#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৩৫
দিন তিনেক পরের এক সকালের কথা। সৌমিক এর আজ খুব বেশি তাড়া ছিলো না, কাজের চাপ একটু কমই ছিলো, তাই সে অপর্ণার জন্যে অপেক্ষা করতে চেয়েছিলো কিন্তু অপর্ণা ঠিক সময়ে তৈরি হতে পারলো না কিছুতেই। বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করেও যখন অপর্ণা তৈরি হতে পারলো না তখন সৌমিক বিরক্ত হলো,
অপর্ণা! বড্ড দেরি হচ্ছে তোমার, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি!
অপর্ণা কোনো রকমে বাথরুম থেকে স্নান সেরে বেরিয়ে এসে ঘড়ির দিকে তাকালো,
আমার তো খাওয়া হয়নি এখনো! তোমার দেরি হয়ে যাবে এবার, তুমি বেরিয়ে যাও নাহয়!
সৌমিক কে একা বেরোতে দেখে রীনা বিরক্ত হলেন, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বললেন,
সকাল থেকে তো কোনো কাজ করতে হয়না, তাও কি একটু সময় মতো তৈরি হতে পারেনা মেয়েটা? প্রতিদিন দেখি একা একা বেরোয়!
অপর্ণা সৌমিকের পেছনে পেছনে দোতলা থেকে নেমে এসেছিলো তার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে সৌমিক কোনো উত্তর না দিয়ে জুতোর ফিতে বাঁধতে লাগলো। ছেলেকে চুপ করে থাকতে দেখে রীনা আরো বিরক্ত হলেন,
ফেরার সময় অন্তত নিয়ে এসো সঙ্গে করে, নাহলে আবার কার না কার গাড়িতে উঠে পড়বে!
সৌমিক ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেলো, তার বাইক রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যাওয়ার পরে অপর্ণা দরজা বন্ধ করে এসে খেতে বসলো। তার খাওয়া যখন প্রায় শেষের পথে তখন মিনতি ছাদ থেকে জামা কাপড় মেলে নিচে নেমে এসে বাড়ি যাওয়ায় জন্যে দরজার দিকে এগোলো। তাকে দেখেই অপর্ণা হাত তুললো,
মিনতি মাসী! একটু দাঁড়াও প্লিজ! আমার হয়ে গেছে খাওয়া, তোমার সঙ্গে বেরিয়ে যাবো! একা একা অটো স্ট্যান্ড পর্যন্ত হাঁটতে ভালো লাগে না!
মিনতি কাজ সেরে বেরোনোর জন্যে জুতো পরছিলো পায়ে, অপর্ণার কথায় থমকে দাঁড়ালো। ঘড়ির দিকে তাকে তাকিয়ে দেখতে দেখে অপর্ণা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো,
তোমার দেরি হবে না গো, আমি হাতটা ধুয়েই আসছি।
রীনা খাটে বসে তাকিয়ে ছিলেন, মিনতি অনেক পুরনো দিনের লোক, প্রায় রীনার খাস বলা যেতে পারে। মিনতি রীনার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো, গিন্নীর অনুমতি ছাড়া তার পক্ষে ছোটো বৌমার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। রীনা ইশারা করলেন, মিনতির সঙ্গে বেরোনোতে তাঁর কখনো আপত্তি থাকেনা। তিনি বরং মনে মনে খুশিই হচ্ছিলেন যে অপর্ণা মিনতির সঙ্গে বেরোলে আর মিতার মুখোমুখি হবার সুযোগ পাবে না। ইদানিং তিনি লক্ষ্য করছেন অপর্ণা প্রায় দিনই ঋজুর সঙ্গে বেরোনো বা বাড়ি ফেরা কোনোটাই করেনা যদিও তাতে তার খুব বেশি দোষ নেই, ঋজু নিজেই এতো তাড়াহুড়ো করে বেরোনোর সময় যে অপর্ণা ওর সঙ্গে তাল দিয়ে উঠতে পারে না।
কিন্তু রীনার সেটা একদম পছন্দ নয়, তিনি মাঝে মাঝেই এই নিয়ে ছেলেকে বলেছেন,
একই দিকে তো যাও, আগেও তো তোমার তাড়া থাকতো তাও নিয়ে যেতে, এখন যেতে কিসের অসুবিধা হয়? প্রতিদিন ওর একা একা যাওয়া আমার একটুও ভালো লাগে না।
মায়ের এই সব বিষয়ে কথা বলা সৌমিকের একটুও পছন্দ নয়, সেও খুব বিরক্ত হয়,
তুমি এত চিন্তা করো কেনো বলতো? অপর্ণা কি বাচ্চা নাকি যে হারিয়ে যাবে? ওকে একটু একা একা চলাফেরা করতে দাও, তবে তো রাস্তাঘাট চিনতে শিখবে!
রীনা চুপ করে যান, তাঁর আসল বিরক্তির কারণ ছেলের সামনে প্রকাশ করতে পারেন না। মনের মধ্যে তাঁর সারাক্ষন চিন্তা হয়, এই অপর্ণার একা যাওয়ার সুযোগে মিতা আবার মাঝে মাঝেই ঋজুর বাইকের পেছনে উঠে অফিস যাওয়া শুরু করবে নাতো! একসময় তো এটাই প্রতিদিনের নিয়ম ছিলো, তখন অনেকটা দূরে অফিস হওয়ায় ঋজু মেট্রো ধরতো, কিন্তু তার আগে বাইকে করে মিতা কে নামিয়ে দিয়ে বাইক মেট্রো স্টেশনের পাশে গ্যারেজে রেখে যেতো। সেই চিন্তা থেকেই ছেলে বেরোনোর ঠিক কতক্ষন পরে মিতা বেরোয় সেদিকে দৃষ্টি রেখে খাটের পাশের রাস্তার দিকের জানলায় তাকিয়ে বসে থাকেন তিনি। মিতা অবশ্য প্রায় দিনই গাড়ি নিয়েই বেরোয়, তাও ঋজুর বেশ অনেকটা পরে, সেটা দেখার পরে তাঁর মনের মধ্যে শান্তি হয়।
মিনতির অপেক্ষার কয়েক মিনিটের মধ্যেই, রীনার অন্য মনস্কতার মাঝে অপর্ণা দোতলা থেকে প্রায় দৌড়ে নামলো, রীনার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা আসছি বলেই মিনতির সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো। রীনার মুখ মিনতিও লক্ষ্য করছিলো কদিন ধরেই, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে অপর্ণা কে জিজ্ঞেস করলো,
দিদি তোমার ওপরে রেগে আছে নাকি ছোটো বৌমা?
অপর্ণা হাসলো, একটু মজার গলায় বললো,
মাসি! তুমি নিজেই আমায় ফাঁসিয়েছ, আবার নিজেই কারণ জানতে চাইছো?
মিনতি একটু থতমত খেলো, অপর্ণার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে ভয়ের গলায় বললো,
আমি? আমি আবার তোমাকে কি করে ফাঁসালাম বৌমা?
অপর্ণা হি হি করে হাসলো,
ওই যে মিতার বাবার শ্রাদ্ধে গেছি বলে দিয়ে! আমার শাশুড়ি যা রেগে আছেনা আমার ওপরে, বাড়ি থেকে বার করে না দেয়!
মিনতির মুখে লজ্জার ছাপ পড়লো, খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বললো,
ঋজুও জানে নাকি বৌমা? আমি আসলে তোমাদের ভালো করতেই গিয়েছিলাম। মেয়েটা একটুও ভালো না গো! তুমি জানোনা ঝগড়ার সময় ও দিদিকে কি খারাপ খারাপ কথা বলেছিলো!
অপর্ণা মিনতির কাঁধে হাত রাখলো,
আমি একটুও রাগ করিনি মিনতি মাসি! আমি জানি তুমি আমাদের ভালোই চাও! তুমি বলে না দিলে কি করে জানবো বলো, কোনটা ঠিক করছি আর কোনটা ভুল! শুধু একটা অনুরোধ করবো তোমাকে? তোমার যেগুলো অন্যায় মনে হবে তুমি আমাকে জানাবে, মাকে বলে দিও না। আসলে মায়ের তো বয়স হয়েছে উনি এসব শুনলেই রেগে যান, তারপরে ঋজুর সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়। সব সময় মা ছেলেতে ঝগড়া হলে ভালো লাগে বলো?
মিনতি সহমত হলো,
সে একরকম তুমি ঠিক বলেছো বৌমা! মা, ছেলে দুজনেই সমান! জেদে কেউ কারোর থেকে একটুও কম যায়না! তবে আমি সব কথা বলিনা বৌমা!
অপর্ণা হাসলো, যদিও সে আন্দাজ করতে পারছিলো, তার মিতার বাড়িতে রীতার সঙ্গে দেখা হওয়ার খবর নিশ্চয়ই মিনতি শাশুড়ি কে দিয়েছে তবু না জানার ভান করে বললো,
হ্যাঁ গো মাসী সেও আমি জানি! এই যে মিতার বাড়িতে রীতা পিসির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো, এই কথাটা যে তুমি মাকে বলে দাওনি তাই তো আমি বেঁচে গিয়েছি! নাহলে মায়ের যা রীতা পিসির ওপরে রাগ, জানতে পারলে আর আমাকে আস্ত রাখতো নাকি!
মিনতি মনে মনে প্রমাদ গনলো! উফফ! দিদি ভাগ্যিস এই কথাটা আবার ছেলে কে ডেকে বলেনি! তাহলে যে ও কি বিপদে পড়তো! তবে মনে মনেই একটু অবাক হচ্ছিলো মিনতি, রীতাকে ছোটো বৌমা চিনলো কি করে, এ বাড়িতে তো তার বিষয়ে কখনো কিছু আলোচনা হয়না! আর তার ওপরে দিদির রাগের কথা সে জানলোই বা কি করে! মনের কৌতূহল বেশিক্ষন ধরে রাখার চেষ্টা না করে প্রশ্নটা করেই ফেললো মিনতি,
তুমি রীতাকে কি করে চিনলে বৌমা? দিদি যে তার ওপরে রেগে আছে কি করে বুঝলে?
অপর্ণা কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই এই প্রশ্নটার জন্যেই অপেক্ষা করছিলো, মিনতির মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো,
ওমা! রীতা পিসি তো আমার বিয়েতে এসেছিলো, তখনই তো পরিচয় হয়েছে! তুমি সব ভুলে যাও মাসী! মা যে রীতা পিসিকে পছন্দ করেন না সেতো তাঁর ব্যবহার দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো তখনই! তুমি যে সেদিন রাতে আমাকে বরণ করতে বললে মাকে তখন তো রীতা পিসিই ডালা নিয়ে এলো! মা তো রীতা পিসির হাত থেকে ডালা নিয়ে দিদিকে দিয়ে ডালা ঠাকুরঘরে পাঠিয়ে দিলো, মনে নেই তোমার?
মিনতি লজ্জা পেলো, সেদিনের রাতে সত্যি খুব খারাপ ব্যবহার করা হয়েছিলো বৌমার সঙ্গে। সে একটু মলিন হাসলো, অস্বস্তির গলায় বললো,
দিদি ওরকম কিন্তু নয় বৌমা, এতো বছর তো এখানে আছি, কোনোদিন ঐরকম দেখিনি! সেদিন রাতে যে কি হলো দিদির, আমার ওপরে সাধারণত রাগ করেনা দিদি কখনো, সেদিন আমাকেও কতো কথা বললো! আসলে দাদা পড়ে যাওয়াতে খুব চিন্তায় ছিলো মনে হয়! তুমি কিছু মনে করো নি তো বৌমা? আমি দিদিকে তো ঋজু কে খবর দিতেই বারণ করেছিলাম কিন্তু দিদি শুনলো না। ঋষি তো একটু চুপচাপ তাই দিদি ঋজুর ওপরেই বেশি ভরসা করে, ওকে অতোটা করেনা!
অপর্ণা মলিন হাসলো,
তোমার হলে কি করতে মাসী? কিছু মনে করতে নাতো? ওই ঠান্ডায়, বৃষ্টির মধ্যে যদি তোমাকে কেউ বাইরে বসিয়ে রাখতো?
মিনতি অস্বস্তিতে পড়লো,
আসলে বৌমা সেও ওই রীতার জন্যেই! দিদি ওর জন্যেই এতো রেগে ছিলো! ও যে আসবে সেটা কেউ ভাবেনি তো! কোনো লজ্জা শরম নেই গো, বললেই চলে আসতে হবে নাকি!
অপর্ণা কথা ঘোরালো,
হুঁ, ওকে তো দেখলাম অনেকেরই পছন্দ নয়! ওই বৌভাতের দিন বাবার মামাতো ভাইরা এসেছিলো ওরাও তো রীতা কে দেখে বিরক্ত হচ্ছিলো দেখলাম!
মিনতি উৎসাহিত হলো,
হ্যাঁ গো! ওদেরই তো সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ওই রীতা কে! ওর জন্যেই তো এ বাড়ির মাসীমার সঙ্গে ওবাড়ির মাসীমার গন্ডগোল হয়ে গিয়েছিলো। ওই যত নষ্টের গোড়া! এতদিন তো আসেনি ওরা, এবার তো আমিই খবর দিয়েছিলাম দাদার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বলে, তাই ওরা এসেছিলো!
অপর্ণা মিনতির দিকে তাকালো,
তুমি ওদের কে কি করে চিনলে? ওরা তো কাছাকাছি থাকে শুনলাম, ঋজু বলছিলো সেদিন!
মিনতি হাসলো,
অনেকদিন চিনি গো! আমার মা আর মাসি দুজনে এবাড়ি, ওবাড়ি কাজ করতো! একসময় বাটি চালাচালি হতো কতো, যেকোনো ভালো রান্না হলেই পাঠানো হতো। আমি তখন ছোটো ছিলাম তাই ছুটে ছুটে দিয়ে আসতাম! তাই তো ওই বাড়ির বৌদি কে বললাম যার সঙ্গে ঝগড়া ছিলো সে তো মরে হেজে গেছে, এখন আর ওসব রেখে লাভ কি! তুমিও ভালো, দিদিও ভালো, নিজেরা সব মিটমাট করে নাও আবার! সেই জন্যেই দাদার খবর শুনে এসেছিলো।
অপর্ণা মিষ্টি হাসলো,
আমারও ওদের বেশ ভালো লেগেছিলো, একদিন আমাকে নিয়ে যাবে মাসী?
মিনতি একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকালো,
হ্যাঁ, একদিন এরকম যখন তুমি বেরোবে সেরকম দিনে নিয়ে যাবো! বৌদিও তোমার কথা জিজ্ঞেস করে মাঝে মাঝে। ওদের বাড়ি গেলে দিদি রাগ করবে না জানি তাও দিদি কে কিছু বলো না এখন, পরে জানলে জানবে নাহয়!
ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো, আপাতত কাজ হাসিল হয়ে গেছে দেখে সামনে আসা অটোটার দিকে হাত দেখালো অপর্ণা। প্রথম ক্লাসটা গেলো ঠিকই কিন্তু এটাতে উঠতে পারলে ও পরের ক্লাসটা নিশ্চয়ই ধরতে পারবে! বৌমা কে অটোর দিকে হাত দেখাতে দেখে মিনতি থমকে দাঁড়ালো, তারও পরের বাড়ি তে কাজের দেরি হয়ে যাচ্ছিল, গল্পে গল্পে সে অনেকক্ষন দেরি করে ফেলেছে। অটো তে উঠে বসে অপর্ণা হাত তুললো,
মাসী এলাম!
মিনতি মাথায় হাত ঠেকালো,
সাবধানে যেও!
আজ ক্লাস শেষ হবার অনেকটা আগেই সৌমিকের মেসেজ এলো, ও নিতে আসবে অপর্ণা কে। অপর্ণা মনে মনেই একটু হাসলো, সকালে মাকে কথা দিয়ে এসেছে সৌমিক এখন যদি ওকে সঙ্গে না নিয়ে ফেরে তাহলে শাশুড়ি আস্ত রাখবে না ছেলেকে। সৌমিক এর আসতে আরো বেশ কিছুক্ষন দেরি হবে অপর্ণা জানতো তাই অনেকটা ধীরে সুস্থে ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে পাঁচটা নাগাদ বেরোলো। আরো অন্তত আধ ঘণ্টা পরে সৌমিক এলো, দাঁড়িয়েই বললো,
খুব খিদে পেয়ে গিয়েছে!
অপর্ণা ভ্রু কুঁচকে তাকালো, রাতের রান্নার দায়িত্ব তার, এখন খিদে পাওয়া মানে গিয়েই তাকেই রান্না ঘরে ঢুকতে হবে। এই সময়টা খুব ক্লান্ত লাগে অন্তত ঘন্টাখানেক বিশ্রাম না নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে কষ্ট হয়। সে মুচকি হাসলো,
আমারও পেয়েছে! কিন্তু আমি এক্ষুনি গিয়ে রান্না করতে পারবো না! চলো কিছু খেয়ে ফিরি!
অপর্ণা বাইকে উঠে পড়লো, প্রায় ওদের ব্লকের কাছাকাছি এসে একটা ক্যাফেতে ঢুকলো দুজনে। ওখান থেকে বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো, সৌমিক যখন বাইক স্টার্ট করছে তখন ক্যাফের ঠিক উল্টো দিকের দোকানটা থেকে হাতে একটা প্যাকেট হাতে মিনতি বেরিয়ে এলো। মিনতিকে দেখেই অপর্ণা গলা তুললো,
মাসী!
মিনতিও ওদের দেখতে পেয়েছিলো, সৌমিকের এখানে সে কি করছে এই প্রশ্নের উত্তরে হেসে এগিয়ে এসে হাতের প্যাকেট তুলে দেখালো,
ওই যে বৌদির রাতের রান্নার লোক আসেনি, তাই রুটি কিনে দিতে ডেকেছিলো। এগুলো দিয়েই চলে যাবো! আজ তোমাদের বাড়ি যেতে দেরি হয়ে গেলো বৌমা!
অপর্ণা হাসলো,
সে ঠিক আছে, একদিন তো দেরি হতেই পারে। ওনাদের বাড়ি কি সামনেই?
মিনতি উৎসাহিত হলো, হাত তুলে উল্টোদিকের রাস্তায় একটা সাদা রঙের বাড়ি দেখিয়ে বললো,
হ্যাঁ, ওই যে দেখা যাচ্ছে সাদা বাড়িটা, ঐটা! ঋজু তো চেনে! ঋজু নিয়ে যাওনা বৌমা কে একটু! বৌদি বলছিলো বৌমার কথা!
অপর্ণা খুব উৎসাহের দৃষ্টিতে সৌমিকের দিকে তাকালো, সৌমিক যদিও তার উৎসাহে জল ঢেলে দিলো মুহূর্তের মধ্যেই,
সারাদিন পরে এখনও বাড়িতে ঢুকিনি আর এক্ষুনি আবার বেড়ানো! ও তুমি একদিন নিয়ে এসো মাসী তোমার বৌমা কে। দুজনে ঘুরে এসো একদিন, আমাকে টানাটানি করো না এর মধ্যে!
অপর্ণা এই প্রস্তাব তাড়াতাড়ি লুফে নিলো, সৌমিক না নিয়ে যাক যেতে তো আপত্তি করেনি। সে সঙ্গে সঙ্গেই মিনতির দিকে তাকালো,
আজ যাই মাসী, দু একদিনের মধ্যেই যাবো তুমি আর আমি।
মিনতি ঘাড় কাত করলো,
আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা তো গাড়িতে এক্ষুনি পৌঁছে যাবে, দিদি কে বলো আমার আরেকটু দেরি হবে ওখানে। দিদি আবার বড্ড টেনশন করে!
শাশুড়ি কে জানিয়ে দেবে জানিয়ে অপর্ণা বাইকে উঠে বসলো, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে গেলো দুজনে। রীনা সত্যিই মিনতি আজ আসবে না বলে ভাবছিলেন বোধহয়, ছেলে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বিরক্ত গলায় বললেন,
দেখেছো! ঋজু চলে এলো, তবু তার আসার সময় হলো না এখনো! আজকাল বড্ড কামাই বেড়েছে মিনতির!
সৌমিক মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
মিনতি মাসী লোকজনের উপকার করে বেড়াচ্ছে দেখে এলাম। আমরা বি ব্লকের ক্যাফেতে গিয়েছিলাম, দেখলাম সুবোধ দাদুদের রুটি কিনে নিয়ে যাচ্ছে, ওদের বাড়ির নাকি রান্নার লোক আসেনি! আমাদেরকেও যেতে বলছিলো সঙ্গে, দিদা নাকি অপর্ণা কে দেখতে চেয়েছে! বলেছি একদিন অপর্ণা যাবে মাসীর সঙ্গে!
রীনার মুখ নরম হলো,
আমাকেও বলে গিয়েছিলো একদিন অনিন্দিতা আর অপর্ণা কে পাঠানোর জন্যে! নিয়ে গেলেই পারতে! ওঁরা যখন নিজে থেকে সম্পর্ক ঠিক করতে চাইছে তাহলে আমরা আর পিছিয়ে থাকি কেনো?
সৌমিক উঠে পড়লো,
আমার নতুন করে কিছু ঠিক করার নেই! আমরা যেভাবে আছি, ভালো আছি! নতুন করে যোগাযোগ মানেই নতুন করে পুরনো আলোচনা! সেটা আমি চাই না! তবে অপর্ণা যেতে চাইলে যাক, তাতে আমার কিছু বলার নেই!
রত্না এতক্ষন চুপ করে শুনছিল, এবার ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো,
দেখ ভাই, ওনাদের তো কোনো দোষ ছিলো না, ঠাকুমা কে বরং ওঁরা বারণই করেছিলো। আর সত্যি কথা বলতে কি ওনারাও তো অপমানিত হয়েছেন একসময়, দাদুর বাবা, মাকে তো গ্রামের লোক কম কথা শোনায় নি। তার প্রতিফলন তো পড়বেই, তাই না?
সৌমিক কোনো উত্তর না দিয়ে ওপরে উঠে গেলো, তার মনোভাবের কোনো নড়চড় হবে না বুঝেই রীনা মেয়ে কে থামালেন,
ছেড়ে দাও! ওকে জোর করো না! সবার নিজস্ব ভালো লাগা খারাপ লাগা থাকে, তাকে জোর করে চেঞ্জ করা যায়না! ওনারা এসেছেন, আমরা খুশি হয়েছি, আমাদের বাড়ি থেকে কেউ গেলে ওঁরা খুশি হবেন। কিন্তু কে যেতে চায় আর কে চায় না, সেটা তার ওপরেই ছেড়ে দেওয়া ভালো!
রত্না চেয়ারে বসে পড়লো,
তুমি যাবে?
রীনা ঘাড় নাড়লেন,
নাহ! ভেবে দেখলাম ঋজু খুব একটা ভুল বলেনি, নতুন করে পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে তোলার আর দরকার নেই!
অপর্ণা সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে মনে মনে স্থির করতে লাগলো, ওকে তো যেতে হবেই, সে মিনতিও যদি নাও যেতে চায়, ও এখন একাই যেতে পারবে। ক্যাফের উল্টোদিকের সাদা বাড়িটা চেনা ভীষণ সহজ!
ক্রমশ
#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৩৬
সকাল থেকে অনেকবার চেষ্টা করা সত্বেও অফিস থেকে বেরোতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেলো রবির। ড্রাইভার কে মিতার বাড়ির ঠিকানাটা বলে দিয়ে রবি ঘড়ি দেখলো, প্রায় পাঁচটা বাজতে চলেছে, মিতা ফিরে আসার আগেই ওদের বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে কিনা বুঝতে পারছিলো না ও।
আজ বেশ কয়েকদিন ধরেই মিতার মা ওকে ফোন করছেন, উনি বেশ কয়েকটা ছেলের প্রোফাইল দেখে রেখেছেন মিতার জন্যে সেগুলোর সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর নিতে হবে। প্রথম বার ফোনে যখন উনি বলেছিলেন মিতা না থাকাকালীন আসতে ওখানে তখন রবি মনে মনে একটু অবাক হয়েছিলো, ওনাকে বলেছিলো,
কাকিমা, লুকিয়ে যাবার কিছু নেই, মিতা তো এগুলো জানে! ও নিজেই আমাকে সেদিন ট্রেনে দেখিয়েছিলো ছেলেগুলোর ছবি, বলছিলো খোঁজ খবর এনে দিতে হবে।
মিতার মা একটু অস্বস্তি নিয়ে বলেছিলেন,
হ্যাঁ বাবা, আমাকেও তো নিজেই পছন্দ করে দিয়েছিলো তখন, এগোতেও বলেছিলো, কিন্তু এখন কেনো যেনো আবার বেঁকে বসেছে! বলছে ওসব থাক এখন, এখন নাকি ও ওসব নিয়ে ভাবছে না আর!
রবি তখন কথা দিয়েছিলো ওনাকে ও মিতার অনুপস্থিতিতেই আসবে ওদের বাড়িতে। কিন্তু কাজকর্ম শেষ করে কিছুতেই তাড়াতাড়ি বেরোতে পারলো না আজ, পৌঁছতে পৌঁছতে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে। অফিস থেকে বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় ঘণ্টা খানেক লাগলো, বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে রবি পাশেই ঋজু দের বাড়ির দিকে তাকালো। ঋজু র মা খাটে পা ছড়িয়ে বসে আছেন, রাস্তায় দাঁড়িয়েই সামনের জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল রবি, রীনার সঙ্গে চোখাচোখি হলো রবির, ঋজু র কাছে শুনেছিলো কাকিমা পা ভেঙেছেন তাই রবি সামনে এগিয়ে গেলো। কথা বলতে বলতে আরো মিনিট পনেরো গেলো, রবি যখন মিতার বাড়িতে ঢুকলো তখন প্রায় সাড়ে ছটা। মিতা এখনও ফেরেনি, গ্যারেজে ওর গাড়ি নেই দেখে রবি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
মিতার মা রবির জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন, তাকে গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে দেখে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন। রবি উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখলো, বাড়ি একদম খালি, একসময়ের গম গম করা বাড়িটা আজ নিস্তব্ধ। কাকু যতদিন ছিলেন সন্ধ্যে থেকে টিভিতে খবর চলার আওয়াজ পাওয়া যেতো বাইরে থেকেই, আজ সেসব কিছুই নেই। রবি কে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিতার মা দরজা থেকে সরে গেলেন,
ভেতরে আয়! কতদিন পরে তো এলি! কাকু নেই, তোর ভরসাতেই তো আছি।
রবি জুতো খুলে ঘরে ঢুকে এলো, সোফায় বসতে বসতে বললো,
ভীষণ চাপে আছি কাকিমা, চারিদিকে ক্রিমিনাল যেনো বেড়ে গেছে হটাৎ! একটু শ্বাস ফেলার সময় নেই, এই তো কদিন আগেই দিল্লি থেকে ফিরলাম।
মিতার মা বেশ কয়েকটা প্রোফাইল ওকে খুলে দেখালেন, তার মধ্যে আগের দেখা কয়েকটা ছবিও ছিলো, বললেন,
মিতা ঢোকার আগেই এইগুলো তোকে একটু দেখিয়ে ফেলি, ও জানলেই এক্ষুনি রাগারাগি করবে। এই ছেলেগুলোর একটু খোঁজ নিতে হবে বুঝলি। আসলে সবই তো দিল্লির তাই তুই দিল্লি যাস শুনেই আরো তোর কথাই মনে হলো। দিনকাল তো ভালো নয়, একটু ভালো করে খোঁজ খবর না নিয়ে এগোবো কি করে! মিতা সেদিন যখন বলছিলো তুই দিল্লি গিয়েছিস তখনই দেবো ভেবেছিলাম তার পরে আর হয়ে ওঠেনি।
রবি প্রোফাইল গুলো স্ক্রল করতে করতে বললো,
এখন তো মিতা ফিরে এসেছে কাকিমা, এখন আর দিল্লির ছেলে কেনো? কলকাতায় দেখো, তোমারও তো বয়স হচ্ছে মিতা দিল্লি তে থাকলে তুমি অসুস্থ হলে দেখবে কে?
মিতার মা সোফায় হেলান দিলেন,
নাহ! আমি চাইনা ও এখানে থাকুক! এখানে থাকলে ওর ঘাড় থেকে ওই ঋজুর ভুত কখনো নামবে না! এতো রাগারাগি, এতো জেদাজেদি কম কিছু তো হলো না, তার পরে যে ছেলেটা বিয়ে করে নিলো তার সঙ্গে আর কি কোনো কথা বলার প্রয়োজন আছে? কিন্তু ওই মেয়ে কিছুতেই সেটা শুনবে না! তোর কাকু কে ঋজুর মা এতো অপমান করেছিলো জানা সত্বেও সেই ঋজু কেই বাবার দরকারে আমার মেয়ে ফোন করলো।
রবি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বললো,
আসলে সেই রাতে কিছু করার ছিলো না ওর, তাই বাধ্য হয়েই ডেকে ছিলো। তুমি তো জানো কাকিমা ঋজু খুব ভালো ছেলে কিন্তু দুজনেই খানিকটা পরিস্থিতির শিকার হয়েছে বুঝলে! কারোরই কিছু করার ছিলো না আসলে। তবু একটা কথা বলবো মিতা বড্ড বেশি জেদ দেখিয়ে ফেলেছে। ঋজু র বাবা তো ক্ষমা চেয়েছিলেন তার পরেও ওর এটা করা ঠিক হয়নি।
মিতার মায়ের মুখ রাগে থমথমে হয়ে গেলো,
কিভাবে এটা বললি তুই! ওই বাড়িতে থাকা যায় এর পরে! ঋজুর মা ওকে টিকতে দিতো? আসলে ওই মহিলা তো কোনোদিনও মিতাকে পছন্দ করতো না, তাই এইভাবে ওর বাবাকে অপমান করে শোধ তুললো! আমাদের দোষ কোথায় বলতে পারিস? ওর ঠাকুমা তো নিজেই তাঁর নাত বউ হিসেবে আমার মেয়েকে পছন্দ করে গিয়েছিলেন। ওই মহিলা কে? শুধু ছেলের জন্ম দেওয়া ছাড়া আজ পর্যন্ত ছেলের জন্যে ওর অবদান কি? আজ তো ঋজু যা সবই ওর বাবা ঠাকুমার জন্যে। মায়ের বাপের বাড়ির তো ফুটো কড়িও ছিলো না! টাকা ওনার বরের, শাশুড়ির কিন্তু ছেলের বিয়েতে নাকি মত দেবেন উনি! মাসীমা বেঁচে থাকলে এটা করতে পারতো, ঘাড় ধরে বউকে বাড়ি থেকে বার করে দিতেন উনি!
বন্ধুর মায়ের সম্পর্কে এইসব আলোচনা রবির ভালো লাগছিলো না, ও যতোটা মিতার মাকে শ্রদ্ধা করে ততটাই ঋজুর মাকেও। রীনাও ওর খুব পছন্দের মানুষ, তাই রবি কথা ঘোরালো,
যাকগে! ছেড়ে দাও ওসব, আমি দেখছি এই প্রোফাইল গুলো!
মিতার মা উঠে দাঁড়ালেন, রান্না ঘরে চা করতে যেতে যেতে বললেন,
ছেড়েই দিতাম, কিন্তু খারাপ লাগা কোথায় জানিস, ওই মহিলার জন্যে আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো। ঋজুর বাবা এতো ভালো মানুষ, ওই রকম ভালো ঠাকুমা কিন্তূ এতো বাজে মায়ের জন্যে আমাদেরও পাশাপাশি বাড়ির এতদিনের ভালো সম্পর্কটা একদম নষ্ট হয়ে গেলো। খুব আফসোস হয় বুঝলি, ঋজুর কাছে ওর মায়ের স্বরূপটা মিতা প্রকাশ করতে পারলো না। আমি আর রীতা কতো বুঝিয়েছিলাম তখন, বলেছিলাম বিয়েটা একবার মিটে যাক, তারপরে ঋজু কে নিয়ে চলে যাস নিশ্চিন্তে। কিন্তু আমার মেয়ের জেদ কম নাকি! একদিনও নাকি ও ওই বাড়িতে থাকবে না। আরে, আমরা কি তোকে থাকতে বলেছি একবারও, শুধু বলেছি এক পা এগোতে গেলে দরকারে দু পা পেছোতে হয়! মেয়েটার বোকামির জন্যেই এটা হলো, ঋজুর বাবাও কি কম দুঃখ করেছেন নাকি মিতার বাবার কাছে? কিন্তু ওনার হাতে তো আর কিছু নেই, মা চলে গেছে, দাপটও চলে গেছে! বাবা তো ছেলে, মেয়েদের দু চোখের বিষ!
রবি চুপ করে থাকলো, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই ঋজু সত্যিই ওর বাবাকে পছন্দ করে না। খুব ছোটবেলায় রবি যখন ওদের বাড়িতে খেলতে যেতো তখন ওর ঠাকুমা সুস্থ ছিলেন, রীতা পিসি আর ঠাকুমা ওদের খুব ভালো বাসতেন। ঋজুর মা বরং রান্না ঘর আর নিজের ঘরের মধ্যেই ঘোরাফেরা করতেন, খুব বেশি কথাবার্তা বলতেন না। কিন্তু একটু বড়ো হবার পরে ঠাকুমা যখন বিছানায় শয্যাশায়ী তখন ও কাকিমা কে ওর সঙ্গে কথা বলতে দেখতো, মাঝে মাঝেই ওদের সামনে ঘুরে ঘুরে আসতেন। সেই সময় ওদের বাড়িতে খুব ঝগড়া ঝাঁটি হতো, সেই ঝগড়ার পরে যখন কাকিমা কান্নাকাটি করতেন তখন ঋজুর দিদি ঠাকুমা কে রেগে গিয়ে অনেক কথা বলতো। ঋজুও বলতো ওর ঠাকুমা আর বাবা খুব খারাপ। এখনও সেই ধারণাই ঋজুর মধ্যে আছে, কারণ বিয়ের রাতে বাবার অ্যাক্সিডেন্টের খবরে নার্সিং হোমে মায়ের কথায় ঋজু গিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু তার মুখে খুব বেশি চিন্তার ছাপ ছিলো না। সে বরং বিরক্তি প্রকাশ করছিলো ওই ভাবে আসার জন্যে। আর ওর দাদা, জামাইবাবু কেউ তো একবারের জন্যেও আসেনি বাবার খবর নিতে, সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল বাড়িতে।
রবির অন্য মনস্কতা মধ্যেই বাইরে মিতার গাড়ির আওয়াজ হলো, আওয়াজ শুনেই স্ক্রীন শট নিয়ে নিজের মোবাইলে প্রোফাইলের অ্যাড্রেস আর ফোন নম্বর পাঠিয়ে দিয়ে রবি চায়ের কাপ হাতে সোফায় এলিয়ে বসলো। মিতা ঢুকে এলো রবির দিকে তাকিয়ে বললো,
বাবা! তুই! কি মতলবে? সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছে?
রবি হাসলো,
তুইই একমাত্র আমার আসার পেছনে মতলব খুঁজে বার করার চেষ্টা করিস! কাকিমার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি তাই এলাম!
মিতা ধপ করে সোফায় বসে পড়লো,
এতো ভালো ছেলে তুই কবে থেকে হলি? যেচে খবর নিয়ে যাচ্ছিস! সত্যি কথা বল! ঋজুর বাড়িতে এসেছিলি নিশ্চয়ই? ওর মায়ের পা দেখতে?
রবি ঘাড় নাড়লো,
নারে ভাই! সত্যি তোর বাড়িতেই এসেছি!
মিতা উঠে দাঁড়ালো,
যা, তাহলে আমার ঘরে গিয়ে বোস, ফ্রেস হয়ে আসছি!
রবি মিতার ঘরে গিয়ে বসলো, একটু পরেই মিতা ফ্রেশ হয়ে চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকে এলো, তাকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল। রবির মুখোমুখি খাটে বসতে বসতে সে হাসলো,
কোথাও তোরা দুজনে যখন যাবি তখন আমাকে নিয়ে যাস তো, আমার খুব ভালো লেগেছিলো সেদিন।
রবি হাসলো,
অফিসিয়াল কাজে কি আর সব সময় সঙ্গে করে কাউকে নিয়ে যাওয়া যায়, ওইদিন রবিবার ছিলো তাই।
মিতা মাথা নাড়লো,
হ্যাঁ, রবিবারে গেলেই নিয়ে যাস নাহয়!
রবি কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই মোবাইলটা বেজে উঠলো, ফোন টা হাতে নিয়ে অজানা নম্বর দেখে রবি একটু বিরক্ত হলো,
পুলিশের কোনো ছুটি নেই বুঝলি! সন্ধ্যে বেলায় অচেনা নম্বর মানেই এখন ছুটতে হবে!
রবি একটু বিরক্ত গলায় হ্যালো বললো, উল্টোদিকের কথা ভালো করে শুনতে পাওয়া যাচ্ছিলো না, নেটওয়ার্কের অবস্থা সম্ভবত খুব খারাপ। রবি বিরক্ত হয়ে ফোন স্পিকারে দিয়ে চিৎকার করে কে কোথা থেকে বলছে জানার চেষ্টা করতে লাগলো। বার তিনেক চিৎকারের পরে উল্টোদিকের গলা পাওয়া গেলো, তিনি রসূলপুর থেকে রবীন বাবু বলেছেন জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে সমর চৌধুরীর অ্যাকাউন্ট নম্বর পাঠিয়েছেন বলে জানালেন। রবি ফোন কেটে হোয়াটসঅ্যাপ চেক করতে করতেই মিতা ওর দিকে উৎসাহের দৃষ্টিতে তাকালো,
এই সমর চৌধুরীর খোঁজ করতেই তুই মেদনীপুরে গিয়েছিলিস না সেদিন?
রবি অন্য মনস্ক ভঙ্গিতে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
হুঁ!
মিতা অবাক হলো,
আচ্ছা, লোকটা রসুলপুর থেকে বলছে বললো না? রসূলপুরেই তো অপর্ণার বাড়ি? ওর সঙ্গে সমর চৌধুরীর কি কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? ওই জন্যেই তুই ঋজু কে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলি নাকি?
পর পর ধেয়ে আসা প্রশ্নে রবি মোবাইল থেকে মুখ তুললো, একটু অস্বস্তি নিয়ে বললো,
হুঁ, ওই আর কি!
মিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো, আচমকাই চোখে জল এলো ওর! অভিমানী গলায় বললো,
তোকে আজকাল আমি সত্যি চিনতে পারিনা রবি! অপর্ণাও আজকাল আমার থেকে তোর কাছে প্রিয় হয়ে গেছে! খুব খারাপ লাগে জানিস, মনে হয় তোদের সবার মাঝখানে আমি একদম আলাদা, একটা দ্বীপের মতো। এমন একটা মানুষ যে জোর করে তোদের মধ্যে ঢুকে তোদের গোপন খবর জানার চেষ্টা করছে। এখন বুঝছি ওই জন্যেই সেদিন তুই আমাকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে ঋজু কে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলি। ও ও জানতো সবটা তাই আমাকে স্টেশনে দেখে অস্বস্তিতে পড়েছিলো।
রবি উঠে দাঁড়ালো, মিতার কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত রেখে বললো,
বিশ্বাস কর, এরকম কিছু নয়! অপর্ণা জাস্ট ঋজুর বউ এর বেশি আমার কাছে আর কিছু নয়! নিজের সঙ্গে তুই ওকে তুলনা করিস না! তোর সঙ্গে যা সম্পর্ক আমার সেটা কোনোদিনও অপর্ণার সঙ্গে হবে না। তোকে বলিনি কারণ ঋজু চায়নি তাই। যদিও না বলার মতো কোনো কারণ নেই! আসলে অপর্ণার ওই সমর নামের ছেলেটার সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো পরে ছেলেটা খুন হয়ে যায়! অপর্ণা বিয়ের সময়ই ঋজু কে জানিয়েছিল ও সমর কে খুব ভালোবাসে কিন্তু বাড়ির চাপে এই বিয়েটা করছে। কিছুদিন সময় চেয়েছিলো ওর কাছে। ঋজুও তো তাতে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল বলতে পারিস, ওর বাবার অ্যাক্সিডেন্টের সময় রাতে হসপিটালে দাঁড়িয়ে বলেছিলো আমাকে। আসলে দুজনেই তো কম্প্রোমাইজ করেছিলো অনেকটা, ঋজুর ব্যাপারটা তোর থেকে ভালো আর কে জানে! অপর্ণা নাকি ওকে সমরের খুনি কে খুঁজে দিতে বলেছিলো, ও নাকি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না খুনি কে খুঁজে বার না করা পর্যন্ত! তাই এসব! এতে লুকানোর কি আছে বল!
মিতা খাটে বসে পড়লো, অপর্ণার সেদিনের বলা কথাগুলো শুনে এরকম কিছুই মনে হচ্ছিলো ওর, এখন এর অর্থ আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছিলো ওর কাছে। ঋজু প্রথমে হনিমুনে যেতে চায়নি, পরে ও ও যেতে চায়নি! কতো অজুহাত দিচ্ছিলো রীতা পিসির বাড়ি গিয়ে। তখনই মনে হচ্ছিলো ওদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয় এখনও, ঋজু ওকে ছাড়া অন্য কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারবেনা মিতা সেটা জানে! ঋজু তারমানে আপাতত কম্প্রোমাইজ করছে ওর মায়ের জন্যে, বউয়ের পুরনো প্রেমিকের খুনি কে খুঁজে দিয়ে ও তারমানে মায়ের কাছে অপর্ণার সত্যিটা তুলে ধরতে চাইছে!
মিতা কে অন্য মনস্ক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে রবি ওর কাঁধে হাত রাখলো,
কি ভাবছিস এতো?
মিতা রবির দিকে তাকালো,
অপর্ণার সঙ্গে ঋজুর সম্পর্কটা ঠিক কি রকম রবি? ওদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে আদৌ? অপর্ণা সেদিন বলছিলো ওরা আজ পর্যন্ত কোথাও বেড়াতেও যায়নি!
রবি ঘাড় নাড়লো,
আমার সঙ্গে ওই একদিনই কথা হয়েছিলো এসব বিষয়ে, তখন ঋজু বলেছিলো এগুলো! ও এসব নিয়ে কখনো আলোচনা করেনা রে, তাই বলতে পারবো না এখন কি পরিস্থিতি! তবে সমরকে খোঁজার চেষ্টা করছে মানে এখন খানিকটা তো বেটার নিশ্চয়ই! আর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে বেটার করে নেওয়া ছাড়া কোনো রাস্তাও তো নেই, ওর মায়ের পছন্দ যখন তখন তো ওকে মেনে নিতেই হবে। ওতো কোনো মেয়ের ফটোও দেখেনি বিয়ের আগে, প্রায় যাকে ওর মা পছন্দ করেছে তাকেই চোখ বন্ধ করে বিয়ে করে নিয়েছে, কোনো আপত্তি জানায়নি! এমনকি অপর্ণা নাকি ওদের বাড়িতে গিয়েছিলো যখন তখন এগুলো বলেছিলো ওকে তাও ও বিয়ে করেছে! আসলে মেয়েটা কেমন, ওর সঙ্গে আদৌ সম্পর্ক তৈরি হবে কিনা এগুলো নিয়ে ভাবেনি ও, একটা বিয়ে করতে হয় তাই করা আরকি!
মিতা রবির দিকে তাকালো,
আমারও সেটাই মনে হয়েছে! ও বোধহয় বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছে সবটা!
ওদের কথার মধ্যেই বসার ঘর থেকে রবি কে ডাকলেন মিতার মা, রবি আসছি বলে উঠে যাবার পরে মিতা ভাবতে লাগলো, দুজনের সম্পর্ক যখন এখনও স্বাভাবিক হয়নি তখন ওর হাতে সময় আছে। ঋজু কে পাওয়াটাই একমাত্র জিত নয়, তাতে ওর প্রতিশোধ নেওয়া হয়না, সেটা করতে চাইলে তো ও আগেই করতে পারতো! মা, রীতা পিসি তো ওকে বুঝিয়েছিল বিয়ের পরে ট্রান্সফার নিতে যাতে ঋজুর কিছু করার না থাকে! কিন্তু ওতো সেটা চায়নি। আসল জিত তো ওই মহিলার ওপরে শোধ নেওয়া, যেটা অপর্ণা বাড়িতে থাকলেও ও করতে পারে। ওই মহিলার যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে ঋজুর সঙ্গে ওর যোগাযোগ রাখা আটকে দেখাক!
ক্রমশ