গোপনে_রাঙানো_প্রেম পর্ব-৪৭+৪৮

0
277

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৪৭

নায়ীব ধীরে ধীরে উঠে, হেলান দিয়ে বসলো। রুমটা অন্ধকার। গলা ধরে শুয়ে ছিল স্রোত,আপাতত বুকের ওপর আছে। আরাম করে ঘুমোচ্ছে।
অনুষ্ঠানে বেশিক্ষণ থাকেনি। চোখ-টোখ লাল দেখে সবাই বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন কি হয়েছে। স্রোত জানিয়েছে মাথা ব্যথা করছে ভীষণ। সেজন্য চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। এরপরই আশা রুমে পাঠিয়ে দিয়েছেন ওকে। দুজনের জন্যই রাতের খাবারটা আগে আগে ইমা দিয়ে গেছেন।
নায়ীব খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। গায়ের সেই সবুজ ওড়নাটা পাশেই বড্ড অবহেলায় পড়ে আছে। নায়ীব একবার ওদিকে তাকায়। ফের চোখ নিয়ে আসে স্রোতের দিকে। ড্রিম লাইটের আধো-আধো আলোয় অনেকটা স্পষ্ট দেখাচ্ছে চেহারাটা। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস নায়ীবের বুকের ওপর পড়ছে।
নায়ীব আলগোছে হাত ছাড়ায়। অক্ষিপুটে চিকচিক করছে পানি। হাত বাড়িয়ে সেটা মুছে দেয় নায়ীব। আজকের ঘটনাটা সম্পূর্ণ ভাবনার বাইরে। নায়ীব যদি না আসতো..তবে? তবে কি হতো? নায়ীব দম টানে ঘনঘন। ইহকালে সে আর বউকে একা একা কোথাও ছাড়বেনা। মনে মনে তওবা করল ও, দারুণ শিক্ষা হয়ে গেছে। আপাতত শিক্ষা দেবার পালা।

স্রোতের দুই হাতের ভাঁজে বালিশ রেখে ও উঠে পড়ে নিঃশব্দে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি আছে যে!
ও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, এদিক ওদিক খুঁজে ফোন হাতে নেয়। এরপর ঝুঁকে স্রোতের মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে যায়।

..

স্টোর রুমটা বদ্ধ ছিল এতকাল। পুরনো জিনিসপাতি গুলো গোছানো ভাবেই রাখা এখানে। এই এত এত ধুলো জমা জিনিসপত্রের মধ্যে আরেকটা জিনিসও স্থান পেয়েছে। জিনিস বললে ভুল হবে, সে আস্ত এক অ-মানুষ। দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই তার গোঙানো থেমে যায়। উঠার শক্তি অবিশিষ্ট নেই। ওইটুকু সময়েই যা মা-র খেয়েছে! পুলিশের হাত তো! এত নরম না।

ইফাদ বাল্ব জ্বা;লাতেই ছোট্ট কামরায় লালাভ আলো ছড়িয়ে যায়।
ও ব্যগ্র চোখে তাকায় মাটিতে। মাথায় এত রাগ চেপে আছে তার!
নায়ীব পিছনে দাঁড়িয়ে। দরজাটা হাত বাড়িয়ে আটকায়।
ইফাদের চোখ-মুখে ক্ষোভ ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে।
নায়ীব এর ব্যবস্থা একাই করতে পারতো। তবে আবর্জনা ফেলবে কোথায়?
ও ইফাদকে আগে আগে বলেনি কিছুই। ইফাদ স্টোররুমে এসেছিল রশি খুঁজতে। হঠাৎ দেখে তব্দা খেয়েছিল বটে। ভাগ্যিস তাকে নায়ীব খেয়াল করেছিল। নাহলে সে বাড়িভর্তি মানুষকে জানিয়ে দিতো সব। নায়ীবের থেকে সবটা শুনে ইফাদ বহু কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখেছিল। সুহাদকে জানালে সে আরো তা-ন্ডব চালাতো। কাল বিয়ে বলেই ইফাদ ওকে জানায়নি। নাহলে এই ছেলের জানাযাও হয়ে যেত এতক্ষণে।

ইফাদ ঘাড় ঘুরায়,
“ কি করবেন এই কুকুরটার?”

নায়ীব স্থির চোখে চেয়ে। ঘাড়ে এলোমেলো হাতে বুলাতে বুলাতে বলে,
“ করব কিছু একটা। আপাতত তোমার সাহায্য লাগবেনা। তুমি শুধু দেখো।”

..

বিশাল বাড়িটা নিস্তব্ধ। ভোর হলেই সবাই জেগে যাবে,তোড়জোড় শুরু হবে।
ইফাদ রুমে চলে এল। ওই আধ-ম-রা নোংরা মানবটাকে ওরা বিলের ধারে ফেলে রেখে এসেছে। মনে মনে এবার শান্তি পাচ্ছে ও। ছেলেটার নাম হাবিব। একে শহর থেকে আনা হয়েছিল লাইটিং এর কাজের জন্য। তেমন চেনেনা এখানকার কাউকে। চেয়ারম্যান বাড়ির লোকদের দাপট সম্পর্কেও সে অজ্ঞাত ছিল তাই। নাহলে তাদের মেয়ের দিকে এমন হাত বাড়াতো? স্রোত তো আর শুধু চেয়ারম্যান বাড়ির মেয়ে নয়, নায়ীব ইয়াকীনের অর্ধাঙ্গিনীও। যাকে নায়ীব নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে। তার দিকে এমন হাত বাড়ালে এত সহজে পার পাওয়া যাবে নাকি? উহু!
হাবিব হয়তো ভেবেছিল, বাড়ি খালি। মনবাসনা পূরণ করে সে চম্পট মা-রবে। ঘরে সোনা-দানা থাকলে সেসবও হাতিয়ে নিবে৷ কিচ্ছুটিই হলোনা। উল্টো হাত দু’টো খোয়াতে হলো।

নায়ীব নিঃশব্দে রুমে ঢুকে। অবসন্ন দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বেঘোরে ঘুমানো স্রোতকেও হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয়।
..

স্রোত ঘুম ভেঙে যায় ভোরেই। গলার কাছটায় নায়ীব মুখ ডুবিয়ে ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। স্রোত নড়াচড়া থামিয়ে দেয়। হাত চালায় নায়ীবের চুলের ফাঁকে। আস্তে আস্তে টানতে থাকে। আরাম পেয়ে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয় নায়ীব। তবে ঘুম খানিকটা বিঘ্ন হয়। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বের হয়,
“ স্রোত!”
স্রোত হাত সরিয়ে ফেলে তৎক্ষনাৎ। সাবধানী,লহু স্বরে বলে,
“ সরি,সরি! ঘুমান আপনি। আমি উঠি, ছাড়ুন।”
নায়ীবের ঘুম এবার পুরোপুরি ভেঙে গেল। মস্তিষ্ক সজাগ হয়। কতক্ষণ ঘুমালো ও? বড়জোর তিন ঘন্টা। আরো ঘুম প্রয়োজন। এই মেয়ে উঠে গেলে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে।

“ থাকুন, পরে উঠবেন।”
নায়ীবের কথায় বিপরীতে ত্বরিত মাথা দুলায় স্রোত,
“ না না, সবাই উঠে গেছে। আমারও উঠতে হবে। ছাড়ুন, কোলবালিশ দিচ্ছি।”
নায়ীব ছাড়লোনা। উন্মুক্ত কোমরের পাশটায় তার হাতের বিচরণ শুরু হতেই কেঁপে উঠল স্রোত। কিছু বলার পূর্বেই নায়ীব থামিয়ে দেয়,
“ কোলবালিশ দিয়ে বউয়ের সাধ মিটে নাকি!”
বলতে বলতে তার দাঁত চেপে ধরলো গলার একটু নিচে। তৎক্ষনাৎ চেঁচিয়ে উঠে স্রোত। গলায় হাত ঘষে। রাগান্বিত চোখে চেয়ে বলে,
“ এটা কি করলেন!”
ভোরের নরম আলো পর্দা গলিয়ে প্রবেশ করছে। সেই জ্যুতি আছড়ে পড়ছে স্রোতের চেহারায়। নরম আলোয় রাগান্বিত সেই চোখ-মুখ দেখে মুগ্ধ হলো নায়ীব। কতক্ষণ মাথা তুলে তাকিয়ে রইল এক ধ্যানে। দৃষ্টিতে ঘোর,চেহারায় মুগ্ধতা।
ও মাথা ফেলে বলে,
“ লাভ বা’ইট বলে এটাকে।”
“ লাভ বাই’ট? এমন ভাবে কাম-ড়ানোকে লাভ বা’ইট বলে?”
“ জানতেন না বুঝি?”
একটু দম নেয় নায়ীব,
“ আমি জানিয়ে দিলাম। দেখিয়েও দিলাম। থ্যাংক মি লেটার,মিসেস।”

বলতে দেরী অথচ গলার কাছটায় শক্ত দাঁতের আক্র-মণ হতে দেরী নেই। নায়ীব চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। স্রোত মুখ সরিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসে,
“ এবার বলুন, কেমন লাগলো লা ভ বা ই ট? ”
টেনে টেনে বলা কথার ধরণে চোখ-মুখ কুঁচকেই হাসে নায়ীব। ওর হাসি দেখে ভ্যাবাচেকা খায় স্রোত। নায়ীব সে হাসি বজায় রেখেই বলে,
“ শার্ট নাহয় পাঞ্জাবির কলারে আমারটা ঢেকে যাবে। আপনারটার কি হবে,শুনি?”

সত্যি সত্যিই নায়ীবের গলার দাগ ঢেকে গেল পাঞ্জাবির আড়ালে। অথচ স্রোত রেডি হওয়ার সময় পড়লো মহা বিপাকে। যন্ত্রণা হচ্ছিল,তাও মানা যায়। লোকসমাগমে এই সুরতে যাবে কীভাবে? ও অনেক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উপায় খুঁজে। যে শাড়িটা পরেছে,সেটার সঙ্গের ব্লাউজের গলাটা ওত ছোট না। চুলগুলো ছাড়লে তারই অশান্তি লাগবে। বাঁধলে আবার গলার লাল দাগটা দৃশ্যমান হবে। কি এক জ্বালা!

নায়ীব ব্যস্ত পায়ে রুমে ঢুকে। শশুরবাড়ি এসে হাত গুটিয়ে বসে থাকার মত নির্বোধ সে নয়। মাত্রই নিচে সবকিছুর তদারকি করে এলো। গাড়ি-টাড়ি রেডি। এবার কেবল বেরোনোর পালা। কিন্তু রুমের মধ্যে ঢুকে,উদাসীন চেহারার বউকে দেখে খটকা লাগলো ওর। বাম হাতে ঘড়ি পরতে পরতে জিজ্ঞেস করল,
“ বসে আছেন কেন? জুতা পরুন। যেতে হবে তো। লেট হয়ে যাচ্ছে।”

স্রোত ঝাঁঝাল স্বরে বলল,
“ যাওয়ার উপায় রেখেছেন? গলায় কাম-ড়ায় কেউ? এটা এখন ঢাকব কীভাবে?”

নায়ীব অদ্ভুত চোখে তাকাল। এরপরই হুট করে কাছে চলে এলো। সামনে এলিয়ে রাখা চুলগুলো আলতো স্পর্শে পেছনে সরালো। সামান্য লালচে দাগ। তবে চোখে পড়ার মত। নায়ীব মোটেও অনুতপ্ত নয়। সে ভীষণ স্বাভাবিক গলায় বলল,
“একটু পাউডার মাখলেই তো হয় রে বাবা। যান,আমাদের বেরোতে হবে। লেট হলে এমন দু’চারটা দাগ আরো পড়বে।”

স্রোত চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার লজ্জা লাগছে। তবে বিরক্ত লাগছেনা।

..

রাত নেমেছে। আকাশে চাঁদ নেই।চারপাশটা অন্ধকার। কিন্তু বাড়ির উঠোনটা দারুণ উজ্জ্বল। গল্পের আসর জমেছে। অন্যপাশে আগামী দিনের রান্না-বান্না করা হচ্ছে। মাঝখানের এই হৈ-হুল্লোড়ে শামিল নেই শুধু সুহাদ আর রোজ। বাড়ির বড়দের মত তারাও ভেতরে। নতুন বউ ভীষণ ক্লান্ত। এমতাবস্থায় সুহাদ তাকে ফেলে তো আর আসবেনা।

রোজ হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। চোখ দু’টো বন্ধ। ঘুম পাচ্ছে। সুহাদ নিঃশব্দে পাশে এসে বসলো। ডাকল,
“ রোজ,ঘুমাবে?”
রোজ ফট করে চোখ খুলল। সোজা হয়ে বসে মিষ্টি হেসে বলল,
“না।”
“ ঘুম পেলে ঘুমাতে পারো।”
“ পাচ্ছেনা।” ডাহা মিথ্যা কথাটা বলতে বলতে সে হাই তুলে। সুহাদের সম্পূর্ণ মনোযোগই তার ওপর। হাই তুলতে দেখে সে মুচকি হাসে,
“ আচ্ছা,দেখতেই পাচ্ছি।”
“ হু। গল্প করো, সুহাদ। আমার ভালো লাগছেনা।”
সুহাদ ভ্রু কপালে তুলে,
“ ভালো লাগছেনা? কাউকে ডাকব?”
“ কাউকে লাগবেনা। তুমি আছো তো। গল্প করো,আমি শুনি।” বলতে বলতে সে গালে হাত দিয়ে, আসন পেতে বসে। চোখমুখে রাজ্যের আগ্রহ। সুহাদও পা তুলে বসে। তবে সে গল্প শুরু করলনা। দূরত্ব মিটিয়ে,হাত টেনে ধরে রোজের। দু’টো ছোট্ট চুমু খেয়ে বলে,
“ আমার আজ শান্তি লাগছে। এতদিন এই শান্তিটা পাইনি। আজ এইযে,ঘরে ঢুকেই তোমাকে পেলাম। তুমি শুয়ে আছো,প্রতিদিন এভাবেই পাব। ভাবতেই বুকটায় শান্তি লাগছে। এটাকে কি বলে? জানো তুমি,রোজ?”
“ জানি।” রোজ হাসে। কিছুটা পূর্ণতার হাসি,কিছুটা লজ্জার। ওদের বিয়েটা সম্পূর্ণ অ্যারেঞ্জড। অথচ এখন মনে হচ্ছে লাভ ম্যারেজ। কোনো প্রেমালাপই তো হলোনা। এত গোপনেও বুঝি প্রেমে পড়া যায়?

সুহাদ এগোয়। অতি আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ কি জানো?”
“ ভালোবাসা বলে এটাকে। প্রেমও বলে। এখন তুমি ডিসাইড করো,নিজের বউয়ের প্রতি তোমার কোন অনুভূতিটা আছে! প্রেম না ভালোবাসা?”
সুহাদ অমায়িক হাসে,
“ আমার দুটোই লাগছে।”

..

স্রোত ঝুঁকে বসে আছে। কয়েকটা বেতের মোড়া পাতানো উঠোনে। সবাই বসে আছে তাতে। মাঝখানে অল্প আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। তা থেকে বেশ দূরত্ব রেখেই ওরা বসেছে।
সবাই গল্প মজেছে। স্রোত চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। সে একচক্কর স্টোররুমে গিয়েছিল। খালি,উদাম ঘরটা দেখে বোঝার জো নেই,কেউ যে ছিল ওখানে। নায়ীবকে জিজ্ঞেস করলেও সে কিছু বলছেনা। এড়িয়ে যাচ্ছে।
অথচ স্রোতের মাথা থেকে কিছুই সরছেনা। একা একা শহরে থেকেছে। তবুও এত বাজে পরিস্থিতির শিকার হতে হয়নি কখনো। শেষমেশ কিনা নিজ বাড়িতে? ভাবলেই বুক ফেটে কান্না আসে ওর।
ও আড়চোখে নায়ীবের দিকে তাকায়। ভীষণ স্বাভাবিক ভাবভঙ্গিতে সে গল্প করে যাচ্ছে।
স্রোত অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকল। হাই তুলতেই নায়ীব তড়াক করে চাইলো। বাজপাখির নজর। আগুনের উজ্জ্বল আলোয় সে দৃষ্টি দেখে হাসলো স্রোত। সোজা হয়ে বসতেই নায়ীব লহু গলায় বলল,
“ ঘুম পাচ্ছে নাকি? সবে তো ন’টা বাজল।”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় স্রোত।

“ এদিকে আসুন।”

স্রোত হকচকিয়ে তাকায়। সাবধানী নজরে সবাইকে পরখ করে একবার। সবাই গল্পে ব্যস্ত। তাদের দিকে মনোযোগ নেই। ও ভ্যাবাচেকা খাওয়া গলায় বলল,
“ কোথায় আসব?”
“ আমার দিকটায় সরে বসুন।”

স্রোত মোড়া সমেত কাছে এল। কাঁধটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিতেই ও মাথা রাখলো। নায়ীবের কিছু বলা লাগলোনা। সবার মনোযোগ ঘুরতে সময়ও লাগলোনা। তিন্নি হইহই করে উঠল,
“ ওহহো! একি দেখছি!”

স্রোত চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। ঠোঁটে ফুটে ওঠে লাজুক হাসি। সবসময় সে কেনো লজ্জায় নাস্তানাবুদ হবে? এবার নায়ীবের পালা। অথচ নায়ীবের বিশেষ ভাবান্তর হলোনা। সে কেবল হাসলো।

.

ওরা আরেক চমৎকার দৃশ্যের সাক্ষী হলো। স্রোত ঘুমে ঢলে পড়ছে। তার বাহু আকড়ে অনেক্ষণ বসে ছিল নায়ীব। শেষমেশ একদম ঘুমে কাদা হওয়া স্রোতকে ও টেনে তুলল। স্রোতের আলুঢালু অবস্থা। মেয়েটার ঘুম গাঢ়। একবার চোখের পাতা মেলে আবার বুজে ফেলেছে। নায়ীব ওকে ধরে ধরে সিঁড়ির পাশটায় আনলো বহু কষ্টে। শেষমেশ বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে কোলে তুলে নিল। এরপর আস্তে ধীরে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠে গেল। সবাই সেসব দেখল। সদর দরজার আড়াল থেকে সাঈম সাহেবও তা দেখলেন। মুখে তার চওড়া হাসি।
পেছন থেকে আশা কাঁধে হাত রাখতেই তিনি হকচকিয়ে উঠলেন। আশা সন্দিহান চোখে তাকিয়ে,জিজ্ঞেস করলেন,
“ কি?”
“ কিছুনা,আশা। স্রোতের খাবারটা ওর ঘরে পাঠিয়ে দিও,ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা।”
“ সেকি! একটু আগে না উঠোনে দেখলাম? ঘুমালো কই!”
“ ওখানেই বসে বসে ঝিমুচ্ছিলো। হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছে।”
সাঈম সাহেব হাঁটা ধরলেন ভেতরের দিকে। আশা পিছু পিছু গেলেন। প্রশ্ন করলেন,
“ তাহলে নিয়ে গেল কে?”
“ আর কে? তোমার মেয়ের জামাই।”

..

“ বাবা,আসি?”

নায়ীব সরে বসলো। স্রোত একপাশে শুয়ে আছে। গায়ের উপর মোটা কম্বল। ইমার হাতে খাবারের প্লেট। নায়ীব সোজা হয়ে বসে বলল,
“ আসুন,ছোটমা।”

ইমা ঢুকলেন ধীর পায়ে। স্রোতকে দেখলেন একবার উঁকি দিয়ে। খাবারের প্লেটটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বললেন,
“ আমার আম্মার ঘুম অনেক গাঢ়। মাঝেমধ্যে না খেয়েই ঘুমিয়ে যেত। এরপর আমি টেনে-টুনে তুলে খাওয়াতাম।”
নায়ীব হাসলো। বলল,
“ প্লেটটা আমার হাতে দিয়ে দিন,ছোট মা।”
“ চামচ আছে। মাখিয়ে এনেছি,শুধু ওকে তুলে মুখে দিয়ে দিও। দেখবে,মুখের মধ্যে চিবোচ্ছে।”
বলতে বলতে হাসলেন ইমা। নায়ীব হেসে একপল তাকায় স্রোতের দিকে। ইমা বেরিয়ে যান।

..

“ ওয়াহিদের মতিগতি সুবিধের লাগছেনা।”

শুভ্রার এমন কথায় কি প্রতিক্রিয়া দেয়া উচিত,জানা নেই স্রোতের। তা-ই ও তেমন ভাবাবেগ দেখালোনা। দৃষ্টি শুণ্যে রেখে প্রশ্ন করল,
“ যেমন?”
“ ও মা-রাত্মক লেভেলের প্রেমিক! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আমাদের ব্যাচের তানহা ওকে প্রপোজ করেছে। ও সেটা সবার সামনে সসম্মানে প্রত্যাখান করেছে। কারণ হিসেবে বলেছে,ও নাকি প্রেম করে। এই ভার্সিটিরই এক মেয়ের সাথে। নামটা বলেনি।”
স্রোত এবার চোখ ঘুরালো। এ তো ভার্সিটির গরম গরম, তাজা তাজা একখানা খবর।
এসেই এমন খবর শুনতে হবে,তা কল্পনাতীত ছিল ওর।
ও ধীর গলায় বলে,
“ আচ্ছা,করুক প্রেম। আমাদের তাতে কি করার!”

শুভ্রা অনেক্ষণ ঠোঁট চেপে বসে ছিল। কণ্ঠনালীতে একটা কথা কিলবিল করছিল। তবে কীভাবে বলবে,ভেবে পাচ্ছিলোনা। শেষমেশ না পারতে বলল,
“ এ্যাই স্রোত! একটা কথা বললে রাগ করবি?”

মাথা দুপাশে মাথা নাড়াতেই শুভ্রা কথার দ্বারা এক বিস্ফো রণ ঘটাল,
“ নিশাতের মত কাকে যেন সেদিন দেখলাম, ওয়াহিদের বাইকের পেছনে।”

‘নিশাতের মত’ ডাহা মিথ্যা। শুভ্রা আদতেই নিশাতকেই দেখেছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখেছে বলে এখনও মানসপটে সেই দৃশ্য ভাসছে।

স্রোত গোল-গোল চোখে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইল। অবিশ্বাসযোগ্য একটা কথা। হজম করার উপায় নেই। ও বিস্ফো রিত নেত্রে তাকিয়ে বলল,
“ আর ইউ শিওর,ওটা নিশাতই ছিল?”
“ দেখে তো লাগলো। তুই পারলে ওকে একবার ইনিয়েবিনিয়ে জিজ্ঞেস করিস। না হলে ওয়াহিদকে।”

নিশাতকে জিজ্ঞেস করতে গেলে নিজেই বিব্রত হবে স্রোত। নিশাতও লজ্জায় পড়বে। এর চেয়ে ভালো ওয়াহিদকে জিজ্ঞেস করা। মনে মনে ঠিক করে নেয় স্রোত, সে ওয়াহিদকেই জিজ্ঞেস করবে।

চলবে.

#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—৪৮

ওয়াহিদ বসে আছে। তবে স্থির নেই। বসে বসেই কেমন বাচ্চাদের মত একটু পরপর নড়ে-চড়ে উঠছে। যেন রাজ্যের তাড়া তার। স্রোত অনেক্ষণ ওকে গভীর চোখে পরখ করল। ওয়াহিদের তা খেয়ালে আসে। শ্লেষাত্মক কণ্ঠে আচানক বলল,
“ এভাবে দেখছিস কেন? তোর জামাই জানলে আমার হাড্ডি-মাংস এক করে ফেলবে!”

স্রোত ত্বরিত চোখ সরাল। বিরক্তিতে মুখ দিয়ে চ শব্দ উচ্চারিত হলো আপনা-আপনি। ওয়াহিদ শশব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
“ কিজন্য ডাকলি?”
“ নিশাতকে চিনিস? নিশাত? আমার ননদ।”
এরকম সোজা প্রশ্নের পিঠে ওয়াহিদ কেবল উপর-নিচ মাথা দুলাল। স্রোত সঙ্গে সঙ্গে খ্যাক করে উঠল,
“ কীভাবে চিনিস?”

ওয়াহিদ ভড়কাল না। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায়, ধীরে সুস্থে বলল,
“ অনেকভাবে চিনি। প্রথমত, জুনিয়র হিসেবে চিনি। দ্বিতীয়ত তোর ননদ হিসেবে।”
“ ব্যস? আর কোনোভাবে চিনিস না?”

ওয়াহিদ ঠোঁট চেপে ওর দিকে তাকায়। স্রোতের চোখ-মুখে গোয়েন্দা গোয়েন্দা ছাপ ফুটে উঠেছে। পুলিশ বর আর গোয়েন্দা বউ; দারুণ জুটি।

“ তুই বাংলা বিভাগে ভর্তি হলি কেনো? তোর তো উচিত ছিল গোয়েন্দা হওয়া।”

স্রোত তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে,ঝাঁঝাল গলায় বলল,
“ ওয়াহিদ, নিশাতের সঙ্গে যদি কিছু থেকেও থাকে! খবরদার! আগে থেকে সাবধান করছি। পিছু ছেড়ে দে ওর।”

ওয়াহিদ এপর্যায়ে মা-রাত্মক সিরিয়াস হলো। গম্ভীর দেখাল তার শুভ্র মুখখানি,
“ না ছাড়লে?”
“ ওয়াহিদ! সবসময় ত্যাড়ামো সুখকর কিছু বয়ে আনেনা। নিশাত এখনও ছোট।”
“ ছোট? ছোট কীভাবে? ঊনিশ বছর চারমাস বয়সে কেউ ছোট হয়?”

স্রোত হতভম্ব হয়ে গেল। বেশ বিরক্তও হলো বটে,
“ দেখ ভাই, ভালোভাবে বুঝাচ্ছি। ও শুধু আমার ননদ না, ছোট বোনের মত। আমি চাইনা এসব লেইম ব্যাপারে কথা বলে ওর চোখে নিজেকে ছোট করতে। তুই ওর ভাইকে চিনিস না…”
“ থাম,থাম। ওর ভাইকে চিনে আমি কি করব? তোর বর, তুই চিনবি। আমি তার বোনকে চিনে দিব্যি একজীবন কাটিয়ে দিতে পারব।”

স্রোত মেজাজ হারালো। সে অনেক্ষণ নিজেকে আটকে রেখেছিল। রাগান্বিত গলায় একপ্রকার চেঁচালো,
“ ওয়াহিদ! মশকরা করছিনা আমি!”

ওপরপ্রান্তে বসে থাকা ওয়াহিদ অত্যাধিক শান্ত। অনেক্ষণ মৌন রইল সে। শেষমেশ এক উদ্ভট প্রশ্ন করল,
“ আমি দেখতে খারাপ?”

স্রোত ভ্রু কুঁচকালো। ওয়াহিদ আরো দুইবার একই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করালো ওকে। স্রোত বাধ্য হয়ে দু’পাশে মাথা নাড়তেই ও ফের প্রশ্ন করল,
“ আমার রেজাল্ট খারাপ?”
“ না।”
“ তোর মনে হয় মাস্টার্স শেষ করে আমি চাকরি পাবনা?”
“ পাবি।”
“ তোর মনে হয় আমি নিশাতকে সুখি রাখতে পারবনা?”

স্রোত নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। বাকরুদ্ধ সে। বলার জন্য শব্দভান্ডারে একটি শব্দও অবশিষ্ট নেই।

ওয়াহিদ আচমকাই হাসে,
“ তোর আচরণে এত তফাৎ দেখে আমি সত্যিই বিমোহিত। আগের স্রোত হলে তার ননদের সঙ্গে প্রেম করার অপরাধে এসেই কথা ছাড়া দুই গালে ঘা বসাতো। অথচ দেখ, নতুন স্রোত আমায় ডেকে এনে সুন্দর ভাবে বোঝাচ্ছে। ইম্প্রেসিভ! নিশাত আর ওর ভাই; দুজনেই জাদু জানে, বুঝলি। ওর ভাই তোকে পালটে দিয়েছে, আর ও আমাকে।”

স্রোত তব্দা খেয়ে,স্থির চিত্তে বসে রইল।ওয়াহিদ এবার নিজেই উঠে গেল। স্রোতকে সে কথায় জব্দ করেছে একপ্রকার। ঠোঁট গোল করে, শিঁষ তুলে পা বাড়ালো বাইরে বেরোনোর উদ্দেশ্যে। নিশাতের শেষ পরীক্ষা আজ, তাকে একচক্কর দেখে আসা যাক।

..

নিশাতের চোখ-মুখে ভয়, আতঙ্ক। ওয়াহিদ বাদাম চিবোতে চিবোতে বলল,
“ পরীক্ষা কেমন হলো?”
“ ভালো না।” নিশাতের পরীক্ষা ভালো হয়েছে। অথচ তার মনে হচ্ছে সে এবার দু’টো বড় বড় ঘোড়ার ডিম পাবে। ভাইয়া সেই ডিম দু’টো দেখলেই তাকে শূলে চড়াবে। রুদ্রমূর্তি ধারণ করে প্রশ্ন ছুঁড়বে, ‘ভার্সিটিতে যাও প্রেম করতে?’

“ বাদাম খাও তাহলে। বাদাম খেলে পড়া মনে থাকবে।”
ওয়াহিদের অহেতুক কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ে নিশাতের।
ও কপাল কুঁচকে, বিরক্তি ভরা গলায় বলে,
“ আপনার বাদাম আপনিই খান।”
“ ওওওওকে!”

নিশাত এবার চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“ ভাবীকে আর কি কি বলেছেন?”
“ আর কি বলবো? তুমি যে সেদিন আমার সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলে, ওটাও বলতাম নাকি?”
“ ওয়াহিদ! আপনি খুব বেয়া-দব।”

ওয়াহিদের চক্ষুদ্বয় নিজ নিজ স্থান থেকে বেরোনোর দশা। অবিলম্বে চোয়াল ঝুলে গেল তার। বাদামের খোসাগুলো হাত থেকে ফেলে ও সোজা হয়ে দাঁড়াল। হতভম্বি নিয়ে বলল,
“ বেয়াদবি? আর আমি? শুনো নিশাত, তুমি আমার থেকে গুনে গুনে পাঁচ বছরের ছোট। তোমার সঙ্গে আমি বেয়াদবি করবো কীভাবে?”

নিশাত নিশ্চুপ। একবার আড়চোখে ওর দিকে তাকাল। এত সিরিয়াস হওয়ার কি আছে? সে তো এমনি বলল কথাটা।

ওয়াহিদ আচমকা হাত বাড়ালো। শুভ্র কপালের ওপর এলোমেলো,ছড়ানো, ছোট ছোট চুলগুলো আলতো হাতে সরাতে সরাতে বলল,
“ তোমার ভাবী যা চিজ! ভেবেছিলাম আমাকে সামনে পেলেই ঠাটিয়ে একটা লাগাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। উল্টো আমার কথা শুনে চুপ হয়ে গেল। চুপ তো হতেই হবে। নিজে প্রেম করেছে। এখন আমার প্রেমে ভাটা দিবে কেনো? নিজের বেলা ষোলো আনা! আর আমার-তোমার বেলা এক আনাও না? তাতো আমি ওয়াহিদ মেনে নেবনা।”

..

জিহাদ মিষ্টির প্যাকেট এক হাতে নিয়ে, অন্য হাতের সাহায্যে ছোট্ট দরজাটায় ঠকঠক আওয়াজ তুলল।
নায়ীবের গভীর মনোযোগে ভাটা পড়লো তাই। একবার চোখ তুলে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই নামিয়ে ফেলল। গম্ভীর গলায় বলল,
“ আসো।”

জিহাদ এলো। হাতের মিষ্টির প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“ স্যার,মিষ্টি খান।”
“ মিষ্টি? কি উপলক্ষ্যে?”

নায়ীব এবার চোখ তুলল। দু’হাত ওপরে তুলে ম্যাজম্যাজ করা শরীরটা টানটান করে নিল একবার। জিহাদের ঠোঁটে বিশাল এক হাসি। অনেক্ষণ সময় নিয়ে সে বলল,
“ স্যার,বাবা হচ্ছি। জুনিয়র জিহাদ ইজ কামিং, তার জন্যই মিষ্টি।”

নায়ীব কয়েকপল ওর দিকে তাকিয়ে রইল। কথাগুলো বিশ্বাস করল অনেক সময় নিয়ে। অতঃপর একটা মিষ্টি হাতে তুলে নিয়ে বলল,
“ অভিনন্দন, জিহাদ। দোয়া করি তোমার যেন একটা মেয়ে হয়। আমীন।”
“ কেনো স্যার? জুনিয়র জিহাদ আসতে কি সমস্যা?”
“ ছেলে হলে মন্দ হবেনা। তবে তোমার মতো হলে বিরাট সমস্যা আছে। তোমাকে একটা কাজ দিয়েছিলাম,সেটা করেছ?”

জিহাদ থতমত খেলো। কোন কথা থেকে স্যার কোন কথায় গেল? সবকিছুতে তার কাজ ঢুকাতে হয়। জিহাদ ফ্যাকাশে মুখে বলল,
“ জ্বি,স্যার। করে ফেলব। একটু সময়..”

নায়ীব কেমন করে তাকালো। রুক্ষ চোখের দৃষ্টিতেই জ্বিভ আর অর্ধেক বাক্য মুখের ভেতরই গুটিয়ে ফেলল জিহাদ।
নায়ীব চোখ নামাল,
“ যাও,দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“ স্যার, মিষ্টির…”
“ খেলাম তো।”
জিহাদ দুপাশে মাথা দুলাল,
“ না,স্যার। এগুলো ম্যামের জন্য। ম্যামকে বলবেন দোয়া করতে। আমার ওয়াইফ তাকে খুব পছন্দ করে।”

নায়ীব বড্ড আগ্রহ দেখাল এবার,
“ পছন্দ করে? কেনো?”
“ কি জানি, স্যার। মহিলা মানুষের ব্যাপার-স্যাপার।”

বলতে বলতে সে মিষ্টির প্যাকেটটা টেবিলের ওপর রাখল। জ্বিভটা তার একটু বেশিই চলে। অতিরিক্ত বলা যায়। এই যেমন, মিষ্টির প্যাকেট রাখতে রাখতে সে ফট করে এক বিস্ফো রণ ঘটানোর মতো বাক্য বলে বসল,
“ একদিন আপনিও মিষ্টি খাওয়াবেন, স্যার। ভাবতেই আমার আনন্দ হচ্ছে।”

নায়ীবের চতুর মস্তিষ্ক তার এমন হেয়ালি কথার মানে চট করেই ধরে ফেলল। জিহাদ সঙ্গে সঙ্গেই জ্বিভ কাটলো। তড়িঘড়ি করে বলল,
“ সরি,স্যার! এক্সট্রিমলি সরি।”

জিহাদ নিজেও জানেনা, এখানে সরি বলার কারণটা কি। সে তো ভুল বলেনি। আদতেই নায়ীব একদিন তাদের মিষ্টি খাওয়াবে। নায়ীবও সেটা জানে।

নায়ীব অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিল,
“ তা তো দিবই। আপাতত কাজটা সেড়ে আমায় উদ্ধার করো।”

..

আজ নায়ীব-স্রোতের বিবাহের একশো তম দিন। স্রোত দিন গুনে রাখছে। এত দিন পার হলো কীভাবে? সে বুঝেই পায়না। মানুষটা সকালে কাজে যায়,রাতে আসে। স্রোতও ভার্সিটি যায়,কোনোদিন না গেলে শশুরের কাছে রান্না শিখে। এ কাজ অবশ্য নাবিদ সাহেব করেন খুবই আগ্রহ নিয়ে। রাবেয়ার রান্না তার মন মতো হয়না। রাবেয়া যদি বলেন, ‘তাহলে আপনে শিখায় দেন আমারে,ভাইজান।’ তা মানতেও নারাজ নাবিদ সাহেব। তিনি তার কুকিং স্কিলস কারোর সঙ্গেই শেয়ার করেন না। তবে এক্ষেত্রে বোধহয় স্রোত সবার ঊর্ধ্বে।
স্রোতের যেদিন ভার্সিটি থাকেনা,সেদিন রাবেয়া আসেননা। ওদিন ওরা শশুড় আর বউমা মিলে রান্নার দায়িত্ব নেয়।
এই যেমন, আজ। স্রোত ইচ্ছে করেই ভার্সিটি যায়নি। নিশাতের পরীক্ষা শেষ। ক্লাস নেই,তবুও সে গিয়েছে কোথাও। স্রোত জানে,কোথায় গেছে সে। তবে সে সবটা সময়ের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। ওয়াহিদ ওতটাও খারাপ নয়।

স্রোত খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“ আব্বু, আম্মু দেখতে কেমন ছিলেন?”

নাবিদ সাহেব থমকালেন। মনে পড়লো, এতদিনেও তার স্ত্রীর ছবি স্রোতকে দেখানো হয়নি।

“ তোমাকে তো তার ছবি দেখাইনি! হায়রে! দাঁড়াও তো মা, দুই মিনিট। আমি আসছি।”
বলেই শশব্যস্ত হয়ে ছুটলেন তিনি। দেড় মিনিটের মাথায় ফিরেও এলেন। হাতে একটা ছবি। পুরোনো হলেও ঝকঝকে। অনেক যত্নে রাখা ছিল, বোঝাই যাচ্ছে। স্রোত উৎসুক চোখে তাকালো।
নাবিদ সাহেব বলা শুরু করলেন,
“ তোমার শাশুড়ীর নাম দোলা। আমি তাকে দুলি বলে ডাকতাম। নায়ীব হওয়ার পর নায়ীবের মা বলে ডাকতাম। সে খুব খুশি হতো।”

স্রোতের মনোযোগ ছবির দিকে। শশুড়ের কথা শুনে সে হাসলো। তার ছেলে-মেয়ে হলে কি নায়ীবও এভাবে ডাকবে? স্রোত নিজের ভাবনায় নিজেই হকচকালো। একা একাই লজ্জা পেল।

নাবিদ সাহেব তখনও বলছেন,
“ নায়ীব দেখতে ওর মায়ের মত। ওর আচরণও দুলির মত।
দুলি নিজের মতই এক পিস রেখে গেছে দুনিয়ায়।”
বলতে বলতে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন উনি। স্রোত তরকারির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ আব্বু, তরকারিটা হয়ে এসেছে। নামিয়ে ফেলি?”
“ হ্যাঁ, হ্যাঁ নামাও। কিন্তু সাবধানে।”

..

নায়ীব এলো দশটার দিকে। হাতের জিহাদের দেয়া মিষ্টির প্যাকেট। স্রোত মিষ্টি খাবার-দাবার পছন্দ করে। তবে সে বেশি খেতে পারেনা। নায়ীব তাই খুব কমই আনে এসব।

ও সোজা রুমে ঢুকলো। স্রোত তখন বিছানা গুছাচ্ছিলো। দরজা খুলেছে নিশাত। ও জানত,নায়ীব এসেছে।

নায়ীব মিষ্টির প্যাকেটটা রাখল টেবিলের ওপর। ক্লান্ত গলায় ডেকে বলল,
“ এক গ্লাস পানি দিন তো।”

স্রোত ছুটে গিয়ে শরবত নিয়ে এল। সে রোজ এমনটাই করে। হাতে থাকে শরবতের গ্লাস,মুখে থাকে মিষ্টি এক হাসি। নায়ীব ওর দিকে চেয়ে চেয়েই পুরো গ্লাস সাবাড় করে ফেলে।

“ মিষ্টি আছে প্যাকেটে।”
নায়ীবের কথার পিঠে স্রোত ঝটপট প্রশ্ন করল,
“ কিসের মিষ্টি?”
“ জিহাদ দিয়েছে। ও বাবা হতে যাচ্ছে।”

স্রোত গোল-গোল চোখে তাকিয়ে বলল,
“ ওহ।”

নায়ীব তন্মধ্যে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে। স্রোত তখন পা দুলিয়ে বিছানায় বসা। শুণ্যে তাকিয়ে,কি যেন ভাবছে। নায়ীব টিশার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে একবার দরজার দিকে তাকালো। অল্প খোলা। তবে কেউ নেই।

ও ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালো স্রোতের সামনে। চুলে হাত ডুবিয়ে বলল,
“ কি ভাবছেন এত?”
“ হু..হুম? কিছুনা। চলুন, খাবেন।” অন্যমনস্ক স্রোতের ভাবনায় ভাটা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে দাঁড়ায়। তবে পা বাড়ানো হয়না। নায়ীব সন্তপর্ণে তার কোমর প্যাঁচিয়ে ধরে। চুলে নাক ডুবায় অবিলম্বে,
“ শ্যাম্পু দিয়েছেন?”
“ হু..হুম।”
“ তোতলাচ্ছেন কেনো,স্রোত? আদর তো নতুন খাচ্ছেন না।”
স্রোত হকচকালো। নায়ীব হাসে। ক্ষীণ হাসি। ঠোঁট চেপে ধরে গালে। এত পরিচিত আদুরে স্পর্শেও অকারণেই কেঁপে উঠে স্রোত। মিহি গলায় বলে,
“ দরজা খোলা!”
সে কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো নায়ীব। তার স্পর্শ আরেকটু গাঢ় হলো। অনেক প্রহর খুঁইয়ে সে মুখ খুলে। বুকে উত্তাল তোলা, ঘোর লাগানো স্বরে সহসা এক প্রশ্ন করে,
“ আমি কবে ওদের মিষ্টি খাওয়াবো, হুম?”

চলবে.