#চন্দ্রকথা
সিমরান মিমি
সূচনা পর্ব
সময়টা ১৪১৯ খ্রিষ্টপূর্ব,বৃহস্পতিবার মধ্যাহ্নের শেষ প্রহর।
ইন্দ্রনগরের শেষ সীমানায় এসে দন্ডায়মান হয়েছেন তারা।সামনেই বিশালাকার,অনন্য সৌন্দর্যের এক পশলা স্বর্গানুভূতির স্থান পদ্মবিল।তিন প্বার্শে তার জলাভূমি,যাতে বসতি গেড়েছে হিংস্র সাপ,জোঁক,এবং জলপ্রাণী।পঁচে যাওয়া কচুরিপানায় জলাভূমি পরিণত হয়েছে নর্দমায়।যেখানে চরণ ফেলতেই যেন চামড়ায় হয়ে যাবে দগদগে ঘাঁ।চারপাশের এমনই নিকৃষ্ট পরিবেশের মধ্যেখানে সগৌরবে চিত্ত উঁচিয়ে অবস্থান নিয়ে এই অপূর্ব সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি পদ্মবিল।যার জল যেন অমৃতের মতন শুদ্ধ এবং স্বচ্ছ।বিলের মধ্যখানে ফুঁটে রয়েছে চিত্তস্পর্শকারী পদ্ম।যেগুলোর রঙ,আকার,বর্ন সবকূল মানব হৃদয়কে স্পর্শ করে মুহুর্তে’ই বিমোহিত করতে সক্ষম।নগরে থাকা কালীন দুরান্তের প্রজাদের মুখে মুখে এই অপূর্ব বিলের কথা শ্রবণ হয়েছে রাজকন্যার।নিজ রাজ্যের এই অপার সৌন্দর্য্য স্বচক্ষে দেখার জন্য হয়ে উঠেছিলেন উতলা।ফলস্বরুপ একটানা তিনরাত্রি দুই দিন গমণের পর পৌছেছেন এই কিনারায়।সহস্র গ্রাম এবং জঙ্গল পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে এই কূলে।রাজকন্যা বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন বিলের পদ্মগুলির দিকে।এমনই সময় পেছনের জঙ্গল থেকে স্বশব্দে শরীর ঝাপটাতে ঝাপটাতে রাজকন্যার কার্নিশে এসে শুয়ে পড়লো একটা শুভ্র রঙের বনবিড়াল।আর দু-তিনবার তার শরীরটা কেঁপে উঠলো এবং এরপর পরই নিস্তেজ হয়ে গেলো।তার পিঠের খানিকটা নিচে ঢুকে রয়েছে একখানা তীর।সেই তীর টাকে ছুঁয়ে শক্ত হাতে টান দিলো রাজকন্যা। অপার স্নেহ এবং যত্ন নিয়ে কোলে নিলো ছোট্ট বন বিড়াল টাকে।বার দুয়েক আলতো ধাক্কিয়ে আহত কন্ঠে ডাকলো।
“পিঞ্জর!পিঞ্জর!”
চোখ থেকে আপনা-আপনি গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা অশ্রু।সিপাহি’রা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একে -অপরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।একজন লাল রঙের কারুকার্য খচিত পোশাক পরিহিতা অল্পবয়সী যুবতী এগিয়ে এলেন।কন্ঠে কাতরতা নিয়ে বললেন,
“রাজকন্যা, কেউ পিঞ্জরকে তীর ছুঁড়েছে।ও মারা গেছে।”
হাতের রক্তমাখা তীর টার দিকে তাকালেন রাজকন্য।সুক্ষ, ধারালো ফলার তীরের আগা কালো বর্নের খচিত।সেটাকে শক্ত করে ধরে সিপাহি’র উদ্দেশ্যে কঠোর কন্ঠে বললো,
“সিপাহি,তীর কোন দিক থেকে ছোঁড়া হয়েছে?”
চারজন সিপাহি এবং তিনজন অল্পবয়সী যুবতি নিয়ে পদ্মবিল ভ্রমণে পাড়ি দিয়েছিলেন রাজকন্য।সাথে ছিলো তার প্রিয় শুভ্র ঘোড়া এবং পালিত বনবেড়াল পিঞ্জর।পদ্মবিল দর্শনের সময়েই মুক্ত পিঞ্জর জঙ্গল দেখে সেদিকে ছুটে গেছিলো।মুক্তভাবে পালন করা হতো বিধায় এ বিষয়ে কেউই রাজকন্যাকে জ্ঞাত করেনি।তবে কোন দিক থেকে কে এই তীর ছুঁড়েছে এটা বিলের সামনে থেকে সঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়।চারজনের মধ্যকার একজন সিপাহি আন্দাজ করে বললেন,
“রাজকন্যা,পিঞ্জর পশ্চিমের জঙ্গলের দিকে ছুটিয়াছিলো এবং সে-জায়গা হইতেই তীরবদ্ধ হইয়া ফিরিয়াছে।হয়তো পশ্চিমের জঙ্গলের ওইপাশেই থাকা কোনো শিকারী এই কাজ করিয়াছে।”
কথাটুকু শোনামাত্র’ই কিঞ্চিৎ সময় ব্যয় করলেন না রাজকন্যা।দ্রুত উঠে গেলেন ঘোড়ায়,টেনে দিলেন লাগাম।বাকি সিপাহিরাও তড়িঘড়ি করে যে যার ঘোড়ায় উঠে পড়লেন এবং দাসীরা সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছু মুহুর্ত পার হতেই তারা ঢুকে পড়লেন জঙ্গলে।শুকনো পাতাকে মুড়িয়ে ঘোঁড়া তার নিজস্ব গতিতে চলছে সামনের দিকে।রাজকন্যাকে সুরক্ষা দিয়ে সামনে এগিয়ে চলা ঘোড়ায় বসে থাকা সিপাহি বললেন,
-রাজকন্যা,আমরা নগরের সীমানার কাছাকাছি আসিয়া পড়িয়াছি।এই জঙ্গল পার হইলেই চন্দ্রনগর।চলুন,ফিরিয়া যাই।
মুহুর্তেই ঘোড়া থামিয়ে দিলেন রাজকন্যা।যুবক সিপাহি খুশি হলেন রাজকন্যা তার কথা মেনেছে ভেবে।কিন্তু তাদেরকে পুরোপুরি আশাহত করে আদেশ সূচক বাক্যে বললেন,
-ধনুক আর তীর দাও।
অবাক হয়ে রাজকন্যার দিকে ফিরে তাকালেন সিপাহিরা।তার সূচালো দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে সামনে তাকাতেই নজরে পড়লো জঙ্গলের শেষ সীমানার দৃশ্য।কয়েকটা ঘোড়াসমেত সিপাহি দেখা যাচ্ছে।রাজকন্য রক্তাক্ত তীর টা আরেকবার দেখে দুরের অপরিচিত যুবকের হাতের তীরকে মিলিয়ে নিলেন।পরক্ষণেই চোয়াল শক্ত করে ধনুকের সাথে তীরটাকে সাঁজালেন।সুচালো দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিয়ে ছুঁড়ে মারলেন।মুহুর্তে’ই ধাঁরালো ফলা গিয়ে ঢুকে পড়লো কৃষ্ণবর্ণের ঘোড়ার পিঠে।আর্তনাদ করে সামনের দু-পা উঁচু করে লাফিয়ে উঠলো ঘোড়া।তার পিঠে তীর হাতে বসে থাকা আগুন্তক তাল সামলাতে না পেরে লাফিয়ে জমিনে নামলো।এরপর চক্তচক্ষু নিয়ে তীরন্দাজের দিকে তাকিয়ে হুংকার ছাড়লেন।রাজকন্যা তীর ছুঁড়েই ক্ষ্যান্ত হলেন না।এগিয়ে এলেন ঘোড়া নিয়ে।সাথে সাথেই আগুন্তকের সাথে থাকা বাকি সিপাহি রা তীর ছোঁড়ার জন্য উদ্যত হলো।এর’ই মধ্যে ইন্দ্রনগরের সিপাহীগণ ঘোড়া নিয়ে দুরন্ত বেগে ছুটে এসে তাদের বাঁধা হলো।পিঠে তলোয়ার খোঁচা এবং হাতে তীর নিয়ে কঠোর কন্ঠে বললেন,
“সাবধান!ইনি ইন্দ্রনগরের রাজকন্যা।”
“রাজকন্যা” শব্দটি কর্নপাত হতেই আগুন্তক কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো।গায়ে সাদা পাথরে খচিত শুভ্র রাজকীয় পোশাক এবং মুখে পাতলা শুভ্র পর্দায় আবৃত শুভ্র অশ্বের পিঠে তেজী কাজল চোখের চাহনি দেখতেই থমকে গেল।শক্ত পাথরে আবৃত পাষাণ হৃদয়টা যেন মুহুর্তেই বরফের পাহাড়ের ন্যায় গলতে লাগলো।ধীর কদমে হেঁটে একদৃষ্টে তাকিয়ে এলোমেলো পদচিহ্ন নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো আগুন্তক।ওই রক্তাক্ত চোখের টানা কাজল’টা খানিকটা লেপ্টে গেছে অশ্রুতে।যেই লেপ্টে থাকা কাজল মুছতে এক অভাবনীয় ইচ্ছে আপ্লুত হচ্ছে তার। ইন্দ্রনগরের সিপাহি’রা অবাক দৃষ্টি নিয়ে আগুন্তকের দিকে দৃষ্টি দিলো।তার পোশাকের গায়ে চন্দ্রনগরের রাজকীয় চিহ্ন এবং তলোয়ারের কারুকার্য দেখে বললেন,
-রাজকন্যা,ইনি চন্দ্রনগরের রাজকুমার।
কর্নপাত করলেন না রাজকন্যা।“চন্দ্রনগরের রাজকুমার হোক বা স্বয়ং রাজা ;সেটা আলোকপাত করার মোটেই প্রয়োজনীয়তা নেই আমার।আমার পিঞ্জরকে হত্যা করেছে এই আগুন্তকঃ”-বলতে বলতেই ছুঁড়ে মারলো আরেক খানা তীর।রাজকুমার বিমোহিত দৃষ্টিতে রাজকন্যাকে দেখতে দেখতেই কিছুটা সরে গেলেন।লক্ষ্যভ্রষ্ট হতেই ক্ষেপে গেলেন রাজকন্যা।পুণরায় সাজালেন তীর।হাসলেন রাজকুমার।বললেন,
-রাজকন্যার মতিভ্রষ্ট হয়েছে।এই নামে কারো সাথে সাক্ষাৎ ‘ই হয় নি আমার;সেখানে তাকে হত্যা করা তো অসম্ভব।
-মিথ্যে!এই তীর তোমার।আর এটাই ছুঁড়েছো তুমি আমার পিঞ্জরকে।
-এই পিঞ্জর টা কে?
সিপাহি’রা দ্রুত মৃত পিঞ্জরকে সামনে তুলে দেখালেন।রাজকুমার হাসলেন।অবহেলা করে ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বললেন,
-ওহহ!বন বেড়াল….
বাক্যটুকু শেষ করার পূর্বেই হুংকার ছাড়লেন রাজকন্যা।অশ্ব থেকে লাফ দিয়ে নেমে তলোয়ার চেপে ধরলো রাজকুমারের গলায়।কন্ঠে কাঠিন্যতা নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-সাবধান যুবক!ওকে বন বেড়াল বলবে না।ওর নাম পিঞ্জর,বুঝলে?
ঠোঁট চেপে হাসলেন রাজকুমার।পুণরায় রাজকন্যাকে রাগিয়ে দিতে বললেন,
-ও একটা বেড়াল। আমি কেন পিঞ্জর বলে ডাকবো।যত্তসব আহ্লাদী নাম।
মস্তিষ্কে রক্ত উঠে গেলো রাজকন্যার।সারা শরীর রাগে কাঁপছে অনবরত।একে তো প্রিয় পিঞ্জরকে হারিয়েছে,তার উপর প্রিয় জিনিসকে তাচ্ছিল্য করে হাসছে এক যুবক।নিজের রাগকে সংযত করে রাজকুমারের উদ্দেশ্যে সাবধানী বার্তা শোনালো।বললো,
“রাজকুমার,তোমার ভয় করছে না?একে তো তুমি নিজের রাজ্যের সীমানার বাইরে এসে শিকার করছো।তার উপর আমার’ই পালিত পিঞ্জর কে হত্যা করেছো।তোমাকে এই মুহুর্তে বন্দি করে আজীবন গুপ্ত কুঠুরিতে ফেলে রাখলেও কেউ টের পাবে না। ”
চুপ করে রাজকন্যার যাবতীয় হুমকি শ্রবণ করলেন রাজকুমার।মাথাটাকে খানিকটা নুইয়ে রাজকন্যার মুখ বরাবর রাখলেন।ফিসফিস করে বললেন,
-ভয় পেয়েছি রাজকন্যা।আপনার সাহস এবং যুদ্ধ কৌশলের পারদর্শীতার গল্প অনেক শুনেছি,তবে অনুরোধ থাকবে এই কৌশল চন্দ্রনগরের রাজকুমারের সামনে দেখাবেন না।তাহলে বনবেড়ালের মতো আপনাকেও শিকার করে নিয়ে যাবো।বেড়ালটাকে দেখেই সন্দেহ হয়েছিলো এটা কোনো সুন্দরী রমনীর হবে।আপনাকে দেখে নিশ্চিত হলাম।বেড়াল,মালকিন দুটোই পছন্দের।একজন কে শিকার করেছি,বাকিজন অপেক্ষারত।তা এই চক্ষুজোড়া দেখিয়ে খুন না করে পুরো মুখশ্রী টাই দেখান।অস্তিত্ব হীন হয়ে যাই ধরনী থেকে।”
ক্ষোভ নিয়ে দু-কদম পেছনে সরলেন রাজকন্যা। দাম্ভিকতার সুরে শিরদাঁড়া উঁচু করে বললেন,
-ইন্দ্রনগরের রাজকন্যা অতৃপ্তা যাকে তাকে নিজের মুখশ্রী দেখায় না।কোনো হত্যাকারীকে তো নয়’ই।
-তবে এই শ্রী খুব শীঘ্রই রাজকুমার অভিরুপের কক্ষ আলোকিত করবে।
আবারো পিছু ফিরলেন অতৃপ্তা।ঘৃণা বর্ষণ করে বললেন,
-জ্ঞাত আছি।পিতা তার মিত্র রাজ্য চন্দ্রনগরের রাজকুমারের সহিত বিবাহ দেওয়ার বাসনা করেছেন।তবে সেই সু-পাত্র কে স্বচক্ষে দেখিলাম।পরবর্তীতেও যে এরুপ কথাপকোথন হবে সে আশা ত্যাগ করার জন্য সম্পূর্ন নিশ্চিত থাকুন।
বাক্যটুকু শেষ করেই রাজকন্যা অশ্বে উঠলেন।লাগাম টেনে সিপাহি দের চলে আসার নির্দেশ দিয়ে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে এলো পদ্মবিলের দিকে।রাজকুমার অভিরুপ এখনো মোহনীয় দৃষ্টিতে ধ্যানমগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে অশ্বের পিঠে বসে থাকা শুভ্রপরির দিকে।দৃষ্টিতে তার প্রগাঢ় অসন্তোষ ওই সুশ্রী দর্শন করতে না পারার।
চলবে?