#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৪৯
উষ্ণ ছোঁয়া। অথচ তার বিপরীতে স্রোতে সম্পূর্ণ চিত্ত বরফের মত শীতল। নায়ীব এবার একহাতে তার কপাল ছুঁলো। লহু স্বরে জানতে চাইলো,
“ ঠান্ডা লাগছে?”
দু’পাশে মাথা দুলালো স্রোত। নায়ীব ফের বলে,
“ আমার প্রশ্নের উত্তর তো দিলেন না।”
স্রোত দু’হাতে ঠেলে তাকে। অথচ বল প্রয়োগ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে নায়ীব। স্রোত ব্যর্থ হলো। নাক ফুলিয়ে তাকাতেই নায়ীব চোখে হাসে।
“ ছাড়ুন, কেউ চলে আসবে।”
“ কেউ আসুক আগে,তারপর ছাড়বো।”
স্রোত হকচকায় এবার। নাবিদ সাহেব গভীর মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছেন। নিশাত রুমে দরজা আটকে বসে আছে। দুজনেই মহা ব্যস্ত। এদিকে আসার সম্ভাবনা নেই। সে হিসাবে ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই আপাতত। স্রোত ব্যস্ত গলায় বলল,
“ ক্ষিদে পায়নি আপনার?”
মাথা নাড়ায় নায়ীব,
“ সে একটু-আধটু পেয়েছে। কিন্তু এখন খাবোনা।”
স্রোত নড়চড় শুরু করল। ছাড়াতে চাইল নিজেকে,
“ ছাড়ুন। লজ্জা লাগছে আমার।”
নায়ীব ছোট ছোট চোখে তাকালো। একসময় হাতের বাঁধন ঢিলে হতেই স্রোত দ্রুত বাঁধনছাড়া হলো। নায়ীব কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
“ ওকে,ফাইন। ছাড়লাম। কিন্তু ঘর থেকে বেরোবেন না। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন আগে!”
স্রোত লম্বা দম টানে। আরক্তিম গাল দু’টোয় লজ্জার ছাপ স্পষ্ট। মিইয়ে আসা কণ্ঠে আড়ষ্টতা মিশে যায়,
“ আপনার যখন মন চায়, তখন খাওয়াবেন। আমাকে জিজ্ঞেস করার কি আছে?”
বলেই মেয়েটা ছুটলো। বেরোনো আগে নায়ীবের উচ্চ হাসির আওয়াজ কানে এসে ধাক্কা খায়।
..
“ ওয়াহিদ কে?”
নিশাত দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে। এটা তার বদভ্যাস। এজন্য নায়ীব তার হাতে বাড়িও দিতো ছোটবেলা। তবে আজ দিচ্ছেনা।
“ কিছু জিজ্ঞেস করেছি!” নায়ীবের শান্ত স্বর। অথচ তাতেই নিশাতের অক্ষিকোটরে জল জমলো। ভ্যা ভ্যা করে কান্না করা থেকে তবুও সে নিজেকে আটকে রেখেছে। ও কেবল দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করল,
“ ভাইয়া, তুমি কি আমাকে মা-রবে?”
নায়ীব হতভম্ব হয়ে গেল এমন কথায়। তবে তা বুঝতে দিলনা নিশাতকে। কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পড়ে তার। আগের ন্যায় গম্ভীর থাকল,
“ শুধু মা-রবোনা। নদীতে ভাসাতেও পারি। শেষ বারের মত জিজ্ঞেস করছি, ওয়াহিদ কে?”
এবার সত্যি সত্যিই নিশাত উচ্চস্বরে কেঁদে ফেলল। ভ্যা ভ্যা শব্দের এই কান্না কানে ঢুকতেই নায়ীব এবার নড়েচড়ে বসলো। শোয়ার ঘর থেকে ছুটে এল স্রোত। নাবিদ সাহেব মসজিদে গেছেন। বাসায় আপাতত ওরা তিনজনই।
স্রোত এসে নিশাতের এ অবস্থা দেখে হকচকালো। দ্রুত কাছে এসে বলল,
“ কি হয়েছে, নিশু? কাঁদছো কেনো?”
সে উত্তর দিলনা। বরং কান্নার বেগ বাড়ালো। স্রোতের তীক্ষ্ণ নজর এবার নায়ীবের দিকে তাক হলো। সে কটমটে গলায় জানতে চাইলো,
“ কি বলেছেন ওকে? বকেছেন কেনো?”
নায়ীব এবার চোখ রাঙিয়ে তাকালো,
“ ওকে অযথা বকবো কেনো? একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি। উত্তর না দিয়ে কাঁদছে।”
“ কি প্রশ্ন?”
“ ওয়াহিদ কে?”
এবার চোখ সরালো স্রোত। আমতা আমতা করে বলল,
“ আমাকে চোখ রাঙাচ্ছেন কেনো? আমি কি করলাম?”
নায়ীব এবার নিশাতের দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠল,
“ এ্যাই তোর রেডিও অফ করবি?”
নিশাত কান্না থামালোনা। তবে কান্নার বেগ কমলো তার। ফ্যাচফ্যাচে আওয়াজে কান ধরে যাচ্ছে নায়ীবের। ও কপাল কুঁচকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“ বল,ওয়াহিদ কে! ঝটপট অ্যান্সার দে!”
“ কেউ না, ভাইয়া। কেউ না।”
“ দিব ধরে এক চ-ড়! কেউ না হলে এত রাতে ম্যাসেজ দিচ্ছে কেনো?”
নিশাত অসহায় চোখে স্রোতের দিকে তাকালো। স্রোত ঠোঁট উলটে বোঝাল, তার কিচ্ছুটি করার নেই।
নায়ীব উঠে গেল। সঙ্গে জব্দ করলো নিশাতের ফোন। নিশাত সে রাত ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদেই কাটালো। মনে মনে দোয়া করল,ওয়াহিদ যেন আজ আর ম্যাসেজ না দেয়। দোয়া বোধহয় কবুল হয়েছে। ওয়াহিদ রাতে আর ম্যাসেজ দেয়নি।
সকাল হতেই নিশাত চুপিচুপি উঁকি দেয় নায়ীবের রুমে। স্রোত রান্নাঘরে। চা বানাচ্ছে। আজ শুক্রবার,নায়ীব উঠবে অনেক পরে।
ও এবার রান্নাঘরে হানা দেয়। পিছু হতে লহু কণ্ঠে ডাকে,
“ ভাবী! ও ভাবী!”
স্রোত হকচকিয়ে তাকায়,
“ ওহ, নিশু! তুমি! এভাবে চো রের মত ডাকছো কেন? ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে!”
নিশাত এগিয়ে এল। ফ্যাকাশে মুখটা দেখে স্রোতের বড্ড মায়া হলো। এক হাত বাড়ায় ও। মাথায় বুলিয়ে বলে,
“ এত কান্না করলে কেনো? ফোন এমনিতেই দিয়ে দিবে তোমার ভাই। হঠাৎ রাগ উঠেছে তো, কমেও যাবে।”
“ ভাবী!”
বলতে বলতে ঠোঁট উল্টায় নিশাত।
স্রোত শান্ত গলায় অকস্মাৎ প্রশ্ন করে,
“ ওয়াহিদ তোমাকে ভালোবাসে?”
ত্বরিত উপর নিচ মাথা দুলায় নিশাত।
“ তুমিও ওকে ভালোবাসো?”
এ প্রশ্নের জবাবেও নিশাত মাথা দুলায়। লজ্জায় তার ম-রি ম-রি অবস্থা। স্রোত চা ঢালতে ঢালতে বলে,
“ যাও,পড়তে বসো। তোমার ভাইয়ার সঙ্গে আমি কথা বলবো।”
নায়ীব উঠার আগেই স্রোত এককাপ চা নিয়ে হাজির হলো। বেড সাইডে রেখে ঝুঁকলো ওর দিকে। মিষ্টি গলায় ডাকল,
“ নায়ীব, উঠুন!দশটা বাজে।”
নায়ীবের মস্তিষ্ক সজাগই ছিল। সে চোখ মেলে তাকাতেই স্রোত মিষ্টি করে হাসলো। থমকালো নায়ীব। উঠে বসতে বসতে দারুণ চিন্তা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ গোসল করেছেন কেনো এত সকালে? ঠান্ডা লাগলে?”
“ লাগবেনা। নিশাতের ফোন কোথায়?”
নায়ীবের চোখ-মুখ শক্ত হলো সঙ্গে সঙ্গেই। কঠিন গলায় বলল,
“ কেনো? সেটা দিয়ে আপনি কি করবেন?”
“ আপনি আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছেন?”
“ না,দেখাচ্ছিনা। ফোন আমার কাছে থাকবে। ওয়াহিদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর বায়ো-ডাটা বের করতে আমার এক ঘন্টাও লাগবেনা। তারপর দেখাচ্ছি মজা..”
স্রোত জ্বিভ কাটে,
“ এভাবে বলেনা। দেখি ফোনটা দিন। নিশাত সারারাত কান্না করেছে। মুখটা এত ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে! কখন না জানি আব্বু জিজ্ঞেস করে বসেন।”
নায়ীব অদ্ভুত চোখে তাকাল,
“ আপনি ওর পক্ষ নিচ্ছেন?”
স্রোত কাঁধ উঁচাল,
“ এখানে তো মা-রা-মা-রি চলছেনা যে পক্ষ বাছাই করবো। সামান্য একটা ব্যাপারে..”
নায়ীব এবার গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে,
“ সামান্য ব্যাপার? এটা সামান্য হলে অসামান্য কোনটা?”
তার এমন চেঁচানো বসার ঘর থেকে শোনা গেল। নাবিদ সাহেব নিউজ পেপার পড়ছিলেন। ছেলের এত উচ্চ আওয়াজে তিনি চিন্তিত গলায় হাঁক ছাড়লেন,
“ নায়ীব! কি হয়েছে?”
নায়ীব দমে গেল। চোখ তুলে তাকানোর আগেই স্রোত হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।
..
পুরো সকাল আর স্রোত রুমে এলোনা। নায়ীব বিরস মুখে অনেক্ষণ অপেক্ষা করলো। কয়েকবার ডাকলেও সাড়া পেলনা। শেষমেশ গোসলে ঢুকলো। এই ফাঁকে একবার রুমে এলো স্রোত। বিছানা গোছাতে গোছাতে সে জহুরি চোখে ফোনটা খুঁজলো। পেলনা!
বেরিয়ে যাওয়ার আগেই খট করে বাথরুমের দরজা খুলে গেল। নায়ীব সময় খোয়ালো না,দানবের মত দুই কদম ফেলে এসে স্রোতের হাত টেনে ধরলো। দরজাটাও পা দিয়ে ঠেলে লক করলো।
উদাম,ভেজা শরীরে শরীর লাগতেই স্রোত লাফিয়ে উঠে। গা মুছেনি নায়ীব। তার শরীরের পানিতে স্রোতের কামিজ ভিজে যাচ্ছে। তবুও চুপ থাকে স্রোত। নায়ীব অবাক হয়। পরমুহূর্তেই ঘাড়ের কাছটায় নাক ঘষে,নরম কণ্ঠে বলে,
“ আপনাকে বকেছি আমি? আমার ওপর রাগ করছেন কেনো? নিশাতের কি কোনো দোষ নেই?”
স্রোত মৌন রইল। তার পিঠটা ঠেকানো নায়ীবের খালি বুকে। নায়ীব একসময় তাকে ঘুরালো। কোমর আঁকড়ে, গালে গাল ঘষতে ঘষতে বলল,
“ কথা বলছেন না কেনো? চুপ থাকলে কিন্তু আজ পুরোদিন ঘরে আটকে রাখবো!”
কিছুদিন আগেই নায়ীব শেভ করেছে। অল্প-সল্প দাঁড়ি গজিয়েছে। গালে বেশ ভালোই খোঁ-চা লাগছে। স্রোত চোখ-মুখ কুঁচকে তা হজম করে। শক্ত গলায় বলে,
“ আপনি বললেই হলো? আমি আর এ ঘরে থাকবোনা। রাতেও নিশাতের সঙ্গে ঘুমাবো।”
“ রাগাবেন না, স্রোত।”
স্রোত নিশ্চুপে বুকের সঙ্গে এঁটে রইল। একসময় রাগ-টাগ সরিয়ে, নরম গলায় শুধাল,
“ ওয়াহিদ আমাদের ভার্সিটিতে পড়ে, আমার সঙ্গেই। রিসিপশনেও এসেছিল,দেখলেনই তো।”
নায়ীব প্রত্যুত্তর দিলনা। স্রোত মুখ তুলে চাইলো এবার,
“ ওরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসে।”
“ নিশাত ভালোবাসার কি বুঝে?”
“ আপনি কি বুঝেন?”
“ আপনাকে।” ফটাফট জবাব নায়ীবের। স্রোত হেসে মাথা দুলায়,
“ তাহলে সেও নিশ্চয়ই ওয়াহিদকে বুঝে।”
নায়ীব গম্ভীর মুখে তাকালো। অধরে অধর মিলানোর আগ মুহূর্তে শুধু বলল,
“ ছেলে ভালো না হলে কনস্টেবলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিব। আমার হাতে ভালো পাত্রের অভাব নেই। তখন ননদ-ভাবীর কান্না-কাটি দিয়েও কিচ্ছুটি মওকুফ করা হবেনা।”
..
হন্তদন্ত পায়ে বাসায় ফিরলো নায়ীব। সে নাবিদ সাহেবের সঙ্গে মসজিদে গেছিলো মাগরিবের সময়। মসজিদ থেকে বেরোনোর আগেই স্রোতের ফোন এল। বাসায় নাকি মেহমান এসেছে। বিনা দাওয়াতি মেহমানটা কে, ভেবে কূল পাচ্ছেনা নায়ীব। ও বাসায় ঢুকতেই তব্দা খেয়ে গেল। বসারঘরে অপরচিত তিনজন ব্যক্তি বসা। মাঝের জন অবশ্য স্বল্প পরিচিত; ওয়াহিদ। নামটা মস্তিষ্কে ত্বরিত বেগে হানা দিলো নায়ীবের। সে তৎক্ষনাৎ অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল যেন। এই ছেলের সাহসের তারিফ করতে হয়। দু এক ঘা খাওয়ার জন্য সেধে সেধে এসেছে। নায়ীব শক্ত চোখ-মুখে এগোনোর আগেই নাবিদ সাহেব হাত টেনে ধরেন। ফিসফিস করে শুধান,
“ এরা কে? চিনিস?”
“ তোমার গুণধর মেয়ে চিনে। তাকে জিজ্ঞেস করো।”
নাবিদ সাহেব পুরো বাসায় চোখ ঘুরালেন। ওইযে,রুমের পর্দার নিচ দিয়ে দু’টো পা দেখা যাচ্ছে। চোখও দেখা যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। নাবিদ সাহেব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়েন। নায়ীবের কাঁধ চাপড়ে বলেন,
“ রাগারাগি একটু কমাও। সকালেও চিল্লাফাল্লা করেছো, বউমাকেও দেখলাম মনম-রা হয়ে ছিল। কিচ্ছুটি বলিনি বলে ভেবোনা,সবসময় রাগ করে পার পেয়ে যাবে।
মেহমান এসেছেন,হোক অপরিচিত। তবুও তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা উচিত। বুঝেছো?”
নায়ীব মুখ কুঁচকে কয়েকবার মাথা ঝাঁকালো। হনহনিয়ে রুমে চলে এলো সোজা। নাবিদ সাহেব গেলেন বসার ঘরে। তিনি যেতেই সেখান থেকে চলে আসে স্রোত।
চুলোয় চা বসিয়ে এসেছে। নাশতাও বানাতে হবে। হাতে সময় খুব কম। তবুও তাকে এখন নায়ীবের পিছন পিছন ছুটতে হবে।
নায়ীব বিছানায় বসে। চোখ-মুখ দারুণ শক্ত,কাঠিন্যতায় ঘেরা। ফোঁস-ফোঁস করছে। কেউ সামনে গেলেই চিবিয়ে খাবে; ভাবখানা এমনই। স্রোত পা টিপে টিপে সামনে গেল। মাথা ঝুঁকিয়ে বলল,
“ বাইরে আসুন। ওরা কথা বলতে এসেছে তো।”
“ এখান থেকে যান,স্রোত। রাগলে সমস্যা হবে।”
স্রোত ঠোঁট উলটে তাকায়। হঠাৎই দু’হাতে ওর গলা ঝাপটে ধরে। নায়ীবকে কাবু করার মন্ত্র যে তার দারুণভাবে টুটস্থ হয়ে গেছে এতদিনে! নায়ীব তবুও ঠায় বসে রইল। কেবল স্রোতের এমন আচরণে সহসা ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেল। চোখে চোখ রাখতেই স্রোত আদুরে গলায় বলতে লাগল,
“ আপনি আমার বাড়িতে যাওয়ার পর আমার ভাই এভাবে রাগ করে, রুমে দরজা আটকে বসেছিল?”
নায়ীব চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলায়। স্রোত আরেকটু ভর রাখে ওর ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে দুহাতে আগলে নেয় নায়ীব। গম্ভীর গলায় বলে,
“ একটু বাড়াবাড়ি করছেনা ওরা?”
“ মোটেও না। ভালো ছেলে বলেই সোজা বাড়িতে এসেছে।”
নায়ীব গাঢ় চোখে তাকালো। স্রোত মিষ্টি হেসে গালে অধর ছুঁয়ালো। সে ভেতরে ভেতরে লজ্জায় গুমরে যাচ্ছে। অথচ মুখখানা করে রেখেছে অত্যন্ত স্বাভাবিক। নায়ীবের রাগ গললো সময় নিয়ে। কণ্ঠে গম্ভীরতা কমিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ এগুলো কি আমাকে ঘুষ দেয়া যাচ্ছে?”
“ একদম না। উঠুন এবার।”
নায়ীব উঠলো। স্রোত পাঞ্জাবির কলার টেনে ঠিক করে দিলো। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে, হাত উঁচিয়ে চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“ রাগারাগি করবেন না। এতে ওদের কিচ্ছুটি হবেনা,উলটো আপনিই ছোট হবেন ওদের সামনে। সেটা আমি চাইনা। একদম গুড ম্যান হয়ে কথা বলবেন,হাইপার হবেন না। ঠিকাছে?”
নায়ীব আচমকাই হেসে ফেলল। রাগ যে কোথায় উড়ে গেল, কে জানে।
..
ওয়াহিদের বাবা ওয়ালিদ জামান। ভদ্রলোক একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। ওয়াহিদের মা-ও একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। মা-বাবা দুজনেই রেপুটেড পার্সন। ছেলে আজ তাদের রেপুটেশনে একটা দাগ লাগিয়েই ছাড়বে,এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন ওয়ালিদ জামান। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, এই ছেলে তাদের। তিনি ভেতরে ভেতরে টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছেন। কখন না জানি এ্যাটাক-ফ্যাটাক খেয়ে বসেন। আর তার ছেলে কিনা ভয়ডরহীন হয়ে নিশ্চিন্তে বসে আছে?
ওয়াহিদ বুক টানটান করে বসা। নাবিদ সাহেব গভীর চোখে তাকে পরখ করলেন। এরপর চোখ নিলেন ওয়ালিদ সাহেবের দিকে। স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
“ আপনাদের তো ঠিক চিনলাম না,ভাই সাহেব?”
দারুণ অপ্রস্তুত হলেন ওয়ালিদ জামান। একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে দু’টো গা লি ছুঁড়লেন। এরপর বললেন,
“ জ্বি, ভাই সাহেব। না চিনারই কথা। আমরা ওয়াহিদের মা বাবা। আসলে..”
বলতে বলতে তিনি হাসার চেষ্টা করছিলেন। সামনের সোফাটায় নায়ীব এসে বসতেই মুহুর্তের মধ্যে তার মুখের হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এই ছেলে পুলিশ, তিনি জানেন। না জানি কোন অপমান করে ছাড়ে আজ।
তিনি ওয়াহিদের দিকে তাকান। দৃষ্টিতে অগ্নি ঝরে পড়ছে যেন। ওয়াহিদ বিশেষ পাত্তা দিলনা। বরং নায়ীবের দিকে চেয়ে লম্বা করে সালাম দিল,
“ আসসালামু আলাইকুম।”
নায়ীব বিচলিত হলেও বুঝতে দিলনা। রাশভারি গলায় সালামের জবাব দিল।
ওয়াহিদের মা গাইগুই করছিলেন। এবার মুখ খুললেন,
“ আপনাদের মেয়ে কোথায়?”
সঙ্গে সঙ্গেই নায়ীবের প্রশ্নটা তীরের মতই প্রবল বেগে ছুটে এল,
“কেনো? তাকে কি দরকার?”
ভদ্রমহিলা চমৎকার হাসলেন। জবাব দেয়ার আগেই নাবিদ সাহেব নিশাতকে ডাকলেন। সে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল পর্দার আড়ালে। গুটিগুটি পায়ে এগোনোর আগেই স্রোত ছুটে এসে তার মাথায় ওড়না টেনে দিল। এরপর পর্দা ঠেলে তাকে নিয়ে এল বসার ঘরে। সে এসেই অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় সালাম দিল।
ওয়াহিদের মা; আফিয়া বোধহয় প্রসন্ন হলেন। ছেলে তার সকালে এক অদ্ভুত আবদার করে বসে। সে নাকি বিয়ে করবে। মেয়ে ঠিক করা। ওয়ালিদ সাহেব তৎক্ষনাৎ মানা করে দেন। বেকার ছেলের হাতে কে মেয়ে তুলে দিবে? তবুও সে কথার জালে তাকে ফাঁ-সিয়ে ফেলেছে। তার সিজি ভালো। মাস্টার্স শেষ হতে আর কতদিনই বা বাকি! এরপর একটা চাকরি সহজেই পেয়ে যাবে। এসব দোহাই দিয়ে, একপ্রকার ব্ল্যাকমেইল করে তাদের এখানে নিয়ে এসেছে।
আফিয়া মুখ খুললেন,
“ বসো,মা। দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
নিশাত এদিক ওদিক চাইলো। একমাত্র নায়ীবের পাশের সোফা খালি। সে ঠোঁট উল্টে দেখল,নায়ীব তার দিকে তাকাচ্ছেনা। গম্ভীর চেহারায় বসে আছে। ও ধীর পায়ে গিয়ে বসলো সেখানটায়।
সেদিন এক উদ্ভট এবং চমৎকার কান্ড ঘটলো। বিয়ের কথা তুলতেই ওয়াহিদকে নায়ীব প্রশ্নের পিঠে জর্জরিত করে ফেলল। সবকিছুর উত্তরই ওয়াহিদ ভীষণ স্বাভাবিক ভাবে দিল। নায়ীব তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিল। এই ছেলের সাহস আসলেই তারিফ যোগ্য। শেষমেশ সে নড়েচড়ে বসলো। বাকিসব ছাড়লো নাবিদ সাহেবের ওপর। ভদ্রলোক পড়লেন বিরাট এক বিপাকে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতে তিনি জানালেন, মেয়ে আরেকটু বড় হোক। ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়াক,এরপর এসব ভাবা যাবে। আপাতত উনারা মেয়েকে কোথাও বিয়ে দিচ্ছেননা। এসব সান্ত্বনা বাণী শুনেই ওয়ালিদ জামান বেঁকে বসলেন। নিজের চৌদ্দ গোষ্ঠীর বায়োডাটা তিনি নিজেই দিলেন। ছেলেরও সুনাম গাইলেন। শেষমেশ একপ্রকার অনুরোধ করলেন। ওয়াহিদ বাবার এই বিস্তর পার্থক্য দেখে বিষম খেল।
নিশাত,স্রোত; দুজনেই চুপচাপ সব দেখলো। দুজনেই দারুণ উৎকণ্ঠা।
শেষমেশ হার মানতেই হলো নাবিদ সাহেবকে। সে রাতেই ওয়াহিদের মা নিজের হাতের দু’টো বালা পরিয়ে দিলেন নিশাতকে। দৃঢ় গলায় বলে গেলেন,
“ ভাইসাহেব, আপনার মেয়ে একদিন আমার বাড়িরও মেয়ে হবে। সেই ভরসাটা রাখলাম আপনাদের ওপর। আশা করি,কথার খেলাপ হবেনা।”
চলবে.
#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৫০ (প্রথমাংশ)
ওয়াহিদ খ্যাক-খ্যাক করে হেসে উঠল,
“ তোমার ভাই অনেক সুইট।”
নিশাতের মনে হলো, সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে যেকোনো। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠছে।
ও বিভ্রান্তি নিয়ে শুধাল,
“ কিইই?”
“ চেঁচাচ্ছো কেনো,নিশু? তোমার ভাই আসলেই অনেক সুইট। স্রোত জিতেছে।”
নিশাত মুখ ভেঙ্গচালো। বলল,
“ সুইট না ছাই! ভাইয়া জিতেছে। সে যাকগে,ভাইয়াকে কেনো সুইট মনে হলো আপনার?”
“ কতো সুইটলি আমার ইন্টারভিউ নিল। আমি তো সেই রাতের কাহিনি জীবনেও ভুলবোনা।”
নিশাত চোখ উল্টায়। প্রবল বিরক্তি প্রকাশ পায় সেই ভঙ্গিতে। ওরা বসে আছে স্বচ্ছ,সবুজ ঘাসের ওপর। জায়গাটার নাম জানা নেই নিশাতের। ওয়াহিদ নিয়ে এসেছে। যেদিকে চোখ যায়,সেদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। অদূরে একটা খাল। ব্যস,আর কিচ্ছুটি নজরে আসছেনা। মানুষজনও তেমন নেই।
নিশাত ঠোঁট উলটে বলল,
“ আপনি এত উদ্ভট কেনো,ওয়াহিদ?”
“ আমি উদ্ভট?”
ওয়াহিদ হতভম্ব গলায় শুধাল। নিশাত কাছ ঘেষল। ওয়াহিদের চওড়া কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বলে উঠল,
“ হ্যাঁ।”
“ এই উদ্ভটের সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে,নিশাত। সারাজীবন কাটবে তোমার উদ্ভটতায়।”
..
একহাতে মাস্টার্স পরীক্ষার রুটিন, অন্যহাতে একটা প্রেগন্যান্সি কিট নিয়ে বিমুঢ় চিত্তে বসে আছে স্রোত। না,সে টেস্ট এখনও করেনি। বিয়ের আজ নয় মাস পেরোলো। তার কেবল সকালে একটু মাথা ঝিমঝিম করেছে। সে কথা শুভ্রাকে জানাতেই সে হাতে কিট ধরিয়ে দিল। খিকখিক করে কতক্ষণ হেসেছেও! স্রোত কিটটা ফেলেনি। সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তবে অজানা ভয়ে সে টেস্ট করেনি। বুক কাঁপে ওর এসবে। সম্পূর্ণ শরীর বরফ শীতল হয়ে যায়। ও হাত বাড়িয়ে ড্রয়ার খুলে সেখানটায় রেখে দেয় কিটটা। এরপর কাপড় পালটে রান্নাঘরে যায়। রাবেয়া চা বানাচ্ছিলেন। অসময়ে চায়ের আবদারটা নাবিদ সাহেবেরই করা।
স্রোত চুলগুলো খোঁপা করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকে। এখন বিকাল চারটার মতো বাজে। ভ্যাপসা গরম চারপাশে। ভীষণ অস্বস্তি ধরিয়ে দেয়।
রাবেয়া চা দিতে চলে যেতেই স্রোত চুলায় গরম পানি বসায়। দুপুরের খাবারের বদলে তার কফির শখ জেগেছে। নায়ীব জানলে খবর আছে। ও চুপিচুপি কফির কাপটা বের করলো। কিন্তু তার আগেই রাবেয়া এলেন। বড়বড় চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ হায়হায়! এই সময়ে কফি? নায়ীব বাবায় জানলে..”
স্রোত বিরস মুখে চায়। বলে,
“ ক্ষিদে নেই তো। রাতে জলদি জলদি ভাত খেয়ে নিব। উনাকে জানাবেন না প্লিইইইইজ!”
রাবেয়া ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। রান্নাঘর গুছাতে গুছাতে বললেন,
“ শরীর যখন খারাপ করবো, তখন বাবায় এমনেই জানবো। আমার জানানো লাগবোনা।”
প্রত্যুত্তর না পেয়ে আনমনে একবার ঘাড় বাঁকালেন রাবেয়া। সঙ্গে সঙ্গে নেত্রযুগল বৃহৎ আকার ধারণ করে। হাতের কাজ ফেলে, দ্রুত এগিয়ে আসেন উনি। স্রোতের কাঁধ ধরে সোজা দাঁড় করিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“ এই দেখছেন,খাবার না খাইলে কি হয়!”
স্রোত নতজানু হয়। মিহি গলায় বলে,
“ আমাকে একটু ঘরে দিয়ে আসবেন,আন্টি?”
রাবেয়া তাকে ধরে ধরে রুম অব্দি নিয়ে গেলেন। তন্মধ্যে রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন নাবিদ সাহেব। চিন্তিত স্বরে দরজার পাশটায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“ কি হয়েছে, রাবেয়া? চেঁচালে কেনো?”
রাবেয়া ফটাফট জবাব ছুঁড়েন,
“ আর বইলেন না! আপনার বউমা এই অবেলায় খালি পেটে কফি খাইতে গেছিলো। সকালের পর পেটে কিচ্ছুটি পড়েনাই। তাই মনেহয় এখন মাথাডা চক্কর দিয়া উঠছে। দাঁড়ান, আমি ভাত আনি।”
বলতে বলতে তিনি ছুটলেন। নাবিদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,
“ নায়ীব শুনলে কিন্তু খুব রাগারাগি করবে। খেয়ে নাও, মা। ভাত খেয়ে পরে যা মন চায় খাও।”
স্রোত মাথা নুইয়ে সম্মতি দেয়,
“ আব্বু,আপনি যান। ঘুমান। আমি খেয়ে নিবো।”
নাবিদ সাহেব চলে গেলেন। রাবেয়া আসলেন প্লেট ভর্তি ভাত নিয়ে। তা দেখেই লাফিয়ে উঠল স্রোত,
“ আন্টি, কয়জনের খাবার এনেছেন?”
“ এইটুক ভাত, কয়জন খাইতে পারবো?”
মুখ বাঁকালেন রাবেয়া। প্লেট বাড়িয়ে দিলেন। স্রোত তা হাতে নিতে নিতে বলল,
“ আমি এত খেতে পারবোনা,আন্টি। শুধু শুধু নষ্ট হবে।”
রাবেয়া প্রত্যুত্তর দিলেন না। রুম থেকে গেলেনও না। স্রোত দুই লোকমা খেয়েই আচানক অসহায় গলায় বলে উঠল,
“ আর পারছিনা। বমি পাচ্ছে।”
রাবেয়া হকচকালেন। হাত থেকে প্লেট নিতেই মেয়েটা ত্বরিত বেগে ছুটলো বাথরুমে। বেসিনে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই মুখ দিয়ে গড়গড় করে খাবারগুলো উগলে বেরিয়ে এলো। রাবেয়া প্লেট রেখে দ্রুত ছুটলেন। নেতিয়ে পড়া শরীরটা ধরে তিনি চঞ্চল গলায় বলেন,
“ আল্লাহ! দেখসেন,পেটের ভিতরে গ্যাস জইমা কি হাল! আজকে নায়ীব বাবা আসুক, আমি সব কমু।”
স্রোত চোখ বুজে নিঃশ্বাস টানে। বলে,
“ আমি ঘুমাবো একটু। আর খেতে পারবোনা,বমি আসবে। আপনি বাসায় চলে যান খালা,আব্বুকে বলার দরকার নেই কিছু।”
রাবেয়াকে সে ম্যানেজ করল বহু কষ্টে। রাবেয়া যেতেই দরজা আটকালো। ঘুমের ছিঁটেফোঁটাও নেই তার নেত্রে। সে ড্রয়ার হাতড়ে কিট নিয়ে ছুটলো বাথরুমে।
..
শুভ্রা বড়বড় চোখে তাকিয়ে। অগাধ বিষ্ময় সে দৃষ্টিতে। স্রোত ব্যগ্র গলায় বলল,
“ আরেকটা কিট কিনতে হবে।”
“ কেনো,আগেরটা কই?”
“ ওটা আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা।”
“ কিহ! পজিটিভ এসেছে না নেগেটিভ?”
স্রোত মাথা নুইয়ে লম্বা দম টানে। বলে,
“ পজিটিভ। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা। মানুষের তো এমনিতেও মাথা ঘুরায়,বমি পায়। তাইনা?”
শুভ্রা মুখ চেপে হেসে ফেলল। এই মেয়ের মাথা গেছে। ও মাথা নাড়িয়ে বলল,“ আচ্ছা, ঠিকাছে। তোর বরকে জানাস নি?”
“ না।” স্রোত ঠোঁট চেপে বলে উঠে। সে রাতে একফোঁটাও ঘুমায়নি। ফর্সা মুখটা তাই শুকনো লাগছে। শুভ্রা একবার তাকে পরখ করে লম্বা দম ফেলে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“ আচ্ছা, চল।”
..
আজ নাবিদ সাহেব,নিশাত গেছে নায়মার বাসায়। কি এক জরুরী কাজ। স্রোতকে টেনেও সঙ্গে নেয়া যায়নি।
বাসা খালি বলে নায়ীব আজ দ্রুত ফিরেছে। আটটার দিকে। হাতে দু’টো লাল গোলাপ। রাস্তায় এক বাচ্চা বিক্রি করছিল। নেতিয়ে গেছে বলে ফুল দু’টো কেউ কিনছেনা। নায়ীব তাই কিনে ফেলল। একটু নেতিয়ে গেছে, তবে সে জানে; তার মিসেস দারুণ খুশি হবে।
নায়ীব কলিংবেল চাপলো। মিনিট পাঁচ এক গড়ালেও দরজা খোলা হলোনা। নায়ীব ক্লান্তি চিত্তে, সংগোপনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চাবি ঢুকিয়ে লক খুলল। কোনোরকম জুতোজুড়া খুলে পা বাড়ালো সোজা রুমের দিকে।
পুরো রুমজুড়ে কেবল ড্রিম লাইটের আলো। বিছানার মাঝখানটায় কাত হয়ে শুয়ে আছে স্রোত। গলা অব্দি কাঁথা টানা। অল্প আলোয় তা দেখেই দ্রুত সুইচবোর্ড হাতড়ায় নায়ীব। সেকেন্ডের মাথায় ঘরটা ঝলমলে আলোয় সজ্জিত হয়।
আগষ্টের শেষ চলছে। গরমের দাপটটা খুব বেশি। নায়ীব বাইরে বেরোলেই অতিষ্ঠ হয়ে যায়। ঘরে এসে সে ঠান্ডা পানি দিয়ে আগে গোসল করে। নাহলে মনে হয় সম্পূর্ণ চিত্ত জ্ব লে যাচ্ছে। অথচ এই মেয়ে কিনা এই ভ্যাপসা গরমে কাঁথা গায়ে টেনে শুয়ে আছে?
নায়ীব চিন্তিত নেত্রে তাকায়। তার অস্থির হাত তন্মধ্যে ছুঁয়ে ফেলে স্রোতের কপাল,নাক,মুখ। স্রোত সেই স্পর্শে অল্প-সল্প নড়েচড়ে উঠে।
নায়ীব লহু, সতর্কী গলায় ডাকে,
“ স্রোত,জ্বর এসেছে? শীত করছে?”
স্রোত চোখ খুলতেই,তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ দু’টো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে আসে। ও অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়,
“ একটু।”
“ জ্বর এসেছে?”
“ ন.না। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
নায়ীব বাথরুমে ঢুকতেই স্রোত পিটপিট করে তাকায়। ঠোঁট কাম-ড়ে ভাবে,সে ঘুমালো কখন! বিকালের দিকে নাবিদ সাহেব আর নিশাতকে বিদায় দিয়ে সে রুমে এসেছিল রেডি হতে। নায়ীবকে একটু চমকানোর জন্য কতো আয়োজন করে নিজেকে সাঁজালো।
এরপর শীত শীত অনুভূত হওয়ায় বিছানায় গা এলিয়ে ফোন দেখছিল। তারপর কিচ্ছুটি মনে নেই। সে এত ঘুমকাতুরে!
আড়ষ্টতা ঝেঁকে ধরলো তাকে। দ্রুত উঠে,রুমের বাইরে ছুটলো।
নায়ীব বেরোলো ঝড়ের গতিতে। রুমটা ফাঁকা দেখে উচ্চস্বরে হাঁক ছাড়ল,
“ কোথায় গেলেন?”
স্রোত মিনিটের মাথায় ছুটে এল। হাতে শরবতের গ্লাস। জোড়ালো ভঙ্গিমা। হাঁটার মধ্যেও কেমন আড়ষ্টতা,লজ্জার ছোঁয়া। নায়ীব এবার তাকে আপাদমস্তক খেয়াল করলো।
শুভ্র বদনে একটা মেরুন রঙের জর্জেট শাড়ি প্যাঁচানো। কুঁচি এলোমেলো হয়ে গেছে। অথচ ঘন্টাখানেক আগেই স্রোত বড্ড যত্ন নিয়ে কুঁচি ঠিক করেছে।
মাথার খোঁপা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা,তার পরেও নায়ীব কয়েকদফা মুগ্ধ হলো তার এই রূপে। মুখে প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই,কেবল পুরু ওষ্ঠদ্বয়ে লিপ গ্লোসের আস্তরণ। নায়ীব স্তব্ধ, গাঢ় চোখে ওর দিকে চেয়ে রইল। এহেন লাস্যময়ী রূপ সে আজ প্রথম দেখছেনা যদিও। তবুও চোখ ফেরানো তার পক্ষে দুরসাধ্য।
স্রোত হম্বিতম্বি করে হাত বাড়াল,
“ কি দেখছেন? শরব..”
বলার আগেই হাত টান পড়ে। গ্লাসটা আঁকড়ে ধরে সামনের দিকে হেলে পড়ে স্রোত। ঝকঝকে টাইলসে ছিটকে পড়ে কয়েকফোটা শরবত। হতভম্ব স্রোতের মাথা ঠেকে নায়ীবের বুকে। নায়ীব সন্তপর্ণে হাত থেকে গ্লাসটা নেয়। একটানে শরবতটুকু শেষ করে গ্লাস রাখে বেডসাইডে।
স্রোত হতবাক, সরল চোখে তাকিয়ে। নায়ীবের চুল ভেজা। টুপটুপ পানির ফোঁটা সোজা তার মুখের ওপর পড়ছে। স্নিগ্ধ,মায়াবী চাহনি ওর দিকেই তাক করা। স্রোত ঢোক গিলে। তার লজ্জা লাগছে,ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত অনুভূতির আন্দোলন হচ্ছে। হৃদপিন্ড ধ্রিম ধ্রিম আওয়াজ তুলছে। নায়ীবের মুখের দিকে চেয়ে, তার কথা কণ্ঠানালীতেই প্যাঁচিয়ে যাচ্ছে।
নায়ীব হাসে। শুধায়,
“ সেঁজেগুজে ঘুমাচ্ছিলেন?”
“ ন..না।”
“ আপনার জন্য ফুল এনেছি, দেখেছেন?”
বলতে বলতে মাথা ঝুঁকায় নায়ীব। থুতনিতে শুকনো এক চুমু বসায়। স্রোত চোখ বুঁজে আওড়ায়,
“আমারও আপনাকে কিছু দেয়ার আছে।”
“ তা নাহয় দিবেন,আগে বলুন। এত সাঁজগোঁজ কি উপলক্ষ্যে?”
হৃষ্ট এক হাসি তার কালচে ঠোঁটের ভাঁজে বিদ্যমান। স্রোত ঠোঁট কাম-ড়ে বলে,
“ এমনি সেঁজেছি। পছন্দ হয়নি?”
নায়ীবের দৃষ্টি নিগুঢ়। স্রোতের প্রশ্নটা তার পছন্দ হয়নি। কপালে সূক্ষ্ণ কটা ভাঁজ পড়ল। স্রোত তা বুঝে মেকি হাসলো। সরল গলায় বলতে চাইল,
“ হেহে..মজা কর..”
বলার পূর্বেই ঠোঁটজোড়া তার নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে গেল। প্রবল আক্রোশে,তীব্র অধিকারবোধ নিয়ে নায়ীব ঝটপট তার ঠোঁটজোড়া দখল করে ফেলেছে। মিনিট খানেক গড়ালো, সে শ্লথ বেগে মুখ সরাল। ভ্রু নাঁচিয়ে,ভীষণ স্বাভাবিক গলায় বলল,
“ কি যেন বলছিলেন?”
স্রোত দুপাশে ঘাড় নাড়াল। বলল,
“ ক.কিছুনা। একটু ছাড়বেন?”
আবদারের সঙ্গে সঙ্গেই হাতের বাঁধন ঢিলে হলো। স্রোত সরে গেল সঙ্গে সঙ্গে,ড্রয়ার হাতড়ালো অনেক্ষণ। নায়ীব সময় গুণলো। পাক্কা দুই মিনিট পর রমণী ঘুরলো। পুরো শরীরটা নায়ীবের দিকে ফেরানো। কেবল হাত দু’টো পেছনে, লুকায়িত। নায়ীব শীতল চোখে চেয়ে। অক্ষিকোটরে অগাধ আগ্রহ।
অনেক্ষণ নীরবতা চলল। স্রোত হাঁসফাঁস করছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। শব্দ পাচ্ছেনা। মনে হচ্ছে সে কথা বলতে ভুলে গেছে। নায়ীব অধীর আগ্রহ নিয়ে তার এসব ভাবভঙ্গি দেখল। তার ভালো লাগছে। এই নারীর হাঁসফাঁস করা দেখতেও তার চোখ জুড়ায়।
খানিক পর, থেমে থেমে আওয়াজ আসে,
“ আপনি কয় কেজি মিষ্টি বিলাবেন, নায়ীব?”
অহেতুক এক প্রশ্ন। স্রোতের এমন প্রশ্নে আহাম্মক বনে গেল নায়ীব। সহসা লম্বা দম টানতেই,মসৃণ কপালে ভাঁজ পড়ে। এই পরিস্থিতিতে এই প্রশ্ন?
“ কিসের মিষ্টি?”
প্রশ্নের বিপরীতে স্রোত কেবল ঠোঁট কাম-ড়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইঙ্গিত দিতেই তার অবস্থা নাজেহাল। অথচ এই পুরুষ ইঙ্গিতের ‘ই’ ও টের পায়নি। কি লজ্জা!
নায়ীবের সন্দেহ গাঢ় হলো। এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করল,
“ হাতে কি?”
স্রোত নিরুদ্যম চেয়ে রইল। নায়ীব চোখে চোখ রেখে কবজি টেনে সামনে নিয়ে এল। হাত উঁচাতেই সে বাকরুদ্ধ হলো। পিটপিট করে কতক্ষণ হাতের মুঠোয় থাকা কিটটার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু ঝুঁকে লাল দু’টো দাগেও চোখ বুলাল। এরপরই অবিশ্বাস্য চোখ দু’টো স্রোতের দিকে ফিরলো। কণ্ঠনালী চিঁড়ে বেরিয়ে এল,
“ এটা কি?”
স্রোত গাল ফুলালো। লজ্জা-টজ্জা একপাশে ছুঁড়ে বলল,
“ কি আবার? বাবা হবেন,এটাও বলতে হবে?”
..
জিহাদ খ্যাটখ্যাট গলায় এক চো-রের উদ্দেশ্যে গা-লি ছুঁড়ছিল। সেই অকথ্য ভাষায় গা-লা-গা-লিতে কানে পোঁকা ধরার জোগাড় রুমার। কানটা ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে একদম। কানে এক আঙ্গুল গুঁজে সে উচ্চস্বরে ডাকে,
“ জিহাদ,ভাই! ও জিহাদ ভাই! স্যার ডাকছে।”
“ ব্যস্ত আমি, দেখছোনা রুমা? শুধু শুধু কাজে ব্যাগড়া দিচ্ছো কেন?”
রুমার চক্ষুদ্বয় কপালে উঠল বুঝি। সে বড়বড় চোখে তাকিয়ে বলল,
“ গা-লি দেয়া কোনো কাজ নাকি? তাহলে তো এতে ব্যাগড়া দিলে আমার সওয়াবই হবে।”
কটমট চোখে চাইলো জিহাদ। লকাপ থেকে বেরিয়ে চলে গেল সোজা নায়ীবের কেবিনে।
হাত দিয়ে ঠকঠক আওয়াজ তুলে,কলার টেনে ঠিক করল ও। বাইরে যতই মেজাজ দেখাক, এই কেবিনটার ভেতর প্রবেশ করতে হলে তার মেজাজের পারদ শূণ্যের কোঠায় ঠেকাতে হয়। স্যারের সামনে তো আর রাগ প্রকাশ করা যায়না।
রাশভারী স্বরের পারমিশন পেতে হুড়মুড় করে ঢুকে জিহাদ। মুখে মেকি হাসি ফুঁটিয়ে বলে,
“ স্যার! ডেকেছিলেন?”
“ হুম।”
নায়ীবের ব্যস্ত চোখ ফোনের স্ক্রিনে। জিহাদ মিনিট খানেক অপেক্ষা করলো। এরপরই ধপাস শব্দে নায়ীব ফোনটা রাখল টেবিলের ওপর। এত অবহেলা! ফোনটার প্রতি অদ্ভুত মায়া হলো জিহাদের।
নায়ীবের চোখ এবার তার ওপর পড়তেই সে তটস্থ হলো। একদম ফিটফাট। আজ কথা শোনার কোনো রিজন সে রাখেনি। তবুও ভিতরে ভিতরে একটু আধটু ভয় লাগছে।
নায়ীব আচানক হাসলো। টেবিলের ওপর রাখা মিষ্টির প্যাকেটটা ঠেলে একটু এগিয়ে দিতে দিতে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“ জিহাদ,মিষ্টি নাও।”
মিষ্টির প্যাকেটটা জিহাদ আগে খেয়াল করেনি। ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’- নিজেকেই নিজে উপাধি দিল জিহাদ। এরপর কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল,
“ মিষ্টি? কেন স্যার?”
“ তুমি কেন দিয়েছিলে?”
“ জ্বি স্যার,বাবা হবো বলে দিয়েছিলাম। সে ল্যান্ড করে ফেলবে আগামী মাসে। কিন্তু আপনি..”
অর্ধেক কথা বলে,নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরলো সে। হতভম্ব চোখ মুখেও সে চওড়া হাসলো। বলল,
“ হেহে,সত্যি স্যার? জুনিয়র নায়ীব ইয়াকীন অন দ্যা ওয়ে। হোয়াট আ গ্রেট নিউজ!”
তার এত উৎফুল্লতা দেখে তব্দা খেয়ে গেল নায়ীব।
চলবে.
#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৫০ (শেষাংশ)
নিশাত স্রোতের বেডের ওপর ধপাস শব্দে গা এলিয়ে দিল। চোখের পাতায় যেকোনো সময় নিদ্রা ভর করবে। ও নিজেকে যথাসাধ্য ধরে রাখল। এখন ঘুমানোর সময় নয়।
নিশাত চনমনা কণ্ঠে বলে উঠল,
“ ভাবী, দেখতো কাপড়গুলো সুন্দর হয়েছে কিনা!”
তাজ্জব বনে দাঁড়িয়ে আছে স্রোত। হাতে কয়েকটা প্যাকেট। সেগুলোর ভেতর ছোট ছোট বাচ্চাদের কাপড়। বাচ্চাদের বলা ভুল। মেয়ে বাচ্চার কাপড় এগুলো।
সেগুলো বেডের ওপর রেখে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল ও। জিজ্ঞেস করল,
“ এগুলো কি নিশাত?”
“ আমার ভাইঝির কাপড়।”
“ আশ্চর্য! সে ছেলে নাকি মেয়ে তুমি জানো কীভাবে?”
নিশাত ফট করে চোখ খুলল। ফিচেল হেসে,আমতা আমতা স্বরে বলল,
“ সে আমি আন্দাজ করে ফেলেছি।”
স্রোত তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে। এ এক পা-গল,এর ভাই আরেক পা-গল। সে খুশির খবর জানালোই কালকে। আজই শপিং শুরু! অদ্ভুত!
কলিং বেল বাজতেই হকচকিয়ে উঠল নিশাত। স্রোত উঠার আগেই বলল,
“ নড়াচড়া কম করো ভাবী,বাবুর সমস্যা হবে। আমি যাচ্ছি।”
মাথায় হাত দিয়ে বসলো স্রোত। নিশাত এক ছুটে গিয়ে দরজা খুলে,ফিরেও এল। সে বেরিয়েছিল দুপুরের পর। ওয়াহিদের সাথে ঘুরেঘুরে এসব কাপড়গুলো কিনেছে। যার সিংহভাগই ওয়াহিদের চয়েজ করা। সে কথা অবশ্য নিশাত কাউকে বলেনি।
নায়ীব ঘরে ঢুকল অবসন্ন চিত্তে। ক্লান্তিতে শরীর ঝিমিয়ে আসছে তার। অথচ কালচে ঠোঁটের ভাঁজে এক চওড়া হাসি। হাতে তারও প্যাকেট।
সেগুলো বেডের ওপর রাখতে রাখতে সে একবার বেডের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট কাপড়গুলোর দিকে তাকালো। ঠোঁট চেপে মাথা ঘুরিয়ে দেখল, নিশাত উৎসুক চোখে চেয়ে। প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে ভাইয়ের।
নায়ীব ভীষণ উদ্রেকহীন বনে শুধাল,
“ তুইও মেয়েদের কাপড় এনেছিস?”
নিশাত মাথা নাড়ে উপর-নিচ। উৎসাহ নিয়ে বলে,
“ কেনো,ভাইয়া? তুমিও এনেছো?”
উত্তরে কিঞ্চিৎ মাথা নাড়ায় নায়ীব।
স্রোত নড়েচড়ে বসে। বিরক্তি ধরা গলায় বলে,
“ থামবেন আপনারা?”
নায়ীব তড়াক করে তাকালো,
“ হু?”
ভ্যাবাচেকা খেল স্রোত। কিছু বলার পূর্বেই নায়ীব আদেশের সুরে,নিশাতের উদ্দেশ্যে বলে,
“ এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়, নিশু।”
“ আমি আনছি..”
স্রোতের কথার বিপরীতে দুই জোড়া রক্তিম দৃষ্টি তার ওপরে স্থির হতেই,সে চুপসে যায়। আনমনে বলে,
“ কি হয়েছে?”
তার প্রশ্নের পরোয়া অবশ্য কেউ করেনি। ভাইবোন যে যার মত ব্যস্ত হলো। নিশাত ছুটলো রুমের বাইরের দিকে। শার্টের উপরের দুই বাটন খুলতে খুলতে নায়ীব প্রশ্ন করল,
“ কাল ডক্টরের কাছে যেতে হবে।”
মাথা নাড়ায় স্রোত। নায়ীব গাঢ় চোখে তাকায়,
“ দুপুরে খেয়েছিলেন?”
উপর নিচ মাথা ঝাঁকায় স্রোত। তা দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে নায়ীবের। গম্ভীর গলায় বলে,
“ রাবেয়া খালা এখন থেকে রোজ আসবেন। খবরাখবর আমি তার থেকেই পাব। শুনলাম সেদিন খাবার না খেয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন?”
স্রোত বিরক্তিতে চুপ করে থাকে। সে কি বলবে? রাবেয়া খালাকে এতবার না করলো! এত অনুরোধ করলো! তাও রাখলেননা।
..
“ তোমার ভাই সুইট হলেও নিষ্ঠুর, নিশাত। নিজে বাপ হয়ে যাচ্ছে,অথচ আমাকে বিয়ে করতেই দিচ্ছেনা।”
নিশাত যারপরনাই বিরক্ত হয়। প্রতিদিন এসব ফাউল কথাবার্তা শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে রীতিমতো। ও ভীষণ ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল,
“ এখন বিয়ে দিয়ে দিলে,আপনি আমায় খাওয়াবেন কি?”
“ আমি যা খাই,তা-ই খাবে।”
“ অদ্ভুত! বেকার ছেলের হাতে কেউ মেয়ে তুলে দেয়?”
ভোঁতা মুখে তাকালো ওয়াহিদ। পরপরই মুখ ফিরিয়ে নিল। নিশাত জ্বিভ কাটে সঙ্গে সঙ্গে। সে এভাবে বলতে চায়নি। বলার ধরণে গড়মিল হয়ে গেছে। ও সামনের দিকে ঝুঁকল। ঘাড় ডানদিকে কাত করে, ওয়াহিদের দিকে চেয়ে বলল,
“ আচ্ছা,চলুন বিয়ে করে ফেলি।”
“ হ্যাঁ, এরপর তোমার বাপ-ভাই মিলে আমার গর্দান নিক।”
“ ওরা জানবেনা, চলুন।”
“ নিশাত, এভাবে বলবেনা।”
“ কেন?”
“ আমি কিন্তু তোমায় সত্যি সত্যি কাজী অফিসে নিয়ে চলে যাব।”
নিশাত ঝলমলে এক হাসি উপহার দিল। অনিমেষ চেয়ে রইল ফর্সাটে মুখটার পানে। ওয়াহিদ ওর দিকে তাকালো আরো অনেক পরে। ততক্ষণ তাকে মন-প্রাণ ভরে দেখল নিশাত। ওয়াহিদ ঘাড় ফিরিয়েই ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“ নজর দিচ্ছো?”
“ উফফ, ওয়াহিদ! আপনি ভালো কথা বলতে পারেন না?”
“ খারাপ কি বললাম? যেভাবে তাকিয়ে আছো,যে কেউ ভাববে নজর লাগাচ্ছো।”
নিশাত কটমট চোখে তাকাতেই ওয়াহিদের ঠোঁটের ভাঁজে মিশে যায় স্মিত হাসির রেখা। নিশাত তেড়েমেড়ে বলে,
“ আসুন,ফু দিয়ে নজর কাটিয়ে দেই।”
মাথা নুয়ালো ওয়াহিদ,
“ দাও,ভালো করে দাও। এমন দোয়া পড়ে ফু দাও,যেন তুমি বাদে আর কেউ নজর লাগাতে না পারে।”
..
স্রোতের ঠান্ডা লাগছে। চোখে ঘুম নেই। ক্ষিদেও পেয়েছে। তিন জ্বা:লা সহ্য করে সে চুপটি করে শুয়ে আছে। আজ শোয়ার আগে জানলা বন্ধ করা হয়নি। পাতলা, ফিনফিনে পর্দা মেলে দেয়া শুধু। চাঁদের ঝলমলে আলোর একাংশ রুম জুড়ে রাজত্ব করছে তাই। স্রোতের ভয় করছেনা,আশ্চর্যরকমের সুন্দর লাগছে এই দৃশ্য। মন চাইছে, জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে।
ও একটু পর পর নড়েচড়ে উঠায় নায়ীবের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। সারাদিনের ক্লান্তি,ধকলের কারণে ঘুমটা ওত সহজে ভাঙ্গলোনা। তবে অচিরেই ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেল। অল্প,অকৃত্রিম চন্দ্রালোকে তা দেখে মুখ চেপে হাসলো স্রোত। নায়ীবের একহাত তার পেটের ওপর। আরেকহাত অন্যদিকে। শোয়ার সিস্টেম অদ্ভুত। স্রোত ওর বুকের পাশটায় শুয়ে আছে। মুখে চাপা হাসি। সে রোজ এমনভাবেই ঘুমায়। কখনো বা বালিশের বদলে মাথা রাখে নায়ীবের বুকে। হোক শক্ত, তবুও বালিশের চেয়ে সেখানেই ঢের আরাম মিলে।
কয়দিন পর,মাঝখানে আরেকটা প্রাণ ঘুমাবে। ভাবতেই কেমন অদ্ভুত খুশি লাগে স্রোতের। তখন সে নায়ীবের বুকে ঘাপটি মে-রে ঘুমাবে কি করে? নিজের ভাবনায় নিজের ভ্রু-ই সংকুচিত হয় তার। বিড়বিড় করতে করতে সে আরো এঁটে যায় নায়ীবের সঙ্গে। নায়ীবের ঘুম পাতলা। স্রোতের এত নড়াচড়ায় শেষমেশ তার ঘুম ভেঙে যায়। ফট করে চোখ খুলে,স্রোতের অপ্রস্তুত, অপ্রতিভ মুখটা দেখে নেয়। পরপরই হাত বাড়িয়ে ফোনের স্ক্রিন অন করে,সময়টাও দেখে নেয়। দুইটা বেজে দশ।
“ কি হয়েছে? জেগে আছেন কেনো? ব্যথা করছে কোথাও?”
নায়ীবের প্রশ্নে দু’পাশে মাথা নাড়ে স্রোত।
একহাতে তাকে প্যাঁচিয়ে ধরে বলে,
“ ঠান্ডা লাগছে।”
নায়ীব জানলার দিকে তাকায় এবার। বলে,
“ জানলা বন্ধ করে দিব?”
“ না, না। থাকুক। আলো আসছে,সুন্দর লাগছে।”
আশ্চর্য বনে গেল নায়ীব। স্রোত সহসা হাসে। বোকা হাসি।
“ ক্ষিদে পেয়েছে?”
এবারের প্রশ্নের পিঠে ঠোঁট চেপে সম্মতি দেয় স্রোত। পালটা প্রশ্নও করে,
“ বুঝলেন কি করে?”
নায়ীব সন্তপর্ণে ওর মাথা রাখে বালিশে। উঠে বসে বলে,
“ সিক্রেট।”
“ বলুন না।” হাত ধরে আটকালো স্রোত। নায়ীব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। বলে,
“ রাতে কতটুকু খেয়েছেন,দেখেছি তো।”
স্রোতের লটকানো মুখের দিকে চেয়ে সে এবার হাত ছাড়িয়ে উঠে পড়ে। লাইট অন করতেই উঠে যায় স্রোতও। রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হওয়া নায়ীবের পিছু নেয়। নায়ীব না তাকিয়েই প্রশ্ন করে,
“ কি খাবেন?”
“ নুডুলস।”
নায়ীব হতচকিত নেত্রে ফিরে চায়। স্রোত যেসব খাবার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে,তার তালিকায় নুডুলস একদম টপে। বিয়ের এতদিনেও নায়ীব কখনো দেখেনি তাকে নুডুলস খেতে। হতকচিত হওয়া স্বাভাবিক তাই।
নায়ীব কেঁশে গলা ঝাড়ে। সন্দিহান কণ্ঠে জানতে চায়,
“ শিওর?”
“ হু..”
“ আর কিছু খেতে মন চাইছেনা?”
“ না।”
“ আচ্ছা।”
স্রোত চুপচাপ সিংকের পাশটায় দাঁড়িয়ে রয়। নায়ীব নুডুলস বানালো দশ মিনিটেই। তবে সে এর আগে সবজি কাটাকুটি করল। সে নাকি ভেজিটেবল নুডুলস বানাবে। অদ্ভুত! সবজি দেখেই নাক মুখ কুঁচকে একাকার বানিয়ে ফেলল স্রোত। নায়ীব অবশ্য তা পাত্তা দিলনা। সব শেষ করে দুজনে রুমে আসলো। স্রোত পা তুলে বসলো বিছানায়। ঘড়ির কাটা তিনটার ঘরে পৌঁছানোর পথে। অথচ এখনও চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই তার।
নায়ীব জানলা আটকে দেয়। স্রোতের সামনাসামনি এসে বসে। চোখে তার প্রগাঢ় নিদ্রার ছড়াছড়ি।
স্রোত খেতে খেতে হুট করে প্রশ্ন করে,
“ খুব জ্বালাচ্ছি না? হুটহাট ক্ষিদে পেয়ে যায় এখন।”
লটকানো, বিরস মুখটার দিকে তাকিয়ে এক ধ্যানে চেয়ে রয় নায়ীব। নরম গলায় বলে,
“ কিসব ভাবেন আপনি! চুপচাপ খেয়ে ঘুমাতে আসুন। বাবুর অসুবিধা হবেনা?”
স্রোত চোখ নামিয়ে হাসে।
..
নয়টা মাস। দীর্ঘ একটা সময়। লম্বা এই সময়টা চমৎকার ভাবেই পার করেছে স্রোত। প্রেগ্ন্যাসির জার্নিটায় তার কষ্ট কম হয়েছে। তবে পা ফুলে গেছে। এই সমস্যা বাদে বাকিসব ঠিকঠাক। বাড়ি থেকে সবাই এসে তাকে দেখে গেছে। এই সময়টার ভেতর আরেক চমৎকার ঘটনা ঘটেছে। স্রোত এক্সাম দিয়েছে,রেজাল্টও ভালো এসেছে। জব-টবের এপ্লাই করলে তা পেতে বেশি বেগ পোহানো লাগবেনা।
ডেলিভারির ডেট ক্রমশ এগিয়ে আসছে। একটা চাপা ভয় তাকে ঝেঁকে ধরেছে। এই ভয়ে সে এক বদভ্যাস কাবু করেছে! নিশাতের মত সেও এখন নখ কাম-ড়ায়।
এই যেমন আজ। সন্ধ্যা থেকেই সে মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। একটু পরপর থু থু ফেলছে। নায়ীব আজ দ্রুত ফিরেছে। এসেই সে সব রিপোর্ট গোছানো শুরু করেছে। আড়চোখে স্রোতের এই কারবার দেখে তার মাথা ধরে যাচ্ছে। শেষমেশ সহ্য করতে না পেরে ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলেই ফেলল,
“ মুখে হাত কেনো? এটা কেমন বাজে অভ্যাস? সরান হাত। বাবুর অসুবিধা হবে।”
স্রোত ত্বরিত হাত সরালো। ভাবুক গলায় বলল,
“ আচ্ছা, হসপিটালে কয়দিন থাকতে হবে? আমি একা থাকব কীভাবে?”
নায়ীবের গলার স্বর সঙ্গে সঙ্গে পালটে যায়। কণ্ঠে আদুরে ভাব ফুটিয়ে সে বলে,
“ একা কোথায়? আমি থাকব, বাবু থাকবে।”
“ কাপড় তো আনলেন মেয়েদের। যদি ছেলে হয়?”
নায়ীব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। সবাই মেয়ের কাপড় বেশি কিনেছে। সেও কিনেছে। ছেলে বাচ্চার কাপড় খুব কম আনা হয়েছে। সে নিজেও মনে মনে একটা মেয়ের আশা করে একটু আধটু। তবে সে প্রকাশ করেনা।
নায়ীব উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“ছেলের জন্যেও কাপড় এনেছি। দু’টো হলেও সমস্যা নেই। আরামসে পরানো যাবে।”
স্রোত ঠোঁট কাম’ড়ে বলে,
“ কিন্তু বাবু তো একটাই।”
নায়ীব হাসে। রিপোর্টগুলো গুছিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে, কপালে চুমু বসিয়ে বলে,
“ যে-ই আসুক, সে যেন সুস্থ হয়ে আসে। আর তার মা-ও যেন সুস্থ থাকে। এর বাদে আর কিচ্ছু চাইনা। বসুন আমি খাবার আনি।”
..
ওয়াহিদ ঘুমু ঘুমু চোখে একবার সময় দেখে। একটা বাজে। নিশাতের কল আসার নাম নেই। ঘন্টাখানেক আগেই ওটিতে ঢোকানো হয়েছে স্রোতকে। নিশাত সেই খবর দিয়ে উধাও। অথচ সে সকালেই ওয়াহিদকে ধমকে-ধামকে বলেছে রাতে যেন সে সজাগ থাকে। খুশির খবর সে আগে ওয়াহিদকেই জানাবে। সকালে ওয়াহিদের অফিস আছে। সে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে এপ্লাই করেছিল। শেষ সময়টায় সে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছে পড়ালেখায়। ফলও পেয়েছে তেমন।
ভাবনার মধ্যেই ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠে ওর। ও হকচকিয়ে ফোন রিসিভ করে। ঘুম কাটিয়ে ডাকে,
“ নিশু?”
“ ওয়াহিদ,আপনি জেগে আছেন?”
ওয়াহিদ চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেই হুকুম দিল জেগে থাকতে। এখন আবার অহেতুক প্রশ্ন করছে। ওয়াহিদ কিছু বলার পূর্বেই নিশাত চঞ্চল গলায় বলে,
“ ছেলে হয়েছে,ওয়াহিদ। ভাইয়া পারেনা খুশিতে কেঁদে ফেলতে। কি সুন্দর বাবুটা। ভিডিও কল দেই?”
ওয়াহিদ প্রত্যুত্তর দেয়ার পূর্বেই নিশাত ভিডিও কল দিলো। রিসিভ করতেই একখানা নতুন মুখ দেখতে পেল ওয়াহিদ। আগ্রহ নিয়ে চেয়ে রইল ও। নিশাত ফোন ধরে আছে। তোয়ালে মোড়ানো বাবুটা তার বাবার কোলে। নিশাত ক্যামেরা ঘুরায়। তার চোখ মুখ ফোলা দেখে সঙ্গে সঙ্গেই ভ্রু কুঁচকে আসে ওয়াহিদের। জিজ্ঞেস করে,
“ মুখের এই হাল কেন? তুমি কান্না করেছো?”
নিশাত একটু সরে দাঁড়ায়। করিডোরে এখন অনেকে। তার বাবা,ভাবীর বাবা,মা,ভাই; প্রায় সবাই। প্রত্যেকে ব্যস্ত নবজাতক নিয়ে।
নিশাত চাপা গলায় বলে,
“ ঐ একটু কেঁদে ফেলেছি। ভাবীর কান্না দেখে একটু কান্না পেয়ে গেছিলো আরকি।”
“ কি সাংঘা’তিক! স্রোত কেঁদেছে?”
মাথা নাড়ে নিশাত,
“ খুব। ভাইয়ারও কান্না পাচ্ছিলো মনেহয়। চোখ টোখ যা লাল হয়েছিল!”
ওয়াহিদ অকারণেই হাসে। খ্যাকখ্যাক করা সেই হাসির শব্দে নিশাত হকচকায়। ওয়াহিদ একসময় বলে,
“ তাহলে এবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসি? ছেলে হওয়ার খুশিতে তোমার ভাই নিশ্চয়ই সবকিছু এপ্রুভ করে দিবে। আসবো?”
নিশাত রক্তিম চোখে চেয়ে ধমকে উঠে,
“ ফাজলামি ভালো লাগেনা,ওয়াহিদ!”
বলেই সে কল কেটে দেয়।
চলবে.