চলার শেষ প্রান্তে পর্ব-১০

0
10

#চলার_শেষ_প্রান্তে(১০)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

বৃষ্টি মানেই যেন প্রকৃতির অশ্রুপাত নয়, বরং হৃদয়ের গোপন অনুভবগুলোর নরম পরশ। প্রতিটি ফোঁটা এসে মাটিতে পড়ে যেমন মিষ্টি সুর তোলে, ঠিক তেমনই কারো হৃদয়ে তুলে দেয় হারিয়ে যাওয়া কোনো মুহূর্তের স্মৃতি।

যেদিন বৃষ্টি নামে, সেদিন পৃথিবীটা একটু ধোয়া ধোয়া লাগে। রাস্তাঘাট ভিজে যায়, গাছপালা নতুন প্রাণ পায়, আর মানুষের মনের কোণে জমে থাকা আবেগগুলো যেন একে একে খুলে পড়ে। জানালার পাশে বসে থাকা কেউ তখন ভাবতে থাকে কারো কথা যে একসময় ছিল, অথবা যে কখনো আসেনি কিন্তু মনের ভেতর ঠিকই বাস করে।

বৃষ্টির শব্দ অনেক কিছু বলে। কখনো সেটা হয় প্রিয় কারো মনে পড়া, কখনো আবার অব্যক্ত ভালোবাসার অনুরণন। এ যেন প্রকৃতি আর প্রেমিক হৃদয়ের গোপন যোগাযোগ চোখের দেখা নয়, মনের অনুভবে লেখা হয় সেই চিরন্তন কবিতা।

আর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত?
যখন কেউ এসে নিঃশব্দে ছাতার নিচে জায়গা দেয়,
কথা না বলেও চোখে রেখে যায় এক প্রশ্ন, তোমার পাশে হাঁটতে পারি?

ছাতা নিয়েও নিচের অর্ধেক ভিজে যায় ফারিয়ার। তবে মাথা ভিজে নি বলে সর্দি কাশি থেকে বাঁচা যাবে। এই বা কম কিসে?
বাসায় ঢুকার সাথে সাথে সাহানা বেগম, মেয়ে ভিজে গেছে দেখে বললেন,
–” এই বৃষ্টির মধ্যে বের হতে গেলি কেন? বৃষ্টিটা থামলে বের হ‌ওয়া যেত না?
–” আমি যখন বের হয়েছি তখন বৃষ্টি ছিল না আম্মু।

তারপর মাকে ছাতাটা দেখিয়ে বলল,
–” ছাতাটা বারান্দায় খুলে রাখ, শুকিয়ে যাবে।

সাহানা বেগম ছাতাটা হাতে নিয়ে বলল,
–” এটা তো আমাদের ঘরের ছাতা না। তোর ছাত্রীর বাসা থেকে নিয়ে এসেছিস নাকি?

ফারিয়া সত্যিটা কিছুতেই বলবে না যদি বলে তবে তার মা কি না কি ভেবে বসে থাকবে সে জন্য ফারিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
–” আম্মু আমি ভিজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছি আর এদিকে তুমি একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছ। যখন জ্বর চলে আসবে তখন বুঝবে।

সাহানা বেগম আর কিছু বললেন না এ বিষয়ে। মেয়েকে তাড়া দিয়ে বললেন,
–” যা তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে আয়।

ফারিয়া মায়ের থেকে ছাড়া পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

এদিকে তাহসান কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরল। জামাকাপড় ভিজে গা দিয়ে পানি পড়ছে। চুল থেকে টপটপ করে টপকে পড়ে বৃষ্টির ফোঁটা। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই মা তাকে দেখে আঁতকে উঠলেন।
–” কিরে তুই না বাহির থেকে ফিরে এসে ছাতা নিয়ে গেলি? বললি আকাশে মেঘ করেছে যেকোনো সময় বৃষ্টি শুরু হবে। তাহলে তোর ছাতা কোথায়?

তাহসান একটু চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইল। মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে শুধু ভেজা শার্টটা টানতে টানতে ভেতরের ঘরে চলে যেতে লাগল।

মা আবার ডাকলেন,
–” তোর ছাতাটা গেল কোথায় বল তো? কিছু বলছিস না কেন?

তাহসান ধীর গলায় জবাব দিল,
–” একটা মেয়েকে দিয়েছি মা। রাস্তায় হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছিল। কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। ছাতাটা না দিলে পুরো ভিজে যেত মেয়েটা।

মা বিস্ময়ের সাথে বললেন,
–” কোন মেয়ে?

তাহসান হেসে বলল না কিছুই। শুধু বলল,
–” একদিন সিঁড়িতে মুখোমুখি হয়েছিলাম!

তাহসান আর কিছু বলল না, চলে গেল নিজের ঘরে। কিন্তু সেদিনের সেই বিকেল, বৃষ্টি, আর মেয়েটির চোখে লেগে থাকা সেই অদ্ভুত চাহনি, সব মিলে একটা নীরব গল্পের সূচনা হয়ে রইল তাহসানের হৃদয়ে।
.
.
ফারিয়া আর কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করতে পারে না। যে মানুষটাকে একদিন ভালোবেসে জীবনটা উজাড় করে দিয়েছিল, সেই প্রাক্তন স্বামীর অবহেলায় তার সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ভালোবাসা তার কাছে এখন শুধুই একটি ধোঁকা, একটি ফাঁকি। সিরাজের মতো মুখোশধারী পুরুষদের জন্য আজও সে নিঃশব্দে কাঁদে।

এই একটাই সম্পর্ক যেন তার চোখের সামনে পুরো পৃথিবীর পুরুষ জাতিকে সন্দেহের চোখে দেখার জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠেছে। কেউ একটু ভালোবাসার হাত বাড়ালেই মনে হয় এও বুঝি সিরাজের মতোই! মুখে মধু, মনে বিষ! বিশ্বাস শব্দটাই তার কাছে এখন আতঙ্কের আরেক নাম।

যদিও ফারিয়া জানে, পৃথিবীটা ভালো-মন্দ মিলিয়েই চলে। সব পুরুষ সিরাজ নয়। তবুও, অতীতের সেই তীব্র দহন আর অশ্রুজল আজো তার হৃদয়ে আগুন হয়ে ঝলসে দেয়। নতুন কাউকে বিশ্বাস করতে গিয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। মনে হয়, আবার যদি সেই ভুলটা হয়? আবার যদি সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে হয়?

একদিন যাকে আপন ভেবে জীবন সাজাতে চেয়েছিল, সেই প্রাক্তন স্বামীর অবহেলায় আজ তার হৃদয়ে শুধুই অবিশ্বাসের দেয়াল। ভালোবাসার নামে যে ঠকেছে, বিশ্বাসের বদলে পেয়েছে উপেক্ষা তার পক্ষে কি আর সহজে কাউকে বিশ্বাস করা সম্ভব?

সে চুপচাপ থাকে। নিজের ছোট্ট জগতে গুটিয়ে থাকে। ভালোবাসা, বিশ্বাস এসব শব্দ এখন তার কাছে একেকটা পোড়া পৃষ্ঠা, যার কালি মুছে গেছে, কিন্তু যন্ত্রণা এখনও রয়ে গেছে।

নিজেকে সে বারবার বোঝাতে চায়, তবুও মন মানে না। প্রিয় কারো ছায়া পড়লেই আজ তার মনে হয় আবার বুঝি অন্ধকার আসছে…
.
.
পরের দিন বিকেলের দিকে টিউশনি যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ফারিয়া। আচমকা মনে পড়ে গেল, তাহসানের ছাতাটি এখনো ওর কাছেই আছে। প্রথমে ভেবেছিল, ছোট ভাইকে দিয়ে পাঠাবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, ও যদি আম্মুকে কিছু বলে বসে, তাহলেই আম্মুর প্রশ্নবাণে পড়তে হবে। তার চেয়ে বরং নিজেই দিয়ে আসি।

তাহসানদের বাসার দরজায় নক করে ফারিয়া।কিছুক্ষণ পর দরজা খুললেন এক পরিচিত মুখ সাগরিকা চৌধুরী। তিনি ফারিয়াকে চিনতে না পেরে কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ফারিয়া শালীন ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে বলল,
–” আন্টি, আমি মতিন সাহেবের বড় মেয়ে।

সাগরিকা হালকা হেসে বললেন,
–” ওহ, আচ্ছা। মা, ভেতরে এসো।
–” না আন্টি, আমাকে এখনই যেতে হবে, বলে ফারিয়া হাতের ছাতাটা বাড়িয়ে দিলো,
–” আপনাদের ছাতাটা ফেরত দিতে এলাম। নিন, ধরুন।

সাগরিকা চৌধুরী ছাতাটি হাতে নিলেন। চোখেমুখে একরকম বিস্ময় ভেসে উঠলেও সেটা চাপা দিয়ে শান্তভাবে ছাতাটা গ্রহণ করলেন। ফারিয়া আর কথা না বাড়িয়ে আবার সালাম দিয়ে চলে গেল।

দরজা বন্ধ করে সাগরিকা কিছুক্ষণ ছাতাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর গভীর এক নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে যা বোঝার বুঝে নিলেন। এই ছাতাটাই তো গতকাল তাহসান হাতে নিয়ে বেরিয়েছিল।
নীরবে ছেলের ঘরে গিয়ে ছাতাটি আগের জায়গাতেই রেখে এলেন তিনি।
এই কয়দিনে ফারিয়াকে যতোবার দেখেছেন তাতে বুঝেছেন মেয়েটা শান্ত স্বভাবের এবং অত্যন্ত ভদ্র। তাই ফারিয়াকে উনার ভীষণ ভালো লাগে। নিজের ছেলের ব‌উ হিসেবে এমন কাউকে মনে মনে আশা করেন তিনি। কিন্তু ছেলেটার চাকরি পাওয়া নিয়ে সেসব আশা করতেও দ্বিধা করেন। কারণ ভালো চাকরি ছাড়া কোন বাপ তার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবেন না।

এদিকে বাড়ির বাহিরে পা রেখে ফারিয়া মনে মনে ভাবলো,
–” আমার আম্মুর মতো উনার মাও নিশ্চয়ই একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিবেন। যাকগে তাতে আমার কি উনার টা উনি ই সামলে নিবেন। এসব ভেবে আমার কাজ নেই।
.
.
মাস পেরিয়ে বছর শেষের পথে,
ফারিয়ার দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে। তাই সব টিউশনি বাদ দিয়ে পড়ায় বেশি করে মনোনিবেশ শুরু করে সে। এবার যেমন করেই হোক ফাস্ট ক্লাস পেতেই হবে এই যেন পন তার।

অপরদিকে,
তাহসান প্রতিদিনই চাকরির জন্য ইন্টারনেটে ঘেঁটে ঘেঁটে আবেদন করে। একেকটা আবেদন পাঠানোর পর মনে মনে দোয়া করে এইবার হয়তো হবে! কিন্তু দিন যায়, উত্তর আসে না। একদিন হঠাৎ করে একটা নামি কোম্পানি থেকে ফোন আসে ইন্টারভিউর জন্য। মুহূর্তেই আশার আলো ঝলমল করে ওঠে তাহসানের মনে।

ইন্টারভিউর দিন সে খুবই প্রস্তুতি নিয়ে যায়। নিজের সবটুকু মেধা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বোর্ডের সামনে দাঁড়ায়। প্রশ্নের উত্তর দেয় সাবলীলভাবে। বেরিয়ে এসে তার মনটা ভরে যায় আশায় এইবার বুঝি ঘুরে দাঁড়ানোর পালা।

কয়েকদিন পরেই আসে কাঙ্ক্ষিত ফোনটি। তাহসান চাকরি পেয়েছে!

ঘরে যেন ঈদের আনন্দ নেমে আসে। মা আবেগে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, আল্লাহ তোর দোয়া কবুল করছেন, বাবা! ছোট বোন লাফিয়ে ওঠে আনন্দে। তাহসান মাথা নিচু করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। বাবা নিরবে মুচকি হাসে। মনে মনে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করে।কারণ সব বাবারা চাইলেও নিজের আনন্দ দুঃখ প্রকাশ করতে পারে না।

এবার তাহসান ঠিক করে প্রথম মাসের বেতন পেলেই এই বাসাটা ছেড়ে একটা ভালো বাসা নিবে তারা।……

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।