভব না হলে এই দাম্ভিক মানুষ এসব ব্যাপারে জানল কি করে? তাও সোজা প্রশ্ন করে বসল!
“ কাঁশি থামলে জবাব দিন।”
“ জ..জ্বি?”
“ বিয়ে করছেন আপনি?” এবার রাশভারি শোনাল গলা। স্রোত আহাম্মক বনে গেল। বলল,
“ জ্বি…না! কি বলছেন কি?”
“ জানতে চাইছি। বিয়ের স্বপ্ন দেখছেন জেগে জেগে? এত রাত অব্দি জেগে আছেন এজন্যই বোধহয়!”
স্রোত ভ্যাবাচেকা খেল। তবে নিজেও দমলনা। আরেকটু বাজাতে বলল,
“ আমি ঘুমিয়েই ছিলাম মিষ্টার! আপনার কলেই ঘুম ভাঙ্গল আমার!”
“ ডিস্টার্ব করেছি,বোঝাচ্ছেন? সে যাইহোক, কথার তেজে তো মনে হচ্ছেনা ঘুমে ছিলেন। এত তাজা কণ্ঠের স্বর!”
আবার বিষম খেল স্রোত। এই অফিসার সাহেবের হলো কি অকস্মাৎ! সত্যিই এ নায়ীব ইয়াকীনই তো? নাকি অন্য কেউ? কণ্ঠতে তো নায়ীবই লাগছে। কিন্তু আজ কথার ধাঁচ, কথার বাক্য, বাক্যের প্রতিটা শব্দ কেমন আগের নায়ীবের থেকে আলাদা আলাদা! অদ্ভুত অথচ দারুণ ঈর্ষান্বিত!
স্রোত সময় নিয়ে প্রত্যুত্তর দিল,
“ কণ্ঠ আবার তাজা হয় কীভাবে?”
“ এইযে, এভাবে! যেভাবে এখন কথা বলছেন।”
ফটাফট উত্তর এল। স্রোত নিশ্চুপ বনে গেল। ওপাশের মানুষটা আর কিছুই বললনা। চাঁদের ঝলমলে আলোয় ফোন কানে ঠেকিয়ে মাথা নুইয়ে বসে রইল স্রোত। ওপাশ থেকে হঠাৎ গা হিম শীতল করা একটা বাক্য ভেসে এল,
“ আপনাকে বোধহয় আমার সামনা সামনি দেখতে মন চাইছে, স্রোত!”
চলবে.
#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—১৫
আজ আশার বদলে রুমে এসে হানা দিলেন সাঈম সাহেব। তবে তিনি আসার আগেই স্রোত ঘুম থেকে উঠে গেছে। বিছানায় বসে ছিল কেবল। এলোমেলো চুল হাতের সাহায্য সামান্য ঠিক করতে করতে দৃষ্টি নিল দরজার দিকে। সাঈম সাহেব সটান হয়ে দাঁড়িয়ে। সামান্য অগোছালো রুমটায় চোখ বুলাচ্ছেন। স্রোত ডাকল,
“ আব্বু, দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“ দেখছি। রুমে রঙ করাতে চাও?”
প্রশ্নটা এমনি এমনি করা। রুমে বছর দুয়েক আগেই রঙ করানো হয়েছে স্রোতের পছন্দে। হালকা গোলাপি রঙের। স্রোত মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ না,আরো দিন যাক। থাকিই বা কদিন এখানে?”
“ হুম..” গম্ভীর গলায় প্রত্যুত্তর দিলেন তিনি। এরপর এসে দাঁড়ালেন জানলার ধারে। মেয়েটা বিছানা থেকেই তো উঠেনি। জানলা খোলা কীভাবে?
আশা তো আসেননি সকালে; তিনি জানেন। তাও প্রশ্ন করলেন,
“ জানলা খোলা ছিল সারারাত?”
“ উহুম! ভোরে গরম লাগছিল, তাই খুলেছি।”
বলতে বলতে উঠে পড়ল স্রোত। বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কটা কিছুটা অন্যরকম। বন্ধুত্বপূর্ণ বলা যায়না। আবার রুঢ়ও বলা যায়না। মাঝামাঝি। সমস্যায় পড়লে স্রোত সুহাদকে বলতে ভয় পেলে সাঈম সাহেবকে বলে। সুহাদ বোনের ক্ষেত্রে ভীষণ পসেসিভ। হাইপারও হয়ে যায় অনেক সময়।
সাঈম সাহেব আরো কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করলেন। স্রোত এর মধ্যে ফ্রেশ হয়ে আসলো। সাঈম সাহেবকে বেশ উশখুশ দেখাচ্ছে। কিছু বলতে চান বোধহয়। বলতে পারছেন না। স্রোত বুঝে ফেলল। ওমনি মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। বাবা কি এখনই তাকে বিয়ে-টিয়ে নিয়ে লেকচার দিবে? তাহলে ভীষণ দোটনায় পড়বে স্রোত। তবে সাঈম সাহেব ওতকিছু বললেন না। কেবল যাওয়ার আগে বলে গেলেন নিচে গিয়ে নাশতা করতে। স্রোত রাতে ভীষণ স্বস্তি পেল। উনি বেরিয়ে যেতেই চটজলদি ব্যাগে কাপড় ভরলো গোছানো ছাড়াই।
..
সকাল ন’টা। টেবিলের দুই মাথা খালি। কর্তাগণ অনেক আগেই খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে চলে গেছেন। সুহাদ আজ দেরীতে যাবে। সে একটা চেয়ার দখল করে বসে আছে। পাশেই ইনান। তার মুখোমুখি ইফাদ। তার পাশের চেয়ারটায় স্রোত এসে বসল। ইফাদ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। বলল,
“ ওরেব্বাস! এত সকালে উঠলি আজ?”
ইনান ফোঁড়ন কাটে,
“ কই সকাল? ন’টা বাজে!”
স্রোত বিরক্ততে ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ বাড়িতে এসেও কি শান্তিতে ঘুমাতে পারবনা?”
“ শশুরবাড়ি গেলেই সব ঘুম টাটা-বাই-বাই করে পালাবে। যা ঘুমানোর এখনই ঘুমিয়ে নাও।” মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠল ইফাদ। স্রোতকে সে খোঁ চাতে ভালোবাসে। তবে আজ একটু ভিন্ন জায়গায় কোঁ প দিয়েছে। কথা শেষ হতেই সুহাদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ইনানও তাকাল সহসা। সুহাদের চোখে শা-সানো দৃষ্টি, ইনানের অবাক। ইফাদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সে না বুঝেই কথাটা বলেছে। কালকের আলোচনায় সে ছিলোই না। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল স্রোতের চেহারা-সুরত শান্ত, এক ধ্যানে চা পান করছে! যেন কিছু শুনতেই পায়নি। সুহাদও এটা খেয়াল করল। তাই আর বেশি কিছু বললনা।
..
নায়ীব ঘুমিয়েছে রাত দু’টোর দিকে। উঠার পর থেকেই বুকের ভেতর অনুভূতির তীব্র,উথাল-পাথাল জোয়ার সে টের পাচ্ছে। রাত-বিরাতে একজন মেয়েকে ফোন দেয়া, উদ্ভট কথা বলা, একজন পুলি শের সঙ্গে নিশ্চয়ই যায়না? তবে ব্যক্তি ক্ষেত্রে হয়তো যায়! তাই এসব কাজকে অন্যায় ভাবা অযৌক্তিক। নায়ীবের যা ঠিক মনে হয়েছে, সে তা-ই করেছে।
ও ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এসেছে। নাশতা করেনি। সামনে জিহাদ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তিনটে নীল রঙের ফাইল। কি যেন বলছিল এতক্ষণ! নায়ীব খেয়াল করেনি। ভ্রু নাঁচিয়ে তাই জিজ্ঞেস করল,
“ কি যেন বলছিলে?”
“ কিছুনা, স্যার। এই ফাইলগুলো লাগবে বলেছিলেন। তাই আনলাম।”
“ ওহ হ্যাঁ, রেখে যাও।”
জিহাদ তা-ই করল। যেতে যেতে আবার বাঁকা চোখে তাকাল। টানা পাঁচ মিনিট সে ফাইল তিনটে নিয়ে ভাষণই ছেড়েছে একপ্রকার। প্রত্যেকটা ডিটেইলসই মুখস্থের মত আওড়াচ্ছিলো। তার কিছুই শুনলনা নায়ীব? অদ্ভুত! এত কি ভাবে আজকাল?
..
স্রোত রুমে ফিরে আসলো। ফোনটা বিছানার একপাশে পড়ে আছে। তড়িঘড়ি করে সেটা হাতে তুলে নিল। যতবারই ফোন হাতে নিচ্ছে, বারবার চোখ যাচ্ছে কল লিষ্টে। দেড় মিনিটের কল রেকর্ডটা যদি আবার শোনা যেত? সবকিছুই যেন ভ্রমের মত লাগছে স্রোতের কাছে। কল লিষ্টে রেকর্ড না থাকলে বোধহয় সে বিশ্বাসই করতোনা কাঠখোট্টা মানুষটা তাকে কল দিয়েছিল, কথাও বলেছে কিসব! গাল দু’টোয় লাল আভা নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ল তার। ফোনটা হাতে নিয়ে বসে রইল। ওমনি ফোনটা বেজে উঠল। কেঁপে উঠে স্ক্রিনে তাকাতেই শুভ্রার নামটা ভেসে উঠল। চট করে কল রিসিভ করতেই চঞ্চল গলায় শুভ্রা বলল,
“ কবে আসবি রে?”
“ আজই।”
“ ওমা! তুই না আরো এক সপ্তাহ থাকবি?”
“ না, পরে আবার আসব। জোহার এক্সাম সামনে।”
“ কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো তোর?”
“ কেমন? তাজা-তাজা?” চটপটে শোনাল তার গলা। শুভ্রা ফিক করে হেসে ফেলল। একপ্রকার গড়াগড়িই খেল ওপাশে। স্রোতের গলা থেমে থেমে শোনা যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে। এবার চটপটে গলার উদ্ভট কথা শুনে সে হাসার বদলে আর কিই বা প্রতিক্রিয়া দিবে! স্রোত আহাম্মক বনে গেল। শুভ্রার হাসির শব্দে লজ্জাও পেল। কি থেকে কি যে মুখ থেকে বের হয়!
“ পরে কথা বলব। রাখি।” শুভ্রার প্রত্যুত্তর শোনা আগেই কল কেটে দিল স্রোত। উঠে দাঁড়াতেই ভিড়িয়ে রাখা দরজায় টোকা পড়ল। স্রোত তড়াক করে তাকাল। বলল,
“ আসো!”
সুহাদ ঢুকল। দরজাটা পুরো খুলে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ দিন দুপুরে দরজা বন্ধ করে থাকিস কীভাবে?”
স্রোত তাকাল না। টেবিলের উপর কিছু পুরোনো বই রাখা। সেগুলো নেড়েচেড়ে বলল,
“ অভ্যাস আছে।”
সুহাদের ভ্রু সোজা হলো। বলল,
“ আজই যেতে হবে?”
“ হুম।”
“ আর দুই তিন দিন থাকা যেত না!”
“ তোমার বিয়ে হলে থাকতাম। বিয়ে তো তুমি এখন করছো না!”
সুহাদ চমকাল। সন্দিহান গলায় বলল,
“ মানে?”
“ কাল শুনেছি সব।” মুখটা কেমন অভিমানে ফুলে গেল স্রোতের। সুহাদ আরেক দফা চমকাল। তারপর আবার স্বাভাবিক হলো। ব্যাপারটা স্রোতের বিষয়ে, সে জানলে ক্ষতিই বা কি?
সুহাদ হাসল স্রোতের চেহারা দেখে। বলল,
“ সব শুনেছিস?”
“ হু..”
“ তাহলে তো ভালো। বিয়ে-শাদির জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকাও প্রয়োজন।”
“ ভাইয়া?” অবিশ্বাস্য চোখে ফিরে তাকাল স্রোত। সুহাদ হাসি থামিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ে। স্রোত বিরস গলায় বলল,
“ আমি বিয়ে করবনা এখন।”
“ এখন করতে কে বলছে? লং একটা প্রসেসিং আছে এসবের। তবে আব্বু চাইলে সব সম্ভব। হাতে কিন্তু অনেক ভালো পাত্র আছে, অনেকে আবার আব্বুর বিশেষ পছন্দের।” সুহাদ বলতে বলতে গা ঝাড়া দেয়। স্রোত হতবাক চোখে তাকায়। সুহাদের ভাব ভঙ্গিমায় বোঝাই যাচ্ছেনা যে সে মজা করছে! স্রোত পাক্কা দু’মিনিট সেভাবেই তাকিয়ে রইল সুহাদের দিকে। হতবাক, অবিশ্বাস্য নজর। সুহাদ আড়চোখে দেখে বলল,
“ কি হলো? মুখ বন্ধ কেন?”
“ কিছুনা। কখন বের হব?”
“ বিয়ের কথা শুনেই তাড়াহুড়ো শুরু? পালালে তো হবেনা।”
“ ভাইয়া! কখন বের হবে সেটা বলো..”
“ এত আর্জেন্ট যাওয়ার কারণ কি!”
দু’টো বই হাতে তুলে নেয় স্রোত। ব্যাগের ভেতর রাখতে রাখতে বলে,
“ আমার একমাত্র টিউশনটা খোয়াতে চাইনা। জোহার এক্সাম সামনে। আন্টি এমনিতেই এতদিন ছাড় দিয়েছেন!”
“ জোহার জন্য তো যাচ্ছিস না!”
হাত থেমে গেল স্রোতের। জমে গেল যেন। কেবল নিঃশ্বাসটুকুই ফেলল কোনোমতে। সুহাদ ঘাড় ঘুরাল। স্রোতের অবস্থা দেখে প্রশ্ন করেই বসল,
“ কার জন্য এত তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছিস? সত্যি করে বল!”
চলবে.