ঘর পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
2

#ঘর
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
#দ্বিতীয়_পর্ব_শেষ_পর্ব

” মা একটু শান্ত হও! আমি দেখছি! কাল ও শিপ্রার ফোন থেকে অর্ণব দার সাথে কথা হলো কিছু তো অন্যরকম লাগলো না ।আবার বললো এবার গেলে তোমার হাতের বাটার চিকেন খাবো!”- একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে কথাগুলো কুটুস। কিন্তু ভয় যেন ওর গলাকেও কাঁপিয়ে দিচ্ছে বারবার।

” কি হয়েছিল গো, আমায় বলো!” – কুটুস খুব সতর্কতার সাথে জিজ্ঞেস করলো শিপ্রাকে। শিপ্রা কি বলবে?কি হয়েছিল? সত্যি কি কিছু হয়েছিল! যেকেউ দেখলে ভাববে কি সুন্দর পরিবার। মা ছেলে আর বৌ। এই তো এখানেও দেখছে কিন্তু এই বাড়ি আর ওই বাড়ি বিস্তর ফারাক।

” বলো না আমায় কি হয়েছে? ” – খুব শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো কুটুস। ” আমি আর পারছি না গো এখানে, সকাল থেকে শুরু হয় শাশুড়ির হুকুম! এটা করো, ওটা কোরো না, সকালে জলখাবার থেকে রাতের রান্না সব ওনার নির্দেশ, সপ্তাহের বাজার ওনার নির্দেশ, অতিথি আপ্যায়ন কেমন হবে সেটাও উনি ঠিক করেন।আমার ঘর কেমন সাজানো হবে সেটাও উনি।অর্ণব সে নিজেও যেন বড্ড আস্কারা দেয় এসবে।সেদিনই দুটো চাদর এনে মাকে বলছে কোনটা আমাদের বিছানায় পাতা হবে! খুব সামান্য বিষয় কিন্তু যে সারাদিন খেটে মরে তারও তো মতের একটা দাম থাকা উচিত!আজ এ বাড়িতে আসলেও উনি ঠিক করে দেবেন আসবো কিনা ! এবার আসার সময় অসুস্থ বলে বেরিয়ে এসেছি। এখন তুমি বলো আজ যদি তোমার এমন হতো কি করতে!”- চোখ দুটো ছলছল করছে শিপ্রার।

” বিয়ের পর এটুকু মানিয়ে সব মেয়েদের নিতে হয়! আমরা নিই নি!” – বললেন প্রভাদেবী। ” মা সম্ভব নয়, এগুলো মেনে নেওয়া সত্যি কঠিন। আজ যদি তুমি প্রতি পদে পদে আমায় বাধা দিতে আমি সত্যি এতো গুছিয়ে সংসার করতে পারতাম না।” – কুটুসের কথায় আসতে আসতে শান্ত হলো শিপ্রা। মনে কুটুসের যাই থাকুক মুখে দুটো কথা তো ওর নাম বলেছে! আর কি চাই!

“ছোট থেকেই তো শুনে আসছি মানিয়ে নিতে হবে! নিয়েওছি। কিন্তু সেটারও তো একটা শেষ আছে!” – মিনমিন করে বললো শিপ্রা। ” শেষ বলে কিছু নেই, সবাইকে মানাতে হয়!” – প্রভাদেবী আবার বললেন। সাথে সাথে কুটুস বললো ” না মা বিষয়টা মানিয়ে নেওয়া নয় বিষয়টা অধিকার। দিদির যেটা করতে হবে নিজের অধিকারটা বুঝিয়ে দিতে হবে।ছেলে যখন বিয়ে করে নিয়ে এসেছে, রান্নাঘর থেকে ঘর সবেতেই বৌয়ের অধিকার আছে। আর দসেটা ওখানে থেকেই ঝগড়া করে হোক কেঁদে হোক আদায় করতেই হবে। একটা কথা শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি এখন তোমার এই বাড়িতে যত অধিকার দেখাতে পারবে তার থেকে বেশী ওখানে দেখালে কাজ হবে। “- শিপ্রার দিকে তাকিয়ে বললো কুটুস।

কথাটা শুনে একটু যেন কেঁপে উঠলো শিপ্রা। কি বোঝাতে চাইলো কুটুস এ বাড়িতে ওর অধিকার নেই? তাই কি এই ঘরটা ওর দখলে এখন! ” বুঝতে পারছো তুমি কি বলছি!” আবার বললো কুটুস।

” তুমি আজই বাড়ি যাও! আর যাওয়ার সময় পছন্দ মত বাজার করে রান্না করো! শাশুড়ি কিছু বললে বলবে খুব ইচ্ছে করছিলো খেতে! আর বেশী কিছু বললে তুমিও বলে দেবে তাহলে এক বাড়ি থেকে লাভ কি! যদি ইচ্ছে গুলো মনেই মারা যায়!”

শিপ্রা দেখলো প্রভাদেবীও দেখছে মেয়েকে। কুটুস অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে কে জানে ভয় পেয়ে গেছে হয়তো যে শিপ্রা আবার এ বাড়ি ফিরে এলো এটা ভেবে!

শিপ্রার ইচ্ছে করছে বলে এইটাই আমার বাড়ি। আমি এখানে থাকবো, খাবো কিন্তু পারছে না। একটা কথাও বলতে পারছে না। সত্যি তো কিসের অধিকার আছে আর! মা তো যা যা পাওয়ার মানের ভাগের সবটাই গুছিয়ে দিয়ে দিয়েছে বিয়ের সময়। কিচ্ছু চায়নি অর্ণব কিন্তু টাকা গয়না কিচ্ছু বাদ রাখেনি দীপেন আর প্রভাদেবী।তাহলে! কি বলবে শিপ্রা! যে এই ঘরটাও আমার চাই! সত্যি কি ঘরের জন্য! আজ যদি ওই বাড়িতে কুটুসের মত প্রাধান্য পেত ও এই একটা ঘরের জন্য এটা করতো ও!

যত ভাবনা গুলো আসছে রাগ গিয়ে পড়ছে অর্ণবের ওপর, ভারতীদেবীর ওপর! শেষে নিজের ওপর। সত্যি তো ওই বাড়িতে তো হঠাৎ উড়ে গিয়ে জুড়ে বসে নি ও! নিয়ম করে লোকজন আগুন সবাইকে সাক্ষী রেখে ভারতীদেবীর পছন্দে গেছে! তাহলে অধিকারের জন্য যদি চিৎকার করতেই হয় ওই বাড়িতেই করবে! এ বাড়িতে এই ঘরে বেকার মায়া বাড়িয়ে লাভ কি!

উঠে পড়লো শিপ্রা। ব্যাগ খুলে চুড়িদারটা বের করে নিলো। পাশে ফোন রাখা ছিল সেটা নিয়ে ফোন করলো অর্ণবকে। ধরলো না। মেসেজ আসলো মিটিংএ আছি। সাথে সাথে ঘুরিয়ে করলো ভারতীদেবীকে। মাথায় তখন দাউ দাউ করছে আগুন। বুক জুড়ে অধিকারের লড়াই।

” হ্যালো!” – ভারতীদেবী বলতেই শিপ্রা বললো ” কি করছো? “, ভারতীদেবী বললেন ” এই তো ভাত বসালাম!” শিপ্রা বললো ” চালটা বেশী নিও আমি আসছি সাথে একটু মুসুর ডাল কোরো। আর আলু সেদ্ধ। আমি এসে ডিম ভেজে নেবো!”- একনাগাড়ে বলে গেলো শিপ্রা কথা গুলো।

কুটুস আর প্রভাদেবী তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হাঁপাচ্ছে যেন শিপ্রা। উত্তেজনা, রাগ, হেরে যাওয়া সব মিলিয়ে বড্ড নাড়িয়ে দিয়েছে মেয়েটাকে।

” আচ্ছা করে রাখছি। তুই পারলে একটু টক দই আনিস! শেষ পাতে ভালো লাগবে!” – ওই পাশ থেকে ভারতীদেবী বললেন। শিপ্রা যেন ভাবতেই পারছে না। বিয়ের এতগুলো দিন পর এই প্রথম ও মেনু ঠিক করলো! আর সেটা মেনেও নিলেন ভারতীদেবী। ফোনটা রাখতেই কুটুস বললো ” এই তো পেরেছো! প্রথম দিন থেকেই মুখটা খুললে আজ দিনটা আসতোই না। পাঁচটা কথার একটা প্রথম দিন থেকে তোমাকেও বলতে হতো! আচ্ছা ওসব বাদ দাও! তোমার দাদা চিংড়ি এনেছিল তুমি ভালো খাও বলে! ভেবেছি আজ দুপুরে লাউ চিংড়ি বানাবো। কিন্তু আমি আজ আটকাচ্ছি না তোমায়। তুমি যাও। মাছটা টিফিন বক্সে দিয়ে দি নিয়ে যাও! ”

“আমার শাশুড়ি চিংড়ি খায় না। অর্ণবেরও এলার্জি।” – শিপ্রা বলতেই কুটুস বললো ” তো? তুমি রান্না করে খাবে! ওই বাড়িতে তুমিও তো একটা মানুষ! ওরা নাই খেতে পারে। তুমি রান্না করে খাবে! দিদিভাই আগে নিজেকে অধিকার দিতে শেখো দেখবে সবজায়গায় অধিকার এমনিতেই তৈরী হয়ে গেছে।” কুটুসের কথায় ওকে জড়িয়ে ধরলো শিপ্রা।

খুব শান্তি লাগছে, এই যে ভারতীদেবী একটা কথা মেনে নিয়েছে এতেই যেন ও জিতে গেছে। অনেক শান্তি পেয়েছে। আর সেই থেকেই কুটুসকে জড়িয়ে ধরেছে শিপ্রা। যতই হোক এটা তো ওই শেখালো! সত্যি তো অধিকার! কত ছোট অথচ দামি কথা।

” এই ঘরটা নিয়ে ভেবো না, এটা তোমারই থাকবে,” – কানের কাছে ফিসফিস করে বললো কুটুস। শিপ্রা বললো ” লাগবে না এখন, তুমি তোমার ব্যবসা করো! যখন দরকার হবে ঠিক দখল করে নেবো! নিজের অধিকার ছাড়বো কেন!”- শিপ্রাও ফিসফিস করে বললো।

সাথে সাথে হেসে ফেললো কুটুস। আর শিপ্রাও।শত হোক এই মেয়েটার জন্য তো ওর ঘরটা বাঁচলো। তার জন্য ও হাসতে হাসতে এই ঘর টাও ছেড়ে দিতে পারে!

—-সমাপ্ত ——-