চন্দ্রকথা পর্ব-০৭

0
50

#চন্দ্রকথা
সিমরান মিমি
সপ্তম পর্ব

নিকষ কালো আঁধারে ছেঁয়ে গেছে চন্দ্রনগরের প্রাসাদ।যেন কোনো অভিশপ্ত ছায়া পড়েছে রাজ্যের উপর।পুরো আকাশ জুড়ে নেই কোনো তারার আলো।চাঁদ ও যেন লুকিয়ে পড়েছে ওই ছাইরঙা মেঘের নিচে।হয়তো সেও আলো দিতে অস্বীকার জানাচ্ছে এই প্রাসাদকে।কক্ষের ডানদিকে বিশাল বড় জানালা।তার সামনে বসেই আঁধারে ঘেরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রাজকুমারী।চোখে-মুখে তার এক বুক হাহাকার।এ কেমন বন্ধন?কই বিবাহের পূর্বে তো এমন মায়ার আবির্ভাব কখনো ঘটেনি।সে তো অন্যায়ের দ্বারস্থ হতেই সগর্বে বুক ফুলিয়ে শাস্তি দেওয়ার প্রয়াসে এগিয়ে গেছে।আপন-পর কখনো হিসেবে মেলায় নি।তাহলে আজ কেন সুযোগের পর সূযোগ দিচ্ছে রাজকুমারকে।কেন মন বারংবার করজোড়ে মিনতি করে সায় জানাচ্ছে – আরেকটু চেষ্টা করাতে।কেন?এই অপরাহ্ণেই আজ টানা চার দিন পর মহারানীর কক্ষে ঢুকেছিলো সে।অথচ তাকে দেখে খুশি হওয়ার পরিবর্তে যেন রানী ভীষণ ভাবে মলিনতায় ডুবে গেলেন।কোনো রকম কুশল বিনিময় তো ছাড় বরং নববধুকে প্রথমেই প্রশ্ন ছুঁড়েছেন : “কেন এসেছো এ কক্ষে?”

এই প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে গেছিলেন রাজকন্যা।বিস্ময়ের চোখে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ।তারপর ক্ষণেই কন্ঠে তেজ এনে শাশুড়ীর উদ্দেশ্যে ছুঁড়েছিলো একের পর এক প্রশ্ন।

_রাজকুমার একজন পাষাণ হৃদয়ের পুরুষ।অলস,নেশাখোর এবং নারীলোলুপ এমন দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য আপনি কি করে আমায় পছন্দ করতে পারেন রানীমা;যেখানে আমার পিতাকে আপনি ভ্রাতা সম্বোধন করেন?বিনা দোষে ঠুনকো কিছু ভুলের কারনেই যেই রাজকুমার দাসীর প্রাণ নেয় সে কি করে আমার মতো একজন কোমল নারীর যোগ্য হয়?কেন আপনি আমার জীবন টা নষ্ট করলেন?কেন এই প্রাসাদের সবকিছু অস্বাভাবিক?কেন প্রজারা সবসময় আতংকে থাকে?আমার উত্তর দিন রানীমা।

এতো সব প্রশ্নের মধ্যে রানী পারমতি চুপ করে রইলেন।ব্যর্থ হয়ে হতাশ চোখে কক্ষ হতে বের হওয়ার প্রয়াস করতেই থেমে গেল।ক্ষোভের দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে রানী পারমতির উদ্দেশ্যে বললো,

-আপনি সন্তানকে সু শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেন নি রানীমা।মেনে নিন।

এ পর্যায়ে চোখে-মুখে উজ্জ্বলতা নিয়ে তাকালেন রানী।বললেন,

_বেশ!আমি না হয় সন্তান মানুষ করতে পারে নি।তাহলে নিজের স্বামীকে এবার তুমি মানুষ করে দেখাও।

“মানুষ করবে,কিভাবে মানুষ করবে অতৃপ্তা?একজন বুঝদার লোককে কি করে ঠিক-ভুল বোঝাবে?ভাবতে লাগলো অতৃপ্তা।এর মধ্যেই কক্ষে প্রবেশ করলো রাজকুমার। অতৃপ্তাকে জানালার দিকে দাঁড়ানো দেখে বিরক্ত হলো।সে কিছুক্ষণ কক্ষে হাঁটাহাঁটি করে পালঙ্কে বসলো।অথচ তার কোনো দিশাই নেই।একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

-অনেকক্ষণ আকাশ দেখেছো।এখন জানালা বন্ধ করে পালঙ্কে এসো।

চমকে পিছু তাকালো অতৃপ্তা।উদাম গায়ে পালঙ্কে পিঠ ঠেকিয়ে তার’ই অপেক্ষায় বসে আছেন রাজকুমার।সেদিকে তাকিয়ে ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। কক্ষের এক প্রান্তে ছোট্ট কুড়েঘর টার ভেতর থেকে বনবিড়াল কে কোলে নিলো।এর বুকের সাথে আলগোছে চেপে ধরে আসনে আঁধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো।

ক্রমে রাগ তরতর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে রাজকুমারের।দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিলো।এক ঝলক অতৃপ্তা তো অন্য ঝলক বনবেড়ালের দিকে তাকালো। রাজকুমারের ভয়ানক চাহনিতে বেড়ালটা যেন ভয় পেয়ে আরো লেপ্টে রইলো রাজকুমারীর বুকের সাথে।দপ করে জ্বলে উঠলো অন্তর।চোখ দুটো বন্ধ করে ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠে অতৃপ্তার উদ্দেশ্যে বললো,

_পালঙ্কে ডেকেছি আমি।অপেক্ষা করছি।

বুক ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অতৃপ্তা।মলিন কন্ঠে বললো,

-আমার শরীর টা বড্ড খারাপ রাজকুমার।এখানে আরাম পাচ্ছি।ভাবছি,রাত টা এখানেই যাপন করবো।আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন।

এরপর আবারো চোখ বন্ধ করে নিলো।কিন্তু বন্ধ হলো না আরেকটি তেজপূর্ণ, হিংস্র,পৈশাচিক চোখ।যেটি জ্বলতে লাগলো সারাটি রাত ধরে।

ভোরের আলো ফুঁটে গেছে ইতোমধ্যে। চারপাশে নানা পাখ-পাখালির কিচির মিচির শব্দে নিদ্রা ভেঙে গেলো অতৃপ্তার।কাঁত হয়ে মোড় ঘুরতেই আটকে গেল কারো শক্ত বাহুবন্ধনে।চোখ খুলে তাকাতে ই দৃষ্টি গেল পরিচিত লোমশ প্রশস্ত বুকটার উপর।ঠোঁট এলিয়ে হেসে দিলো অতৃপ্তা।ঘুম ঘুম চোখে আলতো ঠোঁটে চুমু খেল বুকটার উপর।অভিরুপ বন্ধন আরো গাঢ় করলো।বউয়ের গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বললো,

_আমার ভোরের সতেজ পদ্মফুল।অহং ত্বাং প্রেমামি।

লজ্জায় রাজকুমারের বুকের সাথে মিইয়ে গেল অতৃপ্তা।ভাঙা গলায় শুধালো : ”অহং অপি ভবন্তং প্রেমামি।”

বলেই চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।সাথে সাথেই সম্বিত ফিরে পেল।মস্তিষ্কে গাঁথলো রাজকুমারের চিরচেনা রুপ।মুহুর্তেই নিজেকে গুঁটিয়ে নিলো অভিরুপের কাছ থেকে।পালঙ্ক ছেড়ে আলতো পায়ে নেমে কক্ষ ত্যাগ করলো।ফটক খুলতেই সম্মুখে নিঃশ্বব্দে কান্নারত প্রিয় দাসী হাফিজা কে দেখলো।কিছু বুঝে ওঠার প্রয়াস করতেই হাফিজা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো।

_কি হয়েছে দাসী?আমায় বলো।

কিছু বলতে পারলো না হাফিজা।চরম সাহস নিয়ে সখীরুপি রাজকন্যার হাত এগিয়ে গেলো প্রাসাদের সম্মুখ প্রান্তের ঘাসভর্তি পরিচ্ছন্ন মাঠ টায়।সিঁড়ির কাছে যেতেই থমকে গেলো রাজকন্যা।মাঠের মধ্যখানে সাদা তুলোর মতো কিছুর অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। ছুঁটে তার কাছে গেল।মস্তক ছিন্ন ছোট্ট পিঞ্জর কে দেখতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো।কিন্তু ওই নিথর দেহ টাকে ছোয়ার সাহস হলো না।পাথরের মূর্তির ন্যায় স্তব্ধ চোখে দাঁড়িয়ে রইলো।সময় গড়ালো, কিন্তু রাজকুমারীর এমন দশা থেকে সইতে পারলো না হাফিজা।তাকে জড়িয়ে ধরলো সান্নিধ্যে। কিন্তু সেই সান্নিধ্য গ্রহণ করলো না অতৃপ্তা।দাসীকে সরিয়ে দিয়ে কঠোর চিত্তে প্রাসাদের দিকে অগ্রসর হলো।নিজ কক্ষের সামনে যেতেই দেখলো রাজকুমার তার পোশাক পরিধান করছে।অতৃপ্তার চোখে নেই কোনো জল।আর নেই মুখশ্রীতে কোনো বিষাদের ছোয়া।ত্রস্ত পায়ে অভিরুপের সামনে দাঁড়ালো।বললো,

-নিদ্রায় যাওয়ার আগে পিঞ্জর আমার কাছেই ছিলো।এরপর আমাকে তুমি পালঙ্কে নিয়েছো।কিন্তু পিঞ্জর কোথায়?

কোনোরকম ভাব-ভঙ্গি দেখা গেলো না অভিরুপের মধ্যে;যেন সে কিছু শোনেই নি।অতৃপ্তা কঠোর চাহনি নিয়ে দৃষ্টি দিলো অভিরুপের দিকে।দুহাত দিয়ে বুকে স্বজোরে ধাক্কা দিলো।বললো,

-কাপুরুষের মতো কথা এড়িয়ে কেন যাচ্ছো?শিঁরদাঁড়া বাঁকা নাকি?

অভিরুপ নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো অতৃপ্তাকে।দুগাল চেপে ধরে হিংস্র কন্ঠে বললো,

_গতরাতে আমায় অবজ্ঞা করে একটা নিকৃষ্ট প্রাণী নিয়ে শোয়ার আগে এ কথা ভাবা উচিত ছিলো।বেড়াল দেওয়ার সাথে সাথে সাবধান ও করেছিলাম।

চোখের জল গড়িয়ে গালে পড়লো অতৃপ্তার।প্রচন্ড ঘৃণা এবং বিতৃষ্ণা নিয়ে দুহাতে স্বজোরে ধাক্কা দিয়ে দর্পনের উপর ফেললো।বলশালী শরীর টা দর্পনের উপর পড়তেই সেটা চুরমার শব্দে ভেঙে গেলো।অতৃপ্তা দাবানলের গতিতে পেছনে ঘুরে দেয়ালে ঝোলানো তলোয়ারের হাতল ধরে টান মেরে হাতে আনলো।এরপর একহাতে অভিরুপকে দর্পনের কাঠের টেবিলের উপর চেপে ধরে গলায় ধাঁরালো তলোয়ার টা চেপে ধরলো।ভাঙা দর্পনের কাঁচে পিঠ এবং বাহু কেঁটে গেছে ইতোমধ্যে। এরইমধ্যে অবস্থা বেগতিক দেখে অতৃপ্তার হাত চেপে ধরে তলোয়ার টা নিজের হাতে নিলো।এরপর ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো আসনের উপর।একহাতে অতৃপ্তার দুহাত চেপে ধরে গলায় চেপে ধরলো তলোয়ার।ক্ষোভ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

_আলাদা করে দেই মাথাটা?একেবারে তোমার পিঞ্জরের মতোই।

ব্যাথায় বিষিয়ে উঠলো অতৃপ্তার হাত।চোখ দুটো খিঁচিয়ে বন্ধ করে শুধু বললো,

_নরপশু!

তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলো অভিরুপ।তলোয়ার টাকে ছুঁড়ে কক্ষের অপর প্রান্তে ফেললো।দুহাতে অতৃপ্তাকে কোলে তুলে নিয়ে পালঙ্কে ছুঁড়ে ফেললো।গায়ে পরিহিত পোশাক টাকে খুলে পুণরায় ছুঁড়ে মারলো জমিনে।এক হাত মুড়িয়ে পিঠের কাঁটা স্থানের রক্তের অস্তিত্ব পেতেই ক্ষোভ নিয়ে তাকালো অতৃপ্তার দিকে।বললো,

-এই তোমার যুদ্ধ দক্ষতা?একজন নিরস্ত্র রাজকুমারের সামনে পরাজিত হয়ে পালঙ্কে বসে ফোঁপাচ্ছো।হাস্যকর!

ক্রমে ফুঁসে উঠছে রাজকুমারী।রক্তচক্ষু নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বললো,

-তোমার ভাগ্য অতিশয় ভালো যে আমার মায়া কাজ করছে।নাহলে এতোক্ষণে পিঞ্জরের মতোই এই জানোয়ারের দেহ টা দিখন্ডিত থাকতো।

চলবে?