#গ্যারাকলে_জোৎস্নারাত
#লেখিকা_সিনথিয়া_জাহান
#পর্বঃ৪
পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে রাত ফজরের নামাজ আদায় করে নিল ৷ তারপর বেলকনিতে গিয়ে ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস অনুভব করতে লাগল ৷ কাল না বলার পর ওর গুরবাজের সাথে আর কথা হয়নি এবং কথা বলার কোনো ইচ্ছাও ওর নেই ৷
আরো কিছুক্ষণ প্রকৃতির সাথে একাকী সময় কাটানোর পর রাত নিচে চলে গেল মাকে রান্নায় সাহায্য করার জন্য ৷ নাইমা রহমান মেয়ের সাথে হাসি ঠাট্টা করতে করতে রান্না সম্পুর্ণ করতে লাগলেন ৷ অন্যদিকে জোৎস্না জিমের সাথে বসে ওকে পড়ায় সাহায্য করে দিচ্ছে ৷ আর মাঝে মাঝে মেজাজ হারিয়ে জোৎস্না জিমের মাথায় চাটি মা**রতেও ভুল করছে না ৷
জোবায়ের সিদ্দিকী সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলেন ৷ ভাই বোনের থেকে চোখ সরিয়ে উনি সোফায় বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাতে লাগলেন ৷ ওদিকে জোৎস্না জিমের গালে একটা হোটা মে*রে বলল,,,
গাধার গাধা এই ব্রেন নিয়ে তুই পড়াশোনা করার মতো সাহস দেখিয়েছিস? তোর বুকের পাটা আছে মানতে হবে!
জিম গালে হাত বোলাতে বোলাতে ভ্রু কুঁচকে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,,,
বোনের ব্রেন যেমন ভাইয়ের ব্রেনও তেমন ৷ তুমি যদি ওই ব্রেন দিয়ে পড়াশোনা করতে পারো তাহলে আমিও পারি ৷ তবে তোমার মতো অন্তত ৩৩ মার্ক পেয়ে পাস করব না আমি!
জোৎস্না থতমত খেয়ে গেল কিন্তু উপরে বুঝতে দিল না যে ও লজ্জা পাচ্ছে ৷ ও অত্যন্ত ভাব নিয়ে বলতে লাগল,,,
আরে পাগলা পরীক্ষার হলে গিয়ে আমার সেদিন প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছিল তাই পরীক্ষা অর্ধেক দিয়ে চলে এসেছিলাম ৷ নয়তো সব প্রশ্ন আমার কমন ছিল ৷ যদি ক্ষুধা না লাগত তাহলে দেখতি ১০০ এর মধ্যে স্যার আমাকে খুশি হয়ে ১০৫ মার্ক দিতে বাধ্য হতো! আর সবচেয়ে বড় কথা ৩৩ পেলেও পাশ আর ৯০ পেলেও পাশ তো অযথা পেটকে অগ্রাহ্য করে আমি পরীক্ষাকে কেন এতো মূল্য দিতে যাব রে?
ওর দিকে চোখ সরু করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিম বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিল ৷ জোৎস্না গর্বিত মুখে ক্ষণকাল বসে থাকল কিন্তু জিমের থেকে পাত্তা না পেয়ে ও হতাশ শ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,,,
এতো ঢপ মা**রলাম তবুও পাত্তা দিল না ছ্যাহ!
জোবায়ের সিদ্দিকী খবরের কাগজ খানিকটা সরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,,,,
সামনে তোমার বিয়ে হতে চলেছে ৷ এখন অন্তত চাটু মা*রা বন্ধ করো জিম!
জিম আর জোৎস্না চকিতে বাবার দিকে তাকাল ৷ এক মিনিট লাগল ওদের আসল বিষয়টা বুঝতে ৷ বোঝার সাথেই জিম হু*ঙ্কার করে বলল,,,
বাবা আর একবার যদি আমার নামের সাথে বিয়ের প্রসঙ্গ তোলো তাহলে সত্যি করে বলছি আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব! আমি ওই রামছাগল দুটোকে বিয়ে করতে পারব না!
ভাইয়ের অবস্থা দেখে জোৎস্না জোরে জোরে হাসতে লাগল ৷ যদিও শেষে জিম, নিলয় আর গুরবাজকে অপমান করেছে তবুও জোৎস্নার হাসি থামছে না ৷ ও বেশ মজা পেয়েছে জিমের মুখভঙ্গি দেখে ৷ ওদিকে জোবায়ের সিদ্দিকী থতমত খেয়ে গেছেন ৷ উনি নিজের ভুল স্বীকার না করে বললেন,,,,
বারে আমি তোমাকেই বলেছি ৷ সামনে তো তোমারও বিয়ে হবে যদিও সেটা অনেক বছর পর তবুও হবে তো নাকি? তোমরা অযথা ভুল বোঝো আমাকে ৷ আমি কি আমার বাচ্চাদের নাম ভুলতে পারি?
জিম ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল ৷ এই বাড়ির এই দুই ব্যক্তির সাথে জিম পেরে ওঠে না কারন এরা দুজন জীবনেও নিজের ভুল স্বীকার করে না বরং আলতু ফালতু লজিক দেখিয়ে নিজেদের ভুল ঢাকার চেষ্টা করে ৷ তাই জিমও বেশি কথা বাড়ায় না ৷ বয়স কম হলেও বুদ্ধি পরিমাণের তুলনায় একটু বেশিই পেয়েছে ও ৷
জিম চুপচাপ থাকলেও জোৎস্নার হাসি চুপ হচ্ছে না বরং সময়ের সাথে সাথে সেটা আরো বেড়ে চলেছে ৷ তা দেখে জোবায়ের সিদ্দিকীর একটু একটু মানে অল্প একটু লজ্জা লাগছে ৷ তাই উনি গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলেন,,,,
হাসি থামাও জোনাকি ৷ জিমকে বলা কথাটা তোমার উপরেও বর্তায় ৷ তোমার দ্রুত বিয়ে হতে চলেছে ৷ এবার অন্তত নিজের আচরণ অল্প একটু নমনীয় করো ৷
জোৎস্নার হাসি থেমে গেল ৷ ও শান্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকল ৷ এই প্রথমবার জিম হাসতে লাগল ৷ জোবায়ের সিদ্দিকীর ভ্রু কুঁচকে গেল ৷ উনি ভেবে পাচ্ছেন না জিমের হাসির কারন কি হতে পারে ৷ উনি তো হাসার মতো কিছু বলেননি তাই না?
জোৎস্না কাটকাট গলায় বলল,,, জোৎস্না ইট’স জোৎস্না নট জোনাকি পোকা ৷ তবে তুমি এই নামটা রাখতে চাইলে একটা গরু কোরবানি দাও তারপর সে নামে ডেকো ৷ তার আগে না ৷
জোবায়ের সিদ্দিকী দ্বিতীয় দফায় থতমত খেয়ে গেলেন ৷ এবার আর লজিক খুঁজে পেলেন না তাই মুখ লুকানোর জন্য খবরের কাগজ সামনে রেখে সেটা মনোযোগ দিয়ে পড়ার অভিনয় করতে লাগলেন ৷ জিম এখনও হাসছে ৷ তা দেখে জোৎস্না ওর মাথায় চাটি মে*রে বলল,,,
হাসি থামা নয়তো তোকে থামিয়ে দিব নিলয় আর গুরবাজের বউ!
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
সকালের খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ করে সকলে বাগানে গিয়ে বসে পড়ল ৷ আজ ছুটির দিন তাই জোৎস্না চিলমুডে গল্প করার পাশাপাশি ফোন স্ক্রলিং করছে ৷ হঠাৎ সময়ের দিকে নজর যেতেই ওর পিলে চমকে উঠল ৷ ১০ টা বাজতে আর মাত্র ২০ মিনিট বাকি ৷
রাত জিমের সাথে গাছে পানি দিচ্ছিল ৷ জোৎস্না দ্রুত ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,,,
রাত একটু শোন ৷
গাছে পানি দেওয়া বাদ দিয়ে রাত পিছু ঘুরে বলল,,, কি?
জোৎস্না রাতের হাত ধরে আদুরে গলায় বলল,,, একটা কাজ করে দিবি?
রাত ভ্রু কুঁচকে বলল,,, বাইরে যাওয়ার মতো কোনো কাজ আমাকে করতে বলবি না ৷ আমি আজ বাগানে সময় কাটাতে চাই ৷
জোৎস্না হতাশ হলেও হাল ছেড়ে দিল না ৷ ও বোনের হাত আরো শক্ত করে ধরে বলল,,,
সোনা বোন আমার একটা বার্গার কিনে এনে দে ৷ পাশেই তো আছে ৷ বেশি সময় লাগবে না প্লিজ যাহ ৷ আমিই যেতাম কিন্তু আমার শরীর টা আজ ভালো লাগছে না ৷
তোর কি হয়েছে?
জানি না রে? ক্ষণে ক্ষণে খেতে ইচ্ছা করে ৷ আর মানুষ দেখলে তাদের সাথে বিনা কারনে ঝগড়া করতে ইচ্ছা করে ৷ তাই তোকে যেতে বলছি ৷
রাত ক্ষণকাল বোনের দিকে তাকিয়ে থেকে পুনরায় গাছে পানি দিতে দিতে বলল,,,
বাড়িতে অনেক খাবার আছে ৷ সেগুলো খা ৷
না আমার বার্গার ই চাই ৷
তাহলে বাবাকে বল এনে দিবে ৷
দূর আর যাই বল কিন্তু বাবাকে বলার কথা বলিস না ৷ দেখা যাবে বার্গারের জায়গায় চিংড়ি মাছ এনে হাতে ধরিয়ে দিবে! নিজের ব্যক্তিগত বাচ্চাগুলোর নাম মনে থাকে না সেখানে বার্গারের নাম মনে রাখার আশা করা বিলাসিতা মাত্র ৷
ঠিক আছে ঠিক আছে এনে দিব ৷ তবে এখন না ৷ বিকেলের দিকে গিয়ে অনেকগুলো বার্গার এনে দিব ৷
জোৎস্না ভ্যাবাচ্যাকায় পড়ে গেল ৷ বিকেলে গেলে তো হবেনা ৷গুরবাজ হয়তো ইতোমধ্যে কাছাকাছি চলে এসেছে ৷ চিন্তাতে চিন্তাতে জোৎস্নার মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম ৷ হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসায় ও বুকে হাত চেপে ধরে মিথ্যা আ**র্তনাদ করে বলতে লাগল,,,
রাত রে আমার মনে হয় গালিব আঙ্কেলের মতো আবারও শ্বাস টান উঠে যাচ্ছে! দ্রুত বার্গার এনে দে আমায় নয়তো নিজের ডুপলিকেট মানুষটাকে আর নাও দেখতে পারিস ৷
রাত ভ্রু কুঁচকে বোনের নাটক দেখতে লাগল ৷ ও জানে জোৎস্না নাটক করছে তবুও বার্গার আনতে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল ৷ ও রাজি হতেই জোৎস্না উচ্ছ্বসিত হতে বলে উঠল,,,,
যাহ যাহ দ্রুত বোরকা পড়ে রেস্টুরেন্টে যা ৷
যদিও জানে তবুও রাত জিজ্ঞাসা করল,,, একটু আগে না তোর শ্বাস টান উঠে যাচ্ছিল? এখন এতো স্বাভাবিক হলি কিভাবে?
জোৎস্না তৎক্ষণাৎ পুনরায় বুকে হাত চেপে বলল,,, হচ্ছে তো এখনও হচ্ছে কিন্তু তুই বার্গার আনতে রাজি হওয়ায় শ্বাস একটু নরমাল হয়েছে ৷ তুই এসব বুঝবি না ৷ সো দ্রুত বার্গার কিনতে যা ৷ তোর হয়ে আমি গাছে পানি দিচ্ছি ৷
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
রাত ১০ টা ১০ মিনিটে রেস্টুরেন্টে পৌঁছাল ৷ সোজা গিয়ে ও একটা বার্গার কিনতে লাগল ৷ ওর ঠিক উল্টো দিকে গুরবাজ তার একজন সহকারী অফিসারের সাথে এসেছে ৷ আজ গুরবাজ পুলিশের ইউনিফর্ম পড়েনি বরং ব্লু শার্টের সাথে সাদা প্যান্ট পড়েছে ৷ ওকে আজ একটু অন্যরকম ই লাগছে ৷ গুরবাজের সহযোগী অফিসার কালু মিয়া বলে উঠল,,,,
স্যার আপনাকে দেখলেই আমি ক্রাশ খাচ্ছি ৷ মুখে একটা মাস্ক পড়ে নিন ৷
গুরবাজ কঠিন দৃষ্টিতে তাকাতেই কালু মিয়ার কৌতুকময় মুখটা মুহূর্তেই চুপসে গেল ৷ ও বিরবির করে বলতে লাগল,,,,
নিজের রূপ সবাইকে দেখাতে চান সেটা সরাসরি বললেই হয় ৷ মাস্ক পড়তে বলায় আমার দিকে ওমন দৃষ্টিতে তাকানোর কোনো মানে আছে? আমার বুঝি ভয় করে না?
গুরবাজ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,, কি ফাসুর ফুসুর করছো?
কালু মিয়া থতমত খেলেও দ্রুত জবাব দিল,,, যাই ভাবি না কেন কিন্তু আপনার বিষয়ে কিছু ভাবছিলাম না ৷
গুরবাজ শান্ত চোখে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকল ৷ এতে করে কালু মিয়া ভয়ে একটা ঢোক গিলল ৷ অতঃপর এপাশ ওপাশ তাকাতে তাকাতে বলল,,,
আমার দিকে না তাকিয়ে ম্যামকে খুঁজুন স্যার ৷ উনি না আবার আসামীর মতো ফুরুৎ করে হাত থেকে ফসকে যায়!
গুরবাজ কাটকাট গলায় জবাব দিল,,, আমার হাত তোমার মতো না ৷ চোরের মতো হাতে সরিষার তেল মাখলে আসামী হাত ফসকে পালাবে না তো আঠার মতো চিপকে থাকবে?
ওরা দুজন এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে লাগল ৷ ওদিকে রাত বার্গার কেনা শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় ওর নজর গুরবাজের দিকে গেল ৷ সাথে সাথে ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেল এবং গুরবাজের সাথে কালকের বলা কথাগুলোও মনে পড়ে গেল ৷ ও দ্রুতপদে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে ধরলে গুরবাজ আর কালু মিয়া দরজার সম্মুখের দিকে চলে গেল তাই রাত উল্টো ঘুরে একটা টেবিলের নিচে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল ৷
টেবিলের নিচে থেকে দেখল দু জোড়া পা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল ৷ তা দেখে রাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে টেবিলের নিচ থেকে মাথা বের করতেই গুরবাজকে দেখতে পেল ৷ ওকে দেখে ভুত দেখার মতো ভয় পেয়ে রাত চিৎকার করে উঠল ৷ তারপর তাড়াহুড়ো করে টেবিলের নিচে থেকে বেরোতে ধরে মাথায় ব্যা*থাও পেল ৷ গুরবাজ ওর অবস্থা দেখে বলল,,,
হেই রিল্যাক্স ৷ বাই দা ওয়ে টেবিলের নিচে কি করছিলে তুমি?
রাত আমতা আমতা করে বলতে বলল,, ক-কই কিছু না ৷ একটু দেখলাম টেবিলের নিচে থেকে রেস্টুরেন্ট টা কেমন দেখায় ৷
গুরবাজ আহাম্মক হয়ে রাতের দিকে তাকাল আর রাত ৩২ পাটি দাঁত বের করে জোরপূর্বক হাসতেছে ৷
চলবে,,,,,