গোপনে_রাঙানো_প্রেম পর্ব-৩৯+৪০+৪১

0
589

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৩৯

পাতলা,ফিনফিনে পর্দা গলিয়ে সূর্যের কিরণ প্রবেশ করছে। নরম রোদে ঘর মাখো-মাখো। সে রোদের ঝলকানির একাংশ দখল করেছে স্রোতের ফর্সা চোখ-মুখ। ঘুমের মধ্যেই বিরক্তির রেশ লেগে আছে চেহারায়।
নায়ীব লম্বা দম নেয়। তার ঘুম ভেঙেছে একটু আগে। বেঘোরে ঘুমে কাবু স্রোত। ঘুমিয়েছেই তো ভোরের আগে। নায়ীব মুখ উঁচালো। নিবিড় চোখের দৃষ্টি বিচরণ করছে স্রোতের সম্পূর্ণ মুখে। অল্প বোঁচা নাকটায় চোখ আটকালো তার। ঠোঁট এগিয়ে একটা চুমুও বসালো। ঘুমে কাদা মেয়েটা কি টের পেল? উহু!
নায়ীব থেমে থাকলোনা। স্রোতের ভেজা চুলের রাজ্যে হাতের বিচরণ চললো আর চোখে-মুখে চললো ঠোঁটের রাজত্ব।
সহসা স্রোত নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমু-ঘুমু চোখে তাকাতেই আবছা-আবছা নায়ীবের অবয়ব নজরে এল। গরম নিঃশ্বাস তখন চোখ-মুখে আছড়ে পড়ছে। চোখ দু’টো কচলে স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকাতেই নায়ীব ধপ করে মাথা ফেলল বালিশের ওপর। বলল,
“ শুভ সকাল,মিসেস।”

স্রোত গাঢ় চোখে তাকালো। বুঝতে সময় লাগলো, সে এখন কোথায়। একে একে তার সবই মানসপটে ভাসলো। ওমনি মুখখানি লজ্জা রাঙা হলো। নায়ীব কোণা চোখে তাকিয়ে লক্ষ্য করল তা। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ এখনও এতো লজ্জা কিসের?”

স্রোত মুখ ফেরালো। অদ্ভুত অসহনীয় ব্যথায় নড়চড় করাও দায় যেন। গায়ে এলোমেলো শাড়ি। নির্লজ্জ লোক কথা রাখেনি। শাড়িটা ঠিক করে দেয়া তো দূর..উলটো আরো উলোটপালোট করে দিয়েছে।
তন্মধ্যে নায়ীব উঠে পড়ে। বলে,
“ ঘুম পুরো হয়েছে? নাকি আরো ঘুমাবেন?”
“ ক’টা বাজে?”
“ বেশি না, মাত্র সাতটা বিশ। ঘুমাবেন? ঘুমান।”

প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা ছাড়াই নায়ীব ত্রস্ত পায়ে হেঁটে চলে যায় ওয়াশরুমে। স্রোত হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে। ঘুম পাচ্ছে, তবে এখন ঘুমালে উঠতে নির্ঘাত নয়-দশটা বাজবে। নায়ীব বেরোনোর আগেই ও উঠে দাঁড়ালো। লাগেজ থেকে টাওয়াল বের করলো। পিঠের ওপর আছড়ে পড়া চুলগুলো হাতখোঁপা করে দাঁড়াল। নায়ীব বেরোতেই সোজা ঢুকলো ওয়াশরুমে।

..

শাড়ির আঁচল কাঁধে তুলে বেরোতেই বিছানায় বসা নিশাতকে নজরে এলো স্রোতের। নিশাত চমৎকারভাবে হাসলো। জিজ্ঞেস করল,
“ গুড মর্নিং, ভাবী! ঘুম কেমন হলো?”
স্রোত থমকালো। নিশাত ফের প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ নতুন জায়গায় ঘুম এসেছে?”
স্রোত হাঁফ ছেড়ে সম্মতি দেয়। নিশাতের দিকে এগোতেই পায়ে শাড়ি বাজে। নিশাত চট করে ধরে ফেলে তার এক হাত। কুঁচির অবস্থা বেহাল। নিশাত তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন রাখে,
“ শাড়ি সামলাতে পারোনা তুমি?”
“ ওই একটু আধটু। কখনো পরা হয়নি।”
স্রোত পা দুলিয়ে বিছানায় বসে। তন্মধ্যে দেখা মিলে নায়ীবের। ব্যস্ত পায়ে সে রুমে ঢুকছে। পরপরই রাবেয়ার আগমন। হাতে ট্রে ভর্তি নাশতা। ছোট্ট টেবিলের ওপর সেগুলো রেখে তিনি একপলক স্রোতকে পরখ করলেন। মেয়েটাকে তো চেনা চেনা লাগছে তার! রাবেয়া ভাবুক হয়ে বেরিয়ে গেলেন। নিশাত উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“নাশতা খেয়ে নাও, ভাবী। পার্লার থেকে মানুষ আসবে দশটার দিকে। রেডি হতে হবে।”

নিশাত বেরোতেই দরজা চাপালো নায়ীব। স্রোত জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করে,
“ এই সকালে দরজা আটকালেন কেনো? খুলুন..”
“ দরজা উদাম খোলা রাখবো কেন? নতুন জামাই-বউ এখন একসঙ্গে সময় কাটাবে। কেউ ঢুকে পড়লে?”
“ সময় কাটাবে আবার কি? নাশতাই তো খাবো।”
“ শুধু নাশতা?” নায়ীবের চোখ-মুখে দুষ্টু হাসি। সেই দুষ্টুমি চোখে পড়লোনা স্রোতের। বড়-বড় চোখে তাকিয়ে, সিরিয়াস ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলে সে,
“ খবরদার, কাছে আসবেন না। সবসময় শুধু অস-ভ্যতামি।”
নায়ীব হো হো করে হাসলো। কাছ ঘেষে বসার আগেই লাফিয়ে অন্যমাথায় গিয়ে বসে স্রোত।
..

ওয়াহিদ এসেছে। বৌভাতের আয়োজন করা হয়েছে বিশাল এই কমিউনিটি সেন্টারে। ওয়াহিদ মূলত এসেছে অন্য মতলবে। বৌভাত খেয়ে সে কি করবে? বৌয়ের ভাত বৌ খাক!
ও ব্যস্ত পায়ে পায়চারি করছে। দুপুর দেড়টা বাজে। এত মানুষের আনাগোনা! তবে কোথাও কাঙ্ক্ষিত মানুষটার দেখা নেই। ও পায়চারি করার ক্ষণেই সামনে গাড়ি থামলো। বড্ড আগ্রহ নিয়ে তাকাল ওয়াহিদ। ওমনি অস্থির চিত্ত শান্ত হলো তার। নিশাত গাড়ি থেকে ছোট-ছোট পায়ে নেমে একটু সরে দাঁড়াল। মুডটা তার বেজায় খারাপ। মেজাজ বিগড়ানো বেশ। খোলা চুলগুলো জ্বালাচ্ছে খুব।

ও এদিক-ওদিক চাইলো। অকস্মাৎ ভূত দেখার মত চমকে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই সে উৎফুল্ল চিত্তে এগিয়ে গেল।
ওয়াহিদ ওকে আসতে দেখে ভড়কে গেল। আশ্চর্য! মেয়েটা নিজ থেকে এগিয়ে আসছে? একদিনে কত শক খাবে সে? এমনিতেই মেয়েটার এই রুপে সে কুপোকাত। মেয়েটার পরনে মেজেন্টা রঙের একটা ড্রেস। চেহারায় অল্প প্রসাধনীর ছোঁয়া। পাতলা চুলগুলো পিঠ ছেঁড়ে কোমরের কাছটায় পৌঁছেছে। মেয়েটার চুল এত লম্বা? আগে তো খেয়াল করেনি ওয়াহিদ। ও হাঁসফাঁস করে উঠল। অস্থির চোখে পরখ করল নিশাতকে। নিশাত এসে থামলো ঠিক সামনে, মুখোমুখি। মধ্যিখানে বড়জোর একহাত দূরত্ব। আশেপাশের মানুষের তোয়াক্কা নেই তার। নিজের মত হাত নাড়িয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ আপনি এসেছেন?”
চুড়ির রিনঝিন আওয়াজ কানে তীরের মত বিঁধলো ওয়াহিদের। মন্ত্রমুগ্ধের মত সে জবাব দিল,
“ হ..হু..”
“ খুশি হয়েছি। ভেতরে আসুন। ভাইয়া-ভাবী রাস্তায়। ভাবীর সাজতে একটু দেরী হয়েছে। ওদের আসতে লেট হচ্ছে তাই।”

এই প্রথম বোধহয় নিজ থেকে এত কথা বলেছে মেয়েটা। ওয়াহিদ বিমুঢ় চেয়ে রইল। নিশাত ততক্ষণে হাঁটা ধরেছে। ভেতরে ঢোকার আগে কেবল ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। ওয়াহিদ ওমনি স্মিত হেসে হাঁটা ধরলো। মৃদু গলায় আওড়ালো,
“ তোমাকে বরাবরের মত সুন্দর লাগছে,নিশাত।”

নিশাত তখন অনেকখানি এগিয়ে গেছে। শুনেনি কিছুই। তবুও মনে হলো,ওয়াহিদ তাকে ডাকছে। ফের জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে প্রশ্ন করল,
“ কিছু বললেন?”
“ হুম? না!” ওয়াহিদ ত্বরিত মাথা নেড়ে অস্বীকার যায়।
নিশাতের দৃষ্টি তখন তার ওপর স্থির হয়। পলক ঝাপটিয়ে অনেক্ষণ দেখে ওকে। হাঁটার গতি অত্যন্ত ধীর। আজ ওয়াহিদের বেশভূষা অন্যদিনের থেকে আলাদা। কপালের চুলগুলো গোছালো, গায়ে হালকা নীল রঙের একটা পাঞ্জাবি। তার গায়ের রঙের সঙ্গে মানানসই। চোখ-মুখে অদ্ভুত মায়া ছড়াচ্ছে যেন আজ। নিশাত দ্রুত চোখ ফেরালো। ভাইয়ের মুখখানি ভাসলো দৃশ্যপটে। মুখটা ওমনি ফাঁটা বেলুনের মত চুপসে গেল।

..

স্রোত একটু পরপর লম্বা নিঃশ্বাস টানছে। শাড়ি পরলে তার একপ্রকার দমবন্ধ লাগে। হয়তো প্রথম-প্রথম বলেই। অভ্যাস হলে এমন হবেনা আর।
ও চারদিকে চোখ বুলায়। ওইতো, অদূরেই নায়ীব দাঁড়িয়ে। গায়ে ঝকঝকে স্যুট-বুট। নেভি ব্লু রঙের ব্লেজারের ভেতর সাদা শার্ট, নেভি ব্লু টাই। চুলগুলো সামায় লম্বা হয়েছে এই কয়েকদিনে। কপাল ছুঁই-ছুঁই। হাত নাড়িয়ে কারোর সঙ্গে কথা বলছে। ভীষণ ব্যস্ত তার ভঙ্গিমা। স্রোতের দিকে নজর দেয়ার ফুরসৎটুকুও বুঝি নেই?

স্রোত সামনে চোখ নেয়। তখন সেন্টারে ঢুকছেন নাবিদ সাহেব, সাঈম সাহেব,সাহিদ সাহেব। পিছু পিছু আশা, ইমাও। ও উঠে দাঁড়ালো। প্রফুল্লচিত্তে, ত্বরিত গতিতে ছুটল সেদিকে। তক্ষুনি নজর কাড়লো নায়ীবের। সে-ও গেল ওদিকে। সালাম সেড়ে টুকটাক কথা সাড়তেই নজরে এলো সাঈম সাহেবের বুকের ভেতর গুটিসুটি মেরে দাঁড়ানো স্রোতকে। নাজুক চেহারা। সাঈম সাহেব দু’হাতে আগলে ধরে রেখেছেন তাকে। বাবা-মেয়ে ফিসফিস করে কথা সাড়ছে। স্রোত মাথা তুললো এক পর্যায়ে। সাঈম সাহেব মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,
“ যাও,মায়ের সঙ্গে কথা বলো। আমি নায়ীবের সঙ্গে আলাপ সেড়ে আসছি।”

নায়ীব দাঁড়িয়ে পাশেই। সাঈম সাহেব চওড়া হাসলেন এবার। বললেন,
“ সব ঠিকঠাক আছে তো, বাবা?”
“ জ্বি,আব্বু। আপনাদের আসতে সমস্যা হয়নি তো?”
“ না,কোনো সমস্যা হয়নি।”

নায়ীব কথা সেড়ে সরে আসলো। তখন আবার সোফায় বসেছে স্রোত। গায়ে হালকা গোলাপি রঙের একটা কাতান শাড়ি তার। চেহারায় মিনিমাল মেক-আপ লুক। চুলগুলো খোঁপা করা। মাথার ওপর আবার গোলাপি একটা ওড়নাও আটকানো। পাশেই আশা হাত ধরে দাঁড়িয়ে। একটু পরপর ঝুঁকে কি যেন বলছেন। নায়ীব লম্বা দুই কদমে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। আশার উদ্দেশ্যে বলল,
“ বসুন না, আম্মু..”
নায়ীবের গলা কাঁপলো অল্প। সে কতটা বছর পর ‘আম্মু’ শব্দটা মুখে এসেছে? বুকটা ভার হলো তার।
তবে আশা কথার পিঠে চমৎকার হাসলেন। বললেন,
“ তুমি বসো, বাবা। আমাকে খুঁজছে বোধহয় সুহাদের বাবা, আসছি আমি।”
তিনি চলে গেলেন। নায়ীব ধপ করে বসলো। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো স্রোতের দিকে। অধরের কোণায় লিপস্টিক কিঞ্চিৎ লেপ্টে গেছে। নায়ীব পকেট থেকে টিস্যু বের করল। নিজেই হাত বাড়িয়ে মুছে দিতে চাইলো। স্রোত হকচকিয়ে হাত ধরে আটকালো। হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ আরে! করছেন কি?”
“ লিপস্টিক লেপ্টে গেছে,স্রোত। সেটাই মুছতে গেছি। আর কিছুনা।” হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে নায়ীব। টিস্যুটা বাড়িয়ে দেয়। স্রোত টিস্যু হাতে নিয়ে লজ্জায় মিইয়ে যায়।

“ ওটা ওয়াহিদ না?” নিজে নিজেই আওড়ায় স্রোত। এরপর মৃদু স্বরে চেঁচায়,
“ এ্যাই, ওয়াহিদ?”
ওয়াহিদ একা এলোনা। সঙ্গে এলো শুভ্রাও। সে শুভ্রার সাথে কথা বলছিল এতক্ষণ। স্রোতের ডাক উপেক্ষা করলোনা। দ্রুত কদমে হেঁটে এল। স্রোতকে জবাব দেয়ার আগে নায়ীবের দিকে চাইলো। কাঠিন্যতায় ঘেরা মানুষটার মুখের আদল পরখ করেই দম নিলো ওয়াহিদ। সাংঘাতিক জহুরি চাহনি! ও হাত বাড়ালো হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে। স্মিত হেসে বলল,
“ হ্যালো..দু লা ভা ই! আমি ওয়াহিদ, স্রোতের ক্লাসমেট।”
নায়ীব অল্প হাসার চেষ্টা করল। হ্যান্ডশেক করে সোজা হয়ে বসলো। ওয়াহিদ,শুভ্রা; স্রোতের সঙ্গে টুকটাক কথা সেড়ে সরে গেল। তার কাজ শেষ। এসেছেই মূলত নায়ীবের সঙ্গে একটিবার দেখা করতে।
ও আর শুভ্রা যেতেই নায়ীবের কাটকাট চেহারার দিকে ফিরে চাইলো স্রোত। ওমনি নায়ীব প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ ওয়াহিদের কথা তো কখনো বলেন নি।”
“ কি বলবো? ও তো আমার বন্ধুও নয়। শুধু ক্লাসমেট। আর একাডেমিক রাইভাল বলা যায়।”
নায়ীব ফিরে চায়,
“ যা-ই হোক, বলা উচিত ছিল না?”
“ আশ্চর্য! আপনি জেলাস হচ্ছেন?” স্রোত হেসে ফেলে। ওমনি কোমরে শক্ত হাতের ছোঁয়ায় হাসি গিলে ফেলে। অসহায় মুখে তাকাতেই নায়ীব এবার চওড়া হাসে। কানে কানে কিছু একটা বলতেই লজ্জায় গুটিয়ে যায় স্রোত।

“ আসসালামু আলাইকুম,স্যার-ম্যাডাম। বিবাহিত জীবনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা, স্যার!”
জিহাদ লম্বা সালাম দিল। তার মুখে চকচকে এক হাসি। পাশেই দাঁড়ানো তার স্ত্রীও। নায়ীব হাসলো। সালামের জবাব নিয়ে বললো,
“ এত দেরী কেনো হলো তোমার, জিহাদ?”
জিহাদ আড়চোখে নিজের স্ত্রীর দিকে চাইলো। সে কীভাবে বলবে এই নারী ঘন্টা দু’এক লাগিয়ে সাঁজগোজ শেষ করেছে? সে তাই হেসে হেসে মিথ্যে বলল,
“ ওই আরকি,স্যার। শার্ট প্যান্ট পরতে ঘন্টা দু’এক লেগে গেছে।”

নায়ীবের ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেল। স্রোত গোল-গোল চোখে তাকালো। চোখে-মুখে অসীম কৌতুহল। শার্ট প্যান্ট পরতে এত সময় লাগে? তাদের এ চাহনি দেখে ঘাবড়ে গেল জিহাদ। তার চেয়েও বেশি ঘাবড়ালো, যখন দেখল স্ত্রী তার রণচণ্ডী রুপ ধারণ করেছে। খুশি-খুশি মুখটা তার নিমিষেই চুপসে গেল। তার স্ত্রী হনহনিয়ে চলে গেল অন্য পাশে। জিহাদ হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ে। পুনরায় বলে,
“ আপনার বিবাহিত জীবন সুখের হোক, স্যার।”

“ তোমারো।” চাপা হাসে নায়ীব। চট করে ফের প্রশ্ন রাখে,
“ তুমি না লেকচার দিয়েছিলে, লাভ ম্যারেজে অনেক মজা? সিংগেল লাইফ থেকে ফার বেটার?”
জিহাদের চুপসানো মুখটা আরো চুপসে গেলো। বড্ড আফসোসের স্বরে বলল,
“ হ্যাঁ, স্যার। দেখতেই তো পেলেন কত বেটার!”

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৪০

নিস্তব্ধ রজনী। বারান্দায় একটা টুল পাতিয়ে বসেছে স্রোত। ঠান্ডা বাতাস শরীর নাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। স্রোতের ভয়ানক মন খারাপ। সেজন্য সে এই খোলা জায়গাটায় বসে আছে। চারপাশে বিশাল বাউন্ডারি দেয়া আছে বলে বারান্দাগুলোয় গ্রিল নেই। চো-র-টোর আসার সম্ভবনা একদমই নেই। নায়ীবের বারান্দাটা থেকে বিল্ডিং-এর পেছনের দিকটা দেখা যায়। একটু দূরেই আরো কয়েকটা বিল্ডিং।
স্রোতের দৃঢ় দৃষ্টি শুণ্যে। গতকালের চেয়ে আজ সে বেশি কেঁদেছে। স্বাভাবিক ব্যাপারই তো। এই স্বাভাবিক ব্যাপার নিয়েও গাড়িতে প্রথমবারের মত অস্বাভাবিক এক ধমক দিয়েছে নায়ীব।

নায়ীব রুমে ঢুকলো ব্যস্ত পায়ে। দরজা আটকে এরপর পুরো রুমে ব্যগ্র দৃষ্টি ঘুরপাক খায় তার। খালি ঘরটা দেখে আপনা-আপনি ললাটে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পড়ে। বিছানার সামনের অংশে এখনো ক’টা কাঁচা,ম-রা ফুল পড়ে আছে। তবে অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছে।
সে তন্মধ্যে চোখ নেয় বারান্দার দিকে। দরজাটা ভিড়িয়ে রাখা। বোঝা দায় সেখানে কেউ আছে কিনা। সন্দিহান মন নিয়েই সে সেদিকে এগুলো।
দরজা ধরাম করে খুলতেই প্রাণটা লাফিয়ে উঠল স্রোতের। ডান পাশে তাকিয়েই তার মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে। মুখ ফিরিয়ে, হাত গুটিয়ে বসে সে। হেলদোল নেই দেখে অবাক হলো নায়ীব। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে কাছটায় দাঁড়াল। হাঁটার তালে তালেই কয়েকদফা শীতল বাতাস গায়ে ধাক্কা খেল। এই হাড়কাঁপানো শীতে মেয়েটা বাইরে বসে আছে? কপালে আরো স্পষ্ট ভাঁজ পড়ে তার। দাঁতে দাঁত পিষে শুধায়,
“ এখানে কি করছেন? ঘরে বসার জায়গা নেই?”
“ না নেই।”

আচমকাই নায়ীব শান্ত হয়। হাঁটু ভাঁজ করে বসে। হাত দু’টো টেনে বুকের পাশটায় আটকায়। নরম গলায় বলে,
“ এত কান্নাকাটি আমার ভালো লাগেনা, স্রোত। বিশেষ করে আপনার। এত দুঃখ কিসের আপনার? আমি আছি না? আব্বু-আম্মুর কথা মনে পড়লে আমি নিয়ে যাব। নাহয় উনারা আসবেন। তাও কান্না করবেন না,প্লিজ।”

নতজানু স্রোত একপল চোখ তুলে তাকায়। টের পায়, মন খারাপের বাতাস আর তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছেনা। বরং তার সুখ-সুখ অনুভূত হচ্ছে। নায়ীব হাত বাড়িয়ে মুখটা উঁচিয়ে ধরে। খসখসে হাতের আজলায় মুখ পুড়ে শব্দ করে চুমু খায় কপালে। এরপরই সরে। আদেশের সুরে বলে,
“ উঠুন..”
স্রোতের এখানে বসে থাকতেই বেশি ভালো লাগছিল। তবুও সে কথা অমান্য করলনা।
সে উঠতেই নায়ীব বসে টুলটায়। স্রোত চমকে তাকানোর আগেই তাকে টেনে বসায় কোলের ওপর। গ্রীবা দেশে চলে তখন অবাধ ঠোঁটের বিচরণ। স্রোতের দৃষ্টি স্থির আকাশের অর্ধেক চাঁদের ওপর। নায়ীব থুতনি ঠেকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে,
“ আকাশে অর্ধেক চন্দ্র,বাকি অর্ধেক আমার কোলে।”

..

নিশাত মিষ্টিকে নিয়ে লাইব্রেরীতে এসেছিল। পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিয়েছে। অথচ সে বেশ কয়েকটা বই কিনেনি। সেগুলো কিনে আবার পড়ে শেষ করতে হবে। নিশাত পড়াশোনায় অলস হয়ে গেছে। পড়াশোনা করতে তার এখন ভালো লাগেনা। মনে হয়, একটা বিয়ে-শাদি করে সংসার পাতানো এর চেয়ে ঢের ভালো। কিন্তু তাদের পরিবারে এমন রীতি চলেনা। বিয়ের পরেও পড়াশোনা-সংসার; সবই সমানতালে চালিয়ে যেতে হয়। তাতে দুনিয়া উল্টে গেলে উলটে যাক। সে ভাবীকে দেখে ভীষণ অবাক হয়। এইযে! বিয়ের ক’দিনই বা পেরোলো? বই-পুস্তকে তার ঘর ভর্তি। সে বড্ড আফসোস করে, সে-ও যদি এমন মনোযোগী হতো!
নিশাত আনমনে হাই তুলে। একটা চেয়ারে আধ ঘন্টা ধরে সে বসা। সামনে একটা বই মেলে রাখা বেহুদাই। মিষ্টি শব্দ করে সেটা বন্ধ করে। সঙ্গে সঙ্গে চোরা চোখে একবার আশপাশ পরখ করে। লাইব্রেরীতে উচ্চশব্দ করা নিষেধ। কাউকে না দেখে, ও টেবিলে হাত দিয়ে ভর রাখে। অকস্মাৎই প্রশ্ন করে,
“ এ্যাই, নিশাত! ওয়াহিদ ভাইকে তোর কেমন লাগে?”

নিশাত পুনরায় হাই তুলতে গেছিল। অথচ মিষ্টির কথা শুনে তার ঘুমের চৌদ্দগোষ্ঠী অব্দি লেজ গুটিয়ে পালালো। বিস্ফো’রিত নেত্রে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল ও। আতঙ্কিত গলায় পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ এসব কি জিজ্ঞেস করছিস?”
“ এমন ভয় পাচ্ছিস কেন? ভালো লাগতেই পারে। সেটা স্বীকার করতে দোষ কী?”
“ তোকে কখন বললাম, ওই ছেলেকে আমার ভালো লাগে?” তেজী কণ্ঠ নিশাতের। মিষ্টি অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে পুনরায় প্রশ্ন করে,
“ তাহলে বলছিস পছন্দ করিস না? অপছন্দ করিস?”
“ আশ্চর্য! সেটা কখন বললাম?” নিশাত চোখ সরায়। চেহারায় আড়ষ্টতা। মিষ্টি কথা ধরে,
“ কিছুই তো বলছিস না। কি ধরে নেব?”
“ ভালোও লাগেনা, খারাপও লাগেনা।”
“ ওহ..” ছোট্ট জবাবে এ প্রসঙ্গের ইতি টানলো মিষ্টি। যা জানার জেনে গেছে। ওয়াহিদ ছেলেটা গতকাল থেকে তাকে পেরেশানির ওপর রেখেছে। এবার খবর পা-চার করে যদি একটু স্বস্তি মিলে!

..

মেহমান সব চলে গেছেন। বাড়িতে কেবল বাড়তি মানুষ বলতে, নায়মা। তিনিও আগামীকাল চলে যাবেন। তার সঙ্গে স্রোতের সম্পর্কটা একটু অন্যরকম। ভদ্রমহিলা স্রোতকে পছন্দ করেন নাকি অপছন্দ তা স্রোত ঠিক ঠাহর করতে পারছেনা। এইতো সকালে উনি রুমে হাজির হলেন স্রোতের শাশুড়ীর দু’টো স্বর্ণের চুড়ি, নাকের দুল নিয়ে। বালা দু’টো তাকে বেশ সমাদরে পরিয়ে দেয়ার পরপরই তার ভাবমূর্তি পালটে গেল। স্রোতের নাক ফুঁড়ানো নেই। কান ফুঁড়াতেই স্রোতের হয়েছিল যত জ্বালা! আর নাক? তা দেখেই তিনি নাক-মুখ কুঁচকে একাকার করে ফেললেন। নাকের সেই ছোট্ট সুন্দর দুলটা তাই আর পরা হলোনা স্রোতের। সে সেটা সযত্নে আলমারির ড্রয়ারে রেখে দিয়েছে।

রান্নাঘরে রাবেয়ার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্রোত। সকালের নাশতার পর্ব শেষ। দুপুরের রান্নার আয়োজন করার পালা এবার। রাবেয়া সব কাটাকুটি করে রান্না চাপাতে যাবেন, তক্ষুনি স্রোত বাঁধ সাধলো। আমতা-আমতা মুখে, ভীষণ অনুনয়ের স্বরে বলল,
“ আমি রান্না করি, আন্টি? আপনি শুধু সাহায্য করবেন।”
রাবেয়া তার কথার বিপরীতে বড় করে হাসলেন। নায়ীব বাবার বউ তার মতোই। কি ভীষণ মিষ্টি করে কথা বলে। এত ভালোমানুষি আজকাল সচোক্ষে দেখা অসম্ভব প্রায়। রাবেয়া প্রফুল্লচিত্তে সরে দাঁড়ালেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“ রান্ধেন,মা। আমার সমস্যা নাই। আমি পাশে দাঁড়াই। কিছু লাগলে দেখাই দিব।”

..

নায়ীব সকাল সকাল বেরিয়েছিল এক গোপন কাজে। কাজটা অবশ্য গোপনও বলা যায়না। সে বেরিয়েছিল সিগা রেট কিনতে। এই নে-শাটা ছাড়া অসম্ভব প্রায়। তবে পরিমাণটা ক্রমশ কমিয়ে আনছে নায়ীব। সে ঘরে ঢুকলো চুইংগাম চিবোতে চিবোতে। খালি বিছানায় বসে আরাম করে। পকেট থেকে আরো দু’টো চুইংগাম বের করে রাখে ছোট্ট ড্রয়ারের ওপরের অংশে। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। স্রোত গোসলে। ও বেরোলেই নায়ীব ঢুকবে।
ঘর-দোরের ছবি-সুরত সম্পূর্ণ পালটে গেছে যেন। আলমারিতে এখন নায়ীবের শার্টের পাশাপাশি শাড়ি,ড্রেসের অবস্থান। ঘরজুড়ে মেয়েলি এক সুভাস। এখন মাঝেমধ্যে শার্টে চুল-টুলও পায় নায়ীব। অবাক হয়না সে। ঘরে বউ আছে, এসব তো সেটারই লক্ষণ।

স্রোত বেরোয় আস্তে-ধীরে। গায়ে তার সদ্য ভাঁজ ভাঙা একটা সবুজ রঙের সুতি শাড়ি। বেশ খানিকটা ভিজেই গেছে৷ মাথায় বড়-সড় একটা তোয়ালে। ও একহাতে, আনাড়ি ভাবে আকড়ে ধরে রেখেছে তা। অন্যহাতে ভেজা কাপড়। চোখ তুলে নায়ীবকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ক্ষীণ চমকালো। চমকিত গলায়ই শুধালো,
“ কোথায় গেছিলেন আপনি? আর কখনই বা এলেন?”
“ একটু দরকারে বের হয়েছিলাম।”

স্রোত দ্রুত পা বাড়িয়ে কাপড় মেলে আসে। বারান্দাটায় ভালোই রোদ থাকে। গোসল সেড়ে বসে থাকতে আরাম-আরাম লাগে। তবে সে বসলোনা। মাথার তোয়ালেটাও খুলে রুমে চলে এলো। নায়ীবের চুইংগাম চিবোনো তখন শেষ। সেটা বিনে ফেলে সে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। স্রোত তীক্ষ্ণ চোখে খেয়াল করে তা। কণ্ঠে সন্দেহ ঢেলে শুধাল,
“ কি খাচ্ছিলেন?”
“ চুইংগাম,স্রোত। খাবেন? ড্রয়ারের ওপর রাখা আছে।” নায়ীব অল্প হাসে। সিগা-রেট জিনিসটা বেশিরভাগ মেয়ে মানুষেরই অপছন্দের। সে লিস্টে স্রোতও আছে,জানে নায়ীব।

“ চুইংগাম খাওয়ার আগে একটা সিগা-রেট পেলে ভালো হতো। সেটা খেলে চুইংগামের স্বাদ এরপর দ্বিগুণ বেড়ে যায়, তাইনা?”
স্রোত আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে আয়নার প্রতিবিম্বের মধ্যেই নায়ীবকে নজরে রাখে। তার রঙ উড়ে যাওয়া ফ্যাকাশে, গম্ভীর মুখটা দেখে তারও চোখ-মুখ শক্ত হয়।
নায়ীব নিরস মুখে বলে,
“ আমি কমই খাই,স্রোত।”
“ সেজন্যই তো দোকান থেকে আস্ত প্যাকেট কিনেন।”
নায়ীব কথার পিঠে মৌন রইল। হঠাৎ দূরত্ব ঘুঁচালো। মেয়েটাকেও টেনে কাছে আনলো। দু’হাতে পেছনে থেকে ঝাপটে ধরতেই স্রোত তেঁতে উঠল,
“ ইশ! গন্ধ আসছে! সরুন, নায়ীব! সরুন!”
নায়ীব ভোঁতা মুখে তৎক্ষনাৎ সরে গেল। একবার শার্ট শুঁকে গেল, সত্যিই তীব্র গন্ধ আসছে সিগা-রেটের। স্রোত র-ক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল। ভেজা চুল আঁচড়ে, হনহনিয়ে বেরোনোর আগে কেবল বলে গেল,
“ খবরদার, গোসল না করে একদম কাছ ঘেঁষবেন না।”
ও বেরিয়ে যেতেই নিরস মুখে গোসলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় নায়ীব। জিহাদ বেচারাকে তিরষ্কার করা ঠিক হয়নি। সেও ধীরে-ধীরে একই নৌকার মাঝি হবে।
আজ থেকে সিগা-রেটকে সে তার জাত শ-ত্রু ঘোষণা করলো!

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৪১

“ আজকের রান্নাটা কিন্তু ভাবী করেছে।”
নিশাত বসতে বসতে বললো। নায়ীব চমকালো বেশ। পাশে বসা স্রোতের কাছটায় মুখ নিয়ে ফিসফিস করে অবাক স্বরে শুধাল,
“ আপনি রান্নাও করতে জানেন?”
মুখটা পিছিয়ে নিলো স্রোত। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেল সহসা। তরকারির বাটি এগিয়ে আনতে আনতে ছোট্ট করে জবাব দিল,
“ হুম।”

নায়ীব হম্বিতম্বি করে উঠল। পুনরায় ফিসফিসালো,
“ এখনও গন্ধ আসছে নাকি? আমি তো মাত্রই ব্রাশ করে আসলাম।”
“ আসছেনা।” ওর জবাবে প্রসন্ন চিত্তে সোজা হয়ে বসলো নায়ীব। নাবিদ সাহেব এসে বসলেন ধীরে-সুস্থে। টেবিলে হরেকপদের তরকারি সাজানো। বসেই তিনি প্রশ্ন করলেন,
“ রান্নাটা কে করেছে, রাবেয়া? তরকারির ছবি-সুরত দেখে তো তোমার রান্নার মতো লাগছেনা।”
পাশে দাঁড়ানো রাবেয়া জবাব দেয়ার পূর্বেই স্রোত স্মিত হেসে বলল,
“ আমি রেঁধেছি,আব্বু। খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে!”

নায়মা চেয়ার টেনে বসতে বসতে অবাক হওয়ায় ভঙ্গিতে ভ্রু কপালে তুললেন,
“ রান্না জানো তুমি? যাক,বাঁচা গেল।”

স্রোতের হাসি-হাসি মুখটা অকস্মাৎই নিভে এল। তবুও খুশ মেজাজে সে অপেক্ষা করলো সবার প্রতিক্রিয়ার। নায়ীব পাতে ভাত তুলতে তুলতে দাম্ভিক গলায় বলল,
“ রান্না-বান্না সামলানোর জন্য রাবেয়া খালা আছেন, এ নিয়ে বাড়তি চিন্তার প্রয়োজন নেই। খালা একাই একশো,তাইনা খালা?”
রাবেয়া দ্রুত হেসে মাথা নাড়েন। বলেন,
“ জ্বি,বাবা।”

ও মাংস পাতে তুলে। এক লোকমা খেয়ে আড়চোখে তাকায় স্রোতের দিকে। সেও চোরা চোখ তাকাচ্ছিল। চোখা-চোখি হতেই নজর সরিয়ে ফেলল। সবাই প্রশংসা করার পূর্বেই ও কণ্ঠ অতিমাত্রায় নিচু করে বলল,
“ মজা হয়েছে।”

……

দরজাটা ভিড়িয়ে ঘরে ঢুকলো নায়ীব। ভেজা চুলে হাত নাড়াতে-নাড়াতে সামনে চাইলো। বিছানার একপাশে স্রোত কম্বলমুড়ি দিয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। চোখ-টোখ বুঁজে রাখা। ঘুমের ভাণ ধরেছে। নায়ীব দুষ্টু হাসলো। দ্রুত গতিতে কম্বলের নিচে ঢুকে গেল। ওমনি নড়েচড়ে উঠলো স্রোত। তবুও চোখ বুঁজে পড়ে রইল। পরনের শাড়িটাও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ও একদম ধীরে-ধীরে শাড়ি ঠিক করে ঘুমানোর ভাণ ধরে থাকল। নায়ীব একধ্যানে চেয়ে তার মুখের দিকে। চোখের পাতা অল্প-সল্প কাঁপছে। শ্বাস নিচ্ছে ঘনঘন। পেটের ওপর আচমকাই ঠান্ডা হাতের স্পর্শে শিউরে উঠে স্রোত। চোখ ফট করে খুলে সে বলে,
“ আল্লাহ! এত ঠান্ডা কেন হাত? সরান!”

নায়ীব আরেকটু কাছ ঘেঁষলো। ঠোঁটে এখনো দুষ্টুমির হাসি। তার ভালো লাগছে মেয়েটাকে জ্বালাতে। ও নাক ঘষে স্রোতের গলায়। স্রোত সহসাই খাম-চে ধরে ওর হাত। ওমনি নায়ীব ভ্রু কুঁচকায়,
“ নখ কাটেননা?”
“ কাটি। সরুন, সুরসুরি লাগছে।”
বলতে দেরী অথচ সুরসুরি দিতে দেরি নেই। স্রোত হেসে সরতে চায়,
“ ছাড়ুন না, নায়ীব। সত্যিই সুরসুরি লাগছে!”

নায়ীব থামলো। নিগূঢ় দৃষ্টিতে অনেক্ষণ পরখ করল। মুখ তুলে অধরে অধর ছুঁয়ালো হঠাৎ। স্রোত লজ্জায় মিইয়ে গেল। ওর লজ্জায় লাল হওয়া গাল দু’টোয়ও টুপ করে চুমু খেল নায়ীব। এরপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। স্রোত ওর বুকে মাথা রাখে। নায়ীব ধীর গলায় বলে,
“ স্রোত..”
“ হু?”
“ ভালোবাসি।”
“ আমিও।”
স্রোতের কথা শেষ হতে না হতেই বাইরে থেকে আওয়াজ হাঁকডাক,
“ ভাবী, ভাবী!”
স্রোত হকচকিয়ে উঠে বসে। নায়ীব চোখ বুজে। বিরক্তি ধরা গলায় বলে,
“ রোম্যান্সের শুরুই করতে দিলনা।”
স্রোত চোখ রাঙিয়ে তাকায়,
“ এসেছিলাম একটা শান্তির ঘুম দিব বলে। তাতেও ব্যাগড়া দিলেন।”
মেয়েটা মুখ বাঁকিয়ে উঠে গেল। নায়ীব চট করে চোখ খুলে।
দরজা খুলতেই নিশাতকে দেখে স্রোত। তার পিছনে জোহাও। মুখে বিস্তর হাসি। স্রোতকে নতুন রুপে দেখে সে ভীষণ খুশি। তার মা তো বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে স্রোতের সঙ্গে নায়ীবের বিয়ে হয়েছে।
স্রোত সরে দাঁড়ালো। বলল,
“ ভেতরে আসো..”

জোহা,নিশাত ঢুকলো ধীর পায়ে। নায়ীব ততক্ষণে উঠে বসেছে আওয়াজ শুনে। কম্বলটাও একপাশে কোনোমতে গুটিয়ে রেখেছে। ও একপল জোহার দিকে তাকাতেই সে বড় করে হাসলো। প্রশ্ন করল,
“ কেমন আছেন, ভাইয়া?”
“ ভালো আছি। তুমি?”
“ আমিও।”
“ বসো, গল্প করো তোমরা। আসছি আমি।”
বলেই সে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল। বিছানায় পা দুলিয়ে বসে জোহা। সে বিয়েতে যায়নি। বৌভাতে গেছিল বাবার সাথে। তবে বেশিক্ষণ থাকেনি।
স্রোত চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতে বলল,
“ সবার আগে বিয়ের দাওয়াত চাইলে কিন্তু বিয়েতে এলেনা।”
“ মা আর যেতে দিল কই, আপু। নাহলে আমার আগে থেকেই খুব শখ ছিল ভাইয়া আর আপনার বিয়ে খাবো।” হা হুতাশের ভঙ্গিতে বলে উঠে জোহা। নিশাত হকচকায়। এই মেয়ে তো বেফাঁস কথা ফাঁ-স করার ক্ষেত্রে ওস্তাদ! ও দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
“ সেসব ছাড়ো। এখন কি খাবে বলো?”

স্রোত মাথা নাড়ে,
“ বলো, জোহা। আমি বানিয়ে আনছি। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস না তোমার প্রিয়?”

জোহা তড়িঘড়ি করে ডানে-বামে মাথা ঘুরায়,
“ কিছুই খাবোনা।”
স্রোত ছোট-ছোট চোখে তাকায়,
“ লজ্জা পাচ্ছো কেনো আমার সামনে? যাইহোক, তোমার রেজাল্ট দিয়েছে?”

জোহার চেহারায় উদয় হওয়া খুশির ঝলক সাথে সাথেই উধাও। সে বিষন্ন মুখে নিশাতের দিকে তাকায়। নিশাত কাঁধ উঁচিয়ে বুঝায়, তার কিচ্ছুটি করার নেই। জোহা ঠোঁট উলটে বলে,
“ দিয়েছে আপু।”
“ বাহ! বাংলা ২য় পত্রে কতো উঠেছে?”
“ ৭০।”
“ বাকি ত্রিশ কোথায়?”
জোহা বড়-সড় দম নেয়। বলে,
“ কলমের কালি শেষ হয়ে যাওয়ায় লিখতে পারিনি।” নিশাত হো-হো করে হেসে উঠল। বলল,
“ পুরনো নাটকের ডায়লগ কেনো দিচ্ছো, জোহা! এগুলো বিশ্বাসযোগ্য?”
স্রোত হাসে। রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।
ও যেতেই জোহা বলে,
“ স্রোত আপুর তো বিয়ে শেষ। আপনারটা কবে?”
নিশাত হতবিহ্বল চোখে তাকায়। লজ্জা পেয়ে বলে,
“ যাহ! আমার বিয়ে এখন কেন হবে!”

..

আজ চেয়ারম্যান বাড়িতে রমরমা পরিবেশ। নতুন মেয়ের জামাই আসবে। বিয়ের মত এখনও হৈ-হুল্লোড় বিরাজমান। তিন্নিরা থেকে গেছে। জামাই-আদর শেষ করে ওরা যাবে।
স্রোতদের আসার কথা দুপুরের আগে। অথচ ওরা বাড়ি এলো দ্বিপ্রহরের শেষের দিকে। বাড়ির দুয়ারে প্রতিটা মানুষ দাঁড়িয়ে। স্রোত বড়বড় কদমে এগিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঈম সাহেবের বুকে। আগে তো এত টান অনুভূত হতোনা এই বুকে মাথা রাখার জন্য!
সাঈম সাহেব ওকে একপাশে জড়িয়ে ধরলেন। ইনান,ইফাদ ছুটে গেছে ব্যাগ আনতে। নায়ীব ধীর পায়ে পাশে এলো। সালাম সাড়তেই সাঈম সাহেব হাত বাড়িয়ে একহাত দিয়ে কোলাকুলি সাড়লেন। বললেন,
“যাও, ভেতরে যাও বাবা। সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছি তোমাদের। দেরী কি কারণে হলো? সমস্যা হয়েছে রাস্তায়?”

“ জ্বি না, আব্বু। বেরোতে দেরী হয়েছে।” জবাব দিয়ে আড়চোখে তাকালো স্রোতের দিকে। আর্দ্র নেত্রে সে এদিকেই তাকিয়ে। মেয়েটা আসার আগে একশো প্রশ্নে জর্জরিত করেছে তাকে। এখানে কেবল দুই দিন থাকবে ওরা। নায়ীবের ছুটি শেষের পথে।
নায়ীব ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে। ইনান,ইফাদ এসে বসলো সামনের সোফাটায়। সুহাদ সিঁড়ির নিচে। ভীষণ ব্যক্তিগত এক কল এসেছে।

সাবিলা,আইরিন,তিন্নিও এসে হানা দিলো বসার ঘরে। কেবল নিপা আর পিয়া ছুটলো আশার ঘরে,স্রোতের কাছে। তিন্নির হাতে মিষ্টির প্লেট। নায়ীবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“ দুপুরের খাবারের আগে একটা মিষ্টি টেস্ট করে দেখুন তো, দুলাভাই।”

নায়ীব এক ভ্রু কপালে তুলে হাসলো। তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ আজকেও কিছু মিশানো হয়েছে নাকি?”

তিন্নি থতমত খেল। সঙ্গে সঙ্গে অধরের কোণ সুক্ষ্ণভাবে বেঁকে গেল তার। ইফাদ হইহই করে উঠল,
“ কি সাং!ঘাতিক! তোরা কি আগে কিছু মিশিয়েছিলি?”

তিন্নি মুখ ভেংচিয়ে বলল,
“ ওগুলো পিয়ার কাজ। আমি ওর মত বিচ্ছু নাকি? আমি একদম ফ্রেশ মিষ্টি নিয়ে এসেছি।”

নায়ীব হাসলো। মিষ্টি খেয়ে দেখল, আজকে আর শালি সাহেবারা উল্টা-পাল্টা কিছু মিশায়নি। ও হেলে বসে। ইনান হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“ বড় ভাইয়া কোথায়? ওরা আসতেই কই নাই হয়ে গেল?”
ইফাদ শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বলে,
“ পার্সোনাল ফোন এসেছে। বিজি মানুষ।”
ইনান বুঝলেও নায়ীব কথাটা ধরতে পারলোনা।

খাবার টেবিলে তখন একে একে সবকিছু সাজাচ্ছেন আশা। তন্মধ্যে তিনি বলে উঠলেন,
“ বাবা,ফ্রেশ হয়ে এসে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নাও..”

আশা আবার ইফাদকে চোখ দিয়ে ইশারা দিলেন। সে আলস্য ভঙ্গিতে কাঁধ উঁচায়। নিজে তো আশার কথা রাখলোই না। বরং ইনানকে আদেশ দিল,
“ এই ইনান,নায়ীব ভাইকে নিয়ে উপরে যা তো।”
বয়সে বড় হলেও নায়ীব সম্পর্কে তার ছোট বোনের স্বামী। ইফাদের কেমন কেমন যেন লাগে দুলাভাই ডাকতে।
ইনান উঠে দাঁড়ালো,
“ জলদি আসুন, দুলাভাই।”
নায়ীব উঠল। হাত-পা টানছে খুব। ফ্রেশ হয়ে একটা লম্বা ঘুম দিতে পারলে ভালো লাগতো। ও হাঁটা ধরল। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ইনান আচমকাই বলল,
“ দুলাভাই,সাঁতার জানেন?”
“ হ্যাঁ। ”
“ তাহলে তো ভালোই হলো। কালকে আমরা পুকুরে নেমে গোসল করবো নাহয়? সঙ্গে মাছও ধরা যাবে। পানি একদম কম।”
নায়ীব ‘না’ করতে পারলনা। কাল এলে দেখা যাবে এসব। আপাতত তার বিশ্রাম প্রয়োজন। ও কেবল আনমনে মাথা নাড়ে।

..

পরদিন। সকাল আটটা। বিছানার খালি অংশে হাত পড়তেই গভীর ঘুমটা নড়বড়ে হলো নায়ীবের। চোখ-মুখ কুঁচকে আরেকটু হাতড়িয়ে সে নিশ্চিত হলো, পাশে কেউ নেই। বিছানায় সে একা শুয়ে আছে। ঘরটা অন্ধকার। জানলাগুলোর কপাট বন্ধ,আবছা আলো আসার রাস্তাও নেই। নায়ীব ধীরে-সুস্থে উঠে বসলো। দু’একবার স্রোতের নাম ধরে ডেকেও শুণ্য ঘরটা হতে কোনো প্রত্যুত্তর ভেসে এলোনা। নায়ীব উঠে দাঁড়াল। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এসে জানলার কপাট খুলল।
এরপরই গায়ে জ্যাকেট চড়িয়ে নিচে নামলো।

সদর দরজা আর উপরে উঠার ক্ষণে কয়েকটা ছোট-ছোট সিঁড়ি আছে। সেখানেই পাঁচ রমণী গল্পের আসর জমিয়েছে। ঠিক মাঝখানটায় স্রোত বসে আছে। তার খিলখিল হাসির শব্দ কানে আসতেই পা মাঝ সিঁড়িতে থেমে যায় নায়ীবের।

“ আরে, দুলাভাই! আপনি উঠে গেছেন?”
বলতে দেরী, সমস্বরে ‘শুভ সকাল, দুলাভাই।’ বলা কয়েকটা কণ্ঠের আওয়াজ কানে ধাক্কা খেতে দেরী নেই। নায়ীব হাসলো। ‘দুলাভাই’ ডাকতে ডাকতে এরা ফেনা তুলে ফেলছে রীতিমতো। স্রোত নিশ্চুপে ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে আছে।
নায়ীব ছোট্ট করে বলল,
“ শুভ সকাল।”

স্রোত এবার উঠে দাঁড়ালো। বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল,
“ তোরা বোস, আমি আসছি।”

বলে সে ভেতরে ঢুকে। পিছু পিছু ছুটে নায়ীবও। সদর দরজা পেরিয়েই বসার ঘর। সেখানে আপাতত কেউ উপস্থিত নেই। রান্নাঘর থেকে টুকটাক শব্দ ভেসে আসছে। স্রোত ওদিকেই যাচ্ছিলো, দু’কদম এগোনোর আগেই নায়ীব হাত টেনে বাঁধা দিল। স্রোত ভ্রু নাঁচায়,
“ কি?”
“ কখন উঠেছেন?”
“ সাতটার দিকে।”
“ আমাকে ডাকলেন না কেনো?খালি বিছানা দেখে তো টেনশনে পড়ে গেছিলাম।”
“ আপনাকে ডাকলে আর উঠা লাগতোনা আমার।”
নায়ীব ততক্ষণে কাছে এসেছে। নেত্রযুগলে তখন উপচে পড়া হাসি। স্রোত লাফিয়ে সরে গেল। হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
“ কেউ এসে যাবে। যখন তখন ভালোবাসা উতলিয়ে পড়ে! ছাড়ুন!”

নায়ীব স্বেচ্ছায়ই হাত ছাড়ে। প্রাণখোলা এক হাসি এসে দখল করে বসেতার ঠোঁটের কোণে।

..

“ আপনি নাকি আজ পুকুরে গোসল করবেন?”

ডিসেম্বরের শুরু সবে। ঠান্ডার প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে। রাত হলে হাড়কাঁপানো শীত টের পাওয়া যায়। এই কনকনে ঠান্ডায়ও জোয়ান ছেলে-পেলে ব্যাটাগিরি দেখাতে পুকুরে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

স্রোতের বাঁকা স্বরের প্রশ্নে নায়ীব কেবল ছোট্ট করে বলে,
“ হুম।”
“ সাঁতার পারেন?” ফটাফট প্রশ্ন ছুঁড়ে স্রোত। তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি।
নায়ীব পুনরায় ছোট্ট করে বলে,
“ হুম।”
“ যদি ডুবে যান?”
“ আপনি এসে রেসকিউ করবেন। কি? করবেন না?” শেষ কথাটা নায়ীব ওর দিকে চেয়ে, একবার চোখ টিপ দিয়ে বলে। স্রোতের তীক্ষ্ণ নজর স্থানচ্যুত হয়। গালে হাত রেখে বলে,
“ ঠান্ডা লাগবে। কি দরকার শুধু শুধু?”
“ লাগবেনা। পুরুষ-মানুষের শরীর এত সহজে রোগ-বালাই ধরতে পারেনা।”

স্রোত একই কথা ব্যঙ্গ করে বলল। মুখ মা-রাত্মক কুঁচকে বলল,
“ ঢং! ভাইয়াদের অভ্যাস আছে এই ঠান্ডায় পুকুরে গোসল করে। আপনার আছে?”
“ আমিও শাওয়ারের ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করি।”
“ পুকুরের ঠান্ডা পানি আর শাওয়ারের ঠান্ডা পানির মধ্যে বিস্তর তফাৎ আছে,মিষ্টার।”
“ এত চিন্তা করবেন না, মিসেস।”
নায়ীব উঠে এসেছে। স্রোতের নাকে টোকা দিয়ে সরে যায়। তোয়ালে নিয়ে বেরিয়ে যায়। স্রোতের মন ঘরে টিকে না। সেও পিছু পিছু বের হয়।

..

ইনান নিজেও ঠান্ডায় কাঁপছে। তবুও ফুর্তি থামছেনা। সে চেঁচিয়ে চনমনে গলায় বলে,
“ ওইযে, মাছ। দুলাভাই ধরেন!”
নায়ীব অসহায় চোখে তাকায়। সে শুধু সাঁতার জানে বলেছে। মাছ ধরতে পারে; এটাতো বলেনি।
ঘাটের সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে বসা স্রোতসহ বাকিরা। বড্ড আগ্রহ নিয়ে পুকুরের মাঝে চলতে থাকা কান্ড দেখছে। ইফাদ-সুহাদ; সুযোগ বুঝে আগেই উঠে পড়েছে। ফ্যাসাদে পড়েছে কেবল নায়ীব। ইনান বড্ড ডানপিটে। ঘন্টা দেড় এক আগে নেমেছে। এখনও বিন্দুপরিমাণ উৎফুল্লতা কমেনি।

মাছ ধরার বৃথা চেষ্টা তাও চালিয়ে গেল নায়ীব। হাত দিয়ে আবার মাছ ধরে কীভাবে? সে জানে না। ও না পেরে এবার কাঁপতে কাঁপতে উঠে আসে। কণ্ঠে হাপিত্যেশ ঢেলে বলে,
“ ইনান, উঠে পড়ো ভাই। তোমার মাছগুলো ধরা দিতে চাইছেনা আমার হাতে।”

নায়ীব তড়িঘড়ি করে মাথা মুছলো। ঘাট থেকে একে একে সরে গেছে সবাই। স্রোত তখনও দাঁড়িয়ে,
“ ঘরে এসে চেঞ্জ করে নিন জলদি।”
“ ঘর ভিজে যাবে স্রোত। কাপড়গুলো এনে দিন, এখানেই পালটে নেই।”

তিন্নিকে পাঠিয়ে কাপড় আনালো স্রোত। এরপর ওরা সব ছুটলো দুপুরের খাবারের আয়োজন করতে। নায়ীব কাপড় পাল্টে স্বস্তি পেল। সব শালা-শালিই এক। খালি ফ্যাসাদে ফেলে।
সে ভেজা কাপড় নিয়ে চলে আসে বাড়ির ভেতর।

রাত তখন এগারোটার কাছাকাছি। স্রোত পা টিপে-টিপে ঘরে ঢুকে। সে এতক্ষণ তিন্নিদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলো। কালকে ওরাও চলে যাবে, স্রোতও চলে যাবে। আর কবে দেখা হবে কে জানে। আড্ডা-টাড্ডা সেড়ে ও চুপিচুপি রুমে ঢুকলো। ঘোর অন্ধকারে ডুবে থাকা রুমটায় মানুষের হদিস পেলনা ও। মানুষটা কি রাগ করলো? করলে করুক! স্রোত রাগ ভাঙাতে জানে। ও অন্ধকারেই আন্দাজ করে পা বাড়ায়। বিছানার কাছটায় এসে হাত বাড়ায়। ওমনি মনে হয়, কোনো অ-গ্নিপিণ্ডে তার নরম হাতখানি ছুঁয়েছে।
স্রোত হাত সরায়না। আস্তে-ধীরে হাতটা ছুঁয়ে যায় ঘুমন্ত নায়ীবের ঠোঁট-মুখ-ললাট। স্রোত তড়িঘড়ি করে লাইট অন করে। ফার্স্ট এইড বক্স বের করে সেখান থেকে ওষুধ বের করে। এরপর আবার ফিরে আসে নায়ীবের কাছে। কপাল ছুঁয়ে ডাকে,
“ নায়ীব? উঠুন। জ্বরে শরীর পুঁ-ড়ে যাচ্ছে। ওষুধ খেয়ে ঘুমাবেন, উঠুন।”
নায়ীবের ঘুম ভাঙে রয়ে-সয়ে। কিছু বুঝে উঠার আগেই মুখে ওষুধ ঢুকিয়ে দেয় স্রোত। না পারতেই পানিটুকুও গিলতে হয় তার। স্রোত ড্রিম লাইটটা অন করে আসে। এরপর বিছানার ওপাশে উঠে। নায়ীবের গভীর ঘুমটা ভেঙে গেছে। এখন আর ঘুম আসবেনা। তার আরেকটি কারন সামনে বসে থাকা রমণীটিও বটে। জ্বরের ঘোরেও নায়ীবের নে শা ধরে যাচ্ছে। ও টেনে স্রোতকে কাছে আনে। বুকের ভেতর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতেই স্রোত কঁকিয়ে উঠে,
“ জ্বর গায়েও এত শক্তি! ব্যথা পাচ্ছি তো।”
“ চুপ করে শুয়ে থাকুন স্রোত। আমার ঠান্ডা লাগছে।”
“ খুব না বলেছিলেন পুরুষ-মানুষের শরীর রোগ-বালাই সহজে ধরেনা?”
নায়ীব পূর্ণ চোখে তাকায়। তার শরীরের উত্তাপ স্রোতকেও নাজেহাল করে দিচ্ছে;সে তা স্পষ্ট টের পাচ্ছে। মেয়েটা একটু পরপর নড়ে-চড়ে উঠছে। নায়ীব দাম্ভিক কণ্ঠে ডাকে,
“ স্রোত?” দাম্ভিক সাঁজার কি নিদারুণ ব্যর্থ প্রচেষ্টা! অথচ কণ্ঠটা শুনালো ভারী দুর্বল।
“ হু?” অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় স্রোত।

“ আমার ঠান্ডা লাগছে।”
“ আরেকটা কম্ব…”
কথার শেষ হওয়ার পূর্বেই গলায় উষ্ণ নিঃশ্বাসের আছড়ে পড়া টের পায় স্রোত। নায়ীব বেসামাল। মুখ গুঁজেছে গলায়। বিড়বিড় করে কি যেন আওড়াচ্ছে। কান খাড়া করে স্রোত। নায়ীব এবার স্পষ্ট গলায় আবদারের সুর টানে,
“ একটু ভালোবাসি,স্রোত?”
স্রোত বাকরুদ্ধ হয়। নায়ীব গলায় অধর ছুঁয়ায় সহসা। কয়েক প্রহর খুঁইয়ে কথার জাল বুনে। সে জালে ফাঁ-সতে স্রোতের মিলিসেকেন্ডও লাগবেনা। নায়ীব উত্তপ্ত দম ফেলে, কণ্ঠে একসাগর মায়া ঢেলে শুধাল,
“ বাসিইইই?”

চলবে.