চলার শেষ প্রান্তে পর্ব-০৯

0
11

#চলার_শেষ_প্রান্তে(৯)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

ফারিয়া চোখ নামিয়ে নিয়ে শান্তভাবে একপাশে সরে দাঁড়ায়। ছেলেটিও লজ্জায় কিছু না বলে দ্রুত উপরের দিকে উঠে যায়, যেন কিছুই ঘটেনি।

ফারিয়া নিচে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে যায়। তখনও তার মনে একটু অস্বস্তি কাজ করছিল। ছেলেটিকে আগে কখনো দেখেনি।

টিউশনিতে যাওয়ার পথে ফারিয়ার মনে পড়ে আব্বু বলেছিলো এই মাসে নতুন ভাড়াটিয়া উঠবে। হঠাৎই মনে হল এই ছেলেটাই কি সেই নতুন ভাড়াটিয়া? তার হাবভাব, পরনে বাসার আরামদায়ক পোশাক, আর হাতে কাপড়ভরা বালতি সবকিছুই যেন মিলিয়ে যাচ্ছে বাবার বলা বর্ণনার সঙ্গে।

দিনের বেলা টিউশন শেষে বাসায় ফিরে ফারিয়া রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ মা ডেকে বললেন,
–” ফারিয়া, নিচের বাসায় যে নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে, ওর মা এসেছেন আজ। তোর বাবা বলল ছেলেটা বেশ ভদ্র, ছেলে নিজের পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য চেষ্টা করছে।

মায়ের মুখে শোনামাত্রই নিশ্চিত হয়ে যায় ফারিয়া সকালে সিঁড়িতে যে অদ্ভুত মুহূর্তটা হয়েছিল, সে ওই ছেলেটি!

কিন্তু সেই ‘ভদ্র ছেলে’ সম্পর্কে ফারিয়ার মনে ঠিক কেমন ধারণা তৈরি হলো তা সে নিজেও জানে না।
রাতে নীরবতা ভেঙে আব্বুকে ডেকে ফারিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–” আব্বু, কাজটা কিন্তু একদম ঠিক করোনি তুমি।

মতিন সাহেব কিছুটা বিস্মিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন,
–” কোন কাজের কথা বলছিস মা?

ফারিয়া বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
–” তুমি ভাড়াটিয়াদের ছাদে উঠার অনুমতি দিলে কেন? জানো না তোমার দুটি মেয়ে আছে? পুরুষ মানুষ ছাদে যাওয়া মানেই যে কোনো সময় আমাদের মুখোমুখি হয়ে যাওয়া। এটা কি তোমার উচিত হয়েছে?

মতিন সাহেব একটু অসহায় মুখে গভীর কণ্ঠে বললেন,
–” আমি তো চাইনি এমন হোক মা। কিন্তু দেখ, নিচতলাটা একদম অন্ধকার। ভিজে কাপড় শুকানোর মতো উপযুক্ত কোনো জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়েই ছাদ ব্যবহারের অনুমতি দিতে হয়েছে।

ফারিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” তোমার মেয়েদের নিরাপত্তার চেয়ে কাপড় শুকানোটা কি বেশি জরুরি ছিল, আব্বু?

মতিন সাহেব নিরুত্তর হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলেন।

পরের কয়েক দিন ফারিয়া লক্ষ্য করল, ছেলেটি খুব একটা বাড়ির বাইরে বের হয় না। এখন আর সকাল বেলায় ছাদে কাপড় শুকাতে যেতে দেখা যায় না। তবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চলাচল আছে। তখন ফারিয়া বুঝতে পারে নিশ্চয়ই আব্বু কিছু বলেছে।

তাছাড়া ফারিয়া চেষ্টা করে যতটা সম্ভব চোখে না পড়ে চলতে। সিঁড়িতে নামার সময় সাবধানে দেখে নেয় কেউ আছে কি না। নতুন ভাড়াটিয়া নিয়ে ওর মনে কেমন যেন এক অজানা অস্বস্তি।

একদিন বিকেলে মা যখন রান্না ঘরে ছিলেন, তখন নিচতলা থেকে একজন মহিলা ওপরে উঠে এলেন। বয়সে কিছুটা মধ্যবয়স্ক, মুখে মায়াবী হাসি। ফারিয়াকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
–” তোমার মা বাসায় আছে?

ফারিয়া ভদ্রভাবে জবাব দিল, তারপর মাকে ডেকে দিলো। একটু পরেই জানতে পারল এই ভদ্রমহিলাই সেই ছেলেটির মা। নাম তার সাগরিকা চৌধুরী।

ভদ্রমহিলা চলে গেলে সাহানা বেগম মুখ ফিরিয়ে ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
–” ছেলেটার নাম তাহসান। খুব ভদ্র এবং পরিশ্রমী। ওর মা বলছিল, ছেলেটা কোনো মেয়ের সঙ্গে মিশে না, সব সময় পড়াশোনা নিয়েই থাকে আজকালকার ছেলেদের মাঝে এমন ভাবা যায়?

মায়ের কথা শুনে ফারিয়ার মনে হালকা একটা বিরক্তি জেগে উঠল। মানুষ ভদ্র হতেই পারে, তাই বলে এতো মাথা ঘামানোর কী আছে?

তবে মুখে কিছু না বলে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেল সে। দরজা খোলাই থাকল, কিন্তু ফারিয়ার মনে যেন হালকা একটা বিরক্তির পর্দা নেমে এল।

ওদিকে সাহানা বেগম আর কিছু বললেন না। মেয়ের মুড বুঝে নিয়ে আবার রান্নার কাজে মন দিলেন। হাঁড়িতে তরকারির ঘ্রাণ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল পুরো বাড়িতে।
.
.
তাহসান মিয়াজী একজন মেধাবী তরুণ। ছাত্রজীবনে সে ছিলো বরাবরই প্রথম সারির, ফলাফল দেখে যে কেউ বলবে ভবিষ্যত নিশ্চয়ই উজ্জ্বল। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম। দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেও সে এখনো একটি ভালো চাকরির সন্ধান পায়নি।

তবে তাহসান থেমে থাকেনি। বেকার হলেও বসে নেই সে। ঘরে বসেই ছোটখাটো কাজ করে কিছু অর্থ উপার্জন করছে। সেই আয়ে কোনোমতে চলে যাচ্ছে মা, বাবা আর ছোট বোনের খরচ। কিন্তু তাহসান জানে, এভাবে আর কতদিন?

জীবনের গতি এক জায়গায় আটকে থাকতে চায় না। আজ না হোক, কাল তো তাকে বিয়েও করতে হবে। তখন তো এই সীমিত আয়ে সংসার চলবে না। এইসব ভাবনা তাকে প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তার গভীরে ডুবিয়ে দেয়। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা আর পরিবারের দায়িত্ব মিলিয়ে তাহসান এখন এক অদৃশ্য যুদ্ধের সৈনিক।

চাকরির চেষ্টা চলছে প্রতিদিনই, কিন্তু এখনো কোনো নিশ্চিত সুযোগ আসেনি তাহসানের হাতে। তাই বাধ্য হয়েই ঢাকার এক সস্তা ভাড়ার বাসায় ঠাঁই নিতে হয়েছে তাকে। নিজের মতো করে কিছু একটা করার তাড়না থাকলেও, বর্তমান বাস্তবতা যেন সবসময়ই টেনে ধরে তাকে।

বাসাটা এমন এক গলির ভেতরে যেখানে সূর্যের আলোও ঢুকার সুযোগ নেই। রুমগুলো ছোট, চারপাশে এমন অন্ধকার আর ঘনত্ব যে দিনের বেলাতেও ঘরে বাতি জ্বালিয়ে থাকতে হয়।

সবচেয়ে কষ্টদায়ক বিষয় হলো এই বাসায় কোনো আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ নেই। যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। আর মশা? সেটাকে যেন বাসার ‘স্থায়ী সদস্য’ বলা চলে। কয়েল, স্প্রে, মশারি সব ব্যবহার করেও তাদের তাণ্ডব থামানো যায় না। রাতের বেলা ঘুমানোর চেয়ে যুদ্ধ করাটাই যেন সহজ। বাড়ি ওয়ালার মেয়েদের জন্য ছাদে যাওয়া ও নিষেধ তাহসান এর। তবে তার মা আর বোন যেতে পারে এটাই অনেক।

এতো কিছুর পরেও তাহসান হাল ছাড়ে না। ঘরের চারপাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে সে ভাবতে থাকে একদিন নিশ্চয়ই দিন বদলাবে। এই দুঃসময় একদিন শেষ হবে। আর সেই আশাতেই প্রতিদিন সে নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করে যায়, অন্ধকার ঘরে বসেও ভবিষ্যতের আলোর পথ খোঁজে।
.
.
কয়েক মাস পর,
সেদিন বিকেলটা ছিল একটু ভিন্নরকম। আকাশটা সারাদিনই মেঘলা ছিল, কিন্তু ফারিয়া টিউশন শেষে বাসার পথে হাঁটা শুরু করেছিল নির্ভয়ে। ভাবছিল, পৌঁছানোর আগেই বুঝি বৃষ্টি নামবে না। কিন্তু হঠাৎ করেই এক তীব্র দমকা হাওয়ার সাথে আকাশ যেন ধুয়ে দিতে লাগলো সবটা। বৃষ্টি শুরু হলো অঝোর ধারায়।

চারপাশে কোথাও ঠাঁই নেই। রাস্তায় দাঁড়ানোর মতো কোনো ছাউনি বা দোকান চোখে পড়লো না। কিছুটা সামনে দোকান থাকলেও সেখানে পুরুষ মানুষের সমাগম তাই বাধ্য হয়ে বৃষ্টির মধ্যেই ফারিয়া বাসার দিকে হাঁটা শুরু করল। পাঁচ-সাত মিনিটের রাস্তা, তবুও এই সময়েই পুরো ভিজে যাবে এটা নিশ্চিত।

হঠাৎ একটা পা দৌড়ে এসে থামল তার পাশে। চোখের সামনে ছড়িয়ে গেলো এক ছাতার ছায়া।
ছেলেটি ভদ্রস্বরে বলল,
–” ছাতাটা নিয়ে যান। না হলে জ্বর-সর্দি লেগে যাবে। বছরের প্রথম বৃষ্টি শরীরের জন্য ক্ষতিকর হয়।

ফারিয়া চমকে তাকিয়ে দেখে এই মুখটা তার অপরিচিত নয়। একদিন সিঁড়িতে মুখোমুখি হয়েছিল এই ছেলেটির সাথে। তাদের ভাড়াটিয়া। চোখে একরকম শান্ত ভদ্রতা, কণ্ঠে সতর্কতা, আর আচরণে একধরনের সম্মান।

ফারিয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
–” আপনার ছাতা আমাকে দিয়ে দিলে আপনি নিজেই তো ভিজে যাবেন।

ছেলেটি মৃদু হেসে জবাব দেয়,
–” আমি ভিজলে অসুবিধা নেই। আপনি কেবল নিরাপদে বাসায় পৌঁছান, এটাই যথেষ্ট।

সে মুহূর্তে ফারিয়ার বুকের ভেতর যেন হালকা কাঁপুনি উঠল। না ঠান্ডায়, না বৃষ্টিতে এটা ছিল এক অজানা অনুভূতি। তবে কথায় কথা বাড়ে, ফারিয়া কথা আর বাড়াতে চাইছে না সে জন্য ছাতাটা নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিল।

এদিকে তাহসান মনে মনে ভাবলো,
–” কি মেয়েরে বাবা! মানুষ একটা ধন্যবাদ তো দেয়….

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।