ঘর কুটুম পর্ব-০৯

0
4

#_ঘর_কুটুম_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_৯_

রুমে হালকা আলো জ্বালিয়ে শুয়ে আছে অরুনিমা। ড্রিম লাইটের সবুজ আলোয় ঘরটা যেন এক নিস্তব্ধ মায়াজালে মোড়া। রাত বেশি হয়নি, মাত্র নয়টা। কিন্তু, মনে হচ্ছে রাত যেন অনেক গভীর, অনেক ভারি হয়ে আছে। বিছানায় শুয়েও তার চোখ বার বার চলে যাচ্ছে সিলিং এর দিকে। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা। সন্ধ্যার সময় পরীক্ষার খাতা দেখতে বসেছিলো সে, কিন্তু মন বসেনি। চোখ বইয়ের পাতায় থাকলেও, মন ছুটে যাচ্ছিলো আজকের সেই কলেজের মুহুর্ত গুলোতে। আরাভের উপস্থিতি, আরাভের বলা কথাগুলো। তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে, শুধু একটা বাক্য। কিন্তু, কেমন করে যেন বাক্যটা তার মনের দেওয়ালে গেঁথে গেছে। কথাটা কানের কাছে যেন বার বার বাজছে। কেন এমন লাগছে? এই অনুভূতি নতুন কেন?

স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি জীবনের প্রতিটা অধ্যায়ে এমন অনেক কথায় শুনেছে সে। পছন্দের কথা, প্রেমের প্রস্তাব, ভালো লাগার আভাস, কিন্তু আজকের অনুভুতি একদম আলাদা। যেন একটা অচেনা স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনি ফোন বেজে উঠে অরুনিমার। হঠাৎ এমন শব্দে চমকে উঠে অরুনিমা। পাশে রাখা ফোনটা তুলে নেয় সে। ফোনের স্ক্রিনে একটা অচেনা নাম্বার। ভ্রু কুঁচকে যায় তার। এই সময়, এইটা আবার কে? রিং কেটে যায়। অরুনিমা ফোন রাখতে যাবে, আবার কল বেজে উঠে। এইবার রিসিভ করে সে।
–” হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম!”

ওপাশ থেকে নরম স্বরের পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসে,
–” ওয়ালাইকুম আসসালাম!”

–” কে বলছেন?”

ফোনের ওপাশ থেকে নরম সুরে ছেলেটি বলে,
–” আরাভ!”

নামটা শুনেই শরীরটা যেন নড়ে উঠে অরুনিমার। সে শোয়া অবস্থা থেকে এক লাফে উঠে বসে পড়ে। বুকের ভেতর হঠাৎ যেন ঢেউ আছড়ে পড়লো।
–” আপনি? আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?”

ওপাশ থেকে ঠান্ডা গলায় উত্তর আসে,
–” বলেছি না, মনের ইচ্ছে যদি খুব তীব্র হয়, তবে খুঁজে নিতে সময় লাগে না। শুধু একটু চেষ্টা লাগে।”

অরুনিমা চুপ। বুকের মধ্যে যেন কেউ ড্রাম পেটাচ্ছে। কান পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছে নিজের হৃৎস্পন্দন। অরুনিমা বুকে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। নিজেকে সামলিয়ে বলে,
–” কেন কল করেছেন?”

–” কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো তাই।”

অরুনিমার কন্ঠ একটু কঠিন হয়,
–” আপনি এগুলো কি শুরু করেছেন? কেন করছেন এইসব?”

আরাভের মুখে হালকা হাসি। ডিভানে হেলান দিয়ে বসে সে। তার হৃদয় এই কথোপকথনের প্রতিটা সেকেন্ড উপভোগ করছে।
–” কারন তো অবশ্যই আছে, অরু!”

এই অরু ডাকটা আবার শিরা উপশিরায় কাঁপন তুলে দেয়।
–” কি কারন? কি চান আপনি?”

আরাভের কন্ঠ এবার আরও গাঢ়, আরও ধীর,
–” যদি বলি তোমাকে চাই, তাহলে?”

এইবার আর গলা দিয়ে কিছু বের হয় না অরুনিমার। একটা শ্বাস আটকে আছে বুকের মাঝামাঝি। শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরন খেলা করে যাচ্ছে। অরুনিমা ঠোঁট চেপে ধরে। কন্ঠে কঠিন স্বর এনে বলে,
–” দেখুন, আরাভ! আপনি কি করতে চাইছেন, কি ভাবছেন, আমি কিছুই জানি না। কিন্তু বেশি ভাববেন না আমাকে নিয়ে। আপনি আমাকে চিনেন না। আমার জীবন আপনার দেখা অন্য মেয়েগুলোর মতো না। তাহলে এতোদিনে আমার বিয়ে করে সংসার হতো। আমার জীবনে অনেক জটিলতা আছে। অনেক বাস্তবতা আছে আমার জীবনে। অতএব, এইসব অনুভুতি গুলোর জটলা তৈরি করে লাভ নেই। আমি এতো সহজ না। আমার কাছে এইসব অনুভুতির কোনো বিশ্বাস নেই, মূল্যায়ন নেই।”

আরাভের গলায় একরকম নির্ভার হাসি,
–” আমি এতো ক্যালকুলেশন করে চলতে পারি না। আর এই মুহুর্তে তোমার ব্যাপারে তো একদমই না।”

–” বুঝার চেষ্টা করুন, আরাভ!”

–” চাই না বুঝতে।”

–” উফ! শুনুন আমার কথা।”

আরাভ কথা কেটে বলে ওঠে,
–” বৃথা চেষ্টা করছো, অরু! আমি যদি এতোই বুঝার চেষ্টা করতাম, তাহলে কখনোই এই ব্যাথা হাত নিয়ে, এই পেইনকিলার খেয়ে হন্যে হয়ে তোমার কলেজ খুঁজে বেড়াতাম না। তোমার নাম্বার খুঁজতে হতো না৷”

একটা ক্ষীণ কম্পন বয়ে যায় অরুনিমার শিরা উপশিরা দিয়ে। কম্পিত কন্ঠে বলে,
–” আমি ঘুমাবো, রাখছি।”

অরুনিমা ফোন কেটে দেয়। তারপর আর দেরি না করে, ফোনটা সম্পূর্ন বন্ধ করে ফেলে। যেন আরাভ আবার কল দিলে না আসে। নিজের উপরও আর কনফিডেন্স পাচ্ছে না অরুনিমা। যদি আবার আরাভের কল রিজেক্ট করতে না পারে। শুয়ে পড়ে আবার। মুখের উপর কথা টেনে নেয়। চোখ বুজলেও ঘুম যেন অনেক দুরে। বুকের ভেতর ধুকপুক আর অচেনা এক অনুভুতির ঘূর্নি। তাও চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে অরুনিমা।

অরুনিমা ফোনটা কেটে দেওয়ার পর আরাভ আবারও কল দেয়। কিন্তু, ফোন তখন বন্ধ। তবুও রাগ হয় না আরাভের। বরং ঠোঁটের কোণে একটু খানি হাসি খেলে যায়। আকাশ আজ ভারি মেঘে ঢাকা। আরাভ বসে আছে নিজের ডুপ্লেক্স বাড়ির দ্বিতীয় তলার নিজের রুমের বারান্দায় ডিভানে। পাশেই একটা ছোট্ট গোল টেবিল। তার গায়ে হেলান দিয়ে রাখা আছে একটা গিটার। টেবিলের উপর রাখা আছে একটা সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার আর আধা ভর্তি কফির মগ। হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে এই মিনিট পনেরো হলো। বাগান থেকো আসা রজনীগন্ধা আর বেলির মিশ্র গন্ধে যেন সমস্ত চারপাশ স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। আরাভ মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীরে চোখ বন্ধ করে।

হাসপাতালের মুহুর্ত গুলো ভেসে উঠে আরাভের চোখে। মাত্র একদিনের পরিচয়, অথচ অনুভূতি গুলো এমন গভীর হয়ে উঠছে কিভাবে? অরুনিমা! নামটা উচ্চারণ করলেই বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠে। এক অদ্ভুত নারী৷ শ্যামবর্নের অপরুপ সুন্দরী নারী। গায়ের রং যেন ধূলোমাখা বাদামী মাটি। অথচ কী আশ্চর্য, এমন বর্নেই যেন তার সৌন্দর্য ফুটে উঠে সবচেয়ে বেশি। অবাক লাগে, যেখানে আরাভ চকচকে ফরসা রঙের মেয়েদের দিকে আকর্ষন বোধ করলো না, সেখানে শ্যামবর্নের এই মেয়েটি সব হিসেব পাল্টে দিয়েছে।

অরুনিমার চোখ দুটো। কি মায়াবী চাহনি। চোখ যেন সর্বদা কোমল ভাষায় কথা বলছে। আরাভ হাত বাড়িয়ে গিটারটা তুলে নেয়। বাম হাতে ব্যাথা, যার জন্য ড্রাইভিং করতে একটু সমস্যা হলেও গিটার বাজাতে সমস্যা হচ্ছে না। গিটারের তারে টান দিয়ে আস্তে আস্তে সুর তুলে সে। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে গিটারের সুর মিলে এক একান্ত রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। আরাভ চোখ বন্ধ করে গেয়ে ওঠে তার নরম কন্ঠে,

তোর ঐ দু’হাতের আলতো ছোয়াতে
মন ছেয়ে যায় প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে
তোর ঐ দু’হাতের আলতো ছোয়াতে
মন ছেয়ে যায় প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে
এসেছি তোর মনেরই দেশে
আমি এক মুসাফির বেশে
দে না ঠাই একটু হেসে
ভালোবেসে
এসেছি তোর মনেরই দেশে
আমি এক মুসাফির বেশে
দে না ঠাই একটু হেসে
ভালোবেসে

রাত প্রায় ১০ টা!!
বাইরের আকাশ জুড়ে মেঘের ঘন স্তূপ। বৃষ্টি থেমে থেমে ঝরছে। রুপন্তি বসে আছে মেয়ের মাথার পাশে বিছানায়। তিতলি, তার বুকের ধন, তার জীবনের এক মাত্র আলোর রেখা অচেতন হয়ে পড়ে আছে। গায়ে আগুন জ্বর। জ্বর যেন মেয়েটার শরীর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। মুখটা কেমন লালচে হয়ে আছে। এক ধরনের ফ্যাকাশে লাল, যা দেখে রুপন্তির বুকটা ধড়ফড় করে উঠে। রুপন্তি বার বার করে তিতলির কপালে ভেজা তোয়ালে চেপে দিচ্ছে। ঔষধও দিয়েছে, কিন্তু জ্বর কমছে না। কপালে হাত রাখলেই মনে হচ্ছে আগুন ছুয়ে দিচ্ছে। রুপন্তির চোখের ভেতর অশান্ত ঝড়।

রুপন্তি বিভিন্ন দোয়া পড়ছে আর মেয়ের মুখে ফু দিচ্ছে। কী করবে সে? এই মেয়েটাই তো তার সব। তার বেঁচে থাকার এক মাত্র কারন। হঠাৎ মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠে। খুবই হালকা কাঁপুনি। কিন্তু, রুপন্তির প্রান যেন ওখানেই আটকে যায়। সে কাঁপা কাপা গলায় মেয়েকে ডাকে,
–” তিতলি! মা, শোনো, আমার সাথে কথা বলো। তিতলি! মা, চোখটা খোলো একটু।”

কোনো সাড়া নেই। তিতলি যেন নিথর। চোখ বন্ধ। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। তিতলির নিস্তব্ধ মুখ দেখে রুপন্তির বুক কেঁপে উঠে। রুপন্তি ছুটে গিয়ে ফোন তুলে। প্রথমেই কুশানকে কল করে। রিং হচ্ছে, কিন্তু কেৎ রিসিভ করে না। আবার কল করে রুপন্তি। রিসিভ হয় না। রাগে, দুঃখে, অসহায়তায় রুপন্তির বুক জ্বলে যাচ্ছে। কুশান তো আজ সকালেই দেখেছে মেয়েটা জ্বরে ভুগছে। তারপর থেকে একটা ফোন পর্যন্ত করেনি। একটি বার খোঁজ নেয়নি তিতলির। এতোটুকুও কি চিন্তা হয় না তার? হঠাৎ মেয়েটার জন্মদিনের কথা মনে পড়ে যায় রুপন্তির। কুশান সেদিন সারাদিন তিতলির সাথে ছিলো। তিতলি হাসিখুশি ছিলো, আনন্দে ভরপুর। যেন কুশান আগের মতো হয়ে গেছে। কিন্তু না, পরদিন থেকেই কুশান যপন আরও দুরে সরে গেছে। চোখ দুটো পানিতে ঝাপসা হয়ে আসে রুপন্তির।

তিতলি আবার কেঁপে উঠে। এইবার পুরো শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে বেশ জোরে। রুপন্তি থরথর করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েকে ডাকে, কিন্তু তিতলি সাড়া দেয় না। রুপন্তি ছটফট করে উঠে। কুশানকে আরও কয়েকবার কল করে রুপন্তি। রিসিভ হয় না। উপায়ন্তর না পেয়ে ছোয়াকে ফোন করতে যায়। তখন মনে পড়ে ছোয়ারও জ্বর। কল দেয়না রুপন্তি। তখনি মনে পড়ে অরুনিমার কথা। কল দেয়, কিন্তু ফোন বন্ধ। শরীর জ্বলে উঠে রুপন্তির। পরমুহূর্তেই রুপন্তির মনে পড়ে, অরুনিমার একটা বাটন ফোন আছে, ইমার্জেন্সির জন্য। তড়িঘড়ি করে সেই নাম্বারে ডায়াল করে রুপন্তি। প্রথমবার রিং হয় কেউ ধরে না। রুপন্তি দাঁতে দাঁত চেপে আবার কল দেয়। এইবার কল রিসিভ হয়। ফোনের ওপাশ থেকে অরুনিমার কন্ঠ ভেসে আসে,
–” রুপন্তি!”

রুপন্তি হাউমাউ করে উঠে। কান্নায় গলা আটকে আসা স্বরে বলে,
–” অরু! আমার মেয়েটা অনেক অসুস্থ। বুঝতে পারছি না কি করবো।”

–” কি হয়েছে, তিতলির?”
অরুনিমা প্রশ্ন করে দ্রুত।

–” অনেক জ্বর। অচেতন হয়ে গেছে। ডাকছি সাড়া দিচ্ছে না। চোখও খুলছে না। আমার মাথা কাজ করছে না, অরু। কি করবো এখন আমি?”
রুপন্তির কন্ঠে অসহায়তা আর ভয় স্পষ্ট ফুটে উঠে।

–” শোন! এইভাবে ভেঙে পড়িস না। কুশান ভাই কোথায়?”

রুপন্তি একরাশ রাগ নিয়ে গর্জে উঠে,
–” জানি না। সকালে বের হয়েছে। একটা খবর পর্যন্ত নেয়নি মেয়েটার। অমানুষ একটা। ও কোনো মানুষের মাঝেই পড়ে না।”

অরুনিমা মুহুর্তেই পরিস্থিতি বুঝে ফেলে। এখন কোনো সম্পর্কের বিচার নয়, এখন তিতলির চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ। অরুনিমা তাড়াতাড়ি বলে,
–” শোন, তুই তিতলিকে নিয়ে হসপিটালে যা। আমি হসপিটালে আসছি।”

–” কিন্তু, বাইরের অবস্থা দেখেছিস? এই বৃষ্টি। কিভাবে নিয়ে যাবো আমি ওকে? কুশান একটা গাড়ি নিয়ে গেছে। আরেকটা সার্ভিসিং এ দেওয়া। এখন আমি কিভাবে যাবো?”

–” তুই চিন্তা করিস না। আমি উবার ডেকে দিচ্ছি। আমি তোর বাসায় গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। উবার করে তুই চলে আই।”

–” ঠিক আছে!”

কল কেটে দেয় অরুনিমা। রুপন্তি আবার ছুটে আসে তিতলির কাছে। বাচ্চা মেয়ের নিস্তেজ মুখে পানি ছিটায়। কোলের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,
–” তিতলি! মা আমার। চোখ খুল।”

তিতলি নিস্তব্ধ, নিঃশব্দ। রুপন্তির বুকের ভেতর যেন কিছু একটা চিৎকার করে ফেটে পড়ে। বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ে চলেছে। আর ভেতরে এক মা তার অসুস্থ সন্তান আকড়ে ধরে বসে আছে।

#_চলবে_ইনশাআল্লাহ_🌹