চন্দ্রকথা পর্ব-০৩

0
62

#চন্দ্রকথা
সিমরান মিমি
তৃতীয় পর্ব

(নাম বিভ্রান্তির কারনবশত ইন্দ্রনগরের রাজার নাম স্নেহাভিলাষ থেকে পরিবর্তন করে শওকত উজ্ জামান্ রাখা হলো।)

৫.
চিন্তিত মহারাজ ক্রমশ দৃষ্টি পরিবর্তন করতে লাগলেন।একবার রাজকুমার অভিরুপ সিং, একবার রাজকুমারী অতৃপ্তা, একবার মন্ত্রী এবং পরবর্তীতে সভাসমাবেশে উপস্থিত গণমান্য ব্যক্তিবর্গের দিকে।এভাবে কিছু মুহুর্ত ব্যয় হবার পরক্ষণে কন্ঠকে শান দিয়ে গম্ভীর চিত্তে প্রশ্ন ছুঁড়লো রাজকুমারের দিকে। বললো,

-“রাজকুমার,তুমি কেন নগরে অনুপ্রবেশ করেছিলে?আর কেনোই বা রাজকন্যার প্রিয় পিঞ্জরকে হত্যা করেছো?”

আসনের সম্মুখ প্রান্তরে রাখা আসনে বসা রাজকন্যার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি দিলো রাজকুমার।সেদিকে তাকিয়েই কন্ঠে তেজ বয়ে আনলো।দাম্ভিক স্বরে বললো,

-“মহারাজ!চন্দ্রনগর এবং ইন্দ্রনগর দু রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানে অশ্বথ বনের অবস্থান।যে বনের অর্ধাংশ এ রাজ্যের এবং বাকি অর্ধাংশ চন্দ্রনগরের সীমানায়। শিকারে গিয়ে খেয়াল না থাকায় অনিচ্ছাকৃত ইন্দ্রনগরের সীমানায় প্রবেশ করেছিলাম।বিষয়টা বোঝার পরক্ষণেই সেই স্থান ত্যাগ করে আসার প্রয়াস করেছিলাম।কিন্তু এর মধ্যেই রাজকুমারী তীর ছুঁড়লেন।

রাজকুমারী ক্ষুব্ধ চোখে তাকালেন।তেজী কন্ঠে বললেন,

-সেটা না হয় বুঝলাম।কিন্তু সে আমার পিঞ্জরকে কেন হত্যা করেছে?

-এটা বড়ই হাস্যকর কথা মহারাজ।শিকার করতে গিয়েছি জঙ্গলে,সম্মুখে এক বনবেড়াল পেয়েছি বলে তার উপর তীর ছুঁড়েছি।বেড়াল টা মারাও গিয়েছে।এবারে আমি কিভাবে বুঝবো জঙ্গলে রাজকুমারীর বেড়াল ঘুরছে?

মহারাজ শঙ্কিত চোখে রাজকুমারীর দিকে চাইলো।পরক্ষণেই রাজকুমারের দিকে তাকিয়ে ভুল শুধরে দিয়ে ভীত কন্ঠে বললো,

-বনবেড়াল নয় তাহার নাম পিঞ্জর।তুমি নাম ধরেই বলো।

উপর পাটির সম্মুখভাগের দন্ত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে রাজকুমারীর রাগন্বিত মুখশ্রী উপভোগ করলো অভিরুপ। ব্যঙ্গ,তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললো,

-আমি এতো আহ্লাদ করতে পারি না মহারাজ।

থেমে অতৃপ্তার বিষাদে ছাওয়া মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে নরম কন্ঠে বললো,

-যদিও এতে আমার কোনো ভুল নেই, তারপরেও রাজকন্যার প্রিয় প্রাণীর বিয়োগে আমি অত্যন্ত অনুতপ্ত।

ক্ষোভে ফেঁটে পড়লো অতৃপ্তা।বললো,

-আপনার অনুতপ্ত হওয়াতে তো আর আমার পিঞ্জর ফিরে আসবে না?অন্যায় যখন করেছেন তখন শাস্তি ও পেতে হবে।

-রাজকন্যার আদেশ শিরধার্য!বলুন কি শাস্তি দিবেন?

-একজন পাষাণ, পাথর হৃদয়ের অধিকারী, দয়ামায়া হীন নরপিশাচ, পশু-পাখিদের প্রতি সামান্যতম করুনাহীন এক দানব রুপি রাজকুমারের জন্য রাজকন্যা অতৃপ্তা শাস্তিস্বরূপ
আজ এই রাজসভায় ঘোষণা করছি যে,“আগামী সপ্ত অহ চন্দ্রনগরের রাজকুমার অভিরুপ সিং আমার অশ্বশালার অশ্বদের যত্ন নেবে এবং প্রাসাদের চুড়ায় রাখা পায়রা খোঁপের পায়রা দের নিয়ম মোতাবেক আহার করাবে।

স্তব্ধ হয়ে গেলেন মহারাজ শওকত উজ্ জামান্।স্বীয় কন্যার মত অনুযায়ী শাস্তি তাও আবার একজন প্রভাবশালী রাজকুমারকে দেওয়া হবে এ যেন ভাবনার অতীত।এতে যে সম্পর্ক বিনষ্ট হতে খুব বেশী প্রহর লাগবে না।না না কন্যাকে এতোটা প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হচ্ছে না।সে থাকুক তার পিতার প্রতি অভিমান করে।কিন্তু তাও এই শাস্তি হতে দেওয়া অসম্ভব।কন্ঠে প্রগাঢ় অসন্তোষ এবং দ্বিমত পোষণ করে বললেন,

-এ হতে দেওয়া অসম্ভব।একজন রাজকুমারের প্রতি তুমি এ ধরণের অবিচার করতে পারো না কন্যা।এ বড় অপমানজনক এবং নিয়মবহির্ভূত।

-বেশ তবে প্রয়োজন নেই কোনো শাস্তির।তাকে রাজ আপ্যায়ন করে মাথায় তুলে রাখুন।তবে এটা মনে রাখবেন পিতা,আমি আমার বাবা নহে;এই রাজ্যের রাজার কাছে বিচার দিয়েছিলাম।আপনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন।

বলে সভা ছাড়ার প্রয়াস করতেই অভিরূপ বললো,

-মহারাজ,আপনি শান্ত হোন।রাজকুমারীর শাস্তি আমি নিশ্চয়ই মানবো।আমার বলা অনুতপ্তের কারনে তার বনবেড়াল ফিরে না আসলেও;তার বলা শাস্তি পালনের পর নিশ্চয়ই বেঁচে উঠবে।

৬.

রাজসভার সমাপ্তি ঘটেছে কিছু মুহুর্ত পূর্বেই।রাজকুমারী নিজস্ব সিদ্ধান্তের উপর ঠিক যেমনটা অটল ছিলেন, তেমন দৃঢ় ভাবেই সেই শাস্তি পালন করার আশ্বাস দিয়েছেন রাজকুমার।তবে মধ্যপর্যায়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ফেঁসে গিয়েছেন মহারাজ।কন্যার উপর অসন্তোষ নিয়েই ফিরেছেন অন্দরমহলে। মাতৃহীন কন্যার বিষয়ে কার কাছেই বা নালিশ করবেন তিনি?বেগম জীবিত থাকলেও না হয় অন্দরমহলে গিয়ে পুরো রাগ টা তার উপর ঝেড়ে বলা যেত,“বেগম!তোমার কন্যা আজ আমার বিরুদ্ধে গিয়েছে,আমারই মিত্রের পুত্র -যার সাথে কিনা কিছুদিন পরেই তার বিবাহ;সেই তার সাথেই অবিচার করেছে।কেন তুমি নিজ কন্যাকে শাসন করছো না?”কিন্তু মহারাজ এমন কিছুই করতে পারছেন না।আফসোস নিয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে রইলেন পালঙ্কে।

অশ্বশালায় ঢুকেই সেখানে তুলকালাম কান্ড বাঁধালো রাজকুমার।আশেপাশের যাবতীয় মাটির পাত্র ভেঙে দিলো। চারপাশে আহার সামগ্রী ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে একজন কর্মচারীকে ডাকলো।ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কম্পনরত শরীর নিয়ে রাজকুমারের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।অভিরুপ হঠাৎই তাকে অবাক করে দিয়ে বললো,

-রাজকুমারীর নিকটে যাও।এক্ষুনি যা ঘটলো এগুলো বলবে,আরো বাড়িয়ে বলবে,আমার নামে বদনাম করবে।দ্রুত যাও।যাও!

কর্মচারী ভীত হলেন।রাজকুমারের কথা-বার্তা কিছুই বুঝতে পারলেন না।শঙ্কিত হয়ে তাকে খুশি করার জন্য কম্পনরত কন্ঠে বললেন,

-হুজুর!আমি কিছুই বলবো না রাজকন্যার কাছে।এগুলো এখনই পরিস্কার করছি।

মুহুর্তেই কলারের উপর ভয়ঙ্কর এক থাবা ফেললো রাজকুমার।কর্মচারীর পরনের ফতুয়াকে টেনে সংকুচিত করে নিকটে আনলো।ভয়াল কন্ঠে বললো,

-তোকে যেটা বলা হয়েছে সেটা কর। যা ইচ্ছা বল শুধু রাজকুমারী যেন এখানে আসে।মনে রাখিস,তাকে না আনতে পারলে তোর গর্দান যাবে।

রাজকুমারের থেকে মুক্তি পেতেই ছুটলো কর্মচারী।অন্দরমহলের ফটকের সামনে যেতেই আটকালো প্রহরী।প্রথম বাঁধা পেতেই ঘাবড়ে গেল।অনুনয় বিনয় করে বললো,

-দয়া করে রাজকুমারীকে ডাকুন।খুবই দরকারী বার্তা জানাতে আসছি।

একজন প্রহরী ধমক মেরে বললো, -রাজকন্যা শয্যায় আছেন।এখন ডাকা যাবে না।

এ পর্যায়ে হাটু মুড়িয়ে বসে পড়লেন লোকটি।করূন কন্ঠে বললেন,

-তাকে একবার বলুন,অশ্বশালা থেকে এক কর্মচারী আসিয়াছে রাজকুমারের খবর জানাইতে।এরপর না আসলে আমি চলিয়া যাইবো।

শুনলেন প্রহরী।একজন দাসীকে ডাকিয়া খবর জানাতেই সে ছুটলো রাজকুমারীর কক্ষের দিকে।দুয়ারের নিকটে গিয়ে রাজকন্যার ব্যক্তিগত দাসীকে খবরটা পাড়লেন।এরপর দুয়ারে টোকা দিয়ে ব্যক্তিগত দাসী রাজকন্যাকে উক্ত কথাটা বলতেই দ্রুত দুয়ার খুললো।মুখে ঝালর বেঁধে দ্রুত রওনা দিলো ফটকের দিকে।দুরেই ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন কর্মচারী রাজকুমারীকে আসতে দেখেই ডাকলেন প্রহরী।বললেন,

-উঠে আয়।রাজকন্যা এসেছেন।

তিনি কাছে আসতেই সবাই হাটু মুড়িয়ে কুর্নিশ করলেন।রাজকন্যা শক্ত কন্ঠে জানতে চাইলেন,

-অশ্বশালার বিষয়ে যাহা জানো বলো।

-মাননীয়া রাজকুমারী, এ কাকে দায়িত্ব দিয়েছেন আপনি?সে প্রথম দিনেই অশ্বের আহার সামগ্রী,জিনিসপত্র ভাঙিয়া -চুড়িয়া লন্ডভন্ড করে দিয়েছেন।রাজকুমার বড়ই ভয়ানক।তিনি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন।আপনি দ্রুত চলুন।না হলে একটা অশ্ব ও হয়তো জীবিত থাকবে না।

শোনামাত্র’ই ক্ষুব্ধ রাজকুমারী যাত্রা আরম্ভ করলেন অশ্বশালার দিকে।গিয়ে যা দেখলেন তাতে বড্ড আশ্চর্য হয়ে কর্মচারীর দিকে তাকালেন।সমস্ত এলোমেলো জিনিস পত্র গোঁছানো,এমনকি ভাঙা পাত্রগুলো ও এক পাশে জড়ো করে রাখা।রাজকুমার স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে এক অশ্বের পিঠে হাত বুলাচ্ছেন।হতবাক হয়ে অন্যপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন কর্মচারীর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,

-এসব কে পরিস্কার করেছে?

তারা ভীত চাহনিতে একে অপরের দিকে তাকালেন।এরপর বললেন,

-রাজকুমার নিজেই করেছেন।

তাদের অর্ধস্বরের কথা শুনে খুব সহজেই বোধগমাই হচ্ছে যে এ কাজ রাজকুমারের নির্দেশে তারাই করেছে।কিন্তু অস্বীকার করছে শাস্তির ভয়ে।অতৃপ্তাকে দেখেই চৌকস হাসলো অভিরুপ।এগিয়ে এলো দৃঢ় পায়ে।তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে তাকালো।মোহনীয়তায় বিমূঢ় হয়ে বললো,

-অবশেষে রাজকুমারী আসলেন।আমি তো কাজ করতে করতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।শক্তির প্রয়োজন খুব।কিছুক্ষণ আপনার ওই চক্ষুপানে চেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে নেই।

রাজকুমারী সরে গেলেন সামনে থেকে।দৃষ্টিকে সূচালো করে বাকি কর্মচারীদের হাতের দিকে তাকালেন।এরপর তাচ্ছিল্য করে বললেন,

-কাজ করেছেন আপনি।অথচ হাত নোংরা ওদের।আপনার হাত তো দেখছি একদম স্বচ্ছ।

নিমিষেই হাতের দিকে তাকালেন রাজকুমার।বললেন,

-ওহহ!এটা তো রাজকুমারীকে আলিঙ্গন করার জন্য পরিস্কার করেছিলাম।তবে আপনি চাইলে আলিঙ্গন শেষে আবারো নোংরা করতে পারি।

চলবে?