গোপনে_রাঙানো_প্রেম পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
615

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—২৮

ডাইনিং টেবিলে পিনপতন নিরবতা। একটু আগেই বিশাল আকারের একটা বিস্ফো-রণ ঘটেছে এখানে। নিশাতের গলায় খাবার আটকে গেছে। কাঁশি উঠবে; এমন অবস্থা। তা-ও তার বড় বড়, অবিশ্বাস্য চোখ দু’টো বাবা-ভাইয়ের মুখের দিকে চক্কর কাটছে। মুখ ভর্তি ভাত সে গিলতে পারছেনা, ফেলতেও পারছেনা। ও পানির গ্লাস টেনে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল পুরোটা পানি, সেই সঙ্গে মুখে থাকা ভাতও। বহু কষ্টে গিলে, বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলল ও। এরপরই সজোরে এক চিৎকার দিল,
“ ভাইয়া! কি বললে একটু আগে? আবার বলো!”
মেয়েটা বাম হাত দিয়ে কান ছুঁলো নিজের। চুল পেছনে সরিয়ে অতি আগ্রহ, উত্তেজনা নিয়ে বসলো। ওর এমন হম্বিতম্বি দেখে ভড়কাল না নায়ীব। ভীষণ তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল,
“ বললাম, বিয়ে করবো। এমন রিয়্যাকশান দেয়ার কি আছে?”
“ আছে বৈকি! কি শুনালে ভাইয়া! আমি তো নিজের কান-কেই বিশ্বাস করতে পারছিনা। আমার চেয়েও দ্বিগুণ রিয়্যাকশান দিবে ফুপ্পি। ওহ, আই কান্ট ওয়েট! ফুপ্পিকে এই নিউজ দিতে হবে কুইকলি!”
নিশাতের চোখ মুখ ঝলমলে। সে পারছেনা এক্ষুনি কল দিয়ে নায়মাকে এ ব্যাপারে জানাতে। টেবিলের মাথার চেয়ারটায় বসা নাবিদ সাহেবের সম্পূর্ণ চিত্ত আবার উদ্রেকহীন। অনেক আগেই কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। বিচক্ষণ অফিসারের খ্যাতি তো এমনি এমনি পাননি কর্মজীবনে। ছেলের হাব-ভাবেই অর্ধেক ব্যাপার ধরে ফেলেছিলেন। নায়ীব কিছুটা ঘরকুনো। সে কাজ ছাড়া খুব কমই বের হয় বাসা থেকে। সেই ছেলে ইদানীং হুটহাট গায়েব হয়ে যায়— সবকিছুই নাবিদ সাহেব বুঝতে পেরেছেন। তাই তিনি এখন নির্বিকার। তবে বলতে হয়, বুকের ওপর থেকে বিশাল ওজনের একটা চিন্তার ভার সরে গেছে তার।

নায়ীব একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে বাবার দিকে চেয়ে। কখন বাবা কিছু জিজ্ঞেস করবেন আর ও স্রোতের কথা বলবে! সেই অপেক্ষায় ও খাওয়া ছেড়ে বসে রইল। নাবিদ সাহেব খেতে খেতে বললেন,
“ খেয়ে নে। বাকি কথা খাওয়ার পর হবে।”

খেয়ে উঠে সোফায় বসলেন নাবিদ সাহেব। একে একে এলো নায়ীব, নিশাতও। নিশাতের হাতে ফোন। এখন একটা বিরাট আলোচনা বসবে; সে জানে! আলোচনা শেষ হলেই সে নায়মাকে কল দিবে।

নাবিদ সাহেব হেলান দিয়ে বসলেন। টিভি অন করে সাউন্ড লো রেখে বললেন,
“ বিয়ে করবে, ভালো কথা। পাত্রী কোথায়?”

নায়ীব মুখ খোলার পূর্বেই নিশাত ফট করে জবাব দিল,
“ পাত্রী তো রেডি,আব্বু!”
নাবিদ সাহেব ভ্রু কপালে তুলে ফিরে তাকালেন। নিশাতের মুখে কিছু আটকায় না। বিশেষ করে, বাবার কাছে সে কিছুই চেপে রাখতে পারেনা। ও উৎফুল্ল চিত্তে, হড়বড়িয়ে বলতে লাগল,
“ এভাবে তাকাচ্ছো কেন? স্রোত আপুর চেয়ে বেস্ট কেউ হবেনা ভাইয়ার জন্য, নোট ইট। ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে আমার!”
নায়ীব এ পর্যায়ে অপ্রস্তুত হলো। চোখ রাঙিয়েও লাভ হলোনা। নিশাত তাকালোই না ওর দিকে। নাবিদ সাহেব হতভম্ব চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। বললেন,
“ সত্যি?”
নায়ীব মাথা নাড়ায় ইতস্তত করতে করতে। পরমুহূর্তেই নাবিদ সাহেবের বিস্তর হাসি দেখে ইতস্ততবোধ কেটে যায় ওর। অবাক চোখে তাকাতেই নাবিদ সাহেব জানালেন,
“ আমার কোনো আপত্তি নেই।”

..

সুহাদ অপেক্ষা করছে থানার সামনে। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে, ভ্রু কুঁচকে আশেপাশে তাকাচ্ছে। সে সকালেই চলে এসেছে। এসে বন্ধুর থেকে সাজেশন নিয়েছে। কীভাবে ছোট বোনের হবু স্বামীকে ট্রিট করা যায়! বলতে সে বাধ্য, সে এসবে আনাড়ি। একপ্রকার ঘটকালি-ই করছে ও। নায়ীব নামের ছেলেটাকে দেখার জন্য ও অপেক্ষা করছে আপাতত। সে কল দিয়েছে একটু আগে। নায়ীব বেরোচ্ছে বোধহয়।
তন্মধ্যে থানার গেটের দিকে তাকায় সুহাদ! ওইতো,লম্বা-চওড়া এক টগবগে যুবক বেরোচ্ছে। তবে গায়ে সিভিল ড্রেস দেখে পুরোপুরি শিওর হতে পারলোনা সুহাদ। ছবিটা দেখা জরুরি ছিল!
ও চেয়ে থাকতে থাকতেই চোখে চোখ পড়ল। নায়ীবের মস্তিষ্ক চিনে ফেলল তাকে। ও দ্রুত হেঁটে রাস্তা পার হলো। এবার শিওর হলো সুহাদ। নায়ীবের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসলো বেশ বড় করেই। বিপরীতে হ্যান্ডশেক করতে করতে নায়ীবও একটা হাসি উপহার হলো। নায়ীব ভেতরে ভেতরে অল্প নার্ভাস বলা যায়। ফার্স্ট ইমপ্রেশনটা ঠিক থাকলেই হলো। ইদানীং মনের মানুষটাকে হারানোর ভয় ঝেঁকে ধরেছে। ও স্রোতকে কোনোভাবেই হারাতে চায়না।
ও স্রোতকে এখনও জানায়নি, সুহাদের সাথে দেখা করার ব্যাপারটা।

সুহাদ আচানক সহাস্যে বলল,
“ চলুন, কোথাও বসি।”

.
নায়ীব সোজা হয়ে বসলো। গায়ে তার আজ অফ হোয়াইট একটা শার্ট। বরাবরের মতই একটা ফর্মাল, ডিসেন্ট লুক। ড্রেসিং সেন্স দেখে মনে মনে সন্তুষ্ট হলো সুহাদ। সে হেমন্তকে দেখেছে। লুক নিয়ে জাজ করা উচিত না তবে ওই ছেলের চোখে-মুখে কোনো সিরিয়াসনেসই ছিলোনা। স্রোতের চয়েজের ওপর সুহাদ সন্তুষ্ট। এবার বাবা সন্তুষ্ট হলেই হয়।
সুহাদ দু’টো ব্ল্যাক কফির অর্ডার দিল। দেখা করার জন্য ক্যাফের চাইতে ভালো প্লেস বোধহয় দ্বিতীয়টি নেই। ও টেবিলে দু হাত রেখে একটু ঝুঁকে বসলো। বলল,
“ আমি যে আপনাকে কল দিয়েছি, দেখা করতে বলেছি, স্রোত এসব ব্যাপারে জানে?”

নায়ীব চোখ তুলে। সাবলীল গলায় সত্য বলে,
“ না, জানাইনি।”
কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো সুহাদ। স্রোত জানলে নিশ্চয়ই হোস্টেলে বসেই প্যানিক করতো। বোনকে সে হাড়েহাড়ে চেনে। ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ থ্যাংকস! আমি এটা নিয়েই বেশি চিন্তা করছিলাম। জানলে ও টেনশন করতে করতে প্যানিক হতো।”
নায়ীবও এটা জানে। মেয়েটা তাকে নিয়ে কত বেশি বেশি চিন্তা করে! আর এ ব্যাপারে করবেনা?

সুহাদ অল্প হেসে সহজ হওয়ার চেষ্টা করল। সত্যি বলতে তার নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছে। তবে দেখা করাটা জরুরি ছিলো। সাঈম রহমান তো আর তার মতো ফ্রি না। যতই পুলিশ হোক, শশুড়ের কাছে মেয়ের হাত চাইতে গেলে বড় বড় মানুষজনও নাস্তানাবুদ হয়।
ও মুখ খুলল,
“ স্রোত বাড়ির একমাত্র মেয়ে, আমার একমাত্র ছোটবোন। ও আমাদের ভীষণ আদরের, বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই।”
নায়ীব হেসে মাথা নাড়ে। সুহাদের কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারে, সে কতটা কনসার্ন বোনকে নিয়ে। সে যেমন নিশাতকে চোখের আড়াল হতে দেয়না, ওরকমই।

“ ও আমাকে অনেক আগেই জানিয়েছে, ওর পছন্দ আছে। আমি বাঁধা দেইনি, একটা বয়সে এসব হয়ই। দ্যাটস টোটালি নরমাল। তবে ভুল কারোর সঙ্গে জড়ালে অবশ্যই বাঁধা দিতাম।”
নায়ীব স্বাভাবিক চোখ-মুখে বসা। ওর মনে তখন প্রশান্তির হাওয়া বইছে। অল্প-সল্প নার্ভাসনেস কেটে গেছে কবেই!

“ আমি আসলে..কি বলবো ভেবে পাচ্ছিনা। তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি ওকে খুশিতে রাখবেন। ও আপনাকে সত্যিই মন থেকে ভালোবাসে, আমি জানি। একটা হাম্বল রিকুয়েষ্ট..ওকে কখনো কষ্ট দিবেন না, প্লিজ!”

নায়ীব চোখ দিয়েই তাকে ভরসা, আশ্বাস দিল।

..

আশার হাতে ফোন, ফোনের স্ক্রিনে একটা ঝকঝকে ছবি। ইমাও উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে ফটোটা দেখলেন। ঘরজুড়ে পায়চারি করলেন। সাঈম সাহেব আর সাহিদ সাহেব; দুই ভাই ফিরবেন সন্ধ্যার দিকে। রান্না-বান্নার কাজ প্রায় শেষ বলে আশা বসে আছেন। বাকিটা ইমা সামলে নিবেন। তবে তিনি আপাতত রান্নাঘরে পা বাড়াবেন না। তিনি ব্যস্ততার সাথে পায়চারি করছেন। ভীষণ অস্থির কিনা তিনি! ইনান গেছে স্কুলে। ফিরতে বিকাল হবে। ইফাদটাও বাড়িতে নেই। পড়াশোনার জন্য রাজশাহীতে থাকে ও। তবে আর বেশিদিন নেই, পরীক্ষা খুবই নিকটে।

ইমা এক পর্যায়ে থামলেন। অস্থির চিত্তে আশাকে পরখ করলেন। আশা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ছবিখানা দেখছেন। ছেলের চেহারা আপাদমস্তক মুখস্থ করছেন নাকি! ইমা পাশে এসে বসলেন ত্বরিত গতিতে। গা ঘেষে বসে বললেন,
“ আপা, দেখি আমাকে দেখতে দাও!”
আশা বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করলেন। বললেন,
“ একটু আগে না দেখলি!”
“ তুমি নিজেই তো আধ ঘন্টা ধরে দেখছো। আমাকে দেখতে দাও!”
ইমা আশার হাত ধরেই ফোনটা নিজের দিকে ফিরালেন। ওমনি মুখ দিয়ে বের হলো,
“ মাশা-আল্লাহ! ছেলে তো রাজপুত্রের মত! কি সুন্দর! আমাদের মেয়ের সঙ্গে মানাবে,দেখে নিও!”
আশা নিরস গলায় বললেন,
“ দেখতে সুন্দর হলেই হয়না, মন-মানসিকতারও একটা ব্যাপার আছে, ইমা!”

ইমা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“ সে যাইহোক! সুহাদ বলেছে, ছেলেটা অত্যন্ত ভালো, নম্র-ভদ্র। একটুও অহংকার নেই। ও তো দেখাও করেছে বললো! এবার শুধু ভাইজান আর আমাদের সঙ্গে দেখা করার পালা।”

ইমা খেয়াল করলেন আশার মুখ। কেমন আঁধারে ছেঁয়ে গেছে ফর্সা মুখটা। পাশ ঘেঁষে বসলেন ইমা। তার কোনো বড় বোন নেই। বিয়ে হয়েছে খুব অল্প বয়সে। তখন সুহাদ বছর এক এর। আশারও অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছে। তবে তিনি এই সংসারকে খুব জলদিই আপন করে নিতে পেরেছেন। ইমার এক্ষেত্রে সময় লেগেছে। সবসময় বড় বোনের মত আশা পাশে লেগে ছিলেন, ভুল হলে ধরিয়ে দিয়েছেন। বকেন নি কোনোদিন। মনোমালিন্য হলেও ইমা বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারেন না তার সঙ্গে। কারণ হলো, ওইযে আশাকে তিনি বড় বোন মানেন; সেজন্যই। আশাও তাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন।
ইমা আশার মন খারাপ চট করে বুঝে ফেললেন। খুবই নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“ ও আপা! মন খারাপ কেন? ছেলে তোমার পছন্দ হয়নি?”
“ সেটা না ইমা!” আশা একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন। অনেক্ষণ সময় নিয়ে এরপর বললেন,
“ মেয়ে খুব বড় হয়ে গেছে, তাইনা ইমা? ওকে পরের ঘরে পাঠিয়ে দেয়ার সময় হয়ে এসেছে! সেদিনই না কোল আলো করে ও এলো! আর তোর ভাইজান পুরো গ্রামে মিষ্টি বিলালো! ক’টা বছর আগের কথাই তো! সুহাদ, ইফাদ ওকে কোলে নিয়ে ঘুরলো! দিনগুলো এত জলদি চলে গেল কেন, ইমা?”

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—২৯

স্রোত রিং টোনের শব্দ পেয়ে তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো। হাতে তুলে দেখল, ইমার কল। চিন্তারা গ্রাস করলো ওকে। ইমা খুব কম ফোন দেন নিজ নাম্বার থেকে। মাকে কল দিলে একসাথে আশা,ইমা; দুজনের সঙ্গেই কথা হয়ে যায়। ও দ্রুত হাতে কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে ইমা বললেন,
“ আম্মাজান! শুনতে পাচ্ছো?”

“ বলো, ছোট মা। কিছু হয়েছে?”
“ কিছু হয়নি, আম্মা। একটু বাড়িতে আসতে পারবা?”
“ কেন? হঠাৎ কি হয়েছে? সবাই ঠিক আছে?”
“ সবাই একদম ফিট, আম্মা। তোমাকে খুব মনে পড়ছে। আসতে পারবা বাড়িতে? ইফাদও আসবে। সবাই বাড়িতে আছে। খুব মজা হবে। আমরা উঠোনে পিকনিক করব, বার্বিকিউ করব। আসবা, প্লিজ?”
ইমার কথা বলার ধরণ খুবই আদুরে। তিনি স্রোতকে ‘মা’,’আম্মা’ বলে সম্বোধন করেন বেশিরভাগ সময়। ওর অস্তিত্ব আছে বলেই হয়তো মেয়ের অভাব কোনোদিন তড়পায় নি ইমাকে।
স্রোত লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
“ আচ্ছা, আসবো।”
“ একা আসবানা। আমি সুহাদকে বলি। ও বিকালের আগে রওয়ানা হবে। তুমি ব্যাগ গোছ-গাছ করে রাখো। এবার কিন্তু অনেকদিন থাকা লাগবে।”
“ আচ্ছা, ছোট মা। থাকব।”

ইমা প্রফুল্ল চিত্তে কল কাটলেন। স্রোত মাথার তোয়ালে খুলে জানলার কাছে মেলে রাখলো। এরপর ব্যাগ বের করলো। ব্যাগে এমনিতেই ভালো ভালো কাপড়গুলো রাখা থাকে। ছোট্ট আলনাটায় কাপড় রাখলে কেমন ময়লা হয়ে যায় কয়েকদিনেই। কাপড়-চোপড় ধুঁতে বড্ড কসরত করতে হয়। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি রকমের অনীহা আছে স্রোতের।
ও ব্যাগে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস ঢুকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে নায়ীবকে কল দিল। না জানিয়ে গেলে নিশ্চয়ই সে রেগে ফা-য়ার হয়ে যাবে!
নায়ীব কল রিসিভ করলো প্রথম রিং হতেই। সে ফ্রি ছিল। ঠিক টাইমে কল আসায় খুশিও হলো। রিসিভ করলেও দুপাশ থেকেই নিরবতা বজায় রইল। নায়ীব অপেক্ষা করলো স্রোতের কথা বলার। অন্যদিকে, স্রোতের ফোনে কথা বলতে ভীষণ লজ্জা লাগে। বিশেষ করে নায়ীবের সঙ্গে। নায়ীব জানে, বুঝে। তা-ও নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলেনা। যেন সে খুবই মজা পায় স্রোতকে লজ্জায় ফেলে।
কিন্তু আজ নায়ীবই প্রথমে মুখ খুলল,
“ কিছু তো বললামই না, তাতেই এত লজ্জা পাচ্ছেন?”
স্রোত লজ্জায় মিইয়ে গেল আরো। তবুও কপট রাগী স্বরে বলল,
“ আমি মোটেও লজ্জা পাচ্ছিনা।”

নায়ীব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। চোখ-মুখ কুঁচকে হাসে। এ মেয়ের ভারী লজ্জা! লজ্জা ভাঙ্গাতেই না বিয়ের পর এক যুগ লেগে যায়!

“ আপনি লজ্জা-ই পাচ্ছেন, স্রোত। আপনাকে আগাগোড়া মুখস্থ হয়ে গেছে আমার। না দেখেও বলতে পারি আপনার গাল দু’টো লাল টমেটোর মত হয়ে গেছে। ব্লাশ করছেন।”

সত্যি কথা শুনেই স্রোতের হাঁসফাঁস শুরু হলো। ও কথা ঘুরাতে প্রশ্ন করল,
“ আপনি কি ব্যস্ত?”
“ ছিলাম। এখন ফ্রি। কি করছেন আপনি? গলা শুনে তো মনে হচ্ছে সর্দি লেগেছে।”

নাক টেনে একবার সত্যতা যাচাই করলো স্রোত। সত্যিই সর্দির জন্য আওয়াজ কেমন যেন শোনাচ্ছে। সে তো খেয়ালই করেনি। তন্মধ্যে নায়ীব আবার আবদারের সুরে বলল,
“ কথা বলুন!”
“ সর্দি লেগেছে খেয়ালই করিনি। সে যাকগে! বাড়ি যাব আজ।”
“ কি জন্য?” কপালে স্পষ্ট ক’টা ভাঁজ পড়ল নায়ীবের। পিঠ টানটান করে বসলো ও। স্রোত মিহি গলায় জানাল,
“ ছোট মা ফোন দিয়েছিল। খুব আবদার করে যেতে বলছে। অনেকদিন দেখেনি যে, তা-ই হয়তো।”
“ আর আপনার টিউশন?”
“ জোহার এক্সাম চলছে। শেষ হলে কিছুদিনের ভ্যাকেশন আছে। তাই চিন্তা নেই।”

নায়ীব অনেক্ষণ চুপ রইল। মনটা উশখুশ করছে ওর। মুখ ফুটে সহসা প্রশ্ন করল,
“ কেউ আবদার করলে, আপনি ফেলতে পারেননা। তাইনা?”
“ হু..হুম?” স্রোত এ কথার মানে ধরতে পারলনা চট করে।
“ আমি যদি এক বুক ভালোবাসা নিয়ে আবদার করি, আমার কাছে চলে আসবেন তো?” নায়ীবের কন্ঠস্বর কেমন যেন। শব্দগুলো জড়িয়ে গেলেও মাতা-ল করার মত মুগ্ধতা ভর করেছে কণ্ঠে। স্রোত এবারও ভয়াবহ লজ্জা পেল। টুপটুপ করে পরপর কয়েকবার চোখের ভারী পল্লব ঝাপটালো। রুমে কেউ নেই, তাও তার লজ্জায় মরি-মরি অবস্থা। উত্তরের অপেক্ষায় বেশিক্ষণ থাকতে হলোনা নায়ীবকে। স্রোত লজ্জা ভেঙে কিঞ্চিৎ কাঁপা গলায় টেনে-টেনে উত্তর দিল,
“ আ..আসবো।”

..

স্রোত পথিমধ্যে গাড়িতে গাঢ় এক ঘুম দিয়েছে। সুহাদ বাড়ির সামনে এসে তাকে ডেকে তুলল। স্রোত দুপুরের দিকেও না পারতে ঘুমিয়ে গেছিল। আসার পথেও ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েছে। রাতটা ও পেঁচার মত জেগে কাটাবে। সঙ্গী স্বরুপ নায়ীব আছে তো! এলোমেলো চুল হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে গাড়ি থেকে নামলো স্রোত। গাড়ির শব্দ পেয়ে বাড়ির ভেতরের সকলেই ছুটে এসেছে বাইরে। ইমা আগে আগে এলেন। তার কথা ফেলেনি মেয়েটা। স্রোতের মাথায় টুপ করে একটা চুমু খেয়ে বললেন,
“ থ্যাংকিউ আম্মা! কথা রাখার জন্য।”

আশার দেখা মিললো সদর দরজার কাছটায়। তার পা টলছে না যেন। স্রোত কাছে আসতেই দু’হাতে ঝাপটে ধরলেন। স্রোত টের পেল, মায়ের শরীর সামান্য কাঁপছে। চোখ দু’টো ভীষণ টলমলে। গালে কয়েকটা চুমু দিয়ে তিনি বললেন,
“ ফ্রেশ হয়ে আয়। আজকে সব তোর আর ইফাদের পছন্দের খাবার রান্না করা হয়েছে।”
ইফাদ ইনানকে নিয়ে দু’তলা থেকে দ্রুত গতিতে নামছিলো। ইফাদ এসেছে দুপুরের আগে। আশার কথা শুনে তার পা জোড়া থেমে গেল। বাকি চারটা সিঁড়ি না ডিঙিয়ে সে লাফ দিল। ইনান থেমে গেল। সে লাফ দিতে গেলে পড়ে যায়। এরপর ব্যথা পেলে ইমা পিঠে ধুমধাম বসান। তা-ই ও লাফ দেয়ার বৃথা চেষ্টা করলনা। ধীরে-সুস্থে অলস ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে নামলো। ইফাদ এসে আশার পাশে দাঁড়াতেই পিঠে ত্বরিত বেগে একটা থা-প্পড় পড়লো। ইফাদ জানে, ইনানের এই দুঃসাহস নেই। তাও ও রাগ নিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখল ইমা দাঁড়িয়ে আছে। তার চেয়েও দ্বিগুণ রাগী চোখ-মুখ ইমার। পলক ফেলার আগেই ইফাদের বাহুতে আরেকটা চ-ড় বসিয়ে তিনি বললেন,
“ লাফালাফি করা কই থেকে শিখছিস? তোর দেখা দেখি ছোটটা এসব করে। পরে আবার উলটে পড়ে হাত-পা ছুঁলিয়ে বসে থাকে!”
প্রথমে একবার খুশি হলো ইনান। মায়ের মা-রের শিকার সে-ই বেশি হয়। ইফাদ দূরে থাকে বলে বেঁচে যায়। তবে ইমার শেষ কথা শুনে সে আশাহত হলো।
ইফাদ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ ও লম্বা লাফ দিতে পারেনা, ওর ব্যর্থতা। আমাকে মে-রে কি ওর ঠ্যাং লম্বা হয়ে গেছে নাকি?”

সুহাদ তখন ব্যাগ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সদর দরজায় এমন জটলা পাঁকানো দেখে বিরক্ত। এরপর ইনানের কাঁধ চাপড়ে বলল,
“ চল, আমরা দুই ভাই ঘরে যাই। আমাদের এখন মূল্য-টুল্য নেই। সব খাবার-দাবার আজ ওদের পছন্দের খেতে হবে! আহ! চল ইনান, দুই ভাই মিলে দুঃখ বিলাশ করি।”
ইনানও তাল মিলাল। সুহাদ পাঁচ ফিট দশ আর ইনান পাঁচ ফিট পাঁচ। এই অসম উচ্চতা নিয়েও ইনান সুহাদের কাঁধ চেপে ধরল। এরপর দুঃখী মুখ নিয়ে দুজনে ভেতরে চলে গেল। স্রোত মুখ বাঁকিয়ে তাকালো ইফাদের দিকে। ওদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
“ চলো, ইফাদ ভাইয়া আমরা খেতে বসি।”
আশার চোখ ভিজে উঠল সন্তানগুলোদের দিকে তাকিয়ে। এরা বাড়িতে থাকলেই বাড়িতে প্রাণ থাকে।

..

নায়মা আজ সকাল সকাল হাজির হয়েছেন। নায়ীবকে ধরতে তিনি নয়টার দিকে এসেছেন। কিন্তু এসেও নায়ীবকে পেলেন না। নায়ীব আরেকটু আগেই বেরিয়েছে। নায়মা হতাশ ভাবমূর্তি নিয়ে সোফায় বসে আছেন। পুরোটা দিন তার উশখুশ করতে করতে কাটাতে হবে। কল দিলেও বজ্জা!তের হাড্ডি ধরবেনা তা তিনি ঢের জানেন। সজোরেই তিনি ক’টা গা-লি দিলেন ওকে। গালি গুলো ঠিক এমন,
“ বেয়া-দব ছেলে!”
“ অজাত একটা! কোনো কথা শুনেনা,মর্জিমাফিক চলে!”
নিশাত তৈরি হচ্ছিল ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। গা-লি শুনে সে রুম থেকে দ্রুত কদমে বের হয়ে বড় বড় চোখে তাকালো। পরপর রান্নাঘর থেকে বেরোলেন নাবিদ সাহেবও। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে তেজি গলায় বললেন,
“ গা-লি দিলে জাত ছাড়া দে। একই জাতেরই মানুষ তুই।”
নায়মা ফুঁসে উঠলেন। বিড়বিড় করে আরো গা-লি দিলেন। নিশাত হাসলো এবার খিলখিল করে। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা তার। নায়ীব বিয়ে করবে শোনার পর থেকেই নায়মা অস্থির হয়ে আছেন। পাত্রীর খোঁজ নেয়াই মূলত উদ্দেশ্যে। সেদিনকার পাত্রীটাকে বেশ লেগেছে নায়মার কাছে। বয়সটা যদিও একটু বেশি, নায়ীবের কাছাকাছি। তবে দেখে বোঝা যায়না। ঘরোয়াও বেশ। কিন্তু নায়ীব না দেখেই তাকে রিজেক্ট করল। এখন কোন রাজকন্যাকে বিয়ে করবে, নায়মাও দেখতে চান।

নিশাতের দেরী হচ্ছে বলে সে বেরিয়ে গেল।
ভার্সিটির সামনেটায় আসতেই আবার পরিচিত মুখটা দেখতে পেল। গত সাতদিন যাবত দেখা ছিলনা মানুষটার। কোথায় গায়েব ছিল তা জানার সুযোগ, অধিকার; কিছুই নিশাতের নিকট নেই। ওর আজ অদ্ভুত কারণেই মানুষটার উপস্থিতি বিরক্ত লাগলোনা। বরং মনে মনে বেশ চিন্তা হচ্ছিলো এতদিন। আজ কেমন স্বস্তি লাগছে। ও চোরা চোখে চেহারাখানা পরখ করে ক্যাম্পাসে ঢুকল। এরপর কয়েকবার পিছু ফিরেও ফিরে দেখল। মিষ্টি আসেনি এখনও। মিষ্টি আসার পর ক্লাসে যাবে বলে বড় গাছের নিচটায় দাঁড়িয়ে রইল ও। আধ-ঘন্টা পেরোলেও মিষ্টির দেখা মিললোনা। কিন্তু আরেক বিপত্তি ঘটলো। সিনিয়রদের এক বড়-সড় দলবল হাজির হলো। এরা ফোর্থ ইয়ারের বোধহয়। কম হলেও ছয়-সাত জন হবে। নিশাত সঠিক সংখ্যা গুনলোনা। চোখ নামালো অচিরেই। তবে পাঁচ-ছয় জোড়া পা ওর কাছে এসেই থামল। কেমন একপাশ দিয়ে ঘিরে রাখল। এখানে তিনটা মেয়েও আছে। বাকিগুলো ছেলে। সবার চোখ-মুখে উপচে পড়া বিদঘুটে হাসি।
নিশাত ভড়কালো। এসব পরিস্থিতি সামাল দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব প্রায়। বাবা-ভাইয়ের আদুরে ছায়ায় সে আঠারো বৎসর পার করেছে। কেউ মজা উড়ালেও সে কেঁদে কেঁদে যখন বিচার দিত, নায়ীব গিয়ে তাদের টাইট দিয়ে আসতো। স্কুল, কলেজ লাইফ এভাবেই কেটেছে ওর। ভাইয়ের কারণে ছেলেরা প্রেমের প্রস্তাবও দিতে পারেনি। তার আগেই কীভাবে যেন এসব জেনে রুদ্রমূর্তি ধারণ করতো নায়ীব।

“ কি ছোটআপু! নাম কি?”
একটা ছেলে প্রশ্ন করল। নিশাত সময় নিয়ে, থেমে থেমে জবাব দিল,
“ নিশাত..”
“ আগে পিছে কিছু নেই?”
আরেকজন প্রশ্ন করল। নিশাত পড়লো বিপাকে। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ জ্বি, পিছে আছে।”
“ তাহলে বললে না কেন? মহাবেয়াদব তো তুমি!” একটা মেয়ে বলল। গলায় কপট রাগ। সে কঠিন সাজতে চাইছে। অথচ কণ্ঠে স্বচ্ছ কৌতুক।

নিশাত হাঁসফাঁস করে উঠল। দম বন্ধ লাগছে ওর। এত মানুষ ঘিরে ধরায় কেমন সাফোকেটেড লাগছে ওর। পিছু হটে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ আমার নাম নিশাত ইফরাহ্।”
“ তোমার মতই সুন্দর নাম।” খিকখিক করে হেসে বলল একজন ছেলে। সে থেমে আবার বলল,
“ গান জানো?”
“ জ্বি।”
“ তাহলে গাও দেখি দুই লাইন।”
“ গান জানি শুধু, ভাইয়া। গাইতে পারিনা।”
নিশাতের কপালে ঘাম, চোখে-মুখে অসীম ভীতি ভাব। এরা যে র‍্যাগ দিতে এসেছে, বুঝতে পারছে ও। কিন্তু সরার উপায় পাচ্ছেনা।

ছেলেটার কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ নাচতে পারো? নাকি সেটাও..”

ছেলেটার কথা অসম্পূর্ণই রয়ে গেল। এর আগেই চোয়ালে একটা শক্ত-পোক্ত ঘু-ষি পড়ল। অকস্মাৎ এমন হাম-লায় ছেলেটা ঠিকরে পড়ল মাটিতে। বন্ধুবান্ধবরাও ছিটকে সরে গেল। নিশাত হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আঁতকে উঠল।

ওয়াহিদের চোখ-মুখ অত্যাধিক শান্ত। অথচ তাতেই কেমন রাগের আভাস। মাটিতে পড়া ছেলেটা আস্তে ধীরে উঠলো। ওয়াহিদকে দেখে ওর র-ক্তচক্ষু আচমকাই শীতল হলো। মস্তক নত হলো চটজলদি। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়ালের ব্যথা সহ্য করে নিল। চোয়াল খানিকটা নড়বড়ে ঠেকল ওর কাছে। ওয়াহিদ এগিয়ে খুবই শ্লথ পায়ে। অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে তার কলার টেনে মুখ সামনে টেনে আনলো। হিসহিসিয়ে প্রশ্ন করল,
“ কি বলছিলি?”
“ ক..কিছুনা ভাই। আর হবেনা। মাফ করে দিন।”

ওয়াহিদের ভেতরে চেপে রাগ আবার প্রকাশ্যে এল। শ-ক্ত হাতে চ-ড় বসালো সে। চ-ড় তো নয়, যেন বাঘের থাবা। ছেলেটা ব্যথার কঁকিয়ে উঠে। কোত্থেকে পিয়াশ ছুটে আসে। সঙ্গে ওয়াহিদের অন্য বন্ধুরাও। ওরা এসে শত টেনেও ওয়াহিদকে টলাতে পারেনি। শেষমেশ ওরা থা-প্পড় খাওয়া ছেলেটা তার বন্ধুদের হাতে গছিয়ে চলে যেতে বলল। ক্যাম্পাস ভর্তি স্টুডেন্টসরা তাকিয়ে ছিল এদিকেই। তবে ওই ছেলের দল বিদায় হতেই তারা নজর সরালো।
ওয়াহিদ হাত ঝাড়লো, শার্টও ঝাড়লো অযথা। এরপর বাম দিকে চাইলো। ক্রুরদার দৃষ্টি স্থির রেখে ঠোঁটের কোণ বাঁকালো সে। নিশাতের চক্ষুদ্বয় রসগোল্লার মত বড় দেখাচ্ছে। যেকোনো সময় কোটর ছিঁ-ড়ে বেরিয়ে মাটিতে পড়বে, এমন অবস্থা। ওয়াহিদ ওর বন্ধুদের রেখে নিশাতের দিকে এগোলো। ভীষণ স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করল,
“ পানি আছে?”
নিশাতের ধ্যান ছুটলো। ও ঘনঘন দু’বার মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ আছে।”
“ দাও।”

হাত বাড়ালো ওয়াহিদ। নিশাত ত্বরিত গতিতে ব্যাগ খুলে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিল। এরপর ইতস্তত ভাবভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওয়াহিদ পানি খেলনা। বরং অর্ধেক বোতল খালি করল হাত ধুঁয়ে। নিশাত এবারও চরম অবাক হলো। চোখ-মুখ কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেল। ওয়াহিদ আঙুল ওর মুখের সামনে নিয়ে দু ফোঁটা পানি ঝাড়ল। তাতেই নিশাতের পুরো মুখ কুঁচকে যায়। ওয়াহিদ বিড়বিড় করে বলে,
” মায়াপরী!”

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩০

দোতলা চেয়ারম্যান বাড়িটায় একটা চাপা হৈচৈ ভাব বিদ্যমান। চাপা বলার কারণ, এই হইহই কেবল দু’তলা থেকে নিচে নামলেই বোঝা যায়। রান্নাঘরে ভোর থেকেই আয়োজন চলছে। সব পরিচারিকারা ঘর-দোর পরিষ্কার করছে। তবে খুবই সূক্ষ্ণভাবে,আওয়াজ ছাড়া। রান্নাঘরের দিকটা আজ ইমা-ই বেশি সামলাচ্ছেন। আশার মন খারাপ। তবে তা তিনি বুঝতে দিচ্ছেন না। ইমা তাই রান্না করতে করতে গল্প করছেন আশার সঙ্গে।

স্রোত উঠলো নিজের মত। ঠিক নয়টা চল্লিশে। উঠে বিছানা গোছালো,ফ্রেশ হলো ধীরে সুস্থে। দশটা বাজতেই নিচে নামলো। রান্নাঘরের দিকে আর গেলোনা। খাবার টেবিলে বসলো। ইনান তখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে। স্রোত ভ্রু নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ স্কুল নেই তোর?”
“ আছে, যাবনা।”
“ কেনো?”
“ মেহমান আসবে আজ, জানোনা?”
ইনান এসে চেয়ারে বসল।
স্রোত অবাক হলোনা ততটা। মেহমানদারি তো তাদের বাড়িতে বারোমাসই লেগে থাকে। সাঈম সাহেব পারলে রোজই মেহমান দাওয়াত দিয়ে আনেন। এ আর নতুন কি!
তবে স্রোত আরো আশ্চর্য হলো, যখন দেখল বাড়ির কর্তারা কেউই আজ কাজে যাননি। যত মহা মেহমানই আসুক, সাঈম সাহেব সকাল সকাল গ্রাম চক্কর দিয়ে ফ্যাক্টরিতে যান। সঙ্গে সাহিদ সাহেবও। সাঈম সাহেব, সাহিদ সাহেব এসে দুই মাথার দুই চেয়ার দখল করে বসলেন। সাঈম সাহেব গম্ভীর চোখে স্রোতকে পরখ করে আশার উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লেন,
“ আশা, নাশতা দিয়ে যাও।”

নাশতা নিয়ে আশার বদলে ইমা এলেন। স্রোতের পাশে দাঁড়িয়ে একে একে চা,রুটি সার্ভ করলেন। স্রোত তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। মুখ ওপরে তুলে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
“ মাংস রান্না হচ্ছে?”
“ একটু আগেই বসিয়ে এসেছি। খেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে।”
স্রোত হেসে মাথা দুলাল কিঞ্চিৎ। বলল,
“ আচ্ছা, আনো।”
ইমা চলে গেলেন। স্রোত খালি চা মুখে তুলতেই সাঈম সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। বললেন,
“ রুটি দিয়ে খাও, খালি পেটে শুধু চা পড়লে ব্যথা করবে।”
স্রোত নিমিষেই কাপ নামিয়ে রাখল। রুটি এক টুকরো দিয়েই পুরোটা চা সাবাড় করলো।
রুটি দিয়ে মাংসের ঝোল ওর প্রিয় খাবার। ইমা অনেক্ষণ পর গরম গরম মাংস ভর্তি বাটি নিয়ে এলেন। এরপরই তৃপ্তি নিয়ে খেল স্রোত। হোস্টেলের মিলটা ওতো বাজেও না। বেশ ভালো এমাউন্টই পে করতে হয় বলে খাবারের মান একটু ভাল। তবে বাড়ির খাবারের স্বাদ-ই যে আলাদা!

..

ইনানের সঙ্গে পুকুর পাড়ে আসতে না আসতেই স্রোতের ডাক পড়ল। রান্নাঘর থেকে পুকুর পাড় দেখা যায়। চুলার কাছে একটা ছোট্ট জানলা আছে। আশা সেখান দিয়েই হাঁক ছাড়ছেন,
“ স্রোত,ঘরে আয়।”

স্রোত রয়েসয়ে আসছিলো নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায়। পায়ের গতি অত্যন্ত শ্লথ। ইনানও তা-ই। স্রোত বাড়ির কাছটায় আসার আগেই আশা আবার এক পরিচারিকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। নিপা নামের সেই পরিচারিকা কাচুমাচু মুখে বলল,
“ আপা, ঘরে আসেন জলদি। বড় আম্মা ডাকে আপনারে।”
স্রোতের কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ল। এরপর সে ইনানকে ফেলেই দ্রুত কদমে ঘরে এসে ঢুকলো। রান্নাঘর,আশার রুম টহল দিয়েও উনাকে পেলনা। নিপা পিছু পিছু আসতে আসতে বলল,
“ বড় আম্মা,ছোট আম্মা দুই তলায়। আপনার রুমে।”
“ আচ্ছা..”— বলে স্রোত দু’তলায় উঠে গেল।

রুমের প্রত্যেকটা জিনিসপত্র আরেকজন পরিচারিকা গোছাচ্ছে। ইমা তার কাজ তদারকি করছেন। আশা বিছানায় পা দুলিয়ে বসে আছেন। স্রোত ঢুকলো হুড়মুড় গতিতে। এরপর তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“ কি হয়েছে?”
“ এখানে বোস এসে। বাইরে খুব রোদ। পুঁ-ড়ে যাবি।”
“ সকালের রোদে ভিটামিন থাকে, আম্মু।”
স্রোত তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে আশার পাশে বসে। আশা আচমকাই ওর হাত ধরেন। অন্যহাতে গাল ছুঁয়ে বলেন,
“ আমার মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে!”
“ কত বড় আবার? চব্বিশ হয়ে যাব আরকি।” কৌতুক শোনালো যেন স্রোত। মায়ের মন খারাপের আঁচটা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে। কিন্তু কারণটা ধরতে পারছেনা। তন্মধ্যে নিপা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল,
“ আসবো,আম্মা?”
“ আয়,দ্রুত আয়!” ইমা জবাব দিলেন।

নিপার হাতের পানে তাকাতেই স্রোতের দৃষ্টি স্থির হলো। এরপর কেমন অবুঝের মত তাকালো আশার পানে। আশা ততক্ষণে নিপার হাত থেকে শাড়িগুলো একে একে বিছানায় সাজিয়ে রাখছেন। প্রত্যেকটা শাড়িই নতুন। কয়েকটা আছে শুধু; আশা একবার পরেছেন- এরকম। স্রোতের দিকে নজর ফেলে তিনি বললেন,
“ কোনটা তোর পছন্দ হয়?”
“ এগুলো..এখানে এনেছো কেনো?” থেমে থেমে আওয়াজ শোনা গেল স্রোতের। মেয়েটা ঘাবড়ে গেছে। ইমা দেখলেন, মেয়েটার কপাল বেয়ে সরু ঘামের রেখা। অল্প হেসে তিনি বললেন,
“ ঘাবড়াচ্ছো কেন আম্মা! আজকে মেহমান আসবে, বুঝলা! তাই এত আয়োজন। দেখো তো, ওই বাদামী রঙের জামদানিটা কেমন?”

স্রোত স্থির চিত্তে তাকালো মায়ের পানে। অবিশ্বাস্য চোখের দৃষ্টি। আশা ভরসা দিলেন চোখে চোখেই। বলার মত যে কিছুই পাচ্ছেন না তিনি!

..

ইফাদ অলস ভঙ্গিতে গা এলালো। সুহাদ ভ্রু কুঁচকালো। বলল,
“ বিছানা সবে গোছানো হয়েছে। নষ্ট করলে..”
“ আহ, ভাইয়া! ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।”
“ ওরা চলে আসবে যেকোনো সময়, ইফাদ। মজা করিস না, উঠ। বাড়ির সামনে তোর বাইক রাখা, ওটা সরা গিয়ে।”
“ ওরা কি সত্যিই আসছে?”
ইফাদ ফট করে চোখ খুলল। এরপর উৎফুল্ল চিত্তে, লাফিয়ে উঠে বসে বলল,
“ আমাদের বাড়িতে এই প্রথম পাত্রপক্ষ আসছে। স্রোত জানে?”
“ এতক্ষণে তো জেনে যাওয়ার কথা।”
“ রে-গে গেছে নিশ্চয়ই।”
“ রাগবে কেনো, পাত্র তো ওর পছন্দেরই।”
ইফাদ মাথা নাড়ল। বলল,
“ তা-ও ঠিক।”

..

স্রোতের গায়ে সেই বাদামী রঙের জামদানিটা। কাঁধ, কোমরের কাছটায় কম হলেও দশটা পিন আটকে দিয়েছেন ইমা। স্রোত জড় পদার্থের মত বসে আছে। না নড়ছে, না কথা বলছে। হাতে দু’টো চু-ড়ি পরিয়ে এরপরও ক্ষান্ত হলেন না ইমা। ভেজা চুলগুলো আবার তোয়ালে দিয়ে মুছে দিতে দিতে বললেন,
“ আমার আম্মাকে একদম পরীর মত লাগছে।” স্রোত নির্লিপ্ত,উদ্রেকহীন। আশা রান্নাঘরে। ইমা ওর চুল মুছে দিয়ে নিজের রুমে ছুটলেন প্রসাধনী আনতে। এবার স্রোত উঠল। শাড়ি সে খুব কমই পরেছে। তা-ও কেমন ও হেলেদুলে গেল বিছানার কাছে। যেতে যেতে একবার পা ও প্যাঁচিয়ে গেল শাড়ির সঙ্গে। স্রোত সামলে নিল। ফোন হাত তুলে নায়ীবকে কল দিয়েও বিশেষ লাভ হলোনা। তার ফোনটা সুইচড অফ শোনালো।

তন্মধ্যে ইমা এসে তাকে আবার বসিয়ে দিলেন আয়নার সামনে। খুবই অল্প প্রসাধনী দিয়ে সাজালেন ওকে। এরপর বললেন,
“ আম্মা,জানলার কাছে রোদে গিয়ে বসো। চুল শুকালে ছোট মা খোঁপা করে একটা ফুলের মালা বেঁধে দিব, ঠিকাছে?”
ইমা বলেই চলে গেলেন বাইরে। উদ্দেশ্য নিপাকে বলে ফুল সংগ্রহ করে এরপর মালা বানানো। ইমা ছোটবেলায়ও স্রোতকে পুতুলের মত সাজাতেন। এরপর শ’খানেক ছবি তুলতেন।

স্রোত জানলার ধারে গেলনা। একই ভঙ্গিতে ফোন হাতে চেপে বসে রইল। চোখ-মুখ অত্যাধিক শান্ত। অথচ বুক ফেঁটে তার কান্না আসছে।

খানিক পরে হুড়মুড় করে সুহাদ ঢুকলো। বেলা তিনটার ওপর বাজে। সুহাদ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। দেখল, স্রোত মাথা নুইয়ে বসে আছে আয়নার সামনে। দেখতে ভারী মিষ্টি লাগছে। সুহাদ কাছে গেল একদম ধীর কদমে। শব্দহীন পায়ে। স্রোত অনেক্ষণ পর টের পেল তার অস্তিত্ব। এরপরও মাথা তুললোনা। সুপ্ত রাগ তার মাথা কিলবিল করছে আপাতত। সে ভাইকে সব জানিয়েছে, তবুও কেন আজকের এই পরিস্থিতি? ভাই কি আটকাতে পারতোনা এসব? অবশ্যই পারতো। সুহাদ হাত বাড়িয়ে ওর মাথার ওপর রাখল। মিহি গলায় জানতে চাইল,
“ মন খারাপ?”
উত্তরের অপেক্ষায় পাক্কা পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে রইল সুহাদ। এরপর আবার মুখ খোলার পূর্বেই ইফাদ এলো দৌঁড়ে। তাড়াহুড়ো করে বলল,
“ ওরা এসে গেছে ভাইয়া, জলদি আসো।”

চলবে.