ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-৫৪ এবং শেষ পর্ব

0
441

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৫৪
শুভঙ্কর চুপ করে থাকলো, অপর্ণার কথার পরে আর কোনো কথা বললো না। রবি এবার উঠে দাঁড়ালো,

চলুন শুভঙ্কর যাওয়া যাক! বাকি কথা থানায় গিয়ে হবে।

রবি বেরিয়ে যাওয়ার আগেই অপর্ণা উঠে দাঁড়ালো সোফা থেকে, শুভঙ্করের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

আর একটা কথা, আমি যে সমরকে চিনতাম সেই সমর পাপ পুণ্যে বিশ্বাস রাখতো খুব, সব সময় বলতো এ জীবনের পাপের শাস্তি পেতে পরজন্মে ফিরে আসতে হয়। সেই সমর যে কাউকে খুন করার মতো পাপ করতে পারে সেটা আমি এখনো বিশ্বাস করিনা, বরং আমি এটা বিশ্বাস করি যে পাপী লোকটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে কখনই সমর নয়! এক্ষেত্রে ভেবে দেখতে গেলে বরং আমার হাজবেন্ডের কথাই সত্যি, এই জন্মের পাপের সাজা এই জন্মেই ভোগ করে যেতে হয়, আসলে সত্যিই পরজন্ম বলে কিছু হয়না!

শুভঙ্কর মাথা নামালো, রবি মিতার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললো,

আসি রে! তুই যে এরকম বোকার মতো কোনো কাজ করতে পারিস এটা এখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না! আমার ওপরে কি তোর একটুও বিশ্বাস ছিলো না? আমি তো দেখছিলাম প্রোফাইল গুলো, কোনো কিছু ফাইনাল করার আগে একবারও বলবি না আমাকে?

মিতা এগিয়ে এলো, রবির হাত ধরে বললো,

সত্যি রাগের মাথায় ভুল করে ফেলেছি রে, তোর সঙ্গে একবার কথা বলা উচিত ছিলো। মাও বলেছিলো আমাকে সেটা, আমিই গুরুত্ব দিইনি!

রবি হাসলো,

ছাড়! আমি অতো কিছু মনে রাখিনা! তবে ক্রেডিট কিন্তু অপর্ণার, ও যদি তোদের কে ঢুকতে না দেখতো, তাহলে আজ শুভঙ্কর ধরা পড়তো না। তবে জোর বেঁচে গেছিস, বাড়িটা বিক্রি করে দিলে তোর হাতে এক পয়সাও আসতো কি না কে জানে! দলিল পত্র দিয়ে ফেলিস নি তো কিছু?

মিতা ঘাড় নাড়লো,

নাহ! এখনও কিছু দিইনি! তবে আরেকটা সমস্যা আছে রবি, আমি রীতা পিসির সংসার চলছিলো না ভেবে ওর ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে ব্যাংকে রেখে সুদের টাকায় সংসার চালানোর পরামর্শ দিয়েছিলাম। সেই জন্যে শুভ কে দিয়েছিলাম ওই ফ্ল্যাটের দলিল টা, ওটা ওর কাছেই ছিলো!

রবি অবাক হলো,

রীতা পিসির ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিচ্ছিস! কেনো? তুই তো চাকরির চেষ্টা করছিলি ওনার জন্যে?

মিতা হতাশ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লো,

কিছু পাইনি রে! চাকরি পেতে গেলে কিছু মিনিমাম কোয়ালিফিকেশন তো লাগে! পিসির কিছুই নেই, আবার সে আয়ার কাজও করবে না, তার নাকি সম্মানে লাগে! তাহলে আর কি অপশন থাকে বল?

ঠিক আছে, শুনে রাখলাম! খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে পরে, এখনও সেটা আছে কিনা কে জানে! আগে কোর্টে কেস উঠুক, তারপর ওসব প্রসঙ্গ আসবে, কারণ এই মুহূর্তে ওর কাছে থাকা কোনো জিনিসই আমি নিয়ে নিতে পারবো না! সবটাই এই মুহূর্তে আইনের আওতায়! বরং যদি আমার ক্ষমতা থাকতো আমি টাকাগুলো দীপা দিকে দেওয়ার চেষ্টা করতাম তাড়াতাড়ি, কিন্তু সেটাও এই মুহূর্তে সম্ভব নয়!

রবি শুভঙ্কর কে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে অপর্ণা উঠে দাঁড়ালো, অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে। যে সমরকে ও চিনতো এ তো সে নয়, এ সম্পূর্ন অন্য মানুষ যে নিমেষে অপর্ণাকে চিনতে অস্বীকার করলো। অপর্ণা বেরিয়ে আসছিলো পেছন থেকে মিতা ওকে নাম ধরে ডাকলো, অপর্ণা থমকে গিয়ে ঘুরে তাকালো। মিতা ওর সামনে এগিয়ে এসে বললো,

থ্যাংক ইউ অপর্ণা, তুমি সেকেন্ড বার আমার অনেক বড়ো উপকার করলে।

অপর্ণা হাসলো,

আমি তোমার কাছ থেকে ধন্যবাদ পাওয়ার জন্যে কাজটা করিনি মিতা দি, সে তুমি না দিলেও আমি ওটা করতাম। সত্যি কথা বলতে কি যদি কে আমার সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করেছে বা করছে এগুলো আমি মনে রাখতে চাইতাম তাহলে হয়তো অনেকের সাথেই আমার সম্পর্ক থাকতো না। আমি পুরনো কথা মনে রাখি না, আমি মনে করি অনেক কিছু আছে সেগুলো ভুলে গেলে আমাদের জীবনে এগিয়ে যেতে সুবিধা হয়। এই যে আজকের ঘটনাই ধরো, তুমি চাও না তাও আমি তোমাকে সাহায্য করতে যেচে এলাম। অন্য কেউ হলে হয়ত ইগো নিয়ে বসে থাকতো, কিন্তু আমার অতো ইগো নেই। আমি সব সময় মনে করি যদি আমার সাহায্য কারোর কাজে লাগে তাহলে আমারই ভালো লাগবে।

মিতা হাসলো,

তুমি ভালো মেয়ে কিন্তু ভুল জায়গায় বিয়ে হয়েছে তোমার, আমি জানি একদিন তুমি স্বীকার করবে সেটা। ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে তুমি এক ছাদের তলায় কিছুতেই থাকতে পারবে না, আমি এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।

অপর্ণাও সরাসরি তাকালো,

তোমাকে কয়েকটা কথা বলবো মিতা দি, কিছু মনে করো না। তুমি অত্যধিক আত্মবিশ্বাসী, এতটা আত্মবিশ্বাসও ভালো নয়। ঋজু তোমার কাছে আসবে এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থাকার ফল তুমি হাতেনাতে পেয়েছো। অনেক কিছু কথা আজ তোমাকে বলতে ইচ্ছে করছে নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারছি না। তোমার প্রতি আসলে আমার বিয়ের পর থেকেই আলাদা একটা সিম্পথি ছিলো সব সময়, সেই জন্যেই তোমার বিপদে আমি কখনো চুপ করে থাকতে পারিনা। তুমি জানোনা কিন্তু আমি প্রথম থেকেই জানি ঋজুর সঙ্গে তোমার ঠিক কি সম্পর্ক ছিলো, ঋজু নিজেই আমাকে বলেছিলো। আমার সব সময় মনে হতো ঋজু আর তোমার সম্পর্কটা শুধু মাত্র জেদাজেদির জন্যে ভেঙে গেছে, নাহলে হয়ত তোমরা খুব ভালো কাপল হতে পারতে।

মিতা স্তম্ভিত হয়ে গেলো, অবাক গলায় বললো,

তুমি সবটা জানতে! জেনেও চুপ করে ছিলে!

অপর্ণা ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ, জানতাম। আর সেই জন্যেই তোমাকে সম্মানও করতাম। আমার সব সময় একটা কথা মনে হয়েছে তুমি যাই করো না কেনো কখনই আমাদের সম্পর্ক ভাঙতে চাওনা, তাই সারাজীবন ঋজুকে বেস্ট ফ্রেন্ড বলে পরিচয় দিয়ে গেছো। অথচ ইচ্ছে করলেই তুমি যেকোনো সময় আমাকে সত্যিটা বলে দিতে পারতে! আমার শাশুড়ি বিরক্ত হয়েছেন, ঋজুও কখনো কখনো মায়ের কথা ভেবে তোমার সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করেছে কিন্তু আমি শুনিনি। আমার সব সময় মনে হয়েছে তোমার ক্ষোভ আছে, দুঃখ আছে এবং সেগুলো থাকাটাই স্বাভাবিক। ছোটো থেকে চলে আসা একটা সম্পর্ক যখন অনেকটা বিনা কারণেই অন্যের জন্যে ভেঙে যায় তখন তো ফ্রাস্ট্রেশন আসবেই। সব কিছুই সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ মাত্র! এমনকি ঋজু যখন বলেছিলো তুমি আমার ফ্যামিলিকে সব স্ট্যান্ডার্ড বলেছো, সমরকে খুঁজে বার করতে চাওয়ার চেষ্টার মধ্যে ঋজুর সত্যি খুঁজে বার করে মাকে জানানোর চেষ্টা ভেবেছো তখনও আমি কিছু মনে করিনি। আমার বরং খুব খারাপ লেগেছে জানো, সব সময় মনে হয়েছে তোমার খুব কাছের আর কেউ নেই বলেই হয়ত সৌমিকের ওপরের অধিকারবোধটা ছাড়তে পারছো না। তবে ভাগ্যের পরিহাস দেখো, যাকে ভালোবেসেছিলাম বলে তুমি আমাকে সাব স্ট্যান্ডার্ড বলেছিলে, আজকে তাকেই তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছিলে! তবে আমি তাতে তোমার স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবো না, কারণ আমি মানুষের স্ট্যান্ডার্ডে বিশ্বাস রাখিনা!

মিতা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো,

স্ট্যান্ডার্ডের কথা যদি বলো তাহলে তো আরো অনেক কথা তোমাকে বলতে হয়! এতো কথা ঋজু বলেছে তোমাকে আর আসল কথাটা কিন্তু বলেনি, তোমার শ্বশুর মশাই….

অপর্ণা হাত তুলে থামিয়ে দিলো,

জানি! ওটা সৌমিক আমাকে বলার আগে থেকেই জানি। এগুলো কোনো সুস্থ সম্পর্ক নয় মিতা দি, যে বারবার আলোচনা করার মধ্যে কোনো আনন্দ আছে। তবে এটা শুনেও আমি তোমার ওপরে রাগ করিনি, তুমি ওকে জানিয়েছ, বেশ করেছো। নোংরামি প্রকাশ্যে আসাই উচিত। বরং আমি বলবো তোমার বাবা, মা এগুলো জেনেও রীতাকে প্রশ্রয় দিয়ে অন্যায় করেছিলেন, তার শাস্তি আজ তুমি ভোগ করছো! রাগ, প্রতিহিংসা এমন জিনিস যেগুলো জমিয়ে রাখার মধ্যে কোনো ক্রেডিট নেই ওগুলো শুধুই ক্ষতি করে। ভেবে দেখো, একটা সময় তোমার বাবা মায়ের ওপরের রাগেই কিন্তু আমার শাশুড়ি তোমাকে মেনে নিতে চান নি। তার জন্যে কি ওনাকে ঠিক দোষ দেওয়া যায় এখন আর? কারণ আজ দেখো তুমিও রাগেই এটা করলে তো! আমরা সবাই সাধারণ মানুষ, নিজেদের রাগ, দুঃখ কন্ট্রোল করতে পারিনা বলেই হয়ত এরকম কাজগুলো করে ফেলি। আসলে কেউই আমরা ঠিক ভুল নই, সবাই পরিস্থিতির শিকার মাত্র। সুতরাং তোমার মত বুদ্ধিমতি মেয়ে যে এবার পুরনো ভুলে এগিয়ে যাবার কথা ভেবেছো, এটাই ঠিক কাজ, সেটাই তুমি করছো। আমিও খুব খুশি হয়েছি কিন্তু এবার তুমি ভালো থাকতে গিয়ে কোনো ঠকের পাল্লায় পড়ে যাও এটা আমি চাইনা। তাই নিজেই তোমাকে হেল্প করতে চলে এলাম। তবে একটা কথা বলবো, তুমি জানো কিনা জানিনা হয়তো ওই শুভঙ্করের কথাই সত্যি রবিদা সত্যিই তোমাকে পছন্দ করে, তুমি একবার ভেবে দেখতে পারো। আসি আমি, ভালো থেকো।

কলকাতা শহরে পাশের বাড়িতে কি হচ্ছে জানার উৎসাহও বোধহয় লোকজনের নেই, তাই এই ভর সন্ধ্যেবেলায় পুলিশের গাড়ি মিতাদের বাড়ির সামনে থেকে একজনকে তুলে নিয়ে গেলেও পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে খুব বেশি আলোড়ন দেখা গেলো না। যদিও অপর্ণার ক্ষেত্রে সেটা হলো না, অনিন্দিতা এবং রত্না ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা কিছুটা শুনেছিলো, সৌমিক তাদের রেখে ঢেকে জানিয়েছিল যে ওই ছেলেটি রসূল পুরে ব্যবসা করতো সমর সেজে তাই রবি অপর্ণাকে চিনিয়ে দেবার জন্যে যেতে বলেছে। ফলে অপর্ণা ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তারা দুজনে মিলে প্রবল কৌতূহলের সঙ্গে অপর্ণার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো, অপর্ণা র এসব আলোচনা করার একটুও ইচ্ছে ছিলো না। তার অবস্থা দেখে রীনা এগিয়ে এলেন,

অনেক রাত হয়েছে, রত্না তোমার বেরোনোর দেরি হয়ে যাচ্ছে, সকালে রজতের অফিস আছে তো? যাও এখন চলে যাও কাল সকালে এসে শুনবে সব।

অগত্যা রত্না প্রায় মাস তিনেক পরে রজতকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো, রীনার কড়া গলার আওয়াজ শোনার পরে অনিন্দিতা আর খুব বেশি কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস দেখালো না। নিচের প্রশ্ন থেকে ছুটি পেয়ে অপর্ণা নিজের ঘরে উঠে এলো, তার কোনো কিছুই ভালো লাগছিলো না।

যতো বার ওকে চিনতে অস্বীকার করার দৃশ্য টা মনে পড়ছে ততবারই ভেতরটা ঘেন্নায় ভরে উঠছে। এই ছেলেটাকে ও একসময় ভালোবেসে ছিলো, মায়ের অমতে গিয়েও লুকিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। ওর জেদ, ওর কষ্টকে প্রাধান্য দিতে চেয়ে বাবাও মাকে লুকিয়ে ওর রেজিষ্ট্রি করে দিতে চেয়েছিলো এই ছেলেটার সঙ্গে! সমরের মৃতদেহ দেখে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো শুধু এই ভেবে যে ও কি করে সারাজীবন কাটাবে এরপর! মায়ের আড়ালে বাবা কতো স্বান্তনা দিয়েছে ওকে, মনের জোর বাড়ানোর চেষ্টা করেছে সব সময়। যে বাবা ওর প্রাণের থেকেও প্রিয়, সেই বাবার এই ভয়ানক অসুস্থতার জন্যেও এই লোকটা দায়ী! আজ যদি বাবার কিছু হয়ে যেতো তাহলে কি থাকতো আর ওর জীবনে! ওর ধারণা ছিলো ছেলেটা ওকে খুব ভালোবাসত, আজ বুঝলো ও ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে ওর হাত থেকে। যদি আসল সমরকে খুন করতে না হতো তখন তাহলে ওর অবস্থাও অনেকটা ওই মেয়েগুলোর মতোই হতো হয়ত।

সন্ধ্যে থেকে ও সব কাজ করে গেছে অনেকটা যান্ত্রিক ভাবে, কারোর সঙ্গে কোনো কথা না বলেই। বাড়ি ফেরার পর থেকে সৌমিক এতক্ষন খুব বেশি কথা বলেনি ওর সঙ্গে, ওকে খানিকটা নিজের সঙ্গে থাকার সময় দিয়েছিলো হয়ত, কিন্তু একা থাকতেও ভালো লাগছিলো না অপর্ণার। শেষ পর্যন্ত ও নিজেই সৌমিক কে ডাকলো, অভিমানের গলায় বললো,

এখানে বসো, আমার একা একা ভালো লাগছে না! সমর যে কখনো এরকম করবে আমি বুঝিনি! তুমি তো আমার সঙ্গে গেলে না, আমাকে একাই ওই লোকটার মুখোমুখি হতে হলো! ফিরে এসেও কিছু জানতে চাইছো না একবারও!

সৌমিক অপর্ণার মুখোমুখি বিছানায় এসে বসলো, হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

এক মিনিট! ও সমর নয়, ও শুভঙ্কর! তুমি সমর কে ভালোবেসেছিলে, শুভঙ্কর কে নয়! তাই সবটা জানার পরে ওকে সমর বলে সম্বোধন করো না! আর আমি ইচ্ছে করেই যাইনি, কারণ অহেতুক মিতার মুখোমুখি হবার আমার কোনো ইচ্ছে নেই আর!

অপর্ণার গলা কাঁপছিলো,

কিন্তু আমার মিতা দির জন্যে সত্যি খুব খারাপ লাগছে! যদি ও ধরা না পড়তো তাহলে মিতা দির অবস্থাও আমার মতই হতো তাইনা?

সৌমিক শক্ত গলায় বললো,

রবি বলছিলো হতো না! ও তো এবার সব কিছু ঠিক মতোই দিয়েছে। তবে কলকাতার সঙ্গে ও যোগাযোগ রাখতে চায়না, তাই মিতাকে বেছে নিয়েছিলো, কারণ ও জানতো মিতা দিল্লিতেই থাকবে। যাতে এখানে আসা আর কোনোদিনও সম্ভব না হয় মিতার পক্ষে তাই জন্যেই তো বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছিলো যাওয়ার আগে। তবে বিয়ের পরে কি হতো বা বাড়ি বিক্রির টাকা হাতিয়ে নিয়ে ও মিতার সঙ্গে কিছু করতো কিনা এই মুহূর্তে সেটা বলা মুশকিল!

অপর্ণা একটু চিন্তিত গলায় বললো,

মিতা দি বলছিলো ও নাকি রীতা পিসির বাড়ি বিক্রির জন্যে ওই লোকটার কাছে দলিল দিয়েছে! কি হবে কে জানে!

দিয়েছে তো আমরা কি করবো? ওই মহিলা সম্বন্ধে আর একটাও আলোচনা আমাদের বাড়িতে যেনো না হয় আর! ওর নাম শুনলেই আমার বিরক্ত লাগছে! মা না থাকলে আজ আমি বাবাকেও বাড়ি থেকে বার করে দিতাম!

রাগের গলায় বললো সৌমিক, অপর্ণা সৌমিক বিরক্ত হয়েছে বুঝে কথা ঘোরালো,

আমি কিছুতেই একটা কথা বুঝতে পারছি না। এতো কিছু করার পরে ও কোন সাহসে অরিজিনাল নাম দিয়ে প্রোফাইল খুললো! এখানে যদি কোনো রকম চালাকি করে তাহলে তো ও ধরা পড়তই!

সৌমিক নিজেকে সামলে নিলো, ঘাড় নেড়ে বললো,

নাহ! আর কোনো চালাকি তো ও করতে চায় না। ওর তো কাজ হাসিল হয়ে গেছে। সমরের ঘাড় দিয়ে সবটা করে নিয়েছে ও, এবার নিজের নামে সব টাকা পয়সা ট্রান্সফার করে সুস্থ ভাবে নিজের নামেই বাকি জীবনটা কাটাতে চায়।

আচ্ছা, ওর কি বিন্দুমাত্র ভয় হয় না! রসূল পুরে তো ওকে সবাই সমর বলেই চেনে! ওরা যদি কখনো ওকে দেখে ফেলতো!

অবাক গলায় বললো অপর্ণা, সৌমিক হাসলো,

রসূল পুরের কটা লোক দিল্লি যায় বলোতো? এসব জায়গাতেই তো ক্রিমিনালরা ফাঁদ পাতে, যেখানে আজকের ফাইভ জি নেটওয়ার্ক এর সময়ে দাঁড়িয়ে একটা কল করতে গেলেও ঠিক মত লাইন পাওয়া যায় না। আর ও তো কোথাও নিজের ছবি টুকুও রাখেনি, স্মার্ট ফোনও ইউজ করতো না! সারাদিনে দুটো ট্রেন যাতায়াত করে, তাও কলকাতা সেদিন এলে, সেদিনই ফিরে যাওয়া মুশকিল! সেখানে কটা লোক বাস করে, আর তাদের মধ্যে দিল্লি ছেড়ে দাও, কজন কলকাতায় আসে?

অপর্ণা চুপ করেছিলো, সৌমিকের কথার মধ্যে যুক্তি আছে! সত্যি বলতে কি রবীন কাকু ছাড়া ও এতদিনেও তো রসুলপুর থেকে কখনো কাউকে আসতে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না!এক সময় সৌমিক উঠে পড়লো,

চলো খেয়ে আসি, নিচে সবার সঙ্গে কথা বললে তোমার ভালো লাগবে।

থাক! ওকে যেতে হবে না, আমি ওর খাবার নিয়ে এসেছি, তুমি গিয়ে খেয়ে এসো নিচের থেকে,

আচমকা পেছন থেকে শাশুড়ির গলার আওয়াজে অপর্ণা চমকে তাকালো, রীনা খাবার থালা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। অপর্ণা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে থালা টা নিয়ে বললো,

আপনি কেনো এলেন মা, আমি যেতাম তো।

সৌমিক খেতে চলে গেলো, রীনা খাটের এক পাশে বসে পড়লেন, অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন,

আমরা খুব বোকা তাই না! সবাই কে কিরকম অন্ধের মতো বিশ্বাস করে ফেলি! কি জানি কাউকে ভালোবাসলে কি বুদ্ধি, বিবেচনা সব হারিয়ে যায়! তার বলা সব কথাকেই কি ধ্রুব সত্য মনে হয়? কখনো কি মনে হয়না যে সে আমাকে সব সত্যি নাও বলতে পারে!

অপর্ণা জলভরা চোখে তাকালো,

হয়ত তাই! নাহলে অন্য সময় যে জিনিসগুলো যুক্তি দিয়ে ভাবি, এই সময় ভাবতে পারিনা কেনো! তবে জানেন তো মা, আমার না খুব বড়ো ক্ষতি হয়ে গেলো! আমি বোধহয় আর কাউকে কখনো বিশ্বাস করতে পারবো না!

রীনা মলিন মুখে তাকালেন,

বিশ্বাস গড়তে কতো সময় লাগে তাই না, ভাঙতে একটা সেকেন্ড! আজ দেখো আমিও কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা, সব কিছুর মধ্যেই শুধুই কারণ খুঁজি! অথচ এই আমিই তো কতো বোকা ছিলাম একদিন, মেয়ের মাথায় হাত রেখে যে কোনো বাবা মিথ্যে বলতে পারে একবারের জন্যেও মনে হয়নি! মানুষ অন্যায় করে, সেই অন্যায়ের শাস্তিও পায় হয়ত! কিন্তু যারা তাদের বিশ্বাস করে ঠকে, তাদের বিশ্বাস ভাঙার জন্যে কি আলাদা করে কোনো শাস্তি পায়? যদি বিশ্বাস ভাঙার আলাদা কোনো শাস্তি হতো, তাহলে খুব ভালো লাগতো।

রত্না রজত খেয়ে দেয়ে চলে গিয়েছিলো তাই আজ শুধু সৌমিক ঋষি আর ওদের বাবা খেতে বাকি ছিলো। অনিন্দিতা আর ধৈর্য্য রাখতে পারছিলো না, শাশুড়ি উপস্থিত নেই দেখে পরিবেশন করতে করতে সে সৌমিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

ওখানে কি হলো ঋজু? কিছুই তো জানতে পারলাম না!

সৌমিক মুখ নিচু করে খেতে খেতে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, বাবার দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে বললো,

কি আর হবে বৌদি! ঠক, যোচ্চরে দুনিয়াটা ভরে গেছে একদম। কাউকে তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না, যাকে বেশি বিশ্বাস করবে সেই দেখবে তোমাকে ঠকিয়ে দিচ্ছে। দীপা দির বর এমন বিশ্বাস করলো ওই ছেলেটাকে যে নিজের জীবন দিয়ে তার মূল্য চোকাতে হলো। আসলে আমরা তো কেউই নিজের জীবনে খুশি নই বুঝলে তো! সবারই প্রচুর অপূর্ন চাহিদা আছে।

ঋষি ঘাড় নাড়লো, মুখে আফসোসের আওয়াজ করে বললো,

আসলে আমরা আরো ভালো থাকতে চাই সব সময়, তাই দরকারে ভুল পথ বেছে নিতেও পিছপা হই না।

সৌমিক হাসলো,

কিন্তু দিনের শেষে কে সাফার করে? যে ভুল টা করেছে সেই তো? অন্য কেউ তো তার দায়ভার নেয় না, তাই না? তবে ভুল আর অন্যায়ের মধ্যে ফারাক আছে, ভুলের মাফ হয়, অন্যায়ের হয়না। আজ না হোক কাল কেস মিটলে দীপা দি হয়ত সব না হলেও অনেকটাই ফেরত পেয়ে যাবে, কিন্তু সমর তো খুন হলো, ওর তো আর জীবনে বড়লোক হওয়া হলো না!

ছেলের বলা কথাগুলো যে অনেকটা তাঁকেও উদ্দেশ্য করে সেটা বুঝে আশুতোষ মাথা নিচু করে নিলেন। অনিন্দিতার খাবার দেওয়া হয়ে গিয়েছিলো, ও সৌমিকের পাশের চেয়ার টেনে নিজের থালার সামনে বসতে বসতে বললো,

দীপা দি কি তাহলে চলে যাবে ঋজু? ওর তো বোধহয় আর এখানে থাকার দরকার পড়বে না! তাহলে তো নতুন কাউকে খুঁজতে হবে আমাদের?

সৌমিক ঘাড় কাত করলো,

আজই হবে না হয়তো তবে মাস দুয়েকের মধ্যেই কিছু তো হবে। অন্তত ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট টা তো নমিনি হিসেবে ওর কাছেই যাবে। তুমি লোক খুঁজতে শুরু করো বৌদি, মিনতি মাসি কে বলে দাও। তাছাড়া আমরা তো সামনের মাসে দিল্লি যাবো জলির বিয়েতে, বাবার কাছে মিনতি মাসি কে তো থাকতে হবে কয়েকদিন, ওকে সেটাও বলতে হবে।

ঋষি একটু অবাক হলো,

মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিস? বাবা মিনতি মাসীর ভরসায় থাকবে? আমাদের সঙ্গে যাবে না?

সৌমিক কোনো উত্তর দেবার আগেই সিঁড়ির ওপর থেকে রীনার গলা শোনা গেলো,

এতে আবার মায়ের অনুমতি নেবার কি আছে? ও তো ঠিকই বলেছে এই বয়সে অসুস্থ মানুষকে কেউ টানাটানি করে নাকি, ও মিনতি কে বলে দিলেই থেকে যাবে কয়েকদিন।

ঋষি আড়চোখে মাথা নিচু করে খেতে থাকা বাবার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললো,

তাহলে তো ঠিকই আছে। তবে ঋজু তোর কবে চলে যাওয়া? বিয়ের আগেই যেতে হবে নাকি ওখানে?

সৌমিক খেতে খেতে মাথা নাড়লো,

যাবো না ঠিক করলাম, মাও তো চাইছে না আমি যাই। তাই ভাবলাম একটু কষ্টই করি, মাও তো সারাজীবন আমাদের জন্যে কতো কষ্ট করেছে, আর আমি সামান্য কয়েক কিলোমিটার বেশি ট্রাভেল করবো, এই তো!

রীনা খুশির হাসি হাসলেন, আড়চোখে একবার আশুতোষের মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন,

তোমরা আছো বলেই তো বাড়িটা এখন আমার বাড়ি মনে হয়, নাহলে আর এই বাড়িটা কবে আর আমার বাড়ি ছিলো? আমি তো এখানে অতিথির মতোই থাকতাম। সেখানে তোমরাই যদি না থাকো তাহলে চলে কি করে!

ঋষি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বাবার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললো,

পুরনো কথা ছাড়ো না মা, যারা তোমাকে অতিথি ভাবতো তারাই তো এখন এখানে অতিথি, আজ আছে কাল নেই! তারা কবে কি বলেছিলো সেসব ভেবে আজকের দিনটা নষ্ট করো কেনো?

রীনা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

যাও, সবাই শুয়ে পড়, রাত অনেক হয়েছে।

সৌমিক ঘরে ঢুকে অপর্ণা কে দেখতে না পেয়ে ব্যালকনি তে উঁকি দিলো, অপর্ণা তখন ফোন হাতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ওকে দেখেই ঘুরে ঘরের দিকে আসতে আসতে বললো,

তুমি এখানে থাকবে বলেছো মাকে?

সৌমিক কৌতুহলী হলো,

তুমি কি করে জানলে? ওপর থেকে শুনলে নাকি?

অপর্ণা সামনে এসে দাঁড়ালো,

মায়ের এতো আনন্দ হয়েছে যে পা নিয়ে আর ওপরে আসতে না পেরে ফোন করে ফেলেছে।

সৌমিক হেসে ফেললো,

আর তোমার?

অপর্ণা লজ্জা পেলো,

হ্যাঁ, আমারও। কিন্তু তুমি যে সবাই কে বলে দিয়েছো ট্রান্সফারের কথা সেটা কি করে ম্যানেজ করবে?

সৌমিক অপর্ণাকে জড়িয়ে ধরলো, মাথার চুলে মুখ ডুবিয়ে বললো,

ম্যানেজ করব কেনো? তুমি আর আমি অনেক তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবো, তারপরে কিছুক্ষন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে প্রেম করবো।

অপর্ণা চোখ বন্ধ করলো, আদুরে গলায় বললো,

আজ পর্যন্ত হানিমুনে যাওয়া হলো না আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রেম!

সৌমিক ঘরের আলো হাত বাড়িয়ে নিভিয়ে অপর্ণার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে রাখতে বললো,

এবার সব যাবো, রাজীব দা বলেছেন আমি যতো খুশি ছুটি নিতে পারি। দিল্লি থেকে আর এখন বাড়ি ফিরবো না, তোমার যেখানে যেতে ইচ্ছে হয় যাবো।

অপর্ণা বলার চেষ্টা করলো,

আগে রসূলপুর, ওখানে স্বপন…

অন্ধকারেই সৌমিক হেসে ফেললো,

ওখানে স্বপণ অপেক্ষা করছে নাকি!

অপর্ণা আলতো করে ধাক্কা মারলো,

ধ্যাত! আমি তো ক্ষমা চাওয়ার কথা বলছিলাম! বেচারা রবি দার ধমকে খুব ভয় পেয়ে আছে!

সৌমিক গম্ভীর গলায় কৃত্রিম অভিমানের সুরে বলল,

সবার কথা মনে আছে তোমার, এমনকি স্বপনের কথাও, শুধু আমার কথা ভাবার সময় নেই!

অপর্ণা হেসে ফেললো, সৌমিকের গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

তুমি তো আমার টপ মোস্ট প্রায়োরিটি!

একই সময়ে আজও প্রায় দিনের মতোই আরেকজন তার ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো ওই ঘরের বন্ধ জানলার দিকে তাকিয়ে, সে মিতা। অপর্ণার বলা কথাগুলো নিজের মনেই ভাবছিলো মিতা, সত্যি কি সে পেরেছিলো নিজেকে সংযত রাখতে! অপর্ণা যতোই বলুক সে তো মনে মনেই জানে ঋজুর মায়ের ওপরে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সে কখনো কখনো ঋজু আর অপর্ণা কে আলাদা করতেও চেয়েছিলো। তবু মনের ঝাল মিটিয়ে নেওয়ার পরে তো সব ভুলে এগোতে চেয়েছিলো সে কিন্তু সেই সুযোগটুকুও ভগবান তাকে দিলেন না। তবুও হয়ত অপর্ণার কথাই ঠিক আরো বড়ো ক্ষতির হাত থেকে সে বেঁচে গেছে। সেটা কি শুধুই নিজের ভাগ্যে নাকি অনেকটাই রবির জন্যে! অপর্ণা কি বলে গেলো তখন, রবি ওকে পছন্দ করে! কিন্তু ও তো ওকে কখনো বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনি! কিন্তু এই মুহূর্তে তো সত্যিই ওর একজন প্রকৃত বন্ধু দরকার, সেটা রবি ছাড়া আর কেউ কখনো হতে পারে না। ভাবতে ভাবতেই হাতের সাইলেন্ট থাকা মোবাইলটা তে আলো জ্বলে উঠলো, মিতা উদগ্রীব হয়ে ফোনটা ধরলো,

কি রে মিটলো সব?

রবি হাসলো,

হ্যাঁ, আপাতত, বাকিটা ধীরে ধীরে হবে। তবে রীতা পিসিরটা গেলো বুঝলি তো, ওটা ও বেচে দিয়েছে ইতিমধ্যেই! ঘুমিয়ে পড়, কাল সকালে এসে বলছি সবটা। আর শোন, কাকিমাকে বলিস রান্না সব রেখে দিতে কাল দুপুরে গিয়ে খাব, যা সুন্দর গন্ধ আসছিলো না তখন!

পরের দিন খুব ভোরে বাড়ির সদর দরজার বেল বাজলো, তখনও কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। এতো সকালে মিনতি আসেনা, তাই একটু অবাক হয়েই অনিন্দিতা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে দরজা খুললো, সামনে রীতা দাঁড়িয়ে ছিলো। বাড়ির সবাই এতো ভোরে বেলের আওয়াজে অবাক হয়েই নিজের নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, অপর্ণা দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

এতো সকালে কে দিদিভাই?

অনিন্দিতা একটু অবাক গলায় উত্তর দিলো,

রীতা পিসি! মায়ের কাছে এসেছে বলছে!

রীনার কানেও অনিন্দিতার কথা গিয়েছিলো, তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, পেছন পেছন আশুতোষ। তাঁদের দেখেই রীতা সামনে এগিয়ে এলো,

বৌদি! আমাকে ক্ষমা করে দাও! তুমি আশ্রয় না দিলে আমাকে রাস্তায় ভিক্ষে করে খেতে হবে! আমার বাড়িটা ওই শয়তান ছেলেটা বিক্রি করার নামে নিয়ে নিয়েছে গো, মিতা ভোর বেলা ফোন করেছিলো, বলল রবি বলেছে ওটা নাকি আর আমার নামে নেই!

ঋষি সামনে এগিয়ে এলো, বিরক্ত গলায় বললো,

তুমি এখানে কেনো? বাড়ি গেছে তো আমরা কি করবো? এরকম আবার হয় নাকি! তুমি কোথাও সই করেছিলে নাকি?

রীতা ঘাড় নাড়লো,

সই করতে আমি জানিনা! ও কয়েকটা কাগজে আমার আঙ্গুলের ছাপ নিয়েছিলো, বলেছিলো ওটা নাকি পাওয়ার, ওতে বাড়ি বিক্রি করতে সুবিধা হয়!

তুমি পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়েছো! যাহ! তাহলে তো গেছেই মনে হচ্ছে!

আফসোসের গলায় বললো ঋষি, অনিন্দিতা সামনে এগিয়ে এলো, রীনার দিকে তাকিয়ে বললো,

মা! দীপা দি তো চলে যাবে এবার, আপনি বলছিলেন না ওর বদলে কোনো বয়স্ক কাউকে নিলে ভালো হতো? রীতা পিসি তো ওই কাজটা করতে পারে তাইনা?

রীনা শক্ত মুখে তাকালেন, সৌমিক এতক্ষন দোতলার ওপর থেকেই বিরক্ত মুখে সবটা শুনছিল, এবার বৌদির কথা তে মা পাছে রীতা কে থাকতে দেয় এই ভেবে দৌড়ে নামতে চেষ্টা করলো,

ওহ! বৌদি না! এক্ষুনি মা আবার রাজি না হয়ে যায়!

অপর্ণা তাকে থামিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি দোতলা থেকে নেমে এলো, অনিন্দিতা কে উদ্দেশ্য করে বললো,

দিদিভাই! রীতা পিসি ওসব কাজ করতে পারবে না, কালই মিতা দি বলছিলো রবি দাকে! তাই তো বাড়ি বিক্রি করতে চাইছিলো! আর রীতা পিসি ঠাকুমার বান্ধবীর মেয়ে তাকে দিয়ে এসব কাজ করানো উচিত নয় আমাদের! তুমি বরং কিছু আর্থিক সাহায্য করে দাও ওনাকে, আপাতত কিছুদিন চলে যাবে! ওনার তো চেয়ে চিন্তেই চলে এসেছে এতকাল, বাকি দিন গুলোও ওই ভাবেই চলে যাবে! মা তো অনেক বছর দিয়েছেন আর কতই বা দেবেন!

ঋষি বিরক্ত হলো,

নাহ! সাহায্য করতে হবে কেনো? এতদিন কিভাবে চলতো? তুমি ওকে সাহায্য করতে নাকি মা! সত্যি তোমাকে নিয়ে আর পারা যায়না! তোমাকে আমি বুঝতে পারিনা! বাবা তোমার সঙ্গে সারাজীবন দুর্ব্যবহার করেছে তাও তুমি তার সেবা করো, এই মহিলা এতো কিছু করেছে ঠাকুমার সঙ্গে মিলে একেও নাকি তুমি পয়সা দিতে!

রীনা সামনে এগিয়ে এলেন, রীতার দিকে তাকিয়ে বললেন,

দেখলে তো রীতা, আমি ক্ষমা করতে চাইলেও আমার ছেলে, মেয়েরা তোমাকে ক্ষমা করতে রাজি নয়! কি করি বলো? ওরা এখন বড়ো হয়েছে, ওদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তো আমার যাওয়ার উপায় নেই আর আমি সেটা চাইও না! তুমি আমার কাছে আশ্রয় চাইতে এসেছো আর ওরা পারলে তোমার সঙ্গে তোমার আশু দাকেও বাড়ি থেকে বার করে দেয়! নেহাৎ আমি ঠেকিয়ে রেখেছি তাই, নাহলে বোধহয় মায়ের সঙ্গে করা দুর্ব্যবহারের বদলা নিতে ওরা বাবাকেও তাড়িয়ে দিতে পারে! আমি তো ভেবেছিলাম আমি যতদিন আছি ততদিনই বোধহয় তোমার আশুদা এখানে থাকতে পারবে, তারপরে তোমার কাছেই উঠতে হবে, আমি না থাকলে তো ছেলেরা আর তাঁকে থাকতে দেবে না বোধহয়! কিন্তু তোমার তো নিজেরই মাথার ওপরে এখন ছাদ নেই শুনছি, তাহলে দাদাকে নিয়েই বা রাখবে কোথায় তুমি! তুমি ক্ষমা চেয়েছো, আমিও তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম, কিন্তু আশ্রয় দেওয়া বা না দেওয়া আমার ছেলে বউদের ওপরে নির্ভর করছে! অপর্ণা এটা ঠিকই বলেছে তুমি আমার শাশুড়ির বান্ধবীর মেয়ে তোমাকে তো আর যে সে কাজ দিতে পারিনা, তাই তোমাকে দেবার মতো কোনো কাজ তো এই মুহূর্তে আমাদের বাড়িতে নেই!

রীতা রীনার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আশুতোষের দিকে তাকালো, কিন্তু আশুতোষ আর দাঁড়ালেন না, মাথা নিচু করে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। স্ত্রী আগে মারা গেলে ছেলেরা তাঁকে বাড়ি থেকে বার করে দিতে পারে এটা শোনার পর তাঁর নিজেকে এই বাড়িতে বড়ই অপাংক্তেয় লাগছিলো। সারা জীবন শুধু নিজের সুখ খোঁজা আশুতোষ আজও নিজের সুখ খোঁজার জন্যে এই প্রথম বার স্ত্রীর আগে পৃথিবী ছাড়ার প্রার্থনা করতে লাগলেন।

দরজা বন্ধ করে দিতে বলে রীনা ঘরে চলে যাওয়ার পরে রীতা আর দাঁড়ালো না, অপমানিত মুখে, বিধ্বস্ত অবস্থায় রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো। বাঁকের মুখেই তার সঙ্গে মিনতির দেখা হলো, সে হন্তদন্ত হয়ে এ বাড়ির দিকেই আসছিলো, রীতার কাছ থেকে সব শুনে সে প্রস্তাব দিলো,

একটা খাওয়া পরার কাজ আছে করবে?

এই মুহূর্তে এর থেকে আর কোনো ভালো প্রস্তাব রীতার কাছে ছিলো না, সে অগত্যা ঘাড় কাত করলো, থমথমে মুখে বললো,

করবো।
সমাপ্ত