ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-৩৩+৩৪

0
200

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৩৩
টানা কয়েকদিনের ব্যস্ততার পরে আজকের দিনটা রবিবার, তাই অপর্ণা একটু দেরিতেই উঠলো। অনিন্দিতাও অন্য দিনের থেকে রবিবারে দেরিতে ওঠে, তাই চা হতে আজ দেরি হবে বুঝেই সৌমিক কে আর ডাকলো না অপর্ণা। মেজো মাসীরা গত কাল বিকেলে ফিরে গেছেন, এই কদিন পারত পক্ষে শাশুড়ির মুখোমুখি হয়নি অপর্ণা, গিয়ে খাওয়ার থালা রেখেই চলে এসেছে, পাছে ওকে দেখলে শাশুড়ি রীতা পিসির বাড়ি যাওয়ার জন্যে রাগারাগি করেন। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে লক্ষ্য করেছে শাশুড়িও ওকে এড়িয়ে যাচ্ছেন, দু একটা খুব প্রয়োজনীয় কথা বললেও এই প্রসঙ্গে একটাও কথা তোলেন নি।

শ্বশুর মশাই এবং শাশুড়ির সম্পর্ক আবার আগের মতোই স্বাভাবিক, তাঁর যা যা প্রয়োজন সবই শাশুড়ি নিজে উঠতে না পারলেও অন্যদের দিয়ে করিয়ে দিচ্ছেন আগের মতোই। দুজনের মধ্যে কথোপকথন এতটাই সাধারণ যে মাঝে মাঝেই অপর্ণার সন্দেহ হচ্ছে সেদিন রাতে ও ঠিক শুনেছিলো কিনা! মিতার সঙ্গে সেদিনের পর থেকেই একবারের জন্যেও দেখা বা কথা হয়নি অপর্ণার, এমনকি যে মিতা আগে মাঝে মাঝেই ছাদে আসতো সে আর ছাদেও আসেনি একদিনও।

সৌমিক ঘুমোচ্ছে বলেই আজ আর জানলা গুলো খুললো না অপর্ণা, নাহলেই এক্ষুনি সরাসরি চোখে রোদ এসে ঘুম ভেঙে যাবে। নিজের টুকটাক কাজকর্ম গুছিয়ে নিয়ে নিচে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলো অপর্ণা এমন সময় দরজায় টোকার আওয়াজ হলো। বেরিয়ে দেখলো অনিন্দিতা চায়ের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে, ওকে দেখেই হাসলো,

নে ধর, মা বললেন কদিন খুব খাটনি গেছে তাই কাউকে আজ আর নিচে নামতে হবে না। আমিও আমাদের চা ঘরেই নিয়ে এলাম।

অপর্ণা হাত বাড়িয়ে ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকে এলো, ওর শাশুড়ি সাধারণত এসব বিষয়ে খুব কড়া, চায়ের সময় সবারই নিচে যাওয়া বাধ্যতামূলক। খুব কম দিন হয় যেদিন উনি ঘরে বসে চা খাওয়ার অনুমতি দেন। দরজায় টোকার আওয়াজে সৌমিক উঠে পড়েছিলো, অপর্ণার সাইড টেবিলে নামিয়ে রাখা ট্রে থেকে কাপ তুলে নিতে নিতে হাসলো,

কতদিন পরে মনে হচ্ছে রবিবার এলো! আজ সারাদিন শুধু ঘুমিয়ে কাটাবো।

অপর্ণা হাসলো,

ওই জন্যেই মা আজ নিচে নামার ছুটি দিয়েছেন তোমাদের দুই ভাই কে, বলেছেন তোমরা খুব ক্লান্ত আছো!

চা খেয়ে সৌমিক আবার বালিশ টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো, সকালের দায়িত্ব তার নয় তবু সারা সপ্তাহ অনিন্দিতা একা সামলায় বলে রবিবার দিন অপর্ণাও একটু হাত লাগায়, অন্য দিন বিরক্ত হলেও রবিবারে রীনাও এতে খুব বেশি আপত্তি জানান না। যদিও এখনও অনিন্দিতার রান্না শুরুর দেরি ছিলো তাই ঘরটা একটু গুছিয়ে রাখতে অপর্ণা উঠে পড়ছিলো, তাকে উঠতে দেখে সৌমিক হাত ধরে টানলো,

বসো না একটু, আজ তো রবিবার! কি সারাদিন এতো কাজ করো! একটু বরের খোঁজ খবরও তো নাও না!

অপর্ণা আবার বসে পড়ল, অভিমানী গলায় বললো,

তোমার যেদিন ছুটি থাকবে সেদিন আমাকে বসে থাকতে হবে, আর আমার কিছু বলার থাকলে তুমি শোনো না! তখন যদি ফোনও করি তুমি ব্যস্ত আছো বলো! তুমি যেমন আমার খবর নিতে চাওনা ব্যস্ত আছো বলে, তেমনি আমিও এখন ব্যস্ত! আমারও তোমার খোঁজ খবর নেওয়ার এখন সময় নেই!

সৌমিক অপর্ণার কোমর জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা রেখে হাসতে হাসতে বললো,

ঠিক আছে, যাও তাহলে! তুমি তোমার ব্যস্ততা নিয়ে থাকো। তুমি খোঁজ খবর রাখতে চাও না তো কি হয়েছে, আমার কি খবর নেওয়ার লোকের অভাব আছে? একজন তো আমার সারাদিন খবর নেয়!

অপর্ণা ঘুরে বসলো, ছদ্ম গম্ভীর গলায় বললো,

কে সে শুনি একবার? কার এতো সাহস যে আমাকে না জিজ্ঞেস করেই আমার বরের খবর নেয়?

সৌমিক হাসতে হাসতেই নিজের মোবাইলটা অপর্ণার দিকে এগিয়ে দিলো, হোয়াটসঅ্যাপ খুলে মিতার নম্বরটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

দেখো! প্রতিদিন আমার শরীরের খবর নেয়! আমি খেলাম কিনা জিজ্ঞেস করে! আর তুমি? আমাকে পাত্তাই দাও না! শুধু সমরের কি হলো সেটা জিজ্ঞেস করতে থাকো!

অপর্ণা হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিলো, মেসেজগুলো যদিও খুব সাধারণ, তবু প্রতিদিন সারাদিনে সত্যিই অনেকবার করে খুঁটিনাটি জানতে চাওয়া হয়েছে। একটা জিনিষ একটু অবাক হয়েই লক্ষ্য করলো অপর্ণা, মাত্র দিন তিনেক আগে থেকে এই মেসেজগুলো শুরু হয়েছে, এর আগে কোনো মেসেজ নেই! অপর্ণা কে ভ্রু কুঁচকে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সৌমিক একটু অস্বস্তিতে পড়লো,

এই তুমি কি সিরিয়াস হয়ে গেলে নাকি! আমি কিন্তু জাস্ট মজা করছিলাম। খুব সাধারণ মেসেজ, ওইভাবে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছো কেন? ছাড়ো এসব, তুমি কি বলতে চাইছিলে কিন্তু আমি শুনতে সময় পাইনি সেটা বলো।

অপর্ণা মোবাইল থেকে চোখ তুলে অন্য মনস্ক গলায় বললো,

সেরকম কিছু নয়, খুব সাধারণ কথা, পরে বলবো। আচ্ছা, এই মেসেজগুলো তো মাত্র দিন তিনেক এর, ও তোমাকে আগে কখনো মেসেজ করেনি? মাত্র তিনদিন ধরে করছে?

সৌমিক একটু অবাক হলো,

তুমি কি ভাবছো বলোতো? এটা কিন্তু খুব সাধারণ ব্যাপার! আগে করেনি ঠিকই কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওর বাবার অসুস্থ হওয়ার পরে তো আনব্লক করলাম ওকে, সেই সময় তো নিজেই বলেছিলো তোকে অহেতুক বিরক্ত করবো না! আসলে এখন মনে পড়লো, সেদিন রাতে কথা হলো যখন তখন বলছিলো আমাকে পরের দিন রেস্ট নিতে, তারপর থেকেই মেসেজ করছে। প্রথমে অফিসে এসেছি কিনা জানতে চেয়েছিলো, সেই থেকেই টুকটাক খবর নেয়। তুমি এতো সিরিয়াস হয়ে যাবে জানলে তো দেখাতামই না!

আনব্লক তো অনেকদিন আগে করেছিলে, তখন তো মেসেজ করতো না, যেটুকু দরকার ফোনেই বলতো! আমার অদ্ভুত লাগছে এই কারণেই যে যেদিন থেকে ও তোমাকে মেসেজ করতে শুরু করেছে ঠিক সেদিন থেকেই যেনো ও আমাকে এড়িয়ে চলছে! এটা কেনো! আমার মনে হচ্ছে ও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাইছে না আর, শুধু তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে!

চিন্তিত গলায় বললো অপর্ণা, সৌমিক অবাক হলো,

কোথায়? কি ভুল ভাল বলছো! ওই তো তোমাকে গাড়িতে তুলে বাড়ি পৌঁছে দিলো সেদিন!

অপর্ণা মাথা নাড়লো,

নাহ! তার পরের কথা বলছি! বাড়িতে ফিরে আর বলছে না! আচ্ছা ওর অফিস কি আমার ইউনিভার্সিটির কাছে?

আমি নিজে জিজ্ঞেস করিনি কখনো তবে যদ্দুর রবির কাছে শুনেছি না! ও হয়ত ফিরছিলো কোনো জায়গা থেকে, অফিসে যায়নি, কারণ অফিসে গেলে পাঁচটায় ওখানে পৌঁছতে পারতো না, বেরোতেই তো ছটা হয়ে যাবার কথা!

সৌমিক এর কথায় অপর্ণা চিন্তায় পড়লো, ও কি তাহলে ইচ্ছে করেই ওকে রীতা পিসির বাড়ি নিয়ে যাবে বলে গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিলো! অপর্ণার মুখের পরিবর্তন সৌমিকেরও নজরে পড়ছিলো, তাকে একদৃষ্টে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপর্ণা নিজেই বললো,

ও জানো তো আমাকে রীতা পিসির বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলো, ওঁর সঙ্গে আমার মিতাদির বাবার শ্রাদ্ধের দিন আলাপ হয়েছিলো। যাবার সময় বা ওখানে গিয়েও অনেক কথা বলছিলো কিন্তু ফেরার সময় থেকেই দেখলাম খুব বেশি কথা বলছে না!

সৌমিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো,

তুমি আবার মিতার সঙ্গে রীতা পিসির বাড়িতে গিয়েছিলে নাকি! ওহ! তুমি না বড্ড ঝামেলা বাড়াও! মায়ের পিসিকে একদম পছন্দ নয়, জানতে পারলেই রাগারাগি করবে! আর কখনো যেওনা!

অপর্ণা ইচ্ছাকৃত ভাবেই গলায় বিরক্তির স্বর আনলো,

আমি কি ইচ্ছে করে গিয়েছি নাকি! গাড়িতে ওঠার পরে তো মিতা দি বললো আমাকে! তখন কি করতাম বলো তো? বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নেমে পড়তাম? আর তোমার মায়ের যে ঠিক কাকে কাকে পছন্দ নয়, সেটা আমি কি করে জানবো বলতো? তুমি বরং একটা লিস্ট করে দিও আমাকে!

সৌমিক মাথা নাড়লো,

সেটা বুঝতে পারছি, মাকে ওই জন্যেই তো ফোন করে বলে দিয়েছিলাম আগেই। বলেছি বৃষ্টিতে তোমার আর কিছু করার ছিলো না! তবে তখন তো মা রীতা পিসির ব্যাপারটা জানতো না, ওটা জানলে আর এক বিপত্তি হবে!

কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, রীতা পিসি তো বললো তোমাদের বাড়িতেই থাকতো একসময়, তার ওপরে মায়ের রাগের কারণ কি? কি কারণে সে বাড়ি থেকে চলে গেছে?

খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো অপর্ণা, সৌমিক একটু বিরক্ত গলায় উত্তর দিলো,

ঠিক রীতা পিসি নয় মায়ের রাগ আসলে ঠাকুমার ওপরে! আমার ঠাকুমা মায়ের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করতেন আর রীতা পিসি কে যেহেতু ঠাকুমা বাড়িতে এনেছিলেন তাই পিসিও ঠাকুমার কথা শুনেই চলতো, মায়ের কোনো কথাকেই পাত্তা দিতো না! ঠাকুমার সঙ্গে মিলে মাকে অপমান করতো। তাই মা রীতা পিসিকে পছন্দ করতো না একদম।

অপর্ণার খারাপ লাগছিলো, সত্যিই বাইরের কেউ যদি বাড়ির বউয়ের কথাকে পাত্তা না দেয় তাহলে তো খারাপ লাগারই কথা। নিজের সঙ্গে মনে মনেই শাশুড়ির তুলনা করছিলো অপর্ণা, আজ যদি দীপা দি কে ওর থেকে বেশি প্রায়োরিটি দেওয়া হয় তাহলে ওরও তো খারাপ লাগবে নিশ্চয়ই। অপর্ণা একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো,

আচ্ছা! রীতা পিসি তো তোমাদের সেইরকম কেউ হয়না শুনলাম, উনি নিজেই বলছিলেন সেদিন, তাহলে ওনার নিজের বাপের বাড়ি থাকতে এখানে এসে উঠলেন কেনো?

সৌমিক মাথা নাড়লো,

সত্যি কথা বলতে কি আমি এগুলো খুব ভালো করে জানিনা, আর মনেও নেই সবটা। খুব ভাসা ভাসা খানিকটা মনে আছে। রীতা পিসি যখন এবাড়ি ছেড়ে গিয়েছে তখন আমার খুব বেশি হলে বছর দশেক বয়স হবে। অতো ছোটো বেলার কথা কি মনে থাকে? দিদি তখন বছর চোদ্দো, ওর কিছু থাকলেও থাকতে পারে। এটুকু জানি হাজব্যান্ডের সঙ্গে কিছু নিয়ে সমস্যা ছিলো তাই ঠাকুমা এখানে এনে রেখেছিলেন ওনাকে। তবে রীতা পিসি নাকি যখন এসেছিলো আমাদের বাড়িতে তখন শুধু দিদি হয়েছে, তাই অতো আগের কথা আমি জানিনা। আমি তো জন্ম থেকে পিসিকে আমাদের বাড়িতেই দেখেছি।

রীতা পিসির চলে যাওয়ার কথা তোমার মনে আছে?

অপর্ণার জিজ্ঞাসার উত্তরে সৌমিক একটু অন্য মনস্ক হলো,

হুঁ, সেটা মোটামুটি আছে! ঠাকুমার সঙ্গে মায়ের খুব ঝগড়া হয়েছিলো, ঠাকুমা চাইছিলো না পিসি যাক! কিন্তু তখন তো ঠাকুমা খুব অসুস্থ, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতো না তাই খুব বেশি কিছু করতে পারে নি, পিসি চলে গিয়েছিলো শেষে!

আর বাবা? তিনি কিছু বলেন নি?

সৌমিক অবাক হলো,

বাবা! এসব সংসারের বিষয়ে বাবা তো কিছু বলে না! এখন বলেনা যখন তখনও নিশ্চয়ই কিছু বলেনি, আমার ঠিক মনে নেই! তবে ঠাকুমা নিজেই নিশ্চয়ই বলেছিলো যা বলার, তাই মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিলো। সত্যি বলছি আমি অতো কিছু জানিনা, জানার বয়সও ছিলো না তখন! আমি তার পর থেকে কখনো যাইনি পিসির বাড়ি, তবে মিতা যেতো, পিসিও আসতো ওদের বাড়ি। ওর কাছ থেকেই খবর পেতাম!

রীতা পিসির মা শুনলাম ঠাকুমার বন্ধু ছিলেন, তার মানে নিশ্চয়ই দুজনের একজায়গাতেই বাড়ি ছিলো? তোমার ঠাকুমার বাপের বাড়ি কোথায়?

খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো অপর্ণা, সৌমিক হাসলো,

তুমি আজ সক্কাল সক্কাল রীতা পিসি কে নিয়ে পড়লে কেনো?

অপর্ণা একটু লজ্জা পেলো,

এমনই! খুব জানতে ইচ্ছে হলো, তোমাদের বাড়ি সম্বন্ধে সেরকম কিছুই তো জানি না তাই! এই যে রীতা পিসি যে এই বাড়িতেই থাকতো এটাও তো আগে শুনিনি কখনো! আগে যদি জানতাম মায়ের সঙ্গে রীতা পিসির সম্পর্ক ভালো নয়, তাহলে তো যেতাম না ওনার বাড়ি! তুমিই তো আমাকে কিছু ক্লিয়ার করে বলো না! সেই জন্যেই তো আমি বারবার ঝামেলায় পড়ি!

সৌমিক হেসে ফেললো,

ক্লিয়ার করে বলার মতো কি আছে এতে! রীতা পিসি আমাদের আশ্রিতা ছিল, এর বেশি কিছু নয়। তবে ঠাকুমার বাপের বাড়ি আমিও কখনো যাইনি, শুনেছি বর্ধমানের দিকে কোথাও ছিলো। গেলে তোমাকেও বলতাম হয়ত। শুনেছি প্রথম দিকে খুব ভাব থাকলেও ঠাকুমার ভাইয়ের সঙ্গে ঠাকুমার সম্পর্ক খুব বেশি ভালো ছিলো না পরে। আগে তো একদমই যাতায়াত ছিলো না, আমার ছোটো বেলায় আমি খুব কম দেখেছি ওদের, এমনকি ওরা তো দাদার বিয়েতেও আসেনি। এই প্রথম দেখলাম আমার বৌভাতের সকালে তাও বাবার মামাতো ভাই আর তাঁর স্ত্রী এলেন, মনে হয় বাবার অসুস্থতার খবর পেয়েছিলেন বলে!

অপর্ণা চমকে তাকালো,

বৌভাতে এসেছিলেন? কোন জন বলতো? আমি তো দেখিনি!

সৌমিক অবাক হলো,

কিভাবে বোঝাবো কোন জন? আমি কি খেয়াল করে রেখেছি নাকি তোমার সঙ্গে কে কখন কথা বলছিলো। আমি তো হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করছিলাম!

অপর্ণা হতাশ হলো, ইসস, ও কিছুতেই ওনাদের চিনতে পারছে না! তখন কি ছাই জানত যে এতো দরকার পড়বে এসব! সৌমিক এর ঠাকুমার বাপের বাড়িতে যাওয়া গেলে হয়তো রীতা পিসির বাপের বাড়ির কাউকে খুঁজে পাওয়া যেতো, কিছু জানতে পারতো ও, এখন তো সেসব কিছুই জানার উপায় থাকলো না!

আচ্ছা তোমার ঠাকুমা নাহয় মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন কিন্তু তোমার বাবা কিছু বলতেন না ঠাকুমা কে? ওনার তো উচিত ছিলো ওনার মায়ের ব্যবহারের প্রতিবাদ করা?

নিরীহ মুখে প্রশ্ন করলো অপর্ণা, সৌমিক হাসলো, মজার গলায় বললো,

সবাই কি আর এই অধমের মতো যে, বউয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেই দৌড়ে যাবে? আমার বাবা উল্টে মাকেই বাজে কথা বলতো!

অপর্ণা অবাক হলো,

বাবা তো ভীষণ চুপ চাপ, পারত পক্ষে তো কথাই বলেন না! আমার বিশ্বাস করতেই ইচ্ছে করছে না যে ওনার মতো মানুষ স্ত্রীর সঙ্গে বাজে ব্যবহার করতে পারেন!

সৌমিক ম্লান হাসলো,

সময় বদলায় অপর্ণা, সেই বদলানো সময়ের সঙ্গে মানুষও বদলে যায়! বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দাপট কমে যায়, আজকের বাবা কে দেখে তুমি পঁচিশ ত্রিশ বছর আগের বাবাকে বিচার কোরো না!

অপর্ণা গলার স্বর নামিয়ে আনলো,

আমি দাদা কে দেখে ভাবতাম দাদা এরকম কেনো! মা যে দিদিভাই কে চাকরি ছাড়িয়ে দিলো তাও দাদা কোনো প্রটেস্ট করেনা কেনো! আজ বুঝলাম তোমার দাদা আসলে তোমার বাবার মতোই! এই বউ কে সাপোর্ট না করাটা সে ওখান থেকেই শিখেছে।

সৌমিক হাসলো, অপর্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

ভুল জানো তুমি! দাদাও বৌদিকে সাপোর্ট করে তবে মায়ের আড়ালে, যাতে মা দুঃখ না পায়! আর সেগুলো মাও জানে! তোমার কি মনে হয় দাদা বৌদির বাপের বাড়িতে টাকা দেয় বা বৌদির মায়ের চিকিৎসায় খরচ করে এগুলো মা বোঝে না? এটা যে কেউ বোঝে, কারণ বৌদির বাড়ির অবস্থা যে সেরকম কিছু ভালো নয় সেটা বিয়ের সময় আমরা সবাই জানতাম। যদি টাকা পয়সা দেওয়াতে আপত্তি থাকতো মায়ের তাহলে এইখানে মা দাদার বিয়েই দিতো না। তুমি আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলে না যে মাকে লুকিয়ে দাদা বৌদির সংসার খরচ দেয় সেটা আমি জানি কিনা! জানতাম না ঠিকই তবে অনুমান করতে পারি, মাও সেটা পারে। কিন্তু জিজ্ঞেস করে না কখনো!

অপর্ণার মনের মধ্যে কোথাও শাশুড়ির জন্যে খারাপ লাগা জন্ম নিচ্ছিলো, ও সৌমিকের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো,

তাহলে এগুলো জানা সত্বেও তুমি মাঝে মাঝেই মায়ের সঙ্গে এতো কড়া করে কথা বলো কেনো? মা যখন চান না তখন তুমি মিতার সমস্যায় ঢোকো কেনো?

সৌমিক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে অপর্ণা কে জড়িয়ে ধরলো,

তোমার মন খারাপ হয়ে গেলো নাকি! একটা কথা কি জানো, আমি আমার মতো, দাদা দাদার মতো! মা সেটা জানে! কিন্তু আমরা কেউ বাবার মতো নই, হতেও চাইনি কখনো! আসলে মাকে ছোটবেলায় আমরা এতো দুঃখ পেতে দেখেছি যে এখন দুঃখ কম দিতে চেষ্টা করি। দাদা লুকিয়ে রাখে আর আমি মা অহেতুক জেদ দেখালে কড়া কথা বলি ঠিকই, কিন্তু মা এটা খুব ভালো করে জানে যে মাকে কখনো কোনো মতেই ছেড়ে যেতে পারবো না!

অপর্ণা আবেশে চোখ বন্ধ করলো,

সেই জন্যেই তুমি মিতা কে বিয়ে করো নি? মাকে ছেড়ে যেতে হবে বলে!

সৌমিক অপর্ণার চুলের মধ্যে মুখ ডোবাতে ডোবাতে গাঢ় গলায় বললো,

মিতা আমাকে নিজেকে প্রুভ করার সুযোগ দেয়নি, আমি বলেছিলাম ওর এখানে থাকলে কোনো অসুবিধা হবে না! ও আমাকে বিশ্বাস করেনি। বাবা ক্ষমা চাওয়া সত্বেও মায়ের করা অপমানের শোধ নিতে ও আমাকে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করছিলো, ওর আসলে বিয়ে নয়, প্রতিশোধটাই মুখ্য ছিলো!

অপর্ণা অভিমানী গলায় বললো,

এখন তো আবার ও ফিরে এসেছে, তুমিই বললে আমার থেকে তোমার বেশি খোঁজ খবর নিচ্ছে! এখন যদি ও তোমার সঙ্গে সব কিছু ঠিক করে নিতে চায়, আবার নতুন করে শুরু করতে চায়, তাহলে তুমি কি করবে? আমাকে ভুলে যাবে নাতো?

সৌমিক দু হাতে অপর্ণার মুখ তুলে ধরলো, গভীর আশ্লেষে ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট নামিয়ে আনতে আনতে বললো,

এরকম কখনো হয় নাকি? যেটা শেষ হয়ে গেছে সেটা শেষই, আর কখনো নতুন করে শুরু হয়না! তুমি একটা পাগলী!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৩৪
দেখতে দেখতে আরো একটা সপ্তাহ কেটে গেলো, মনে মনেই ছটফট করছিলো অপর্ণা, রীতা পিসি কেনো শাশুড়ি কে ব্ল্যাকমেল করছিলো সেটা জানার কোনো উপায় নেই। সৌমিক এতো ব্যস্ত থাকে সারা সপ্তাহ যে একটা ছুটির দিন ওকে উপভোগ করতে দেখলে অপর্ণার খুব ভালো লাগে। তখন মনে হয়না যে রবীন কাকুর বলা কথাগুলো মা জানতে পেরেছে জানিয়ে ওকে মায়ের কাছে পাঠায়। এই করে করেই সৌমিক কে আর বলা হয়ে ওঠেনা, তাই শাশুড়িও মুখ গম্ভীর করেই থাকেন ওকে দেখলে। শাশুড়ি যে ওর সঙ্গে খুব বেশি কথা বলছেন না সেটা বাড়ির ছেলেরা কেউ লক্ষ্য না করলেও অনিন্দিতা করছিলো। দু একদিন ধরে মাঝে মাঝেই এর কারণ অপর্ণার কাছে জানতে চেয়েছে ও কিন্তু অপর্ণা এড়িয়ে গিয়েছে বারবার। কিই বা বলবে ও, না সমরের কথা না সেদিন রাতে শোনা শ্বশুর শাশুড়ির কথোপকথন, কোনোটাই তো ওর পক্ষে অনিন্দিতা কে বলা সম্ভব নয়।

তাছাড়া অনিন্দিতার প্রকৃতি একটু অন্য রকম, এমনিতে হাসি খুশি, মিশুকে কিন্তু কোনো ব্যাপারে যেচে দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। তাকে দেওয়া যেকোনো কাজ সে যথেষ্ট দায়িত্ব সহকারে পালন করে কিন্তু অন্যের সমস্যায় সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে চায়না। শাশুড়ি কে সন্তুষ্ট করে চলাই তার একমাত্র লক্ষ্য, তাঁর ঠিক ভুলের বিচার সে কখনো করেনা। কিন্তু এতেও যে সে রীনার মন জয় করতে পারে তা কিন্তু কখনোই নয়, তার নিজস্ব ভাবনা চিন্তার অভাব থাকাকেও রীনা ভালো ভাবে নেন না। কোনো কোনো ব্যাপারে তার এই মুখ বন্ধ করে রাখার স্বভাবের জন্য সে শাশুড়ির কাছেই বকুনি খায়।

এবাড়িতে নতুন আসার পর থেকেই এগুলো লক্ষ্য করেছে অপর্ণা, নিজে অনিন্দিতার রান্নাঘরের কাজের চাপ দেখে সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়েছে মাঝে মাঝে,অনিন্দিতা কিন্তু নিতে রাজি হয়নি। শাশুড়ি যখন বিরক্ত হয়েছেন অনিন্দিতার ওপরে কোনো কারণে, তখন হয়ত অপর্ণা প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজে রীনার কাছে বকুনি খেয়েছে কিন্তু অনিন্দিতা একবারের জন্যেও মুখ খোলেনি। এমনকি অপর্ণার রাতের রান্নার দায়িত্বেও অনিন্দিতা কখনো সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি, অপর্ণা অনিন্দিতার হয়ে প্রতিবাদ করলেও ও অপর্ণার হয়ে কখনো প্রতিবাদ করেনি।

ইদানিং এসবের কারণে অপর্ণা নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে, অনিন্দিতার ব্যাপারে ও খুব বেশি মাথা ঘামায় না, বিভিন্ন ধরনের গল্প করলেও খুব বেশি গোপন কথা আলোচনা করা বন্ধ করে দিয়েছে। সেই জন্যেই এই কথাগুলো বলতে চায়নি অপর্ণা, কারণ এগুলো শেয়ার করলেও অনিন্দিতা কোনো পজেটিভ সাজেশন দেবেনা, শুধু শুনবে আর খুব বেশি হলে শাশুড়ির আড়ালে শাশুড়ি সম্পর্কে দু একটা বিরূপ মন্তব্য করতে পারে। এগুলো আবার অপর্ণার একদম পছন্দ নয়, মুখে এক মনে আরেক এই মানসিকতা তার ভালো লাগে না।

অপর্ণা বলতে না চাইলেও স্বাভাবিক কৌতূহল থেকেই অনিন্দিতার জানার প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিলো। যে জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়, তার প্রতি মানুষের স্বাভাবিক কৌতূহল থাকে। সেই জন্যেই আজ দুপুরে অপর্ণা ক্লাসে যায়নি দেখে সে তার দৈনন্দিন রুটিন এর দিবানিদ্রা বন্ধ রেখে জায়ের ঘরে টোকা মারলো। অপর্ণা দুপুরে ঘুমোয় না, ক্লাস না থাকলে সে সাধারণত এই সময়টায় পড়াশোনা করে আজও তাই করছিলো। টোকার আওয়াজে দরজা খুলে অনিন্দিতা কে দেখে সে অবাক হয়ে গেলো। অনিন্দিতা ঘরে ঢুকে খাটের ওপরে গুছিয়ে বসলো, বাটামে হেলান দিয়ে জায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

বলতো খুলে ব্যাপারটা! কিছুতো নিশ্চয়ই হয়েছে তোদের মধ্যে, মা তোকে দেখলেই অন্য দিকে তাকিয়ে থাকছে কেনো?

অপর্ণা ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে খাটে উঠে বসলো, অনিন্দিতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো,

খুব শখ না ঝগড়া শোনার! মা ওপরে উঠে আসতে পারবে না বলে এতো সাহস, আজ পা ঠিক থাকলে তো আর জিজ্ঞেস করতে আসতে সাহস পেতে না!

অনিন্দিতাও হেসে ফেললো,

যা বলেছিস! মাকে দেখলেই আমার কেমন ভয়ে বুক শুকিয়ে আসে! তবে তোর দম আছে ভাই, কিরকম লড়ে যাস শেষ পর্যন্ত!

অপর্ণা হাসলো,

তোমারও এটা করা উচিত বলেই আমার মনে হয়! সব কিছুকেই যে ঠিক বলতে হবে এটার কোনো মানে নেই। ভুল তো সবারই হয়, তোমার আমারও হতে পারে, কিন্তু সেটা কেউ শুধরে না দিলে তো ওই ভুলটাই সারাজীবন করে যাবো তাই না?

অনিন্দিতা ঘাড় নাড়লো,

পাগল! ভুল শোধরাতে গিয়ে বাঁশ খাই আর কি! তোর বর এক্ষুনি ঝাঁপ দিয়ে পড়বে তাই তুই এসব করতে সাহস পাস! আমার বর তো একটাও কথা বলবে না! ওরকম বরেরা পেছনে থাকলে না সবাই বীরত্ব দেখায়!

অপর্ণার মুখে কালো ছায়া পড়লো। সেদিনের সৌমিকের বলা কথাগুলো মনে পড়ছিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে অপর্ণা হাসলো,

তোমার বর তোমার পেছনে নেই বলতে চাও দিদিভাই? এই যে তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছ বলে দাদা তোমার বাড়িতে খরচ দেয় এটা নাহয় এখন মা জানেন না! যদিও আমার মনে হয় উনি জানেন কিন্তু মুখে বলেন না! তাও যদি তোমার কথাই ঠিক হয় উনি পরে যদি ধরো জানতে পারেন কখনো, তাহলে কি হবে? দাদা কি টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেবে? নিশ্চয়ই দেবেনা, অন্য কোনো অজুহাত ঠিক খুঁজে বার করবে। যেমন তোমার মায়ের অ্যাপ্যয়েন্টমেন্টের দিন করলো! আর তুমি সেটা জানো বলেই সেই কনফিডেন্স থেকে চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারলে। যদি সত্যি তোমার প্রয়োজন থাকতো তাহলে তুমি যে করেই হোক এটা করে যেতে। আমি যখন রজত দা এখানে থাকবে বলে ক্লাস কামাই করতে চাইনি তখন কিন্তু শুধু মা নন তোমার দেওরও বেশ বিরক্ত হয়েছিলো আমার ওপরে। আমাকে আড়ালে বলেও ছিলো কিছুদিন কামাই করতে, কিন্তু শেষে ও বুঝলো যে কোনো কিছুতেই আমি সেটা করবো না। তখন বাধ্য হয়ে ও নিজেই দীপা দি কে খুঁজে নিয়ে এলো। ঠিক দাদাও তোমাকে সাবস্টিটিউট এর ব্যবস্থা করে দিয়েছে বলেই তুমি চাকরি ছেড়েছো স্বেচ্ছায়, কেউ তোমাকে আসলে জোর করেনি, সেটা আমি এখন বুঝতে পারি। তোমার বরং মনে হয়েছে এতে তুমি অনেক আরামে থাকবে, আর সত্যি কথা বলতে কি শুধু ভোর বেলায় ওঠাটাই কষ্টের তার পরে তো মোটামুটি সকালে নটার পর থেকে পরের দিন ভোর পর্যন্ত আর তোমার কোনো কাজ থাকে না!

অনিন্দিতা খানিকক্ষন চুপ করে থাকলো, মনে মনে নিশ্চয়ই সে ক্ষুব্ধ হয়েছিলো কিন্তু তার রাগের ছাপ তার মুখে পড়লো না। সে যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে, সবাইকে তোয়াজ করে রাখার যে পদ্ধতি সে শ্বশুর বাড়িতে এসে থেকেই করে আসছে আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। একটু পরেই সে মুচকি হাসলো, জায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

তুই কি সাইকোলজির স্টুডেন্ট নাকি? মানুষের মনের কথা পড়ে ফেলিস! আচ্ছা ঠিক আছে আমার বরও খুব ভালো তোর বরের মতোই, এটা মেনে নিলাম। এবার বল তোর এতো ভালো বরের সাপোর্ট থাকতেও মা কেনো রেগে আছে তোর ওপরে?

অপর্ণা সোজাসুজি জায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো এতক্ষন ধরে, তার কথার কি রিয়াকশন হয় দেখার জন্যে অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু অনিন্দিতার কোনো পরিবর্তন নেই দেখে মনে মনেই সে বিস্মিত হলো, এতো নির্লিপ্ত মুখ নিয়ে এতো কথার পরেও অনিন্দিতা কি করে থাকতে পারছে! ও তো কিছুতেই নিজের মুখের রাগ, দুঃখের এক্সপ্রেশন গুলোকে চেপে রাখতে পারেনা, যাকে ওর পছন্দ হয়না তাকে দেখলেই মুখে বিরক্তির ছাপ পড়ে।

কি ভাবছিস? বল কিছু? কি হয়েছে তোদের?

অনিন্দিতার দ্বিতীয়বার প্রশ্নে অপর্ণা বাস্তবে ফিরলো, হেসে বললো,

না কিছু নয়! তুমি আমার ওপরে রাগ করোনি দেখে খুশি হলাম, ভাবছিলাম এই কথাগুলো শুনে তুমি রেগে যাবে বোধহয়!

অনিন্দিতা হাসলো,

ধুস! আমার অতো রাগ টাগ নেই! কি হলো সেটা বল!

অনিন্দিতা যে কারণ না শুনে এখান থেকে যাবে না সেটা অপর্ণা বুঝতেই পারছিল, তাই জায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো,

আমি একটা খুব বড়ো অপরাধ করেছি, মানে মা সেরকমই ভাবছেন আর কি! তাই কথা বলছেন না! সেদিন বৃষ্টির জন্যে ক্লাস থেকে ফেরার সময় মিতার গাড়িতে ফিরেছিলাম, শুধু তাই নয়, মিতার সঙ্গে রীতা পিসির বাড়িতেও গিয়েছিলাম। মানে জোড়া অপরাধ বলতে পারো!

অনিন্দিতা চোখ বড়ো করলো,

সর্বনাশ! তাহলে তো বেশ ঝামেলা পাকিয়েছিস! রীতা পিসি কে তুই চিনলি কি করে?

অপর্ণা হাসলো,

সেটা আরো ঝামেলার, মিতার বাবার শ্রাদ্ধে মাকে লুকিয়ে গিয়েছিলাম তোমার দেওরের কথায়, সেখানে দেখা হয়েছিলো! তুমি রীতা পিসিকে চেনো?

অনিন্দিতা চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো,

আমার সঙ্গে আলাপ নেই তবে চিনি! মিতার বাড়িতে আসে তো! ও যখন এখানে আসতো ঋজুর কাছে তখন রীতা পিসির দেওয়া আচার, মোরব্বা আমাকে লুকিয়ে দিয়ে যেতে চাইতো! রীতা পিসি পাঠাতো আমাকে মিতার হাত দিয়ে। যদিও আমি খুব আচার ভালোবাসি কিন্তু তাও রিস্ক নিইনি বাবা! মা জানতে পারলে কেটে রেখে দিতো আমাকে! তোর বড্ড বেশি সাহস!

অপর্ণা নিজেও জায়ের পাশে শুয়ে পড়লো, না জানার ভঙ্গিতে বললো,

একটা কথা বলো দিদিভাই, মিতা এখানে এতো আসতো আর এখন কেনো আসেনা? মানে মায়ের ওর ওপরে রাগের কারণ কি?

অনিন্দিতা হাই তুললো,

মায়ের রাগের আবার কারণ হয় নাকি? রাগ হলেই হলো! ওই রীতা পিসিকেই দেখনা, কি এমন করেছে যে ওকে মা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো? মিতাও তাই! ওর বাবা, মা নাকি কবে মাকে অপমান করতো তাই মা ওর বাবাকে অপমান করলো একদিন! মাঝখান থেকে ঋজুর সঙ্গে বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে গেলো। নাহলে তো ও ঋজু আর রবি একেবারে গলায় গলায় ছিলো এককালে।

সৌমিক এর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কথা অনিন্দিতার মুখ দিয়ে কখনো বেরোবে না সেটা অপর্ণা জানতো, তাই প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য কথা জিজ্ঞেস করলো,

রীতা পিসি কেনো চলে গিয়েছিল জানো তুমি?

অনিন্দিতা ঘাড় কাত করলো,

হুঁ একবার দিদি বলেছিলো তোর বিয়ের সময়ে তখন শুনেছিলাম।

অপর্ণা অবাক হলো,

আমার বিয়ের সময়ে? তখন জানলে?

অনিন্দিতা হাসলো,

আর বলিস না! তোর বিয়ের সময়ে জাস্ট বলতে হয় তাই রীতা পিসিকে বাবা গিয়ে বলে এসেছিলো তাতে যে পিসি এসে হাজির হবে আমরা তো কেউ ভাবিনি! আমরা ভেবেছিলাম মা যখন কথা বলেন না তখন নিশ্চয়ই বাবার নেমন্তন্ন পেয়ে পিসি আসবে না! এদিকে বাবার মামার বাড়ি আর রীতা পিসির বাড়ি তো একজায়গায়, ওখান থেকে তোর বৌভাতের দিন তো বাবার মামাতো ভাই আর তার বউ এসেছে। তারা তো রীতা পিসিকে দেখে খুব বিরক্ত, ওরা নাকি কেউ রীতা পিসিকে পছন্দ করেনা। অনেকটা ওদের দেখেই তো রীতা পিসি ফিরে চলে গেলো, নাহলে অতো সহজে যেতো নাকি! তখন দিদি বলছিলো যে রীতা পিসির সম্মান জ্ঞান নেই একদম, মা এতো অপমান করে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলো তাও আবার কার্ড পেতেই চলে এসেছে।

কিন্তু রীতা পিসিকে বাবার মামাতো ভাইরা পছন্দ করেন না কেনো? রীতা পিসির সঙ্গে তো ওনাদের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই?

খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো অপর্ণা, অনিন্দিতা মুখ বিকৃত করলো,

আরে রীতা পিসি কি আমাদের স্ট্যান্ডার্ডের নাকি? ওই গ্রামের দিকে হয়না যে রকম বন্ধুত্ব, সেরকম ছিলো বাবার মায়ের সঙ্গে রীতা পিসির মায়ের। খুব গরীব ছিলো ওরা, এখন ঠাকুমা রীতা পিসি কে এখানে থাকতে দিয়ে স্ট্যান্ডার্ড হাই করে ফেলেছে এদিকে ওর বাপের বাড়িতে তো কিছু নেই। এমনকি রীতা পিসি যখন বাপের বাড়ি তে ফিরতে চেয়েছিলো তখন ওরা থাকতে দিতেও পারে নি। এবার ওর দাদারা ওকে আশ্রয় দেয়নি অথচ ঠাকুমা দিয়েছে এতে ওর দাদাদের খুব রাগ হয়েছিলো ওরা নাকি ঠাকুমার ভাই কে অনেক অপমান করেছিলো। ঠাকুমার ভাই নাকি বুঝিয়েছিল অনেক তাও ঠাকুমা শোনেনি তাই ঠাকুমার ভাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না আর।

অপর্ণার কাছে বিষয়টা ঠিক পরিস্কার হলো না। একজন আশ্রয় দিতে চায়নি বলে অন্য কেউ যদি আশ্রয় দেয় তাহলে রাগের কি আছে! এটা তো ভালো কাজ! ঋজুর ঠাকুমা তো ভালো কাজই করেছিলেন, বন্ধুর মেয়ে বলে তাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাঁর সমান স্ট্যান্ডার্ড নয় বলে দূরে সরিয়ে দেন নি! অপর্ণা একটু চিন্তিত গলায় বললো,

আচ্ছা দিদিভাই আমার বৌভাতের দিন ঠাকুমার ভাই পো আর তার বউ এসেছিলো বললে না? ওনাকে মনে আছে তোমার? আমার বিয়ের অ্যালবাম দেখালে আমাকে চেনাতে পারবে?

অনিন্দিতা খিল খিল করে হাসতে লাগলো,

অ্যালবাম দেখাতে হবে না তোকে এমনই চিনিয়ে দিচ্ছি। ওই কাকিমার যা মুখ! আমার বিয়েতে তো আসেনি তাই আমাকে নাকি খুঁজছিলো, কেউ নাকি ডেকে দেয়নি তাই তোর দাদা কে যা ঝাড় দিয়েছিলো! শেষে দিদি ডেকে দিচ্ছি বলায় ওকেও ঝাড় দিয়েছে। তার পরে তো আমি গেলাম ওনার কাছে, তোর দাদা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলো কথা বলাতে। আমাকে দেখে বলে কি জানিস? আমি নাকি রান্নাঘরে বন্দী হয়ে আছি এখানে! যাইহোক বিয়েতে আসতে পারেনি বলে আবার গিফট দিলো আমাকে, যেতেও বলেছিলো একদিন, সে আর হয়নি।

অপর্ণা চমকে উঠলো, এই মহিলাকে তো ও ও দেখেছিলো তখন! ওর ননদ কে ঋষির বউকে রান্নাঘরে আটকে রেখেছিস বলে বলছিলেন! রীতিমত কড়া গলায় সমালোচনা করেছিলেন বৌভাতের সকালে! অপর্ণা সোজা হয়ে উঠে বসলো,

ওনাদের বাড়ি ঠিক কোথায় জানো দিদিভাই? ঋজু বলছিলো বর্ধমানের দিকে? চলো না সবাই মিলে ঘুরে আসি একদিন, তোমাকে তো যেতে বলেছে। দাদা আর ঋজু মিলে গাড়ি চালাবে, কারোরই কষ্ট হবে না তাহলে! আমার আসলে খুব গ্রাম ভালো লাগে, গেলেই রসূলপুরের কথা মনে হয়!

অনিন্দিতা অবাক হয়ে গেলো,

তুই পাগল নাকি! মাকে জিজ্ঞেস না করেই প্ল্যান করে ফেলছিস! তবে তোর প্ল্যান যদিও মা পারমিশন দিলেও সাকসেসফুল হবে না কারণ ওনারা তো এখন ওখানে থাকেন না। অনেকদিন কলকাতায় চলে এসেছেন!

অপর্ণা উত্তেজনায় নিজের বুকের ধড়াস ধড়াস করতে থাকা আওয়াজটা কে চাপা দিয়ে লাফ মেরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো,

কলকাতায় থাকেন! কোথায়?

অনিন্দিতা হাসতে লাগলো,

তুই তো বড্ড উৎসাহী মনে হচ্ছে ওনাদের বাড়ি যেতে! আরে এইখানেই থাকেন, পাশের ব্লকে। গিয়ে কিছু লাভ নেই, গ্রামের “গ” ও পাবি না বুঝলি! শুনেছি ঋষির দাদু আর ঠাকুমার ভাই দুই শালা ভগ্নিপতি একসঙ্গে এখানে বাড়ি করেছিলেন লটারিতে জমি পেয়ে। তখন নাকি তাঁদের ভীষণ ভাব ছিলো। পরে বোধহয় রাগারাগি হয়েছে। একসময় নাকি সারাদিন ওঁরা বোনের বাড়িতেই থাকতেন। এই যে মিনতি মাসী আমাদের বাড়িতে কাজ করে সেটাও নাকি অনেকটা ওনাদের কাছ থেকেই পাওয়া, মিনতি মাসির মাকে নাকি ঠাকুমার ভাই বউই এনে দিয়েছিলেন একসময়।

অপর্ণা কয়েক মুহূর্ত জায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ধপ করে খাটে শুয়ে পড়লো। হায় রে! যাঁদের খুঁজতে ও বর্ধমান যেতে চাইছিলো তাঁরা পাশের ব্লকে থাকেন! এবারে তো রীতা পিসির খবরও খুব সহজেই পাওয়া যাবে!
ক্রমশ