#ঘর
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
Feminine Wisdom
” শিপ্রা সকালে লুচি খাবে তো? করবো তাহলে!” – বৌদির কথায় খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকালো শিপ্রা।কাগজে আজকাল ভালোই চাকরির বিজ্ঞাপন আসছে ওগুলোই গোল গোল করে দাগিয়ে রাখছিলো ও । বেলার দিকে সবাইকে ফোন করবে। মানে এরকমই করছে দুদিন ধরে শিপ্রা।
দুদিনই হলো ও এসেছে এই বাড়িতে। এইটা বাড়ি মানে শিপ্রার বাপের বাড়ি। যদিও ও বাপের বাড়ি বলে না বরং বলে মায়ের বাড়ি। কারণ সেই কবে বাবা মা*রা গেছেন শুধু শুধু একটা সামান্য বাড়ির জন্য বাবাকে হেকে ডেকে লাভ কি!
শিপ্রা দেখলো কুটুস তাকিয়ে আছে শিপ্রার দিকে। সম্পর্কে বৌদি হলেও বয়সে অনেকটাই ছোট মেয়েটা শিপ্রার থেকে।শিপ্রার বিয়ের দু মাস পরেই বিয়ে হয়ে এসেছে মেয়েটা।শান্ত নিরীহ। খুব নিশ্চিন্ত ছিল শিপ্রা মাকে নিয়ে। ছিল কি আজও আছে। সত্যি ভালো মেয়েটা। কি সুন্দর মাথায় করে রেখেছে। মুখ না খুলতেই খাবার রেডি, সব কাজ গোছানো।আসলে কাজ করার স্বাধীনতাও পায়!
ও যা রান্না করে দেয় সেটাই সবাই সোনামুখ করে খেয়ে নেয়। দুদিন হলো এসেছে শিপ্রা শ্বশুরবাড়ি থেকে। এসে থেকেই দেখছে কুটুস নিজের মতো রান্না করে, নিজের মন মত আইটেম। কালকেই তো সকালে রুটি আর আলু চচ্চড়ি দুপুরে নিম পাতা, ডাল আর মাছের ঝোল। ফ্রিজে কত মাছ! শিপ্রার দাদা রবিবার ফ্রিজ ভরিয়ে দেয়। কোনদিন কি মাছ হবে সেটাও কুটুসেরই পছন্দমত হবে।অথচ শিপ্রার! কোনো স্বাধীনতা আছে শ্বশুরবাড়িতে ! সকাল থেকে রাত অবধি কি কি কাজ করবে কিভাবে করবে সবেতেই শাশুড়ির নজরদারি আর এটাই আর নিতে পারছে না শিপ্রা।
বাড়িতে অতিথি এলে কোন চায়ের কাপের সেটটা নামাবে সেটাও অর্ণবের মা বলবে। রান্নার ব্যাপার তো কথাই নেই। ভাতটার নরম শক্ত হওয়াটাও ওনারই নিয়ন্ত্রণে। শিপ্রার ওটাই রাগ তাহলে কাজটাও তুমিই করে নাও!কাজ করবে একজন আবার ছড়ি ঘোরাবে আরেকজন। এটা যে কাজ করে তার পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন।অর্ণব বলে ভালো তো একজন কেউ মাথার ওপর থাকলে ভুলের দায় গুলো থাকে না।
প্রথম প্রথম সেটাই ঠিক মনে হতো শিপ্রার কিন্তু এখন বিয়ের তিন বছর পর খুব অসহায় লাগে।পেপারের দিকে তাকিয়ে এসবই ভেবেই চলেছে শিপ্রা।
” এতো কি ভাবছো বলো তো! লুচি না পরোটা। আমি কিন্তু পরোটাই বলবো। তাতে কিছু তেল কম যাবে শরীরে। সুস্থ থাকবে!” – বলতে বলতেই দেওয়ালে টাঙানো শিপ্রার বাবার ছবিটার ওপর কাপড় দিয়ে মে*রে মে*রে ঝুল ঝাড়ছে কুটুস।
বৌদির ওপর সংসার দিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত ছিল শিপ্রা, বিয়ের পর এই বাড়িতে খুব বেশী আসতো না ও।ইচ্ছে থাকলেও অনুমতি পেত না আসার।বিয়ের পর এই প্রথম মনে হয় টান থাকলো! আর থাকবেও।একটা চাকরি খুঁজে এখানেই থেকে যাবে ও, এরকমই প্ল্যান করে এসেছে।
শিপ্রা তাকিয়ে আছে কুটুসের দিকে। আজকাল বড্ড হিংসে হয় ওকে দেখে। এই সংসার এখন ওর ইশারাতেই চলে। আর শিপ্রা একই সময়ে ওই বাড়ি গিয়েও কিচ্ছু করতে পারলো না। কিচ্ছু না।
” এই তোমার আর ভেবে কাজ নেই আমি পরোটা করে দিচ্ছি। এতো বড় সংসার সামলাও কি করে সেটাই ভাবছি।” – কুটুসের কথায় খুব রাগ হচ্ছে শিপ্রার। গম্ভীর মুখে বললো ” লুচি খাবো!” বেশ বিরক্ত হলো কুটুস।
” সেটা এতক্ষন বলতে কি হচ্ছিলো! এতক্ষনে লুচি দিয়ে যেতাম! বেলা কত হলো! এখনো পেটে কিচ্ছু পড়লো না! যদি আরও কিছুদিন থাকো তাহলে পরের দিনগুলো আমি আমার মতন খাবার দেবো । তোমাকে জিজ্ঞেস করা মানে তোমাকে উপোস রাখা!” -বলেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল কুটুস।
পাশেই মায়ের ঘর শিপ্রার। সে যদি শুনেও নেয় এই কথাগুলো,বৌয়ের প্রতি ভালোবাসা আরও দ্বিগুন হয়ে যাবে। কতটা যত্ন করেছে বৌমা ওনার মেয়েকে।
শিপ্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কুটুসের যাওয়ার পথের দিকে। ওর আর শিপ্রার দাদার সমন্ধ অনেক আগেই ঠিক হয়ে ছিল। অর্ণব আর শিপ্রারও আগে। শুধু বোনের বিয়ে না দিয়ে বিয়ে করবে না বলেছিল দীপেন। তাই শিপ্রার বিয়ের দু মাসের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেছিল দীপেন আর কুটুসের।
তখনই শুনেছিল প্রায় তিন বছরের ছোট এই কুটুস। খুব চিন্তায় ছিল শিপ্রা কে জানে পারবে কিনা ওর মা দাদাকে সামলে রাখতে! আজ শিপ্রা অবাক হয়ে যাচ্ছে। পারবে মানে দাপটের সাথে পারছে। যুক্তি দিয়ে তর্ক দিয়ে কি সুন্দর সবাইকে নিজের হাতে রাখছে। কি সুন্দর বললো আরও যদি কিছুদিন থাকো! মানে কি বলতে চাইছে ও! ও কি যাওয়ার ইঙ্গিত করলো!
মনে মনে ভাবতেই চোখ দুটো জলে ভিজে যাচ্ছে শিপ্রার। একে তো এসে থেকে দেখছে ওর ঘরটার অবস্থা পুরো বদলে দিয়েছে কুটুস। ওটাতে ছড়ানো রয়েছে পুতি, লেস,কাঁচি, ছোট বড় আয়না। ও নাকি জুয়েলারি বানিয়ে বিজনেস করে। তাই এই ঘরটাই ওকে একমাত্র সুবিধা দিতে পারে!যদিও শিপ্রাকে দেখে সব গুছিয়ে দিয়েছে কিন্তু তাও নিজের ঘরের সেই গন্ধটা আর পাচ্ছে না শিপ্রা।
অনেক্ষন কান্নাটা চোখে খেলা করলো শিপ্রার। কেমন অসহায় লাগছে নিজের। বড্ড অসহায়। ওই বাড়িটাতো আজও নিজের হলো না উল্টো নিজের বাড়ি বলে ছোট থেকে যেটাকে চিনতো সেটাও একটু একটু করে বেদখল হয়ে গেছে।ভাবলো এই বাড়িতে এসে আর ফিরবে না এবার । একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়ে এখানেই থেকে যাবে। শাশুড়ির সাথে আর লড়তে পারছে না ও।
কিন্তু এই বাড়িতে কি টিকতে দেবে কুটুস! ভাবনার সাথে সাথে আরেক দফা চোখের জল বেরিয়ে এলো। এক মন বলছে নেই আর কিচ্ছু নেই তোর কিন্তু আরেক মন বলছে অধিকার ছাড়িস না শিপ্রা। লড়াই কর!
” নাও খেয়ে নাও দেখি! ইশ কত বেলা হয়ে গেল! অর্ণব দা কি বলবে বলো তো! বৌটাকে আমার না খাইয়ে মেরে ফেললো!” – হাতের প্লেটটা শিপ্রার হাতে ধরিয়ে দিয়ে হেসে হেসে বললো কুটুস। মুখ টিপে এই হাসিটা খুব মিষ্টি লাগে মেয়েটাকে কিন্তু আজ যেন সহ্য হচ্ছে না।
লুচি চারটে হাতে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না একদম। নিজের বাড়িতে নিজে নিয়ে খাবে এতেই সুখ। এতো আপ্যায়ন ভালো লাগছে না শিপ্রার। ” তুমি খাবে না? ” – জিজ্ঞেস করলো শিপ্রা। কুটুস বললো ” হুম এই তো রুটি হয়ে গেছে, মাকে দুধ দিয়ে দিলাম আমিও খাবো দুটো কলা দিয়ে। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলছে কুটুস।
” এ বাবা আমার জন্য আবার এসব করতে গেলে কেন! আমিও রুটি খেতাম!” – শিপ্রা বলতেই কুটুস চোখ গোলগোল করে বললো ” বিয়ে হয়ে এসে থেকে কোনোদিন ননদের সেবা করতে পারিনি এবার যখন এসেছ ছাড়ছি না। খাইয়ে যত্ন করে তারপর ফেরত পাঠাবো! এমনিতেই কথা আছে অতিথি নারায়ণ,!” –
কথা গুলো বড্ড মিষ্টি কুটুসের।এতো মিষ্টি যে সেটা কান অবধি পৌঁছালেই অস্বস্থি হয়। যার উদ্দেশ্য বলে তার তো হয় কিন্তু বাকিদের মনটা শান্তিতে ভরে যায়। যেমন এই মুহূর্তে প্রভাদেবীর হচ্ছে,
” শিপু তুই কতদিন থাকবি? ” – সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন প্রভাদেবী, শিপ্রার মা, চোখমুখ উজ্জ্বল, হয়তো ছেলে বৌয়ের গর্বে। ওই যে যার উদ্দেশ্য কথাগুলো বলা সে ছাড়া কেউ সেই কথার ধার বুঝবে না।
শিপ্রা দেখলো তাকিয়ে আছেন প্রভাদেবী।একই রকম ভাবে তাকিয়ে আছে কুটুসও, উত্তরের অপেক্ষা করছে।চোখ দুটো উৎসাহে জ্বলজ্বল করছে দুজনেরই।
শিপ্রা এসে থেকেই দেখছে মা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করছে। শাশুড়ি কেমন আছে! অর্ণব এলো না কেন! চলে এলি শাশুড়ির অসুবিধা হবে না! কত প্রশ্ন।
আজ দুজনেই যখন আছে বলে দেবে শিপ্রা। সবটা বলে দেবে আর এটাও বলে দেবে এই বাড়ির এই ঘরটা ওর। এটা ওর অধিকার। ও এখানেই থাকবে। আর খাওয়া দাওয়া! সে ঠিক একটা চাকরির ব্যবস্থা হবে তখন খাওয়া বাবদ দিয়ে দেবে কিছু একটা ।
একটু গুছিয়ে নিয়ে শিপ্রা বললো ” আমি ঠিক করেছি আর যাবো না। এখানেই থাকবো একটা চাকরি ঠিক পেয়ে যাবো!” শিপ্রা দেখলো ধপ করে লম্বা সোফাটায় বসে পড়লেন প্রভাদেবী।সাথে সাথে কুটুস মা বলে চিৎকার করলো। শিপ্রা মুখ তুলে দেখলো প্রভাদেবী শুধু বসেই পড়েছেন আর কিছু হয়নি মানে মা বলে চিৎকার করার মত তো কিছু হয়ই নি।
কুটুসের এইসব ব্যবহার একদম নাটক লাগছে শিপ্রার। ” কি বলছে কুটুস ও ” জিজ্ঞেস করলেন প্রভাদেবী। কথা শুনে যে কেউ বুঝবে যে বৌয়ের প্রতি ভরসা অনেক বেশী মেয়ের চেয়ে।
” মা একটু শান্ত হও! আমি দেখছি! কাল ও শিপ্রার ফোন থেকে অর্ণব দার সাথে কথা হলো কিছু তো অন্যরকম লাগলো না ।আবার বললো এবার গেলে তোমার হাতের বাটার চিকেন খাবো!”- একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে কথাগুলো কুটুস। কিন্তু ভয় যেন ওর গলাকেও কাঁপিয়ে দিচ্ছে বারবার।
চলবে।