#চলার_শেষ_প্রান্তে(১৬)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
সকাল থেকেই এক অদ্ভুত আনন্দের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে দুই বাড়িতে। সাহানা বেগমের ঘরজুড়ে ব্যস্ততা, অতিথিদের আপ্যায়নের আয়োজন, আর ছোট ছোট খুশির মুহূর্তগুলোতে মিশে আছে দীর্ঘ অপেক্ষার এক মধুর পরিণতি।
ফারিয়া আজ যেন সত্যিই এক নবপরী। লাল আর গোল্ডেন জড়ির কাজের শাড়িতে তার মুখে যে আলো, তা যেন বাইরের রোদের থেকেও উজ্জ্বল। হাতে মেহেদি রাঙা, ঠোঁটে এক লাজুক হাসি।
নূরাইন মাকে আঁকড়ে ধরে বলল,
–” আম্মু, সত্যিই কি আজ আপুর বিয়ে? খুশিতে আমার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
সাহানা বেগম চোখে জল নিয়ে বললেন,
–” হ্যাঁ মা, আজ তোর আপু কারো ঘরের বউ হবে। মেয়েটার জন্য দোয়া করেছি সারাটা জীবন। আল্লাহ যেন তাকে সুখী করে রাখেন।
এদিকে তাহসান পরেছে সোনালি বর্ডারওয়ালা মেরুন শেরওয়ানি। চোখেমুখে শান্ত এক দৃঢ়তা। মা সাগরিকা চৌধুরী বারবার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলছেন,
–” আজ তোর জীবনের নতুন শুরু। মনে রাখিস, ভালোবাসা আর সম্মান, এ দুটো নিয়েই একটা সংসার গড়ে ওঠে।
তাশফিয়া আর তার বান্ধবীরাও তৈরি হয়েছে যাওয়ার জন্য। সবার মুখে আনন্দ, ঠাট্টা, খুনসুটি নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বলে,
–” ভাবি ভাইয়া কে দেখেই প্রেমে পড়ে যাবে।
.
.
বিয়ের মুহূর্তে কাজি সাহেব যখন কবুল বলার সময় দেন, পুরো ঘর একেবারে নিঃশব্দ। ফারিয়ার গলা কাঁপছে, কিন্তু তার চোখে আজ ভয় নয় লজ্জা মিশ্রিত মুখশ্রী। অতঃপর বলেই দেয়,
–” আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
এরপর তাহসান এর আলহামদুলিল্লাহ কবুল উচ্চারিত হওয়ার পর চারপাশে মোনাজাতের ধ্বনি, কণ্ঠর সুরে দোয়া, চোখে জল আনন্দের, ভালোবাসার, তৃপ্তির।
বিয়ের পর, তাশফিয়া ফারিয়ার পাশে এসে বলল,
—”ভাবি, আমি তো অনেক আগেই আপনাকে ভাইয়ার জন্য পছন্দ করেছিলাম। এবার সত্যিই নিজের ভাবি হিসেবে পেয়ে গেলাম!
ফারিয়া মুচকি হেসে বলল
–” তাই?
–” হুমমম।
এরপর নতুন জীবন শুরু হয় তাহসান আর ফারিয়ার। যেখানে অতীতের কষ্টগুলো পেছনে ফেলে, তারা একসাথে হাঁটবে ভবিষ্যতের আলোকিত পথে, আল্লাহর উপর ভরসা রেখে।
সাগরিকা চৌধুরীর সাজানো-গোছানো বাসায় শান্তিতে ভরা, ভালোবাসায় ভরা। প্রথমদিন ই ঘুরে ঘুরে সবটা দেখিয়ে দিলেন ফারিয়াকে। শেষে তাহসান এর ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন,
–” আজ থেকে তোমাদের দুজনের ঘর এটা।
ফারিয়া পুরো ঘর চোখ বুলিয়ে দেখলো। তাহসানের রুমে সাদা-নীল থিম রাখা হয়েছে। একপাশে পড়ার টেবিল, বইয়ের র্যাক আর দেয়ালে একটি ঘড়ি ও একটি আয়াতুল কুরসির ফ্রেম। ফারিয়ার জন্য নতুন আনা, ড্রেসিং টেবিল, স্ট্রিলের আলমারি। বিছানার পাশে ছোট্ট এক টেবিল, তাতে কুরআন শরীফ রাখা আছে।
দেয়ালে নরম রঙ, ছোট একটা বুক শেলফে বই, বারান্দায় ছোট্ট এক গাছের টব আর পাশে দুইটা কুশন বসানো চেয়ার তাদের একান্ত মুহূর্তের জন্য আনিয়ে রেখেছে তাহসান। সবকিছুর জন্য ফারিয়া মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বললো।
.
.
কিছুদিন পর তাহসান অফিস থেকে ফিরেই বলল,
–” ফারিয়া, আজ আমার খুব স্ট্রেসফুল একটা দিন ছিল। তোমার হাতের চা কি পাবো?
ফারিয়া হেসে বলল,
–” হ্যাঁ এক্ষুনি বানিয়ে আনছি। আর কিছু লাগবে আপনার?
তাহসান মুচকি হেসে জানাল,
–” এই কথাগুলোই আমার সব ক্লান্তি দূর করে দেয়।
ফারিয়া মুচকি হেসে চা বানাতে চলে যায়।
তারপর রাতে একসাথে মাগরিবের নামাজ পড়ে, ফারিয়া পছন্দ করে এমন হাদীস পড়ে শোনায় তাহসানকে। দুজনের মধুর আলাপের মাঝে যেন এক অনন্য বন্ধন গড়ে ওঠে যেখানে আস্থা আছে, বোঝাপড়া আছে, আর আছে আল্লাহর দিকে ফেরার ইচ্ছা।
ফারিয়া এখনো পড়াশোনায় মনোযোগী। তাহসানও তার পাশে দাঁড়িয়ে সবসময় সাহস জোগায়।
–” তুমি পড়াশোনা শেষ করো, আমি আছি পাশে। তোমার স্বপ্ন আমারও স্বপ্ন।
আর ফারিয়া ভেজা চোখে বলে,
–” এমনি করে সারাজীবন পাশে থাকবেন তো?
–” ইনশা আল্লাহ শেষ পর্যন্ত থাকবো।
ফারিয়া তখন তাহসান এর প্রশস্ত বুকে ঢলে পড়ে। এখানেই যেন দুনিয়ার সমস্ত সুখ খুঁজে পায়।
তাহসান নিজের হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু এঁকে দিয়ে বলে,
–” আমার জীবনের সবচেয়ে বড় নিয়ামত তুমি, ফারিয়া।
ঘরটা নিস্তব্ধ, জানালার পর্দা হালকা দুলছে, দূর থেকে ভেসে আসছে আজানের মৃদু ধ্বনি।
দুজন একসাথে উঠে দাঁড়ায়, ওযু করে। নামাজে দাঁড়ানোর আগে তাহসান হালকা গলায় বলে,
–” চলো আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি, আমাদের এই সুন্দর সম্পর্কের জন্য।
ফারিয়া চোখ নামিয়ে মাথা নাড়ে।
নামাজ শেষে তাহসান তাকে জিজ্ঞেস করে,
–” তোমার চোখে আমি কেমন স্বামী হতে পেরেছি?
ফারিয়া একটু চুপ করে থাকে। তারপর মিষ্টি হেসে বলে,
–” যে মানুষ আমাকে আল্লাহর দিকে টেনে নেয়, সে আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ।
তাহসান স্ত্রীকে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে বলে,
–” আল্লাহ যেন আমাদের এই ভালোবাসাকে কবুল করে নেন।
.
.
দিন গড়ায়। ফারিয়া এখন রুটিন করে ঘর সামলায়, পড়াশোনা চালিয়ে যায়।
একদিন রাতে, তাহসান বিছানায় শুয়ে ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
–” জানো, আমি মাঝে মাঝে ভয় পাই। এই শান্তি, এই ভালোবাসা সবকিছু যেন এক স্বপ্ন। যদি একদিন হারিয়ে যায়?
ফারিয়া তাহসানের হাত ধরে বলল,
–” স্বপ্ন হারায় না, যদি তা আল্লাহর জন্য হয়। আমরা একে অপরকে শুধু দুনিয়ার জন্য ভালোবাসি না আমরা জান্নাত পর্যন্ত একসাথে থাকতে চাই ইনশা আল্লাহ।
তাহসান চোখ বন্ধ করে গভীর প্রশান্তি অনুভব করে। এ ভালোবাসা কেবল চোখে দেখা নয়, বরং অন্তরের এক পবিত্র অনুভব যেখানে পরস্পরের প্রতি দায়িত্ববোধ, আস্থা, আর আল্লাহর সন্তুষ্টি সবচেয়ে বড়।
.
.
মাস্টার্স শেষ করার পর থেকেই ফারিয়া যেন আরেক রকম সিরিয়াস হয়ে ওঠে। আগে যেভাবে পড়াশোনায় মন দিত, এখন তার চেয়েও বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠে। ফারিয়া আরেকটা নতুন পরিচয় চায় যেখানে একজন সচেতন, আত্মনির্ভর নারী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।
প্রতিদিন ফারিয়া নিয়ম করে পড়তে বসে। কখনো সে অনলাইনে চাকরির সার্কুলার খুঁজে, কখনো রিসার্চ করে কীভাবে নিজেকে আরও দক্ষ করে তোলা যায়।
তাহসানও পাশে থেকে উৎসাহ দেয়। একদিন রাতে ফারিয়া বলল,
–” আমি ভাবছি একটা ভালো চাকরির জন্য আবেদন করব। কিন্তু কোনটা করব, বুঝে উঠতে পারছি না।
তাহসান গভীর মনোযোগে শুনে বলল,
–” চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হতে পারো। আর ইচ্ছে হলে ইসলামিক এনজিও তে কাজ করতে পারো। তবে যে কাজই করো, দেখে নিও যেন তা তোমার দীন ও পর্দার সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়।
ফারিয়া তখন বলল,
–” সে জন্যই তোমার থেকে জানতে চেয়েছি কোনটা ভালো হবে।
তাহসান হেসে বলে,
–” তোমার স্বপ্ন তুমি পূরণ করো, আমি আছি তোমার ছায়ার মতো পাশে।
ফারিয়ার চোখে তখন আলোর ঝলকানি। ধীরে ধীরে সে অতীত ভুলে যাচ্ছে প্রায়। এখন আর মনে হয় না তার সাথে খারাপ কিছু হয়েছিল। মনে হয় সেগুলো দুঃস্বপ্ন ছিল।
ধীরে ধীরে সে যেন অতীতের সব দুঃখগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের পথে।
যে স্মৃতিগুলো একসময় বুক চিরে ব্যথা দিত, সেগুলো এখন কেবল ধোঁয়াটে কুয়াশার মতো মনে হয়।
কখনো কখনো সে ভাবে,
“সেই কষ্টগুলো কি সত্যিই ঘটেছিল? নাকি ছিল শুধুই কোনো দুঃস্বপ্ন?”
আলহামদুলিল্লাহ, এখন তার জীবন সুন্দর, পরিপূর্ণ। আল্লাহ তাকে ভালোবাসার, সম্মানের, শান্তির ছায়াতলে এনে দিয়েছেন।
এখন সে আর ফিরে তাকাতে চায় না। তার মনে হয়, অতীতটা যেন কোনো পুরনো সিনেমার মতো যার পর্দা নামিয়ে দিয়েছে সে নিজেই।
আজ তার চারপাশে আছে এক গভীর সম্মান, মমতা আর ভালোবাসা। সবচেয়ে বড় কথা, হচ্ছে তাহসানের নির্ভরতা আর আল্লাহর রহমতের ছায়া।
এই জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাসে সে কেবল একটিই শব্দ ফিসফিস করে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ।”
#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।