চলার শেষ প্রান্তে পর্ব-০১

0
297

#চলার_শেষ_প্রান্তে(১)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সিরাজ আর তার স্ত্রী ফারিয়া’র মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়া হয়, কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সিরাজ মুখে তালাক দিয়ে বসে! পর-মুহূর্তেই মুখে হাত চাপা দেয় সে। রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে এ কি বলে ফেললো সে? অপরদিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ফারিয়া।
কথাটা উচ্চারণ করার পর মুহূর্তেই যেন নিজের কানে নিজের কথাই বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো ফারিয়ার দিকে। ফারিয়ার মুখের সব রঙ এক মুহূর্তে ফিকে হয়ে গেছে। চোখে বিস্ময়, ঠোঁট কাঁপছে।

আর সিরাজ? পরমুহূর্তেই মুখে হাত চেপে ধরলো। এ কী করলো সে! এ কী বললো!
রাগের মুহূর্তে নিজের জিভের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণই রাখতে পারেনি সিরাজ।

অবাক, ফারিয়া তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখে একরাশ অবিশ্বাস আর বুকভাঙা কষ্ট।
দুজনেই চুপ। দুজনের‌ই যেন নিজেদের মনের ভেতর একটা ঝড় বয়ে যেতে চলেছে।
কিছু শব্দহীন ঝড় ভাঙনের পূর্বাভাস।

নিজেকে ধাতস্থ করে ছুটে আসে ফারিয়ার কাছে। দুই হাতে ফারিয়ার কাঁদ চেপে ধরে বলল,
–” কিছু হয়নি, রাগের মাথায় বলে ফেলেছি, এগুলো মাথায় নিও না।

সিরাজের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে ফারিয়া চোখের পানি ফেলে বলল,
–” একদম ছোঁবেন না আমাকে। এই মুহূর্ত থেকে আপনি আমার কাছে একজন পরপুরুষ। এই দুইটা বছর আপনার মায়ের সমস্ত অত্যা/চার সহ্য করেছি শুধুমাত্র আপনাকে ভালোবেসে। আর আপনি এই প্রতিদান দিলেন?

সিরাজ থমকে গেল। ফারিয়ার কণ্ঠে যে কঠিন দৃঢ়তা, এতদিনে সে কখনো দেখেনি।
সে দু’পা এগিয়ে আবার ফারিয়াকে ছুঁতে চাইল, কিন্তু ফারিয়া এক পা পিছিয়ে গেল।
তার চোখ দুটো ভেজা, কিন্তু দৃষ্টিতে যেন আগু/ন জ্বল/ছে।

ফারিয়া কাঁপা কণ্ঠে আবারো বলল,
–” আপনার মায়ের অত্যাচারকে সহ্য করেছি, নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়েছি, সবকিছু মেনে নিয়েছি শুধু আপনাকে আঁকড়ে ধরার জন্য। কিন্তু আপনি! রাগের মাথায় যে জিহ্বা এত সহজে ‘তালাক’ উচ্চারণ করতে পারে, তার কাছে আর কিছুই আশা করিনা আমি।

সিরাজ বিছানায় বসে পড়ল ভেঙে পড়া এক মানুষর মতো। মাথা দু’হাতে চেপে ধরল সে।
তার গলা কাঁপছে, কণ্ঠ ভেঙে যাচ্ছে, তবুও বলল,
–” আমি তোমায় ছাড়া বাঁচ/বো না ফারিয়া। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি ভেবে কিছুই বলিনি, ভুল করেছি। আমি তুমাকে ছাড়া বাঁচ/বো না।”

ফারিয়া ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল,
–” ভুল? এই ভুলের পরিণতি ইসলামে কতটা গুরুতর, সেটা জানেন আপনি? তিনবার নয়, দুইবার উচ্চারণ করলেই তা কতটা ভয়াবহ, তা কি বোঝেন? আবেগের বশে মুখে চলে আসা শব্দও আল্লাহ্‌র কাছে রসিকতা নয় সিরাজ।

তারপর ফারিয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে দ্রুত খাটের পাশে রাখা নিজের ফোনটা বের করল। কাঁপা আঙুলে বাবার নাম্বার টা ডায়াল করতে গেল, ঠিক তখনই সিরাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোনটা ছিনিয়ে নিল তার হাত থেকে। কলটা কেটে দিল মুহূর্তেই।
–” ফারিয়া শুনো! প্লিজ! আমি বলেছি তো, এটা রাগের মাথায় হয়ে গেছে। তুমি যদি এখন তোমার বাবাকে বলো, তাহলে ব্যাপারটা আরও বড় হয়ে যাবে। প্লিজ, একটা সুযোগ দাও আমাকে?

বলতে বলতে সিরাজের গলা কেঁপে উঠল।

ফারিয়া অবিশ্বাস ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো সিরাজের দিকে। তার গলার স্বর কঠিন, চোখ দুটো রক্তবর্ণ। তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখ থেকে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
–” আপনার জন্য আজ আমি নিজের সম্মানও বিসর্জন দেবো? আমি কি এতটাই তুচ্ছ আপনাদের কাছে?”

সিরাজ ব্যাকুল হয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল,
–” আমি তোমাকে হারাতে চাই না ফারিয়া। প্লিজ, এই একবার আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি কসম করে বলছি, আর কখনও এমন কিছু হবে না।

কিন্তু ফারিয়া নির্দয় চোখে তাকিয়ে বলল,
–” ভালোবাসা যদি সম্মানহীন হয়, তা ধরে রাখার কোনো মানে হয় না সিরাজ। আমি নিজেকে আর ছোট করবো না।

তার কণ্ঠে ছিল এক অনড় সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা।
তারপর সে শক্ত হাতে সিরাজের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিল। সিরাজ তাকে আটকাতে গিয়ে আবারো বলল,
–” শুনো না! খালুকে কিছু বোলো না! আমরা নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নিতে পারি। আমি চাই না কেউ জানুক।

ফারিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল এবার, গলার স্বর ভেঙে গেল,
–” নিজের মুখে তালাক দিয়ে এখন লুকাতে চাইছেন? আপনার ইজ্জত রাখতে আমি নিজের ইজ্জত বিসর্জন দেবো না!

ফোনে আবার বাবার নাম্বার ডায়াল করল ফারিয়া।
সিরাজ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো মেঝেতে, চোখে হতাশার ছায়া নিয়ে। কি ভেবে আবারো ফারিয়ার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে এবার কন্ঠস্বর পাল্টে বলল,
–” কাউকে কিছু বলতে পারবে না তুমি। আমি বলতে দিব না।

ফারিয়া আবারো ফোন নিতে চাইলো কিন্তু সিরাজের বলিষ্ঠ দেহের সাথে পেরে উঠলো না।

তারপর ফারিয়া দ্রুত চোখের পানি মুছে একরাশ কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে বলল,
–” আমি এখানেই এই সম্পর্ক শেষ করছি। আমার আত্মমর্যাদা আপনাদের সংসারে আরও ক্ষতবিক্ষত হোক, তা চাইনা।

সে দ্রুত আলমারি খুলে, কয়েকটা দরকারি জামা-কাপড় ব্যাগে ভরে নিল।
সিরাজ ছুটে এল, ব্যাগটা ফারিয়ার হাত থেকে টানতে চাইল, কিন্তু ফারিয়া এবার কঠিন এক দৃঢ়তায় হাত সরিয়ে নিল। আরো দিগুন রা গ নিয়ে বলল,
–” যদি সামান্যতম সম্মান থাকে আমার প্রতি, তাহলে আমাকে থামানোর চেষ্টা করবেন না। আমি চলে যাচ্ছি।

এরমধ্যে সিরাজের মা বাড়িতে ফিরলেন। তিনি পাশের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঘরে ঢুকেই দেখলেন অদ্ভুত এক দৃশ্য,
ফারিয়া কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগ গোছাচ্ছে, আর সিরাজ ব্যাকুল মুখে তাকে থামাতে চাইছে।
গম্ভীর কণ্ঠে গলা চড়িয়ে বললেন সিরাজের মা,
–” এ কী হচ্ছে এখানে?

শাশুড়ি মায়ের কথা শুনতে পেয়ে এতোক্ষণে নিজের রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে সিরাজের বড় ভাইয়ের বউ। এতোক্ষণ রুমে বসে সবকিছুই শুনেছে সে কিন্তু বেরিয়ে আসেনি। দেবর আর তার ব‌উয়ের ঝগড়া শুনতে বেশ লাগছিল তার। এখন শাশুড়ি মায়ের গলা শুনে বেরিয়ে আসে।

এদিকে ফারিয়া কোনো উত্তর দিল না। চোখ মুছে ব্যাগের চেইন টানল। সিরাজ অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে।
–” মা, ফারিয়া চলে যেতে চাইছে।

সংক্ষেপে সবটা মাকে বলল সিরাজ।

সিরাজের মা মুহূর্তে পরিস্থিতির গাম্ভীর্য বুঝলেন।তার চেহারায় বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। তিনি গর্জে উঠে বললেন,
–” চলে যেতে চাইছে মানে? এত সাহস কোথা থেকে পেল? দু’দিনের মেয়ে হয়ে এখন আমাদের মানসম্মান নষ্ট করতে চায়?

তারপরে তিনি ফারিয়ার দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন,
–” এই ঘরে তোমাকে বিয়ে করে এনেছে আমার ছেলে। এই ঘর ছেড়ে যাওয়ার সাহস দেখাচ্ছো? তাও এমন ছোট্ট একটা কারণে?”

ফারিয়া মুখ তুলে তাকাল, চোখে বিস্ময় আর ক্ষো/ভ। তবুও শান্ত গলায় উত্তর দিল,
–” তিন তালাক আপনার ছেলে মুখে উচ্চারণ করেছে। ইসলামে এটার কী মানে, সেটা নিশ্চয়ই আপনিও জানেন। এই ঘরে আমার আর কোনো অধিকার নেই।

সিরাজের মায়ের মুখে কিছুক্ষণ কথা আটকে রইল। তারপর জিদ আর গোঁড়ামিতে ফেটে পড়লেন তিনি,
–” রাগের মাথায় একটা কথা বেরিয়ে গেলে কি ঘর ভেঙে যাবে? এক কথায় তালাক হয় না, বুঝেছো? আজকালকার মেয়েরা একটু হলেই নিজের ইজ্জত, নিজের সম্মান, এসব মুখে আনে। বিয়ে টিকিয়ে রাখতে জানতে হয়, ছাড়াছাড়ি করতে নয়!

ফারিয়া এবার কঠিন হয়ে বলল,
–” আপনার ছেলের বলা কথা যদি তুচ্ছ হয়, তাহলে আমার চোখের জলও তুচ্ছ ভাবুন। আমি কোনো তর্কে যাবো না। আমি শুধু নিজের সম্মান রক্ষা করতে চাই।
–” আমি এতো কথা শুনতে চাই না তোমার থেকে। এসব নাটক বাদ দিয়ে যাও গিয়ে রান্না বসাও!

ফারিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। তাকে কাজের জন্য‌ই প্রয়োজন তাদের, তাছাড়া আর কিছু নয়….

#চলবে?