#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৬
নিশাতের পা জোড়া অচল হয়ে পড়ল যেন। থম মেরে ও দাঁড়িয়ে গেল। ওয়াহিদও দাঁড়ালো। তবে অত্যন্ত ক্ষীণ সময়ের জন্য। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখল, নিশাত নামের মেয়েটার চোখ-মুখ ভীত। এত ভীতু কেন এই মেয়ে? ওয়াহিদ কি তাকে র্যাগ দিয়েছে? অদ্ভুত! ভেবেই হাসি পেল ওয়াহিদের। তবে হাসলনা। গম্ভীর চোখে তাকিয়ে বলল,
“ এত অবাক হওয়ার কি আছে? তোমার বান্ধবীর থেকে জেনেছি।”
এরপরই সে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। নিশাত খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মিষ্টির থেকে নাম জেনেছে! আর কি কি জেনেছে খোদা জানে। নিশাত দ্রুত কদম ফেলে ক্লাসে যায়। এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে।
মিষ্টি সিট রেখেছে তার জন্য। পাশে বসেই নিশাত মেকি রাগী স্বরে বলল,
“ এই মিষ্টি! তোমাকে কেউ আমার নাম জিজ্ঞেস করেছে?”
“ উহ, হ্যাঁ! অনুষ্ঠানের দিন শেষের দিকে একটা ভাইয়া জিজ্ঞেস করেছে।”
“ কেনো বললে!”
অপ্রস্তুত হলো মিষ্টি। ছেলেটা তারও নাম জিজ্ঞেস করেছে সঙ্গে নিশাতেরও। সিনিয়র পরিচয় দেয়ায় গড়গড় করে নাম বলে দিয়েছে। এতকিছু তো মাথায় আসেনি!
… …
জোহার মা আজ বাসায় নেই, গেছেন তার কোন খালার বাসায়। বাবা পড়াশোনা নিয়ে এত সিরিয়াস না। পাশ করলেই হলো। তাই জোহা ভাবলো, আজ পড়বেনা। স্রোত এলেও পড়বেনা। তা-ই হলো। স্রোত এলো যথাসময়ে। ঘড়িতে কাটায় কাটায় পাঁচটা বাজছে তখন। আজ দেরিই হয়েছে বটে। জোহা দরজা খুলেই লম্বা করে সালাম দিল।
স্রোত ভেতরে ঢুকে সালামের জবাব দিল। সন্দিহান চোখে তাকে পরখ করল এরপর। মেয়েটার চোখ-মুখে উপচে পড়া হাসি। সবসময়ই হাসে ও।
জোহা তাকে নিয়ে গেল ভেতরের রুমে। এরপর বলল,
“ আপু, আজ পড়বোনা।”
স্রোত বিরক্তি নিয়ে তাকাল। চেয়ারে বসে ব্যাগটা রাখল টেবিলের ওপর। বলল,
“ জোহা, সময় নষ্ট না করে বসো। পড়া দাও।”
“ আপু প্লিজ। শুধু আজকের দিনটা? প্লিজ?”
“ তোমার আম্মুকে বলবো?”
“ আম্মু তো বাসায় নেই আপু। রোজ রোজ পড়তে ভালো লাগেনা। আজকের দিনটা অন্তত অফ দিন না।”
“ জোহা, চুপচাপ এসে বসো।”
আরো দুইমিনিট জোর করলেও লাভ হলোনা বিশেষ। স্রোত নিজের কথায় অনড়। জোহা বসল। অন্ধকার চোখ-মুখ। উজ্জ্বল পরিষ্কার আকাশে যেমন মেঘ ঘাপটি মেরে বসে অকস্মাৎ, ঠিক তেমন। স্রোত তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। পড়া ধরালো। মেয়েটা পারলো সবই। স্রোত তাই খুশি হয়ে বলল,
“ আচ্ছা, যাও! আজ শুধু ত্রিশ মিনিট পড়াবো।”
জোহা নিজের খুশি চেপে রাখল। পরবর্তী ত্রিশ মিনিট সে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিল পড়ায়। ঘড়িতে তখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। পড়া শেষ। স্রোত ব্যাগ নিয়ে উঠতেই জোহা লাফিয়ে তার হাত চেপে ধরে। বলে,
“ আম্মু বলেছে নাশতা করে যেতে। এখন যেতে পারবেন না আপু।”
স্রোত বসল ফের। জোহা ঠোঁট চেপে বলল,
“ আপু! আমি ছাদে যাব, আপনি যাবেন? অনেক বড়, সুন্দর ছাদ।”
স্রোত ‘না’ করার আগেই আরো দুইবার আবদার করলো জোহা। স্রোত না করলনা। দরজা খুলে এক ছুটে উঠল ছাদে। স্রোত উঠলো ধীরে ধীরে। এই মেয়ের সঙ্গে তো তার তাল মিলানো অসম্ভব। তার মনে আছে, নাইন-টেনে সেও এমন চঞ্চল ছিলো। ইন্টারে উঠেই কেমন গাম্ভীর্য তাকে ঝেঁকে ধরল। তার আলাদা খোলসই হয়ে উঠল গাম্ভীর্য। কিন্তু সে তো এমন নয়! এখনও সে পুরোদমেই চঞ্চল। তবে তা বাড়ির মানুষের সামনে।
জোহা আগে আগে উঠে চারপাশ দেখে নিল। আহহা! মন জুড়িয়ে গেল তার। এত বড় ছাদে তাহলে আরেকটা মানুষও আছে তাহলে! দারুণ হয়েছে! নিজেকে কয়েকবার বাহবা দিল জোহা। এখন স্রোত আসার পালা শুধু। জোহার সন্দেহ ঠিক হয় নাকি ভুল, তা ই দেখার অপেক্ষা।
নায়ীবের তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে সিগা রেটের শেষাংশ। অন্যহাতে চুইংগাম। অতিরিক্ত টেনশন ব্যতীত সে এই জিনিস ছুঁয়েও দেখে না। তবে মাঝেমধ্যে একটু সুখটান দিতে মন চায়। বাসায় বারান্দা আছে তিনটে। সেখানে দাঁড়িয়েও খাওয়া যায়। তবে নিশাত কিংবা নাবিদ সাহেব দেখলে সমস্যা। নায়ীব চায়না তার এই বাজে অভ্যাস কেউ দেখুক, জানুক। ইদানীং কাজের প্রেশারে তার অবস্থা নাজেহাল। যদিও কাজের চাপ বরাবরই ছিল। কিন্তু এখন সে হাঁপিয়ে উঠে। রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়না। কেমন যেন ছন্নছাড়া জীবন। এভাবে আর ক’দিন চলবে?
স্রোত দরজার পাশটায় এলো। জোহা মেয়েটা কোথায় গেল? সত্যিই ছাদটা বিশাল বড়। একদিকে ছড়ানো হরেক রকমের ফুলগাছ। সেদিকেই এগোলো ও। গোধুলী লগ্ন। কিঞ্চিৎ কমলা বর্ণের পরিষ্কার আকাশে পাখিরা উড়ছে, সঙ্গে বইছে মৃদুমন্দ হাওয়াও। মেইন রোডটা দূরে হওয়ায় তেমন কোলাহল নেই। বার কয়েক মিনমিন স্বরে জোহাকে ডাকলো ও। জোহা ঘাপটি মেরে দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বেরোচ্ছেনা। স্রোত ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক খুঁজতেই চোখ আটকে গেল। ব্যস! এটাই তো চাচ্ছিলো জোহা। সে দেখেছে দুপুরের দিকে নায়ীব ফিরেছে নিশাতকে নিয়ে। নিশাত রোজ বিকেলেই আসে ছাদে। ভাইও আসে সঙ্গে। জোহা জানে। জানে বলেই আজকে স্রোতকে এখানে টেনে এনেছে। তার কিশোরী মনের কৌতুহল যে দমছেনা। স্রোত আর নায়ীব কি পূর্ব পরিচিত? সে জানতে চায়।
নায়ীব আনমনা হয়ে গেল। নারীকণ্ঠ শুনে তৎক্ষনাৎ ফিরে তাকাল ও। ওমনি চার চোখ এক হলো। নায়ীবের ছোট ছোট চোখ দু’টোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মিলিত হলো স্রোতের বড়-বড় আঁখিযুগলের সঙ্গে। গুনে গুনে সেকেন্ড সাত এক হয়তো, এরপরই নায়ীব নিজেকে সংযত করল। কক্ষনো কোনো নারীর দিকে সে এত গভীর ভাবে তাকায়নি, খেয়াল করেনি। সে সু্যোগও সে নিজেকে দিতে চায়নি। একটা কঠিন ব্যক্তিত্ব সে ধরে রেখেছে সর্বদাই। তবে এখন কেন হঠাৎ হঠাৎ মন, চোখ ঘুরে যায়?
হাতের সিগা রেটটা তৎক্ষনাৎ ফেলে দিল ও। পায়ের তলায় পিষে এরপর তাকাল স্রোতের দিকে। স্রোত এখনও চেয়ে আছে। তবে এবার জড়তা নিয়ে।
স্বল্প হলেও তারা তো পরিচিত খানিকটা। কথা বললে নিশ্চয়ই অভদ্রতা দেখায়।
নায়ীবের দৃষ্টি গাঢ় হলোনা এবার। তবে তার চোখ দু’টো গোল-গাল মুখের আদল থেকে ঘুরে এল একবার। এরপরই চোখ আকাশের পানে স্থির রেখে প্রশ্ন করল,
“ আপনি এখানে?”
“ আব..আমি আসলে জোহাকে নিয়ে এসেছি।”
মিনিট খানেক গড়াল।
“ ওহ, গুড। আর কিছু চু রি যায়নি তো আপনার?”
কি ভেবে প্রশ্ন করেছে, নায়ীব নিজেও তা জানেনা। স্রোত চোখ ছোট-ছোট করে তাকাল। নায়ীবকে পরখ করে বলল,
“ জ্বি না!”
“ যাক, তাহলে ভালো। গুড লাক।”
নায়ীব পাশ কাটিয়ে এগোলো। সিঁড়ির কাছটায় চলে গেছে ও ততক্ষণে। স্রোত আনমনে তাকিয়ে রইল। ক্ষীণ স্বরে আওয়াজ তুলল,
“ আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এতবার দেখা কেনো হচ্ছে, ইন্সপেক্টর সাহেব?”
নাহ! আওয়াজ নায়ীবের কান অব্দি যায়নি। সুঠাম দেহের মানুষটার পা দু’টো বেশিই লম্বা বোধহয়। এই যে! সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল!
…
দ্রুত কদম ফেলে এগোলো নিশাত। ওইযে, ভার্সিটির বাইরে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে তার ভাই। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপাশে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সে। নিশাত দ্রুত হেঁটে রাস্তা পার হলো। নায়ীব তাকে আসতে দেখেই বাইকে উঠে বসল। নিশাত বসতেই হেলমেট বাড়িয়ে দিয়ে বাইক স্টার্ট করল। বাইকটা আজ অনেকদিন পর বের করেছে। বাইকের তেমন দরকার হয়না। যখন যেখানে যেতে হয়, তখন পুলিশের গাড়িই থাকে। আসার সময়ও নামিয়ে দেয়। নিশাত তো একাই আসতে পারে। তবে সে আজ ফ্রি থাকায় নিতে এসেছে। ক্লাস একেকদিন একেক সময় শেষ হয়। রোজ রোজ আসা সম্ভব না।
জ্যাম নেই আজ। সাঁ সাঁ করে ছুটে চলছে বাইক। নিশাত ভাইয়ের কাঁধে হাত চেপে ধরে। চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
“ আস্তে চালাও না, ভাইয়া! সর্দি এসে যাচ্ছে।”
নিশাতের সামান্য বাতাসেই ঠান্ডা লেগে যায়। নায়ীব হেসে ফেলে।
ঘড়িতে তখন আড়াইটা বাজে। রাস্তাটায় বড় বড় গাড়ি শুধু। রিকশা-টিকশা এদিকে নেই। স্রোত আর শুভ্রা হাঁটছে রাস্তার ধারে। শুভ্রা যাবে নার্সারিতে। স্রোতের যদিও বা আজ কাজ নেই। বিকালে জোহাকে পড়াতে যাওয়ারও তাড়া নেই আজ। তাই সেও যাচ্ছে।
বাইকের গতি সামান্য কম করতেই অকস্মাৎ কোত্থেকে পেছনে এসে বাড়ি লাগল। সেকেন্ড খানেকের মধ্যেই বাইকটা কাত হয়ে পড়ল। তারপর..তারপর রাস্তার ধারে ঠিকরে পড়ল দু’টো প্রাণ। মিনিট কয়েক হয়তো পার হলো। পাশ কাটিয়ে ধাক্কা দেয়া গাড়িটা চলে গেল। নায়ীব মাথা চেপে উঠে বসল। ওমনি নিঃশ্বাস আটকে এলো যেন। র ক্তে ভাসছে রাস্তাটা। নিশাতের অবচেতন শরীরটা খানিক দূরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। সাদা জামাটা লাল র ক্তে রঞ্জিত। নায়ীব চট করে নিজের হেলমেট খুলে ফেলল। সেটা একপ্রকার ছুঁড়েই হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো। হাঁটু, গোড়ালি, কনুইয়ে লেগেছে তারও। চিনচিন ব্যথাকে সে পাত্তা দিচ্ছেনা। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। নিশাতের মাথাটা কোলে নিয়ে হেলমেট খুলে ফেলল একটানে। নিশাত চোখ বুজে ফেলেছে। এলোমেলো চেহারাটায় থমকানো চোখে তাকিয়ে রইল নায়ীব।
চলবে.
#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৭
হসপিটালের করিডর, ফিনাইলের অসহ্যকর গন্ধ। রোগীদের আত্মীয় স্বজনের কতশত চাপা আহাজারি, প্রিয় মানুষের আরেকটু বেঁচে থাকার আশা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে দিন রাত!
নায়ীবের মা মা-রা যাওয়ার আগে হসপিটালে ভর্তি ছিলেন টানা একমাস। মা রা যাওয়ার পর আর হাসপাতালের ধারে কাছেও আসা হয়নি কারোরই।
নাবিদ সাহেবের গম্ভীর চোখ-মুখ। দুশ্চিন্তা থাকলেও চেহারায় ফুটে উঠছেনা। তিনি বরাবরই কঠিন ধাচের মানুষ। এখন তিনি নিজের দুশ্চিন্তা দেখালে ছেলের কি হবে? সে যে ঐ বিকাল থেকে থম মেরে বসে আছে। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেনা কোনোভাবেই!
“ আব্বু, মাফ করে দাও! আমি আর জীবনে বাইক ছুঁয়েও দেখবনা।”
নাবিদ সাহেব হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“ নায়ীব, মাফ চাচ্ছো কেনো? দোষ তো তোমার নয়। দোয়া করো, আব্বু! নিশাত ঠিক হয়ে যাবে। আমার বাচ্চার কিচ্ছু হবেনা।”
শেষের দিকে গলা মিইয়ে এলো।
“ রোগীর জ্ঞান ফিরেছে, দেখা করতে চাইলে একজন আসুন।”
দীর্ঘ চার ঘন্টা শেষে কলিজায় পানি এলো নায়ীবের। তবুও, অসহায় চোখে বাবার পানে তাকিয়ে ও বলল,
“ আব্বু তুমি যাও!”
নাবিদ সাহেব মাথা নাড়লেন। উঠে চলে গেলেন ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে।
“ আপনারও চেক আপ করানো উচিত। ড্রেসিং লাগতে পারে। অনেক খানি কে টে গেছে তো!”
রিনরিনে পরিচিত মেয়েলি স্বর। নায়ীব মুখে হাত ঘষে। কনুই, গোড়ালি ছিলে গেছে। ভাগ্যিস মাথায় হেলমেটটা ছিল! ভাগ্যিস! নাহলে নিশাত আর তার কি অবস্থা হতো? ভাবতেই রূহ কেঁপে উঠে! নিশাত সবসময়ই এসব ব্যাপারে সচেতন। সামান্য স্পীড বাড়ালেই মেয়েটা ভয়ে জমে যায়। রাস্তাটাও তো ঠিকঠাক পার হতে পারেনা এখনও।
“ শুনছেন?”
যেন কোনো গৃহবধূর আবদার মাখা ডাক। কণ্ঠে ভীষণ মায়া মিশানো। এবার আর ডাক উপেক্ষা করতে পারলনা নায়ীব। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মুখ তুলে তাকাল। তার এমন বিধস্ত চেহারা দেখে বুকটা ধক করে উঠল স্রোতের। সবসময় যে মানুষটা পরিপাটি হয়ে থাকে, তার এমন অবস্থা দেখে থমকানোটাই কি স্বাভাবিক নয়? পরনের নেভি ব্লু শার্টটায় র ক্ত লেগে ছিলো। শুকিয়ে গেছে এতক্ষণে। কালো দেখাচ্ছে তাই। পায়ের দিকটায়ও র ক্ত লেগে আছে। কনুইয়ের দিকটায় শার্ট ছিঁড়েছে সামান্য।
স্রোত, শুভ্রাই তাদের হসপিটালে আনতে সাহায্য করেছে। স্রোত তখনই জেনেছে নিশাত তার বোন! নায়ীবের অস্থিরতা, পাগলামো দেখেই সবাই বুঝেছে ছেলেটা ঠিক কতখানি ভালোবাসে বোনকে!
নায়ীব ফের মুখে হাত ঘষে। মৃদু স্বরে বলে,
“ অনেক ধন্যবাদ মিস.স্রোতশ্রী।”
প্রত্যুত্তর দেয়ার আগেই নায়ীব ফের বলল,
“ আপনার বোধহয় দেরী হয়ে যাচ্ছে!”
“ সমস্যা নেই! আমার হোস্টেল বন্ধ হতে অনেক্ষণ সময় আছে। আপনি ডাক্তার দেখিয়ে নিন। আংকেল আসলে নিশাতের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন তাহলে। ও নিশ্চয়ই আপনার এ অবস্থা দেখে খুশি হবেনা!”
একটানে বলে গেল স্রোত। নায়ীব ভাবশুণ্যের মত পড়ে রইল। কোনো ভাবাবেগ নেই। তবে যখন দেখল, স্রোতের চোখ-মুখেও একই কথা। তখন উঠে দাঁড়ালো।
সঙ্গের মেয়েটার কি যেন নাম..নায়ীব খানিক্ষণ পর মনে করতে পারল! শুভ্রা! সে আধ ঘন্টা আগে চলে গেছে। স্রোতই পাঠিয়েছে।
ডাক্তার বের হলেন কেবিন থেকে। নিশাতের পায়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে বড়-সড়। রিকোভার করতে সময় লাগতে পারে। বেড রেস্টেই থাকতে হবে ক’দিন। তাছাড়া সব ঠিক আছে। র ক্তও দেয়া হয়েছে তাকে। নায়ীব ডাক্তারের সঙ্গে যাওয়ার পূর্বে একবার কেবিনে উঁকি দিল। নিশাত চোখ বুজে আছে। পাশেই নাবিদ সাহেব হাত ধরে বসে আছেন। ঠোঁট নাড়িয়ে কি যেন বলছেন মেয়েকে!
নায়ীব ডাক্তারের সঙ্গে যেতেই নাবিদ সাহেব বের হলেন কেবিন থেকে। স্রোত তখন বাইরে রাখা চেয়ারে বসেছে। মানুষজন এদিকে কম। ফোনেও চার্জ নেই তার। নায়ীব আসলেই বিদায় নিয়ে চলে যাবে। তার আগে একবার নিশাতকে দূর থেকে দেখে যাবে। মেয়েটা ভীষণ নাজুক বোধহয়। বাবা-ভাইয়ের আদরের।
পাশে কেউ ধপ করে বসতেই চোখ তুলে তাকাল স্রোত। গোল-গোল চোখে তাকাতেই নাবিদ সাহেব সামান্য হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“ নাম কি তোমার?”
“ জ্বি, আংকেল.. স্রোতশ্রী। স্রোত বলেই ডাকে সবাই।”
“ বেশ ইউনিক নাম তোমার, মা। বাসা কোথায়?”
“ হোস্টেলে থাকি আংকেল।”
“ বাড়ি?”
“ জয়পুর। চিনবেন না হয়তো..”
“ কেনো চিনবোনা? স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে গেছিলাম সেখানে। অনেক সুন্দর গ্রাম।”
স্রোত মাথা নুইয়ে হাসলো। নাবিদ সাহেব আরও প্রশ্ন করলেন। সবই স্রোতের বিষয়ে। স্রোত নির্দ্বিধায় সেসবের উত্তর দিল। ততক্ষণে নায়ীব চলে এসেছে। বিশাল আকারের তিনটা ব্যান্ডেজ চোখে ভাসছে খুব। চোখ-মুখ মারাত্মক গম্ভীর। ভ্রু কুঁচকানো। শার্টের এক হাতা কনুইয়ের উপর ভাঁজ করা। অন্যহাত দিয়ে একহাত চেপে ধরে আছে ও। নাবিদ সাহেব হায় হায় করে উঠলেন। বললেন,
“ বাসায় চলে যা, চেঞ্জ করা উচিত এসব কাপড়-চোপড়। আমি এখানে আছি নিশাতের সঙ্গে।”
“ যাব, আব্বু। একটু পর।”
“ আপনি যাননি?”
আচমকা প্রশ্নে থতমত খেল স্রোত। নায়ীবের গভীর দৃষ্টি। অত্যন্ত ভাবুক হয়ে স্রোত বলল,
“ জ্বি, যাব! নিশাতের সঙ্গে একবার দেখা করা যাবে কি?”
নাবিদ সাহেব তৎক্ষনাৎ জবাব দিলেন,
“ অবশ্যই! কেনো যাবেনা! মেয়েটা সজাগ আছে এখন! রাতে হয়তো কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ পড়বে। যাও, যাও।”
স্রোত উঠলো। নাবিদ সাহেব চোখের ইশারায় নায়ীবকে বললেন,
“ তুইও যা।”
নায়ীব গেল। কেবিনের দরজাটা চেপে দাঁড়াল। স্রোত ঢোকার পর সেও পিছু পিছু ঢুকল। পায়ে টান লাগছে বেশ। ক’দিন তারও ছুটি কাটাতে হবে! তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বেডের কাছটায় যায় ও। নিশাত সজাগ তবে চোখ বুজে পড়ে আছে। স্রোত বসল বেডের পাশে রাখা ছোট্ট টুলটায়। মৃদু স্বরে ডাকল,
“ নিশাত?”
নিশাত ওমনি চোখ খুলল। নায়ীব এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। নিশাতের ডান পায়ের হাঁটু থেকে গোড়ালি অব্দি- সবটাই সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। বাম হাতের কিছু অংশও ঢাকা ব্যান্ডেজে।
“ আপু, আপনি?” তার স্বরে পরিচিত ভাবখানা স্পষ্ট যদিও। তবে নায়ীব সেসব খেয়াল করলনা। সে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে স্রোতের সামনে নিজেকে আটকে রাখার, শক্ত দেখানোর।
স্রোত মৃদু হাসল। নিশাতের ডান হাতের এক আঙুল ছুঁয়ে বলল,
“ সেসব কথা পরে হবে। এখন কেমন লাগছে মিষ্টি মেয়ে?”
নিশাত একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ভাইয়ের দিকে। ভাই ওমন চো রের মত নজর লুকাচ্ছে কেন? তার দিকে একবারও তাকাচ্ছেনা!
“ এখন ভালো লাগছে, আপু।”
পা পুরো অবশ করে রাখা। ব্যথাটা কিছু সময়ের জন্য হয়তো বুঝবেনা মেয়েটা। স্রোত তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। বলে,
“ জলদি ঠিক হয়ে যাও। তোমাকে আবার এসে দেখে যাবো আমি, কেমন?”
নিশাত সামান্য মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। স্রোত উঠে দাঁড়ায়। নায়ীব ওপাশে দাঁড়িয়ে। স্রোত উঠে দাঁড়াতেই তার দিকে তাকায়। স্রোত চোখে চোখ রেখে বলে,
“ আসি। ভালো থাকবেন।”
এরপর নিশাতের দিকে চেয়ে হেসে বেরিয়ে যায়। ও বেরোতেই নায়ীব দ্রুত কদমে ঘুরে এসে টুল দখল করে বসে। মাথা এগিয়ে বোনের কপালে দু’বার চুমু খায়। এরপর ডান হাতটা নিজের দু’হাতের মুঠোয় ভরে কাঁপা গলায় বলে,
“ আ’ম সরি নিশু। ভাইয়া আর কোনদিন বাইক ধরবেনা। প্রমিস।”
নিশাত ঠোঁট উল্টায়। এতক্ষণই বোধহয় তার ভাই ভালো ছিল। এত নরম, ভেঙে পড়া ভাইকে দেখে সে যে অভ্যস্থ নয়!
ওকে ঠোঁট উল্টাতে দেখেই নায়ীব উদ্বিগ্ন হয়। অস্থির গলায় বলে,
“ ব্যথা পাচ্ছিস সোনা? ডাক্তার ডাকবো?”
দুপাশে মাথা নাড়া নিশাত। এরপর মুখ খুলে বলে,
“ কিছুই ফিল হচ্ছেনা ভাইয়া। বাসায় কবে যাব?”
“ যাব, খুব জলদি।”
… …
তখন রাত বাজে প্রায় নয়টা। নায়ীব এখনও বাসায় যায়নি। নাবিদ সাহেব এক ঘন্টা যাবত তাই রেগেমেগে বসে আছেন। নিশাত এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ব্যথা সহ্য করতে পারবেনা নিশাত। তাই কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে তাকে। ভোরের আগে ঘুম ভাঙ্গবে বলে মনে হয়না।
তিনি তো এখানে আছেনই! নায়ীব তাও যাচ্ছেনা। অকারণে ময়লা কাপড়-চোপড়ে বসে আছে গোঁ ধরে। অসহ্য!
ভোঁতা মুখে তিনি বসে রইলেন।
জিহাদ ছুটতে ছুটতে এলো। নায়ীবকে এ অবস্থায় দেখে তব্দা খেয়ে বসে রইল। নিজের মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“ একি স্যার! আপনার অবস্থাও তো খারাপ! আপনি এডমিট হলেন না কেন?”
কপাল চাপড়াতে মন চাইল নায়ীবের। অসহ্য! এই বেকুব কি দেখতে পাচ্ছেনা নায়ীব হাঁটা চলা করতে পারছে?
“ জিহাদ! আমি ঠিক আছি। এডমিট হবো কেন?”
“ আপনাকে তো ঠিক লাগছেনা, স্যার! তাই বললাম..” মিন মিন স্বরে বলল জিহাদ।
নাবিদ সাহেব পাশ থেকে বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“ একে নিয়ে যাও তো! বিরক্ত লাগছে। সেই কখন থেকে বলছি বাসায় যেতে, শুনছেইনা!”
জিহাদ থতমত খেল। নায়ীবের পানে তাকালও। নায়ীব ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বলল,
“ যাচ্ছি! দরকার লাগলে সাথে সাথে কল দিবে।”
নাবিদ সাহেব ঠোঁট বাঁকালেন। নিজেই তো হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে! সেদিকে খেয়াল নেই! অদ্ভুত! তিনি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই বেরিয়ে পড়ে নায়ীব আর জিহাদ। জিহাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। নায়ীব তাতে চড়ে বসল। গাড়ি তখন মাঝরাস্তায়। নিস্তব্ধতায় ঘেরা চারপাশ। ল্যাম্পপোস্টের আলো চোখে এসে লাগছে নায়ীবের। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। গিয়ে কাপড় পালটে এক ঘুম দিবে। এরপর যা হবে দেখা যাবে। ক্ষিদেও ম রে গেছে!
গলির মুখে নেমে গেল ও। জিহাদ সঙ্গে আসতে চাইল। বলল, এগিয়ে দিবে। নায়ীবের চোখ রাঙানোতে আর সাহস করে জোর করতে পারলনা। নায়ীব দু’কদম এগিয়ে আবার ফিরে এল। জানলার ধারে এসে থমথমে গলায় বলল,
“ জিহাদ! বাসায় গিয়ে আমাকে স্রোতশ্রীর নম্বরটা ম্যাসেজ করে পাঠিয়ে দিও।”
চলবে.