#_ঘর_কুটুম_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_৮_
সন্ধ্যা অনেক আগেই নেমেছে। অরুনিমা বসে আছে বিছানার উপর। হাতে আছে পরীক্ষার ছাত্র-ছাত্রীদের খাতা। মনোযোগ দিয়ে প্রতিটা উত্তর খুঁটিয়ে দেখছে সে। হঠাৎ করেই দরজার বেল বেজে উঠে। অরুনিমার মনটা একটু চঞ্চল হয়ে উঠে। অরুনিমার এখানে সাধারনত কেউ আসে না। এসময়ে তো আরও নয়। তাহলে কে এলো? এর মাঝে আবারও বেল বেজে উঠে। অরুনিমা ভ্রু কুচকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলতেই চোখ স্থির হয়ে যায় তার। দরজার ওপাশে দাড়িয়ে আছে তার মা মিসেস.রেহানা। হাতে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ।
অরুনিমা আস্তে করে বলে,
–” তুমি?”
মিসেস.রেহানা একটু হালকা গলায় বললেন,
–” ভেতরে যেতে দিবি না?”
অরুনিমা দরজা থেকে সরে দাড়ায়। মিসেস.রেহানা ভেতরে প্রবেশ করে চারিদিকে একবার চোখ বুলায়। খুবই সাধারন মানের ছোট্ট ফ্লাট অরুনিমার। মিসেস.রেহানা আগেও এখানে অনেকবার এসেছে মেয়ের সাথে দেখা করতে। একই পরিবেশ, কোনো বদল নেই। মিসেস.রেহানা নিজে অনেক কিছু কিনে দিয়ে গেছেন। কিন্তু, পরের বার এসে সেগুলো কখনোই দেখতে পায় না মিসেস.রেহানা। অরুনিমা হয়তো রাখে না, কাউকে দিয়ে দেয় নতুবা ফেলে দেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস.রেহানা। দরজা বন্ধ করে অরুনিমা এগিয়ে এসে বললো,
–” কেন এসেছো?”
মিসেস.রেহানার মুখে আঘাতের মতো হাসি।
–” এইভাবে বলছিস কেন? মেয়ের কাছে আসতে মায়ের কি কোনো কারন লাগে? কতোদিন পর এসেছি তোর কাছে। তুই খুশি হোসনি?”
অরুনিমার গলার স্বর ঝাঁকুনি দিলেও সুর কাটা,
–” খুশি হওয়ার মতো কোনো কারন দেখছি না।”
–” আমাকে কি একটুও মনে পড়ে না তোর?”
মিসেস.রেহানার চোখের চাহনিতে মিশে আছে বিষাদ ছায়া। অরুনিমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উত্তর দেয়,
–” পড়তো মা! যখন আমার তোমাকে খুব মনে পড়তো, তখন তুমি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলে। আর এখন সেই মনে পড়াটুকু পূর্ন না হতে হতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর কাউকে মনে পড়ে না।”
মিসেস.রেহানার বুক কাপে। মেয়ের ধারালো কথাগুলো শুনে তার চোখে পানি জমে উঠে। মেয়ের কটু কথা তাকে ছিন্ন করে দেয়। কিন্তু, সে বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না, আর না পায় শক্তি। মিসেস.রেহানা একটু সময় নিয়ে ছোট্ট ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। যেখানে রাখে তার হাতে থাকা ব্যাগ। ব্যাগ থেকে ধীরে ধীরে বের করে কয়েকটা টিফিন বক্স। অরুনিমা ভ্রু কুচকিয়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। মিসেস.রেহানা অরুনিমার দিকে তাকিয়ে বলে,
–” আমি নিজের হাতে তোর জন্য রান্না করে এনেছি। আই, খেয়ে নে।”
–” আমি কি তোমাকে খাবার আনতে বলেছি?”
–” আমি কি তোর জন্য খাবার আনতে পারি না?”
অরুনিমা কাঠ কাঠ গলায় উত্তর দেয়,
–” কোনো প্রয়োজন নেই।”
কথাটা বলেই অরুনিমা নিজের বেড রুমের দিকে চলে যায়। মিসেস.রেহানা ছলছল চোখে মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। টুপ করে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে মিসেস.রেহানা গাল বেয়ে।
…
অরুনিমা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশে চাঁদের আলোয় মেঘ ভেসে যেতে দেখে মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের সেই দূরত্বের কারণগুলো আজও তার হৃদয়ে আগুন জ্বালায়। ভালোবাসা থাকলেও অতীতের যন্ত্রণা যেন তাদের ভালোভাবে কথা বলার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। চোখ জ্বালা করছে অরুনিমার আর সে যেন নিজের চোখের পানি গুলো আটকাতে পারছে না।
ধীর পায়ে মাঝের রুমের দিকে এগিয়ে যায় অরুনিমা।
মিসেস.রেহানা চলে গেছে কিছু সময় আগে। অরুনিমা রুমে চলে আসার পর মিসেস.রেহানাও এসেছিলো তার পিছু পিছু। চোখের পানি ফেলে কিছু সময় অরুনিমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দিয়ে চলে যায়। অরুনিমা কোনো কথা বলেনি আর৷ মায়ের এমন কান্নারত মুখ দেখলে তার বুক ভেঙে আসে৷ কিন্তু, সেইটা প্রকাশ করতে চায় না অরুনিমা।
অরুনিমার চোখ পড়ে ডাইনিং টেবিলে রাখা টিফিন বক্সগুলোর দিকে। ব্যাগটি চেয়ারের ওপর পড়ে আছে। যত্ন সহকারে বক্সগুলো খুলে দেখে বেগুন ভাজি, সরিষা ইলিশ, চিংড়ির মালাইকারি, ডিমের কোরমা, মুরগির রোস্ট আর গরুর মাংস রান্না। তার প্রিয় সব খাবার। একা থাকার জন্য খুব একটা রান্না করে না সে, সাধারণত দ্রুত ও সহজ রান্নার ওপরই ভর করে। ফ্রিজেও গরুর মাংস এনে রেখেছে অনেক আগেই, কিন্তু রান্না করা হয় না। মিসেস রেহানা পোলাও ও এনেছে, অরুনিমার ঠোঁটে এক হালকা হাসি ফুটে ওঠে।
রান্নাঘর থেকে প্লেট নিয়ে বসে খেতে শুরু করে অরুনিমা। মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ তার মুখে ছড়িয়ে পড়ে, যেন জাদু মিশে আছে। মায়ের রান্নার প্রতি তার ভালোবাসা গভীর। মিসেস.রেহানা সব সময় মেয়ের জন্য এটা সেটা রান্না করে নিয়ে আসে। নিজের কষ্ট, জিদ, অভিমানের জন্য মায়ের সামনে খাবার গুলো স্পর্শ না করলেও মা চলে যেতেই খাবার গুলোর উপর হামলে পড়ে অরুনিমা। মা তো মা, তার হাতের রান্নার জাদু কিছুমাত্র কম নয়।
খুব তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া শেষ করে অরুনিমা। নিজে আলু ভর্তা দিয়ে ভাত করে রেখেছিলো। সেইটা আর খাওয়া হলো না। আবার মিসেস.রেহানা বেশ ভালো পরিমানে খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছে। তিন চার দিন অনায়াসে চলে যাবে অরুনিমার। অরুনিমা বাড়তি খাবার গুলো ফ্রিজে রেখে বারান্দায় চলে আসে।
নরমালি মিসেস.রেহানা দশ, পনেরো দিন অন্তর অন্তর একবার আসে মেয়ের কাছে। কিন্তু, এইবার বেশ দেরি করে এসেছে। কতো দিন হবে? ২৬-২৭ দিন তো বটেই। এতো দেরি করে আসার কারন কি? অরকোর পরীক্ষা থাকতে পারে। কি জানি। কিন্তু, মায়ের মুখটা দেখে বেশ ফুরফুরে লাগছে অরুনিমার। হালকা হাসে অরুনিমা। ইশশশ! জীবনের এই বিচিত্র চলার মাঝে যদি তার দিনগুলো অন্যদের মতো একটু স্বাভাবিক হতে পারে, তা হলে কতো ভালো হত!
…
সকাল থেকেই আকাশে থম থমে ভাব। সূর্যের দেখা নেই, চারপাশে শুধু ছায়াঘেরা আলো। ঘন মেঘে ঢেকে আছে নীল আকাশ। মনে হচ্ছে, এখনি বুঝি বৃষ্টি নামবে। কিন্তু, কিছুতেই নামছে না। কলেজ শেষে গেট পার হয়ে রাস্তার দিকে এগোচ্ছে অরুনিমা। ঠিক তখনি চোখে পড়ে একটা সাদা রঙের গাড়ি। গাড়ির পাশে হেলান দেওয়া ছেলেটিকে দেখে পা একটু থেমে যায় তার। জিন্স আর টিশার্ট পরা ছেলেটি ফোন হাতে স্ক্রল করছে। ছেলেটি আরাভ।
অরুনিমার কপালে ভাজ পড়ে। এই ছেলে এখানে কি করছে? হাসপাতালে সেই রাতে তাকে রেখে আসার পর দিন সন্ধ্যায় গিয়েছিলো আবার দেখতে। কিন্তু কেন গিয়েছিলো সে? দূর্বলতা নয়, কোনো অকারন অনুভব নয়, শুধু একটা দায়িত্ববোধ থেকে। একজন মানুষ হিসাবে আরেকজন আ*হ*ত মানুষকে দেখতে যাওয়ার ভেতর কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু গিয়ে শুনেছিলো আরাভ সকালেই রিলিজ নিয়ে বাসায় চলে গেছে। এরপর যোগাযোগ হয়নি আর। আর এখন এখানে কেন ছেলেটা? আরাভ চোখ তুলে তাকাতেই দেখে অরুনিমা সোজা তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে হালকা হাসে, তারপর মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে দ্রুত পা বাড়ায় অরুনিমার দিকে। আরাভ স্নিগ্ধ ভাবে বলে,
–” অবশেষে তোমার দেখা পেলাম। সরি! তুমি করে বলছি। কিছু মনে করো না। আপনি করে বলতে অস্বস্তি লাগে।”
আরাভের এমন সাবলীল ভঙ্গি দেখে অরুনিমা অবাক হয়ে যায় কিছুটা। তার কথাবার্তায় এমন আত্মবিশ্বাস যেন দুজন বহুদিনের পরিচিত। অরুনিমা স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,
–” আপনি এখানে কি করছেন?”
–” ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম।”
হেসে বলে আরাভ। অরুনিমা একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তার উপর। চোখে খানিকটা খটকা। অরুনিমার কন্ঠে কঠিন শীতলতা,
–” মিথ্যা কেন বলছেন? এখানে ঘুরতে আসার মতো কিছু নেই। উদ্দেশ্য ছাড়া মানুষ এখানে আসে না।”
আরাভের ঠোঁটে খেলা করে আরও একফোঁটা হাসি। হাসিটা অরুনিমার চোখে ধরা পড়ে। অদ্ভুত সুন্দর একটা হাসি। আরাভ বলে,
–” যদি তাই হয়, তাহলে আমিও উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছি।”
–” কি উদ্দেশ্য?”
ভ্রু কুচকায় অরুনিমা।
–” তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”
অরুনিমা একদম নির্লিপ্ত মুখে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–” কেন? আর আপনি জানলেন কিভাবে আমি এই কলেজে পড়ায়?”
আরাভ অরুনিমার চোখে চোখ রেখে বলে,
–” মনের ইচ্ছে গুলো যদি খুব তীব্র হয়, তবে খুজে নিতে সময় লাগে না। শুধু একটু চেষ্টা লাগে।”
অরুনিমা তড়িঘড়ি করে চোখ সরিয়ে নেয়। এই ছেলের চোখে তাকিয়ে থাকা যায় না বেশি সময়। তার চোখে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা আছে।
–” আপনি এইসব কি বলছেন?”
চাপা রাগ আর অস্বস্তিতে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় অরুনিমা। আরাভ একটু হেসে বললো,
–” আমার কথা কি খুব অদ্ভুত লাগছে তোমার কাছে?”
–” হ্যা! খুব বেশি।”
আরাভ একটু শব্দ করে হাসে। হাসিটা অরুনিমার ভালো না লাগলেও জিজ্ঞেস করে,
–” আপনার ফিজিক্যাল কন্ডিশন এখন কেমন? রেস্টে থাকার কথা আপনার, তা না করে আপনি শহর চষে বেড়াচ্ছেন?”
–” রেস্টের থেকে বেশি দরকার ছিলো তোমার সাথে দেখা করা। হাত এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি। তবুও ড্রাইভ করে এসেছি।”
–” কেন?”
–” সব কিছুর কারন থাকতে হয়, বুঝি?”
–” কারনহীন কিছু করা উচিত নয়।”
–” যদি বলি, তোমাকে দেখার জন্য মনটা খুব ছটফট করছিলো।”
হালকা কেঁপে উঠে অরুনিমা। বুকের ভেতর যেন হঠাৎ এক ঝাঁঝালো শব্দ বেজে উঠে। এরকম কথা সে কখনো শোনেনি। আরাভের মুখে নিজের নামের এই মূল্যবোধ শুনে একটা অদ্ভুত অনুভুত হয় অরুনিমার। অরুনিমা নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে কঠিন গলায় বলে ওঠে,
–” বাজে কথা বন্ধ করুন। বাসায় যান। আবহাওয়া ভালো না। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। আমাকেও যেতে হবে।”
কথাগুলো বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয় অরুনিমা। ঠিক তখনি পেছন থেকে ডাক ভেসে আসে,
–” অরু!”
পা থেমে যায় অরুনিমার। এই নাম অরু, এটা তো শুধু কাছের মানুষেরা ডাকে। এতো ঘনিষ্ঠতা কোথা থেকে আসে এই অপরিচিতের মধ্যে। ধীরে ঘুরে তাকায় সে। আরাভ কয়েক কদম এগিয়ে এসে আস্তে করে বলে ওঠে,
–” তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।”
শরীরে ভেতর দিয়ে এক হিমেল স্রোত বয়ে যায়। ভেতরটা কেঁপে উঠে অরুনিমার। তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর কিছু না বলে, চোখ নামিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায় অরুনিমা। আরাভ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার চলে যাওয়ার পথে। হালকা বাতাসে চুল গুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ছেলেটার। ঠোঁটের কোণে এক হালকা হাসি খেলে যায়। যা দেখলে যে কোনো মানুষের চোখ আটকে যাবে সেখানে।
#_চলবে_ইনশাআল্লাহ_🌹