#ঘিয়ে_ভাজা_পরোটা
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
Feminine Wisdom
অ্যালার্মটা বাজতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো রুহি। কতক্ষণ ধরে বাজছে বুঝতে পারছে না! চোখ খুলতেও পারছে না যেন! কী সাংঘাতিক যে ক্লান্ত লাগছে! ঘুমের ঘোরেই ফোনটা টেনে দেখলো পাঁচটা দশ! তার মানে দশ মিনিট হলো অ্যালার্মটা ডাকছে রুহিকে! ইশ দেরি হয়ে গেল! তুতানের বাস আসে ঠিক সাড়ে ছটায়! তার মধ্যে তুতানকে রেডি করে ড্রেস পরিয়ে টিফিন গুছিয়ে কিছুতেই যেন সময়ের সাথে পেরে ওঠে না! রোজই বাস এসে হর্ন দেয়! আর তুতান জুতো মোজা হাতে নিয়ে দৌড়!
পাশ ফিরে উঠতে গিয়ে দেখলো তুতান প্রায় পুরো খাট দখল করে নিয়েছে! লম্বাও হয়েছে ছেলেটা! সবে ছয় কিন্তু কেউ বলবে! দশ বারো বললেও কম বলা হবে! ছেলেটাকে সোজা করে বালিশে শুয়ে দিলো রুহি! ঘুমোক আরও কিছুক্ষণ! টিফিনটা করে ডাকবে!
টিফিনের কথা মনে পড়তেই জ্বর আসছে রুহির! “বৌদি কাল একটু ঘিয়ে ভাজা পরোটা খাইয়ো তো!” – অমর মানে ছোট দেওরের আবদার কাল রাতে! আবদার কী আর এমনি বোন ঘুরতে এসেছে যে! বছর খানেক হলো বিয়ে হয়েছে রিনির! দুদিন হলো বাপের বাড়িতে এসেছে! সন্তানসম্ভবা! সদ্যই ধরা পড়েছে আর সেই জন্যই সব গুছিয়ে মায়ের বাড়ি!
মা আর ছোড়দার আদরে বোন তো প্রায় ফুলের গায়ে মূর্ছা যায়! বড়দা তাও কী ভাগ্যিস বাড়ি নেই! বাড়ি থাকলে তার আপ্যায়নটা দেখতো রুহি! বোন আর বৌ – কে বেশি ওকে ভাবায় সেটাই দেখতো!
রুহি অনেক কষ্টে খাট থেকে নামলো! পেটটা যেন কেমন করে উঠলো রুহির! খুব ভার লাগছে! সাথে গা টাও গোলাচ্ছে! মাথাটা ভার! ইচ্ছে করছে না উঠে রান্নাঘরে যায়! কিন্তু উপায় নেই আজ যে ছেলেটার অঙ্ক পরীক্ষা!
নেমে ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসতেই রুহি দেখলো প্রতিভা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে এসে মালা গাঁথতে বসেছে! খুব সুন্দর সুন্দর মালা গাঁথে প্রতিভা! সুন্দর করে ঠাকুর সাজায় পুজো দেয়! কিন্তু সেইসব কিচ্ছু যেন আজকাল ভালো লাগে না রুহির! রুহি বাইরে বেরোতেই প্রতিভা বললো “আজ স্কুল যাবে না তুতান?” রুহির এইটুকু উত্তর দিতেও ভালো লাগছে না! মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো শুধু!
রান্নাঘরে ঢুকে আগে সব জল দিয়ে মুছে নিলো রুহি! ‘এটাই নিয়ম প্রতিভার! বাসি ঘর, গ্যাস না মুছে জ্বালানো যাবে না! বাসি জামাটাও বদলে আসতে হবে! কিন্তু সত্যি সকাল সকাল এত কিছু পারে না রুহি! এখন জামা বদলানো কম ঝক্কির কাজ! তাই রাতেই একটা পরিষ্কার জামা পরে শোয় রুহি! শুধু শাশুড়ির চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য এই আয়োজন!
“শোনো, অমর বলে শুয়েছে, আজ নাকি সাইটে যাবে! সাতটার মধ্যে বেরোবে! ওকে একটু সেদ্ধ ভাত করে দিও! আর পরোটা আলু চচ্চড়ি নিয়ে যাবে টিফিনে! তুমি তুতানেরটা করে ওরটা বসিয়ে দিও! আমি না হয় তুতানকে বাসে তুলে দেবো!” – সাদা টগরের লম্বা মালার মাঝে কী সুন্দর চন্দ্রমল্লিকা দিয়ে লকেট বানিয়েছে প্রতিভা! যেমন হাতের জাদু তেমনি মুখের!
রুহি ওঁনার ছেলের খাবার রেডি করে দেবে বলে উনি রুহির ছেলেকে বাসে তুলে দেবেন! তাও বাস আসে দরজার ঠিক সামনে! রাস্তার ওপর বাড়ি হওয়ায় এটা একটা সুবিধা! বাস ধরতে কোথাও যেতে হয় না!
অন্যদিন হলে এই কাজটুকুও করতে দিত না রুহি, কিন্তু আজ শরীর মুখ কিছুই চলছে না ওর! তাই যেটুকু করে দেবে সেটাও বোধহয় অনেক! বাসি ঘরকে আবার সতেজ করতে যা যা করতে হয় প্রায় সব সারা! এখন শুধু টিফিন বানাবে! ঘড়িতে ছটা পয়ত্রিশ! ময়দা কাল রাতে ভালো করে ঘিয়ে ময়ান দিয়ে মেখেই রেখেছিল রুহি! রাতের খাওয়ার পর যখন সবাই ঘুমোতে চলে গেছে এই অতিরিক্ত কাজগুলো করে রেখেছিল !
ময়দা মাখা, আলু কাটা সব সেরে রুহি ঘরে গেছে প্রায় সাড়ে এগারোটা! তুতান অবশ্য অমরের কাছে অঙ্ক প্র্যাকটিস করে ঘুমিয়ে পড়েছিল! এটুকুর জন্যই যেন কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে যায় রুহির! ছেলের জন্য দুটো পরোটা ভেজে সস দিয়ে টিফিনবক্সের ঢাকনা আটকে দিলো! আলু চচ্চড়ি ততক্ষণে হয়ে গেছে! গরম জল ফ্লাক্স থেকে ঢেলে ঘরে যেতে যাবে দরজার সামনে প্রতিভা! হাতে এক কৌটো চাল!
“নাও ভাতটা বসিয়ে ঘরে যাও! কাজ বুঝে বুঝে করলে কাজ করা কোনো ব্যাপার! তুতানকে রেডি করতে করতে ভাত হতে থাকবে!” বলেই চালটা দিলো রুহির হাতে! চাল দিয়ে কাজ এগোনোটা প্রতিভার উদ্দেশ্যে নয়! চাল মশলা এগুলো উনি নিজের হাতেই রাখেন! এক হাতে হিসেব রাখবেন বলে! আপত্তি নেই রুহির! মাঝ জীবনে এসে বুঝেছে যত দায়িত্ব কম পাওয়া যায় ততই মঙ্গল!
“চাল এত কম!” – রুহি জিজ্ঞেস করতেই প্রতিভা বললো, “ছেলেটা খেয়ে যাক, আমাদের ভাত পরে হবে! মেয়েটার এই সময় ঠান্ডা ভাত খেতে ভালো লাগবে! এমনি তেই এই সময় অরুচি!”
মনে পড়লো রুহির- কাল রাতে রিনি কালিয়া দিয়ে ভাত খাচ্ছিল! দু-পিস মাছ খেলো! না, নজর দিচ্ছে না রুহি! অরুচি বললো বলে মনে পড়লো! অরুচি যদি বলা হয় তাহলে তো সেটা রুহির! দিনের মধ্যে যে কতবার বমি করছে! সারাক্ষণ গা গোলাচ্ছে! পেটটাও যেন এবার অতিরিক্ত বড়ো! তুতানের সময় এত ভোগায়নি!
আসলে এত অবহেলা বোধহয় পেটেরটা বুঝতে পারছে! তাই রাগে অভিমানে এত জ্বালাচ্ছে মাকে! “কাল খেজুর ভেজাওনি রিনির?” – জিজ্ঞেস করলো প্রতিভা! মনে পড়লো রুহির, সত্যি ভুলে গেছে ও! রিনি আসার পর ওই নিয়ম করে খেজুর ভেজাচ্ছে! রিনি অবশ্য বলেছে, “বৌদি তুমিও খেয়ো!”
রিনি মাথা নাড়িয়ে না বলতেই প্রতিভা বাঁকা স্বরে বললো, “এত মনে করিয়ে কাজ করানো সম্ভব?” রুহি আর থাকতে না পেরে বললো, “এই দায়িত্বটা রিনিকেই দিন! ও নিজের জন্য এটুকু করতে পারবে!”
রুহি বলতেই প্রতিভা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “আসলে ভেজালে তো তুমিও দুটো খেতে পারো! এটার যত্ন নিতে পারছো কোথায়! তুতানের সময় কম করেছি!” ওই যে কথার জাদু! ঠিক শুনিয়ে দিলো রিনির বরের কিনে আনা খেজুর রিনি নিজের জন্য ভেজাবে! যদি কাজটা রুহি করে দেয় তাহলে ওর দাবি থাকে তাতে!
দরকার নেই রুহির এরকম যত্নের! কান্না পেয়ে যাচ্ছে! এই সময় মেয়েরা সত্যি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে যায়!মনে হয় সবাই বোধহয় মনটা বুঝে নেবে! দ্বিতীয়বার মা হতে চলেছে রুহি! সত্যি প্রথম আর দ্বিতীয়ের অনেক পার্থক্য! তুতানের সময় কী করেনি ওরা! প্রতিভা, অমর, সমর, রিনি! মাথায় তুলে রেখেছিল রুহিকে! আর এইবার! সমর মানে রুহির বর কী নির্দ্বিধায় অফিসের কাজ নিয়ে বাইরে চলে গেছে! দায়িত্ব বলতে টাকা পাঠানো আর দিনে চারবার ফোন!
দেওর ননদের কথা আর কী বলবে! বৌদির এই অবস্থায় ওদের ঘিয়ে ভাজা পরোটা লাগবে, মাছের কালিয়া, মুরগির রোস্ট! আসলে রিনিও যে প্রথম মা হতে চলেছে, এটুকু আবদার তো রাখা বৌদি হিসেবে রুহির কর্তব্য! ছেলেকে উঠিয়ে ব্রাশ করিয়ে ড্রেস পরানো হয়ে গেছে! রোবট মনে হয় নিজেকে রুহির!
পেটটা আজ খুব ভার লাগছে! নাড়াচাড়া ও বড্ড কম! মনে পড়লো অনেকক্ষণ কিছু খায়নি রুহি! কাল রাতে সেই যে সব উগলে দিলো, তারপর থেকে না খাওয়া।
চলবে।