#চলার_শেষ_প্রান্তে(২)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
বোনকে অগাধ বিশ্বাস করে একমাত্র মেয়েকে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সাহানা বেগম। ভাবেননি, আপন বড় বোনের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে এমন নির্মম রূপ।
ফারিয়ার বিয়ের কয়েক মাস পরই সিরাজ বিদেশে চলে যায়। আর তখনই শুরু হয় ফারিয়ার দূর্বিষহ দিনগুলি।
সিরাজের অনুপস্থিতিতে তার মা, অর্থাৎ ফারিয়ার খালার অত্যাচার দিনে দিনে বাড়তে থাকে।
কখনো রান্নায় সামান্য ভুল হলে গালিগালাজ, কখনো ভরদুপুরে কাজের বাহানায় বিশ্রাম না দেওয়া, আবার কখনো অকারণে অপমান।
ফারিয়া মনের কষ্টে কাঁদত, কিন্তু সিরাজকে কিছু বলত না। ভেবেছিল একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। স্বামীকে কষ্ট দিতে চায়নি কখনো।
ফোনে কথা বলার সময় ফারিয়া হাসিমুখে কথা বলত, চাপা দুঃখ লুকিয়ে রাখত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার সেই কৃত্রিম হাসিও ফিকে হতে শুরু করেছিল। মাঝে মাঝে কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠত, অজান্তেই চোখের কোনা ভিজে উঠত।
কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফারিয়া তার শাশুড়ির কথা বললে উল্টো সিরাজ রে/গে কল কেটে দিত।
কারণ আগেই সিরাজের মা তার কানে নানান উল্টোপাল্টা কথা ঢালতে শুরু করে,
–” ফারিয়া ঠিকমতো কাজ করে না। আমাদের অপমান করে কথা বলে। শখ করে ছেলের বউ করে নিয়ে এসে এখন হারে হারে টের পাচ্ছি।
সিরাজ শুরুতে বিশ্বাস করতে চায়নি।
কিন্তু দিনের পর দিন যখন একই কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন মায়ের কথাতেই সন্দেহের বিষবৃক্ষ গেঁথে গেল মনে। ফারিয়ার নিষ্পাপ চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা না করেই সে মায়ের কথাকে সত্যি ভেবে নিল। ফলে, হঠাৎ করেই সিরাজ ফোনে কথা বলা কমিয়ে দিল।
অনেকদিন ফোন না করলে ফারিয়া নিজেই ফোন করত, আর সিরাজ বিরক্ত স্বরে বলত,
–” ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলবো।
ফারিয়ার বুকের ভেতরটা তখন মুচড়ে উঠত।
স্বামীর কাছে একটু ভালোবাসার আশ্রয় খুঁজেছিল সে, কিন্তু সেই মানুষটিই আজ অবহেলার দেয়াল তুলেছে তার সামনে। একে তো সংসারের নিত্যদিনের অশান্তি, তার উপর স্বামীর এমন ব্যবহারে ফারিয়া ভেঙে পড়ল আরও বেশি।
কান্না আর আড়াল করা কষ্টের মাঝেই চলছিল তার দিনগুলি। মাঝরাতে বিছানায় চুপিচুপি কাঁদত। মনে মনে দোয়া করত,
–” আল্লাহ! আমাকে সবর দাও। আমাকে সহ্যশক্তি দাও।
.
.
যখনই ফারিয়া বাবার বাড়ি আসত, মায়ের কাছে বসে চোখের জল ফেলে সমস্ত কষ্টের গল্প শোনাতো। মায়ের বুকটা ফেটে যেত কষ্টে, কিন্তু সাহানা বেগম লোকলজ্জার ভয়ে শক্ত মুখ করে বলতেন,
–” ভাগ্যে আছে মা। কী করবি? মানিয়ে নে। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েদের জীবনে বিয়ে একবার ই হয়। এখন যদি ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, আত্মীয়-স্বজনের কাছে মুখ দেখাবো কিভাবে?
আমারই তো আপন বোন! কে জানে কার মনে কী আছে? আগে যদি জানতাম, তোকে ও বাড়িতে বিয়ে দিতাম?
মায়ের কথায় ফারিয়া যেন আরো অসহায় হয়ে যেত। ভেতরটা চিৎকার করে উঠত, কিন্তু মুখে কিছু বলত না। চোখের পানি লুকিয়ে আবার ফিরে যেত সেই বাড়িতে, আবারও সহ্য করত সব অপমান, সব যন্ত্রণা শুধু এই আশায় যে একদিন বোধহয় সত্যিই সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু সময় তো কারো জন্য থেমে থাকে না। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ফারিয়ার আত্মমর্যাদা ভাঙতে ভাঙতে একদিন একেবারে চুরমার হয়ে গেল। সিরাজের অবহেলা, মায়ের বিষা/ক্ত কথা আর সংসারের নির্যাতন মিলে ফারিয়াকে শেষ করে দিল ধীরে ধীরে। ভেতরটা মৃ/ত একটা শরীরে পরিণত হচ্ছিল।
আর আজ…
আজ সেই চাপা ব্যথা, জমে থাকা সব অসম্মান আর অবহেলার পাহাড় এক ঝড়ের মতো ফুঁসে উঠেছে। একটা শব্দের ভেতর দিয়ে সবকিছু শেষ করে দিয়েছে সিরাজ নিজেই তালাক দিয়ে।
এখন আর কোনো মানিয়ে নেওয়া নেই। এখন আর কোনো লোকলজ্জার হিসাব নেই। ভাঙা সম্পর্কের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে ফারিয়া আজ নিজের অস্তিত্বটাকেই বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
.
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল কিন্তু সিরাজ কিছুতেই ফারিয়া কে যেতে দিচ্ছে না। তাছাড়া ফারিয়ার ফোনটাও দিচ্ছে না। সিরাজের মা বিরক্ত হয়ে বললেন,
–” এই মেয়েকে যেতে দে সিরাজ। তোর জন্য অনেক ভালো বউ খুঁজে এনে দিব!
এমন পরিস্থিতিতে মায়ের এমন কথায় রে গে যায় সিরাজ। ধমকের স্বরে বলল,
–” অনেক হয়েছে মা। তুমি আর কিছু বলতে এসো না। এক হাতে তালি বাজে না কখনো। আমি এখন বুঝতে পারছি আজকে তোমার জন্যই সবকিছু হয়েছে। আমাকে উল্টো পাল্টা কথা বলে মেজাজ খারাপ তুমি করেছো।
সিরাজের কথা শুনে তার মা যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন। এমন করে তো কখনো কথা বলেনি তার ছেলে! গলার স্বর কঠিন ছিল, চোখ দুটো রা/গে টকটক করছিল।
ফারিয়া বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সিরাজের দিকে।
এতদিন পর হলেও সত্যটা এক মুহূর্তে বেরিয়ে এসেছে! কিন্তু এখন আর কিছুতেই মনের ক্ষত সেরে উঠবে না তার। ভেঙে যাওয়া ভরসা আর ফিরে আসবে না।
সিরাজ এবার ব্যস্তভাবে ফারিয়ার হাত ধরে বলল,
–” ফারিয়া, প্লিজ যেও না। ভুল হয়ে গেছে। সব ঠিক করে নেবো। তোমার কাছে কথা দিচ্ছি, আজ থেকে কিছুই আগের মতো থাকবে না।
ফারিয়া নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হাত সরিয়ে নিল।
চোখের কোণে শুকিয়ে যাওয়া জল, ঠোঁটে কঠিন এক রেখা। শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
–” বিশ্বাস কাঁচের মতো। একবার ভেঙে গেলে যতই জোড়া দেন, দাগ থেকেই যায় সিরাজ।
আজ যদি আপনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন, তাহলে সেটাই আপনার শিক্ষা।
কিন্তু আমার জন্য দেরি হয়ে গেছে।
আমি আর এই অসম্মানের জীবনে ফিরতে পারবো না।
কিন্তু সিরাজ নাছোড়বান্দা। কিছুতেই ফারিয়াকে ছাড়বে না। মনে হচ্ছিল, যেন এতো দিনের জমে থাকা ভালোবাসা এক সাথে উথলে উঠেছে। এরই মধ্যে সিরাজের ভাবি এগিয়ে এসে বলল,
–” আমি ফারিয়াকে বুঝিয়ে বলছি। তুমি রুমে চলে যাও।”
সিরাজ যেন এক টুকরো আশার আলো দেখতে পেল। না চাইতেও মাথা নিচু করে নিজের রুমে চলে গেল। অথচ রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তার ভাবি এমনভাবে জোরে জোরে বলল, যেন সিরাজ স্পষ্ট শুনতে পায়,
–” মানুষ মাত্রই ভুল করে। আর যে ক্ষমা করতে জানে, সেই-ই মহৎ।
এরপর ফিসফিস করে ফারিয়াকে বলল,
–” আমার ফোন দিয়ে তোমার বাবাকে কল করো। বলো, এসে তোমাকে নিয়ে যেতে। না হলে এই ছেলে কিছুতেই তোমাকে ছাড়বে না। নিজের সম্মান বাঁচাতে হলে তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও।
ভাবির কথা শুনে প্রথমে ফারিয়া কিছুটা অবাক হয়ে গেল। পরে মনে মনে একরকম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।
এই মহিলা যিনি কখনও তাকে আপন করে নেননি, বরং শাশুড়ির কান ভরে ফারিয়াকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে আজও চাইছে ফারিয়া যেন দ্রুত এ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তবে অবাক করা ব্যাপার, নিজের অজান্তেই হয়তো তার ভালো চাইছে!
ফারিয়া আর দেরি করল না। চুপচাপ ভাবির হাত থেকে ফোনটা নিল। কিন্তু বাবাকে কল দিতে গিয়েও হাত থমকে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল বাবার শান্ত মুখ, মায়ের ভীত দৃষ্টি।
এভাবে হঠাৎ চলে গেলে কি বলবে সবাই? মনে মনে দ্বিধা জাগল তার।
ভাবি আবার ফিসফিস করে তাগাদা দিল,
–” তাড়াতাড়ি করো। এই ছেলে একেবারে পাগল হয়ে গেছে। যেকোনো সময় চলে আসতে পারে।
হাত কাঁপলেও ফারিয়া অবশেষে বাবার নাম্বারে ডায়াল করল। ফারিয়ার বাবা কল রিসিভ করতেই বলল,
–” আব্বু তুমি এক্ষুনি একবার এখানে আসতে পারবে? ভীষণ দরকার ছিল।
ওপাশ থেকে বাবার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ভেসে এল। তাই বাবাকে শান্ত রাখতে ফারিয়া বলল,
–” না কিছু হয়নি। প্লিজ আসো?
মেয়ে যতই না করুক কিছু তো একটা হয়েছে এই ভেবে চিন্তায় পড়ে গেলেন মতিন সাহেব। তবে দ্রুত আসার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
এদিকে কল কেটে ফারিয়া ফুঁপিয়ে উঠল না। নিজেকে শক্ত রাখল। জানালার বাইরে তাকিয়ে নির্লিপ্তভাবে আকাশের মেঘ দেখল।
বাতাসে ঝড়ের পূর্বাভাস। ঠিক তার নিজের জীবনেও যেন এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ দরজার আড়াল থেকে সিরাজের নিঃশব্দ পায়ের শব্দ পেল। ছেলেটা যেন গোপনে তাকিয়ে আছে, অপেক্ষা করছে কখন ফারিয়া তাকে আরেকবার সুযোগ দেবে। কিন্তু ফারিয়া আজ দৃঢ়। আর কোনো ভুল নয়। আর কোনো আবেগের জায়গা নয়……
#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।