#চন্দ্রকথা
সিমরান মিমি
ষষ্ঠ পর্ব
➤
প্রাসাদের চতুর্দিকে দাস-দাসীতে ভরপুর।প্রতিটা মুহুর্তে তাদের আগ্রহ নববধুর দিকে।প্রয়োজন-অপ্রয়োজন,ইচ্ছা-অনিচ্ছা জানার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা।যেন ছিঁটেফোঁটা ভুল হলেই গর্দান যাবে তাদের।প্রত্যেকের চোখ-মুখ কেমন অনুজ্জ্বল এবং ফ্যাকাসে। অতৃপ্তা অবাক হলো।কিন্তু প্রকাশ করলো না।গায়ের পোশাকটি সামান্য উঁচু করে পালঙ্ক থেকে নামলো।বিবাহের দ্বিতীয় দিবস চলমান।এরইমধ্যে মাত্র দু-বার রানী পারমতি বানু এবং সৌদামিনীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে।এ যাবৎ তারা কক্ষে আসেন নি। শুধুমাত্র আহারের সময় চক্ষুসাক্ষাৎ হয়েছে।একই জায়গায় বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত অতৃপ্তা ইন্দ্রনগরে থাকাকালীন প্রিয় ব্যক্তিগত দাসী এবং এখানকার দুজন দাসীকে নিয়ে প্রাসাদ পরিদর্শনে বের হলো।একে একে অন্দরমহলের প্রতিটা কোনা দর্শন করার পর একজনের উদ্দেশ্যে বললেন,
_রাজকুমার মধ্যাহ্নের পূর্বেই বেরিয়েছে।রাত্রি নামবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।কিন্তু এখনো ফিরলেন না।তোমরা কি কিছু জানো?আগেও কি একই সময়ে প্রাসাদের বাইরে যেতেন তিনি?
হাঁসফাঁস করে উঠলো একজন দাসী।কিয়ৎক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে নোয়ানো কন্ঠে বললো,
_রাজকুমার তো এ সময় জলসাঘরে থাকেন বেগম। আজ ও হয়তো সেখানেই আছেন।
চমকে দাসীদের দিকে তাকালেন অতৃপ্তা।মুখ দিয়ে ভাঙা ভাঙা স্বরে আওড়ালেন,
-জ ল সা ঘ র!
থেমে আদেশের সুরে বললো,
-কোথায় সেই জলসাঘর।আমাকে নিয়ে চলো।
-মাফ করবেন বেগম।অন্দরমহলের কোনো নারীই সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না।এটাই নিয়ম।
কদম থামিয়ে দিলেন রাজকুমারী।নানা ভাবনা -চিন্তা উদয়ের মধ্যে আর প্রাসাদ ঘুরে দেখার ইচ্ছে হলো না।কন্ঠে গম্ভীরতা নিয়ে বললেন,
-আমি কক্ষে যাব।
সময়ের গতিকে থামানো অসম্ভব।নিজ গতি অনুযায়ীই চলতে লাগলো সে।এক পর্যায়ে রাতের শেষ প্রহর চলে এলো।অতৃপ্তা রাজকুমারের অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লো জানালার ধারের আসনটাতে।এমনই গভীর রাতে স্টিলের কিছু পড়ে গিয়ে ঝনঝন করে আওয়াজ হলো।নিদ্রা হালকা হয়ে এলো তার।হঠাৎই নগ্ন কোমড়ে ঠান্ডা-শীতল ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই চমকে বসলো। রাজকুমার অভিরুপ তার সাথেই আসনে বসে আছেন।তার হাত দুটো তারা পুরো বক্ষপিঞ্জর আবদ্ধ করা।অতৃপ্তা সেই হাতকে সহস্তে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।পালঙ্কের দিকে যেতে যেতে বললো,
-ভোর হয়ে এলো রাজকুমার।আমার নিদ্রা ভঙ্গ করা উচিত হয় নি তোমার।বিশ্রাম নাও।
বিরক্ত হলো অভিরুপ।চোখচোখ কুঁচকে উঠে দাঁড়ালো আসন থেকে।দু-কদম এলোমেলো পায়ে হাঁটতেই এগিয়ে এসে ধরলো অতৃপ্তা।বুক চিরে নিঃশ্বাস নিয়ে নরম কন্ঠে বললো,
_তুমি নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছো।শরীর ক্ষয়ে গেছে,মাতালদের চিহ্ন তোমার মধ্যে বিরাজমান রাজকুমার।বিশ্রাম নাও।
রাজকুমার ডান হাত উঁচিয়ে দু-আঙুল ফাঁক করে একটা নির্দিষ্ট ব্যবধান দেখিয়ে বললো,
-এতটুকু পান করেছি।
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো রাজকুমারী।বললো,
-এতোটুকু নয় অনেকটা।
স্বীকারোক্তি স্বরুপ রাজকুমার গর্জে উঠলো।দাম্ভিকতার জেরে বললো,
_অস্বাভাবিক কিছু নয়।রাজকুমার আমি।উন্নত মানের সুরাহ শুধুমাত্র রাজকীয় পরিবারের জন্যই বরাদ্দ।কেন পান করবো না?
_সেটা ঠিক।তবে আমার অপছন্দের ছিলো। পিতাকেও পান করতে দিতাম না সহজে।সেখানে আজ নিজের স্বামী দিবস-ভর ডুবে থাকে। রাজকুমার,আমি তো কম খোঁজ নেই নি প্রহরীদের নিকট থেকে।তুমি তো ইন্দ্রনগরে বসে এসব পান করতে না।তাহলে এখন কেন?দাসীদের থেকে শুনলাম তোমার এগুলো পুরোনো অভ্যাস।সারাদিন রাত বাইজীঘরে পরে থাকো নর্তকী নিয়ে।
কি ভাগ্য আমার?এতো বড় একটা রাজ্যের ভবিষ্যৎ রানী আমি,অথচ আমার স্বামী নারী পিপাসু।যার স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সারা রাত-দিন বাইজী ঘরে পড়ে থাকতে হয়।
রাজকুমার নির্বাক হয়ে অতৃপ্তার বক্ষে মুখ ডুবালো।ক্রমশ শরীরের ভাঁজে হাত এবং ঠোঁট দিয়ে বিচরণ করতে লাগলো।রাজকুমারী ঘেন্নায় চোখ বন্ধ করে নিলেন। চোখের কার্নিশ দিয়ে গরম অশ্রু ছেড়ে দিলেন।ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে বললেন,
_আচ্ছা রাজকুমার, কার শরীর বেশি আকর্ষনীয়?তোমার রানীর নাকি যেসব নর্তকীদের সাথে সারাটা রাত পার করে এলে তাদের?
অভিরুপ এ পর্যায়েও নিশ্চুপ রইলো।তার শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে রাগের তীব্র প্রকোপ। দাঁতে দাঁত চেপে নিশ্চুপ রইলো।কিন্তু অতৃপ্তা নিশ্চুপ রইলো না।আবারো হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ করা কন্ঠে বললো,
_রাজকুমার,তোমার শরীরে আমি অন্য নারীর শরীরের গন্ধ পাচ্ছি।তুমিই বলো,এ আমি কেমন করে সইবো?
ছেড়ে দিলো অভিরুপ।সোজা হয়ে পড়লো পালঙ্কে। চোখ দুটো উপরের দিকে তাক করে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
_তুমি একজন রাজকুমারী।নিশ্চয়ই রাজকীয় নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দিতে হবে না।বাইজীঘর নির্মাণ’ই করা হয়েছে রাজকীয় পরিবারের পুরুষদের জন্য।এখানকার আমোদ-প্রমোদ নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য মনকে সতেজ রাখে। আমার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস।তোমার অপছন্দ জেনেই ইন্দ্রনগরে থাকাকালীন ত্যাগ করেছি।এগুলো স্বাভাবিক।
_কিন্তু রাজকুমার,আমি এই স্বাভাবিকতাকেই স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারি না।
সে রাতে আর কোনো কথা হলো না।দু-জনেই নিশ্চুপ হয়ে দু দিকে ফিরে নিদ্রায় গেল।ভোরের আলো ফুঁটেছে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।কিন্তু ঘুম ভাঙেনি অতৃপ্তার।সারা রাত জেগে অপেক্ষা করার কারনেই হয়তো ভোরে নিদ্রারা তাকে ঝাপ্টে ধরেছে।সূর্য তখন তার উত্তপ্ততা ছড়িয়ে দিয়েছে প্রবলভাবে।অতৃপ্তা সকালের আহার শেষ করে মহারানীর কক্ষের দিকে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো।হঠাৎই চোখ পড়লো দাসী দের দিকে।এরা সকলে নতুন।তাদের দিকে দৃষ্টি দিতেই ভয়ে কাচুমাচু করে উঠলো।প্রত্যেকের চোখে-মুখে লেপ্টে আছে ভয়।
_আমার পূর্বের দাসীরা কোথায়?তোমরা কেন এখানে?
তিনজনেরই মুখের বর্ন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।বললো,
_রাজ কুমার আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন বেগম।
_পুরোনো দাসীরা কোথায়?
প্রত্যেকেই মাথা নাড়িয়ে অস্বীকার জানিয়ে বললো,_জানিনা।
চুপ করে বসে রইলো রাজকুমারী।ইন্দ্রনগর থেকে সঙ্গী হিসেবে আনা ব্যক্তিগত দাসীকে গোপনে খবর জোগাড় করতে পাঠিয়েছেন তিনি।দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে অথচ এখনো দেখা নেই তার।রাজকুমার নিজেও গতদিনের মতো প্রাসাদে অনুপস্থিত। কিছু ভেবে পাচ্ছেন না রাজকন্যা।এখানকার কেউই স্বাভাবিক নয়।প্রত্যেকের চোখে-মুখে ভয় লেপ্টানো।যেন একটু ভুল হলেই গর্দান যাবে।এদিকে প্রাসাদের কেউ’ই তার সাথে আহারের সময় বিহীন দেখা করছেন না।সকল কূল-কিনারা হারিয়ে পিতার উদ্দেশ্যে পত্র লিখতে উদ্যত হলেন।গুটি গুটি অক্ষরে লিখলেন,
_পিতা,
স্বীয় মিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখতে প্রিয় কন্যাকে এভাবে বলি না দিলেও পারতেন।
এটুকু লিখে থেমে গেলেন রাজকন্যা।এই পত্র পিতার নিকট পৌছালে তিনি অসুস্থ হয়ে যাবেন। না না এটা প্রেরণ করা যাবে না।পত্রটাকে টুকরো টুকরো করতেই ব্যক্তিগত দাসী হাফিজা এসে পৌছালো কক্ষে।তার শ্বাস অতিশয় দ্রুতবেগে চলছে,কপাল ঘেমে লেপ্টে গেছে মাথার চুল।চোখে-মুখে আতংক নিয়ে রাজকুমারীর পায়ের কাছে বসলো।বললো,
_রাজকন্যা,গতদিনের সেই দাসী, যিনি রাজকুমারের ব্যাপারে আপনাকে বলেছিলেন তাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিয়েছেন রাজকুমার।কিছুক্ষণ পূর্বেই তাকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে ষড়যন্ত্রের দায়ে।বাকিদের কে কারাগারে রাখা হয়েছে।আপনি এ কোথায় এলেন?এখানকার সকলের মধ্যে আতংক।কিভাবে বাঁচবেন আপনি?
শরীরটা নুইয়ে পড়েছে অতৃপ্তার।না খুনের কারনে নয়।নিজ হাতে অজস্র বার তলোয়ার চালানোর ঘটনা রয়েছে রাজকুমারী’র। যুদ্ধের ময়দানে অজস্র সেনাকে দ্বিখন্ডিত করেছে সে।তবে সেটা অন্যায়ের কারনে।এভাবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার কথা ভাবতেই শরীর হিম হয়ে আসে।নরম বালিশ টাকে মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লো।কিছুক্ষণের মধ্যেই কক্ষে প্রবেশ করলে ন রাজকুমার।তাকে দেখতেই ধীর গতিতে উঠে বসলেন অতৃপ্তা।ত্রস্ত কদমে রাজকুমারের সামনে এগিয়ে গেলেন।তার হাত দুটো সযত্নে ধরে বললেন,
_আপনি নিজ হাতেই কি তলোয়ার চালিয়েছিলেন?কিন্তু রক্ত তো দেখছি না রাজকুমার?
অবাক হলো না অভিরুপ। দর্পনের সামনে গিয়ে দেহ থেকে পোশাক খুলতে লাগলো।রাজকুমারী আবারো বলে উঠলো,
_দাসীর অপরাধ কি ছিলো?
_তারা ষড়যন্ত্র করে তোমার মন বিষিয়ে দিয়েছে।
_তুমি এতটা পাষাণ কি করে?কেন করলে আমায় বিবাহ?এটা কি প্রেম ছিলো নাকি আমার প্রতি জেদ?আমি তো সইতে পারছি না এগুলো।
চিৎকার করে উঠলো রাজকুমার।দুহাতে ঝাপটে ধরলো অতৃপ্তার কাঁধ।চেচিয়ে বললো,
_আমিও সইতে পারছি না তোমার এই অতিরিক্ত বোধশক্তি।রাজ্য আমার।প্রজা আমার,দাসীও আমার।কিভাবে একটা রাজ্য শাসন করতে হয় সেটা আমি জানি।সামনের মাসে অভিষেক আমার রাজা হিসেবে।তুমি হবে মহারানী।আমার বিরুদ্ধে গিয়ে রাজ্যের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করো না।
রাজকুমার স্নানের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন।তবে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অতৃপ্তা।মূর্তির বেশে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন ফটকের দিকে।রাজকুমার কক্ষ ত্যাগ করতেই ভেতরে প্রবেশ করলো হাফিজা।রাজকুমারী অতৃপ্তার উদ্দেশ্যে কেঁদে কেঁদে বললো,
_রাজকুমারী,কি হয়েছে আপনার?আপনি এসব সহ্য কেন করছেন?চলুন রাজ্যে ফিরে যাই।
নিস্তব্ধতায় ছেঁয়ে চুপটি করে তাকিয়ে রইল অতৃপ্তা।কিছু সময় পর ভাঙা স্বরে বললো,
_আরেকটু চেষ্টা করি।
চলবে?