#_ঘর_কুটুম_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_১৪_
শিশির অফিসের ডেস্কে বসে কাজ করছে। মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু চোখের সামনে ফাইল খুলে থাকলেও মস্তিষ্ক কাজ করছে অন্য কোথাও। মাথায় ঘুরছে ছোয়ার মুখ, শিথীর কথা, সমাজের চাপ, সবকিছু মিলিয়ে এক অদৃশ্য দড়ির টানে হাঁসফাঁস করে উঠছে তার ভেতরটা। ঠিক তখনই মোবাইলটা বাজে। ছোয়ার নাম ভেসে ওঠে স্ক্রিনে। শিশির দ্রুত ফোনটা কানে তোলে।
–” হ্যালো!”
ওপাশ থেকে ছোয়ার গলা ভেসে আসে, স্বাভাবিক কিন্তু বিষণ্ণ,
–” শিশির! আমি বাপের বাড়ি যাচ্ছি।”
শিশির ভ্রু কুঁচকে ফেলে। এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপর ধীরে জিজ্ঞেস করে,
–” হঠাৎ?”
ছোয়ার কণ্ঠ স্বাভাবিক ঠাণ্ডা, কিন্তু ভেতরে একটা দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্লান্তি ফুটে ওঠে,
–” মা সকাল থেকে একদমই কিছু খাচ্ছেন না। মুখের ওপর বলে দিয়েছেন, আমি নাকি তার সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছি। তার এই গলায় গলায় ঝাঁঝ দিয়ে কথা বলা, টিপ্পনী, একদম সহ্য করতে পারছি না। শিশির! আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না। আমি শুধু একটু নিঃশ্বাস নিতে চাই। একটু বিশ্রাম, একটু নিরবতা। মানুষ তো আমি, রোবট না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।”
শিশির কিছুক্ষণ নীরব থাকে। ওর মুখ থমথমে হয়ে ওঠে। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
–” তুমি যেও না, ছোয়া। আজকের দিনটা আমাকে দাও। আমি, আমি সব ঠিক করে দেবো।”
ছোয়ার গলায় বিস্ময় মিশে আসে,
–” তুমি কি করবে, শিশির?”
শিশিরের কণ্ঠে তীব্র সংকল্প,
–” আমার এখন অনেক কাজ, আছে। তুমি শুধু কোথাও যেয়ো না। রাখছি।”
বিনা প্রতিউত্তরে ফোন কেটে দেয় শিশির। তার কাঁধের ওপর যেন বিশাল ভার পড়ে আছে। সে উঠে দাঁড়ায়। কেবিনের মধ্যে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করে। মনে হচ্ছে, এই অফিসরুমটা ছোট হয়ে আসছে, দেয়ালগুলো তার গলা টিপে ধরছে। কাজের প্রতি মনোযোগ নেই, শরীর ভারী, মন আরও ভারী। একটা কফি খায়। তারপর আরেকটা। এরপর আরেকটা। তবু কেবল মনে হয়, বড্ড ঘোলাটে সবকিছু। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়, আর না। কিছুক্ষণ বাইরে যেতে হবে।
শিশির চুপচাপ অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। শহরের এক পাশের পুরনো পার্কে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করে। বিকেল নেমেছে। চারপাশে মানুষের ভিড়। দুজন দুজন করে হাঁটা জুটি, বাচ্চাদের হৈচৈ, ঝালমুড়ি, ফুচকার দোকান, প্রেমিক-প্রেমিকার নির্ভার হাসি, বেলুনওয়ালার ডাক, সব মিলিয়ে এক জীবন্ত চিত্রপট। শিশির ধীরে হেঁটে গিয়ে একপাশের ফাঁকা বেঞ্চে বসে পড়ে। শরীরের সমস্ত ভার যেন সেদিকে হেলে পড়ে। তার দৃষ্টি সোজা চলে যায় শিশুদের দিকে। কয়েকটা ছোট বাচ্চা দৌড়াচ্ছে, কেউ হাসছে, কেউ পড়ে গিয়ে উঠে আবার দৌড়াচ্ছে, কেউ বাবা-মায়ের হাত ধরে আইসক্রিম খাচ্ছে। শিশির অপলক তাকিয়ে থাকে। এক কোণে একটি ছোট্ট মেয়ে বাবার কোলে বসে, বৃষ্টির ফোঁটার মতো হালকা হেসে বাবার গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
শিশিরের ঠোঁটে হালকা এক ফাঁকা হাসি খেলে যায়। চোখের কোণ জ্বালা করে। হঠাৎ করে তার মনে হয়, এই দৃশ্যের মধ্যেই সে হারিয়ে যেতে চায়। ছোয়া বলেছিল, আমি মানুষ, দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখন শিশির নিজেই বুঝতে পারে, ছোয়া কী বলতে চেয়েছিল। এই সমাজে, এই চারপাশে, এতসব মানুষের ভিড়ে সে নিজেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
তার হাত ফাঁকা। কোল ফাঁকা। জীবন ফাঁকা। আর ছোয়ার? সে তো দিনের পর দিন তার অক্ষমতার বোঝা বয়ে নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। শিশিরের হঠাৎ মনে হলো, সবকিছুই থেমে গেছে। আর থেমে যাওয়া মানেই হয় সিদ্ধান্ত, না হয় বিসর্জন।
…
শিশির ধীরে ধীরে খাবারের ট্রে হাতে মায়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা খোলা, ভেতরে নীরবতা। আনজিলা বেগম চুপচাপ খাটের এক কোণে বসে আছেন, জানালার বাইরে তাকিয়ে। শিশিরকে দেখতে পেলেন বটে, কিন্তু চোখ ফেরালেন আরেক দিকে।
শিশির হালকা করে হাসল। জানত, এই মুহূর্তে মায়ের মুখে রাগ, অভিমান, দুঃখ, সবকিছুর মিশ্রণ। ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে মায়ের সামনে বসল সে। ট্রেটা হাতেই, গলায় নরম কণ্ঠের অনুরোধ,
–” মা! খাবারটা খেয়ে নাও।”
আনজিলা বেগম কঠিন গলায় বললেন,
–” আমার খাওয়া নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।”
শিশির শান্তভাবে বললো,
–” কেন এমন করছো মা?”
আনজিলা বেগম এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। চোখে একরাশ যন্ত্রণার ছাপ।
–” তুই জানিস না কেন এমন করছি? আমি তোকে নিয়ে ভেবেই শেষ হয়ে যাচ্ছি, শিশির। তোর এই ঘর, এই সংসার, আমি তোর জন্য এমন জীবন চাইনি। তোর ঘরে হাসির শব্দ চাই। ছোট ছোট পায়ের আওয়াজ চাই। একটা বাচ্চার গন্ধ চাই। আমি দাদী হতে চাই, এটা কি খুব বেশি কিছু চাওয়া?”
শিশির হালকা হেসে বললো,
–” শিথী কোথায়, মা? শ্রেয়া?”
–” ওরা পাশের বাসায় গেছে।”
রুক্ষ কণ্ঠে জবাব দেয় আনজিলা বেগম।
–” তাহলে খেয়ে নাও, মা!”
আনজিলা বেগম মুখ ঘুরিয়ে নেয়। একটু থেমে বলে,
–” ইচ্ছে করছে না। আর হ্যাঁ, একটা কথা বলি, তুই ছোয়াকে ডিভোর্স দিয়ে দে। আমি তোকে নতুন করে বিয়ে করাতে চাই। মেয়েও দেখছি। একটা সন্তান হওয়া উচিত তোদের সংসারে।”
শিশিরের ঠোঁটের কোনে ফ্যাকাশে একরকম আত্মবিস্মৃতির হাসি খেলে যায়। শান্ত কণ্ঠে বলে,
–” তাতে কী হবে, মা? আমি যদি আরেকটা বিয়ে করি, তবুও এই ঘরে কোনো সন্তান আসবে না।”
আনজিলা বেগম চমকে তাকান ছেলের দিকে। গলায় কাঁপন,
–” মানে?”
শিশির কোনো উত্তর দেয় না, ট্রেটা পাশে রাখে। এরপর ধীরে ধীরে মায়ের হাতটা নিজের হাতে নেয়। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে, যেন এই মুহূর্তে বলা প্রতিটি শব্দ মাপতে চাইছে সে। অবশেষে নিচু গলায় বলে,
–” মা! ছোয়ার কোনো দোষ নেই। আমাদের সংসারে বাচ্চা না হওয়ার জন্য ও দায়ী নয়, দায়ী আমি। আমার শারীরিক সমস্যা আছে মা। আমি কখনো বাবা হতে পারবো না। ছোয়া একদম সুস্থ।”
আনজিলা বেগম যেন ঘরের সব আলো নিভে গেছে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে। চোখের পাতা কাঁপে না। ঠোঁট কাঁপে। দীর্ঘদিনের অভিমান যেন ধাক্কা খেয়ে জমাট বাঁধে গলায়। শিশির কথা চালিয়ে যায়,
–” আমি খুব ভয় পেতাম, মা! সমাজের কথা, লোকের টিপ্পণির কথা, তাচ্ছিল্যের কথা ভেবে কোনোদিন এই সত্যি বলিনি, ছোয়াকেও বলতে দেয়নি। আমি তো চেয়েছিলাম, ও যেন স্বাভাবিকভাবে বাঁচে, কিন্তু ভাবিনি, এই চেপে রাখা সত্যিটাই ওর জীবনটা শেষ করে দিচ্ছে। আমার পাপের বোঝা ওর কাঁধে তুলে দিয়েছি আমি, মা! ভাবো তো, কতোটা অন্যায় করেছি?”
শিশিরের গলা কেঁপে ওঠে। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। সে আবার বলে,
–” এই অপরাধবোধ আমাকে ছিঁড়ে ফেলছে, মা! রাতে ঘুমাতে পারি না, সকালে অফিসে মন বসে না, নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। আমি বাঁচতে পারছি না। তাই তোমার কাছে এসে আজ সব বলে ফেললাম। আর লুকাতে পারলাম না।”
আনজিলা বেগম এখনো নির্বাক। চোখে বিস্ময়ের স্থিরতা, যেন সময় থেমে গেছে। শিশির নিচু গলায় বলে ওঠে,
–” তুমি তো এতদিন জানো ছোয়ার দোষ, তাই বারবার বলেছো ডিভোর্স দিতে। এখন যখন জানো সমস্যাটা আমার, তখন তুমি কি ছোয়াকে বলবে না আমায় ডিভোর্স দিতে?”
আনজিলা বেগম চোখ বন্ধ করে ফেলেন। বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা ঢেউ উঠে আবার স্তব্ধ হয়ে যায়। অনেক শব্দ মনে পড়ে, যা তিনি ছোয়াকে বলেছেন, দিনের পর দিন। অথচ ছোয়া কখনো বলেনি এই সত্যি, শুধু মাথা নিচু করে নিয়েছে সব দোষ, সব অপমান। শিশির বললো,
–” কতোটা স্বার্থপর আমরা, মা! শুধু নিজেদের চাওয়া, নিজেদের সুখটাই দেখি। অথচ ছোয়া, দিনের পর দিন এই অন্যায়ের বোঝা বয়ে চলেছে চুপচাপ। এমনকি তোমার মতো একজন মার রাগ, অপমান, কথার খোঁচাও মুখ বুজে সহ্য করেছে, অথচ আজও বলেনি, দোষ আমার না, দোষ শিশিরের। ও চাইলে পারতো সমাজের সামনে আমায় নগ্ন করে দিতে, অথচ দেয়নি।”
আনজিলা বেগম শ্বাস ফেলেন, জোরে একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। সমস্ত শরীর যেন ভারী হয়ে উঠেছে। শিশির চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। মায়ের কাঁধে একবার হাত রেখে বলে,
–” অনেক কিছুই বলা হলো আজ। অনেক দেরি হয়ে গেছে, মা! অনেক স্বার্থপর আমরা, মা। শুধু নিজেদের কথা ভাবছি, শুধু নিজেদের কথা।”
শিশির চোখ মুছে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আনজিলা বেগম স্থির হয়ে বসে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যে হঠাৎ মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠেন তিনি। এই কান্না কেবল পুত্রের জন্য নয়, একটি ভুল বোঝা মেয়ের জন্য। যাকে তিনি দিনের পর দিন অ*শ্রা*ব্য কথোপকথন করেছেন।
…
বাইরে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। শীতল হাওয়া জানালার ফাঁক গলে ঘরের ভেতর ঢুকে আসছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিশির অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। চারপাশে যেন বিষণ্ণতার সুর। হঠাৎ পিঠে এক আলতো ছোঁয়া। চমকে উঠে ঘুরে তাকায় শিশির। ছোয়া দাঁড়িয়ে আছে। মুখে একটুখানি ক্লান্তি, চোখে প্রশ্নের ছায়া।
কোনো কথা না বলেই হঠাৎ ছোয়াকে বুকে টেনে নেয় শিশির। ছোয়া কিছুটা অবাক হয়। শিশির সাধারণত এমন করে না। ছোয়া অবাক হয়ে ফিসফিস করে,
–” কি হয়েছে শিশির? খাবে না?”
শিশিরের গলা কেঁপে ওঠে।
–” আজ আমি তোমাকে সব কলঙ্ক থেকে মুক্ত করে দিয়েছি, ছোয়া!”
ছোয়া কিছুটা দূরে সরে এসে তার চোখের দিকে তাকায়। শিশিরের চোখ লালচে হয়ে আছে। ভেজা বৃষ্টির আলোয় সে এক অদ্ভুত নির্জন মানুষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোয়া থমকে যায়।
–” শিশির! আমি বুঝলাম না, তুমি কী বলছো।”
শিশির হালকা একটা হাসি দেয়। একটা কষ্টমাখা হাসি, যা দেখে ছোয়ার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
শিশির ধীরে ধীরে বলে,
–” আমি আজ মাকে সব সত্যিটা বলে দিয়েছি। উন্মুক্ত করে দিয়েছি। তুমি সুস্থ, তুমি মা হতে পারো। কিন্তু, বাবা হওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।”
ছোয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গলার কাছে কিছু আটকে যায়।
–” কেন বলতে গেলে এসব?”
শিশির ধীরে ধীরে নিশ্বাস ফেলে।
–” তোমার উপর করা অন্যায়ের বোঝা আমাকে বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে আজকাল। তোমার চোখের আকুতিগুলো আজকাল আমার চোখে বড্ড লাগে। কিছুদিন আগেও আমি এইটা অনুভব করতে পারতাম না। কিন্তু এখন, এখন নিঃশ্বাস নিতে পারি না।”
ছোয়ার চোখ থেকে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ে।
শিশির ছোয়াকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কান্না করে উঠে। তার কণ্ঠ ভেঙে যায়,
–” কেন এমন হলো, ছোয়া? আমি কী অন্যায় করেছি বলতো? কেন আমি এমন হলাম? কেন আমার এই ক্ষমতা নেই? আমারও তো ইচ্ছে করে, একটা সন্তান আসুক আমার জীবনে, যে আমাকে বাবা বলে ডাকবে। অফিসে যাওয়ার সময় যখন দেখি বাচ্চারা বাবার হাত ধরে যাচ্ছে, তখন বুকটা ফেটে যায় ছোয়া। কী পাপ করেছি আমি? কেন আমার ভেতর এই ত্রুটি?”
ছোয়া হাত বাড়িয়ে শিশিরকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে৷ তার ভেজা মুখে দু’হাত রেখে মমতায় বলে,
–” এভাবে বলতে হয় না, শিশির! আল্লাহ যা ভালো বুঝেছেন, তাই করেছেন। তুমি এত ভাবছো কেন? আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবো না। কখনো না। আমাদের সন্তানের দরকার নেই। আমি আর তুমি মিলে আমাদের জীবন কাটিয়ে দেবো। আমি, তুমি আর আমাদের ভালোবাসা।”
ছোয়া শিশিরের চোখের পানি মুছে দেয়। তার কপালে আলতো একটা ভালোবাসার পরশ আঁকে। তারপর নিজেই শিশিরকে বুকে টেনে নেয়। শিশিরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ছোয়াকে। যেন একমুঠো জীবনের সব কষ্ট, সব লজ্জা, সব যন্ত্রণা সেই আলিঙ্গনের ভেতরেই গলে যায়। বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে, অন্তহীন অথচ শান্ত সুরে।
#_চলবে_ইনশাআল্লাহ_🌹