চন্দ্রকথা পর্ব-০২

0
99

#চন্দ্রকথা
সিমরান মিমি
দ্বিতীয় পর্ব

২.

“পিতা,পত্রের শুরুতে সালাম প্রদশর্ন করিলাম।

আপনার মিত্ররাজ্য চন্দ্রনগরের রাজকুমার অভিরুপ সিং বিনা অনুমতিতে ইন্দ্রনগরে অনুপ্রবেশ করিয়াছেন এবং অত্যন্ত নৃশংসতার সহিত তিনি তীরবিদ্ধ করিয়া আমার পিঞ্জরকে হত্যা করিয়াছেন।নেহাত’ই বন্ধুরাষ্ট্রের সহিত আপনার সম্পর্ক ছিন্ন হইবে ভাবিয়া আমি তাহাকে বিনা শাস্তিতে মুক্ত করিয়া চলিয়া আসিয়াছি।তবে আপনি তাহাকে অতি শীঘ্রই এই জঘন্য অপরাধের কারনে শাস্তি প্রদান করিবেন।যতক্ষণ না পর্যন্ত উক্ত বিচার না হয়,ততক্ষণ পর্যন্ত রাজকন্যা অতৃপ্তা আপনাকে মুখদর্শন করাইতে বিরত থাকিবেন।

পত্র রচনায়,
রাজকন্যা অতৃপ্তা

বাহকের থেকে রাজকন্যার দেওয়া পত্রখানা পড়তেই মুখমণ্ডল ফ্যাকাসে হয়ে গেল রাজার।তিনি অতি মন খারাপের সহিত বাহকের দিকে তাকালেন।চিন্তিত কন্ঠে বললেন,

-রাজকন্যার অবস্থান সম্পর্কে কি জানো?

বাহক রাজাকে কূর্নিশ করে নিচু চোখে বললেন,

-মহারাজ,রাজকন্যা কিছু প্রহর পূর্বেই প্রাসাদে ফিরেছেন।তবে তিনি প্রিয় পিঞ্জরের শোকে অত্যন্ত ব্যথিত।রাজমাতার নিকটে জানলাম তিনি দোর বন্ধ করে কক্ষে অবস্থান করছেন।

রাজা যেন এ পর্যায়ে আরো চিন্তিত হলেন।তিনি রাজকন্যার জেদ সম্পর্কে অবগত।যদি তার কথামতো দ্রুতই রাজকুমারকে রাজ দরবারে না ডাকে তাহলে হয়তো ধীরে ধীরে আহারের প্রতি ও অনীহা দেখাবেন। নাহ!এমনটা ঘটতে দেওয়া উচিত হইবে না।তিনি কিছুক্ষণ ভাবিলেন।পরপরই বাহককে বলিলেন পত্র লিখতে।ময়ুরের পেখমে শক্ত অংশে কালি ছুঁইয়ে সাদা কাগজে আঁচড় কাঁটতে লাগলেন গুটি গুটি অক্ষরের।পত্রখানা কে গোল করে ভাঁজ করে সাদা সুতো দিয়ে পেঁচালেন।এরপর রাজকীয় উড়ন্ত দূত পায়রার পায়ে পেঁচিয়ে উঁড়িয়ে দিলেন আকাশে।

৩.

বিস্তীর্ণ নীলাকাশ।স্বচ্ছ নীলাভ আকাশের মধ্যে ঘন সাদা তুলোর মতো মেঘ।এরা যেন ফুল হয়ে ফুঁটে আছে।তার নিচে কিছুক্ষণ পর পর উঁড়ে যাচ্ছে চিল।এরা চন্দ্রনগরের আকাশে স্বাধীন ভাবে উড়ছে।হঠাৎই চিলেদের থেকে বেশ খানিকটা দুরত্বে নিচু স্তরে উড়ে এলো এক পায়রা।দূর থেকে প্রাসাদের সৈন্যরা তাকিয়ে রইলো পায়রার পানে।তার রক্তিম পায়ে সাদা কাগজ পেঁচানো দেখতেই একজন চিৎকার করে উঠলো,

-রাজকীয় পত্র এসেছে।

পায়রা টা আরেকট নিচ থেকে উড়ে এসে দাঁড়ালো প্রাসাদের সম্মুখে থাকা এক স্তম্ভের উপর।সাথে সাথে সৈন্য ধরে ফেললো।অতি সাবধানে তার পা থেকে সুতোর বাধন খুলে পত্রটা হাতে নিয়ে উড়িয়ে দিলো আবারো আকাশে।পত্রখানা বার্তাবাহক এর কাছে হস্তান্তর করে পুণরায় ফিরে এলো প্রাসাদের মুল ফটকের সম্মুখে পাহারা দিতে।

“মিত্র,বাধ্য হইয়া পত্র পাঠাইয়াছি।আশা করিতেছি ভুল বুঝিবে না।অতি শীঘ্রই রাজকুমারকে ইন্দ্রনগরে পাঠাইবার ব্যবস্থা করো।চার দিন পূর্বে সে আমার’ই রাজ্যে অনুপ্রবেশ করিয়া আমার’ই কন্যার পালিত বনবেড়াল কে তীরবিদ্ধ করিয়া হত্যা করিয়াছে ;যাহা রাজকন্যা স্বচক্ষে দেখিয়াছে।সে আমার নিকট এর বিচার চাহিয়াছে এবং হুমকিস্বরূপ বলিয়াছে যতদিন পূর্বক এর বিচার না করিবো,ততদিনে আমাকে মুখদর্শন করাইবে না।রাজকন্যা দোর বন্ধ করিয়া কক্ষে আছে এবং আহার ত্যাগ করিয়াছে।এ বড় যন্ত্রণার সংবাদ।একমাত্র কন্যার এমন তেজের সামনে আমি বড়ই অসহায়।অতি শীঘ্রই আমাকে উক্ত বিপদ থেকে রক্ষা করো।

পত্র রচনায়,

ইন্দ্রনগরের রাজা স্নেহাভিলাষ

পত্র পড়তেই চমকে গেলেন রাজা।দ্রুত সিপাহি পাঠালেন রাজকুমার অভিরুপ সিং এর উদ্দেশ্যে। পিতার ডাক পেতেই ব্যস্ত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলেন রাজকুমার।পত্রে লেখা যাবতীয় তথ্য পড়ে নিজ ভাবনায় ব্যস্ত হলেন।ভাবনা শেষে পিতার উদ্দেশ্যে বললেন,

-পত্রের উত্তর দেওয়া প্রয়োজন নেই, পিতা।আমি আজ’ই ইন্দ্রনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করবো।

রাজা বাঁধা দিলেন।চিন্তিত কন্ঠে বললেন,

-পুত্র,তুমি সেখানে যাবে না।রাজকুমারীর জেদ,তেজ,কঠোরতা সবকিছু সম্পর্কে অবগত আমি।সে তোমায় কঠিন কোনো শাস্তি দিতেও পিছ-পা হবে না।এর থেকে আমি তার কাছে পত্রে ক্ষমা চাইবো।হয়তো এতে আমাদের মধ্যকার সু-সম্পর্ক কিছুটা নড়বড়ে হবে,এমনকি বিবাহ টাও ভাঙতে পারে;তবে তাতে খুব একটা ক্ষতি হবে বলে মনে করছি না।দক্ষিণাত্যের রাজার ভগ্নিকন্যার সহিত তোমার বিবাহের প্রস্তাব এসেছি কিছুকাল পূর্বে।সে বড়ই সুলক্ষনা।নেহাতই স্নেহাভিলাষকে কথা দিয়েছিলাম বলে তাদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।তবে এবারে প্রস্তাব পাকাপোক্ত করবো।

ভ্রুঁ দয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে পিতার দিকে তাকালো রাজকুমার।সুচতুর দৃষ্টিতে তার মুখভঙ্গি অবলোকন করে ভাবভঙ্গি বোঝার প্রয়াস চালালো।হুট করেই প্রস্তাব পরিবর্তন করাটা মোটেও পছন্দনীয় ঠেকলো না তার কাছে।মেরুদন্ড সোঁজা করে শির উঁচু করলো।কন্ঠে কাঠিন্যতা,গম্ভীরতা মিশিয়ে সুনিশ্চিত ভাবে পিতার উদ্দেশ্যে বললো,

-দাক্ষিণাত্যের রাজাকে ফিরিয়ে দিয়ে উত্তম কাজ করেছেন।ভবিষ্যতে ইন্দ্রনগরের রাজকন্যার সহিত আমার বিবাহ দিয়ে আরো উত্তম কাজ করবেন বলে আশা করছি।

রাজা অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকালেন।অভিরুপ সে চোখের দিকে সরাসরি দৃষ্টিপাত করে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

-আমার অভিব্যক্তি বুঝতে আপনার অসুবিধা হবে এটা আশা করছি না।ইন্দ্রনগরের রাজকন্যা সহিত দেখা হয়েছে অশ্বথ জঙ্গলে এবং তাকে দেখার ক্ষণকাল অতিবাহিত মাত্রই সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করেছি।বিবাহ তাকেই করবো।

রাজা অমর সিং পুত্রের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন।তাকে পূর্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন,

-রাজকুমার,কিছুকাল পূর্বে আমিই বিবাহের প্রস্তাব তোমার সম্মুখে তুলেছিলাম।রাজকন্যা অতৃপ্তার বীরত্ব, যুদ্ধকৌশল,অস্ত্রচালনা,সুক্ষ তীরন্দাজ, মোহনীয় সৌন্দর্য্য সকল বিষয়ে গোটাখানেক পুঁথি তোমার সামনে পাঠ করলেও মত দাও নি।দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলে এমন রাজকন্যা কখনোই বিবাহ করিবে না।তোমার কাছে যুদ্ধকৌশল,অস্ত্রচালনা মাত্রই পুরুষের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। যে নারী এইসকল দিক নিজের মধ্যে লালন করে সে কখনোই স্ত্রী হওয়ার যোগ্য নয়।নারী হবে কোমল,নারীর চক্ষু থাকবে জমিনে অন্তর্ভুক্ত, যার দৃষ্টি কখনোই জমিন থেকে উপরিস্থলে উঠিবে না।এই পুরুষ সমান অযোগ্যা নারীকে কখনোই বিবাহ করবে না।তাহলে আজ এমন কি হলো যে তাকে বিবাহ করার জন্য ইন্দ্রনগরে যাত্রা করছো শাস্তি হবে জেনেও?

রাজকুমার চক্ষু বন্ধ করলেন।সাথে সাথেই ভাবনায় ডুব দিলেন।বন্ধ চক্ষুর পর্দায় মস্তিষ্কের কল্পনা শক্তির সাহায্যে সেই অভাবনীয় দৃশ্যগুলো ভেসে উঠলো।শুভ্র অশ্ব,তার উপর এক অপূর্ব সৃষ্টি,ওই তেজ,ওই অশ্রুশিক্ত লাল চক্ষু,কালো কাজলে লেপ্টে থাকা দুপাশ ভাবতেই চোখ খুলে ফেললো।পিতার উদ্দেশ্যে সম্মোহনী কন্ঠে বললো,

-কারন ওটা কোনো নারী নয়,ও একরাশ মুগ্ধতা,মোহনীয় শক্তি,দিঘির সদ্য প্রস্ফুটিত তাঁজা পদ্ম,যে পদ্ম তীব্র হাওয়ায় দুপাশে দুললেও ভেঙে পড়ে না।তাকে আমার চাই।ওই আলোর তীব্র ঝলকানি আমার কক্ষে চাই।তার ওই তেজী চোখের দৃষ্টিতে আমি আজীবন দৃষ্টি স্থাপন করার দুঃসাহস দেখাতে চাই।

থেমে কঠোর কন্ঠে বললো,

-আপনি নিশ্চয়ই পুত্রের চাওয়ার বিরোধিতা করে নগরের ধ্বংস ডাকবে না?

৪.

চার দিন এবং পাঁচ রাত্রি যাত্রার পর চন্দ্রনগরের রাজকুমার এবং তার সৈন্যদের ঘোঁড়া পৌছালো ইন্দ্রনগরের রাজপ্রাসাদে।তাদেরকে দেখতেই অতি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে গেলেন রাজা।দ্রুত তাদের বিশ্রাম এবং আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন রাজকীয় ভাবে।দুই প্রহর বিশ্রাম নেওয়ার পর রাজ সভা বসালেন রাজা স্নেহাভিলাষ।সভায় সমস্ত রাজ সভাসদকে ডেকে সময় ঘোষণা করে দিলেন।পরমুহুর্তে’ই বার্তা পাঠালেন কন্যার কাছে।রাজকুমারীর কক্ষের সামনে গিয়ে বন্ধ দুয়ারে অপেক্ষা করলেন বার্তাবাহক।দাসীকে বলতেই তিনি ভীত মুখে বললেন,

-মাননীয় বার্তাবাহক,

রাজকন্যা কিছুক্ষণ পূর্বেই আহার করেছেন।আমাকে বলে দিয়েছেন উনি এই মুহুর্তে বিশ্রাম নেবেন এবং ওনাকে যেন কেউই বিরক্ত না করি।এখন ডাকলে যদি উনি আমার উপর রেগে যান?

বার্তাবাহক ক্ষণকাল নিশ্চুপ রইলেন।এরপর নিজেই দুয়ারে টোকা মেরে বললেন,

-রাজকুমারী,রাজকীয় বার্তা আসিয়াছে।দয়া করে ইহা শ্রবণ করুন।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তাদের।এর মধ্যেই দুয়ার খোলার আওয়াজ এলো।রাজকন্যা খোলা দরজার সামনে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়ালেন।বাহক পড়তে আরম্ভ করলেন,

“রাজকুমারী অতৃপ্তা,চন্দ্রনগরের রাজকুমার অভিরুপ সিং কিছু প্রহর পূর্বেই প্রাসাদে প্রবেশ করিয়াছেন।শীঘ্রই সভা বসিবে।তাহার করা অপরাধের শাস্তিও তিনি পাইবেন।অনুগ্রহপূর্বক উক্ত সভায় উপস্থিত থাকিবার জন্য রাজা স্বয়ং তোমাকে আমন্ত্রণ জানাইয়াছেন।আশা করিতেছি রাজার মান রাখিবেন।”

পত্রের লেখা শ্রবণ করতেই রাজকন্যা খুশি হলেন।সেই খুশির উপস্থিতি হিসেবে তার ঠোঁট, মুখ-চোখ ও উজ্জ্বল দেখালো।সভার সময় জানার পর কক্ষে প্রবেশ করে মখমলের ময়ুরাক্ষী পোশাক’টা পরিধান করলেন।মুখের উপর পাতলা কাপড়টা বেঁধে ব্যক্তিগত দাসীদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন রাজ দরবারের দিকে।জনপূর্ণ সভায় প্রবেশ করতেই সকলে আসন ছেড়ে রাজকন্যাকে কূর্নিশ করে অভিনন্দন জানালেন।তবে আসন ছাড়লেন না রাজকুমার।তিনি চরণের উপর চরণ তুলে আত্মদাম্ভিকতা নিয়ে বসে রইলেন।তার দৃষ্টি নিষ্পলক ভাবে রাজকন্যার চোখের দিকে নিক্ষেপ করা রয়েছে।রাজকুমারকে ওভাবেই বসে থাকতে দেখে অপমানিত হলেন তিনি।এক ঝলক তাকিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বসে পড়লেন নিজস্ব আসনে।কিছুক্ষণ পর পর দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন রাজকুমারের দিকে।হুট করেই অভিরুপ সিং ভরা রাজসভায় মুখ খুললেন।চরম নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়ে বললেন,

-রাজকুমারী,এভাবে তাকাবেন না।আপনার ওটা দৃষ্টি নয়,ধারালো তীরের ফলা।প্রতিনিয়ত জখম হচ্ছি আমি।

সাথে সাথেই রাজা স্নেহাভিলাষ রাজকন্যার দিকে তাকালেন।উপস্থিত সকল রাজসভাসদ দের দৃষ্টি এখন তার দিকে।সবাই কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছেন।অসস্তিতে হাঁসফাঁস করে উঠলেন রাজকন্যা।হতবিহবল হয়ে ক্ষোভ মিশ্রিত চোখে তাকালেন রাজকুমারের দিকে।কন্ঠে তেজ নিয়ে বললেন,

-যারা নারীদের সম্মান করতে জানে না,কোমল পশু-প্রাণীদের প্রতি দয়া করতে জানে না,তাদের উপর শুধু ধারালো দৃষ্টি নয়,সরাসরি তলোয়ার ছোঁড়া উচিত।

চলবে?