#গ্যারাকলে_জোৎস্নারাত
#লেখিকা_সিনথিয়া_জাহান
#পর্বঃ১
কলেজ থেকে ফিরেই থরথর করে কাঁপছে রাত কারন ওর সামনে পাত্রপক্ষ বসে আছে ৷ অবশ্য পাত্রপক্ষকে ভয় পাচ্ছে না বরং পাত্ররুপী পুলিশ টাকে ভীষণ ভয় করছে রাতের ৷ জীবনে ভুতরুপী জ্বীনদের পর ও পুলিশকেই বেশি ভয় পায় ৷ যাক গে সে কথা ৷ নাইমা রহমান মেয়েকে সুন্দর করে সাজিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে এনে বসালেন ৷
পাত্রপক্ষ বলতে পাত্র আর পাত্রের বাবা এসেছে ৷ অবশ্য পাত্রের বাবার সাথে উনার পার্সোনাল ডাক্তার এসেছে ৷ উনি হার্টের রোগী ৷ যেকোন সময় ডাক্তারের প্রয়োজন পড়ে তাই মেয়েরা যেমন মেকআপ ব্যতীত বাড়ির বাইরে বের হয় না তেমনি গালিব মেহতাব ডাক্তার ছাড়া বাইরে বের হন না ৷
রাতের বাবা জোবায়ের সিদ্দিকী গলা খাকারি দিয়ে বললেন,,, আপনার ছেলের নাম টা যেন কি?
গালিব মেহতাব কিছু বলার আগে একটা গুরুগম্ভীর নিরেট কন্ঠস্বর ভেসে আসল,,,
জ্বি গুরবাজ মেহতাব ৷
জোয়াবের সিদ্দিকী মুচকি হেসে বললেন,,, ওহ হ্যাঁ মনে পড়েছে ৷ আসলে আমার ভুলে যাওয়ার রোগ আছে ৷ মাঝে মাঝে তো নিজের নামই ভুলে যাই ৷ সে কথা বাদ ৷ এই যে আমার মেয়ে জিম সিদ্দিকী ৷
উনার কথা শুনে সবাই অবাক নয়নে উনার দিকে দৃষ্টি দিলেন ৷ বল খেলতে ব্যস্ত থাকা দশ বছরের ছেলে জিম মুখে রাগের আভা এনে বলল,,,
বাবা জিম তোমার ছেলের নাম, মেয়ের নাম না ৷
জোবায়ের সিদ্দিকী নিজের ভুলে লজ্জা পেয়ে গেলেন কিন্তু বাইরে গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বললেন,,,
আমি ইচ্ছা করে ভুল বলেছি ৷ দেখলাম তোমাদের মনোযোগ আছে কি নেই ৷ যেহেতু মনোযোগ আছে তো এখন আসল কথা বলা যাক ৷
উনি নিজের পাশে বসে থাকা কলেজ পড়ুয়া মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,,,
আমার মেয়ে রাত সিদ্দিকী ৷ ও ছোট থেকেই একটু চঞ্চল প্রকৃতির তাই এভাবে গড়গড় করে কথা বলে চলেছে ৷
আবারও সকলে চোখ বড়বড় করে উনার দিকে তাকাল ৷ গালিব মেহতাব নিজের বুকে হাত রেখে বললেন,,,
ভাইজান আপনার মেয়ে তো আসার পর থেকে এখনও একটা কথাও বলেনি ৷
রাত বাবার সন্নিকটে এগিয়ে গিয়ে কন্ঠটা খাটো করে বলল,,, বাবা এসব বৈশিষ্ট্য জোৎস্নার ৷ আমি জোৎস্না না আমি রাত ৷
জোবায়ের সিদ্দিকী থতমত খেয়ে গেলেন ৷ পরমুহূর্তে নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বললেন,,,
ওই আরকি একই কথা ৷আমার মেয়ে রাত একটু ভীতু আর লাজুক প্রকৃতির তাই কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে কিছু মনে করবেন না ৷
গালিব মেহতাব উনার কথা শুনে বুক ভরে শ্বাস নিলেন ৷ কেননা একটু আগেই উনার শ্বাস টান উঠতে ধরেছিল ৷ রাতের মা নাইমা রহমান সকলের জন্য টুকটাক নাস্তা এনে বিভিন্ন রকম কথা বলতে লাগলেন ৷
সেসব কথায় একটুও মনোযোগ নেই রাতের ৷ ও মাথা নিচু রেখে নিজের ভয় কাটানোর চেষ্টা করে চলেছে ৷ তবে সামনের মানুষটাকে দেখার কৌতূহলও ভীষণ হতে লাগল ৷ তাই ও ধীরে ধীরে চোখ তুলে সামনের মানুষটার দিকে তাকাল ৷ তাকাতেই একটা গম্ভীর মুখমন্ডল নজরে আসল ওর ৷ হঠাৎ সেই গম্ভীর মুখের মালিক ওর দিকে তাকাতেই ও চট জলদি চোখ সরিয়ে নিল ৷
এমন সময় জিমের বয়সী একটা ছেলে সেখানে চলে আসল ৷ সকলকে দেখে ওর ভ্রু কুঁচকে গেল ৷ ও এসেছিল জিমের সাথে খেলতে কিন্তু এখানে অন্য কাহিনী হচ্ছে দেখে প্লাবনের মনে কৌতূহল দেখা দিল ৷ ও জোবায়ের রহমানের কাছে গিয়ে বলল,,,
কার বিয়ে হতে চলেছে আঙ্কেল?
জোবায়ের রহমান নাম ভোলা রোগের কারনে বলে ফেললেন,,, জোৎস্নার বিয়ে ৷
কথাটা শুনতেই প্লাবনের চোখ কপালে উঠে গেল ৷ ও জিমের সাথে খেলার কথা ভুলে গেল কারন একজন কে ওর গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর দেওয়া বেশি জরুরি ৷ ওর গমনপথের দিকে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নাইমা রহমান কাটকাট গলায় বললেন,,,
জোৎস্না না রাতের বিয়ে ৷
জোবায়ের রহমান বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললেন,, একই হলো ৷
নাইমা রহমান কপাল কুঁচকে নিজের মাথামোটা স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন ৷ গালিব মেহতাব বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠে বসলেন ৷ অবশ্য সাথে ডাক্তারকেও নিয়েছেন ৷ ডাক্তার ছাড়া উনি কোথায় যান না বলে কথা ৷
দরজার কাছাকাছি যেতেই নিজের চোখের সামনে আরেকটা রাতকে দেখে উনি বুকে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন ৷ উনি একবার সামনের রাতকে দেখছেন তো একবার পিছনে বসে থাকা রাতকে দেখছেন ৷ এমন ভুতুড়ে দৃশ্য দেখে গালিব মেহতাব জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বললেন,,,
ডাক্তার এএ ডাক্তার আমার মনে হয় আবার হার্ট এ’ট্যাক হতে চলেছে! আমাকে কোলে তুলে নাও ৷
ডাক্তার টা দ্রুত এসে উনাকে জোরে জোরে শ্বাস নিতে বলল ৷ তা শুনে গালিব মেহতাব ডাক্তারের মাথায় একটা বাড়ি মে*রে বললেন,,,
আমার শ্বাস আটকে গেছে আর তুমি কিনা বলছো জোরে জোরে শ্বাস নিতে? বলি শ্বাস কি তোমার মতো বউয়ের কথায় ওঠে আর বসে নাকি? শ্বাস চলে শ্বাসের মতো আর আমি চলি আমার মতো ৷ ওর সাথে আমার কোনো বৈবাহিক সামাজিক অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই বুঝেছো তুমি?
কথাগুলো বলতে বলতে গালিব মেহতাব আরো জোরে বুক চেপে ধরলেন ৷ উনার অবস্থা দেখে উনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাত বলতে লাগল,,,
রিল্যাক্স আঙ্কেল আমি আপনার হবু বউমা না ৷ আমি রাতের জমজ বোন জোৎস্না ৷
জোৎস্নার কথা শুনে গালিব মেহতাবের শ্বাস পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসল ৷ তা দেখে জোৎস্না হাস্যজ্জ্বল মুখে উনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে রাতের পাশে গিয়ে বসল ৷ অতঃপর সামনের গম্ভীর ব্যক্তিটার উদ্দেশ্যে বলল,,,
এই যে দুলা ব্রো আমার বোনকে নিয়ে ছাদে যান ৷ কিছু মধুর আলাপ করুন ৷ এখানে এই বুড়ো বুড়ির মাঝে কি করছেন আপনি?
রাত চোখ বড় বড় করে বোনের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,,,
না আমি পুলিশের সাথে একলা কথা বলব না ৷
জোৎস্না বোনের কথাকে পাত্তা না দিয়ে ওকে ঠেলে বসা থেকে দাঁড় করাল ৷ গুরবাজ কোনো দ্বিধা ব্যতীত নিজেও উঠে দাঁড়াল ৷ রাত এখনও না যাওয়ার জন্য বোনের সাথে তর্ক করে চলেছে আর জোৎস্না জোর করে ঠেলাঠেলি করছে ৷ওদের দু বোনের নড়াচড়া বন্ধ হলো গুরবাজের কথায়,,,
ঠিক বলেছেন শালিকা ৷ যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি তার সাথে আলাদা ভাবে কিছু কথা বলে নেওয়া উত্তম ৷
জোৎস্না বিজয়ীর হাসি হেসে বলল,,, অবশ্যই ৷
বলে ও বোনকে গুরবাজের পিছনে ঠেলে দিল ৷ রাত আর কোনো উপায় না দেখে হৃৎপিন্ড হাতে নিয়ে পিছু পিছু হাঁটতে লাগল ৷ ওরা দুজনে ছাদের দিকে অগ্রসর হলে জোৎস্না মুচকি হেসে বলল,,,
এই ভীতুর ডিম টাকে সাহসী বানানোর জন্য পুলিশ দুলা ব্রোই পারফেক্ট আছে ৷
কথা শেষ হতে না হতেই ওর ফোন বেজে উঠল ৷ বড় রা উপস্থিত থাকায় ও বেলকনিতে চলে গেল ৷ ফোন এখনও বেজেই চলেছে ৷ জোৎস্না ধরার আগেই ফোন কেটে গেল ৷ আবারও বাজতে শুরু করল ৷ ফোনের স্ক্রিনে “টিউবলাইট” নামটা জ্বলজ্বল করছে ৷ সেটা দেখে জোৎস্নার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠল ৷ ও হাসি থামিয়ে ফোন রিসিভ করল ৷ অতঃপর কন্ঠটা গম্ভীর করে বলল,,,
কি চাই? এতো ফোন দিচ্ছেন কেন?
অপর পাশ থেকে নাক টানার শব্দ ভেসে আসছে সাথে ফ্যাচফ্যাচানি কান্না ৷ জোৎস্না কপাল কুঁচকে বলল,,,,
টিউবলাইটের কি চাকরি চলে গেছে?
এবার ক্রন্দনরত পুরুষালী এক কন্ঠস্বর ভেসে আসল,, মনে মনে সেই দোয়াই করছো তাই না? আমাকে তো কোনোকালেই পাত্তা দাওনি কিন্তু বলেছিলে চাকরি পেলে বিয়ে করবে তাহলে এখন এমন করছো কেন?
মানে? কি বলতে চাচ্ছেন?
এখন না বোঝার নাটক হচ্ছে? নিজের পুলিশ বরকে খুব মনে ধরেছে তাই না? অস্বীকার করবে না প্লাবন এসে আমাকে সব বলেছে যে তুমি পাত্রের সামনে দাঁত কেলিয়ে বসে ছিলে ৷
জোৎস্নার কাছে সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে গেল ৷ ওর হাসি যেমন পাচ্ছে তেমন মেজাজও খারাপ হচ্ছে ৷ কোনো কিছু যাচাই না করে শুধু ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নাই করতে পারে এই নিলয় যে ছোটবেলা থেকে জোৎস্নার প্রেমে পাগল ৷ ওকে আরেকটু রাগানোর জন্য জোৎস্না ইচ্ছা করে বলল,,,
হ্যাঁ মনে ধরেছে তো ৷ পুলিশ রাও যে এতো হ্যান্ডসাম হতে পারে সেটা আমি ভাবতেই পারিনি বুঝলেন? কি এটিটিউড ছেলেটার! উফফ জোশ ৷
নিলয় কান্না বাদ দিয়ে কর্কশ গলায় বলল,,, জোৎস্না কেন এমন করছো? আমি তোমাকে ভালোবাসি ৷ এমন তো না যে আমি বেকার ৷ আমার এখন চাকরি আছে খুব দ্রুতই তোমাকে বিয়ে করব আমি ৷ সত্যি বলছি জোৎস্না যদি তুমি ওই পুলিশকে বিয়ে করতে সম্মতি জানাও তাহলে আমি আগে তোমাকে খু**ন করব তারপর ওই পুলিশকে খু**ন করব!
নিলয়কে এই প্রথম এতো সিরিয়াস হতে দেখল জোৎস্না ৷ তাই ও মজা বাদ দিয়ে ওকে সত্যি কথা বলতে যাবে এমন সময় ফট করে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল ৷ ওর ফোনের চার্জ শেষ ৷ চার্জার টা নষ্ট হয়েছে তাই মেকানিকের কাছে দিয়ে এসেছে ৷
জোৎস্না বিরক্তিতে চ কারান্ত উচ্চারণ করে ফোনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,, শালাহ কম্পিউটারের অবৈধ বাচ্চা তুই একটু পর বন্ধ হতে পারলি না? এই হাদা টিউবলাইট না জানি এখন বিছানার নিচে গিয়ে ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না শুরু করে দেয়! তার আগে প্লাবনটাকে ফাটাতে হবে! ভুলভাল তথ্য পাচার করে টিউবলাইট এর শরীরে আ*গুন ধরিয়ে দিয়েছে শালাহ!
চলবে,,,,