#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৫০
দেখতে দেখতে আরো দিন তিনেক কেটে গেলো, আজ রাতে রত্নার ফিরে যাওয়ার কথা। যেহেতু অনেকদিন পরে সে বাড়ি যাচ্ছে তাই বাড়িতে আর রান্নার ঝামেলা না রেখে রীনা তাকে রাতে এখান থেকেই খেয়ে যেতে বলেছেন। তার জন্যেই রাতে আজ একটু আলাদা করে বিশেষ কিছু পদের আয়োজন করা হচ্ছে, অপর্ণার ভাসুর ঋষি সেসব বাজার থেকে আনবে।
রাতের রান্নার দায়িত্ব যেহেতু অপর্ণার তাই তাকে একথা জানিয়ে দিয়ে অনিন্দিতা বারবার করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে বেরোনোর আগে। অপর্ণা জানে অনিন্দিতা নিজে তাকে কোনো সাহায্য করবে না, নিজের দায়িত্ব যেমন সে কারোর সঙ্গে ভাগ করে না তেমনি অন্যের দায়িত্ব যেচে নেয়না কখনই। তাই বারবার তাড়াতাড়ি ফেরার কথাতে অপর্ণা বিরক্তি প্রকাশ করেছিলো,
জানি দিদিভাই! বলেছো তো একবার! আমি জানি আমার কাজ আমাকে করতে হবে, আমি ঠিক সময় মতো চলে আসবো।
অপর্ণার গলার বিরক্তি যদিও অনিন্দিতা বুঝতে পেরেছিলো তবুও তার স্বরে একটুও তার আভাস ছিলো না, সে হেসে বলেছিলো,
জানি সেটা! তবু একবার মনে করিয়ে দিলাম, নাহলে তো তুইই বিপদে পড়বি! তোর বর তো আবার সন্ধ্যে বেলা রান্না ঘরে থাকলে বিরক্ত হয়! তাই ভাবলাম বলে দিলে যদি তাড়াতাড়ি ফিরে করে নিস সবটা!
অপর্ণা আর কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করেনি, রাস্তায় যেতে যেতেই সৌমিককে ফোনে জানিয়ে দিয়েছিলো আজ তার আর অপর্ণাকে নিতে আসার দরকার নেই, তার তাড়া আছে, সে আগেই ফিরে যাবে। সৌমিক নিজেও জানতো আজ দিদিদের ফিরে যাওয়া আছে তাই সেও কথা বলে আর সময় নষ্ট করেনি, সকালের দিকটা ব্যাংকে খুব চাপ থাকে।
অন্য দিনের থেকে আজ অনেকটা আগেই বাড়ি ঢুকলো অপর্ণা, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দেখলো মিনতি মাসী শাশুড়ির কাছে খুব বকুনি খাচ্ছে। শাশুড়ি এমনিতেই ছেলের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় চিন্তিত আছেন তাই আবার নতুন করে কি হলো জানতে অপর্ণা কৌতুহলী হলো। বাড়ির প্রায় সবার সঙ্গে অনিন্দিতাও ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো, পায়ের জুতো খুলে সিঁড়ির তলায় রাখতে রাখতে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো,
কি হয়েছে দিদিভাই? মা রেগে আছে কেনো?
অনিন্দিতা মুচকি হাসলো,
মিতার নাকি বিয়ে! সেই গল্প শুনতে গিয়ে মাসি এখানে আসতে দেরি করে ফেলেছে, তাই মা রাগ করছেন।
অপর্ণা বিস্মিত হলো, এই তো মাত্র মাস খানেক আগেই মিতা সৌমিককে এতো কথা বললো, এর মধ্যে বিয়ে আবার কখন ঠিক হলো! তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় অপর্ণার গলা একটু জোরেই হলো,
তাই নাকি! কার সঙ্গে গো? কোথায়?
অনিন্দিতা কাঁচুমাচু মুখে তাকালো, কারণ অপর্ণার উত্তেজিত গলা ইতিমধ্যেই উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। সবাইকে তার দিকে ঘুরে তাকাতে দেখে অপর্ণা অস্বস্তিতে পড়লো, রীনা সোফায় বসে পড়ে মিনতির দিকে ইশারা করে কড়া গলায় বললেন,
নাও, তোমার আরেকজন শ্রোতা এসে গেছে, আবার নতুন করে শুরু করো!
মিনতি কাঁচুমাচু মুখে তাকিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে গেলো, পরিস্থিতি একটুও অনুকূলে নেই বুঝেই অপর্ণা দ্রুত সিঁড়ির দিকে পা চালালো। ঘরে ঢুকে জামাকাপড় ছেড়ে বসতে বসতেই মিনতি ঝাঁটা হাতে ঘরে ঢুকে এলো, পেছনের সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে নিচু গলায় উত্তেজিত স্বরে বললো,
ছোটো বৌমা! ওই বাড়ির মিতার তো বিয়ে, শুনলাম ছেলে নাকি খুব বড়লোক! দিল্লীতে থাকে!
অপর্ণা একটু অবাক হলো, দিল্লীতে থাকে! তারমানে কি রবিদা ইতিমধ্যেই ছেলেগুলোর সম্বন্ধে খবর এনে দিয়েছে! তার মধ্যেই কোনো ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! অপর্ণাকে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিনতি আরো কাছে সরে এলো,
ওদের বাড়ির কাজের মেয়েটা বললো আজ রাতে নাকি জামাইয়ের নেমন্তন্ন আছে এখানে, তাই অনেক কিছু রান্না হচ্ছে ও বাড়িতে!
অপর্ণা হেসে ফেললো,
যাহ! রাতের বেলায় নেমন্তন্ন মানে তো তোমার আর দেখা হলো না মাসি! জামাই কেমন দেখতে, জানতেও পারলে না তুমি!
মিনতি কিন্তু অপর্ণার ঠাট্টাকে ঠাট্টা হিসেবে নিলো না একটুও, ঘরের মেঝেতে বসে পড়ে একটু দুঃখের গলায় বললো,
হ্যাঁ গো বৌমা! জামাই তো আর আমার দেখা হলো নি! শুনলুম বিয়েও নাকি সেই দিল্লি থেকেই হবে! ওরা নাকি বাড়ি বেচে দে চলি যাচ্ছে একেবারে। তার মা রে নাকি দেখার কেউ নেই কো! তাই মা রে সঙ্গে করি নে যাবে হোতা!
অপর্ণা এবার নিজেও অবাক হলো, মিতা এর আগে ওর বাবার অসুস্থতার সময় বলেছিলো বটে একসময়, যে ওর ওখান থেকে বারবার ছোটাছুটি করতে খুব অসুবিধা হচ্ছে! তবে একেবারে বাড়ি বিক্রি করে চলে যাবে ওরা! অপর্ণা কৌতুহলী হলো,
বাড়ি বিক্রি করে দেবে এটা তুমি কি করে জানলে মাসি? কে বললো তোমায়?
মিনতি হাসলো,
সে খপর দেবার লোকের কি আর অভাব আছে গো বৌমা! কতো লোক তো কতো কথা বলে! ওই আমাদের বাড়ির সামনে একখান ছেলে থাকে জমি বাড়ির দালালি করে, সে বলছিলো কদিন আগেই। ওকে নাকি বাড়িখান বেচে দেবার কথা বলেছে ও বাড়ির গিন্নি! তাও আমি খুব বেশি বিশ্বাস যাই নি, কিন্তু আজ এট্টু আগেই ওদের কাজের মেয়েটা ধরেছিলো আমারে, একটা কাজ খুঁজে দেবার কথা বলছিলো। ওর মুখেই তো শুনলাম সব, ওরা নাকি নতুন বাড়ি দেখে নিতে বলেছে ওকে।
মিনতির কথার মধ্যেই নিচের থেকে রীনার গলা ভেসে এলো,
কিগো! দোতলা ঝাঁটাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? এতক্ষন ধরে কি করছো?
মিনতি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো,
বাপ রে! যাই বৌমা! বৌদি আজ খুব রেগে আছে! ওদের মেয়েটার কথা শুনতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেছে কিনা!
অপর্ণা ঘাড় কাত করলো,
আচ্ছা!
মিনতি উঠে দাঁড়ালো, দরজার দিকে যেতে যেতেও ফিরে এলো, নিচু গলায় বললো,
রাতের দিকে এট্টু লক্ষ্য রেখো তো বৌমা! জামাইখান কেমন কাল সকালে তোমার কাছ থেকেই শুনবোখনে!
অপর্ণা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে প্রবল হাসিতে ফেটে পড়লো,
মাসী! তুমি পারো বটে! আমি এখন তোমার জন্যে জামাই দেখতে বসে থাকবো!
মিনতি লজ্জিত হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। অপর্ণার হাসির আওয়াজ দরজার বাইরে পর্যন্ত পৌঁছেছিল, সেই আওয়াজে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে অনিন্দিতা অপর্ণার দরজায় এসে দাঁড়ালো, কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো,
কি হয়েছে রে? এতো হাসছিস কেনো?
অপর্ণার হাসি থামছিলো না, সে হাসতে হাসতেই মিনতির দিকে ইশারা করলো,
মাসীর কথা শোনো দিদিভাই! মিতার হবু বর কে কেমন দেখতে সেটা দেখার জন্যে মাসি আমাকে রাতে লক্ষ্য রাখতে বলছে!
অনিন্দিতা অবশ্য হাসলো না, বোঝা গেলো সেও মাসীরই দলে, জামাই দেখার ব্যাপারে তারও যথেষ্ট উৎসাহ আছে। সে খুব উৎসাহ নিয়ে বললো,
অ্যাই অপর্ণা! যা না, রান্নাটা চটপট সেরে আয় না গিয়ে! ঋজু এলে ওকে ফুটিয়ে দেবো ঘর থেকে, তুই আর আমি দুজনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবো সন্ধ্যে থেকে।
অপর্ণা আরো হাসতে লাগলো,
তুমিও কি মাসীর সঙ্গে পাগল হলে দিদিভাই? মিতার বর কে দেখতে সারা সন্ধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে! এই তো ঢুকলাম, এক্ষুনি রান্নাঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না, একটু পরে করবো।
অনিন্দিতা অপর্ণাকে প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে জায়ের ঘরে ঢুকে এলো, খাটের সামনের জানলাটা জোরে ঠেলে খুলে দিয়ে বললো,
ছাদে এলেই এটা দিয়ে দেখা যাবে বুঝলি তো। বেশি ভাও খাসনা, বুঝলি! নেহাত তোর ঘর থেকে ভালো মতো দেখা যায়, তাই বাধ্য হয়েই তোকে সাধছি এতো। নাহলে তোকে পাত্তা দিতাম না, নিজের ঘরে দাঁড়িয়েই দেখতাম। আমার ঘরটা থেকে মিতাদের বাড়িটা একটুও দেখা যায়না! ধুস!
অপর্ণা অগত্যা রাজি হলো, জা রান্না করে না ফেরা পর্যন্ত সে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে জানিয়ে জায়ের দিকে তাকিয়ে অনিন্দিতা হাসলো,
যা তাড়াতাড়ি করে আয় সব, আমি লক্ষ্য রাখি ঢুকে গেলো কিনা!
অপর্ণা যখন নিচে নামছিলো রান্না করতে তখন অনিন্দিতা পেছন থেকে ডাকলো,
এই শোন তোর বর এলে নিচেই বলে দিস আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি, নাহলে আবার বউ ভেবে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবে!
অপর্ণা হাসতে হাসতে সিঁড়িতে পা দিলো,
আর দাদা আগে এলে কি বলবো দিদিভাই?
অনিন্দিতা মুচকি হাসলো,
কিছু বলিস না, তাহলে আবার দাদার সাথে দাদার মাও আমাকে খুঁজতে চলে আসবে। একটু আগেই মাসি যা ঝাড় খেলো, এবার জানতে পারলে আমিও খাবো!
রত্না আজ রাতে খেয়ে দেয়ে নিজের বাড়িতে চলে যাবে জানার পরে যদিও ঋষি অনেকবার বলেছিলো, তবু রীনা তাতে কোনো আপত্তি জানাননি, রত্নার সুবিধাকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। এই মুহূর্তে ছেলের ট্রান্সফারের খবরে তিনি এতটাই চিন্তায় আছেন যে বাড়ির অন্য কোনো ব্যাপার নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন না। মা মাথা না ঘামালেও ঋষি দিদি জামাইবাবুর চলে যাওয়ার আগে তাদের জন্যে ডিনারে ভালো মন্দের ব্যবস্থা করেছে। রান্না ঘরে ঢুকেই অপর্ণার চক্ষু চড়কগাছ হলো, এই এতো সব কিছু রান্না করতে গেলে তো রাত কাবার হয়ে যাবে! দীপা এখন মোটামুটি ফাঁকা থাকে, রজত সুস্থ হবার পরে তার আর খুব বেশি কাজ থাকেনা এখন, তাই তাকে রীনা ছাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অনিন্দিতা এবং অপর্ণার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য কোনো বয়স্ক কাউকে না পাওয়া পর্যন্ত দীপাকে রেখে দেওয়া হয়েছে। প্রথম দিকে তাতে মৃদু আপত্তি জানালেও সৌমিক যেহেতু ইতিমধ্যেই রেগে রয়েছে তাই দীপাকে ছাড়াতে চেয়ে রীনা আর নতুন কোনো বিতর্ক তৈরি করতে চাননি।
অপর্ণাকে কোমরে হাত রেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীপা এগিয়ে এলো, তাকে দেখে অপর্ণা রীতিমত আতঙ্কের গলায় বললো,
দাদা কতো কিছু এনেছে দীপা দি! এসব রেঁধে শেষ করবো কখন?
ওই দিদিরা চলে যাবে তো তাই! আপনি আমাকে বলুন না বৌদি কি করতে হবে, আমি আপনাকে হেল্প করছি, এখন তো আমার সেরকম কিছু কাজ নেই।
নিচু গলায় বললো দীপা, অপর্ণা অগত্যা কথা না বাড়িয়ে কাজে মন দিলো। রান্না যখন শেষ হলো ততক্ষনে সাতটা পেরিয়ে গিয়েছে, সৌমিক একটু আগেই ফিরেছে, বৌকে রান্নাঘরে দেখে আর ওপরে না উঠে বসার ঘরের সোফায় বসে পড়েছে।
অপর্ণা ঘেমে নেয়ে গিয়েছিলো, তাই আর দাঁড়ালো না, বসার ঘরের টেবিলে সবার জন্যে চায়ের ট্রে রেখে, দোতলায় উঠে দেখলো অনিন্দিতা তখনও বারান্দায় একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে। অপর্ণা হেসে ফেললো,
বাপরে! তোমার কি এনার্জি দিদিভাই! এই গরমে তখন থেকে বারান্দায় বসে আছো!
অনিন্দিতা উঠে দাঁড়ালো, একটু লজ্জিত গলায় বললো,
সত্যি! একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এবার! আমিও এনার্জি হারিয়ে ফেলেছি। পায়ে ব্যাথা করছিলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, শেষে তোর ঘর থেকে চেয়ার বার করে নিয়ে এলাম।
অপর্ণা এতক্ষন রান্নাঘরে থেকে ঘেমে গিয়েছিলো, নিজের ঘরের বারান্দায় এসে ঘামে ভেজা হাউসকোট খুলে দড়িতে মেলতে মেলতে বললো,
ভীষণ গরম, আমার ঘেমে গিয়ে শরীর খারাপ লাগছে, আর দাঁড়িয়ে কাজ নেই, ঘরে চলো। গাড়ি নিয়েই তো আসবে নিশ্চয়ই, গাড়ির আওয়াজ পেলে বেরিয়ে এসো নাহয়!
অনিন্দিতারও সব উৎসাহ শেষ হয়ে গিয়েছিলো ইতিমধ্যেই তাই সে জায়ের প্রস্তাবে সম্মত হলো সহজেই। হাউস কোটটাকে বারান্দায় দড়িতে মেলে দিয়ে অপর্ণা সবে ঘুরতে যাচ্ছিলো তখনই মিতার গাড়িটা বাঁকের মুখে দেখা গেলো। অনিন্দিতা এবং অপর্ণা দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়লো, অনিন্দিতা অতি উৎসাহে বারান্দার গ্রিল বরাবর লাগানো কাঠের ওপরে হাত রেখে রাস্তার দিকে ঝুঁকে পড়লো। জায়ের অতি উৎসাহ দেখে অপর্ণা মনে মনেই একটু লজ্জিত হচ্ছিলো, তবু তার নিজের কৌতূহলও একটুও কম ছিলো না। প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে সে নিজেকে হাউস কোটের আড়ালে লুকিয়ে রেখে মিতার বাড়ির গেটের দিকে চোখ রাখলো।
গাড়ির পেছনের দরজা খুলে মিতা নেমে এলো, তারপরে সঙ্গের ভদ্রলোক। মিতার মা বাইরে বেরিয়ে এসেছেন, ওরা দুজনে গেট খুলে বাড়ির সামনের বাগানে ঢুকে পড়েছে, গাছের ছায়া সেখানে রাস্তার আলোকে ঢেকে দিয়েছে, তাই লম্বা দোহারা চেহারার ভদ্রলোকের মুখ বোঝা সম্ভব নয়, তবু চেহারাটা যেনো বড্ড চেনা চেনা! অপর্ণা কৌতুহলী হয়ে হাউস কোটের আড়াল থেকে বেরিয়ে সামনে আসার আগেই ঝুঁকে থাকা অনিন্দিতার দিকে বিরক্ত দৃষ্টি নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো মিতা, তারপরে নিচু গলায় মাকে কিছু বললো। অপর্ণা আর এগোলো না, অনিন্দিতাও মিতার মুখের বিরক্তির এক্সপ্রেশন দেখতে পেয়েছিলো, সেও সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো।
ঠিক সেই মুহূর্তেই মিতার কথা শুনেই সম্ভবত মিতার মা এবং সঙ্গে থাকা ভদ্রলোক অনিন্দিতার দিকে ঘুরে তাকালেন, এতক্ষনের পাশ থেকে দেখতে পাওয়া মুখ এবার সামনে থেকে দেখা গেলো, সেই মুখের দিকে তাকিয়ে অপর্ণার হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো, সমর! চোখের সামনেটা অন্ধকার লাগছে, অপর্ণা হাত বাড়িয়ে দড়িতে মেলে দেওয়া হাউস কোটটা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করলো।
মিতাদের ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই অনিন্দিতা অপর্ণার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো, অপর্ণা তখন আঁকড়ে ধরা হাউস কোট সমেত দড়ি ছিঁড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিলো। তাকে পড়ে যেতে দেখে অনিন্দিতার গলা দিয়ে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো,
অপর্ণা! কি হলো তোর? শরীর খারাপ লাগছে নাকি!
অপর্ণা কোনো উত্তর দিলো না, অনিন্দিতা তাকে টপকে গিয়ে ঘরের ভেতর দিয়ে সিঁড়ির কাছে পৌঁছে চিৎকার করলো,
ঋজু! তাড়াতাড়ি ওপরে এসো, অপর্ণা অজ্ঞান হয়ে গেছে!
অনিন্দিতার আতঙ্কিত চিৎকারে সৌমিক দুটো তিনটে সিঁড়ি টপকে টপকে ওপরে উঠে এলো, পেছন পেছন বাড়ির বাকি সদস্যরাও। একমাত্র রীনার পক্ষেই অতো তাড়াতাড়ি ওঠা সম্ভব ছিলো না তবুও তিনি তাঁর সাধ্যমত ওঠার চেষ্টা করতে লাগলেন। রীনা যতোক্ষনে ওপরে উঠে এলেন ততোক্ষনে অপর্ণাকে তুলে নিয়ে এসে ঘরে শোয়ানো হয়েছে এবং মুখে চোখে জল দেওয়ার পরে তার জ্ঞানও ফিরে এসেছে। মাকে দেখেই রত্না বললো,
অজ্ঞানের আর দোষ কি! যা গরম, এই গরমে এতক্ষন রান্নাঘরে থাকলে এই হবে। ঋষিকে বললাম এতকিছু আনিস না, ও শুনলে তো!
ঋষি লজ্জিত হলো, অস্বস্তি নিয়ে বললো,
সত্যি আমারই খারাপ লাগছে! আগে বুঝতে পারলে অনলাইনেই অর্ডার করে দিতাম।
অপর্ণা শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে দুর্বল গলায় বলতে চেষ্টা করলো,
না দাদা, ওসব কিছু নয়, আমার শরীরটা এমনই একটু খারাপ লাগছিলো!
রীনা সামনে এগিয়ে এলেন, সবাই কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
ঠিক ভুল বিচার করে এখন আর কি হবে! যা হবার তো হয়েই গেছে! এখন এখানটা ফাঁকা কর, ভিড় না বাড়িয়ে সবাই নিচে যাও, ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও, আর দেখো ডক্টর ব্যানার্জী কে পাও কিনা, তাহলে বলো একটু দেখে যেতে একবার।
ক্রমশ
#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৫১
কিছুক্ষনের মধ্যেই উল্টো দিকের বাড়ি থেকে ডক্টর ব্যানার্জীকে ডেকে আনা হলো, খুব ব্যস্ত ডাক্তার হলেও বাড়িতে থাকলে পাড়ার লোকজনদের প্রয়োজনে তিনি বাড়িতে আসেন। তিনি এসে খুব বেশি কিছু হয়নি জানানোর পরে বাড়িতে স্বস্তি এলো। এই অত্যধিক গরমে বাইরে না বেরিয়ে দু একদিন একটু বিশ্রাম নেবার পরামর্শ দিয়ে তিনি চলে গেলেন। তাঁর পেছন পেছন রীনাও সবাইকে নিয়ে চলে যাবার পরে সৌমিক খাটে শোয়া অপর্ণার সামনে চেয়ার নিয়ে বসলো, কপালে হাত রেখে বললো,
কাল আর ইউনিভার্সিটি যেও না, দিদি ঠিকই বলেছে প্রচণ্ড গরমে এরকম হয়ে গেছে, এখন দিন দুয়েক খুব ইম্পর্টেন্ট ক্লাস কিছু না থাকলে বাড়িতেই থাকো।
অপর্ণা কোনো উত্তর দিলো না, সে অন্য মনস্ক ভঙ্গিতে ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো। সৌমিকও আর কোনো কথা বললো না, অপর্ণা রেস্ট নিতে চায় বুঝে চুপ করে পাশে বসে রইলো। কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে অপর্ণা ফিরে তাকালো, দুর্বল গলায় বললো,
কখনো কখনো এমন সময় কেনো আসে যখন ভীষণ প্রিয় মানুষটা যাকে এতদিন তুমি মৃত ভেবে কষ্ট পেয়ে এসেছো তাকে চোখের সামনে জীবিত দেখলেও আনন্দ হয়না কেনো বলতো?
সৌমিক চমকে উঠলো,
তুমি কোনো মৃত মানুষ কে জীবিত দেখলে নাকি! কার কথা বলছো?
অপর্ণার গলায় হতাশার সুর স্পষ্ট হলো,
সমরকে! একটু আগেই ওকে মিতা দির বাড়িতে ঢুকতে দেখলাম।
সৌমিক সোজা হয়ে উঠে বসলো,
কি বললে! ঠিক দেখেছো তুমি? আমার মনে হয়…
অপর্ণা বালিশে হেলান দিয়ে উঠে বসলো, সৌমিক কে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললো,
এক মিনিট! আমি জানি তুমি বলবে আমি ভুল দেখেছি, কিন্তু আমি জানি আমি ঠিক দেখেছি। এতগুলো বছর যার সঙ্গে এতো কাছাকাছি কাটিয়েছি তাকে দু হাত দুর থেকে চিনতে পারবো না তা হতেই পারেনা। তবে আমি কখনো ওর সামনে যাবো না, আমি বুঝতে পেরেছি ও কাকতালীয় ভাবে পাওয়া যাওয়া কোনো বডির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলো। আসলে ও বোধহয় আমাকে কখনই ভালোবাসেনি তাই কোনো অজানা লোকের বডি পাওয়া গেছে জানতে পেরে এই সুযোগে ওখানে আসা বন্ধ করে নিজেকে মৃত প্রমাণ করতে চেয়েছে, আমার কাছ থেকে দূরে পালাতে চেয়েছে।
সৌমিক অপর্ণার দু হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
আমি একবারও বলতে চাইনি তুমি ভুল দেখেছো। আমি বলতে চাইছিলাম আমার মনে হয় তোমাকে এমন কিছু কথা খুলে বলা দরকার যেগুলো এতদিন পোক্ত প্রমাণ না থাকায় তোমাকে বলতে পারিনি। তবে তার আগে আমাকে রবির সঙ্গে একবার কথা বলতে হবে, নাহলে সমর, সরি তোমাকে বলা হয়নি ওর আসল নাম শুভঙ্কর, এক্ষুনি হাতছাড়া হয়ে যাবে। যাকে খুঁজতে রবি দিল্লি যাচ্ছিলো তাকে হাতের কাছে পেয়ে এভাবে সুযোগ নষ্ট হতে দিতে পারা যাবে না। তুমি একটু রেস্ট নাও আমি আসছি এক্ষুনি!
সৌমিক ফোন হাতে ঘরের দরজার বাইরে বেরিয়ে গেলো, অপর্ণা কেমন যেনো বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো, সৌমিকের কথাগুলো ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারছিলো না ও। যে ছেলেটা শুধু ওকে ঠকিয়েছে বলে এতক্ষন ভাবছিলো ও, সে সমর নয়, শুভঙ্কর! তার নামটুকুও ভুল জানতো ও! অথচ ওর ধারণা ছিলো ওর থেকে ভালো কেউ ওকে চেনে না! ওর জন্যে নিজের মাকে লুকিয়ে রেজিষ্ট্রি করতে যাচ্ছিলো ও! অপর্ণা আবার শুয়ে পড়লো, শরীরটা অসম্ভব দুর্বল লাগছে।
সৌমিক বাইরে বেরিয়ে রবিকে ফোন করলো, সব ঘটনা শুনে রবি উত্তেজিত হলো,
আমি এখুনি আসছি, দেখিস যেনো বেরিয়ে না যায়। আর অপর্ণাকে ঘরের বাইরে বেরোতে দিবি না একবারও, বাই চান্স যদি ওকে দেখে ফেলে তাহলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াবে না ও।
সৌমিক ফোন কানে কথা বলতে বলতে লক্ষ্য করলো মা আবার ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। মায়ের সিঁড়ি ভাঙতে একটু বরাবরই সময় লাগে তার ওপরে তো এখন ভাঙ্গা পা সবে জোড়া লেগেছে। একটু অবাক হলেও সৌমিক সিঁড়ির মুখ থেকে সরে দাঁড়ালো, রীনা ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে গেলেন। ফোন রেখে দিয়ে চিন্তা করতে লাগলো সৌমিক, ঠিক কিভাবে এখন রবি না আসা পর্যন্ত ওই ছেলেটাকে আটকে রাখা যায়! যদি হটাৎ করে বেরিয়ে যায় তাহলে কি করবে ও!
ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকে এলো সৌমিক, অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,
কতক্ষন আগে ওই ছেলেটা ভেতরে গেছে বলতো? মানে ঠিক কতক্ষন ও ওখানে থাকতে পারে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। মিতার সঙ্গে কি সম্পর্ক ওর কে জানে, কি করতে এসেছে এখানে সেটাও তো বুঝতে পারছি না ঠিক মতো!
অপর্ণা কোনো উত্তর দিলো না, রীনা এতক্ষন অবাক হয়ে ছেলের কথা শুনছিলেন, অনেকদিন তাঁর সঙ্গে ছেলের সরাসরি কোনো কথা হয়নি, এই সুযোগে এবার জিজ্ঞেস করলেন,
কার কথা বলছো?
সৌমিক ব্যালকনিতে বেরিয়ে সামনে রাখা মিতার গাড়ির দিকে দেখে এসে বললো,
ওই যে মিতার বাড়িতে যে ছেলেটাকে অপর্ণা ঢুকতে দেখেছে তার কথা বলছি। তুমি চেনো না তাকে, তোমাকে বলে লাভ নেই।
রীনা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,
আচ্ছা! চিনিনা ঠিকই তবে শুনলাম বিকেলে মিনতির কাছে। সে তো অল ইন্ডিয়া রেডিও, কোনো কথা তার অজানা নেই। সেই বললো আজ নাকি মিতার হবু হাসব্যান্ড ওদের বাড়িতে ডিনারের নিমন্ত্রণে আসবে, সেই সব গল্প শুনতে গিয়েই তার কাজে আসতে দেরি হয়ে গেছে। আবার আফসোস করছিলো জামাই দেখতে পেলো না বলে!
সৌমিক উত্তেজনায় ঘুরে তাকালো,
মিতার হবু হাসব্যান্ড! তুমি ঠিক জানো?
রীনা বিদ্রুপের ভঙ্গিতে তাকালেন,
কেনো তোমাকে এতো কথা জানিয়েছে আর এটা জানায়নি! এতো উপকারে লাগে তোমাকে ওর, যেকোনো বিপদে হামলে পড়ে উপকার করতে যাও! আর বন্ধুকে বিয়ে ঠিক হবার কথাটাই জানায়নি?
সৌমিক উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই অপর্ণা উঠে বসলো, দুর্বল গলায় বললো,
প্লিজ চুপ করো, আর ভালো লাগছে না এসব! ছেড়ে দাও ওকে, তোমাকে কিছু করতে হবে না! ওকে নিজের পছন্দ মতো নিজের জীবন কাটাতে দাও, ওতো এমনিও আর আমার জীবনে নেই! আমরা তো আমাদের মতো ভালো আছি, আমাদের কোনো অপ্রাপ্তি নেই, তাহলে অন্যদের তাদের মতো ভালো থাকতে দাও এবার। মিতা দিও জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে, এবার যদি ভালো থাকতে পারে তাহলে থাকুক না! আর সমর তো আমার সেই ভাবে কোনো ক্ষতি করেনি, হয়ত ওর মনে হয়েছিলো আমার সঙ্গে ওর মানসিকতার কোনো মিল নেই, তাই ও সরে গিয়েছে। কেউ জানিয়ে সরে, কেউ না জানিয়ে, ফারাক তো এইটুকুই! সেই ভাবে দেখতে গেলে তো তুমিও মিতাদির কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছো তাই না? আর কতো প্রতিহিংসা দেখাবে সবাই সবার ওপরে? মা যতোই নিজেকে আড়াল করে সব দোষ মিতাদির ওপরে দিতে চান না কেনো আসলে তো তিনিও প্রতিশোধ নিতেই চেয়েছেন। তাঁর মিতাদির বাবা মায়ের ওপরে জমানো রাগ তাঁদের মেয়ের ওপরে দেখতে চেয়েছেন, মিতাদির বাবা, মাও তো মাকে হেয় করে তোমার ঠাকুমা আর রীতা পিসিকে প্রায়োরিটি দিয়েছিলেন একসময়। তখন তাঁরা বোঝেন নি যে সময়ের চাকা ঘুরলে এই অপমানের প্রতিশোধ তাঁদের মেয়ের ওপরেই এসে পড়বে! সেই একই ভুল আবার মিতা দিও করলো শেষে, তোমাকে সব বলে দিয়ে নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করলো মায়ের ওপরে। আজ তুমি ট্রান্সফার নিচ্ছ শুনে তার থেকে বেশি খুশি বোধহয় কেউ হচ্ছে না একটুও! মায়ের কাছ থেকে তোমাকে আলাদা করতে পেরে সে মনে মনেই আনন্দ পাচ্ছে! অথচ ভেবে দেখলে এখন তুমি আলাদা থাকো বা না থাকো তাতে কিন্তু সত্যিই আর মিতাদির কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমি প্রতিশোধ চাইনা, আমি মনে করি যে লোকটা তার জীবনে আমার কোনো প্রয়োজন নেই বলে সরে গিয়েছে, আমি তাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারি, সেটুকু মনের জোর আমার আছে। তাকে সামনে ডেকে কেনো তুমি আমাকে মিথ্যে বললে, কেনো আমাকে ঠকালে এগুলো জিজ্ঞেস করে তাকে অতোটাও ইম্পর্ট্যান্ট পারসন বানাতে পারবো না। যার আমাকে দরকার নেই, তাকে আমারও দরকার নেই! ওই লোকটা এই মুহূর্তে আমার কাছে এক্সিক্সট করেনা, ও কে, কোথায় থাকে, ওর আসল নাম কি, এগুলোর কোনটাই আমি জানতে ইচ্ছুক নই। আমি শুধু একটা নিরপরাধ মানুষের খুনি কে খুঁজতে চেয়েছিলাম, যাতে অসহায় মানুষটা শান্তি পায়, আমার মন শান্তি পায়। আজ যখন আমি জেনে গিয়েছি যে মানুষটা জীবিত আছে তখন আর তার খুনি বলে কেউ নেই, তখন আমার চাওয়া এখানেই শেষ। সমর বা শুভঙ্কর নামে কেউ আর কোনোদিনও আমার মনে একফোঁটাও জায়গা নিতে পারবে না, আমি তার সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলতে, তাকে ধরতে বা তার সত্যি জানতে বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্টেড নই।
রীনা অবাক হলেন,
কে সমর? এ সেই ছেলেটি না যার খুন হয়ে যাওয়ার কথা রবীন বাবু বলেছিলেন আমাকে? সে বেঁচে আছে! তাহলে সে খুন হয়েছে এরকম একটা কথা রটলো কি করে? বডি তো কেউ দেখেছিলো নিশ্চয়ই?
সৌমিক কিছু বলার আগেই অপর্ণা বাধা দিলো,
এসব থাক মা, এতো কথা জেনে লাভ কি আর? যেখানে তাকে স্পষ্ট জীবিত দেখছি সেখানে তার বডি কেউ দেখেছিলো কিনা সেসব কথার এখন আর কোনো মূল্য নেই। এসব প্রসঙ্গ থাক এখন, আমার ভালো লাগছে না।
রীনা চুপ করে গেলেন, সৌমিক মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
ওসব অনেক কথা, বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে, আর তার সময়ও নেই এখন। আমি রবিকে জানিয়েছি, ও বলেছে ও না আসা পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরতে, কিন্তু টেনশন হচ্ছে ছেলেটা বেরিয়ে না যায়। তবে যদি তোমার কথাই সত্যি হয় তাহলে তো ডিনার করতে অনেকটাই সময় লাগবে নিশ্চয়ই, তার মধ্যেই রবি এসে পড়বে। তার পরে ছেলেটার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের।
অপর্ণার প্রায় চিৎকার করে উঠে ভাঙ্গা গলায় বললো,
এটা আমার ব্যাপার, আমি বারবার বলছি আমি চাইনা মুখোমুখি হতে, চাইনা ওর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ছোটো করতে, তাও তুমি একই কথা বলে যাচ্ছো! বলছি তো ওকে ছেড়ে দাও ওর মতো, ওর ওপরে আমার কোনো রাগ নেই। আমি প্রতিশোধ নিতে চাইনা!
সৌমিক ঘুরে দাঁড়ালো, অপর্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
আমিও চাইনা কারোর ওপরে প্রতিশোধ নিতে! তোমার কথা থেকেই আমি বুঝতে পেরেছি তুমি মিতা আমাকে কি বলেছে সেটা জানো, তাই বলছি এতো কিছুর পরেও কিন্তু আমিও মিতার ওপরে কোনো প্রতিশোধ নিতে চাইনি। আমিও তোমার মতই বিশ্বাস করি যে প্রতিশোধ আরো প্রতিশোধের জন্ম নেয়, কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা। এটা যদি শুধু মাত্র তোমার বিশ্বাস ভাঙার প্রশ্ন হতো, যদি তোমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে ছেলেটা মরে যাবার কথা চাওর করতো সেক্ষেত্রে আমিও তোমাকে সরে আসারই পরামর্শ দিতাম, বলতাম ওকে সম্পূর্ন ইগনোর করতে। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা অতোটাও জলের মতো সোজা নয়, শুভঙ্করের সমর হওয়ার মধ্যে সম্পূর্ন আরেকটা জটিল গল্প আছে। সমর খুন অবশ্যই হয়েছে তবে সে আসল সমর, আর সেটা কে জানলে তুমিও চাইবে এই খুনের কিনারা হোক। যিনি আসল সমর চৌধুরী তিনি কে জানো? তিনি আমাদের দীপা দির হাসব্যান্ড, আর তাঁকে যে খুন করেছে সে নকল সমর, এই শুভঙ্কর!
রীনা আর অপর্ণা একসাথে চমকে উঠলো, রীনা অবাক গলায় বললেন,
দীপা তো ডিভোর্সী জানতাম, ওর হাজব্যান্ডের খবর তুমি পেলে কি করে!
সৌমিক দুঃখের গলায় জবাব দিলো,
কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে আসে মা! জীবনটা বড্ড জটিল কারো কারো কাছে, তারা সহজ, সরল জীবন যাপন করতে জানে না। তারা বোঝেনা তাদের এই জীবন যাত্রা অন্যদের জীবনে কতো বিপত্তি ডেকে নিয়ে আসে, তাদের সাজানো জীবন অগোছালো হয়ে যায়।
রীনা ছেলের মুখের দিকে তাকালেন, কোথাও গিয়ে ছেলের বলা কথাগুলোর সঙ্গে বোধহয় নিজেকেও মিলিয়ে নিলেন, তাঁর স্বামীর এই অশালীন জীবন যাত্রা তো তাঁদের জীবনেও ঝড় তুলেছে আজ, এতো বছরের সাজানো সংসারে ভাঙন ধরিয়েছে, আদরের ছোট ছেলেকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করছে। তিনি অসহায় হয়ে দেখছেন, কিভাবে সব দিক ধরে রাখবেন হাজার ভেবেও তার কুল কিনারা করতে পারছেন না কিছুতেই।
অপর্ণা এতক্ষন স্তম্ভিত হয়ে বসেছিলো, আর কতো কড়া সত্যি ও জানতে পারবে সমরের সম্পর্কে! শেষ পর্যন্ত ও একটা খুনিকে ভালোবেসেছিলো! নিজের ওপরেই ঘেন্না হচ্ছে ওর, রসূলপুরের ট্রেনের দৃশ্য, কলেজের রাস্তার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে! যে হাত ওর হাতকে ছুঁয়ে যেতো ট্রেনে ওঠার সময়, কলেজের রাস্তায় যে হাতটা শক্ত করে ধরে থাকতো ওর হাত, যে হাতটা ধরে ও চলতে চেয়েছিলো সারা জীবন সেই হাতটা একটা খুনীর হাত! কারো শরীরের রক্তে লাল হয়ে আছে সেটা!
এমন সময় দরজায় কলিং বেল বাজলো, রত্না দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে রবি দৌড়ে ওপরে উঠে এলো, উত্তেজিত গলায় বললো,
পালায় নি তো? ভেতরেই আছে তো?
সৌমিক ঘাড় নাড়লো,
নাহ! আছে ওখানেই, শুনলাম মিতার হবু হাসব্যান্ড নাকি ও! ডিনারের নিমন্ত্রণে এসেছে।
রবি ধপ করে সোফায় বসে পড়লো, পাশের টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে ঢক ঢক করে গলায় অনেকটা জল ঢেলে নিয়ে বললো,
ফোর্সকে বাঁকের পাশে রেখে এসেছি, বেরোলেও পালাতে পারবে না। আমি একাই ঢুকবো এখন, তারপরে অপর্ণাকে ডাকবো ফোন করে। তুই ওকে ঘটনাটা বলেছিস তো বুঝিয়ে?
সৌমিক আড় চোখে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললো,
অপর্ণার শরীরটা খারাপ হয়েছে, ছেলেটাকে ঢুকতে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া ও খুব শকড, মনে হয়না সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে, আমাকে বল তুই, আমিই যা করার করবো, ছেড়ে দে ওকে।
অপর্ণা সোজা হয়ে উঠে বসলো, রবির দিকে তাকিয়ে বললো,
না, আমি পারবো। বলো আমাকে ঠিক কি করতে হবে, আমিও চাই খুনীর শাস্তি হোক! আমাকে কেনো ঠকালো সেটা আমি জানতে চাইনা, কিন্তু একজন নিরীহ মানুষকে খুন কেনো করলো সেটার জবাবদিহি তো আমি চাইবোই!
রবি উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে এসে অপর্ণার মাথায় হাত রেখে বললো,
খুব ভালো অপর্ণা, আমি জানতাম তুমি পারবে। আর একটা কথা বলি তোমাকে, এই ছেলেটা যে শুধু সমর চৌধুরীকে খুন করেছে তা নয়, বেশ কয়েকটি মেয়েকে পাচার করার অভিযোগও ওর বিরুদ্ধে আছে। এই কথাগুলো তোমাকে বললাম কেনো জানো? যখন তোমার মন বিন্দুমাত্রও দুর্বল হবে ওর সামনে দাঁড়িয়ে তখন এই কথাগুলো মনে পড়লে তোমার মনের জোর বাড়বে। তুমি শুধু একজন খুনিকে শাস্তি দিচ্ছ না তোমার মতো, মিতার মতো আরো কতো মেয়েকে পাচার হওয়া থেকে বাঁচাচ্ছ!
ক্রমশ