গোপনে_রাঙানো_প্রেম পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
633

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—২৫

সুহাদের হঠাৎ শহরে আগমন। স্রোতের ক্লাস শুরু হবে ক’দিন পর। তাই ভাবল, ব্যস্থতা ঘিরে ধরার আগে একটু ঘুরে আসুক। স্রোত বেশ সুন্দরমত তৈরি হয়ে নামলো। হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় রাস্তা পার হয়ে গাড়িতে চড়ে বসল। তবে সেকেন্ড খানেক গড়াতেই খুশির সঙ্গে সঙ্গে সে চরম পর্যায়ের চমকে গেল! যতটা চমকালে ঠোঁটের ভাঁজে ইয়া বড় ফাঁক দেখা যায়! ঠিক ততটাই। সুহাদ স্টিয়ারিং ঘুরালো। ভিউ মিররে একবার আরেক সুশ্রী চেহারা পরখ করে নিল। পেছনের সিটে বসে আছে রোজ! তার ঠোঁটেও বিস্তর হাসি। মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসে! সুহাদ এই নিয়ে মোট দুইবার মুগ্ধ হলো! আসার পথে ওতটা কথা না হলেও সুহাদের ভালো লেগেছে। মেয়েটা অল্পভাষী, তবে ওতটাও না। খুব মজার মজার কথা বলে, সুহাদ না হেসে পারেই না!
স্রোত অর্ধেক ঘুরে বসল। মাথা উঁচিয়ে পেছনে তাকিয়ে বড় একটা হাসি উপহার দিয়ে বলল,
“ ভাবী! হোয়াট আ সারপ্রাইজ! আমি তো কল্পনাই করিনি তুমি আসবে!”

রোজ হেসে হাত বাড়াল। স্রোতের গাল টেনে বলল,
“ তোমার ভাইয়া জানাল, আজ আসবে। হবু ননদিনীর সঙ্গে তো টাইম স্পেন্ড করার সুযোগই পেলাম না। তাই তোমার ভাইয়ার সঙ্গে চলে এলাম।”
স্রোত খুশিতে কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। পুরোটা দিন ওরা ঘুরবে! গল্প করবে!
সুহাদ গাড়ি থামালো একটা খোলা-মেলা রেঁস্তোরার সামনে। ওরা বসল আউট-ডোরেই। স্রোত আর রোজ বসলো পাশাপাশি। স্রোত খেয়াল করল, তার ভাই অল্প-সল্প লজ্জা পাচ্ছে। কেমন আঁটসাঁট বেঁধে চুপচাপ বসে আছে। স্রোতের সঙ্গে যার দুনিয়ার গল্প থাকে, সে-ই কিনা আজ চুপ? সে ব্যাপারখানা বুঝতে চোখ ঘুরালো রোজের দিকে। মেয়েটা দেখতে ফর্সা, গোলগাল মুখের আদল। কোঁকড়াচুলে দারুণ মানায়। হাইটটাও বেশ! সুহাদের সাথে খাপে খাপ! ও খেয়াল করল আবার, সুহাদ একটু পরপরই রোজের পানে তাকাচ্ছে। নজর হয়তো লজ্জায় পড়ে স্থির করতে পারছেনা! স্রোত এই চমৎকার দৃশ্য দেখে ভীষণ খুশি হলো! কিন্তু আবার ভাবনায় এল, সাঈম সাহেব সুহাদের জন্য চমৎকার একজনকে বেছে নিয়েছেন। এমন মেয়ে তার ভাই শত চেষ্টা করলেও খুঁজে পেতনা বোধহয়! তাহলে তার বেলায় কেনো এক হাঁদারাম ধরে আনা হলো? ভাবতেই মুখ কুঁচকালো স্রোত। এই ভাবনা থেকে আবার মনে পড়ল, হেমন্তের বিয়েতে মানা করার পেছনের রহস্যটা সে এখনও জানতে পারেনি! নায়ীবকে জিজ্ঞেস করার সুযোগই হয়নি! পরশু সন্ধ্যার পর তো আর দেখাই হলোনা! কথা হয়েছে ওই যা! স্রোতের একদম খেয়ালে নেই এ ব্যাপারটা!

রোজ স্রোতের দিকে তাকালো একবার। এরপর সুহাদের দিকে। সুহাদকে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা দিল কি যেন! স্রোত ভাবুক হয়ে বসে আছে। মেন্যু দেখতে দু’বার ডেকেছে সুহাদ। কিন্তু মেয়েটা কি খেয়ালে বন্দি, কে জানে!
রোজ আলতো করে স্রোতের কাঁধে হাত রাখতেই স্রোতের ধ্যান ছুটে। ওর হকচকিয়ে উঠা দেখেই মুচকি হাসে রোজ। বলে,
“ মেন্যুটা দেখে অর্ডার কনফার্ম করে ফেলো, খাবার আসতে দেরী হবে।”
স্রোত ডিস সিলেক্ট করে দিল। ওয়েটার যেতেই নড়েচড়ে বসল সুহাদ। খোলা আসমানের নিচে বসা ওরা। মানুষজন একদমই নেই। ইচ্ছে করেই এমন কোলাহলমুক্ত পরিবেশ বেছে নিয়েছে সুহাদ। স্রোত ভাইকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে নড়েচড়ে বসল। কাঁধের কাছটা থেকে চুল সরাতে সরাতে বলল,
“ কি হয়েছে?”
“ কি হবে আবার! ইদানীং কি খুব ব্যস্ত থাকিস?”
“ ব্যস্ত কেন থাকবো! ওই বিকেলে যা বেরোই আরকি। ঘন্টা দু’এক বাইরে থেকে চলে আসি।”
স্রোত দূর গগনে চেয়ে রইল নির্নিমেষ। ওর কণ্ঠটা কেমন নড়বড়ে শোনালো। সুহাদ, রোজ; দুজনই লক্ষ্য করল। মেয়েটা একটুতেই অন্যমনস্ক হয়ে যায়।

রোজ হঠাৎ ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে উঠে গেল। সুহাদ অনেক্ষণ ধরেই কিছু বলবে বলে হাঁসফাঁস করছে। ভাই-বোনকে স্পেস দেয়ার জন্যই মূলত ও ওয়াশরুমের কথা বলে উঠে গেছে। সুহাদ বুঝতে পেরেছে তা! মনে মনে সন্তুষ্টও হলো! মেয়েটা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী! সংসার জীবন নিশ্চয়ই চমৎকারই কাটবে তাদের।
রোজ যেতেই মুখ খুলল সুহাদ,
“ বিয়ের ব্যাপারে কি ভাবছিস?”
“ কি ভাববো? ওহ প্লিজ! আবার পাত্র দেখা শুরু করোনা তোমরা! একজনের সঙ্গে দেখা করেই ফেড আপ আমি! এর থেকে মহিলা-গোষ্ঠী এসে হেঁটে দেখাও, চুল দেখাও; বললেও আমার গায়ে লাগতোনা। ওই ছেলেটা আস্ত এক রামছাগল! আব্বুর চয়েজ ভয়াবহ!”
বিরক্তি ভঙ্গিতে বলল স্রোত। সুহাদ নাক-মুখ কুঁচকালাও কিঞ্চিৎ। সে স্রোতের সঙ্গে একদমই একমত নয়! তাই তেঁতে উঠল বেশ,
“ রোজও আব্বুরই চয়েজ! ওকে দেখেছিস? লিট্রেলি আমার ড্রিম গার্ল! যেমন চেয়েছিলাম তার চেয়েও ও বেশি ম্যাচিউরড! শি ইজ মোর দ্যান এনাফ! আব্বু চয়েজ না করলে, আমি এমন মেয়ে ইহজনমেও পেতাম না,ড্যাম শিওর।”
সুহাদের কণ্ঠ ঝলমলে শোনাল এবার। হবু বউয়ের প্রতি তার গভীর অনুভূতি বুঝতে পারল স্রোত। হাসলো তা বুঝে। সত্যিই তার ভাবী অতুলনীয়! নাহলে এক মাসেই তার প্রায় সন্যাস গ্রহণ করা ভাইকে প্রেমে ফেলে?
ওর হাসি দেখে খানিকটা লজ্জা পেল সুহাদ। বেশিই বকে ফেলল নাকি? তবে এবার ও প্রসঙ্গ পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে মোদ্দা কথায়ও এল,
“ ছেলেটার নাম কি?”

স্রোত চমকালো না। সে জানতোই, এ প্রশ্নের মুখোমুখি হবে। ও চোখ নামালো। মিহি গলায় বলল,
“ নায়ীব..নায়ীব ইয়াকীন।”
“ কি করে?”— সুহাদের ভাবখানা এমন, যেন সে কিছুই জানেনা। অথচ সে গতকালই ছেলেটার নাড়িনক্ষত্র বের করে ফেলেছে!

স্রোত কেমন ভীতগ্রস্থ হলো এবার। জড়ানো গলায় জবাব দিল,
“ পুলিশ!”

সুহাদ চমকানোর নাটকটা আর করতে পারলনা। স্রোতের ভীত চেহারা দেখেই দমে গেল। পুলিশের সঙ্গে প্রেম করতে ভয় পায়না! অথচ বলতে ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে!
স্রোতের জানা আছে, বাবা পুলিশদের বিশেষ ভালো চোখে দেখেননা। কর্মজীবনে তিনি যথেষ্ট সৎ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানরত। কিন্তু এই পুলিশ-টুলিশে তিনি কেমন একটা নাক সিঁটকান। সুহাদও তা জানে।
সুহাদ ভ্রু কপালে তুলে আশ্বাস দিতে চাইল,
“ অযথা ভয় পাচ্ছিস কেন? মেয়ের পছন্দকে আব্বু অবশ্যই গুরুত্ব দিবে,সে নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবেনা।”

কথা বলে থামল ও। রোজ তখন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে,পুরো আউটডোর ঘুরে দেখছে। সুহাদ কথোপকথনের ইতি টানতে বলল,
“ রোজের মায়ের শরীর খুব একটা ভালো। একমাত্র মেয়ের বিয়েটা উনি খুব ধুমধাম করে দিতে চান। আব্বুর এতে আপত্তি নেই, আমারও নেই। তবে আমার আপত্তি অন্য জায়গায়, তোর আগে আমি বিয়ে করবোনা।”
সুহাদ লম্বা নিঃশ্বাস টানল,চোখ ঘুরাল রোজের দিকে। স্রোত খানিকটা অসন্তোষ হয়ে বলল,
“ আমার জন্য নিজের বিয়ে আটকে রাখার কি মানে! এরকম মেয়ে পেলে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করে ফেলা উচিত। পরে যদি ভাবীর মুড চেঞ্জ হয়ে যায়?”
শেষের দুই বাক্য কেমন কৌতুকের মতন করে বলল স্রোত। রাগ-টাগ করে এই সুন্দর বিকেলটা মাটি করার মানে নেই—তা বুঝার জ্ঞান অবশ্যই স্রোতের আছে। সুহাদ ওর কথায় ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। মুগ্ধতায় বুদ হওয়া তার দৃষ্টি-জোড়া তখনও রোজের পানে স্থির। বলল,
“ চেঞ্জ হলেও তো লাভ নেই। সুহাদ রহমান ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়।”

..

ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। তবে বহু কষ্টে চোখ খুলে ফোন হাতে তুলল। চার্জ শেষ হওয়ার পথে। এর পূর্বেই একটা কল দিয়ে ফেললো ডায়াল লিস্টের একদম টপে অবস্থান করা নাম্বারটায়। আধ-মিনিটের মাথায় ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে শোনা গেল মানুষের হই-হট্টগোল। স্রোত উঠে বসল। স্ক্রিনে চোখ বুলালো। না! ঠিক নাম্বারেই তো কল দিয়েছে।
সেকেন্ড খানেক গড়াতেই একটা ভারী পুরুষালী গলা শুনতে পেল ও। মুহুর্তেই মনটা শান্ত হয়ে গেল ওর..
“ কথা বলছেন না কেনো?”

কেমন রুক্ষ-কোমলের মিশ্রিত স্বর শোনা গেল। স্রোত ওতশত ভাবলনা। জবাবে বলল,
“ এত চেঁচামেচি শুনে বলিনি। কিসের আওয়াজ হচ্ছে?”

নায়ীব ওপাশ থেকে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। জিহাদকে রেখে সরে এল কোলাহল থেকে। বাসায় ফিরতে আজ ক’টা বাজবে কে জানে! রাত-বিরেতে এই জায়গায় খু*না*খু*নির মত অবস্থা! তাও আবার আড্ডা দিতে দিতে। ভাগ্যিস কেউ পুলিশকে আগে-ভাগে ফোন দিয়েছে, নাহলে নিশ্চয়ই এসে ক’টা লা-শ পেত ওরা!
তখন অনেকেরই ডিউটি শেষ। নায়ীব এমনিতেই আজ ভীষণ ব্যস্ত ছিল। কাজ সামলে বাসার উদ্দেশ্যে বেরোনোর ক্ষণেই এই কুকান্ড ঘটলো! তাই বাসায় যাওয়া হলোনা আর।
ক্লান্তিতে গলা রোধ হয়ে এল ওর। ভাবনায় আসা এত-এত কথা আর কণ্ঠনালি গলিয়ে বেরোলো না। স্রোত তখন অধীর আগ্রহে শোনার অপেক্ষায়! নায়ীব কেবল ছোট্ট করে বলল,
“ একটা জায়গায় কাজে এসেছি। মানুষের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে তাই। বাসায় গিয়ে কল দেই?”

স্রোত জানে, নায়ীবের কাঁধে থাকা কাজের ভার আর দায়িত্ব মোটেও হালকা নয়। প্রেমে আকুবাকু করা মনটা তবুও অবুঝ বনে গেল। পুরোটা দিনে কি পাঁচ মিনিট সময় প্রিয়তমার জন্য বরাদ্দ রাখা যায়না? শুধু সামনে পড়লেই প্রেম উতলে পড়ে? তাহলে, আড়ালে থাকলে নিশ্চয়ই সে দিব্যি ভালো থাকে! স্রোত মন খারাপ করে কল কাটলো বিনা প্রত্যুত্তরে। ভয়াবহ মন খারাপের কারণে সাধের ফোনটাও ছুঁড়ে ফেলল বিছানার এক ধারে।
অথচ কাজে ব্যস্ত প্রেমিক মহাশয় প্রেমিকার অভিমান টেরই পেলেন না!

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—২৬

নায়ীব বাসায় ফিরলো রাত দেড়টার দিকে। নাবিদ সাহেব, নিশাত তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। দু’টো গেট আর বাসার লকের চাবি নায়ীবের কাছে আছে। তবে মেইন গেটটা ভিতর থেকে খুলতে হয়। তাই দেয়াল টপকাতে হয়েছে। নিস্তেজ শরীরটা টেনে-টুনে ও তিনতলায় উঠল। ক্ষীণ আওয়াজে চাবি ঢুকিয়ে নব ঘুরালো দরজার। যেদিন নায়ীবের ফিরতে রাত হয়, সেদিন সিঁটকিনি আটকানো হয়না ভেতরদিকে। তাই এ ব্যাপারে আর বেগ পোহাতে হলোনা ওর। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে ও রুমে ঢুকল। বারান্দা, জানলা; সবই খোলা। হু-হু করে বাতাস প্রবেশ করছে। বাতাসের দল-বল চিত্তে ধাক্কা লাগতেই শিরশির করে উঠল। নায়ীব কাপড় পাল্টালো ধীরে-সুস্থে। মুখে পানি ছিটিয়ে, গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে এরপর রান্নাঘরে গেল। প্লেট দিয়ে খাবার ঢেকে রাখা। নায়ীব সেসব সরিয়ে চা বসালো চুলায়। চোখে এমনিতেই ঘুম নেই, তার ওপর চা! এসব ভাবনা ছেড়ে নায়ীব সিংকের কাছটায় হেলান দিল। এম.পি রাজীবের নামে অহরহ ফাইল হওয়া কেসগুলোর প্রমাণও গায়েব হয়ে যায়। আজকেও তিনি লোক পাঠিয়ে একটা জায়গা দখলের হুম-কি-ধামকি দিয়েছেন। ওই এলাকার মানুষজন বেশ ক্ষীপ্ত তার ওপর। কল দিয়েছিল একজন। নায়ীবের কিছু করার নেই। এসব নিয়ে ঘাটলে ট্রান্সফার হতে হবে। তা নিয়েও সমস্যা ছিলনা নায়ীবের। তবে রাজীব সাহেব যে শুধু ট্রান্সফার করাতেই থেমে থাকবেন না, তা বেশ জানে নায়ীব। নাহলে হয়তো ঘাটাঘাটি করা যেত।
কিছু একটা মনে পড়তেই রুমে গিয়ে আবার ফোন নিয়ে এল। রাত এখন দু’টোর কাছাকাছি। স্রোত নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে কাদা! এই সময় আর তাকে জাগাতে চাইলোনা ও। ছোট্ট করে ম্যাসেজ পাঠাল,
“ ঘুম?”
নায়ীব অনেক্ষণ অপেক্ষা করল উত্তরের। অপেক্ষা করতে করতে চায়ের কথা বেমালুম ভুলে বসলো। চা উতলিয়ে পড়তেই টনক নড়ে ওর।

..

দুপুর আড়াইটার কাছাকাছি বেলা গড়িয়েছে। নায়ীব ইচ্ছে করেই আজ দেরীতে থানায় এসেছে। চারটায় দিকে ঘুমিয়ে দশটায় উঠেছে। ঘুমের সময় উলোটপালোট হলে মাথা ব্যথায় নায়ীবের অবস্থা বেহাল হয়ে যায়। আজও তা-ই। তবে আজ মাথা ব্যথাটা কিছুটা সহনীয়!
ইদানীং জিহাদ তার দিকে কেমন অদ্ভুত নজরে তাকায়! ইদানীং বলতে, বিয়ের কথা বলার পর থেকেই। আজ সে নায়ীবের টেবিলের কাছটায় এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
“ স্যার, আপনার বিয়ে কবে?”

নায়ীবের চোখ তখন একটা পুরোনো ফাইলে স্থির। ও চোখ তুলে তাকাল একবার। জিহাদের কৌতুহলী চেহারা দেখে ওর হাসি পেলেও হাসলোনা। কেবল প্রশ্ন করল,
“ কেনো?”
“ বলব,স্যার?”
“ বলো!”
“ এই বিয়ের সিজনে একটাও দাওয়াত পাইনি, স্যার। ভেবেছিলাম, প্রথম দাওয়াতটা আপনার বিয়েরই পাবো।”
একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল জিহাদ। ওর হা হুতাশ দেখে ক্ষীণ আওয়াজ করে হাসল নায়ীব। বলল,
“ আমার বিয়ে নিয়ে তোমার খুব তাড়া দেখছি।”
জিহাদ হা করে তাকাল। নায়ীব শব্দ করে হাসেনা! আজই বোধহয় প্রথম। বিয়ের কথা শুনে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে, মনে লাড্ডু ফুটছে! তাই এত হাসছে! ওর আগ্রহ, কৌতুহল আরেকটু বাড়লো। কাচুমাচু মুখে ফের প্রশ্ন করল,
“ স্যার! আরেকটা প্রশ্ন করি? রাগ করবেন না তো?”
“ রাগ করার মত হলে করব। এই ব্যাপারে গ্যারান্টি নেই।”
জিহাদ লম্বা শ্বাস টেনে, সাহস জুগিয়ে প্রশ্ন করেই ফেলল,
“ না মানে! আপনার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ঠিক হয়েছে নাকি লা…”

নায়ীবের শীতল চক্ষুদ্বয় আচমকাই জিহাদের পানে স্থির হলো। জিহাদ মুখ বন্ধ করে ফেলল তা দেখে।
‘লাভ ম্যারেজ’— বাক্যের শেষ দুই শব্দ আর যোগ করা হলোনা ওর। ওর ফাঁটা বেলুনের মতন চুপসে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে চোখ নুয়ালো নায়ীব। গম্ভীর হয়ে বলল,
“ বিয়ের দাওয়াত সবার আগে তুমি-ই পাবে, ডোন্ট ওয়ারি। এখন যাও।”
ওর আচানক গম্ভীর হওয়ার কারণ খুঁজে পেলনা জিহাদ। বিদায় নিয়ে বড়বড় কদমে বেরিয়ে গিয়ে হাঁফ ছাড়ল।

জিহাদ বেরোতেই ফাইল বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো নায়ীব। এদিক-ওদিক অস্থির হয়ে পায়চারি করলো কিছুক্ষণ।
এরপর টেবিলের কাছে এসে ফোন চ্যাক করল। না! সকাল থেকে দেয়া এতটা কলের বিপরীতে একটাও ব্যাক আসেনি। আর না এসেছে কোনো ম্যাসেজ! নায়ীব ঠোঁট কাম:ড়ে ভাবলো। এরপর ফোন,ঘড়ি হাতে তুলে দ্রুত কদমে বেরিয়ে গেল।

..
রাস্তায় তখন বেশ জ্যাম। ফুটপাতের ধারে সারিবদ্ধ হয়ে কয়েকজন কিশোর-কিশোরী বসা। বয়স তাদের খুবই অল্প। হাতে গাদা-গাদা ফুল! স্রোতের প্রিয় ফুল সাদা গোলাপ। নায়ীব গুণে গুণে বিশটার মত গোলাপ কিনলো। একসঙ্গে সেসব বাঁধিয়ে, বুকের মত হাত নিল। ফুল-টুল আগে কিনতে হয়নি। নিশাত ছিঁড়া ফুল ওত পছন্দ করেনা। সে ওই চারা-গাছের জন্যই পা-গল। হিমির কোনোকালেই এসবে আগ্রহ ছিলনা। নায়ীব চেয়েও তাই কখনো ফুল দিতে পারেনি। তবে এখন মনে হচ্ছে, ওকে কখনো ফুল না দিয়ে ভালোই করেছে। ওর প্রথম ফুল দিয়ে প্রেম নিবেদন করাটা একমাত্র স্রোতের জন্য! সব ফুলগুলো তা-ই ওই লাজুক মেয়েটার জন্য বরাদ্দ ঘোষণা করল নায়ীব!
ওর বাইকটা গ্যারেজে রাখা আজ অনেক দিন ধরে। বাইক থাকলে নিশ্চয়ই ভালো হতো। সময় পেলে স্রোতকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করা যেত। তবে এক্সি-ডেন্টের পর নায়ীবের ভয় ঝেঁকে বসেছে। ওর বাইক রাইডের স্কিল বরাবরই দারুণ। বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে থাকতেই বাবার বাইক নিয়ে রেস করেছিল। কেউ তাকে টপকাতে পারেনি। তবে এই স্কিলেও ওর সন্দেহ ঝেঁকে বসেছে।
ওর যা হওয়ার হোক! ওর প্রিয় মানুষগুলোর একটু কিছু হলে যে ও সহ্য করতে পারবেনা!
নায়ীব দ্রুত কদমে হেঁটে একটা সুপারমলে ঢুকে। কাপড়ের দোকানগুলোর সামনে এসে থামে। যতটুকু দেখেছে, স্রোত বেশিরভাগই সময়ই সাদা নাহয় কালো রঙের জামা পরে। সাদা রঙে ওকে স্নিগ্ধ লাগে, কালোয়ও লাগে মা-রাত্মক সুন্দর! তবে নায়ীবের মনে হলো, লাল রংটা স্রোতকে আরেকটু বেশি মানাবে। ও শাড়ি খুঁজতে দোকানে ঢুকলো। গায়ে পুলিশি পোশাক দেখে অনেকে ঘাবড়ালো, তটস্থ হয়ে দাঁড়ালো। এমনকি সেলস-ম্যান গিয়ে ম্যানেজারকে টেনে আনলো। আতঙ্কিত স্বরে ম্যানেজার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“ কিছু দরকার, স্যার?”
নায়ীব হতবিহ্বল চোখে তাকাল। হেসে সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“ আমি অফিশিয়াল কাজে আসিনি। ব্যক্তিগত কাজে এসেছি।”
হাঁফ ছাড়লেন ম্যানেজার। বললেন,
“ জ্বি,স্যার! বলুন কি লাগবে?”
নায়ীব ঠোঁট কামড়ে বলল,
“ শাড়ি!”
ম্যানেজার সেলস ম্যানকে ইশারা দিলেন। সেলস ম্যান নায়ীবকে নিয়ে গেল শাড়ি দেখাতে। দশ-বারোটা শাড়ি খুঁজেও মন-মতো রঙ পেলনা নায়ীব। ও বিরক্তি ভঙ্গিতে টুলে বসে বলল,
“ ডার্ক রেড কালারের শাড়ি দেখান, ওইযে বউরা যা পরে..সেটাই।”
তার এত বাছা-বাছি দেখে সেলস-ম্যানও হতবাক হলো। ছেলে মানুষ এতক্ষণ ধরে শপিং করে—জানা ছিলনা। তাদের তো কিছু একটা হলেই চলে। যে শাড়ি গুলো সে দেখিয়েছে, সবই লেটেস্ট কালেকশন। যে কারোরই পছন্দ হবে। কিন্তু এই লোক খুব খুঁত-খুঁত করছে।
সেলস-ম্যান অল্প হেসে আরো শাড়ি আনলো। কৌতুহল দমাতে না পেরে প্রশ্ন করল,
“ ম্যাডামের জন্য শাড়ি নিচ্ছেন,স্যার?”
নায়ীব চোখ ঘুরালো শাড়িগুলোর দিকে। আনমনা কণ্ঠে জবাব দিল,
“হু..”

..
নায়ীবের হাতের শপিং ব্যাগটা মাটিতে পড়ে গেছে। ফুলগুলো সে বহু কষ্টে আগলে ধরে রেখেছে। এমনিতেই সময় যত গড়াচ্ছে তত নেতিয়ে যাচ্ছে ওগুলো। ও র:ক্তচক্ষু নিয়ে সামনে তাকাতেই স্থির বনে গেল। মস্তিষ্কের গতি শ্লথ হল। সেই একই মুখের গঠন, চোখের কাছটায় কুচকুচে কালো তিল— সবকিছুই ধীরে ধীরে পরিচিত মনে হলো ওর। এরপর চোখ আটকালো কাঁধ সমান চুলগুলোয়! হিমির লম্বা চুল খুব পছন্দ ছিল। স্কুলে থাকতেই ওর চুল কোমর ছাড়িয়েছিল। নায়ীবেরও ওর চুলের প্রতি একটা আলাদা ভালোলাগা অনুভূত হতো। এখন অবশ্য অনুভূতির ‘অ’ টুকুও নেই! মন, হৃদয়, এই জীবন— সবটাই সে ওই পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির ছিমছাম মেয়েটাকে কবেই সঁপে দিয়েছে!

তবে জানতে ইচ্ছে করল, ঠিক কি কারণে হিমি চুল ছোট করেছে!
হিমি নামের মেয়েটা তখন নিচু হয়ে ব্যাগগুলো তুলছে। তার নিজেরও হাত থেকে চারটা ব্যাগ পড়ে গেছে। ও নায়ীবেরটাও তুলল। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলো হিমি নিজেই। তাই ধাক্কা লেগেছে। ও ব্যাগ এগিয়ে, বিনয়ী স্বরে বলল,
“ আ’ম সরি, মিষ্টার।”
নায়ীব চোখ সরালো। ব্যাগ নিল। চোয়াল তার বরাবরের মতই শক্ত। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পূর্বেই হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠটা আশ্চর্য হওয়া স্বরে বলে উঠে,
“ নায়ীব? তুমি! চিনতেই পারিনি!”

হিমির কণ্ঠ অল্প কাঁপলো বোধহয়। বাক্যের প্রতিটা শব্দ স্বাভাবিক হলেও হিমির মনটা অস্বাভাবিক রকমের অশান্ত হলো। নায়ীব সেসব খেয়ালই করলনা। ওর পা থেমে গেল আপনা-আপনি। হিমি ঘুরে দাঁড়ালো।

নায়ীবও ঘুরলো। তবে হিমির দিকে তাকালনা আর একবারও। হিমি না পারতেই উৎফুল্ল চিত্তে প্রশ্ন করল,
“ কেমন আছো?”
“ খুব ভালো আছি,তুমি?” কণ্ঠটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। অথচ হিমির মনে হলো, নায়ীব তাকে তাচ্ছিল্য করে ‘খুব’ শব্দটা যোগ করেছে। হিমি যে খুব একটা ভাল নেই— তা তো হিমি বুঝতে দিবেনা ওকে! হিমি তাই মিষ্টি করে হাসলো। বলল,
“ আমিও। কতদিন পর দেখা! চলো, কফি খেতে খেতে আলাপ সাড়ি একটু?”
“ সরি! কাজ ফেলে এসেছি।”
“ কাজ ফেলে শপিং-এ এসেছো?” হিমি ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করল। বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহ তার সর্বদা সবকিছুতেই ছিল।
সে জানে, নায়ীব কিছুতেই কফি খাওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করবেনা। নায়ীব যে এক কথার মানুষ, তা হিমি আগেই বুঝেছে। প্রমাণও পেয়েছে। বাজেভাবে সম্পর্কটা ছিন্ন করার পর নায়ীব বলেছিল,ওদের আর কক্ষনো দেখা হবেনা। অন্তত নায়ীব দেখা হতে দিবেইনা। সে নিজের কথা রেখেছে। এক যুগেরও বেশি সময় ওদের দেখা হয়নি। আজও হতোনা, হিমি এ শহরে না আসলে।

নায়ীব কাটকাট গলায় জানালো,
“ পার্সোনাল কাজের প্রায়োরিটিটা একটু উপরে কিনা! তাই শত ব্যস্ততার মধ্যেও আসতে হলো।”

“ আচ্ছা! কার জন্য শপিং করলে? গার্লফ্রেন্ড না বউ?” নিছক মজার ছলে প্রশ্ন করা। হিমি মেয়েটা বরাবরই রসিক গোছের। সিরিয়াসনেস একটু কম প্রকাশ করে।
হিমির খুবই আন্দাজে একটা একান্ত ধারণা ছিল, নায়ীব এখনও প্রেম-বিরোধী।
কিন্তু না! তাকে ভুল প্রমাণ করে, নায়ীব ওর চোখে-চোখ ফেলে জবাব দিল,
“ হবু বউ বলতে পারো। আসি,ভালো থেকো।”

হিমির হার্টবিট থেমে গেল যেন। নায়ীব তখন লিফটের অপেক্ষা করেনি। তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে নেয়ে গেছে। হিমি মিনিট খানেক স্থির থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
প্রথম দেখায় যদিও ওকে চিনতে পারেনি হিমি। এরপর নেমপ্লেটে খেয়াল করে, এক যুগ আগের দেখা চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করেছে।
কতটা পরিবর্তন হয়েছে মানুষটার! চোখ-মুখে কি কাঠিন্যতা!
দৃষ্টি তো নয় যেন ঘায়েল করার অ-স্ত্র! খোঁচা-খোঁচা দাঁড়ি ভর্তি চোয়াল! কথায় একটা অদৃশ্য দাপট, তেজ! সবটাই একসময় হিমির পরিচিত ছিল। এখন সম্পূর্ণটাই অপরিচিত। ঠিক যেমনটা নায়ীবের কাছে সে অপরিচিত, ঠিক তেমনটাই!

..

নায়ীব মল থেকে বেরিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দেখাটা না হলেই বোধহয় ভালো হতো। রাগে মাথা কিলবিল করছে তার। হাতে আঁকড়ে ধরা ফুলগুলোর দিকে চেয়ে ওর রাগ চাপা পড়ল। এগুলো সে পৌঁছাবে করে? মনে পড়ল, শুভ্রার কথা। কিন্তু শুভ্রাকে পাওয়ারও উপায় নেই।
এখন যে হোস্টেলের দিকে যাবে, তারও সময় নেই। কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে থানায় ফিরতে হলো।
ওকে ফুল-টুল হাতে দেখে থানার সকলেই অবাক হলো। জিহাদ তখন ওয়াশরুমে। নাহলে স্যারের এ রুপ দেখে সে নির্ঘাত মাথা ঘুরে পড়ে যেত। রুমা নামের আরেক লেডি কনস্টেবল ছুট্টে গেল তাকে খবর দিতে। নায়ীব ততক্ষণে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমটায় চলে গেছে। জিহাদ ওয়াশরুমে থেকে বেরিয়ে গা ঝাড়া দিতে দিতে এগোলো। রুমাকে দেখল ছুটে আসতে। জিহাদের সামনে দাঁড়িয়ে সে গড়গড় করে বলল,
“ জিহাদ ভাই! আজকে একটা আশ্চর্যজনক ঘটনার সাক্ষী হলাম।”
জিহাদ ওত গুরুত্ব দিলনা। পা চালাল বাইরের দিকে। পিছু পিছু ছুটল রুমাও। জিহাদ হাই তুলে প্রশ্ন করল,
“ কি এমন ঘটনার সাক্ষী হলে, রুমা! রোজ রোজই তোমার ঘটনার সাক্ষী হওয়া লাগে? দেখতে দেখতে একদিন কোনো কেসের সাক্ষী হয়ে যাবা!”

রুমা পা থামাল। বিরক্ত ভঙ্গিমায় মুখ বাঁকালো। ‘সাক্ষী’ তার কমন ওয়ার্ড। মুখ ফসকে তাই এটা বের হয় বেশি। এ নিয়েই জিহাদ-সহ অনেকে প্রায়শই মজা নেয়।
রুমা বিরক্ত হলেও আশ্চর্যজনক কথাটা বলতে ভুললনা।

“ স্যার কোত্থেকে এসেছে, বুঝলেন জিহাদ ভাই! হাতে একগাদা গোলাপ ফুল আর একটা প্যাকেট। কেউ গোলাপ দিয়েছে নাকি নিজে কিনেছে বুঝতে পারছিনা আমরা কেউ। আপনার কি ধারণা, জিহাদ ভাই?”

জিহাদের চোয়াল ঝুলে পড়ল। পায়ের গতি ধীর হয়ে একসময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে ও ঘুরে তাকাল রুমার দিকে। বলল,
“ গোলাপ? স্যার?”

বলেই সে রুমাকে ফেলে নায়ীবের কাছে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। নায়ীব তাকে ডাকতেই যাচ্ছিল। ওর পা দু’টো দরজার নিচের দিকে খেয়ালে আসতেই গলা উঁচিয়ে ডাকল,
“ জিহাদ,আসো ভেতরে।”
জিহাদ ঢুকলো। দরজার কাছটায়ই ওর হা হওয়া মুখটা আরো বড় ধরণের হা হয়ে গেল। নায়ীব তখন কল নাড়াচাড়া করছে। জিহাদকে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। বলল,
“ একটা কাজ করে দাও, জিহাদ। একটা পানি ভর্তি বালতি নিয়ে আসো। ফুলগুলো কেমন নেতিয়ে যাচ্ছে!”
স্বাভাবিক কণ্ঠ। টেবিলের ওপর রাখা গোলাপগুলো দেখেই মুখ হা হয়ে গেছে জিহাদের। ও যথাসম্ভব নিজের চরম পর্যায়ের চমকিত ভাব ঢাকতে চাইল। দ্রুত কদমে ‘জ্বি স্যার!’ বলেই বেরিয়ে গেল বালতির খোঁজে।
মিনিট পনেরোর মাথায় পানি ভর্তি বালতি নিয়েও এলো। নায়ীব হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় বালতির ভেতর ফুলের নিচ অংশ ডুবিয়ে টেবিলের আড়ালে রাখল। প্যাকেটটাও ড্রয়ারে রাখা।

সন্ধ্যা গড়াতেই আইঢাই শুরু হলো নায়ীবের। কাজে আজ মনোযোগ বসছেনা। চোখ দু’টো একটা মিষ্টি মুখ খুঁজছে, নাক খুঁজছে ওই মেয়েলি পরিচিত সুঘ্রাণ, ঠোঁট খুঁজছে চুলের এলোমেলো ভাঁজ, কান খুঁজছে লজ্জায় মিহিয়ে যাওয়া কণ্ঠটা! আর হৃদয়? সে তো আস্ত মানুষটাকেই খুঁজছে। নায়ীব তড়িঘড়ি করে ফুলগুলো পানি থেকে তুলতেই যাচ্ছিল, তার আগেই টেবিলের ওপর রাখা ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। আননোন একটা নাম্বার। স্বাভাবিকভাবেই রিসিভ করল নায়ীব। ওপাশ থেকে একটা পুরুষালী গলা শোনা গেল,
“ এটা কি ইনস্পেক্টর. নায়ীবের নাম্বার?”
“ জ্বি। আমিই নায়ীব..নায়ীব ইয়াকীন।” একটু থামলো ও। পালটা প্রশ্ন করল,
“ আপনি কে বলছেন?”

ওপাশের ব্যক্তি চওড়া হাসল। নামেই কেমন দাপুটে, চৌকশ ভাবখানা গেঁড়ে রেখেছে। কথায় আছে, ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্যা বেস্ট ইম্প্রেশন। ওপাশের ব্যক্তি গুণে গুণে দশ সেকেন্ড পর জবাব দিল,
“ আমি সুহাদ বলছি, ইন্সপেক্টর! সুহাদ রহমান। স্রোতশ্রী বিনতে সাঈমের বড় ভাই।”

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—২৭

নায়ীব শান্ত চিত্তে চেয়ারে বসল। সামান্য কেঁশে ফের নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করল,
“ স্রোতশ্রীর ভাই?”
“ জ্বি..”

সুহাদ নিঃশব্দে হাসলো। ছেলেটা কি বিশ্বাস করতে পারছেনা, ও স্রোতেরই ভাই?
তবে না! ফোনের এ-প্রান্তে থাকা নায়ীবের মনে অন্য চিন্তা। হঠাৎ করে সুহাদের ফোন মোটেও আশা করেনি সে। আচানক তাহলে কেন কল দিল? স্রোতের কি কিছু হয়েছে?— এ ভাবনা মস্তিষ্কে হানা দিতেই অশান্ত হলো নায়ীব। কেমন ব্যগ্র গলায় জানতে চাইল,
“ স্রোতের কি কিছু হয়েছে? ও ঠিক আছে?”

ওপাশে থাকা সুহাদ এ প্রশ্নে হতবুদ্ধি হলো বটে। স্রোতের আবার কি হবে? বুঝতে পারল, কল দেয়ার কারণ এখনও নায়ীব ধরতে পারেনি। ও হাসলো আবার,
“ও হোস্টেলে। আমি বাড়িতে। যতটুকু জানি, ও ঠিক আছে। আমি কল দিয়েছি অন্য কারণে।”

এবার খানিকটা শান্ত হলো নায়ীব। আন্দাজ করতে পারল কল দেয়ার কারণটাও। খানিক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ও বলল,
“ জ্বি, বলুন!”
“ স্রোত আপনার কথা অনেক আগে জানিয়েছে। কালও এ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা তুলেছিলাম আমি।” একটু থামলো সুহাদ। যতটুকু জেনেছে, নায়ীব ওর সমবয়সী। তাই বেশি দ্বিধা প্রকাশ করতে চাইলোনা সুহাদ। সোজাসাপটা বলল,
“ আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারলে ভালো লাগতো। ইফ ইয়্যু আর ফ্রি, দ্যান..”
“ আই এম! কবে দেখা করবেন?”

_

স্রোত শুভ্রার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছে। আলোচনা মূলত ভার্সিটি নিয়ে। ক’দিন পরই তো ক্লাস। ওদের লাস্ট ইয়ার এটা। ট্যুর কিংবা পিকনিক- কিছুরই আভাস পাওয়া যাচ্ছেনা। আলোচনার এক পর্যায়ে স্রোত প্রচন্ড মন খারাপ করে বলল,
“ ভালো লাগছেনা রে শুভ্রা! পিকনিক-টিকনিক করলে মাইন্ডটা একটু ডাইভার্ট হতো। সারাদিন আমি তাকে নিয়ে ভাবি। কিন্তু সে তো আমাকে নিয়ে ভাবেনা! এসব ভেবেই আমার মন খারাপ হচ্ছে।”
শুভ্রা কপাল চাপড়ালো নিজের। কপট রাগ নিয়ে বলল,
“ বলেছিলাম না? পাত্তা কম দিতে! কে বলেছিল নিজের মনের কথা বলতে? ক’দিন ঘুরাতি, দেখতি পিছু পিছু ঘুরছে। সহজে পেলে মানুষ গুরুত্ব বুঝেনা!”
শেষ বাক্য শুনে মন খারাপের পরিমাণ বাড়াবাড়ি রকমের বৃদ্ধি পেল স্রোতের। সত্যিই কি সহজে পেলে মানুষ গুরুত্ব দেয়না? ও বিরস মুখে বসলো। তন্মধ্যে ফোনে ম্যাসেজ ঢুকল টুং শব্দে। শুভ্রাকে কলে রেখেই ও ম্যাসেজ চ্যাক করল।
পাশাপাশি ছোট্ট তিনটে শব্দ নজরে আসলো,
“ নিচে নামুন, কুইক!”

স্রোত গোল-গোল চোখে ম্যাসেজটা পাঁচবার পড়লো। সে এসেছে! আগেরবারের মত প্রেম-ভালোবাসা দেখিয়ে পরে আবার ইগনোর করবে! স্রোত ঠোঁট উল্টিয়ে শুভ্রাকে বলল,
“ একটু পর কল দিচ্ছি রে।”
কল কেটে ও দ্রুত হাতে গায়ে কালো ওড়নাটা জড়ালো। ওমন পাতলা কামিজ গায়েই বেরিয়ে পড়ল। বাইরে যে শীত, তার তোয়াক্কাই করলনা ও।

প্রথমে সিঁড়ি খুব দ্রুততার সাথে নামলেও শেষের দিকে পায়ের গতি শ্লথ হলো। গেট পেরিয়ে বেরোতেই আজ প্রথমে আসলো সে। অবসন্নতায় জর্জরিত চেহারাটায় বিস্তর হাসির অস্তিত্ব বিদ্যমান। স্রোত অবাক চোখে তাকাল। চোখ আটকালো মানুষটার হাত আর বুকের কাছটায়। বুকের সঙ্গে হাত দিয়ে ঠেস দেয়া কতগুলো ফুল! অন্যহাতে আরেকটা প্যাকেট! স্রোত এগোনোর সময় পেলনা। তার আগেই নায়ীব বড় বড় কদমে এগোলো। তার মুখখানার ভাবভঙ্গি অতিশয় নিষ্পাপ ধরণের। একটু ঝুঁকে কানের কাছটায় ফিসফিস করে বলল,
“ হাত ব্যথা হয়ে গেছে, মিস! একটু সাহায্য করুন ফুলগুলো ধরে!”

স্রোতের দিকে ফুলগুলো বাড়িয়ে দিল নায়ীব। স্রোত সাদরে গ্রহণ করল তা। নায়ীব এবার প্যাকটটা বাড়িয়ে দিল। খুবই সাবলীল গলায় বলল,
“ একটা শাড়ি এনেছি, স্রোত। আমার চয়েজ বাজে। মায়ের পর এই প্রথম কারোর জন্য শাড়ি কিনেছি।”
স্রোত হাত বাড়ালনা। উল্টো ফুলগুলো হাত বাড়িয়ে নায়ীবের ওপর চাপিয়ে মুখ ফেরাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ আমি মোটেও এসবে গলবোনা।”

নায়ীব প্রথমে ভড়কালেও এবার শান্ত নজরে তাকালো। মাঝেমধ্যে কাজের চাপে ব্যবহারটা রুঢ় হয়ে যায় তার। সে নমনীয় হওয়ার চেষ্টা করে। অনেক সময় সম্ভব হয়না। নায়ীব ঢের উপলব্ধি করতে পারছে, সে এক অভিমানীনিকে ভালোবেসেছে। যার অভিমান ভাঙ্গাতেই ওর সারাজীবন কেটে যাবে।
ও দূরত্ব মিটালো। ব্যাগ, ফুল এক হাতে চাপিয়ে অন্যহাতে আচানক স্রোতের থুতনি ছুঁয়ে নিজের দিকে মুখটা আনলো। স্রোতের চোখ গেল সরাসরি ওই কালো কুচকুচে মণি দু’টোয়। ওমনি মনটা শান্ত হয়ে গেল। রাগ যেমন তার অল্পতে উঠে, আবার ভেঙ্গেও যায় একটু মায়া পেলেই। এই যে, মণি দু’টোর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে চোখে চোখে অভিযোগ জানালো। সেসব নায়ীব মাথা পেতে মেনেও নিল। একহাতে গালের একাংশ পুড়ে বলল,
“ আর হবেনা। এই শেষ!”

স্রোত চোখ সরালো এবার। হুট করেই লজ্জারা ভর করল, গাল দু’টো হলো আরক্তিম। নায়ীব ফুল গুলো এগিয়ে দিল দ্বিতীয়বারের মত। স্রোত একহাতে নিল সেগুলো। তবে শাড়ির প্যাকেটটা নিতে সে নাকচ করল। এটা নিতে তার ঘোর আপত্তি। সে শাড়ি পরতে একদমই পটু নয়। যতটুকু পারে, তা পরে বাইরে যাওয়া অসম্ভব। নায়ীব শান্ত চোখে তাকাল। ইশারায় নিতে বলল।
স্রোত চোখ ফিরিয়ে বলল,
“ আমি শাড়ি নিয়ে কি করব! আমি তো ওতো ভালো করে পরতে পারিনা! রেখে দিন আপনার কাছে।”

নায়ীব হতাশ হলো। এই মেয়ের জেদের পরিমান দিনকে দিন ক্রমশ বাড়ছে। অকারণেই জেদ দেখায়। এখন শত বললেও সে প্যাকেটটা নিবেনা- ভালোই বুঝতে পারছে নায়ীব। তাই ও আর ঘাটলোনা। একটা সময় তো আস্ত মানুষটাই ওর ঘর জুড়ে রাজ করবে। এখন নাহয় আলমারি জুড়ে শাড়িটা রাজ করুক।

ও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। নড়বড়ে গলায় অকস্মাৎ বলল,
“ আমাকে বিয়ে করবেন?”

স্রোতের চোখ দু’টো রসগোল্লার আকার ধারণ করল। নায়ীবের কণ্ঠের চেয়েও বেশি স্রোতের সম্পূর্ণ চিত্ত নড়ে উঠল, কাঁপলো। চোখের পাঁপড়িও কাঁপতে ভুললনা। ভুল তো শুনেনি সে। ও কোনোমতে উচ্চারণ করল,
“ হ্যাঁ? কি?”
“ বউ হবেন, স্রোত? আমার বউ?”

নায়ীবের দৃষ্টি এলোমেলো। কিছু পাওয়ার তীব্র আশা-আকাঙ্ক্ষা! মেয়েটা নাকচ করবেনা, নায়ীবের দৃঢ় বিশ্বাস। মেয়েটার ছোট্ট মনে নিজের প্রতি গাঢ় অনুভূতি আছে— ক্রমশ টের পেয়ে যাচ্ছে নায়ীব। সেটাকে ভালোবাসার নাম দেয়া ভুল নয়। নায়ীব জানে, বুঝে সবই। তবে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে সে বরাবরই অপটু। তাই আজ সরাসরি প্রস্তাব রাখা। মেয়েটাকে না পেলে ওর কি হবে- ভাবলেই মস্তিষ্ক শিথিল হয়ে আসে।

স্রোত হুট করে একটা ভয়াবহ সুন্দর কাজ করে বসলো! চট করে সে ঠাই খুঁজে নিল নায়ীবের প্রশস্ত বুকে। মাথাটা ঠেকল একদম বুক বরাবর। ওর আচমকা জড়িয়ে ধরায় পেছনে দু কদম পেছালো নায়ীব। এরপরই প্যাকেটটা পড়ে গেল মাটিতে। দু’হাতে শক্ত করে আগলে ধরল বুকের ভেতর গুটিয়ে থাকা মেয়েটাকে। মেয়েটা তখন নাক টানছে। ওর টলমলে চোখ আগেই খেয়াল করেছে নায়ীব। ওকে দু’হাতে আগলে ধরতেই স্রোত নাক টেনে-টেনে উত্তর দিল,
“ হবো, হবো, হবো।”
নায়ীব মেয়েটার কণ্ঠে চাঞ্চল্যতা, তাড়াহুড়ো করাটা শুনে প্রাপ্তির হাসি হাসলো। কি সুন্দর সে হাসি! বুকের সঙ্গে ওকে আরেকটু শক্ত করে ধরে রেখে বলল,
“ বিয়ের সময় তিন কবুল যেন এভাবেই ফটাফট শুনতে পাই! অপেক্ষা করতে পারবনা আর আমি।”

চলবে.