গোপনে_রাঙানো_প্রেম পর্ব-৩৪+৩৫

0
595

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩৪ (প্রথমাংশ)

ফোন উচ্চশব্দে বেজে চলেছে। নায়ীব ওয়াশরুম থেকে তড়িঘড়ি করে বেরোলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখল, জিহাদের কল। সকাল তখন আটটা বাজে কেবল। এত সকাল জিহাদের কল আসাটা অস্বাভাবিকই বটে। কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে কল রিসিভ করে নায়ীব। ওমনি সে স্তব্ধ,বিমুঢ় হয়ে যায়।
“ স্যার, ওই এক্সি’ডেন্টের ছোট বাচ্চাটা মা-রা গেছে। মাথায় প্রচন্ড আঘা-ত লেগেছিল, হাতটাও পুরো থেত*লে গেছে।” জিহাদের কণ্ঠস্বর মলিন। নায়ীব কোনোমতে নড়বড়ে গলায় বলল,
“ এসে কথা বলছি, জিহাদ।” এরপরই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। ফোনটা ঠাই পেল বিছানায়। নায়ীব মুখে হাত ঘষে বার কয়েক। সে না চাইতেও অশান্ত হচ্ছে। কালকে বাচ্চাটার মা কেঁদেকুটে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। গলির মুখেই ছেলেকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন উনি। পথিমধ্যে ছেলেটা ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নেমে যায়। কিন্তু সে রাস্তায় মাঝ অব্দি যায়নি। গাড়িটা এসেছে ফুটপাত ঘেঁষে। এরপরই ধা-ক্কা দিয়ে চলে গেছে। ভদ্রমহিলার মুখ থেকে ঘটনার বিবরণ শুনেই সে স্তব্ধ হয়ে গেছিল। ভেবেছিল, আজ একবার বাচ্চাটাকে দেখে আসবে।
তার আর সুযোগ রইলো কই!

নায়ীব পায়চারি করলো বারকয়েক। বারান্দা থেকে রুম, রুম থেকে বারান্দা। শেষমেশ সিগা-রেট বের করতে হলো। ড্রয়ার হাতড়ে সেটা বের করে ও বারান্দায় চলে গেল। দু’টো টান দিতেই আবার বিছানায় অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। নায়ীব শুনেও ফোনের ধারে-কাছে গেলনা। সিগা-রেট অর্ধেক শেষ করে বারান্দার বাইরে ছুঁড়ে এরপর ঘরে এল। রয়েসয়ে ফোন হাতে নিল। ততক্ষণে কল কেটে গেছে। স্ক্রিনে ভাসা সেভড নামটা দেখে চিত্ত একপ্রকার শান্ত হলো নায়ীবের। চট করে কলব্যাক করল।

স্রোত আজ জলদি উঠেছে। কাল রাত আটটার দিকে বার্বিকিউ’র আয়োজন করা হয়েছিল। দশটার দিকে স্রোত রুমে এসে ঘুম দিয়েছে। এজন্যই সকাল-সকাল ঘুম ভেঙে গেছে। উঠে সে আবার বেরিয়েছিল ইনানকে নিয়ে। অর্ধেক গ্রাম চক্কর দিয়ে মাত্রই বাড়ির আঙিনায় ঢুকেছে। তখনি কি মনে করে সে কল লাগালো নায়ীবকে।

নায়ীব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ গুড মর্নিং..” কল রিসিভ হলেও ওপাশ থেকে নিরবতা বজায় রইল। নায়ীবের কথার পিঠে এবার সে মুখ খুলল,
“ খুব খুব শুভ সকাল!” মেয়েটার কণ্ঠ অকারণেই ঝলমলে শোনাল।
“ এই শুভটা কে? তার নাম এতবার নেয়া হচ্ছে কেন সাতসকালে?” নায়ীবের কণ্ঠে কৌতুক। মন খারাপেরা ঠাই পেলনা আর হৃদয়ে।
“ হবে কেউ একটা!” স্রোতও কৌতুক ছুঁড়লো। তবে লাভ হলোনা বিশেষ। তার কৌতুক আর কৌতুকের মত ঠেকলোনা নায়ীবের নিকট। মুখ ভয়ানক কুঁচকে সে বলল,
“ কেউ একটা মানে? জানে মে:রে ফেলব একদম!”

হুট করে স্রোত জানালো, সে আজই হোস্টেলে ফিরবে। কেউ দ্বিমত পোষণ করেনি। তবে সুহাদ দিয়ে আসতে পারবেনা। নিয়ে যাবে ড্রাইভার। স্রোত ব্যাগ-পত্র আগে থেকেই গুছিয়ে রেখেছিল। সে আজ চমৎকার এক সারপ্রাইজ দেয়ার প্ল্যান করেছে। সে যাবে হুট করে,নায়ীব নিশ্চয়ই চমকে যাবে খুব?
ওর হোস্টেলে আসতে বিকাল তিনটার মত বাজলো। সে বেরিয়েছেই দেড়টার দিকে। ও এসে আরেকবার গোসল করল। শুভ্রার সঙ্গে তার দেখা হয়নি অনেকদিন। মেয়েটা যখন শুনেছে নায়ীবের বিয়ের প্রতি এত তাড়াহুড়ো, সেদিন থেকেই সে পার্মানেন্টলি নায়ীবের দলে। নায়ীবের বিরুদ্ধে তার মুখ থেকে টু শব্দ বের হয়না। স্রোত অবাক হয়, হাসিও পায়। ও শুভ্রাকে কল দিল। প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,
“ এই,শুভ্রা! ছেলেরা কি পছন্দ করে?”
“ মেয়ে মানুষ।” শুভ্রা অনেক্ষণ পর জবাব দিল। তার জবাব শুনে রিয়্যাকশান দেয়ার কথা ভুলে গেল স্রোত। পরপরই ভ্রুযুগল বেঁকে গেল, মুখে ফুটে উঠল স্পষ্ট বিরক্তি,রাগের মিশ্রণ। ও মুখের ওপর কল কাটলো। তক্ষুনি ফোনে কল এল। স্রোত ভাবল, শুভ্রার কল। কিন্তু না। কলটা নায়ীব ইয়াকিনের। স্রোত অনেক্ষণ স্ক্রিনে চেয়ে রইল। একদম শেষ সময়ে কল রিসিভ করল।
ওপাশ থেকে রাশভারি এক স্বর শোনা গেল,
“ হোস্টেলে ফিরেছেন?”
স্রোতের কুঁচকানো চোখ-মুখ ঠিক হয়ে গেল। ঠোঁটদ্বয়ের ভাঁজে সামান্য ফাঁক হলো। বিষ্ময়ে বলল,
“ আপনি কীভাবে জানলেন?”
“ জেনেছি কোনো এক ভাবে।” একটু থামলো সে। নমনীয় গলায় জানতে চাইল,
“বিকেলে ফ্রি?”
“ হু..কেনো?”
“ আমি আসবো। তৈরি থাকবেন।”

..

হসপিটালে অনেকদিন পর আসা স্রোতের। থার্ড ফ্লোরে লিফট থামতেই থেমে থেমে কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। মুহুর্তেই সেই কান্নার আওয়াজে পরিবেশ ভারী হলো। স্রোতের কৌতুহলী চোখ যখন করিডোরে ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন নায়ীব স্থির ভঙ্গিতে অনিমেষ চেয়ে তার মুখের পানে। চোখ-নাক-ঠোঁট সবটা পরখ করে সে থামল। মেয়েটা ওর থেকে খাটো। বুকের এক ইঞ্চ উপরে অব্দি তার মাথা আসে। হিল পরলে আরেকটু ওপর। সহজেই বুকের ভেতর মিশিয়ে ফেলা যাবে। শুধু মিশিয়ে ফেলাটাও নায়ীবের জন্য যথেষ্ট নয়। পারলে সে বুকের ভেতর লুকিয়েই ফেলত। সে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল নিজের ভাবনার। দিন দিন সে মা’রাত্মক ডেস্পারেট হয়ে যাচ্ছে। সিগা’রেটের নে’শার বদলে প্রেমিকার চোখ দু’টোর নে’শা তরপায় ওকে। ক্ষণে ক্ষণে শেষ করে দেয়। নায়ীবের ভাবনায় মধ্যেই স্রোত রিনরিনে গলায় জানতে চাইল,
“ এখানে এলাম কেনো?”

নায়ীব চোখ রাখল সামনে। করিডোরের শেষ মাথায় কেবিন। ওখানেই ছয় বছরের বাচ্চাটার লা’শ রাখা। রাতের আগে নিয়ে যাওয়ার কথা। ফর্মালিটিস শেষ করতে করতে দেরী হয়। তবে নায়ীবের জানা মতে, বাচ্চাটার বাবা বড় ডাক্তার। তিনি প্রভাব খাটিয়ে সময় কমালেও কমাতে পারতেন।
করিডোরের শেষপ্রান্তে কম হলেও ছয়-সাতজন মানুষ জড়ো হওয়া। দুজন ডাক্তারও আছেন। নায়ীব বিনাবাক্য ব্যয়ে এগুলো। তার আগে মুঠোয় পুড়ে নিলো নরম-সরম হাতটা।
যত এগোচ্ছে, ততই গা হিম শান্ত হয়ে যাচ্ছে স্রোতের। কান্নার আওয়াজ কানে বাড়ি খাচ্ছে। তাতেই কেমন হৃদপিন্ডের গতি বাড়ছে। ধক্ ধক্ আওয়াজ কি শুনতে পাচ্ছেনা নায়ীব? ওরা থামল এক হাত দূরে। বাচ্চাটার মা জ্ঞান হারিয়েছেন তন্মধ্যে। তাকে ধরাধরি করে কেবিনে নেয়া হলো। নায়ীব দেখল, বেঞ্চে বসে আছেন ডাক্তার সাহেবও। অদ্ভুত! কোনো নড়চড় নেই। স্ত্রী তার সামনেই জ্ঞান হারালেন, তাতেও ভ্রুক্ষেপহীন তিনি। এক দৃষ্টিতে ডান পাশের বদ্ধ গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছেন। নায়ীব ডাকল,
“ মিস্টার আহমেদ?”
লোকটা এবার ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরাল। চোখ দু’টো মা’রাত্মক লাল। স্রোত দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। ডান হাতটা ছাড়াতে চাইলেও লাভ হলোনা।
মি.আহমেদ ঢোক গিললেন। কণ্ঠনালি থেকে কথা বেরোতে চাচ্ছে না। তবুও কাঁপা গলায় বললেন,
“ অফিসার, আপনি এসেছেন?
নায়ীবের বুক চিঁড়ে বেরোলো এক দীর্ঘশ্বাস। লহু স্বরে বলল,
“ সরি ফর ইওর লস। অপ-রাধী অবশ্যই শা:স্তি পাবে। নিজেকে সামলান, প্লিজ!”

স্রোতের মাথার ওপর দিয়ে সব যাচ্ছে। কিচ্ছুটি বুঝে আসছেনা। তবে এতটুক তার জ্ঞানে ধরেছে, এখানের কিছু ঠিক নেই। কিছু তো একটা হয়েছেই!
মি.আহমেদ চোখ নামাতেই ও নায়ীবের হাত নাড়াল। নায়ীব তড়াক করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। স্রোত চোখের ইশারায় কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই হইচই শোনা গেল লিফটের পাশ থেকে। নায়ীব ঘাড় ঘুরানোর আগেই স্রোত ঘুরে দাঁড়াল। কৌতুহলী চোখে সামনে তাকাতেই এক ঝাঁক মানুষ নজরে এল। মধ্যিখানে থাকা মানুষটাকে চিনতে পারল স্রোত। এম.পি রাজীব! নিউজে অনেক সময়ই তিনি হেডলাইন দখল করে থাকেন। স্রোত হা হয়ে তাকাতেই নায়ীব তাকে চেপে সরালো আরেকটু। সে ভাবেনি, রাজীব আজই..এখনই আসবেন। সঙ্গে দল-বল, সিকিউরিটি, পুলিশ! সেই সঙ্গে আরেকজন; রায়া! শেষে আবার জিহাদের দেখাও মিললো। সে একদম শেষে। মাথা, হাত উঁচিয়ে নিজ অস্তিত্ব জানান দিল নায়ীবকে। নায়ীব চোখের ইশারায় বুঝাল কিছু। সে ওমনি দাঁড়িয়ে কাজে লেগে গেল।

মি.আহমেদ প্রতিক্রিয়াহীন। মৃ:ত ছেলে, তার শোকে অসুস্থ স্ত্রী, সবটাই তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে এখনও। এত মানুষের হইচই এ তিনি কান চেপে বসে রইলেন। রাজীব সবাইকে চুপ থাকার আদেশ দিয়ে এগোলেন। সর্বপ্রথম গেলেন মি.আহমেদের কাছে। বেঞ্চে এক কোণায় বসলেন। কাঁধে হাত ছুঁয়ে সান্ত্বনা বাণী বলে মন গলাতে চাইলেন বোধহয়। ভাতিজাটা যে ওনার বাম হাত! গরম মামলা মিটমাট তো করতেই হবে।

“ ডক্টর আহমেদ, এমন প্যাথেটিক নিউজ আশা করিনি আজ। সো সরি। আল্লাহ আপনার ছেলেকে জান্নাতবাসী করবে। আমীইইন।”
দু’বার টেনে টেনে তিনি আমীন বললেন। এতেও ভাবাবেগ দেখা গেলনা আহমেদের মধ্যে। তবে নায়ীব বুঝল,লোকটা অতি শোকে পাথর বনে গেছে। এসব তিক্ত বাণিও তাই কান থেকে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসছে। মন অব্দি পৌঁছাচ্ছে না আর।
ও একবার চোখ ঘুরালো স্রোতের দিকে। মেয়েটার জড়সড় মুখখানা দেখে মায়া হলো। রাজীব আসবেন জানলে ওকে নিয়ে আসতোনা নায়ীব। কি মনে করে যে সাথে এনেছিল! বড্ড আফসোস হলো মনের ভেতর।
রাজীব সাহেব আরও কথা বললেন। ক্ষ’তিপূরণ দেয়ার কথাও আকার-ইঙ্গিতে বুঝালেন। তা শুনে আহমেদ এবার মুখ তুলে চাইলেন। চোখে-মুখে অবিশ্বাস্যতা। পরপরই তাচ্ছিল্য করে বললেন,
“ একটা নিষ্পাপ প্রাণের ক্ষতিপূরণও এ জগতে কিনতে পাওয়া যায়,স্যার?”
রাজীব থমথমে চোখে তাকিয়ে উঠে পড়লেন। তক্ষুনি নজরে পড়ল নায়ীবকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা ছুটল একটু নিচে, হাতের কাছটায়। হাতের মুঠোয় হাত দেখে কেমন ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে অল্প হাসলেন। একটু এগিয়ে বললেন,
“ কি খবর অফিসার?”
“ কোন খবর জানতে চাইছেন,স্যা র?” নায়ীবের কণ্ঠে অদৃশ্য তেজ। সুপ্ত রাগ। রাজীব সাহেব হেসে সরাসরি তাকালেন স্রোতের দিকে। সন্ত্রস্ত হরিণীর ন্যায় মেয়েটা গুটিয়ে আছে। না! অফিসারের চয়েজ বাজে নয়। হাস্যোজ্জ্বল মুখেই তিনি নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“ কে হয়,অফিসার? ও-য়া-ই-ফ?” টেনে টেনে বলার ধরণে চোখের দৃষ্টি পালটে গেল নায়ীবের। শক্ত চোয়ালে জবাব ছুঁড়ল,
“ জ্বি।“ অবলীলায় এমন উত্তরে বি:ষম খাওয়ার জোগাড় স্রোতের। এই পরিস্থিতিতেও নাম না জানা অনুভূতিতে উত্তপ্ত হলো বক্ষ। গালে লালচে আভার ছড়াছড়ি মুহুর্তেই নজরে এল।

রাজীব চোখে চোখ রেখে প্রত্যুত্তর করলেন,
“ প্রফেশনাল লাইফ আর পার্সোনাল লাইফের মধ্যে একটা বাউন্ডারি সেট করা উচিত,অফিসার নায়ীব ইয়াকীন!”
“ করাই আছে, স্যার।”
নায়ীব কি ভেবে হাসলো এবার। তার হাসিটা ঠিক পছন্দ হলোনা রাজীব সাহেবের। উনি হাঁটা ধরলেন। সঙ্গে তার পালিত কু’কুরের দলও চললো। তবে একই স্থানে, বিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল একজন; রায়া। কটিল দৃষ্টিতে চেয়ে, এক ভ্রু কপালে তুলে সে তাকিয়ে আছে একই বাঁধনে আটকা হাত দু’টোর দিকে। কি দৃঢ় এক অধিকারবোধে হাতটা ধরে রেখেছে!
বাবা আর অফিসারের ঠান্ডা একটা লড়াই সে টের পেল ভালোভাবেই। তবে তাতে বিশেষ ধ্যান গেলনা। অফিসার বিবাহিত? সে তো বুঝতেই পারলনা! শেষে কিনা এক ম্যারিড পার্সনের ওপর এট্রাকড্ হতে হলো? সেকেন্ড খানেক পরই ওর ধ্যান ছুটে। তক্ষুনি চোখ তুলল সোজা তরুণীটির সুশ্রী মুখায়বের পানে। সেও থমথমে মুখে রায়ার দিকে তাকিয়ে। রায়া কদম ঘুরাতেই সে ফুঁ’সে উঠে।

রাজীব বেরোনোর আগে বিল-টিল মিটানোর আদেশ দিলেন তার ম্যানেজারকে। পরবর্তীতে আবার যাবেন নাহয় আহমেদের বাড়িতে। সান্ত্বনা স্বরুপ কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে আসবেন। আশা করছেন কোনো গন্ডগোল হবেনা এর মধ্যে।
হসপিটালের বাইরে বেরোতেই মিডিয়ার লোকজনদের ধুম পড়ে গেল। উপস্থিত ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন রাজীব। তিনি এসেছেন চুপিসারে। খবর লিক হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম। তবুও কীভাবে এসব মিডিয়ার লোক জড়ো হলো? বডিগার্ড,পুলিশ ওদের ঠেলে দুপাশে সরাল। মেয়েকে নিয়ে চটজলদি গাড়িতে উঠলেন উনি। তবুও মিডিয়ার লোকগুলো ছাড়লো না। গাড়িতে উঠার আগে কম হলেও দশ-বারোটা প্রশ্ন করে ফেলেছে। উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন শুনেই মাথা গরম হয়ে গেল রাজীবের। গাড়িতে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বসলেন। বুঝতেই পারলেন না, পরিস্থিতি সম্পূর্ণটাই তার হাতের বাইরে চলে গেছে!

নায়ীব হাত ছাড়ে আলগোছে। গ্লাসের কাছটায় ছুটে যায়। মিডিয়ার লোকজন দেখে বিস্তর হাসি বেরিয়ে আসে ঠোঁট গলিয়ে। ওর আকস্মিক এই হাসি নজর কাড়লো স্রোতের। নায়ীব ফোন বের করে টেক্সট লিখল,
“ গুড জব, জিহাদ।”

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩৪ (শেষাংশ)

জিহাদ লিফটের বাটন চেপে দাঁড়াল। মিডিয়ার লোকজনদের তাড়িয়ে এসেছে। নাহলে এরা এই সদ্য শোকে কাতর পরিবারটাকেও জ্বা:লিয়ে মা:রতো। ওদের সাক্ষাৎকার, বক্তব্য নাহয় পরেও জনসাধারণকে দেখানো যাবে। আপাতত ওনারা নিজেদের সামলাক। তবে সে রাজীবের হেনস্থায় জর্জরিত চেহারাটা দেখে অত্যাধিক খুশি হয়েছে। লিফট থামলো থার্ড ফ্লোরে। ও বেরিয়ে করিডোর ধরে হাঁটা ধরল। তবে বেশিদূর হাঁটা লাগলোনা। পা দু’টো থেমে গেল অবিলম্বে। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে বিষ্ময়ে অক্ষিযুগলের কোটর ছেড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার জোগাড়! তার ঠোঁটদ্বয়ের মাঝে অচিরেই বড়-সড় ফাঁক তৈরি হলো।

স্রোতের চোখ-মুখ কাটকাট। বিরক্ত নয়, তা স্পষ্ট বোধগম্য। কিছু একটা নিয়ে খুবই ক্রোধান্বিত সে। ঠোঁটের কোণ বাঁকানো। হাত দু’টো বুকের কাছটায় ভাঁজ করা। নায়ীব মি.আহমেদের সঙ্গে কিছু কথা সেড়েছে। কথাগুলো একপাক্ষিক। কোনো হেলদুল এখনও নেই লোকটার। একই ভঙ্গিতে মুখ ঢেকে বসা। নায়ীব বিদায় নিয়ে উঠে স্রোতের কাছটায় আসতেই মেয়েটার হঠাৎ পালটে যাওয়া প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝে উঠতে পারলনা কিছুই। আলগোছে আড়ালে হাত টেনে কাছে নিতে চাইলেও লাভ হলোনা। মেয়েটা ক্রমশ দূরে সরে গেল। মানুষ বুঝে আর জোর করলনা নায়ীব। স্রোত নিরলস,ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“ হোস্টেলে ফিরতে হবে।”

নায়ীব জবাব দেয়ার পূর্বেই বাম দিকে নজর ঘুরল। জিহাদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়ানো। চোখ-মুখের অভিব্যক্তি জানিয়ে দিচ্ছে,সে বিরাট বিষ্ময়কর কিছু দেখছে। ওর হা হওয়া মুখ দেখে নায়ীব হকচকালো একবার। পরপরই ইশারায় ডাকল ওকে। ধ্যান ছুটতেই জিহাদ ত্বরিত বেগে সামনে এগোলো। নায়ীবের কাছটায় গিয়ে থামল। টুপিটা ঠিক করে বলল,
“ আসসালামু আলাইকুম,স্যার!”
“ ওয়া আলাইকুম সালাম, জিহাদ। তুমি এখানে থাকবে কতক্ষণ? আমার ফিরতে হবে আসলে..”

“ আপনি থাকুন, আমি একাই যেতে পারব।”
ফোঁড়ন কাঁটে স্রোত। গলার স্বরে চাপা রাগের আভাস পেয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে নায়ীব। জিহাদ আহাম্মক বনে দাঁড়িয়ে রইল। হুশ ফিরতেই ঘাড় ফিরিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
“ আসসালামু আলাইকুম,ম্যাডাম। কেমন আছেন?”
“ ওয়া আলাইকুম সালাম,ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? আমাকে ম্যাডাম ডাকবেন না। আমার নাম স্রোতশ্রী, তা-ই বলে ডাকবেন।” গম্ভীর স্বর। এত কথা শুনে হকচকালো জিহাদ। আমতা-আমতা করে বলল,
“ না মানে..আপনিই তো স্যারের..ইয়ে.. মানে.. ভালো আছি, ম্যাডাম।”
জিহাদের কানেই নিজের বলা বাক্যটা কেমন বিদঘুটে লাগলো। লজ্জাও পেল বেশ। তবে তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেনি স্রোত। ব্যস্ত হয়ে বলল,
“ আমার দেরী হচ্ছে, আসি।”

বাক্য শেষ হতে না হতেই মেয়েটার পা ছুটলো ঘোড়ার গতিতে। নায়ীবও থেমে রইলনা। বড় বড় কদমে পিছু নিলো। ঘাড় ফিরিয়ে জিহাদকে কোনোমতে একবার বলল,
“ এদিকটা সামলে নিও।” জিহাদ মাথা নাড়ে। পরপরই চোখের সামনে আরেক মন-মাতানো দৃশ্যে তার ঠোঁটের কার্ণিশে ফুটে ওঠে বিস্তর এক হাসি। স্যারের প্রেমিক সত্ত্বা নিজ চোখে দেখার সুযোগ হলো শেষমেশ! প্রেমিকা হাত ধরতে দিচ্ছেনা বলে সে কাঁধ চেপে ধরে এগোচ্ছে। মেয়েটা মোচড়ামুচড়ি করলেও একটু পরই থেমে গেছে।

লিফটেও চড়তে চাইলোনা স্রোত। সিঁড়ি বেয়ে নামার কথা বলতেই চোখ রাঙালো নায়ীব। আচানক রাগের কারণ খুঁজতে ব্যস্ত সে। অন্যদিকে মুখ কিঞ্চিৎ ফুলিয়ে মেয়েটা লিফটে উঠল। লিফটটা ফাঁকা হওয়ায় নায়ীবের সুবিধাই হলো।
স্রোত দাঁড়িয়েছে বিশাল দূরত্ব রেখে। নায়ীব ঘাড়ে হাত চেপে এদিক-ওদিক তাকাল সতর্ক চাহনি নিয়ে। বাজপাখির ন্যায় নজর দু’টো কোনো সিসিটিভি ক্যামেরার হদিস পেলোনা।
ও জি বাটন চাপলো হাত বাড়িয়ে। লিফট বন্ধ হতে না হতেই গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। বাড়াবাড়ি রকমের কাছাকাছি দুজনে।
সরার সুযোগ পাওয়ার আগেই স্রোতের হাত দু’টো সে সবেগে, একহাতে চেপে ধরল।
অকস্মাৎ এটুকু আক্র*মণেই হতবিহ্বল চোখে তাকালো মেয়েটা। পলক ফেলার পূর্বেই অন্যহাতটা ক্রুরদার গতিতে দুই গাল চেপে ধরে। সেই স্পর্শে তবুও নমনীয়তা টের পেল স্রোত। পিঠ ধাক্কা খেল লিফটের ওয়ালে। গালে হাতের পাশাপাশি এক জোড়া ওষ্ঠের ছোঁয়া পেয়ে মেয়েটার শরীর শিথিল হলো এবার।
ওমনি থাকল কিয়ৎক্ষণ। তবে গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসার পূর্বেই সে গাল ছেড়ে দিল।
স্তব্ধ স্রোত চোখ দু’টো বড়বড় হয়ে প্রতিক্রিয়া দেয়ার আগেই নাকে-নাকে ঘর্ষণ হয় একবার। এরপরই নায়ীব একহাত দূরে সরলো। খুক-খুক করে একবার কেঁশে ও বুক টান-টান করে দাঁড়ালো। এমন গর্বের-সহিত দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা; যেন কোনো রাজকার্য সাধন করে এসেছে। বেরোনের আগে একবার আওড়ালো,
“ এবার গালে দিয়েছি। পরেরবার রাগ দেখালে সোজা ঠোঁ..”

কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই লিফট খোলার অদ্ভুত শব্দ হলো। সে আবার হালকা কেঁশে গলা ঝাড়লো।
লিফটের দরজা খোলার আগ অব্দি ডান গালটায় হাত চেপে রেখেছিল স্রোত। বিষ্ময়ে কি মেয়েটা রোবটই বনে গেল? আড়চোখে তাকালো নায়ীব। এই এক ডোজেই সব তেজ শেষ? ডোজ বাড়ালে এ মেয়ের কি হবে? নায়ীব হতাশ হবে কিনা, ভেবে পেলনা।
স্রোত বেরোলো টালমাটাল পায়ে। গাল থেকে হাত নেমে গেল অবিলম্বে। কেমন জড়সড় হাঁটার ভাব! নায়ীব রিকশা দাঁড় করাতেই চুপচাপ উঠে বসল মাঝখানটায়। তা দেখে কপালে স্পষ্ট ভাঁজ পড়ল নায়ীবের। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ লিফটের কাজটা এখানে করা উচিত ছিলো। বিশাল মিস্টেক হয়ে গেছে।”

স্রোত সুরসুর করে ওপাশে চেপে বসল। নায়ীব উঠল এবার প্রশস্ত হেসে। আড়চোখে তা দেখে পূর্বের মতই ফুঁসে উঠল স্রোত। তবে মুগ্ধ না হয়েও পারেনা।
ঠোঁট এলিয়ে হাসলে নায়ীবের অক্ষিপুটে ক’টা সুক্ষ্ণ ভাঁজ পড়ে। নেত্রযুগল ছোট-ছোট হয়ে আসে। মা-রাত্মক সুন্দর লাগে। তাতেই একটা হার্টবিট মিস করে স্রোত। পরপরই মাথায় আসে, অন্যরাও তো ওকে দেখে। ওই মেয়েটাও কেমন চেয়ে ছিল কাঙালের মত। হাতের দিকটায় অবিশ্বাস্য চোখে তাকানো দেখে মনে হচ্ছিলো, স্রোত ভুল অবস্থানে আছে। তার জায়গায় মেয়েটার থাকার কথা। মেয়েটা তাই চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলো ওর ব্যক্তিগত মানুষটাকে।
এসব ভেবেই ও মুখ ফেরাল।
সন্ধ্যার নিভু-নিভু আকাশ। রিকশা চলছে ধীর গতিতে। মেইন রোড পেরিয়ে নির্জন রাস্তায় ঢুকতেই কোমরে বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া লাগলো। ওমনি আঁতকে উঠল স্রোত। শঙ্কিত নজরে ঘাড় ফিরাল। হুটহাট রোম্যান্সের মুড আসে কোত্থেকে লোকটার? ভীষণ জ্বা:লায় পড়লো তো! রিকশাওয়ালা এক ধ্যানে রিকশা চালাচ্ছেন।
ওর তাকানো দেখে নায়ীব ভ্রু কপালে তুলে লহু গলায় ভীষণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানতে চায়,
“ কি? রাগ পড়েছে?”
“ কই? কিসের রাগ!” স্রোত তড়াক করে চোখ নিলো সামনের দিকে।
“ নাকের পাটা ফুলে যাচ্ছে তো,সুন্দরী। ভয়া-নক রাগটা যে নজরে আসছে, সেটা কি তবে মিথ্যে?”
“ হ্যাঁ, মিথ্যে।” দাঁতে-দাঁত চেপে বলল স্রোত। নায়ীব নরম গলায় পুনরায় জানতে চাইল,
“ কি হয়েছে?”

কণ্ঠস্বর দিয়েই বোধহয় বুদ করার ক্ষমতা রাখে সে। স্রোতের রাগের পারদ মিটার হুরহুর করে তলানিতে ঠেকল। তেজহীন গলায় বলল,
“ ওই মেয়েটা কে ছিল? ঐ এম.পির সঙ্গে?”

“ মেয়ে হয় সম্ভবত।”
“ ও কিরকম করে তাকাচ্ছিলো। শি ওয়াজ জেলাস,আই গেস।”
নায়ীব কি বলবে ভেবে পেলনা এবার। বাকহারা সে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল। স্রোত প্রত্যুত্তর না পেয়ে ঘাড় ঘুরালো। নায়ীবের এমন বিমুঢ় চাহনি দেখে সে থমকালো বেশ। ভ্রু নাঁচিয়ে বোঝাল,
“ কি?”
“আপনি এজন্য রাগ দেখাচ্ছিলেন? ড্যাম! ওই মেয়ে জেলাস নাকি তা নিয়ে আমার কনসার্ন নেই। বাট ইউ আর জেলাস।” বলতে বলতেই সে শব্দ করে হাসলো। নিস্তব্ধ রাস্তার আঁকেবাঁকে ধাক্কা খেল সে হাসির শব্দ। স্রোত মস্তক নত হলো ত্বরিত। গাল দু’টোয় তখন রক্তিম আভার ছড়াছড়ি। ও ক্ষীণ রাগ নিয়ে,প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
“ আপনি বলছেন অন্য কেউ চোখ দিয়ে আপনাকে গিলে খেলেও সমস্যা নেই?”
নায়ীব দু’বার মাথা নাড়ল,
“ আছে, ঢের সমস্যা আছে। আমাকে গিলে খাওয়ার অধিকার শুধু একজনের কাছে আছে। অন্য কেউ এই দুঃসাহস দেখালে তার জন্য আমার স্পেশাল হ্যান্ডকাফটা সদা প্রস্তুত!”

সাঈম সাহেবের সঙ্গে নাবিদ সাহেবের কথা হয় মাঝেমধ্যে। খোঁজ-খবর নিয়ে আজ বিয়ের আলাপ-আলোচনা তুললেন নাবিদ সাহেব। আয়োজন হবে আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে। জাঁকজমকে মোড়ানো থাকবে বাসার আনাচে-কানাচে। আত্মীয়-স্বজনে ভর্তি থাকবে ঘর। নায়ীব-নিশাতের মায়ের অপূর্ণ ইচ্ছাগুলোর মধ্যে এটি একটি। ছেলে-মেয়ের বিয়ে নিয়ে তার আগ্রহ ছিল অশেষ। কিন্তু কিছুই যেন তার সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য ছিলোনা।

“ বিয়ের ডেটটা ঠিক-ঠাক করে রাখলে কেমন হয়, ভাই সাহেব? প্রস্তুতিরও তো একটা ব্যাপার আছে।”
সাঈম সাহেব সম্মতি পোষণ করলেন এ কথায়। এই বিয়ে মিটলে আবার আরেক বিয়ের আয়োজন করতে হবে তাদের। আলিফ শেখকে তিনি ঠিক-ঠাক ডেট দিতে পারেননি। তবে কোনো বিয়েতেই উনি তাড়াহুড়ো করবেন না। চেয়ারম্যান বাড়ির বিয়ে-শাদি পুরো গ্রামের নজর কাড়ার মত করেই আয়োজন করা হয়।

“ এজন্য তো দুই পরিবারকে আবার বসতে হবে,ভাইজান। আপনাদের দাওয়াত রইল। সময় করে..”

নাবিদ সাহেব বিনয়ের সঙ্গেই নাকচ করলেন প্রস্তাবখানা। বললেন,
“ আমরা একবার গেছি। আপনারা ভরসা রেখে আসুন এবার। কোনো আপত্তি শুনছিনা।”

সাঈম সাহেব কয়েকবার বলেও নিজ সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারলেন না নাবিদ সাহেবকে। শেষমেশ সম্মতি দিলেন।

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩৫

শুক্রবারে চেয়ারম্যান বাড়ির সকলে আসবেন। শুক্রবার ছুটির দিন বলেই এ দিনটা বেছে নেয়া। হাতে মাত্র একদিন সময়। রাবেয়া তার মধ্যেই ঘর পরিষ্কারের কাজে লেগে গেছেন। সেই সঙ্গে কোমর বেঁধে নেমেছে নিশাতও। বাসাটা ছোট নয়। ডাইনিং,ড্রয়িং স্পেসটা বিশাল। গেস্টরুমটা ফাঁকা পড়ে থাকে। সেটা পরিষ্কার করতেই দিন পেরোলো তাদের। নিশাত অবসন্ন দেহে রুমে ছুটল। হাত-মুখ ধুঁয়ে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। অর্ধেক পা তার বিছানার বাইরেই। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুঁতে ওর ভালো লাগে। সকালে উঠে কখনো নিজেকে ও সোজাভাবে আবিষ্কার করেনা। হয় বিছানার শেষপ্রান্তে মাথা থাকে, নাহয় বিপরীতপ্রান্তে। মা থাকতে কতোবার যে রাতে রুমে এসে চক্কর দিতেন; তার ইয়ত্তা নেই। নিশাত চোখ বন্ধ করল। মা, মা গন্ধটা কত বছর ধরে নাকে আসেনা! নিশাত তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। এখন আর কান্না আসেনা। তাদের চেয়েও বেশি ভেঙে পড়েছিলেন নাবিদ সাহেব। কীভাবে যেন একসময় সবাই-ই নীরবে সয়ে গেছে এসব কষ্ট।

নিশাত ধপ করে চোখ খুলল। কাল ভার্সিটি আছে। ছোটো-মোটো টেস্টও আছে। মিষ্টি পড়াশোনায় ফার্স্টক্লাস। সে নিশ্চয়ই পড়ে ফেলেছে সব। নিশাত তাই শান্তিতে চোখ বুজলো। মিষ্টি থাকতে তার কিসের টেনশন!
সেদিনের পর কোনো সিনিয়রের জ্বালাতনের সম্মুখীন হতে হয়নি। আর না ওয়াহিদকে ভার্সিটিতে দেখা গেছে! কই হারিয়েছে কে জানে। ক্লাস তো অতি শীঘ্রই শুরু হবে। দেখা-সাক্ষাৎ তো হবেই। নিশাত নিজের ভাবনায় লাগাম টানতে পারেনা ইদানীং। তবে মাঝেমধ্যে লজ্জা লাগে। ভাবনারা সীমা ক্রমশ অতিক্রম করছে। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে,লাগাম না টানলে ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে হবে।

..

“ বিয়েটা তাড়াতাড়ি হলে ভালো, নাকি সময় নিয়ে, বড় আয়োজন করে করলে ভালো হয়?”
খেতে খেতে প্রশ্ন ছুঁড়লেন নাবিদ সাহেব। চেয়ারে বসা বাকি দুইজনের উদ্দেশ্যে করা প্রশ্ন। নিশাত জবাব দিলনা। অপেক্ষা করল ভাইয়ের। তবে সে চায় বিয়েটা যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন হোক!
নাবিদ সাহেব ছেলের মৌনতা দেখে নড়েচড়ে বসলেন। লম্বা দম টেনে শুধালেন,
“ নায়ীব, তোমার কি মনে হয়? মানে তুমি কি চাও?”
“ তাড়াতাড়ি আয়োজন করা হোক।”
অবলীলায় মনের ভাব প্রকাশ করল সে। অথচ ভাবভঙ্গি কি নির্লিপ্ত! ভেতরকার বেপরোয়া ভাবটা বাপ-মেয়ে; দুজনেই টের পেলেন। নিশাত অগোচরে ঠোঁট টিপে হাসে।

.

আজ থেকে মাস্টার্সের ক্লাস শুরু। প্রথম ক্লাস বলে খুব কম মানুষই উপস্থিত আজ। এই যে, শুভ্রাও আসেনি। তার নাকি সকালে উঠতে ভালো লাগেনা। স্রোত এমনিতেই খুব কম ক্লাস মিস দেয়। হোস্টেলের বদ্ধরুমটায় প্রায়শই তার দম বন্ধ লাগে। ছোট্ট একটা বারান্দা থাকলে বেশ হতো।

স্রোত লাইব্রেরীতে এসেছে। ঘুরে-ঘুরে কয়েকটা বই দেখে ও আবার বেরিয়ে গেল। ক্লাস দু’টো হয়েছে কেবল। আর করার ইচ্ছেও নেই। ঘড়ির কাটা তখন বারোটার ঘরে। মাথার ওপর থাকা সূর্যের তেজ আজ ক্ষীণ। পেটের ভেতর ক্ষিধায় আচানক অদ্ভুত শব্দ হলো। স্রোত হকচকালো। সকালে তার খাওয়া হয়নি। সে ছুটল এবার ক্যান্টিনে। তবে গিয়ে বিরক্তিতে কাবু হলো। টেবিল একটাও খালি নেই। একজনই এক টেবিল দখল করে বসে আছে। সে ওয়াহিদ! কি আয়েশি ভঙ্গিতে হাত এলিয়ে সে বসেছে! যেন তার কেনা ক্যান্টিন। একটা চেয়ারে পা ও তুলে রেখেছে! অভদ্র,বেয়া;দব— বিড়বিড় করে দু’টো কথা শুনিয়ে দাঁড়িয়ে রইল স্রোত। আশায় রইল, একটা টেবিল অন্তত খালি হবে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ হাত টেনে ধরায় হকচকালো ও। তবে তুলতুলে নরম একটা হাতের ছোঁয়া পেয়ে বুঝল, এ কোনো পুরুষালী ছোঁয়া নয়। সে শান্ত হয়ে ঘাড় ঘুরালো।
নিশাত হাত ধরেছে। মুখে বিস্তর হাসি। স্রোতকে দেখে বলল,
“ কেমন আছো,ভাবী?”

স্রোত কি লজ্জা পেল? হয়তো। গাল দু’টো নিমিষেই রক্তিম হলো। ভাই-বোন, দুজনই দারুণ লজ্জা দিতে পারে। আর স্রোতও ইদানীং একটুতেই লজ্জা পায়।
এভাবে কেউ ভাবী ডাকে?
স্রোত লাজুক হেসে বলল,
“ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো, নিশাত?”
“ আমিও ভালো। দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো কোথাও!”
“ জায়গা খালি নেই। একটু অপেক্ষা..”

কথা সম্পূর্ণ করতে পারলনা ও। ওয়াহিদ এমন ভাবে উঠে দাঁড়ালো! প্লাস্টিকের একটা চেয়ার শব্দ করে পড়ে গেল। সে তড়িঘড়ি করে সেটা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ক্যান্টিনের সবাই-ই একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকে দেখল। নিশাত তাকে দেখে মিইয়ে গেল। স্রোতের সামনে না কোনো সিন ক্রিয়েট করে এই ছেলে!
ওয়াহিদ স্রোত আর নিশাতের দিকে চেয়ে চমৎকার হাসলো। স্রোতের ভ্রু আপনা-আপনি কুঁচকে গেল। বোকার মত হাসছে কেন!
ওয়াহিদ এগিয়ে এল। বলল,
“ আরে স্রোত! লং টাইম নো সি।”
“ তোকে দেখা দিতে এমনিতেও আমার বয়েই গেছে।”
ওয়াহিদ দাঁতে দাঁত চাপল। তবুও হাসি সরলোনা চেহারা থেকে। চোখ ঘুরিয়ে একবার নিশাতকে পরখ করল। মেয়েটা মুখে হাত দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে হাসি আটকানোর।
এবার ওয়াহিদও খিক-খিক আওয়াজে একটু হেসে নিল। স্রোতের ভ্রুযুগল সোজা হলো। মনে সন্দেহের দানা বাঁধল। ওয়াহিদ বলল,
“ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বোস গিয়ে, যা। টেবিল দখল করে ফেলবে কেউ। যা যা, বোস।”
“ অন্য টেবিল খালি হোক, সেটায় বসবো।”
ওয়াহিদ ভ্রু কপালে তুলে বলল,
“ কেনো? আমি বসায় কি টেবিল অপবিত্র হয়ে গেছে?”
“ অনেকটা তেমনই..” বিড়বিড় করে চোখ সরালো স্রোত। নিশাত গোল-গোল চোখে তাকিয়ে তাদের কথাবার্তা শুনছে।

স্রোত বিড়বিড় করলেও কথাটা আন্দাজ করে নিল ওয়াহিদ। দাঁতে দাঁতে সংঘর্ষে অদ্ভুত শব্দ হলো। মনে মনে আওড়ালো,
“ শুধু হবু প্রেমিকা ভাবী ডেকেছে বলে সয়ে নিলাম। ভবিষ্যতে যাতে একটু ফেভার পাই। নাহলে তোর জন্য টেবিল ছাড়তে আমারও বয়ে গেছে,জল্লা-দ মহিলা! ”

ও এরপর জোরপূর্বক হেসে তাকালো নিশাতের দিকে। ইশারায় বলল,
“গিয়ে বসো।”
ওমনি হাতে টান পড়ল স্রোতের। নিশাত টেনে নিয়ে গেল টেবিলের কাছটায়। বলল,
“ এত ঝগড়া করে লাভ নেই, ভাবী। পায়ে ব্যথা করছে, চলো বসি।”

স্রোত দ্বিরুক্তি করলনা এবার। চেয়ারে বসতে না বসতেই কল এল। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই তার চেহারা নাজুক হলো। নিশাত ভ্রু নাঁচাল,
“ ইম্পর্ট্যান্ট কল?”
“ হ..হুম। আসছি আমি।”
কোলাহলপূর্ণ ক্যান্টিন ছেড়ে বেরোলো ও। দু সেকেন্ড গড়াতে না গড়াতেই ওয়াহিদের আগমন ঘটল। ধপ করে বসল চেয়ারে। একটু হলে না চেয়ারই ভেঙে যেত!
নিশাত আঁতকে উঠে,
“ একি! আপনি! আপনি যাননি?”
“ কোথায় যাব?” ওয়াহিদ আশ্চর্য কণ্ঠে শুধাল।
“ এখানে বসেছেন কেন?”
“ এটা না তোমার কেনা চেয়ার। আর না তোমার ওই ভাবীর কেনা চেয়ার। সে যাইহোক, স্রোতশ্রী তোমার কোন ভাইয়ের ভাবী লাগে?”
নিশাত হকচকালো,
“ ভাইয়ের ভাবী মানে?” ওয়াহিদ জ্বিভ কেটে দ্রুত সুধরায়,
“ সরি সরি, ভাইয়ের বউ হবে ওটা।”

নিশাত একপলক স্থির চেয়ে, খিলখিল করে হেসে উঠল। রিনরিনে হাসির আওয়াজ কেমন ছন্দের মত কানে বাজলো ওয়াহিদের। প্রেম; জিনিসটা তো মারাত্মক! হাসির শব্দও ছন্দের মত শোনায়; জানা ছিলনা ওয়াহিদের।
ওয়াহিদ অনিমেষ চেয়ে রয়। চোখের পলক তার সামান্য নড়ছেওনা। সহসা নিশাত থেমে গেল। বড়-সড় ঢোক গিলে বলল,
“ আমার একমাত্র ভাইয়ের বউ হয় উনি, ভাবী না।” বলেই চিকন ঠোঁটগুলো এলিয়ে হাসলো। ওয়াহিদ আর কতবার মুগ্ধ হবে? নিশাত তার দৃষ্টি দেখেই হাসি থামালো। মুহুর্তেই অস্বস্তিতে জর্জরিত হলো সে,
“ আপনি বসে থাকবেন?”
ওয়াহিদের ধ্যান ছুটে। মাথা চুলকে বলে,
“ তোমার ভাবী না আসলে তো থাকতাম। কিন্তু সে আসলে কুরুক্ষেত্র বাঁধাবে। তাই আজকের জন্য আলবিদা।”

.

আজকের মত বিশেষ দিনে,রাবেয়ার ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করতে পারলেন না নাবিদ সাহেব। সিংহভাগ আইটেমই তিনি রান্না করেছেন। পুরো ঘর রান্নার ঘ্রাণে মো মো করছে। রাবেয়া রান্নাঘরে অবহেলায় পড়ে থাকা বস্তুর মত দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে বিরক্ত হলেন। যে কাজের জন্য তাকে আনা হলো, সেটাই তাকে করতে দেয়া হয়না। তিনি ভীষণ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
“ নায়ীব বাবায় আমারে কাজে রাখল রান্নার লাইগা। আপনি তাও করতে দেন না, ভাইজান। করমুটা কি?”
“ রান্না শিখো, রাবেয়া। তোমার রান্না হয়না।”
রাবেয়া আশ্চর্য বনে গেলেন। ক্রুরদার কণ্ঠে বললেন,
“ সারা এলাকার মেসে আমার রান্নার প্রশংসা চলে, ভাইজান। আর আপনে কন আমার রান্না মজা না।”
“ মজা না, সেটা বলিনি। তুমি তরকারিতে এত পানি দাও! আমার বাচ্চাগুলো পছন্দ করেনা এত ঝোল।”
রাবেয়া প্রত্যুত্তর না দিয়ে,মুখ ঝামটা মে রে ড্রয়িং রুম গোছাতে গেলেন।

..

ইফাদ,স্রোত বাদে আজ চেয়ারম্যান বাড়ির সকলেই এখানে উপস্থিত। রমরমা পরিবেশ। টি-টেবিলে নাশতার বাহার। আশা অবাক হলেন। কাজের মহিলা এত সুস্বাদু খাবার বানাতে পারে? অথচ তাদের বাড়িতে চলে সম্পূর্ণ বিপরীত কান্ড। ইমা কৌতুহল দমানোর ক্ষেত্রে সর্বদাই ব্যর্থ। মুখ ফসকে তাই বের হলো,
“ এত এত নাশতা কে বানিয়েছে, ভাই সাহেব?”
“ আমি বানিয়েছি, আপা। কেন মজা হয়নি?” নাবিদ সাহেবের উত্তর পেয়ে উপস্থিত সকলেই হতবাক হলেন। ইমা চোখ ঘুরালেন নিজের স্বামীর দিকে। এই বান্দা তো চা বানাতেই আনাড়ি। চোখে চোখে ইশারা দেয়ার ক্ষণে নাবিদ সাহেব মুচকি হেসে বললেন,
“ অবসর পাওয়ার পর রান্নাকে সঙ্গী বানিয়েছি। চেষ্টা করি নতুন নতুন আইটেম বানিয়ে বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর। ওরা আর বাসায় থাকেই বা কখন!”
বলেই তিনি দারুণ হাসলেন।
নায়ীব অদূরেই দাঁড়িয়ে। বাড়ির সকলেই উপস্থিত। ইফাদের ব্যস্ত দিনকাল। কোনোমতেই আসা সম্ভব নয়। অন্যদিকে; স্রোত! মেয়েটা নাকি লজ্জায় আসেনি। সুহাদের কাছ থেকে এ কথা শুনেছে ও।
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে সকলে আলাপচারিতায় বসলেন। নাবিদ সাহেবের আগে সাঈম সাহেবই কথা তুললেন,
“ নভেম্বরের শেষের সময়টা পার্ফেক্ট। তখন সবার ব্যস্ততাও কম থাকবে।”
এরপরই তিনি সরাসরি ঘাড় ঘুরালেন নায়ীবের দিকে। নায়ীব সোজা হয়ে দাঁড়াল।
“ তোমার কি অসুবিধা হবে,বাবা?” সাঈম সাহেবের মোলায়েম কণ্ঠের প্রশ্নে নায়ীব জবাব দেয়,“জ্বি,না।”

সাহিদ সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,
“ তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ!”

নাবিদ সাহেব আপত্তি করলেন না। হাতে দিন পঁচিশের মত সময় আছে।
তারিখ ঠিক করা হলো নভেম্বরের ত্রিশ। এরপরই মিষ্টিমুখ করা হলো। সুহাদ ততক্ষণে সেখান থেকে সরে কল দিয়ে ফেলেছে বোনকে। ঘাড় ফিরাতেই হঠাৎ নায়ীবকে দেখল ও। চোখা-চোখি হতেই ও এগালো। ফোনটা এগিয়ে দিয়ে অল্প হেসে বলল,
“ স্রোতের কল। খুশির খবরটা নাহয় তুমিই দাও।”

চলবে..