ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-৫২+৫৩

0
219

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৫২
বেলের আওয়াজে মিতাদের বাড়ির কাজের মেয়েটা দরজা খুললো, মিতা ভেতর থেকে কে জানতে চাওয়ায় রবি গলা তুলে জবাব দিলো,

আমি।

রবির গলার আওয়াজ মিতার পরিচিত, সে এক মুখ বিরক্তি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, কোমরে হাত দিয়ে রবির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

কি দরকার? কেনো এসেছিস?

তোর কাছে আসিনি, সর, আমার কাকিমার সঙ্গে দরকার আছে,

বলতে বলতে মিতাকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে রবি বসার ঘরে ঢুকে এলো। মিতার মা রান্না ঘরে ছিলেন, বেরিয়ে এসে রবিকে দেখে বললেন,

আয় ভেতরে আয়, ভালো দিনে এসেছিস তুই।

মিতা পেছন পেছন ঢুকে এসেছিলো, সোফায় বসে থাকা শুভঙ্করের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বললো,

ভদ্র ভাবে বলছি বেরিয়ে যা, তোর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই আমার।

মিতার সঙ্গে রবির হওয়া গন্ডগোলের কথা মিতার মায়ের জানা ছিলো না, তাই রবি কিছু বলার আগেই মিতার মা মেয়েকে ধমকে উঠলেন,

একি রে! ওকে চলে যেতে বলছিস কেনো? ও এসেছে তো তোর কিসের অসুবিধা?

রবি একমুহুর্ত দেরি করলো না, মিতার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

ছেড়ে দাও কাকিমা ওর কথা, তুমি এদিকে এসো। আমি তোমার কাছেই এসেছি। ওই ছেলেগুলোর সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিয়েছি বুঝলে, কয়েকটা প্রোফাইল বেশ ভালো।

মিতার মা হেসে ফেললেন, উৎফুল্ল গলায় বললেন,

আহা, আমার কতো কাজের ছেলে রে! হবু জামাই সামনে বসে আছে, উনি এখনো প্রোফাইল দেখে চলেছেন! ছাড় এবার এসব। আর এসব লাগবে না, মিতার বিয়ে তো ঠিক হয়ে গিয়েছে। এদিকে আয় তোকে আমার জামাইয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি।

রবি অবাক হবার ভান করলো,

তাই নাকি! কবে হলো কিছুই তো জানতে পারলাম না। এক মাসের মধ্যে এতো কিছু এগিয়ে গেছে নাকি? মাত্র তো একমাস আসিনি তোমার কাছে, অবশ্য মিতাও তো বলে নি কিছু।

মিতার মা রবিকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন, সোফার উল্টোদিকে বসা লম্বা, সুদর্শন যুবকের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে হাসলেন,

ওই দ্যাখ, ওর নাম শুভঙ্কর, দিল্লিতে থাকে, আমার হবু জামাই।

শুভঙ্কর উঠে দাঁড়ালো, রবিকে চেনা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না তবুও একবার মিতার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়েই স্মার্ট ভঙ্গিতে রবির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। রবি হাসলো, নিজের হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বললো,

থাক থাক ওকে আর জিজ্ঞেস করতে হবে না, মিতা আমাকে একটুও পছন্দ করেনা, ছোটো বেলার বন্ধু তো তাই ভাবের থেকে ঝগড়াই বেশি। আমি বরং নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে দিচ্ছি, আমি রবি, মিতা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো একসময়, তবে এখন তো বুঝতেই পারছেন আমার থেকে বড়ো শত্রু ওর আর কেউ নেই।

মিতার মা হেসে ফেললেন, হবু জামাই এর দিকে তাকিয়ে বললেন,

ওই ছোটো থেকেই ভাব আর ঝগড়া চলছে ওদের। তবে রবি কিন্তু খুব ভালো ছেলে, ওর ওপরেই আমি এই বিয়ের দায়িত্বটা ছেড়েছিলাম। তার অবশ্য একটা কারণ আরো আছে যেটা ও নিজে মুখে বলে না কাউকে। ও কলকাতা পুলিশে খুব বড়ো পোস্টে আছে, তাই খোঁজ খবর নিতে সুবিধা হয় অনেক।

রবি এটা বলতে চায়নি ইচ্ছে করেই, কিন্তু কাকিমা বলে ফেলায় শুভঙ্করের মুখের কি পরিবর্তন হয় দেখার জন্যে সে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু ছেলেটি যথেষ্ট ধুরন্ধর, তার মুখের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হলো না, সে রবির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো,

বাহ! পুলিশ! আমারও একসময় খুব পুলিশ হবার ইচ্ছে ছিলো!

রবি হাসলো,

আপনার এতো সুন্দর হাইট, পেটানো চেহারা, একেবারে পুলিশ হবার উপযুক্ত। হলেন না কেনো?

শুভঙ্কর হা হা করে হাসলো,

ইচ্ছে থাকলেই কি আর সব হয় বলুন? সে তো সবাই বলতো সিনেমায় অভিনয় করলে আমি নায়ক হিসেবেও চান্স পেতাম, কিন্তু কিছুই তো হলো না আর। ছোটো বেলায় বাবাকে হারিয়ে মায়ের সঙ্গে কলকাতার মামার বাড়িতে থাকতাম, খাওয়া পরার অভাব কখনো ছিলো না ঠিকই তবে শখ পূরণ করারও কেউ ছিলো না!

মিতা এবার এগিয়ে এলো, সোফায় শুভঙ্করের পাশে বসে বললো,

থাক ওসব! কেনো বারবার পুরনো কথা টেনে নিয়ে আসো। এখন তুমি তো তোমার জায়গায় সাকসেসফুল, এসব আলোচনার আজ আর কোনো প্রয়োজন নেই।

রবি একটু গলা খাঁকড়ে নিয়ে বললো,

সরি, আপনাকে হার্ট করতে চাইনি, আমি হয়ত না জেনেই আপনার গোপন দুঃখের জায়গায় আবার আঘাত দিয়ে ফেলেছি। যাইহোক, ছাড়ুন ওসব আপনি এখন কি করেন সেটাই বলুন?

শুভঙ্কর হাসলো,

বিজনেস, গার্মেন্টের বিজনেস। আমার দিল্লির কনট প্লেসে একটা দোকান ছিলো আগেই, আর একটা খুলছি সামনের মাসে।

রবি উৎফুল্ল হলো,

বাবা! সেতো বিশাল ব্যাপার। আগের দোকানটা কতদিনের?

এই বছরখানেক আগেই খুলে ছিলাম, তার আগে বড়ো বড়ো কোম্পানিতে মাল সাপ্লাই করতাম। পরে ভাবলাম নিজেই শুরু করি।

রবি মুচকি হাসলো, মিতার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললো,

খুব ভালো, আমি মাঝে মাঝেই দিল্লি যাই অফিসের কাজে, এবার থেকে তো আপনাদের কাছেই উঠবো। মিতা ঘরে ঢুকতে না দিলে আপনি একটু দেখবেন ব্যাপারটা।

শুভঙ্কর হা হা করে হেসে উঠলো,

নিশ্চয়ই, ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম।

রবি সোফায় আরাম করে বসলো, মিতার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

কাকিমা আমারও আজ ডিনারে নেমন্তন্ন তো? গন্ধ যা বেরোচ্ছে, আজ বাড়িতে গিয়ে রুটি খেতে পারবো না।

মিতার মা রান্নাঘরে চলে গিয়েছিলেন, রবির ডাকে বেরিয়ে হাসলেন,

হ্যাঁ, হ্যাঁ খেয়ে যাস, এটা আবার বলতে হয় নাকি।

আরো কিছুক্ষন গল্পগুজব হওয়ার পরে রবি হটাৎ করেই শুভঙ্করের দিকে তাকালো,

আপনাকে কেনো যেনো আমার বড্ড চেনা চেনা লাগছে, আগে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে। কি নাম বললেন আপনার? সমর, তাই তো?

শুভঙ্কর চমকে উঠে রবির দিকে তাকালো, সে কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই মিতার মা বলে উঠলেন,

না, না ওর নাম শুভঙ্কর। আর চেনা তো লাগবেই ওর প্রোফাইলও তো তোকে দিয়েছিলাম আমি। মিতার সঙ্গে নেহাত ওর চেনাশোনা বেরিয়ে গেছে তাই, নাহলে তো ওর প্রোফাইল তুই দেখেইছিস।

রবি শুভঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

ওহো! ঠিক বলেছো। কিন্তু আপনার সঙ্গে মিতার চেনাশোনা কি করে হলো?

শুভঙ্কর ততোক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়েছিলো, হেসে বললো,

ওই একটা পার্টিতে, আমরা দুজনেই ইনভাইটেড ছিলাম। ফটোটা দেখেই চিনতে পেরেছিলাম, আমিই যোগাযোগ করেছি তারপর।

রবি উৎসুক ভঙ্গিতে তাকালো,

বিয়েটা কি তাহলে দিল্লি থেকেই হচ্ছে? নাকি এখানে?

শুভঙ্কর মাথা নাড়লো,

নাহ! আমার এখানে কেউ নেই, যে কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন সব দিল্লিতেই।

আচ্ছা! আপনার মা ছিলেন বললেন না? আর কলকাতাতেই তো মামার বাড়ি? তাহলে এখান থেকে করলে আমাদের তো সুবিধা হতো একটু!

শুভঙ্কর মলিন হাসলো,

মা অনেকদিন মারা গেছেন, যতদিন মামা ছিলেন ততদিন তো এখানেই ছিলাম, কারণ আমি ছাড়া ওনার সেরকম কেউ ছিলো না। মামা মারা যাবার পরে দিল্লিতে সেটেল করে গেছি।

মামা কি নিঃসন্তান ছিলেন নাকি? তাঁর বাড়িটা কি হলো?

রবির প্রশ্নে শুভঙ্কর বিদ্রুপের হাসি হাসলো,

প্রায় নিঃসন্তান বলতে পারেন। একমাত্র মেয়ে অনেক বছর ধরে বিদেশে থাকে, বাবাকে দেখাশোনা করেনি কখনো, কিন্তু বাবা মারা যাবার পরে এসে বাড়ির দখল নিয়েছে। এখন বাড়ি বিক্রি করে দেবে শুনলাম। আমার অনেক স্মৃতি ছিলো বাড়িটায় তাই আমি কিনে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে দেবেনা, সে কোনো প্রোমোটারের সঙ্গে কথা বলেছে, ওখানে শুনলাম ফ্ল্যাট উঠবে। তাই আমার দিল্লিই ভালো, পিছুটান রেখে আর লাভ কি। বিয়েও তাই ওখানে গিয়েই করবো ঠিক করেছি।

রবি হাসলো,

কেনো? এখন তো এই বাড়িটাই আপনারও, সাজিয়ে গুছিয়ে থাকুন এখানে।

শুভঙ্কর চুপ করে গেলো, কিন্তু মিতার মা মলিন হাসলেন,

আমিও সেকথা বলেছিলাম রে, কিন্তু ওর ইচ্ছে নেই। ও বলছে আমাকে নিয়ে যাবে ওদের কাছে। একজনের সঙ্গে কথা কিছুটা এগিয়েছে, শুভঙ্করের চেনাশোনা, উনিই হয়ত বাড়িটা নেবেন। দেখা যাক কি হয়।

একদম ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এসে যাওয়ায় শুভঙ্কর সম্ভবত বিরক্ত হলো, সে মিতার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তাকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতে দেখে মিতা মায়ের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

রবিকে খেতে দিয়ে দাও, রাত হয়ে যাচ্ছে, ওকে বাড়ি ফিরতে হবে তো।

রবি সোফায় পা তুলে বসতে বসতে বললো,

না, না, আমার কোনো তাড়া নেই, একসঙ্গেই খাবো। আচ্ছা সমর, আপনার কি দিল্লিতে বাড়ি আছে নাকি ফ্ল্যাট? মিতা তো ছোটো থেকে বাড়িতে থেকে মানুষ, ফ্ল্যাটে থাকতে ওর খুব অসুবিধা হবে তাহলে।

এইবার শুভঙ্কর বিরক্ত হলো, তার গলায় সেই বিরক্তি প্রকাশ পেলো,

এক মিনিট! আমি সমর নই, আমি শুভঙ্কর! প্লিজ আমাকে ভুল নামে ডাকবেন না।

রবি কিছু উত্তর দেবার আগেই মিতা বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,

কি ব্যাপার বলতো তোর? ঋজুর পেছনে ঘুরতে ঘুরতে তোর মাথাটা গেছে একদম! সারাক্ষন সমরের নামই জপে চলেছিস দেখছি। ওর বউয়ের সমস্যা বাদেও দুনিয়ার আরো অনেক সমস্যা আছে, সেগুলো নিয়ে ভাব। একটা সাব স্ট্যান্ডার্ড ছেলে, যার বউ নাকি আয়ার কাজ করে সংসার চালায়, তার প্রেমে পড়ে যে মেয়ে সেও তো সাব স্ট্যান্ডার্ড। তাকে নিয়ে তোর কিসের অতো মাথাব্যথা বলতো?

রবি মিতাকে বাধা দিলো,

ওই ভাবে বলিস না! না জেনে তো কতো লোক কতো ভুল করে, জানলে নিশ্চয়ই করতো না। তাই বলে তাকে সাব স্ট্যান্ডার্ড বলা উচিত নয়। আজ ধর তুই এমন কারোর প্রেমে পড়তে পারতিস যে হয়ত তোর যোগ্য নয়, কিন্তু সেটা পরে জানাজানি হলে কি তুই সাব স্ট্যান্ডার্ড হয়ে যাবি? কখনই না, কারণ তুই তো আর তার স্ট্যান্ডার্ড জেনে ভালবাসিস নি তাকে, তাই না?

মিতার সঙ্গে কথা বলতে বলতেও রবির চোখ শুভঙ্করের মুখের ওপরেই ছিলো, বারবার সমরের নাম শুনতে শুনতে বোধহয় কিছু সন্দেহ হলো শুভঙ্করের, সে হটাৎ করে মিতার দিকে তাকালো,

রাত অনেকটা হয়ে গেছে, এরপরে আর উবের পাবো না, আমাকে উঠতে হবে। খেতে গেলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে, তুমি একটা কাজ করো ডিনারটা বরং প্যাক করে দাও।

মিতা দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বললো,

সবে তো সাড়ে আটটা, খেতে কতক্ষন লাগবে আর, উবের পেয়ে যাবে তুমি। মাকে খেতে দিয়ে দিতে বলছি।

শুভঙ্কর উঠে দাঁড়িয়েছিলো ততোক্ষনে কিন্তু মিতা তাকে জোর করে ডিনার টেবিলে টেনে নিয়ে গেলো। রবিও এগিয়ে গেলো, হোয়াটসঅ্যাপে অপর্ণাকে পাঠানোর জন্যে সৌমিককে মেসেজ করে দিয়ে উল্টোদিকের চেয়ার টেনে বসতে বসতে শুভঙ্করের অস্থিরতা লক্ষ্য করতে করতে বললো,

আপনার শরীরটা কি খারাপ লাগছে নাকি? এসির মধ্যে ঘামছেন! এসিটা একটু বাড়িয়ে দেব?

ইতিমধ্যে মিতা রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিলো মাকে সাহায্য করতে, শুভঙ্কর মুখ তুললো না, মাথা নিচু রেখেই মোবাইলে চোখ রেখে মাথা নাড়লো,

নাহ! গরম টা বড্ড বেশি আজ।

রবি সহমত হলো,

যা বলেছেন সমর বাবু, খুব গরম আজ, আমিও সকাল থেকেই ঘামছি। তবে দিল্লির গরমের থেকে অনেকটাই কম কি বলুন?

শুভঙ্কর এবার হিংস্র চোখে তাকালো, ইতিমধ্যে মিতা মায়ের সঙ্গে খাবার নিয়ে এসে গিয়েছিলো, সেগুলো টেবিলের ওপরে রাখতে রাখতে রবির দিকে তাকিয়ে বললো,

রবি! এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে! আমি জানি তুই এতো ভুলোমনা নোস, এগুলো ইচ্ছে করেই করছিস!

রবি সোজা চোখে শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে বললো,

আসলে আমি আমার পরিচিত একজনের সঙ্গে ওঁকে বড্ড গুলিয়ে ফেলছি। তাঁর নাম সমর চৌধুরী, ছবিটা দেখলে তুই অবাক হয়ে যাবি, উনি একদম শুভঙ্করের মতোই দেখতে। বাই দা ওয়ে, আপনার কোনো যমজ ভাই আছে নাকি?

রবি নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলো, মিতা অবাক হয়ে তাকালো,

তুই কোন সমরের কথা বলছিস? তোর পরিচিত মানে? তুই তো সমরকে চোখেই দেখিস নি কখনো!

রবি হাসলো,

আরে না, না, এ অন্য সমর! তুই চিনবি না! উনি একদম এক রকম দেখতে! তাই আমার বারবার ভুল হয়ে যাচ্ছে।

শুভঙ্কর এবার কড়া চোখে রবির দিকে তাকালো,

নাহ! আমার কোনো টুইন নেই! আমি সমর চৌধুরী বলে কাউকে চিনি না আর অন্যের নামে পরিচিত হতে আমি ভালোবাসি না। আমি শুভঙ্কর, কলকাতার অ্যাড্রেস দরকারে দিতে পারি আপনাকে, যদি মনে হয় পাত্র হিসেবে আপনার বন্ধুকে আমি কোনো মিথ্যে তথ্য দিয়েছি, তাহলে স্বচ্ছন্দে পাড়ায় গিয়ে খোঁজ নিতে পারেন। যদিও বাড়ি তালাবন্ধ এখন, তবে পাড়ায় আমাকে সবাই মোটামুটি চেনে। আর আধার কার্ড তো প্রোফাইল খোলার সময় দিয়েছিলাম, ওরা ভেরিফাই করেই নিয়েছিলো। তবু যদি চান আবার দিতে পারি।

পরিস্থিতি অন্য দিকে গড়াচ্ছে দেখে মিতার মা সামনে এগিয়ে এলো, রবির দিকে তাকিয়ে বললো,

কি বলছিস এসব? মিতা ওকে আগে থেকেই চেনে বললাম তো!

রবি কোনো উত্তর দিলো না, মিতার মা হবু জামাইয়ের দিকে তাকালেন,

ওর কথায় কিছু মনে করো না শুভঙ্কর, ও ছোটো বেলার বন্ধুকে নিয়ে খুব চিন্তায় থাকে, তাই পুলিশি চোখে যাচাই করতে চাইছে। তুমি খাও, রাত হয়ে যাচ্ছে।

রবি কে চুপ করে যেতে দেখে শুভঙ্করের সাহস বাড়লো, সে খাবারের থালায় হাত না দিয়ে রবির দিকে তাকিয়ে বললো,

না ঠিক আছে! উনি ওনার কোয়ারিগুলো ক্লিয়ার করে নিন আগে! বলুন কি জানতে চান? আপনার কোনো পরিচিত মানুষের মতো দেখতে হওয়ার পেছনে আমার কোনো হাত নেই, সেটা কোইনন্সিডেন্স বলতে পারেন।

রবি পকেট থেকে ত্রিদিব বাবুর কাছ থেকে নেওয়া ফটোটা বার করে টেবিলের ওপর দিয়ে শুভঙ্করের দিকে ঠেলে দিয়ে সমরের ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো,

ইনি সমর চৌধুরী, একই ছবিতে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনাদের থাকাটাও বোধহয় কোইন্সিডেন্স, তাই না?

শুভঙ্কর কিছু বলতে যাচ্ছিলো, মিতা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

এই ভদ্রলোক আর শুভঙ্কর এক দেখতে! অদ্ভুত তো তুই! দুজনের মধ্যে বিন্দুমাত্র মিল নেই! ইনি তো শুভর থেকে অনেকটাই বড়ো! তবে এই ছবিটায় শুভও আছে দেখছি! তুমি কি এনাকে চেনো শুভ?

শুভঙ্কর মিতার দিকে তাকালো না, রবির দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,

না, চিনি না! তবে ফটোটা একটা ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কাশ্মীর ট্যুরের, আমি মামাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম, উনি একা যেতে সাহস পাচ্ছিলেন না বলে।

রবি একটু ঝুঁকে এলো,

ইনি সেই ট্যুরের গাইড ছিলেন আপনাদের সঙ্গে, মনে পড়ছে? না পড়লে আর একটা ছোট্ট তথ্য দিই। ইনি তো আপনার মামার বিজনেস পার্টনারও ছিলেন, তাই না? রাজি তো আপনিই করিয়েছিলেন, তাই তো?

শুভঙ্কর চোয়াল শক্ত করলো,

মনে পড়ছে না! কোনো ট্যুরের গাইডকে আর কে মনে রাখে! আর আমার মামা অনেকের সঙ্গে ব্যবসা করতেন, তাঁদের সবাইকে আমি চিনতাম না! উনি যদি পার্টনার হয়েও থাকেন, আমি অন্তত দেখিনি কখনো ওনাকে।

আচ্ছা! আপনার দিদি বলছিলেন আপনি আপনার মামার ব্যবসা দেখাশোনা করতেন, এমনকি মারা যাবার পরে সব কিছু আপনিই ক্লোজ করেছেন! পার্টনারদের না চিনেই এসব কি করে করলেন আপনি?

একদম বাজে কথা! ও আমার ওপরে বদলা নিতে চাইছে, আমার সঙ্গে রাগারাগি হয়েছিলো তাই। আমি কখনো মামার ব্যবসা দেখতাম না, আমি আগেই বলেছি আমার খাওয়া পরার অভাব ছিলো না কিন্তু কোনো ব্যাপারে মামা আমাকে ইন্টারফেয়ার করতে দিতেন না, ওনার নিজের ব্যবসা উনি নিজেই দেখতেন।

উত্তেজিত গলায় বললো শুভঙ্কর, রবি সোজা চোখে তাকালো,

আপনার কথাই যদি সত্যি হয় তাহলে আপনি এবং আপনার মা মামার বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন, মামা তাঁর ব্যবসায় আপনাকে নেন নি কখনো। সেক্ষেত্রে আপনার এতো বড়ো ব্যবসার টাকার যোগান কে দিলো? দিল্লীতে দুটো দোকান করার পুঁজি আপনি কোথা থেকে পেলেন?

শুভঙ্কর এই প্রথম বার থতমত খেলো, সে কোনো উত্তর দেবার আগেই রবি পকেট থেকে একটা ছোটো নোট বুক বার করে একটা নম্বর এগিয়ে দিলো শুভঙ্করের দিকে,

এই নম্বরটা আপনারই তো? আপনার মামাতো দিদির কাছ থেকে পেয়েছিলাম।

অস্বীকার করার উপায় না থাকায় শুভঙ্কর ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ, আমার, তবে এখন আর ব্যবহার করিনা, কারণ কলকাতার কোনো আত্মীয় বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না।

রবি হাত তুললো,

ভালো কথা! তবে কবে শেষ ব্যবহার করেছেন মনে আছে?

অদ্ভুত প্রশ্ন তো! আমি কি দিনক্ষণ গুনে রেখেছি নাকি! কলকাতা থেকে চলে যাবার পরে ওখানে নতুন সিম নিয়েছিলাম এটুকু বলতে পারি।

বিরক্ত গলায় উত্তর দিলো শুভ, রবি হাসলো,

আপনার সিম আপনি জানেন না, কিন্তু দেখুন আমি জানি! এই সিমটার শেষ দু তিনদিনের লোকেশন ছিলো সমর বাবুর বাড়ি, আপনার মামার বাড়ি আর সমর বাবুর অ্যাকাউন্ট আছে যে ব্যাংকে সেই ব্যাংকে! আরো বিস্তৃত ভাবে বলতে গেলে যে সময়ে পাসবুক থেকে টাকা তোলা হয়েছে তখন এই ফোনের মালিক ব্যাংকেই ছিলেন। যদি ধরে নিই যে আপনি অন্য কোনো কাজে গিয়েছিলেন সেখানে, যদিও ওই ব্যাংকে আপনার কোনো অ্যাকাউন্ট নেই আমি জানি তাও এটা বলুন যে লোকটিকে আপনি চেনেন না বলছেন তার বাড়িতে তার নিখোঁজ হবার পরে আপনি কি করছিলেন? আর শুধু তাই নয় এর আগেও অনেকবার এই সিমের লোকেশন ওনার বাড়িতে পাওয়া গেছে।

কয়েক মুহূর্ত রবির দিকে তাকিয়ে থেকে শুভঙ্কর মাথা নামালো,

বার কয়েক মামা কিছু কাগজ পত্র দিয়ে পাঠিয়েছিলেন ওনার বাড়িতে, তবে আমি ব্যবসার কিছু দেখতাম না এটা সত্যি। লাস্ট সিমের লোকেশন বলতে কবে বলছেন আমি জানিনা তবে যেদিন শেষ ওনার বাড়িতে গিয়েছিলাম সেদিন উনি ছিলেন না, আমি ফিরে এসেছিলাম।

মিতা ধপ করে সোফায় বসে পড়লো, রবি শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,

তাহলে আপনি মেনে নিচ্ছেন আপনি সমর চৌধুরী কে চিনতেন এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন। তবে এখানে একটা ছোট্ট মিথ্যে আছে, ওনার বাড়িওয়ালা জানিয়েছেন আপনি চাবি নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলেন কিছু জিনিসপত্র নিতে আর বেরোনোর আগে ওনার প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন সমর বাবু আপনাকে পাঠিয়েছেন।

শুভঙ্কর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মিতার দিকে তাকিয়ে বললো,

দেখলে মিতা! আমি তোমাকে বলেছিলাম না কলকাতা ছেড়ে গেলেও ওরা আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না! ওই জন্যেই আমি এই বাড়ি রাখতে চাইছি না!

মিতা রবিকে কিছু বলতে চাইছিল তার আগেই শুভ তাকে আটকালো,

দাঁড়াও! আমাকে ওনাকে সবটা খুলে বলতে দাও!

শুভ রবির মুখোমুখি ঘুরে বসলো,

শুনুন রবি বাবু, আমি ওনাকে চিনতে চাইনি কারণ আমি কলকাতার কারোর সঙ্গে যোগাযোগের কথা মনে রাখতে চাইনা! মামার পার্টনারের সঙ্গে যদি ব্যবসায় মামার কোনো সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে সেটা আমার মামাতো দিদিই মেটাবে। এসবের সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ফেলবেন না প্লিজ! আমি জানি ওই আপনাকে হায়ার করেছে আমার বিরুদ্ধে এসব ভুয়ো অভিযোগ করার জন্যে। এই জন্যেই আমি প্রথম থেকে সমর চৌধুরী কে চিনতে অস্বীকার করেছি। ওই যে ফটোটা আপনি আমাকে দেখাচ্ছেন ওটা আমার মামার বাড়িতেই ছিলো, দিদি আপনাকে দিয়েছে সেটা বুঝতেই পারছি। ওর আমার ওপরে রাগ মেটানোর জন্যে ও সমর চৌধুরীর খুন হয়ে যাওয়ার দায় আমার ঘাড়ে ফেলতে চাইছে! কিন্তু আমি সমর চৌধুরীকে খুব অল্পই চিনি, ওনার ব্যাপারে আমার কাছে খুব বেশি তথ্য নেই। উনি কার কার সঙ্গে মেলামেশা করতেন, কোথায় কোথায় ব্যবসা করতেন এসবের খবর আমার কাছে নেই!

রবি হাসলো,

তারমানে সমর চৌধুরী যে খুন হয়ে গেছেন এটা আপনি জানতেন? আপনি একটু আগেই বলছিলেন আপনি কলকাতার কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। তাহলে এই খবরটা কোথা থেকে পেলেন? আপনার এই ফোন নম্বরটা তো সমর চৌধুরীর বডি পাবার আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো দেখলাম। যেদিন এটা বন্ধ হয়েছে তার পরের দিনই দিল্লিতে আপনি নতুন সিম নিয়েছিলেন, তাহলে কলকাতা থেকে আপনাকে ফোন করে কে জানালো এটা? নতুন নম্বর কার কাছে ছিলো? পুলিশ কলকাতায় আসার আগেই ওনার ব্যাংক থেকে টাকা তোলা হয়ে গিয়েছিলো, বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো আপনার ফোনও তাহলে এসব খবর আপনি কিভাবে পেলেন?

শুভঙ্কর কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো,

এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, তবে কেউ দিয়েছিলো নিশ্চয়ই, নাহলে আমি দিল্লিতে বসে জানবো কি করে!

রবি হেসে ফেললো,

বেশ! মামার পার্টনারকে আপনি চিনতে না চাওয়ার একটা গ্রহণ যোগ্য কারণ খুঁজে পাওয়া গেলো তাহলে! তবে তিনি নিখোঁজ হবার পরে আপনি তাঁর বাড়িতে চাবি নিয়ে কেনো ঢুকেছিলেন বা তাঁর ব্যাংকে আপনি কি করছিলেন তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া গেলো না। আর আপনার ব্যবসার টাকার উৎসটাও বললেন না আপনি।

শুভঙ্কর চুপ করে থাকলো কিছুক্ষন, তার ভাবনার মধ্যেই নিচে কলিং বেলের আওয়াজ হলো, মিতার ইশারায় কাজের মেয়েটি দৌড়ে গেলো দরজা খুলতে। একটু পরেই হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে এসে সৌমিকদের বাড়ির দিকে ইশারা করে বললো,

ও বাড়ির ঋজু দাদার বউ এসেছে, বলছে তোমার সঙ্গে নাকি কি জরুরী দরকার আছে!

মিতা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে দরজার দিকে এগোনোর আগেই অপর্ণা ভেতরে ঢুকে এলো। তাকে ঢুকতে দেখে রবি হাসি মুখে বিস্ফারিত চোখে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকা শুভঙ্করকে অপর্ণার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল,

মামার পার্টনারকে যখন চিনতে চান নি, তখন এঁকে নিশ্চয়ই চিনবেন না কিছুতেই, তাই তো?

শুভঙ্কর কোনো কথা বললো না, মিতা আর ওর মায়ের অবাক দৃষ্টির সামনে অপর্ণা ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো, অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে বললো,

কেমন আছো?
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৫৩
অপর্ণার শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে করা প্রশ্নের উত্তরে শুভঙ্কর সোজা চোখে কঠিন মুখে তাকিয়ে থাকলো, তাকে চুপ করে থাকতে দেখে মিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

তুমি ওকে চেনো নাকি শুভ?

শুভঙ্কর উঠে দাঁড়ালো, মিতার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললো,

নাহ! চিনি না! তবে বাড়িতে ডেকে এনে প্ল্যান করে বন্ধুকে দিয়ে তুমি যেটা করলে সেটা ঠিক করলে না। আসি আমি, ভবিষ্যতে আর কখনো যোগাযোগ কোরো না!

মিতা অবাক হয়ে গেলো, শুভঙ্করের সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো,

বিশ্বাস করো, আমি কোনো প্ল্যান করিনি! তুমি সম্পূর্ন ভুল ভাবছো, এই ঘটনার পেছনে আমার কোনো হাত নেই!

মিতা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু শুভঙ্কর মিতাকে ঠেলে সরিয়ে টেবিলের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো। রবির পাশ দিয়ে যাবার সময় রবি তার হাত ধরে ফেললো, দুই কাঁধে চাপ দিয়ে সোফার দিকে দেখিয়ে বললো,

বসে পড়ুন শুভঙ্কর, আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে। বুঝতেই পারছেন এখান থেকে বেরোলেও হোটেলে ফেরা সম্ভব হবে না আপনার পক্ষে তাই বসে পড়ুন চুপ করে।

শুভঙ্কর হাত মুঠো করে সোফায় বসে পড়লো, উল্টো দিকের সোফায় বসে থাকা অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,

কে উনি? এখানে ওঁকে ডেকে এনে ঠিক কি প্রমাণ করতে চাইছেন?

রবি হেসে ফেললো,

যেখানে আপনি সমর চৌধুরীকেই চিনতে পারছিলেন না, সেখানে ওকে না চেনাই স্বাভাবিক। আমি বরং ওর পরিচয় আপনাকে দিয়ে দি একটু! আপনার মামা আর সমর চৌধুরী যেখানে যেখানে মাল সাপ্লাই করতেন তার মধ্যে রসুলপুর নামে একটা জায়গা ছিলো এটা জানেন তো?

শুভঙ্কর অপর্ণার দিকে তাকালো না, অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,

আমি আপনাকে আগেই বলেছি মামার ব্যবসার ব্যাপারে আমি ডিটেইলস কিছু জানতাম না। সমর চৌধুরীকে চিনতাম ঠিকই তবে সেও না চেনার মতোই! বার কয়েক কিছু কাগজ পত্র দিতে বা নিতে গিয়েছি শুধু! তাই ওনারা কোথায় কোথায় মাল সাপ্লাই করতেন সে সম্পর্কে আমার কোনো আইডিয়া নেই!

আচ্ছা! তাহলে আর একটু পরিষ্কার করে বলে দিই আপনাকে। আপনার কিছু কনফিউশন হয়েছে সেগুলো দুর হয়ে যাবে তাহলে! আপনি ভেবেছেন ওই ফটোটা আমাকে আপনার দিদি দিয়েছেন আপনাকে ফাঁসানোর জন্যে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। ওই ফটোটা আমি ট্রাভেল এজেন্সির কাছ থেকে পেয়েছি, এতে আপনার দিদির কোনো হাত নেই! এমনকি উনি জানেনও না যে সমর চৌধুরী কে বা তিনি খুন হয়ে গেছেন। এই খুনিকে খোঁজার কাজটা আমি ওর ইচ্ছেয় করছিলাম। ও আমার বন্ধুর স্ত্রী, এক সময় সমরকে ভালোবাসতো! তো ও আমাকে রিকোয়েস্ট করেছিলো সমরের খুনিকে খুঁজে দেবার জন্যে, এমনকি সমর ওকে ওর গ্রামের বাড়ির যে ঠিকানা দিয়েছিলো রেজিষ্ট্রি করার আগে সেটাও দিয়েছিলো আমাকে। সেই সূত্রেই খুঁজতে আসা, তাই সমর চৌধুরী সম্পর্কে আপনার কাছে যদি কোনো তথ্য থাকে তাহলে আমার সুবিধা হবে।

অপর্ণার দিকে ইশারা করে বললো রবি, শুভঙ্কর এক মুহূর্তের জন্যে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে নিয়ে মাথা নাড়লো, অস্ফুট গলায় বললো,

আমার কাছে সেরকম কিছু তথ্য নেই!

রবি অপর্ণার দিকে ঘুরে তাকালো,

সমর বাবু কটা সিম ব্যবহার করতেন?

অপর্ণা আঙুল তুললো

একটা! তোমাকে যে নম্বরটা দিয়েছিলাম, ওটাই!

আপনার কাছেও তো সমর বাবুর নম্বর ছিলো নিশ্চয়ই, উনি একটা সিম ব্যবহার করতেন তো?

রবির প্রশ্নে শুভঙ্কর ঘাড় কাত করলো,

হুঁ ছিলো, কিন্তু এখন আর নেই। ওটা ওই মোবাইলে ছিলো যে সিমটা আমি এখন আর ব্যবহার করিনা। সিম কটা ছিলো আমি জানিনা তবে আমার কাছে একটাই নম্বর ছিলো।

রবি হাসলো,

উনি দুটো সিম ব্যবহার করতেন শুভঙ্কর, যার একটা নম্বর আমার বন্ধুর স্ত্রীর কাছে থাকলেও অন্যটা ছিলো না। আপনি শুনলে অবাক হবেন ট্রাভেল এজেন্সি থেকে আমাকে যে নম্বরটা দিয়েছিল সেটার লোকেশন ওনার বাড়িতে থাকলেও বন্ধুর স্ত্রীর কাছে থাকা সিমের লোকেশন বেশির ভাগ সময়েই আপনার মামার বাড়িতেই ছিলো। ওই সিমটার লোকেশন কিন্তু রসুলপুর মানে যেখানে ওনার বডি পাওয়া গিয়েছিলো সেখানে নিয়মিত পাওয়া গেছে। তারমানে সমর বাবু যে ফোনটা নিয়ে রসুলপুরে যেতেন সেটা আপনাদের বাড়িতেই থাকতো? আরো অদ্ভুত বিষয় হলো দুটো ফোনের কল লিস্ট মিলিয়ে দেখেছি উনি একই সময়ে অনেক সময় রসূল পুর আর কলকাতা দু জায়গা থেকেই কথা বলেছেন। এটা তখনই হতে পারে যখন দুজন মানুষ দুটো ফোন ব্যবহার করছে। তার মানে ওনার আধার কার্ড ব্যবহার করে অন্য কেউ আরেকটা সিম তুলে ব্যবহার করেছিল, তাই না?

শুভঙ্কর এবারও অন্য দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো,

হতে পারে, তবে আমার মামার বাড়িতে থাকলেও আমি জানতাম না। হয়ত ব্যবসার জন্যে মামা এবং সমর বাবু দুজনেই ওটা ব্যবহার করতেন।

রবি সহমত হলো,

হ্যাঁ, এটা অবশ্য হতেই পারে। কিন্তু আপনার মামা মারা যাবার পরেও তো ব্যবসা কয়েক মাস চলে ছিলো, সমর বাবু তো ওখানের একজন ব্যবসায়ী রবীন বাবুর কাছ থেকে উকিলের নম্বর নিয়ে দেখা করেছিলেন পার্টনারের নাম চেঞ্জ করার জন্যে। ওই সিম থেকে উকিলের সঙ্গে কথা বলা হয়েছিলো সেটা কল লিস্ট মিলিয়ে দেখেছি আমি। তারমানে হিসেব মতো তখন থেকে তো ওনার কাছেই ছিলো ফোনটা, তাই না? তাহলে তার পরেও প্রায় সব সময়ই ওই ফোনের লোকেশন আপনার বাড়িতে ছিলো কেন? আপনি কি আবার ফোনটা ওনার কাছ থেকে ফেরত নিয়ে এসেছিলেন কথা বলার পরে? নাকি আপনিই কথা বলেছিলেন সমর চৌধুরী সেজে?

শুভঙ্করের গলা এবার অনেকটা নির্জীব শোনালো, আগের দাপট উধাও হয়ে গেলো অনেকটাই, গলা নামিয়ে বললো,

আমি কেনো ওনার হয়ে কথা বলতে যাবো?

বলার কথাও নয় আপনার! তবে ওনার ফোন টা তো মামা মারা যাবার পরে আর আপনাদের বাড়িতে থাকার কোনো কারণ ছিলো না, কারণ ব্যবসার ফোন যেখানে আসে সেটা যিনি ব্যবসাটা দেখছেন তাঁর কাছেই থাকা উচিত তাই না? তারমানে কি মামা মারা যাবার পরে আপনিই ব্যবসাটা দেখছিলেন? হটাৎ করে চালু ব্যবসা বুঝে নেওয়া খুব কঠিন, তাহলে কি অনেকদিন ধরেই দেখছিলেন ব্যবসা, সবটাই আপনার নখদর্পণে ছিলো? মামার ব্যবসাটা কি নিজের নামে করতে চাইছিলেন?

সেটা করলে তো সোজাসুজি করতে পারতাম, নিজেকে সমর চৌধুরী বলে পরিচয় দিয়ে করবো কেনো?

আবার নতুন করে রুখে উঠে বললো শুভঙ্কর, রবি হাসলো,

সেটা আপনার দিক দিয়ে বলছেন হয়তো, কিন্তু আমি হলে এটাকে অন্য ভাবে ভাববো। প্রথমত আপনার মামাতো দিদি তার বাবার ব্যবসা আপনার নামে ট্রান্সফার করতে চাইবে কিনা এটা একটা বড়ো প্রশ্ন, বরং নিজের প্রফিট বুঝে নিয়ে পার্টনারের হাতে সবটা তুলে দেওয়াই সে বুদ্ধিমানের কাজ বলে ভাববে। আর আপনি তাঁর বাবার ব্যবসা নিজের নামে করতে চান এটা কলকাতার কোনো উকিলের সঙ্গে কথা বললে পাড়ার লোকজন জানতে পারে, সেই সূত্রে উনিও খবর পেয়ে যেতে পারেন, তাই এই রিস্ক নেওয়াটা একটু মুশকিল। সেক্ষেত্রে সমর চৌধুরীর নাম ব্যবহার করে ফোন করাটাই অনেক বেশি সুবিধাজনক, মৃত পার্টনারের ব্যবসা পুরোটা নিজের নামে করতে চাওয়াটা তাঁর ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক।

কিন্তু তুই তো বলছিস উনি শুধু ফোন করেন নি, উকিলের সঙ্গে দেখাও করেছেন, তাহলে শুভ গেলে কি রবীন বাবু শুভকে চিনতে পারতেন না? উনি তো সমর চৌধুরীকে চেনেন?

মিতা এতক্ষনে বিধ্বস্ত গলায় প্রশ্ন করলো, রবি মিতার দিকে ঘুরে তাকালো,

ঠিক বলেছিস, এটাই স্বাভাবিক। ধর তুই আমাকে রবি বলে চিনিস, আমার তোর বাড়িতে যাতায়াত আছে, এবার অন্য কেউ রবি সেজে এলে কি তুই তাকে বিশ্বাস করবি? কখনো করবি না, সোজা পুলিশে ধরিয়ে দিবি। কিন্তু ধর তুই আসল রবিকে কখনো চোখে দেখিস নি, তোকে প্রথম থেকেই আমিই রবি বলেই পরিচয় দিয়েছি, তোর সঙ্গে অনেকদিন ধরে মেলামেশা করছি ওই নামেই, এবার যদি আমি তোর কাছে কোনো দরকারে আসি রবি হিসেবে তখন কি তুই আমাকে সন্দেহ করবি? কখনো করবি না, কারণ তুই তো জানিস আমিই রবি! এবার আসল রবি যদি কখনো তোর সামনে আসে তখন তুই উল্টে তার কাছেই রবি হবার প্রমাণ চাইবি, আমার কাছে নয়। এখানেও ব্যাপারটা ঠিক সেরকম।

মানে! শুভ নিজেকে রসুলপুরে সমর বলে পরিচয় দিয়েছিলো! কিন্তু কেনো? এতে ওর লাভ কি!

লাভ ক্ষতির হিসেব ধরলে তো শুধুই লাভ, কোনো ক্ষতি নেই! ধর বিভিন্ন অপকীর্তি গুলো, যেমন ক্যাশে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তোলা, বিভিন্ন মেয়েকে চাকরির নাম করে পাচার করে দেওয়া, এগুলোর সব দায় তো সমর চৌধুরীর ঘাড়েই বর্তায় তাই না? তারপরে সব কিছু হয়ে গেলে সমর চৌধুরীকে সরিয়ে দিলেই তো কেস ধামাচাপা পড়ে যাবে, দোষী যখন খুন হয়ে গেছে তখন আর দোষ থাকলো কোথায়? কি শুভঙ্কর বাবু ঠিক বললাম তো?

রবির প্রশ্নে শুভঙ্কর কোনো উত্তর দিলো না, তার চুপ করে থাকাই বোঝাচ্ছিল যে সে এটা স্বীকার করে নিচ্ছে। মিতার মা সোফায় বসে পড়লেন, রবির দিকে তাকিয়ে বললেন,

এই ছেলেটা এই রকম! কতো বার তো কথা বলেছে মিতা, কখনো একটুও বুঝতে দেয়নি ওকে! ওকে দেখলে বোঝাই যায়না, কি সুন্দর ভদ্র, সভ্য চেহারা!

রবি হাসলো,

পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে এটুকু বুঝেছি কাকিমা ক্রিমিনালদের আসলে কোন চেহারা হয়না, তারা একদম আমার তোমার মতই দেখতে। আইন তো প্রমাণের কথা বলে, সেখানে এসব ভদ্র, সভ্য দেখা বা এটা সে করতে পারে কিনা এই সব ইমোশনের কোনো দাম নেই। আমাদের সিগনেচার এক্সপার্ট, সমর চৌধুরীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বা ডিভোর্স পেপারে করা সই এর সঙ্গে রসুলপুরের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাওয়া সইয়ের কোনো মিল পায়নি। বরং রসুলপুরের সইয়ের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে সমর চৌধুরীর মৃত্যুর পরে তার অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন নামে যে বিয়ারার চেকগুলো তোলা হয়েছিলো তার সইয়ের সঙ্গে। সুতরাং রসূলপুরের সমর চৌধুরী আর এই সমর চৌধুরী যে এক ব্যক্তি নন, সেটা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হবার কথা নয়।

শুভঙ্কর শক্ত মুখে তাকালো, চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

তারমানে আমিই যে সেই সমর চৌধুরী এটা প্রমাণ হলো কি করে? পুলিশ বলে কি যা খুশি করা যায় নাকি? বলতেই পারতেন বন্ধুর প্রতি দুর্বলতা আছে আপনার, তাই অন্য কারোর সঙ্গে বিয়ে হতে দেখতে পারছেন না। সরেই যেতাম আমি, এটা তো অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, প্রেম তো আর করিনি।

মিতা অবাক হয়ে রবির মুখের দিকে তাকালো, রবি দাঁতে দাঁত চাপলো, নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললো,

বেশ! মেনে নিলাম সেই সমর চৌধুরী আপনি নন! কিন্তু সেক্ষেত্রে রসুলপুরের সমর চৌধুরীর সই আর আসল সমর চৌধুরীর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার সময়ে করা সইয়ের সঙ্গে আপনার সই এর মিল থাকে কি করে? ট্রাভেল এজেন্সিতে তো মামার হয়ে আপনিই সই করে টাকা দিয়ে এসেছিলেন, তাই না? আপনার মামাতো দিদির কাছ থেকে আপনার বেশ কয়েকটা সই পেয়েছি আমি, আমাদের হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্ট জানিয়েছেন সেই সইগুলো আর রসুলপুর এবং ব্যাংকের চেক তোলার সময় করা সইগুলো একই লোকের! ওহ! আরেকটা কথা বলা হয়নি আপনাকে, ব্যাংকে আপনার সিমের লোকেশন পাবার কথা যখন বলেছিলাম তখন এটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম শুধু ফোনের সিম নয় ওই দিনগুলোতে ব্যাংকের সিসিটিভি ফুটেজে আপনার উপস্থিতির প্রমাণও আছে।

তারমানে ওর সব কিছু মিথ্যে? ও আমাকে ফাঁদে ফেলতে চাইছিলো?

আতঙ্কিত গলায় বললো মিতা, রবি মুচকি হাসলো,

উঁহু! একদম না! ওর সব কিছু সত্যি! তোকে এক বর্ণ মিথ্যে বলেনি ও। ও সত্যি শুভঙ্কর, ওর সব কাজ শেষ হয়ে গেছে, তাই এখন আর অন্য নামে থাকার তো কোনো প্রয়োজন নেই! সমর চৌধুরী সেজে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশ অনেকটাই ক্যাশে তুলে নিয়েছে ও। কলকাতার অ্যাকাউন্ট ক্লিয়ার হতে দেরি হয়, টাকা হাতে পেতে সময় লাগে এসব বলে তো ও পেমেন্ট ক্যাশে নিয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই, সেগুলো একটাও সম্ভবত আসল সমর চৌধুরীর অ্যাকাউন্টে জমা পড়েনি। রবীন বাবু যতোই বলুন, ওঁরাও কালো টাকা সাদা করার লোভ সামলাতে পারেন নি তখন। তারপর সমর খুন হবার পরে তো ওর অ্যাকাউন্ট থেকেই চেকে তুলেছে পাঁচ লাখ মতো। সবই পঞ্চাশের নিচে, বিভিন্ন নামে, তাই কোথাও আই ডি দেখাতে হয়নি ওকে।

মিতা অবাক হলো,

আসল সমর তাহলে সত্যিই খুন হয়েছেন? উনি তো ওই আয়া মহিলার এক্স হাসব্যান্ড তাই না?

রবি ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ খুন তো হয়েছেন, যে বডিটা পাওয়া গেছে সেটা ওনারই! তবে মজার কথা কি জানিস, ওখানে কিন্তু কেউ ওনাকে কখনো দেখেনি, কারণ উনি কখনো রসুলপুরে যান নি! তাহলে ওঁকে সমর বলে প্রুভ করতে গেলে কি করতে হবে? এমন কিছু আইডেন্টিফাই করার মতো জিনিস সঙ্গে রাখতে হবে যেটা পরে নকল সমরকে সবাই ওখানে দেখেছে। তাই শুভঙ্কর নিজের ঘড়ি, জামা ওই বডির সঙ্গে ফেলে এসেছিলো, আর মুখ ক্ষত বিক্ষত করে দিয়ে বডিটা টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেছিলো যাতে ওঁকে সমর বা শুভ কোনো কিছু বলেই চেনার উপায় না থাকে। তাই তো শুভঙ্কর?

শুভঙ্কর কোনো কথা বললো না, রবি তার দিকে টেবিলে রাখা ছবিটা ঠেলে দিয়ে বললো,

এই ফটোতে যে ঘড়িটা আপনি পরে আছেন এটাই সমর বাবুর বডির সঙ্গে দিয়েছিলেন তো? শার্ট তো লোকে নিয়মিত চেঞ্জ করে কিন্তু মামার দাক্ষিণ্যতে চলে যে, তার পক্ষে বোধহয় ঘড়ি অনেকগুলো কেনা সম্ভব হয়না। তাই এই একটাই ঘড়ি ছিলো দেবার মতো, তাই তো? তবে এখানেও একটা ভুল হয়ে গেছে আপনার। সমর চৌধুরীকে টুকরো করে কাটার পেছনে আরেকটা কারণ ছিলো, তিনি তো খুব সাধারণ চেহারার এবং সাধারণ হাইটের মানুষ, আপনার মতো নায়ক সুলভ চেহারা ওনার ছিলো না, তাই হাইট এবং চেহারাটা যাতে বোঝা না যায় সেজন্যেইএই কাজ, কিন্তু সঙ্গে পরনের শার্ট টাতো আপনারই দিতে হতো, নাহলে রসুলপুরের লোকজন কি করে তাকে সমর বলে আইডেন্টিফাই করবে? এমন একটা শার্ট চাই যেটা পরে রসুলপুরে আপনাকে সবাই দেখেছে, স্বাভাবিক ভাবেই আপনি শার্টটা দিয়ে দিলেন বডির সঙ্গে, লোকে ভাববে ওটাই আপনি। কিন্তু খেয়াল করেন নি, শার্টটা ডবল এক্সেলের ট্যাগ লাগানো, সমর চৌধুরী কিন্তু এক্সেল ব্যবহার করতেন। বডি পুড়িয়ে দিলেও কেস ক্লোজ হয়নি বলে রসূলপুরের থানায় এখনও প্লাস্টিকের প্যাকেটে জিনিসপত্র গুলো রাখা আছে বলে ওঁরা আমাকে থানা থেকে জানিয়েছেন।

অপর্ণা এতক্ষন চুপ করে ছিলো, এবার রবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

দীপা দির হাসব্যান্ড তাহলে কি করে খুন হলেন রবি দা? উনি কি রসূলপুরে এসেছিলেন?

রবি মাথা নাড়লো,

একটা কথা কি বলতো, এভরিথিং এক্সেস ইস ব্যাড! ওনারও তো লোভ কম ছিলো না, শর্ট কার্ট এ বড়লোক হতে চেয়েছিলেন। ব্যবসায় টাকা ইনভেস্ট করেছিলেন কিন্তু কখনো নিজে কিছু করেন নি, সব কিছু কি আর পার্টনারের ভরসায় ছেড়ে দিলে চলে! পার্টনারও বয়স্ক, তাই তাঁর ব্যবসা মোটামুটি ভাগ্নেই দেখা শোনা করতো সেটা ওর মামাতো দিদির মুখেই শুনেছি। সব কিছু ছেড়ে বাড়িতে বসে টাকা হাতে পেতে চাইলে তো এরকমই হবে, তাই না? সমর বাবু প্রসাদ মিত্রর ভরসায় ছেড়েছিলেন আর প্রসাদ বাবু ভাগ্নের ওপরে। যে ভদ্রলোক বেড়াতে যেতে সাহস পাননি একা বলে ভাগ্নেকে সাথে নিয়েছিলেন, তিনি এই বয়সে যে নিজে রসুলপুরে যাবেন না সেটা বলাই বাহুল্য! তাহলে যাবে কে? হিসেব মতো সমর বাবু অথবা শুভঙ্কর! আর সমর বাবু যদি সবটা শুভঙ্করের ওপরেই ছেড়ে দিতে চান ব্যবসা বোঝেন না বলে, তবে তো সোনায় সোহাগা! তবে সমর বাবু যে একদম কিছুই জানতেন না তা তো নয়। কারণ প্রথম দিকে যে অ্যাকাউন্ট পেয়ী চেকগুলো ছিলো সেগুলো তো ওনার একাউন্টে জমা পড়েছিলো সেটা স্টেটমেন্টে বোঝাই গেছে। ওখান থেকেই মাঝে মাঝে প্রসাদ বাবুর অ্যাকাউন্টে গেছে ভাগের টাকা। সেক্ষেত্রে শুভঙ্কর যে ওনার নামে খাতায় সই করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চেকগুলো এনেছে সেটা তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। তবে তিনি অতো মাথা ঘামাননি কারণ টাকা তাঁর অ্যাকাউন্ট এই তো জমা পড়ছিলো আর তাঁকে কোথাও ছোটাছুটি করতে হচ্ছিলো না। এর মাঝে মাঝে হয়ত প্রথম দিকে দুয়েক বার পেমেন্ট শুভঙ্কর ক্যাশে নিলেও বাকিটা ব্যাংকেই যাচ্ছিলো। কিন্তু পরের দিকে শুভঙ্কর অনেকটা বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলো, মামা মারা যাবার পরে ব্যবসা নিজের নামে করে নিয়ে তারপর সমর কে সরিয়ে দিলেই তো কেল্লা ফতে! প্রায় হয়েই এসেছিলো প্ল্যান মাফিক কিন্তু এই সময় টাকা পয়সার হিসেবে কিছু গোলমাল হচ্ছে বুঝেই সমর চৌধুরী ব্যবসা বন্ধ করে চাকরিতে ফিরতে চাইলেন, তার জন্যে বন্ধু ত্রিদিব বাবুকে ফোনও করে ফেললেন। তখন আর সময় নেই বুঝেই শুভঙ্কর তড়িঘড়ি প্ল্যান বানিয়ে ফেললো, সমরকে রসুলপুরে যাবার নাম করে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাকে খুন করে বস্তায় ভরে নিজের ঘড়ি, জামা কাপড়, এরকম দু একটা জিনিস সঙ্গে দিয়ে রসূলপুরের জঙ্গলে রাতের অন্ধকারে ফেলে দিয়ে এলো। কলকাতা থেকে মেরে নিয়ে যায়নি অবশ্য, সম্ভবত সমরকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলানো বা ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো গোলযোগ মেটানোর নামে ওখানে ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়ার পথে কোথাও খুন করা হয়। নাহলে পুরো বডি ওখানে বয়ে নিয়ে যাওয়া মুশকিল। তারপরে বাড়িতে ফিরেই পরের দিন বিকেলে সমর চৌধুরীর বাড়ি থেকে সে বেশ কিছু জিনিষ নিয়ে এসেছিলো, কারণ বাড়িওলা ভদ্রলোক তাকে অন্ধকারে চিনতে না পারলেও লম্বা বলে আইডেন্টিফাই করেছিলেন। আমার ধারণা সমর হয়ত ব্ল্যাঙ্ক চেক বাড়িতে সই করে রাখতেন এরকম কিছু শুভঙ্করের জানা ছিলো, সেগুলোই সে আনতে গিয়েছিলো কারণ সমর চৌধুরী খুন হয়েছে জানা জানি হয়ে গেলে যদি তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে আর কিছু তুলতে না পারা যায় তাই এই ব্যবস্থা। আবার এটাও হতে পারে খুনের আগে তাঁকে জোর করে চেকে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছিলো।

শুভঙ্কর এতক্ষন চুপ করে শুনছিল, রবির কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রুপের গলায় বললো,

গল্পটা ভালো, তবে বাকি সব কিছু মেনে নিলেও আমি খুন করেছি এটা কি করে বলে দিলেন? কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে?

রবি ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ, ওই যে সেই আবার ফোনের লোকেশন! আপনি যে সিম টা নিজের নামে ব্যবহার করছিলেন সমর চৌধুরী যেদিন মারা যান ওই একটা দিনই ওই ফোনের লোকেশন সমর বাবুর দুটো ফোনের লোকেশন এর সঙ্গে একই সঙ্গে পাওয়া গেছে। সমর বাবুর দুটো সিম যার একটা উনি আর একটা আপনি ব্যবহার করতেন দুটোই রসুলপুরের থেকে কিছুটা দূরে সুইচড অফ হয়ে গেলেও এই সিম টা রসুলপুর ঘুরে আবার কলকাতায় ফিরেছে এবং আপনি দিল্লি যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত চালু ছিলো। আরও একটা কথা এই প্রথম বার ওই সিমটা রসুলপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো কারণ ফেরার সময় আপনার কাছে কোনো ফোন থাকতো না। সমর বাবুর নামে নেওয়া সিম তো সমর চৌধুরীর মৃত্যুর পরে ফেলে দিতেই হত, কারণ সমর বাবু খুন হয়ে গেলেই পুলিশ তাঁর ফোনের খোঁজ করতো, বা রসুলপুরে সবাই ওই নম্বরে ফোন করতো। বডি পাওয়ার পরে পার্টনারকে খুঁজতে গিয়ে পুলিশ আপনার মামাকে না পেয়ে কারোর কাছ থেকে আপনার নম্বর পাওয়ার আগেই টাকা পয়সা তুলে আপনি দিল্লি চলে গিয়ে ফোন এর সিম চেঞ্জ করে ফেললেন। সমর বাবুর কলকাতার ঠিকানা ব্যবসায়ীদের কাছে ছিলো, ওনারা কখনো তাঁকে না দেখলেও আপনি নিজের প্রয়োজনেই দিয়ে রেখেছিলেন। যাতে উনি মারা গেলে পুলিশকে রবীনবাবুরা ওনার ঠিকানা দিতে পারে। বাড়িওলা আপনার মামা কে চিনতেন সেটা আমাদের জানিয়েছেন, তাই পুলিশ তাঁর কাছে গেলে যদি তিনি মামার ঠিকানা দিয়ে দেন তাহলে পাড়ার কারো কাছ থেকে আপনার নম্বর পেলে আপনার কাছে খোঁজ খবর নেবার আগেই আপনি দিল্লিতে চলে গেলেন সিম পাল্টে। আর এইবার তো দুটো ফোন সঙ্গে থাকলেও রসূলপুরে আপনাকে ধরার কেউ ছিলেন না। আপনার সমর নামে ব্যবহার করা সিমের লোকেশন, নিজের নামের ফোনের লোকেশন আর সমর বাবুর ফোনের লোকেশন নিখোঁজ হবার দিন একসময়েই রসূলপুরের কাছাকাছি পাওয়া গেছে, পরে অবশ্য ওই সমর বাবুর নামের ফোন দুটো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই দুজনেই যে একসময়ে একই জায়গায় ছিলেন এটা প্রমাণ করতে খুব অসুবিধা হবে না। সম্ভবত সমরকে মেরে ফেলার পরে আপনি দুটো ফোনকেই সিম শুদ্ধ নষ্ট করে ফেলেছেন তাই না শুভঙ্কর বাবু? কারণ আপনার তো সমরকে শুধু মারলেই হতো না, নিজেই যে সমর এটা প্রমাণ করার দরকারও তো ছিলো। চেষ্টা কিন্তু খুব ভালো করেছিলেন আপনি, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আজকের যুগে দাঁড়িয়ে ফুল প্রুফ মার্ডার বলে কিছু হয়না। আরো একটা বড়ো ভুল করেছেন আপনি, রসুলপুরে কাউকে দুটো ফোন না দেখালেও কলকাতায় আপনাকে দুটো সিমই ব্যবহার করতে হতো, কারণ দু দিক থেকেই ব্যবসার ফোন আসতো, রসুলপুর থেকেও ফোন করতো নিশ্চয়ই। সেই জন্যেই প্রায় সময়েই দুটো সিম আপনার বাড়িতেই এক্টিভ দেখিয়েছে।

শুভঙ্কর আর কোনো কথা বললো না, সম্পূর্ন বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে রইলো, রবি অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,

ক্রেডিট কিন্তু অনেকটাই তোমারই, তুমি এরকম মরিয়া হয়ে না উঠলে হয়ত এতো বড়ো বিষয়টা চাপাই পড়ে যেতো! তবে তুমি নিজে কিন্তু জোর বেঁচে গেছো! তোমাকে আমার সাক্ষী হিসেবে প্রয়োজন হবে!

শুভঙ্কর হটাৎ করেই মাথা তুললো, অপর্ণার দিকে ভেজা লাল চোখে তাকিয়ে বললো,

তুমি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে অপর্ণা! আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি! অন্য যাই কিছু করিনা কেনো তোমাকে আমি সত্যি ভালোবেসেছিলাম। তাই কখনই তোমার কোনো ক্ষতি হয়ে যাক সেটা চাইনি! এমনকি তুমি যাতে জড়িয়ে না যাও এসব ব্যাপারে, তাই আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে চিনতে চাইনি!

রবি হা হা করে হেসে উঠলো,

যাক! চিনলেন তাহলে! অপর্ণা নামটাও তো মনে আছে দেখছি! আমি তো নাম একবারের জন্যেও উচ্চারণ করিনি, আপনি নিজেই বললেন!

নামটা মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাওয়ায় শুভঙ্কর থতমত খেলো, অপর্ণা শুভঙ্করের দিকে সোজা চোখে তাকালো,

এক মিনিট! আমি তাকেই আমাকে তুমি বলার অনুমতি দিই যার সঙ্গে আমার সেই রকম সম্পর্ক আছে! আপনাকে আমি চিনি না, তাই আপনাকে আমিও তুমি বলবো না আর আপনিও আমাকে আপনি বলেই সম্বোধন করবেন! দুটো কথা, প্রথমত আমি ভালোবেসেছিলাম ঠিকই তবে সেটা শুভঙ্কর নামের কাউকে নয় সমর চৌধুরীকে, আর তার খুনিকেই খুঁজতে চেয়েছি। আমি সেই লোকটাকে ভালোবেসেছিলাম যার কেউ ছিলো না, সারাদিনের পথ পেরিয়ে যে লোকটা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে আসতো। তার নিজের কেউ ছিলো না বলে অর্ধেক দিন না খেয়ে আসতো, বাবার টিফিন বক্স ভরার সময় মাকে লুকিয়ে আরেকটা টিফিন বক্স ভর্তি খাবার লুকিয়ে নিয়ে যেতাম। হয়ত আপনার চেহারার সঙ্গে ওনার চেহারার মিল ছিলো, কিন্তু ওইটুকুই! সেই লোকটা কাউকে খুন করেনি! আর আপনি একজন প্রতারক এবং খুনি! আর দ্বিতীয়ত যদি তাড়াহুড়ো করে সমর চৌধুরীকে খুন করতে না হতো, তাহলে ঠিক কি হতো আমার সঙ্গে? অন্যের নামে ঠিকানা দিয়েছিলেন মানে তো রেজিষ্ট্রি করতেন না নিশ্চয়ই? তাহলে কি করতেন? অন্য মেয়েদের মতো কোথাও পাচার করে দিতেন তাই তো? তাই এটা বলবেন না যে আপনি আমার ক্ষতি করতে চান নি, বরং এটা বলুন আপনি আমার ক্ষতি করার সুযোগ পান নি! তবে একটা কথা আমি সমরের খুনি কে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম সেই শাস্তি অবশ্যই আপনি পাবেন, কারণ আপনি তাঁকে খুন করেছেন। হতে পারে তিনি আমার চেনা সমর নন, কিন্তু তিনিও কারোর বাবা, কারোর স্বামী অবশ্যই।
ক্রমশ