চলার শেষ প্রান্তে পর্ব-১৫

0
12

#চলার_শেষ_প্রান্তে(১৫)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সাগরিকা চৌধুরীর মতো এমন মনোভাব যদি প্রতিটি ছেলের মায়ের থাকতো তাহলে বোধহয় পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হয়ে উঠতো।
তিনি মনে করেন আজকে যদি তার মেয়ের সাথে এমন কিছু হতো তাহলে কি মেয়েকে অবহেলা করতেন? নাকি অন্যত্র ভালো পাত্রের খোঁজ করতেন না? তাহলে এই এক‌ই ব্যাপারে অন্যের মেয়ের উপর কেন আঙ্গুল তুলতে হবে? কেন তাকে ঘৃণার চোখে দেখতে হবে? যেখানে ইসলাম ডিভোর্সি ও বিধবা নারীদের বিবাহকে উৎসাহিত করেছে এবং এটি একটি পূর্ণ সম্মানজনক কাজ। সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের নয়, বরং এটি সংস্কারযোগ্য সামাজিক ব্যাধি।
.
.
তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ফারিয়া আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিল বিয়েটা করবে। কিন্তু তার গ্র্যাজুয়েশন
কমপ্লিট করার পর ইনশা আল্লাহ। তাহসান যদি এতে রাজি থাকে তাহলে অপেক্ষা করতে পারে আর যদি না পারে তাহলে অন্যত্র বিয়ে করে নিতে পারে।

একদিন সে সাহানা বেগমকে সব কথা খুলে বলল।
সাহানা বেগম মুচকি হেসে বললেন,
–” ভালো ভেবেছিস মা, এমন সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। তুই নিজের পড়াশোনা শেষ কর, তারপর সব কিছু ঠিকঠাক করে বিয়ের কথা ভাবা যাবে।

সাহানা বেগম তখন সাগরিকা চৌধুরীকে ফোন করে ফারিয়ার সিদ্ধান্ত জানালেন।
সাগরিকা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর কণ্ঠটা একটু ভার করে বললেন,
–” মানে, ওর গ্র্যাজুয়েশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করবে না?
–” হ্যাঁ, আপা। ওর ইচ্ছা পড়াটা শেষ করে তবেই নতুন জীবন শুরু করবে।

সাগরিকার মন একটু খারাপ হয়ে গেল। তিনি ভেবেছিলেন, শিগগিরই হয়তো বউ নিয়ে আসতে পারবেন, সংসারটাকে আরেকটু রঙিন করে তুলতে পারবেন।

ফারিয়ার শর্তভিত্তিক সম্মতি পাওয়ার পর, প্রথমে সাগরিকা চৌধুরী কিছুটা হতাশ হয়ে পড়লেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–” আহ্ এত দেরি করে বিয়ে করবে! আমি ভেবেছিলাম এই বছরই আমার ছেলের ঘরনীকে নিয়ে আসবো, এখন তো কে জানে কবে সব হবে!

তাহসান মায়ের কথায় হালকা হেসে বলল,
–” মা, তুমি তো নিজেই বলেছিলে কারো উপর জোর চাপিয়ে নয়, বরং বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিলে সম্পর্কটা টিকে যায়।

সাগরিকা একটু চুপ করে রইলেন। তাহসান মায়ের পাশে বসে হাতটা ধরল,
–” একটা মেয়ে যখন নিজের পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ, আর সম্মানের ব্যাপারে এতটা সচেতন হয়, তখন বুঝতে হবে সে দায়িত্বশীল। মা, আমি ওর সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। তুমি কি চাও না, আমার পাশে একজন এমন বুঝদার মানুষ থাকুক?

সাগরিকা ধীরে মাথা নাড়লেন। চোখে একটু আর্দ্রতা, মুখে একচিলতে হাসি।
–” তুই ঠিকই বলেছিস রে। আল্লাহর উপর ভরসা করি। দায়িত্বশীল একটা মেয়ে আমাদের ঘরের বউ হোক এই দোয়া তো আমি প্রতিদিনই করি।

তাহসান শান্ত স্বরে বলল,
–” তাহলে মা, আমরা ধৈর্য ধরব। ইনশা আল্লাহ, সবকিছু ঠিক সময়ে ঠিকঠাক হবে।

সাগরিকা এবার সত্যিকারের হাসলেন।
–” আল্লাহ াআলা সবকিছু সহজ করুন আমিন!

এরপর ধীরে ধীরে দিন কাটতে থাকে। ফারিয়া নিজের পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর তাহসানও তার অফিস এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।

সাগরিকা চৌধুরী মাঝে মাঝে সাহানা বেগমকে ফোন করেন, খোঁজখবর নেন। কখনো বা হঠাৎ কিছু মজার রান্না হয়েছে বলে একটুখানি পাঠান ফারিয়াদের বাসায়। এদিকে সাহানা বেগম ও তাই করেন। তারা চাইছেন ধীরে ধীরে সম্পর্কটা আরও সুন্দরভাবে গড়ে উঠুক।

একদিন সাহানা বেগম সাগরিকা চৌধুরীর রান্না পাঠানো দেখে হেসে বললেন,
–” এইভাবে যত্ন করে যাওয়া মানে তো আস্তে আস্তে বউমা ভেবে নেয়া, তাই না?

সাগরিকা হেসে বললেন,
–” আপনি জানেন না ভাবী, কবে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বউ নিয়ে আসবো সেই অপেক্ষাতেই বসে আছি। তবে এখন আর তাড়া দিচ্ছি না। ওরা নিজেদের মতো সময় নিয়ে ভালো একটা সিদ্ধান্ত নিক, সেটাই চাই।

সাহানা বেগম বললেন,
–” ফারিয়ার মনে এখন পড়াশোনা আর দায়িত্ব নিয়ে চিন্তা, কিন্তু আমি জানি, ওর মনেও এখন স্থিরতা এসেছে।

সাগরিকা মাথা নাড়লেন,
–” ওর মতো সৎ, স্পষ্টভাষী মেয়ে খুব কমই দেখেছি। আমার মন বলে, অপেক্ষার ফল মধুরই হবে ইনশা আল্লাহ।

এরপর সাগরিকা চৌধুরী আবার একদিন সাহানা বেগমকে ফোন করলেন। অনেকক্ষণ খোশগল্পের পর বললেন,
–” আমার ছেলেও রাজি হয়েছে অপেক্ষা করতে। ইনশা আল্লাহ ওর পড়াশোনা শেষ হলেই আমরা বিয়ের কথা চূড়ান্ত করব।

সাহানা বেগম হাসিমুখে বললেন,
–” আপনার মতো সমঝদার মানুষ পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ ভাবি। ফারিয়ার পড়াশোনা আমার কাছেও অগ্রাধিকার। আপনারা পাশে থাকলে মেয়েটার মনও দৃঢ় থাকবে।

এরই মাঝে ফারিয়া ক্লান্ত মুখে বাসােয় ফিরে আসে। টিউশন, ক্লাস, প্রস্তুতি সব মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে তার। ঘরে ঢুকে আম্মুর মুখে সাগরিকা চৌধুরীর ফোনের কথা শুনে একটু থমকে যায়। এরপর শান্ত কণ্ঠে বলে,
–” আলহামদুলিল্লাহ। যদি সবাই রাজি থাকে, তাহলে আমি ভরসা করে আগাবো। কিন্তু এখন শুধু একটাই চাওয়া আমার পড়াশোনা শেষটা যেন ঠিকভাবে করতে পারি।

সাহানা বেগম মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
–” আল্লাহ তোর পথ সহজ করে দিক মা।

সময় কেটে যায়। দিন, সপ্তাহ, মাস সব মিলিয়ে ফারিয়ার পড়াশোনার শেষ ধাপে এসে পৌঁছায়। গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষাগুলো চলছে। এর মাঝে তাহসান একদমই কোনো চাপ দেয়নি। মাঝে মাঝে সাহানা বেগের কাছে খোঁজ খবর নেয়।

ফারিয়াও নিজের ভিতর থেকে একটা আলাদা শক্তি পায়। সে বুঝে গেছে, তাহসান সত্যিই তাকে সম্মান করে, বোঝে, এবং ধৈর্য ধরতে জানে।

শেষ পরীক্ষার দিনটিতে ক্যাম্পাস থেকে ফিরে ফারিয়া অনেকক্ষণ ইবাদত করে। তারপর নিজের মনেই বলে ওঠে,
–” আল্লাহ! তুমি সব জানো, আমার জন্য যেটা ভালো, তুমি সেটাই করো। আমি এবার নিজের সিদ্ধান্তে স্থির।
.
.
এর কিছুদিন পর মতিন সাহেব আর সাহানা বেগম সিদ্ধান্ত নেন বিয়ের। দুই পরিবার মিলে বিয়ের তারিখ সবকিছু ঠিক করেন।

বিয়ের দিনগুলো এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। চারপাশে একধরনের ব্যস্ততা, কৌতূহল আর আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। সাহানা বেগম আর সাগরিকা চৌধুরী দুজনেই বেশ খুশি। একজন নিজের মেয়েকে নতুন জীবনের পথে এগিয়ে দিতে প্রস্তুত, আর আরেকজন নিজের ছেলের জন্য সাজিয়ে তুলছেন নতুন ঘর।

সাগরিকা চৌধুরী সব কিছু নিজ হাতে দেখভাল করছেন। বিয়ের কেনাকাটার তালিকা, অতিথি তালিকা সবকিছুতেই তিনি নিজ হাতে পরিকল্পনা করছেন। মাঝে মাঝে বলেন,
–” এই বিয়ের কাজ আমি অনেক আশা নিয়ে করছি। যেন দুজনের জীবনেই শান্তি আর রহমত নামে আল্লাহর পক্ষ থেকে।

অন্যদিকে ফারিয়া পড়াশোনা শেষ করে কিছুটা হালকা হয়েছে। এখন আম্মুর সাথে বসে বিয়ের গহনা, শাড়ি, এবং অন্যান্য ছোটখাটো জিনিসপত্র নিয়ে ভাবছে। মাঝে মাঝে হাসছে, মাঝে মাঝে চুপ করে জানালার ধারে বসে ভাবছে,
–” সত্যি সত্যি আমার নতুন জীবন শুরু হচ্ছে…! বিশ্বাস হচ্ছে না যেন।

তাহসান এই পুরো সময়টা বেশ নিরবে ফারিয়ার আর তাদের নতুন জীবনের জন্য দোয়া করে কাটাচ্ছে। বন্ধুদের সাথে বিয়ের কথা বলতে গিয়ে মুখে একরাশ হাসি জমে থাকে।

অবশেষে, দিন গুনে গুনে, বিয়ের তারিখ এসে পড়ে একদম সামনে। আত্মীয়স্বজনেরা আসতে শুরু করে। ফারিয়ার মুখে মৃদু লজ্জা, আবার একধরনের অজানা অনুভূতির ঝলক।

সাহানা বেগম মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন,
–” আমার মেয়ে এখন কারো ঘরের বউ হয়ে যাবে, আল্লাহ তোর জন্য সব ভালো করবেন দেখিস।

এভাবেই ধীরে ধীরে ফারিয়া ও তাহসান জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে পা রাখার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে আশা, দোয়া আর ভালোবাসার পরিপূর্ণতা নিয়ে।
.
.
তাহসানের বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে যেন তার ছোট বোন তাশফিয়া। ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে যেন সে একেবারে স্বপ্নের রাজ্যে চলে গেছে। ছোটবেলা থেকেই সে বলে এসেছে,
–” ভাইয়া, তোমার বিয়েতে আমি নিজে সব সাজিয়ে দেবো!

এবার যখন সত্যি সত্যি তাহসানের বিয়ে ঠিক হয়েছে, তখন তাশফিয়া যেন পুরো বাড়ির প্রাণ হয়ে উঠেছে। নিজের পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বিয়ের কেনাকাটার তালিকা করছে, ভাইয়ের শেরওয়ানি কোন ডিজাইনের হবে তা নিয়ে আলোচনা করছে।

পুরো বাড়ির পরিবেশটা তাশফিয়ার এই সরল আনন্দে আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। সে নিজের জন্য মেহেদির ডিজাইন খুঁজছে, ভাবির জন্য ছোটখাটো চমক ভাবছে, আর বন্ধুদের সাথে শলা করে ভাইয়ের বরের সাজে কোনটা মানাবে তা নিয়েও চিন্তায় মগ্ন।

সবাই বলছে,
–” তাশফিয়া না থাকলে এই বিয়েতে এমন উৎসবই হতো না!

তাশফিয়া হেসে বলে,
–” এই তো শুরু, ভাইয়ার বিয়ে মানেই আমার জীবনের সেরা ইভেন্ট!….

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।