#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৮
সূর্য আজ বেশ তেজ দেখাচ্ছে। স্রোত হোস্টেলে একটা রুমে একাই থাকে। রুম শেয়ার সে করতে পারেনা। ছোট্ট রুমটায় একটা জানলা আছে। ঠিক বেডের পাশে। সাদা পর্দা ভেদ করে সূর্যের ঝলকানি এসে হানা দিচ্ছে সকাল সকাল। সারারাত অকারণেই ঘুম হয়নি তার। চারটার দিকে যাও বা ঘুম লাগল, এখনই আবার ভেঙে গেল। মাথায় বালিশ চেপে ও শুয়ে রইল। ক’টা বাজে? খেয়াল নেই! আজ সে ভার্সিটি যাবেনা বলে ঠিক করেছে। শুভ্রাও যাবেনা।
যেই না ফের চোখ দু’টো লেগে এলো, তক্ষুনি ফোনটা হাঁক ছাড়ল। তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করল স্রোত। নম্বরটা খেয়ালে আসেনি তখনও। ভাবল,বোধহয় সাঈম সাহেব কল দিয়েছেন। রোজ সকালে তিনিই কল দেন।
“ হ্যালো..”
ঘুম মেশানো স্বর। আলুথালু অবস্থা তার কণ্ঠেই বোঝা যাচ্ছে।
ওপাশের মানুষটা যে থমকালো, বুঝতেই পারলনা স্রোত। ওপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসার আগে গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা গেল। ওমনি চট করে চোখ খুলল স্রোত। কান থেকে ফোন সরিয়ে স্ক্রিনে দেখে নিল নাম্বারটা। ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,
“ হ্যালো! কে বলছেন?”
“ স্রোতশ্রী, কেমন আছেন?”
থমকানো চোখে একবার ফের নাম্বার পরখ করল ও। পুরো নাম ধরে তো কেবল একজনই ডাকে তাকে। বাকিরা বলে তার নাম অনেক লম্বা।
“ আপনি! আশ্চর্য! ইন্সপেক্টর নায়ীব ইয়াকীন বলছেন?”
নায়ীব নিঃশব্দে হাসলো। অদ্ভুত! এই মেয়ে কি তাকে চিনতে পারছেনা? নাকি কল দেয়ায় অবাক হয়েছে? নিশ্চয়ই ভাবছে নাম্বার পেল কোথায়! মাঝেমধ্যে মানুষকে এমন চমকে দিলে তো মন্দ হয়না। নায়ীব ঠোঁট চেপে বলল,
“ জ্বি। আমিই বলছি। কাল হোস্টেলে পৌঁছেছেন সেফলি?”
“ হু, নিশাতকে কখন ডিসচার্জ দিবে?”
“ দিয়ে দিবে আজ।”
“ আপনার হাত-পায়ের অবস্থা কেমন?”
নায়ীব এ প্রশ্নে নাক কুঁচকে তাকাল নিজের হাত পায়ের দিকে। সকালে ফ্রেশ হতে গিয়ে ব্যান্ডেজ ভিজে গেছিল। এরপর আবার একা একা কোনোমতে ব্যান্ডেজ পাল্টাতে হয়েছে। জ্বলছিলো ভীষণ। নায়ীব গম্ভীর গলায় বলল,
“ হুম, ভালো।”
… …
মিষ্টির চোখ-মুখে জড়তা, ভয়। কি হচ্ছে না হচ্ছে বুঝে আসছেনা। সামনে বসা ওয়াহিদ। এই মানুষ ভর্তি ক্যান্টিনে মিষ্টিকে দাঁড় করিয়েছে জেরা করবে বলে। মিষ্টি ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে। ওয়াহিদ চায়ে চুমুক বসিয়ে তা দেখে বলে,
“ আরেহ অদ্ভুত! তুমি ঘামছো কেনো? বসো ওই চেয়ারটায়। দু’চারটা কথা বলি। বসো।”
মিষ্টিকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসতে হলো। মেয়েটা বসে কাচুমাচু মুখে প্রশ্ন করল,
“ কি কথা, ভাইয়া? আমার তো ক্লাস আছে।”
“ কিযে বলো! রুটিন দেখোনি নাকি! তোমাদের তো এখন অফ পিরিয়ড।”
মিষ্টি অস্থির হল। এ এসব খবর জানে কিভাবে?
“ তোমার বান্ধবী কোথায়?”
“ জ্বি?”
“ নিশাত কোথায়?”
এ পর্যায়ে চোখ ছোট ছোট হলো মিষ্টির। এই গর্দভটা একারণে তাকে জেরা করছে?
“ কি হলো? কোথায় ওই মেয়ে? তিন চারদিন ধরে দেখা নেই।”
“ ও তো কিছুদিন আসবেনা ভাইয়া।”
ওয়াহিদ এক ভ্রু কপালে তুলে। কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ কেনো, কেনো?”
মিষ্টির চোখ-মুখ গম্ভীর হলো। বলল,
“ জ্বি, ওর এক্সি ডেন্ট হয়েছে। বেড রেস্টে থাকতে হবে।”
“ কি! সেদিন না দেখলাম কার সঙ্গে বাইকে?”
বলে আবার নিজেই থতমত খেল ওয়াহিদ। পরক্ষণে ভাবল, থতমত খাওয়ার কি আছে! সে কি নিশাত বা মিষ্টিকে ভয় পায়? একদমই না! আর লজ্জা? সে তো ওয়াহিদের কোনো কালেই ছিলনা।
সে সোজা হয়ে বসে। মিষ্টি সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে,
“ আপনি কি আমার বান্ধবীর উপর নজর রাখছেন, ভাইয়া?”
“ বুঝে ফেলেছো? বাহ ভালো! তবে তোমার বান্ধবীকে আবার বলতে যেওনা। যাও এখন।”
মিষ্টি উঠে চলে গেল। ওয়াহিদ ভাবুক হলো। মেয়েটার এত বড় এক্সি ডেন্ট হয়েছে, যে বেডরেস্টে থাকবে? মিষ্টির সামনে স্বাভাবিক থাকলেও আপাতত তার কেমন কেমন যেন লাগছে। মেয়েটার দেখা সে কোথায় পাবে?
…
নায়ীবের হাতে স্যুপের বাটি। স্যুপ রান্না করেছেন নাবিদ সাহেব। থাই স্যুপ না কি যেন নাম! ইউটিউব ঘেটে ঘেটে এসব বের করে রান্না করেছেন। শেফ হলেও পারতেন। নায়ীব নিঃশব্দে রুমে ঢুকে। পরশু বাসায় আনা হয়েছে নিশাতকে। পরশু আবার নাবিদ সাহেবের বোন অর্থাৎ নায়ীব আর নিশাতের একমাত্র ফুপু এসেছেন। বাসাটা ওতো দূরে নয় তার। নিশাত ঠিক হওয়া না পর্যন্ত এখানেই থাকবেন ক’দিন।
পায়ে এখনও ব্যান্ডেজ নিশাতের। হাতের ঘা শুকিয়ে গেছে প্রায়। পায়েরটা সাড়তে অনেক দেরী। নিশাত হেলান দিয়ে বসে আছে। হাতে মোটা-সোটা গল্পের বই। ভাই এসে বসতেই সেটা সরিয়ে রাখল ও। নায়ীব এক চামচ স্যুপ মুখে তুলে দিতেই ওমনি কলিংবেল বেজে উঠল। নায়ীবের দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকাল নিশাত। নায়ীব আরেক চামচ স্যুপ মুখে তুলে দিয়ে বলল,
“ ফুপু দেখছে।”
এরপরই ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। দরজার কাছটায় আওয়াজ আসতেই নায়ীব ঘাড় ঘুরাল। নিশাতের চোখও ওদিকে। সে তাকিয়েই বড় করে হাসল। নায়ীব হাসলনা যদিও। তবে তার চোখ দু’টো বড্ড অদ্ভুত দেখাল।
জোহা এগিয়ে এল আগে আগে। শব্দ করে সে ই হাঁটে। স্রোত এলো পিছু পিছু। মাঝারি রুমটার এক ধারে দাঁড়িয়ে রইল। নায়ীব টুল টেনে দিল আরেকটা। নিজেও উঠে দাঁড়াল। বলল,
“ বসুন।”
জোহা টুলে বসলেও স্রোত বসলো বিছানায়। বেশ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,
“ কেমন আছো, নিশাত?”
“ ভালো আছি, আপু। আপনি?”
“ আমিও।”
নায়ীব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই স্যুপ তুলে দিল নিশাতের মুখে।
“ আপনার পা ঠিক হয়েছে?”
নায়ীব মুখ ফেরাল একবার। স্রোতের চোখ দু’টো থেকে ঘুরে এসে আবার তাকায় নিশাতের দিকে। ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,
“ জ্বি,ঠিক হয়েছে।”
ততক্ষণে তাদের ফুপু, নায়মা ও এসে দাঁড়িয়েছেন দরজার পাশে। তার চোখের দৃষ্টি বড়ই তীক্ষ্ণ। অপরিচিত মেয়ে মানুষ দু’টোকে পরখ করছেন তিনি। বাসায় ঢুকেই এরা লম্বা করে সালাম দিয়েছে। এরপর নিশাতের সঙ্গে দেখা করবে বলল। বড় মেয়েটাকে তো দেখে নিশাতের সাথের মনে হচ্ছেনা। ছোটটাকেও না!
নায়ীব খাইয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। নায়মা তক্ষুনি এগিয়ে এলেন বেডের পাশে। ছোট ছোট চোখে চেয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“ তা, তোমরা নিশাতের কি হও?”
স্রোত থতমত খেল। জবাব দেয়ার পূর্বেই ফট করে জোহা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ কিছু হইনা আন্টি। আবার হতেও পারি বা পারে,হেহেহে। আসলে আমি দুই তালায় থাকি। আর উনি আমার টিউটর।”
স্রোত তার হাত চেপে ধরল। মুখ তো নয় যেন ট্রেন! চোখ রাঙিয়ে তাকালেও দমলোনা জোহা।
স্রোত বলল,
“ নিশাত আমার ভার্সিটির জুনিয়র, আন্টি। সেদিন এক্সি ডেন্টের সময় রাস্তার ধারেই ছিলাম আমি।” গলা মিইয়ে এলো। নায়মা বুঝলেন, মেয়েটা ওতো পরিচিত ও না। তবে অপরিচিত ও না।
তিনি ‘ওহ’ বলে বেরিয়ে গেলেন। নিশাতের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে বেরিয়ে গেল ওরা। যাওয়ার আগে একবার নাবিদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করল স্রোত। এর ভেতর আর নায়ীবের ছায়াও দেখা যায়নি।
ওরা বেরিয়ে যেতেই আবার নায়ীব এল নিশাতের কাছে। এসে বসে কপাল ছুঁয়ে দেখল। সকাল থেকেই মেয়েটার মাথা গরম লাগছে। জ্বর টর না এলেই হয়। নিশাত হাই তুলতে তুলতে মুচকি হাসে। আচমকা প্রশ্ন করে,
“ তুমি ওই আপুটাকে চেনো, তাইনা ভাইয়া?”
নায়ীব বাঁকা চোখে তাকায়। চমকিত ভাবটা ভেতরেই চেপে রেখে বলে,
“ চিনবোনা কেন? সেদিন হসপিটালে যেতে তো উনিই সাহায্য করল।”
“ উহ, না! এর আগে থেকেই চিনো, তাইনা?”
নায়ীব গম্ভীর গলায় বলল,
“ এরকম কেন মনে হচ্ছে তোর?”
নিশাত মুখ টিপে হাসে। বলে,
“ তোমার আচরণেই বোঝা যাচ্ছে ভাইয়া। কত ক্যাজুয়ালি কথা বললে! তুমি তো অন্য মেয়েদের সঙ্গে এভাবে কথাই বলোনা ভাইয়া!”
“ আচ্ছা, তো কেমন করে কথা বলি?”
“ কথাই তো বলোনা!” নিশাতের হতাশ স্বর।
“ উনার সঙ্গে আমার থানায় দেখা হয়েছে। আর বেশি চিনিনা। ঘুমিয়ে পড়,সোনা।” বলে একবার বোনের চুলে চুমু খেল নায়ীব। এরপর বেরিয়ে গেল।
…
সন্ধ্যা।
খাবার টেবিলে একে একে নাশতা সাজালেন নায়মা। নাবিদ সাহেব তা দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন,
“ তুই কবে থেকে এত সুন্দর রান্না শিখলি, নায়মা?”
ভদ্রমহিলা আহাম্মক বনে গেলেন। বিয়ের আজ বিশ বছরের বেশি হবে হয়তো। বিয়ের আগে রান্না জানতেন না। এরপর ধীরে ধীরে শিখেছেন। তার ভাইয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে এখনও তিনি রান্নায় অপরিপক্ক! অদ্ভুত!
ধপ করে চেয়ারে বসে তিনি থমথমে গলায় বললেন,
“ হুম, দুনিয়ার রান্না তুমি একাই পারো শুধু।”
“ ঠিক ধরেছিস। খাবারগুলো মুখে তোলা যাবে তো? তোর স্বামী বেচারার জন্য আমার মুখ কষ্ট হতো আগে, বুঝলি!”
নায়ীব সবে এসে বসেছে। এসব শুনে হাসি পেয়ে গেল। নাবিদ সাহেব বরাবরই নায়মাকে জ্বালাতে ভালোবাসেন। সে হাসলো নিঃশব্দে। নায়মা তেঁতে উঠলেন। বললেন,
“ খাওয়া লাগবেনা তোমার! রাখো!”
বলার সঙ্গে সঙ্গেই পাকোড়া দু’টো মুখে ঢুকিয়ে ফেললেন নাবিদ সাহেব। নায়মা ফুঁসে উঠলেন। তবে কিছু বললেন না। খানিক্ষণ পরে পরিস্থিতি ঠান্ডা হতেই তিনি সুযোগ বুঝে বললেন,
“ বাসায় একা থাকতে কষ্ট হয়না? এই যে, রান্না বান্না করতে হয়?”
নাবিদ সাহেব বিরক্ত হন। এই মহিলা না আবার বিয়ের কথা তুলে তার!
“ হেল্পিং হ্যান্ড তো পাচ্ছিনা, ফুপু।”
নায়ীব খেতে খেতে বলে।
“ হেল্পিং হ্যান্ডের কথা বলছিনা! বিয়ে শাদিও তো করতে হয় পুরুষ মানুষের!”
“ আহ! নায়মা! এগুলো কি বলছিস?” নাবিদ সাহেবের বিরক্তিকর গলার স্বর শুনে একবার নিজের কপালে চাপড় দেন নায়মা। বলেন,
“ তোমার কথা বলছিনা ভাই, এই বয়সে তোমাকে কেউ চয়েজ করবেনা। আমি তোমার ছেলের কথা বলছি। বাসায় একটা বউ আসুক,নিজের মতো সংসার গোছাক।”
নাবিদ সাহেবের মুখ কালো হয়ে আসে। চয়েজ করবেনা মানে? তিনি এখনও ফিট! বয়স বোঝাই যায়না। পেটে অল্প মেদ জমেছে এই যা!
পরক্ষণে আবার বোনের শেষ কথাগুলো ভেবে উৎফুল্ল হলেন। ছেলে তার কাজ কাজ করে এত পা গল থাকে যে বিয়ের কথা তোলার সুযোগই হয়না! বয়স তো তারও থেমে নেই।
নায়ীবের খাওয়া থেমে গেছে। বিয়ে শাদির চিন্তা তো সে ভাবেনি এখনও। আরো কয়েক বছর পর ভাবার বিষয় এসব। বছর খানেক হলো প্রমোশন হয়েছে।
নায়ীব আড়চোখে তাকাল নাবিদ সাহেবের দিকে। ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি তার। তা দেখে নায়ীব তড়িঘড়ি করে খেয়ে উঠে পড়ল।
চলবে.
#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৯
“ ভাই? নায়ীব এমন পালালো কেনো?”
নায়মার অবাক স্বর। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন নাবিদ সাহেব। বললেন,
“ ওর এসবে আগ্রহ কম। সবসময় কাঠখোট্টা হয়ে থাকে।”
“ কতদিন বাড়ি-ঘরে কোনো মেয়ে মানুষের ছোঁয়া লাগেনি বলো! নিশাত তো পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। দুদিন পর ওরও বিয়ে দিতে হবে। তার আগে ঘরে বউ আনতে হবেনা? সংসারটা কেমন অগোছালো হয়ে আছে!”
তার হা হুতাশ শুনে একবার চোখ তুলে চাইলেন নাবিদ সাহেব। ভুল তো কিছুই বলেনি তার বোন। খেতে খেতে তিনি জবাব দিলেন,
“ হুহ, দেখি ওর সঙ্গে কথা বলে।”
“ তাহলে আমি পাত্রী খোঁজা শুরু করি?”
নায়মার মুখ চকচক করে উঠল।
“ হুহ? আচ্ছা, কর।” আনমনা হয়ে বললেন নাবিদ সাহেব।
…
ওয়াহিদ হাতে ফোন। ডায়ালে তোলা এগারোটা ডিজিট। এক ধ্যানে চেয়ে আছে সেদিকে। ওর বন্ধু পিয়াশ পাশ থেকে ধাক্কা দিল। বিরক্তি স্বরে বলল,
“ অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি, ব্যাটা। কল লাগা। এতক্ষণ ধরে কি দেখোস?”
ওয়াহিদ আরো সময় নিল। মাঝে একবার ভাবল, এসব করবেনা। কল-টল দিয়ে কি লাভ! তবে আনচান করা মনও যে বাঁধ সাঁধছে।
শেষমেশ পিয়াশ তার হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে কল লাগাল। স্পিকারে দিয়ে আবার ফেরত দিল। এক রিং, দুই রিং, তিন রিং..তারপরই কল রিসিভ হলো।
“ আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?”
ওয়াহিদের নিঃশ্বাস ঘন হলো। এমন মিষ্টি গলায় কেউ সালাম দেয়? ওয়াহিদের বুক ভার হচ্ছে ক্রমশ। নিঃশ্বাস ঘন ঘন ফেলছে। কখনো কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে এমন অস্থির লাগেনি ওর। আজই প্রথম। পাশ থেকে পিয়াশ এসব দেখে ভড়কে গেল। ইশারায় কথা বলতে বলল। ওয়াহিদ ব্যর্থ হলো। কল কেটে দিল। এরপরই পিয়াশকে দিল এক রামধমক,
“ শা!লা! কিসব ফালতু কাজ করতে যাচ্ছিলাম!”
পিয়াশের মাথাও গরম হলো। বলল,
“ তুই গোবর খা! প্রেম করতে এসেছে আমার! একটা মেয়ে পটাতে এত…”
ওয়াহিদ তাকে থামিয়ে দিল। থমথমে গলায় বলল,
“ তোকে কে বলল আমি ওকে পটাবো?”
পিয়াশ থেমে গেল ওমনি। থতমত খেয়ে তাকাল ওয়াহিদের পানে। কি যে উদ্দেশ্য এই ছেলের!
…
নিশাতের দু’হাতে দু’টো স্টিক। পাশেই মিষ্টি দাঁড়িয়ে আছে। আজ সে এসেছে নিশাতের সঙ্গে দেখা করতে। বর্তমানে তারা দাঁড়িয়ে আছে বাসার সামনের খোলা অংশ টুকুতে। আজ নিশাতের চেক আপ করানোর ছিল। হসপিটাল থেকেই ফিরছিল ওরা। পথিমধ্যি মিষ্টি বলল, বাসায় আসছে সে।
নাবিদ সাহেব আগে আগে উঠে গেছেন দরজা খুলতে। নিশাত অপেক্ষা করছে নায়ীবের আসার। সে গেছে দোকান থেকে কি যেন আনতে। মিষ্টি চকচকে মুখে আচমকা বলে উঠল,
“ এই, নিশাত! ওই সুন্দর সিনিয়র ভাই তোর খোঁজ করছিল!” এতদিনে তাদের সম্পর্কটা ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ এ চলে এসেছে। মিষ্টির চোখ-মুখে অকারণেই হাসি দেখা যাচ্ছে।
“ কে?” আতঙ্কে মুখ নীল হয়ে গেল নিশাতের। সে আন্দাজ করে ধরে নিল সেই সিনিয়রটা কে। মিষ্টি তার আন্দাজটা সত্য করে দিয়ে বলল,
“ ওয়াহিদ না কি নাম..খোঁজ করছিল বুঝলি! জেরা করেছে আমাকে! আমি তো ভাবলাম তোর সঙ্গে দেখাই না করতে চায়!”
মিষ্টি নিচু স্বরে বলে উঠে। নিশাত ঢোক গিলে। এ আবার কে পিছনে পড়লো? ভাইয়া জানলে নির্ঘাত কে টে ভাসিয়ে দিবে!
“ কি ভাবছিস রে তুই এত?”
মিষ্টির গলায় ধ্যান ভাঙে নিশাতের।
বলে,
“ এসবে পাত্তা দিসনা। দেখলেই এড়িয়ে যাবি। আমার খবর ভুলেও দিবিনা। ভাইয়া জানলে ওকে সহ আমাকেই না মা রে!”
“ আশ্চর্য! তোকে মা রবে কেনো? ভাইয়া তোকে কতো ভালোবাসে!”
নিশাত নিশ্চুপে সম্মতি জানায়। ভাইয়া তাকে জানের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তবে নিশাত কিছু লুকিয়ে রাখলে খুব রেগে যায়।
..
স্রোত কাছে ভাংতি নেই। রিকশা ওয়ালা একশো টাকার নোট নিবেন না। স্রোত পড়লো ফ্যাসাদে। রিকশা থেকে নেমে ও টং দোকানের ধারে আসে। টং দোকানে চা, সিগা রেট, বান ছাড়া আর কিছুই বোধহয় নেই। মাথা সামান্য এগিয়ে স্রোত মিহি গলায় জানতে চায়,
“ আংকেল, একশো টাকার ভাংতি হবে?”
দোকানদার মাথা নাড়িয়ে বলেন,
“ না, এত টাকা আর বিক্রি হয়নাই।”
“ আমার কাছে আছে।” ভরাট স্বর। স্রোত খেয়াল করতেই থমকে গেল। নায়ীব তাকায়নি তার দিকে। হাতে আস্ত সিগা রেটের প্যাকেট নিয়ে ও বেরিয়ে এল। সেটা দেখে মুখ কুঁচকাল স্রোত।
“ ভাংতি লাগবে?”
স্রোত মাথা নাড়ে। একটু সরে দাঁড়ায়। এই লম্বা চওড়া মানুষটার মুখটা বড্ড উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ইদানীং। সত্যিই দেখাচ্ছে? নাকি শুধু স্রোতের চোখেই লাগছে? কে জানে! স্রোত উত্তর খুঁজে পায়না। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই নায়ীব ভাংতি এগিয়ে দিল। স্রোত পলক ঝাপটে সেটা নিয়ে নোট এগিয়ে দিল। এরপর রোড সাইডে গিয়ে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে এল। নায়ীব অকারণেই দাঁড়িয়ে ছিল। যেন অপেক্ষা করছিল স্রোত কখন আসবে! সে আসতেই গলি ধরে হাঁটা শুরু করল নায়ীব। স্রোত পিছু পিছু এগুলো।
মানুষটার পেটানো শরীরে বাদামী রঙের শার্ট, কালো ফর্মাল প্যান্ট। হাতা দু’টো গুটিয়ে রাখা। চুলগুলো বোধহয় লম্বা রাখতে পছন্দ করেনা সে। স্রোত এ ব্যাপারে খুশি হলো। ছেলে মানু্ষের লম্বা চুল তার পছন্দ না!
পরক্ষণে নিজের ভাবনায় নিজেই নাক কুঁচকালো। যাকে নিয়ে সে ভাবছে, সে তো তাকে খেয়ালই করেনা ঠিকঠাক— এসব ভেবেই মুখে অন্ধকার নামলো স্রোতের। মন কেবল এই মানুষটার কারণে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে কেনো?
নায়ীব হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় বাঁকাল সামান্য। যখন দেখল মেয়েটা মাথা নত করে হাঁটছে, তখন আরেকটু বাঁকাল। কবে না জানি ঘাড়টাই ছিঁড়ে যায়। ঘাড়ে টান পড়তেই আবার মাথা সোজা করে নায়ীব। মেয়েটার গায়ে কালো রঙের একটা ড্রেস। গলার কাছটায় সবসময়ের ন্যায় ওড়না। চুলগুলো এলোমেলো খানিকটা। কপাল, কানের কাছে পড়ে আছে কয়েক গুচ্ছ। মেয়েটা সরাচ্ছেও না! নায়ীব হতাশ হয় নিজের কাজে। এক দেখায়, এত কিছু খেয়াল করা কি অন্যায় নয়? তাও একটা মেয়ে মানুষকে! কিন্তু নায়ীবের মন চিৎকার করল, ‘না! একদমই অন্যায় না!’ নায়ীবের ব্যাক্তিত্ববোধ প্রশ্রয় পেল যেন। মেয়েটার দিকে তাকালেই কি কিছু হবে নাকি?
গেট পেরিয়ে ঢুকতেই দেখল নিশাত আর মিষ্টি এখনও দাঁড়িয়ে। নিশাতকে ডাক্তার বলেছেন রেগুলার হাঁটতে। বিছানায় শুয়ে বসে থাকলেই তো হবেনা! হাঁটার চেষ্টাও করতে হবে! স্টিক দু’টো ধরে দাঁড়িয়ে আছে ও। ভাইকে দেখে চোখ দু’টো যতটা চকচক করে উঠল। তার চেয়েও বেশি চকচক করে উঠল, যখন ভাইয়ের পিছু পিছু আরেকজনকে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখল। মিষ্টির হাত বাম হাত দিয়ে চেপে ধরল নিশাত। বাম হাতের স্টিকটা পড়ার আগেই খপ করে ধরে ফেলে মিষ্টি। বলে,
“ কি হয়েছে?”
নিশাতের অর্ধেক ভর তখন মিষ্টির উপর। কাঁধের দিকটায় ওকে ধরে রাখে মিষ্টি। নিশাত ফিসফিস করে বলে,
“ ভাইয়া আর আপুকে খুব মানাচ্ছে, তাইনা?”
“ কি বলছিস?”
“ সামনে তাকা গাধি!”
সামনে তাকাল মিষ্টি। এরপর বলল,
“ হুহ, মানাচ্ছে দারুণ। কিন্তু কেন?”
“ ওরা কাপল হলে কেমন হবে?”
মিষ্টি থতমত খেল। নিশাত হেসে দ্বিগুণ ফিসফিসালো,
“ সুন্দর লাগবে, তাইনা!”
নিশাত এরপরই গম্ভীর চোখে তাকাল। বলল,
“ ভাইয়া যেন জানতে না পারে, মিষ্টি। নাহলে তোকে আর আমাকে কব র দিবে!”
স্রোত এগিয়ে এল। বরাবরের মত এবারও ঠোঁটে চওড়া হাসি। হাসলে মেয়েটার গজ দাঁত উঁকি দেয়। চোখ দু’টো বড্ড সুন্দর দেখায়। নিশাত একবার পেছনে থাকা ভাইকে দেখে নেয়। ইশ! ভাই এই হাসিটা দেখলেই কুপোকাত হতো নিশ্চিত!
…
আজ থানায় এসেছে নায়ীব। সামনে জিহাদ বসা। দুজনে মিলে খুব সিরিয়াস একটা কেস নিয়ে বসেছে। উপর বিভাগ থেকে চাপ আসছে খুব। এসবের মধ্যে আর এক্সিডেন্ট করা গাড়িটার খোঁজ পায়নি নায়ীব। তবে লোক লাগানো আছে। চ্যাকপোস্ট এমনিতেই বসানো। শহর থেকে বেরোলে অবশ্যই খোঁজ পাওয়ার কথা।
জিহাদের মাথা ধরে গেল। কোন এম.পির দুসম্পর্কের আত্মীয় সুই সাইড করেছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও উল্লেখ্য এটা সুই সাইড! তাও এরা জোর করে খু*ন বানাতে চাইছে এটাকে। আহহা! ষোলো বছরের একটা ছেলেকে কেউ কেনো খু*ন করবে? এম.পির আত্মীয় বলেই হয়তো কেসটা ধরতে হয়েছে। নাহলে সময় নষ্ট করতে হতোনা।
নায়ীব গম্ভীর চোখে ফাইলে চোখ বুলাচ্ছে। পুরোটা দেখে ফাইল বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসল সে। জিহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ কাল এই কেসের কাজ শুরু করতে হবে। সকাল সকাল বেরোবো, লেট করোনা।”
জিহাদ মাথা নাড়ে। উঠে যায়। দরজার পাশটায় যেতেই নায়ীব আবার তাকে ডেকে পাঠায়। জিহাদ ফের আসে টেবিলের কাছে। বলে,
“ জ্বি,স্যার?”
“ তুমি বিয়ে করেছো?”
বিষম খায় জিহাদ। আহাম্মক বনে বলে,
“ জ্বি,স্যার?”
“ করেছো?”
“ হ্যাঁ, স্যার। সামনের মাসে অ্যানিভার্সেরি।”
শেষের কথায় সামান্য লজ্জা পাওয়ার ভাণ করে সে। নায়ীব ছোট ছোট চোখে তাকায়। সেদিন নাবিদ সাহেব ইনিয়ে বিনিয়ে কতোবার তাকে বিয়ের কথা বলেছেন। তবে নায়ীব এড়িয়ে গেছে। কিন্তু ফুপু এ বিষয়ে বেশ এক্টিভ বলা যায়। তিনি সরাসরিই বিয়ের কথা বলে তাকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন। নায়ীব না করতে পারেনি।
“ বিবাহিত জীবন তোমার কেমন লাগে, জিহাদ?”
“ আমার তো ভালো লাগে স্যার, এটলিস্ট সিংগেল লাইফ থেকে ফার বেটার!”
“ এক্সপ্লেইন করো কীভাবে!”
“ খুব দায়িত্ব বেড়ে যায় স্যার। ছোট ছোট বিষয়ে নজর রাখতে হয়। কিন্তু স্যার এসবেও আলাদা তৃপ্তি আছে। সারাদিন কাজের প্রেশারে মাথা ধরলেও কেউ একজন আমার জন্য বাসায় আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে, ভাবলেই মাথা ধরা ছেড়ে যায় স্যার। বউয়ের চেহারায় আলাদাই শান্তি। মাঝেমধ্যে ঝ-গড়া-ঝাটি হয়, তবে এসবেও মজা আছে স্যার। আমার তো লাভ ম্যারেজ, আরো বেশি ঝগড়া হয় স্যার! তবে ভালোবাসাও কম হয়না!”
সামান্য কেঁশে উঠে নায়ীব। মুখে হাত চেপে ধরে। তার এ অবস্থা দেখে জিহাদ দাঁত কেলালো। ফের মুখ খুলল,
“ আমি তো বলব, স্যার আপনিও বিয়ে করে নিন। বিয়েতে খুব শান্তি স্যার! বিশ্বাস করুন! লাভ ম্যারেজ হলে আরো মজা। মজার কোনো শেষ নেই।”
বলতে বলতে বেচারা হাঁপিয়ে গেল। নায়ীবের চেহারায় নমনীয় ভাব ছিল এতক্ষণ, তাই সে অনায়াসে এসব বলে গেছে। তবে এখন চেহারায় কঠোরতা, তীক্ষ্ণ নজর দেখে জিহাদ ঠোঁটে কাম ড় দিল। জিহাদ তড়িঘড়ি করে বলল,
“ যাব স্যার?”
“ যাও!”
জিহাদ বাইরে এসে হাঁফ ছাড়লো। আহহা! কি বড়বড় লেকচার দিয়ে এল! মজার শেষ নেই! বিয়ের পর কিসের মজা! জীবনের রংটাই তার ফ্যাকাশে হয়ে গেছে! বউয়ের রাগ ভাঙ্গাতে গেলেই ঝাড়ি খেতে হয়। আবার না ভাঙ্গালেও কুরুক্ষেত্র! হতাশ নিঃশ্বাসটা অচিরেই বেরিয়ে আসে জিহাদের!
চলবে.