#গ্যারাকলে_জোৎস্নারাত
#লেখিকা_সিনথিয়া_জাহান
#পর্বঃ৫
ক্ষণকাল পিনপতন নিরবতা বিরাজমান থাকল ৷ রাত এখনও দাঁত বের করে হাসতেছে ৷ গুরবাজ আহাম্মক হয়ে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,,,
ওয়াও ৷ তা কেমন দেখলে?
অসাধারণ ভিউ ৷ বিশ্বাস না হলে আপনিও দেখতে পারেন ৷
থাক তুমি দেখেছো তাতেই হবে ৷ আমি তোমাকে বিশ্বাস করি ৷ রেস্টুরেন্ট দেখা শেষ হয়ে থাকলে চলো বসা যাক ৷
রাতের বুক ধুকপুক করতে লাগল ৷ ও গুরবাজের সাথে এক মুহূর্ত সময় কাটাতেও রাজি না ৷ এভাবে বার্গার কিনতে এসে ফেঁসে যাবে সেটা ও ভাবতেই পারেনি ৷ তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে কিছু জটলা পাকাতে লাগল ৷ হঠাৎ একটা বুদ্ধি আসায় ও গলা খাকারি দিয়ে বলল,,,
আমাকে যা ভাবছেন তা আমি না ৷আমি রাত না আমি জোৎস্না ৷
বলে ও নিজেকে যথাসম্ভব জোৎস্নার মতো আত্মবিশ্বাসী করার প্রয়াসে মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে আনল ৷ ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গুরবাজ অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল,,,
মজা করার মুডে নেই ৷ দ্রুত আমার পিছন পিছন চলে আসো রাত ৷
আরে আমি জোৎস্না ৷ আমি আপনার শালী , বউ না ৷
গুরবাজ বাকা হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,,, যাক এই ওসিলায় নিজেকে আমার বউ তো বললে ৷ বেশি অভিনয় করতে হবে না আমি জানি তুমি রাত ৷ সো পিছু পিছু আসো ৷
বলে গুরবাজ হাঁটতে শুরু করল ৷ রাত হতভম্ভ হয়ে ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকল ৷ ওদের দু বোন কে ওদের মা ব্যতীত আর কেউ চিনতে পারে না ৷ যদিও বৈশিষ্ট্য দেখে বোঝে কোনটা রাত আর কোনটা জোৎস্না ৷ কিন্তু রাত তো আজ প্রথমবারের মতো জোৎস্নার মতো আজব কথাবার্তা বলেছে তবুও গুরবাজ কিভাবে চিনতে পারল?
এসব চিন্তায় ভাটা পড়ল গুরবাজের ডাকে ৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাত ওর দিকে এগিয়ে গেল ৷ গুরবাজ নির্দিষ্ট একটা আসনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ৷ রাত চলে আসতেই ও হাত বাড়িয়ে ওকে আসন গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাল ৷ রাত দুরু দুরু বুকে বসে পড়ল ৷ গুরবাজও ওর সম্মুখে গিয়ে বসল ৷
ওয়েটারকে ডেকে গুরবাজ অর্ডার দিয়ে দিল ৷ অর্ডার দেওয়া শেষে সামনে তাকাতেই দেখল রাত নিচু করে বসে আছে ৷ তা দেখে ও গলা খাকারি দিয়ে বলল,,,
আজ তো পুলিশ হয়ে আসিনি তবুও মাথা নিচু করে রাখবে?
রাত এক মিনিট পর কাটকাট গলায় বলল,,, মিথ্যা কথা বলছেন কেন? পুলিশ না হয়ে আসলে পিছনের জন কে? মনে হচ্ছে আমি কোনো ভুল করলেই উনি আমাকে জেলে বন্দী করে রাখবেন ৷
গুরবাজের ভ্রু কুঁচকে গেল ৷ ও চকিতে পিছু ঘুরে তাকাল ৷ দেখতে পেল কালু মিয়া ৩২ পাটি দাঁত বের করে ওর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ৷গুরবাজ নরমাল ড্রেসে আসলেও কালু মিয়া পুলিশের ইউনিফর্ম পড়েই এসেছে ৷ ওর দিকে তাকাতেই গুরবাজের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ৷ ও বিরক্তিতে চ কারান্ত উচ্চারণ করে বলল,,,
আশ্চর্য! তুমি আমার পিছু ছাড়ছো না কেন?
কালু মিয়া অমায়িক হেসে বলতে লাগল,,, আপনার সুরক্ষার দায়িত্ব আমার উপরে স্যার ৷ আপনাকে আমি এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল হতে দিব না ৷ আপনি যেখানে আমি সেখানে ৷ বাথরুমে গেলেও আমাকে সাথে নিয়ে যেতে হবে আপনাকে ৷
হ্যাঁ বাসরঘরেও যেও স্টুপিড কোথাকার!
কালু মিয়ার দাঁত আরো প্রসারিত হয়ে গেল ৷ও লাজুক হেসে বলতে লাগল,,,
আপনি অনুমতি দিলে যাব স্যার ৷ কোনো সমস্যা নেই আমার ৷
গুরবাজ এবার ভীষণ রেগে গেল ৷ ধমকে উঠে বলল,,,
ননসেন্স! এক্ষুণি আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাও ৷ তোমাকে যেন আমার আশেপাশে না দেখি ৷ অন্তত আজকে ৷
ওর ধমকে কালু মিয়ার দাঁত বন্ধ হয়ে গেল ৷ ও দ্রুত জায়গা প্রস্থান করল ৷ ওর থেকে চোখ সরিয়ে গুরবাজ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে কন্ঠটা স্বাভাবিক করল ৷ অতঃপর রাতের দিকে তাকাল ৷ রাত হতভম্ভ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ৷ তা দেখে গুরবাজ কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাত বলে উঠল,,,
আপনি ভীষণ নি**র্লজ্জ আর অ**সভ্য!
গুরবাজ ক্ষণকাল চুপ থেকে থেকে গালে হাত দিয়ে রাতের দিকে তাকাল ৷ তারপর শান্ত গলায় বলল,,,
যেমনই হই না কেন আমি টা কিন্তু তোমার মালিকানা ৷
রাত তৎক্ষণাৎ মাথা নামিয়ে নিল ৷ এই ছেলে দ্রুতই টপিক বদলানোর মতো ট্যালেন্ট নিয়ে ঘোরে ৷ ওকে লজ্জা পেতে দেখে গুরবাজ বলতে লাগল,,,
লজ্জা না পেয়ে আমার দিকে একটু তাকাও ৷ সত্যি বলছি আজ সামনে কোনো পুলিশ দেখতে পাবে না ৷
রাত তবুও মাথা তুলল না ৷ হঠাৎ পাশে চোখ যেতেই ওর লজ্জা আর অস্বস্তি হারিয়ে গেল এবং ভীষণ হাসি পেল ৷ কালু মিয়া এতো ধমক খেয়েও যায়নি ৷ ও এই টেবিলের থেকে খানিকটা দূরে আরেকটা টেবিলে বসে আছে সামনে খবরের কাগজ নিয়ে ৷ নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা এই আরকি ৷ তবুও খবরের কাগজ নিচু করে শুধুমাত্র চোখ দুটো বের করে ওদের দিকে বারবার নজর দিতেও ভুলছে না কালু মিয়া ৷
ওর অবস্থা দেখে রাতের সত্যি ভীষণ হাসি পেল কিন্তু হাসা ঠিক হবে না ভেবে হাসি আটকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে লাগল ৷ তবুও হাসি বাইরে চলেই এলো ৷ ও মৃদু মৃদু হাসতে লাগল ৷ ওকে হাসতে দেখে গুরবাজ এর ভ্রু কুঁচকে গেল ৷ ব্যাপার টা কি দেখার জন্য ও রাত যেদিকে তাকিয়ে হাসছিল সেদিকে তাকাল ৷ ও তাকানোর সাথেই কালু মিয়া নিজেকে খবরের কাগজের বিপরীতে লুকিয়ে ফেলল ৷
কিন্তু গুরবাজের চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না ৷ ও কটমট দৃষ্টিতে কালু মিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল ৷ ওদিকে রাত এবার জোরেই হেসে ফেলল ৷ হাসতে হাসতে ওর চোখ হঠাৎ গুরবাজের দিকে চলে গেল যে এখনও কঠিন দৃষ্টিতে কালু মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে ৷
রাতের নজর সবেমাত্র গুরবাজের দিকে ভালোভাবে চলে গেল ৷ সত্যি আজ কোনো পুলিশ ওর সামনে দাঁড়িয়ে নেই বরং সাধারণের মধ্যে একজন অসাধারণ পুরুষ ওর সামনে বসে আছে ৷ প্রথমবারের মতো রাতের মনে হলো ছেলেটা দেখতে খুব একটা খারাপ না যদিও সেটা এক মিনিটের মতো মনে হলো ৷
গুরবাজ ওর দিকে তাকাতেই রাত আশ্চর্যজনক এক কথা বলে উঠল,,,,
ও আপনি তাহলে মানুষ?
গুরবাজের কঠিন মুখটা মুহূর্তেই আহাম্মক হয়ে গেল ৷ মানে এমন একটা প্রশ্নের কি উত্তর দেওয়া উচিত সেটা ওর জানা নেই ৷ জন্মের পর এমন প্রশ্ন কেউ করেনি তো তাই কোনো অভিজ্ঞতা নেই ৷ তবুও নিজেও অদ্ভুত একটা উত্তর দিল,,,
এতোদিন বাবা বলতো আমি নাকি গন্ডার ৷ আমিও জানতাম না যে আমি একজন মানুষ ৷ আমার আসল পরিচয় জানানোর জন্য তোমাকে জাযাকিল্লাহ রাত সিদ্দিকী ৷
এবার রাত থতমত খেয়ে গেল ৷ ও ইচ্ছা করে প্রশ্নটা করেনি ৷ হুট করে বিনা অনুমতিতে মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ৷ ও সম্পূর্ণ নির্দোষ ৷ ওদের এমন উদ্ভট পরিস্থিতিতে হঠাৎ কোথা থেকে নিলয় হন্তদন্ত হয়ে রাতের সম্মুখে এসে বলতে লাগল,,,
আমার সতীন বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছো দেখছি!
রাত হঠাৎ এমন প্রশ্নে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল ৷ নিলয় রাগত মুখে রাতের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ ওর নজর এখনও গুরবাজের দিকে যায়নি ৷ ওর কনফিউজন ক্লিয়ার করার আগেই ও পুনরায় বলতে লাগল,,,
এই জন্যেই আমার ফোন ধরছিলে না তাই না? সেদিন ওই পুলিশের সৌন্দর্যের কি প্রশংসাই না করলে! এখন আবার নতুন আরেকজনের প্রশংসা করতে এসেছো?
কথাটা বলতে বলতে নিলয়ের ঠোঁট উল্টে আসল ৷ কান্না করার পূর্ব মুহূর্তে যেমন অবস্থা হয় আরকি ৷ ও কম্পিত গলায় বলতে লাগল,,,,
আ-আমি প্রতিদিন জিম করে এতো সুন্দর বডি বানালাম কিন্তু তুমি আমার প্রশংসা করো না ৷হোয়াই? আই ওয়ান্ট উত্তর ৷
গুরবাজ বসা থেকে উঠে নিলয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল,,,
রিল্যাক্স ব্রাদার ৷ কি সমস্যা তোমার? আমার বউয়ের কাছে নালিশ করে লাভ আছে?
গুরবাজকে দেখতেই নিলয়ের অস্থির স্বত্ত্বা শান্ত হয়ে গেল ৷ ও ভ্রু কুঁচকে একপলক গুরবাজের দিকে তাকাল তো এক পলক রাতের দিকে তাকাল ৷ ওর অবস্থা দেখে গুরবাজ বলতে লাগল,,,
এটা আমার টা ৷ তোমার টা বাড়িতে আছে ৷ সেখানে গিয়ে অভিযোগ জানাও ৷ বিয়ে করতে চাচ্ছ অথচ নিজের বউকে চিনো না এটা ভীষণ লজ্জার কথা!
নিলয় থতমত খেয়ে গেল ৷ পর মুহূর্তে গলা খাকারি দিয়ে বলতে লাগল,,,
কেমন লাগল আমার অভিনয়?
গুরবাজ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,, মানে?
নিলয় দাঁত কেলিয়ে বলল,,, মানে আমি ইচ্ছা করে এমন করছিলাম ৷ দেখলাম তোমরা চমকে গেলে ঠিক কেমন লাগে ৷
রাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,,জোৎস্নার মতোই নিজের ভুল ঢাকার জন্য আউল ফাউল লজিক দেখানো শুরু করেছে ছ্যাহ!
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
নিলয় কোনোমতে নিজের সম্মান হাতে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো ৷ ও আর যাই হোক ওই পুলিশের সাথে কোনোভাবেই হারতে চায় না ৷ তাই জান হাতে নিয়ে পালিয়ে এসেছে ৷ ও আর একবার রেস্টুরেন্টের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলতে লাগল,,,
মানুষ জমজ হয় ঠিক আছে কিন্তু তাই বলে এতোটা জমজ? কন্ঠ, মুখ, হাঁটা চলা সব একই রকম ৷ কোনো পার্থক্য নেই ছ্যাহ! শুধু স্বত্ত্বা টাই আলাদা ৷ তবে যাই বলো না কেন আমার জোৎস্না বেস্ট ৷
কথাটা বলে নিলয় লাজুক হাসল ৷ হঠাৎ মাথার মধ্যে এক নতুন চিন্তার উদ্যোগ হতেই ও ফটাফট ফোন বের করে জোৎস্নাকে কল দিল ৷ এবার কিছুক্ষণের মধ্যেই রিসিভ হলো ৷ রিসিভ হতেই নিলয় বলতে লাগল,,,
দেখাদেখির সুন্দর পর্ব শুরু হয়ে গেছে অথচ আমাকে তুমি ডাকলে না?
জোৎস্না ভ্রু কুঁচকে বলল,,, মানে?
মানে তোমার বোন আর ওই পুলিশ রেস্টুরেন্টে সুখ দুঃখের আলাপ করছে ৷ আমরা করব না? এটা মান সম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে জোৎস্না!
জোৎস্না দাঁত কপাটি বের করে বলল,,, বাহ ওরা কথা বলছে তাহলে ৷ যাক শুনে শান্তি পেলাম ৷
আমি কি বললাম আর তুমি কি বলছো? চলো না আমরাও একটু দেখা করি ৷ জীবনে রাস্তা ছাড়া আর কোথাও তোমাকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি ৷
পারব না ৷ আমি ২০ টা আপেল নিয়ে বসেছি ৷ এদের না খাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাব না ৷
নিলয় হতভম্ভ হয়ে গেল তবুও ব্যঙ্গ করে বলল,, ২০ টা কম হয়ে গেল না?
জানি কম হয়েছে ৷ কিন্তু আজ একটু কম ক্ষুধা পেয়েছে তাই কম খাচ্ছি ৷
নিলয় আহাম্মক হয়ে গেল ৷ ক্ষণকাল চুপ থেকে ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,,,
ভাগ্যিস আমাদের বাড়িতে অনেক ফলের গাছ আছে নয়তো তোমাকে খাওয়াতেই আমি ফকির হয়ে যেতাম জোৎস্না!
জোৎস্না রাগত স্বরে বলল,, ফোন রাখুন তো ৷
এই দাঁড়াও ৷ একটা প্রশ্ন ছিল ৷
কি?
তোমার কাছে আমি বড় না আপেল?
জোৎস্না তৎক্ষণাৎ জবাব দিল,,, নিঃসন্দেহে আপেল ৷
নিলয়ের মুখে হাসি ফুটতে ধরেছিল আ তে আপনি হবে ভেবে কিন্তু আ তে আপেল হওয়ায় ওর মুখটা পোড়া বেগুনের মতো চুপসে গেল ৷ ওদিকে জোৎস্না ফোন কেটে দিয়েছে ৷ নিলয় হতাশ শ্বাস ফেলে কান থেকে ফোন নামিয়ে বলতে লাগল,,,
আমার জীবনে আপেলও যে শত্রু হতে পারে সেটা কি জানা ছিল? কেন যেন নিজেকে স্নো হোয়াইট মুভির স্নো হোয়াইটকে আপেল খাওয়ানো ডা**য়নিটা মনে হচ্ছে ছ্যাহ!
চলবে,,,,