চলার শেষ প্রান্তে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

0
2

#চলার_শেষ_প্রান্তে(১৭)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
#অন্তিম_পর্ব

কয়েক বছর পরের কথা।
ফারিয়ার জীবন এখন অনেকটাই বদলে গেছে।
সে এখন আত্মবিশ্বাসী, শিক্ষিত, কর্মজীবী একজন নারী। তাহসানের সাথে তার বন্ধনও সময়ের সঙ্গে আরও গভীর হয়েছে।

সেই বছরের শীতের শুরুতে, মামাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষে ফারিয়া আর তাহসান দুজনে মিলে মামার বাড়ি গেলো।
সাজসজ্জা, আনন্দ-উল্লাস, আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে ফারিয়া হাসছে, কথা বলছে, কিন্তু তার ভেতরের কোনে একটা অজানা অস্বস্তি যেন দানা বাঁধছিল।

দুপুরের দিকে হঠাৎ রান্নাঘরের পাশের ছোট উঠোনে ঢুকতেই ফারিয়া মুখোমুখি হয়ে গেলো এমন একজনের সঙ্গে, যার সাথে দেখা হবার কথা সে কখনোই কল্পনা করেনি।

সিরাজের মা। তিনি যে ফারিয়ার খালা, সেটা সবাই জানে। ভাইয়ের বাড়িতে বিয়ে, তাই আমন্ত্রিত ছিলেন।
তবে ফারিয়া জানত, তিনি এই অনুষ্ঠানে আসবেন না। তাই নিশ্চিন্তে এসেছিল।

কিন্তু… নিয়তি যে সবসময় প্রশ্নপত্রে পূর্বঘোষণা দেয় না। চোখাচোখি হতেই মুহূর্তটা থেমে গেল।

ফারিয়া হকচকিয়ে গেল না, বরং ভেতরে কোথাও একধরনের স্থিরতা খুঁজে পেল।
তার ভেতরের সেই ভেঙে পড়া মেয়েটা অনেক আগেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

সিরাজের মা এক মুহূর্ত ফারিয়ার দিকে চেয়ে থাকলেন। এক কদম এগিয়ে এসে বললেন,
–” কেমন আছিস ফারিয়া?

ফারিয়া তখন শান্ত গলায় বলল,
–” আল্লাহ তাআলার রহমতে আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?

ফারিয়ার কণ্ঠে কোনো বিদ্বেষ নেই, অভিযোগ নেই শুধু দূরত্বটা স্পষ্ট।

সিরাজের মায়ের মুখটা অদ্ভুতভাবে মলিন হয়ে গেল। চোখের কোণে ক্লান্তির ছায়া, ঠোঁটের কোণে কষ্টের ভাঁজ। ধীরে ধীরে বললেন,
–” আছি, কোনো রকমে বেঁচে। বাঁচাকে আর বাঁচা বলে মনে হয় না।

ফারিয়া শান্ত গলায়, তীক্ষ্ণ কিন্তু ভদ্র ভঙ্গিতে বলল,
–” কেন বলুন তো? এখন তো আপনার খুব ভালো থাকার কথা ছিল।
আপনার তো পছন্দের বউ এসেছে ঘরে। নতুন বউ, নতুন জীবন সবই তো আপনি চেয়েছিলেন।

সিরাজের মা চোখ নামিয়ে নিলেন। তাঁর মুখে কোনো জবাব নেই, যেন হাজারো অনুশোচনা গলায় আটকে গেছে। ফারিয়া আর কিছু বলল না।
তার দৃষ্টিতে ছিল না বিদ্বেষ, শুধু ছিল সত্য বলার সাহস। একসময় যার সামনে সে মুখ তুলতে পারত না, আজ তার সামনে সে স্থির, দৃঢ় আর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন।

তাহসান ঠিক তখনই পাশ দিয়ে এসে দাঁড়াল। কোলে তাদের ছোট্ট মেয়ে তায়েবা। ফারিয়া তখন সামান্য হেসে একপাশে সরে দাঁড়াল, তারপর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতে বলল,
–” আপনাদের জামাই, আর আমার মেয়ে।

তার কণ্ঠে ছিল না কোনো গর্ব দেখানোর ভঙ্গি, ছিল না অহংকার ছিল আত্মসম্মান, ছিল ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস।

তাহসান বিনীতভাবে সালাম দিল সিরাজের মায়ের দিকে। সে জানে না আসলে কে এই মহিলা।

সিরাজের মা এক মুহূর্ত যেন হতবাক হয়ে গেলেন।
চোখে মুখে ধরা পড়ল বিস্ময় আর অনুশোচনার ছায়া। যে মেয়েটাকে একদিন তুচ্ছ করে ফেলেছিলেন, আজ সে-ই মাথা উঁচু করে, সসম্মানে নিজের দ্বিতীয় স্বামী সন্তান নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

এই একটা সাক্ষাৎ ফারিয়াকে বুঝিয়ে দিল,
সে সত্যিই এগিয়ে গেছে। অতীতকে পেছনে ফেলে জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে।

আর সেই অধ্যায়ে সিরাজ বা তার মা কোনো চরিত্রেই আর কোনো জায়গা নেই।
.
.
বিয়ের দিন আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে হাসি-আনন্দে মুখর চারপাশ। ফারিয়া চুপচাপ বসে ছিল একপাশে, হঠাৎই ছোট মামির গলা কানে এলো।
তিনি কথায় কথায় বলছিলেন,
–” আরে জানিস ফারিয়া, শুনলাম সিরাজ অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে বিদেশে। কাজ করার মতো শক্তি নেই বললেই চলে। ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে তার!

একটু থেমে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–” এখন তো শুনি তার বউটাই কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। কিন্তু তাতেও কি সুখ জোটে?
বউয়ের পয়সায় বসে খেলে আর যাই হোক, সুখ তো জোটে না রে, জীবন একেবারে ওলটপালট। তোর অভিশাপ লাগছে বুঝলি?

ফারিয়া চুপচাপ শুনছিল। অভিশাপ এর কথা শুনে মুখ খুলল। বলল,
–” আমি তাদের কখনো অভিশাপ দেইনি মামি। ভাগ্যে যা ছিল মেনে নিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য যা করেন ভালোর জন্যই করেন।

ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই ছোট মামি নরম গলায় বললেন,
–” অভিশাপ মুখ দিয়ে দিতে হয় না বুঝলি?
কারো থেকে কষ্ট পেলে, দুঃখ পেলে, তা এমনি এমনিই গিয়ে লেগে যায় তার জীবনে। আল্লাহ সব দেখেন মা, কারো চোখের পানি কখনো বৃথা যায় না।

উনার কণ্ঠে ছিল অভিজ্ঞতার ভার আর কথার গভীরে জমে থাকা জীবনের বাস্তবতা।
ফারিয়া কিছু বলল না, শুধু হালকা করে মাথা নাড়ল। আর মনে মনে ভাবল,
“আল্লাহর বিচার কত নিখুঁত! যাকে হারানোর শোক একদিন বুক ভাসিয়ে দিয়েছিল, আজ তার জন্য মনেও কষ্ট নেই।”

তার চোখে এখন কেবল প্রশান্তি।
সুখের সংজ্ঞা আজ তার কাছে বদলে গেছে।
কারও কষ্টে সে খুশি নয়, শুধু নিজের শান্তিকে আঁকড়ে ধরে আছে।
.
.
তাদের সংসারের ছোট্ট অতিথি তায়েবা এখনো কথা বলতে শিখে নাই। কিন্তু তার চোখের চাহনি, ছোট ছোট হাত-পা নাড়াচাড়া, আর মাঝে মাঝে হেসে ওঠা এসব যেন হাজারো শব্দের চেয়েও বেশি অর্থপূর্ণ।
সে যখন বাবার কোলে গিয়ে বসে, তাহসানের মুখে তখন তৃপ্তির হাসি ফুটে।
ফারিয়া তাকিয়ে থাকে তায়েবার দিকে। একটা প্রাণ, একটা স্বপ্ন, যে এখনো “মা” বলে ডাকেনি, কিন্তু চোখে চোখে ভালোবাসা ঢেলে দেয়।

তায়েবা তার দাদুর বাড়ি আর নানুর বাড়ি দু’জায়গাতেই যেন চোখের মণি। সবার আদর ভালোবাসায় ভরপুর সে।
দাদু তাকে আদর করে বলেন, “আমার বংশের আলোর দ্যুতি।”
আর নানু তাকে কোলে নিয়ে বলেন, “তুই না থাকলে ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে রে বোইন।”

আর সাগরিকা চৌধুরী তায়েবাকে যেন একেবারে চোখে হারান একমাত্র নাতনি বলে কথা।
তায়েবার প্রতিটি হাঁটা, প্রতিটি ছোট্ট হাতের নাড়া, আর ঠোঁট ফোলানো ব্যাকুল মুখখানিই যেন সাগরিকার সবচেয়ে বড় আনন্দ।
তিনি বলেন,
–” আমার তায়েবা এলে ঘরটা ফুরফুরে লাগে। না হয় যেন পানিতে ডু*বে থাকে।

তায়েবা ঘরজুড়ে হামাগুড়ি করে, খেলনার পেছনে ছোটে আর মাঝে মাঝে সাগরিকার কোলে গিয়ে চুপটি করে বসে পড়ে।
তখন সাগরিকার মুখে প্রশান্তির ছায়া নামে, চোখ ভরে যায় ভালোবাসায়।

এই একটিই ছোট্ট প্রাণ, যার জন্য পুরো পরিবারে হাসি খেলে যায় প্রতিদিন।

এদিকে তায়েবার দেখাশোনার জন্য ফারিয়ার কলেজে যাতায়াতে কোনো সমস্যা হয় না।
রাতের বেলা তাহসান যখন তায়েবাকে সামলায় তখন ফারিয়া পরের দিনের রান্নাবান্না গুছিয়ে রাখে, যেন সকালটা সহজ হয়।
আর দিনের বেলায় ঘরের অন্যান্য কাজগুলো সামলে নেয় কাজের বুয়া।
তাতে ফারিয়ার উপর চাপ পড়ে না খুব একটা।

সবচেয়ে বড় সহায়ক হলেন তাহসান এর বাবা মা।
সারাদিন নাতনি তায়েবাকে কোলে নিয়ে, আদরে-ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখেন।
ছয় মাস পেরিয়ে গেছে তায়েবার।
এখন তাকে বাড়তি খাবারও খাওয়ানো যায়, তাই খাবার নিয়ে আর বিশেষ কোনো সমস্যা হয় না।
দুধের পাশাপাশি এখন সে খায় নরম খিচুড়ি, সুজি, কলা পেস্ট ‌ইত্যাদি।
সাগরিকা চৌধুরী নিজেই তায়েবার জন্য নানা রকম নরম আর পুষ্টিকর খাবার তৈরি করে দেন।
তায়েবা খেয়ে খুশি হলে সাগরিকার মুখেও ফুটে ওঠে প্রশান্তির হাসি। এইভাবে ছোট্ট তায়েবার বেড়ে ওঠা যেন পুরো পরিবারের কাছে একটা আনন্দময় যাত্রা।

এইভাবে ব্যস্ততা আর ভালোবাসা মিলেমিশে ফারিয়ার সংসার আর কর্মজীবন দুটোই একসাথে চলতে থাকে, প্রশান্তি আর সুন্দর ছন্দে। তাছাড়া রাতের বেলায় তায়েবা যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শুরু হয় তাহসান এর দুষ্টুমি ভরা ভালোবাসা। ফারিয়া তখন সারাদিনের সব ক্লান্তি ভুলে যায়। স্বামীর উষ্ণ উপস্থিতি, মায়াবী চোখের চাহনি আর নিঃশব্দ ভালোবাসায় তার মুখে ফুটে ওঠে এক চিলতে প্রশান্তির হাসি।
সে-ও তখন মন খুলে হাসে, বলে ওঠে,
–” তুমি পাশে আছো বলেই আমার দুনিয়া এতোটা রঙিন আলহামদুলিল্লাহ।

এইভাবে রাতগুলো কাটে ফারিয়া-তাহসানের মধুর মিলনে।

🌿 সমাপ্ত 🌿

(আসসালামু আলাইকুম। গল্পটা শেষ করে দিতে হলো। যাই হোক কেমন হয়েছে জানাবেন প্লিজ।আর ভুল গুলো মার্জিত ভাষায় ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ।)