গ্যারাকলে জোৎস্নারাত পর্ব-০২

0
917

#গ্যারাকলে_জোৎস্নারাত
#লেখিকা_সিনথিয়া_জাহান
#পর্বঃ২

পুরো ছাদ নিস্তব্ধ ৷ দূরের নীলচে আকাশে পাখিরা ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে ৷ সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে গুরবাজ সামনের অষ্টাদশী মেয়েটার দিকে দৃষ্টিপাত দিল ৷ রাত যেমন মাথা নিচু রেখে এসেছিল ঠিক তেমনই এখনও মাথা নিচু করে রেখেছে ৷ ওর একটা হাত ননস্টপ কাঁপতেছে যেটা ও অন্য হাত দিয়ে থামানোর চেষ্টা করে চলেছে কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না ৷ এতে করে রাত বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলল,,,

বে’য়াদব হাত তোর লজ্জা নেই? নিজে বেহায়া জন্য কি আমাকেও বেহায়া মনে করিস? এখনি কাঁপাকাঁপি থামাবি নয়তো তোর গলা টিপে ধরব নির্লজ্জ!

হাতের জীবন থাকলে ও নিশ্চয়ই বলে উঠত,,,, হাতের মাথাও থাকে? এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা জানিয়ে আমার অনেক উপকার করেছেন ৷ আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন ৷

রাতের কম্পমান হাতের দিকে তাকিয়ে গুরবাজ অস্পষ্ট হেসে বলল,,,

এখানে যে ভূমিকম্প হচ্ছে সেটা তো জানতাম না? কি আশ্চর্যজনক ঘটনা! আমি ভূমিকম্প অনুভব করছি না কেন?

ছাদে আসার পর এই প্রথম রাত গুরবাজের দিকে তাকাল তাও আবার গরম চোখে ৷ ওর চাহনি দেখে গুরবাজ অপরিবর্তিত মুখভঙ্গিতে বলল,,,

মিথ্যা বলেছি? তা তো মনে হচ্ছে না বরং আমার যে একটা সমস্যা হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি ৷ সমস্যাটা হচ্ছে আমি ভূমিকম্প টের পাচ্ছি না কেন?

রাত কাটকাট গলায় বলল,,, মজা করবেন না আমার সামনে ৷

আচ্ছা সামনে করব না ৷ আজ থেকে তোমার পিছনে মজা করব ৷

রাত কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকাল , কিছু বলল না ৷ তবে গুরবাজ চুপ থাকল না , ও বলতে লাগল,,,

যাক তোমার মুখ থেকে একটু কথা তো বের হলো ৷ আমি তো ভেবেছিলাম তুমি কথা বলতে পারো না ৷

রাত বুকে দু হাত গুজে অন্যদিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,,, আমি মানুষের সাথে কথা বলি ৷ কোনো পুলিশের সাথে না ৷

গুরবাজ আহাম্মক হয়ে বলল,,পুলিশরা কি মানুষ না? ওদের কি তোমার কাছে গরু ছাগল মনে হয়?

উহু মোটেও না ৷ গরু ছাগলও অনেক কিউট তবে আপনারা না ৷

কেন বলো তো?

কারন আপনারা মানুষ মা**রেন! ওদের বন্দী করে রাখেন ৷

গুরবাজ শান্ত গলায় বলল,,, আমরা খারাপ মানুষদের শাস্তি দিই, কোনো ভালো মানুষকে না ৷

রাত চকিতে গুরবাজের দিকে তাকিয়ে বিরোধিতা করে বলতে লাগল,,, মিথ্যা কথা ৷ আমি দেখেছি এক অসহায় বৃদ্ধ লোককে লাঠি দিয়ে মা*রতে! গত রবিবারেই দেখেছি ৷

গুরবাজ হতাশ শ্বাস ফেলে বলল,,, এখন আসামীদের মুখমন্ডল যদি ইনোসেন্ট হয় তাহলে আমাদের দোষ কোথায়? ওই বৃদ্ধ লোক নিজের সন্তানকে জ*ঘন্য ভাবে খু*ন করেছিল ৷ তো ওকে মা*রবে না তো কোলে তুলে ঘুমপাড়ানি গান শোনাবে?

রাত কয়েক সেকেন্ড সুক্ষ্ম নজরে গুরবাজের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,,, Whatever… তবুও পুলিশ খারাপ হুহহ!

গুরবাজ শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রাতের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,,,

বিয়ের পর আমাদের বাচ্চা তোমার ভুল ধারনা ভেঙে দিবে ৷

রাত বি**স্ফোরিত নয়নে গুরবাজের দিকে তাকিয়ে গড়গড় করে বলল,,,

আপনাকে আমি বিয়ে করব নাহ!

গুরবাজ ভ্রু নাচিয়ে বলল,,, কেন?

আপনি পুলিশ তাই ৷

শুধু একটা কারনে তো বিয়ে ভাঙব না আমি ৷ তোমাকে আরও কিছু কারন বলতে হবে ৷

রাত ক্ষণকাল চুপ করে থাকল মনে মনে আরো কিছু কারন খুঁজে বের করার জন্য ৷ পাক্কা দশ মিনিট গবেষণা করার পর রাত উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠল,,,,

পেয়েছি ৷

কি?

রাত বুকে দু হাত গুজে কাটকাট গলায় বলল,, আপনি হাসেন না ৷ যে মানুষ হাসে না তাকে আমি বিয়ে করব না ওকে?

গুরবাজ তৎক্ষণাৎ জবাব দিল,,, আমি হাসার জন্য একটুও সময় পাই না ৷ সারাদিন অনেক ব্যস্ত থাকি তাই হাসার জন্য সময় বের করতে পারি না ৷

রাতের চোয়াল ঝুলে গেল ৷ এই প্রথম কোনো মানুষের দেখা পেল যে নাকি হাসার জন্য সময় পায় না ৷ ও ভ্রু কুঁচকে বলতে লাগল,,,

বাথরুমে গেলেও তো একটু সময় পাওয়া যায় ৷ তখন কি করেন?

গুরবাজ গলা খাকারি দিয়ে বলল,,, ওখানে অন্য জরুরি কাজে যাই ৷ হাসার সময় কোথায়?

রাত আহাম্মক হয়ে গুরবাজের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ একটু পর গুরবাজ বলে উঠল,,,,

তুমি ফেইল ৷ তোমাকে নিম্নে দশটা কারন দেখানো উচিত ছিল যেহেতু তুমি ভাবার জন্য দশ মিনিট সময় নিয়েছিলে ৷ তাই বিয়েটা হচ্ছে ৷ বিয়ে নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা আমাদের পোটলাকে সময় করে বুঝিয়ে বলো ঠিক আছে?

রাতের মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে গেল ৷ ও বিরবির করে বলল,,,

কিসব বলছে এই লোক? মাথা টাথা খারাপ নাকি? এখন তো দেখছি আমার ছোটবেলার ধারনা টাই ঠিক ছিল ৷ পুলিশরা আসলে মানুষ না ৷ ওরা তারছেঁড়া পাগল কিসিমের প্রজাতি ৷

নিজের ভাবনা শেষ হতে না হতেই নিচ থেকে শোরগোল ভেসে আসতে লাগল ৷ রাত আর গুরবাজ একে অপরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দ্রুত নিচে নামতে লাগল ৷ ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখতে পেল বহু মানুষের আনাগোনা ৷ অবশ্য গালিব মেহতাব আর ডাক্তার ব্যতীত অতিরিক্ত চারজন মানুষ যুক্ত হয়েছে ৷

নিলয় উশকোখুশকো চুলে ,এলোমেলো জামাকাপড়ে, ফুলে যাওয়া লাল চোখে রাতের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ ওর এমন অবস্থা দেখে রাতের ভ্রু কুঁচকে গেল ৷ ও নিলয়কে চেনে , এই ছেলেটা জোৎস্নার পিছনে পাগল ৷ প্রতিদিন জোৎস্নাকে কল দিত যদিও জোৎস্না রিসিভ করতো না তবে মাঝে মধ্যে দু একবার কথা বলে মজা নিত দু বোনে ৷

রাত যতদূর জানে জোৎস্নাও মনে মনে নিলয়কে একটু একটু পছন্দ করে ৷ এবং খুব শীঘ্রই দুজনের বিয়ে হওয়ারও সম্ভাবনা আছে ৷ কিন্তু আজ নিলয়ের এমন অবস্থা দেখে ও পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ৷ নিলয় র*ক্তাভ চোখে একপলক গুরবাজের দিকে তাকিয়ে অতঃপর রাতের দিকে তাকাল এবং নি*নাদ করে বলল,,,

আমি ব্যতীত কেউ তোমাকে বিয়ে করতে পারবে না! তুমি নিজের কথার খেলাপ করতে পারো না ৷ তোমার স্বামী হবো একমাত্র আমি এবং আজই তোমাকে বউ বানিয়ে নিয়ে যাব আমি ৷

গুরবাজের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল ৷ ও অত্যন্ত কর্কশ কন্ঠে রাতকে জিজ্ঞাসা করল,,,

ছেলেটা কে? এসব কি বলছে?

রাত কিছু বলার আগে নিলয় বলে উঠল,,, খবরদার ওর সাথে কথা বলবেন না ৷ ওকে আমি ভালোবাসি আর ও নিজেও আমাকে ভালোবাসে ৷

গুরবাজ এবার ধমকে উঠে বলল,,, শাট আপ ৷ আমি আপনার সাথে কথা বলছি না ৷

বলে ও রাতের দিকে তাকিয়ে বলল,,, ওকে তুমি ভালোবাসো?

রাত এসব ঘটনায় ভয় পেয়ে গেল ৷ নিলয় যে ওকে জোৎস্না ভেবেছে সেটাও ও বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারল ৷ তাই ও আশেপাশে তাকিয়ে জোৎস্নাকে খুঁজতে লাগল ৷ কিন্তু ওর এই নিরবতা যে একজনকে ভীষণ পী*ড়া দিচ্ছে সেটা ও বুঝতে পারছে না ৷

গুরবাজ একদৃষ্টিতে রাতের ভীত মুখটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল ৷ অতঃপর গম্ভীর গলায় বলল,,,

বুঝতে পেরেছি ৷ ওসব কারন শুধুমাত্র অজুহাত ছিল ৷ আসল কারন তো এটা তাই না?

রাত জোৎস্নাকে খোঁজা বাদ দিয়ে চকিতে গুরবাজের দিকে তাকিয়ে বলল,,, কি বুঝেছেন আপনি?

যা বোঝার ছিল তাই বুঝেছি ৷

এসব ঘটনায় ওদিকে গালিব মেহতাব এখন পর্যন্ত ৩ থেকে ৪ বার হার্টের সাথে যুদ্ধ করেছেন ৷ উনি আবার বুকে হাত দিয়ে দুর্বল কন্ঠে বলতে লাগলেন,,,

আমার শ্বাস আজকে বে’য়াদব হয়ে গেছে! বারবার নাচানাচি করছে! বলছি এখানে আমার ছেলের বিয়ের কথা চলছে, তোর ছেলের না ৷

ডাক্তার টা বলতে লাগল,,, স্যার আপনার আজকে বারো বার শ্বাস টান উঠেছে ৷ আগামী এক বছরের শ্বাস টান আপনি একদিনেই কমপ্লিট করেছেন ৷ আপনাকে কনগ্রাচুলেশন ৷ আশা রাখছি আপনি এই রেকর্ড ভবিষ্যতে ভেঙে দিবেন ৷

গালিব মেহতাব নিজের ধড়পড় করতে থাকা বুককে সাইডে রেখে ডাক্তারের কান টেনে ধরে বলতে লাগলেন,,,

এখানে আমি ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলছি না যে রেকর্ড গড়ব! তোমাকে ডাক্তার কে বানিয়েছে আহাম্মক? আর তোমাকে আমার জন্য কোন মাথামোটা এপয়েন্ট করেছিল?

ডাক্তার টা নিজের কান ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁত বের করে বলল,,,

স্যার আপনি ৷

গালিব মেহতাব খুব একটা লজ্জা পাওয়ার সময় পেলেন না রাতের কথা শুনে ৷ রাত গুরবাজের কথার বিপরীতে বলে উঠল,,,

আমি কোনো অজুহাত দিইনি ৷আর সবচেয়ে বড় কথা আমি উনাকে ভালোবাসি না ৷

রাতের কথায় গুরবাজ খানিকটা স্বস্তি পেলেও নিলয় অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলতে লাগল,,,

এভাবে ধোকা দিতে চাচ্ছ আমাকে? তোমার যদি এই পুলিশের চাকরি পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে আমাকে বলো আমিও এই চাকরি পাওয়ার জন্য যা যা করা লাগে তাই করব তবুও তোমাকে আমার চাই ৷

গুরবাজ অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলল,,, জাস্ট সাট আপ ৷

নিলয়ও গম্ভীর গলায় জবাব দিল,,,,,,, ইউ সাট আপ ৷ আপনি আমাদের মাঝে কথা বলবেন না ৷

ওরা দুজন বেশ রেগে গেছে ৷ ওদের মাঝে কথা কাটাকাটি চলতে লাগল ৷ এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে জোৎস্না ড্রয়িংরুমে চলে আসল ৷ ও এতোক্ষণ ওর ফোনের জন্য চার্জার খুঁজছিল ৷ অনেক খোঁজার পর চার্জার পেলে ও ফোন চার্জে লাগিয়ে নিলয়কে কল করার চেষ্টা করছিল কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছিল না ৷ তখন এসব চেঁচামেচি কানে যেতেই ও দ্রুতপদে এখানে চলে এসেছে ৷

সমস্ত ঘটনা চুপচাপ দেখার পর জোবায়ের সিদ্দিকী নিলয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

তুমি জিমকে বিয়ে করতে চাও?

সোফায় কপাল কুঁচকে বসে থাকা জিম বাবার কথা শুনে বিরক্তিতে চোখমুখ খিচিয়ে বলে উঠল,,,,,,, বাবা জিম আমি ৷ এখানে আপুর কথা চলছে!

জোবায়ের সিদ্দিকী নিজের ভুল ঢাকার জন্য কিছু লজিক শোনাতে যাবেন ঠিক তখন নাইমা রহমান উনাকে থামিয়ে দিয়ে নিলয়কে বললেন,,,

তুমি রাতকে ভালোবাসো?

নিলয় , জোৎস্না আর রাত একসাথে বলে উঠল,,, নাহ ৷

সবাই ওদের তিনজনের দিকে হতভম্ভ চোখে তাকাল ৷ আবারও গালিব মেহতাবের শ্বাস টান উঠে গেছে তবুও উনি ঘটনার দিকে মনোযোগ অব্যাহত রাখলেন ৷ নিলয় নিজের হতভম্ভ ভাব কাটিয়ে বলল,,,

আমি জোৎস্নাকে ভালোবাসি ৷আপনারা ওই পুলিশের সাথে জোৎস্নার বিয়ে দিতে পারবেন না আমি বেঁচে থাকতে ৷

গুরবাজ কাটকাট গলায় বলল,,, তার প্রয়োজনও পড়বে না কারন আমি জোৎস্নাকে নয় বরং রাতকে বিয়ে করতে চাই ৷

সকলে আহাম্মক হয়ে কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকল ৷ অবশেষে গালিব মেহতাবের শ্বাস নিয়ন্ত্রণে আসল ৷ উনি বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে আরাম করে বসলেন ৷ সবার কাছে সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে গেছে ৷

নিলয় কটমট দৃষ্টিতে প্লাবনের দিকে তাকাতেই প্লাবন কাচুমাচু মুখে বলল,,,

আমি নির্দোষ ৷ জোবায়ের আঙ্কেল বলেছে যে জোৎস্না আপুর বিয়ে ৷

সবাই এবার কঠিন দৃষ্টিতে জোবায়ের সিদ্দিকীর দিকে তাকাল ৷ সবার চাহনি দেখে উনি শিস বাজাতে বাজাতে আশেপাশে তাকাতে লাগলেন ৷ জোৎস্না ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নজর সরিয়ে নিল ৷ এবার ওর নজর নিলয়ের দিকে গেল ৷ ওকে দেখে জোৎস্না মনে মনে বলল,,,

আমার টিউবলাইটের দেখছি সাহসও আছে ৷ এই সাহসগুলো কি এতোদিন সোকেজে তুলে রেখেছিলেন নাকি?

চলবে,,,,