চলো রোদ্দুরে পর্ব-১২+১৩

0
677

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_12

বই নিয়ে হোস্টলের নিচে দাঁড়িয়ে আছে রাদ। হাতে একদম ই সময় নেই। অফিস টাইম থেকে সময় নিয়ে বুক শপে গিয়েছিলো। ফার্স্ট ইয়ারে বই আর নোট কেনার জন্য। সেটা অবশ্য প্ল্যান এর মধ্যেই ছিলো।তবে জ্যাম এর কারনে লেট হলো। গাঁয়ে হুডি জড়িয়ে নিচে নেমেছে ভোর। হোস্টেলের সবাই হুডি পরে সেই কারনে নিজেকে এলিয়েন মনে হয় না। তবে কিছু টা অপ্রস্তুত বোধ এখনো হচ্ছে। বই গুলো তুলে দিয়ে রাদ বলে
_কাল থেকে কলেজ শুরু। আমি তোমাকে রোজ সকালে পিক করবো আবার টাইমলি ড্রপ করে দিবো।

_আচ্ছা।

_কিছু দিন সময় নাও।দ্যান কোচিং এ এডমিট করিয়ে দিবো। মন দিয়ে পড়ো।

_হুম। ভেতরে যাবেন না?

_না সময় নেই।

_ওহহ।

এক পা এগিয়ে আবারো চলে আসে। ভোর সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। একটু ঝুঁকে রাদ বলে
_ যদি ও হুডির সাথে স্কাফ এর প্রয়োজন নেই , তবে আনকমফর্টেবল ফিল হলে মাফলার নিও।

_আচ্ছা।

_আমি যাচ্ছি আর শোনো নিজের যত্ন নিও।

রাদ চলে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোর। কি একটা জীবন। যেখানে পরিবার বলতে কেউ নেই। আপন বলতে শুধু একজন সে ও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যাঁর সাথে বিয়ে নামক এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে মাত্র। এমন জীবন তো চায় নি ওহ। শুধু শুধু ওর জন্য আরেক টা জীবন ও নষ্ট হতে যাচ্ছে। চরম ঘৃনা হয় নিজের প্রতি। পরিস্থিতি ওকে কোথায় নামালো।
.

_শোনো রাদ দুটো পেশা সামলানো একটা আর্ট। যাহ অতি সহজে হয় না। এখন তুমি ফ্রি টাইমে আছো, তাই বিজনেস সামলানো তেমন আহামরি লাগছে না। কারন সম পরিমানে প্রেসার তুমি আগে ও নিয়েছো। বাট যখন তুমি লাইসেন্স পেয়ে যাবে হসপিটালে জয়েন করবে। দ্যান আরেক টা প্রেসার নিতে হবে তোমাকে। কতো টা গভীর চাপ একটু ভেবে দেখো।

_আমি জানি ড্যাড। দুটো প্রফেশন সামলানো প্রচন্ড হার্ড।বাট আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট এন্ড আই বিলিভ নাথিং ইজ ইমপসিবল।

_শুনে ভালো লাগলো। আশা করি তুমি তোমার ড্যাড এর থেকে বেশি প্রেসার নিতে পারবে।

_উমম পারবো ড্যাড। তোমরা পাশে থাকলে অবশ্যই পারবো।

ইফতিহার শুধুই হাসলেন। একটা ফাইল নিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পরলেন। রাদ কে তো চাপ নিতেই হবে। মাত্র তো পড়াশোনার এক টা ধাপ পেরোলো। এখনো তো আরো অনেক মেডিকেল ড্রিগি নিতে হবে।

আজ খুব সংকোচ বোধ করছে রাদ। ইফতিহার এর বিজনেস ফেস সত্যিই প্রশংসা প্রাপ্ত। এমন কঠোর কর্মসূচির জন্যই সমান তালে এগিয়ে আছেন তিনি।

কেবিনের এক পাশে সাধারন জনতার মতো বসে আছে রাদ। এই কয়েক দিন কনফারেন্স মিটিং এ স্বাভাবিক থাকলে ত অফিসে বেশ কঠোর ইফতিহার।

_মে আই কাম ইন স্যার?

_ইয়েস কাম ইন।

সোফা তে রাদ কে বসে থাকতে দেখে মৃদু হাসে মুসতাকিম। সামনে এসে বলে
_গুড মর্নিং স্যার।

_গুড মর্নিং।

_আজ থেকে অফিসে জয়েন করবেন?

_উহহু এখন একটু কাজ গুলো শিখে রাখবো। পরে সময় হলে জয়েন করবো।

_ওহহ।

_ এদিকে আসো মুসতাকিম।

_ ইয়েস স্যার।

ইফতিহারের বরাবর চেয়ারে বসে মুসতাকিম। ছেলেটা অফিসের ছোট খাটো পদে পার্ট টাইম জব করছিলো। তাছাড়া কম্পিউটারে ও বেশ ভালো দক্ষ, আর কাজের প্রতি সৎ।
_তোমাকে বিশেষ প্রয়োজনে ডেকেছিলাম।

_ইয়েস স্যার।

_গত এক বছর যাবত বেশ ভালো কাজ করেছো তুমি। আমি বেশ খুশি তোমার উপর। এবার মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছো তাই তো?

_জি স্যার।

_তুমি আর রাদ সমবয়সীই হবে। আর সমবয়সী দের মাঝে যদি বন্ধুত্ব সুলভ আচারন হয় তবে কাজ ও সুষ্ঠু হয়। আমি বিশ্বাস করি তুমি তোমার দায়িত্বে অটল। তাই তোমাকে রাদ এর পি এ হিসেবে নিয়োগ দিতে চাই। তোমার কি মতামত?

মুসতাকিমের চোখ দুটো গোল হয়ে যায়। বেশ কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে ছেলেটা। এই ছোট চাকরি টা ওকে কতো টা সাহায্যে করেছে তা বলে বোঝানো যাবে না। সৎ কাজ করেছে সব সময়।আর সেই সুবাদে আজ এতো বড় দায়িত্ব পেয়েছে ওহ।
বসা থেকে উঠে যায় ওহ। খুশি মুখে বলে
_থ্যাংকস স্যার।আমি আমার বেস্ট দিয়ে কাজ করবো।

_আই নো দ্যাট। ফরমালিটিস গুলো পূরন করে দাও।

_জি স্যার।

কিছু টা অদ্ভুত ভাবে বসে থাকে রাদ। সব কিছুই ওর মাথার উপর দিয়ে গেল। ছেলের অবাক হওয়া দেখে বিস্মিত হয় নি ইফতিহার। চত্বর বুদ্ধি সম্পূর্ণ তিনি। বিজনেস টা রক্তে মিশে আছে। তবু ও ভয় হয় কে কখন ক্ষতি করে দেয়। রাদ কে ও বিজনেস কি জিনিস তা প্রতি অক্ষরে অক্ষরে শিখতে হবে।

ইফতিহার ড্রাইভ করছেন আজ। আর রাদ তাঁর সহযাত্রী। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ছেলে টা কিছু বলবে বলবে করে ও বলতে পারছে না। ইফতিহার যে এতো টা আলাদা তা কিছু তেই বুঝতে পারে নি তবে এক পলক তাকিয়ে বুঝতে পারে অফিসে থাকা কালীন ইফতিহার আর বর্তমান ইফতিহারের মাঝে অনেক ফারাক। তাই বলে
_একটা কথা বলার ছিলো ড্যাড।

_হুম বলো।

_অফিস টাইমে তোমাকে অদ্ভুত লেগেছে আমার। দেখে মনেই হয় নি তুমি আমার ড্যাড।

হেসে ফেলেন তিনি। রাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারো ড্রাইভে মনোযোগী হন। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি টা সাইট করে বলে
_প্রতি টি মানুষের বিজনেস ফেস ভিন্ন হওয়া উচিত। একটা বিষয় মনে রাখবে কে কখন তোমার পিঠে ছুড়ি চালাবে বুঝতে ও পারবে না। এখানে চলে টাকার খেলা। তবে কেউ কেউ আছে যাঁরা আত্মিক ভাবে কাজ টা কে গ্রহন করে। এমন মানুষের সংখ্যা খুব ই কম বেটা।

_হুম বুঝলাম। তবে সত্যি কথা বলতে কি তখন আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার ড্যাড যাঁর চোখে মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকে সে এমন ভঙ্গিমা করে থাকতে পারে, অবিশ্বাস্য ছিলো।

_তুমি আমার ছেলে রাদ। ভয় কেন পাবে? এই চব্বিশ বছরের জীবনে এই টুকু তো বুঝতেই পেরেছো তুমি আর তোমার মম আমার কাছে সব থেকে প্রিয়। যখন থেকে তোমার দাদা দাদি কে হারিয়ে ছি তখন থেকে শুধু মাত্র তোমরাই আমার আপন। কারন আমি বুঝেছিলাম রক্তের সম্পর্ক হলেই আপন হওয়া যায় না।
অবশ্য কষ্ট তো তখন পেয়েছিলাম যখন নিজের ভাই ও পর হয়ে গেল।

_প্লিজ ড্যাড ক্লোজ দ্যা ম্যাটার। অনেক দিন হলো কাচ্চির কম্পিটিশন করি না। চলো হয়ে যাক আজ।

_তুমি পারবে না বেটা।

_তোমাকে হারাবোই আমি।

_আচ্ছা দেখা যাক।

দুই প্লেট কাচ্চি শেষ করে দিলেন ইফতিহার আর রাদ এক প্লেটেই বসে আছে। হার মেনে নেয় ছেলে টা। বাবার মতো খাদক হতে পারে নি সে। হাসেন ইফতিহার, কার্ড বের করে নাক কুঁচকে রাদ বলে
_ইসস আমার এতো গুলো টাকা চলে যাবে এখন।

_বলেছিলাম, পারবে না। এখন পে করো 1500 টাকা।

_ধ্যাত আমার প্রিয় টাকা গুলো।

ছেলের ভঙ্গিমা তে হাসেন ইফতিহার। রাদ কে ড্রপ করে দিতে চাইলে রাদ বলে
_আমি একটু পরে যাবো ড্যাড। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে চাচ্ছি।

_আচ্ছা যাও। তবে বেশি রাত করো না। আমি কি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো?

_দরকার নেই। ওদের কারো বাইক দিয়ে চলে যাবো।

_ওকে।

ইফতিহার চলে যান। মিনিট দশেক পর রনিত আসে। বন্ধু মহলের বেস্ট ফ্রেন্ড হলো রনিত। ছেলেটা যেমন তেমন স্বভাবের। তবে ইনায়ার সংস্পর্শে এসে একদম ই বদলে গেছে। ভালোবাসার প্রভাবে পাল্টে গেছে ওহ। এখন এই মনে এক জনের ই বাস।
.

কলেজের প্রথম দিন। বুকের ভেতর ধীম ধীম কিছু একটা বেজে চলেছে। মনের ভেতর খচ খচ হচ্ছে। এই আড়ষ্টতা, এক অদ্ভুত সংকোচ, ধীম ধীম আওয়াজ কি পাশে থাকা মানুষ টা বুঝতে পারছে না?

গাড়ি তে থেকে তিক্ত হয়ে গেছে ভোর। এতো সময় যাবত জ্যাম লেগেছে যে ঘাম নেমে গেছে। কে বলবে এখন শীত কাল?
_ এটা কি এসি গাড়ি ডাক্তার সাহেব?

_হুম।

_এসি টা অন করুন না।

এতোক্ষন পর ভোরের দিকে পূর্ন দৃষ্টি মেলে তাকায় রাদ।মেয়েটা ঘেমে একাকার। গ্লাস অফ করে এসি অন করে দেয় রাদ। বলে
_মাফলার খুলে ফেলো।

_হুম।

_এতো ঘামছো যে? শরীর খারাপ লাগছে।

_উহহু ভয় হচ্ছে খুব।

_ভয়? সেকি এতে ভয় পাওয়ার কি আছে?

উত্তর করে না মেয়েটা। রাদ ও নিশ্চুপ হয়ে যায়। জ্যাম ছাড়তেই গাড়ি চালাতে শুরু করে। ক্যাম্পাসে এসে ভোরের বরাবর দাঁড়ায়। ধীর হাতে দুই বাহু তে হাত রেখে বলে
_আমার দিকে তাকাও।

ভোর তাকায়। তবে আবারো চোখ নামিয়ে নেয়। মুখ দিয়ে বিরক্তি কর শব্দ ফুঁটিয়ে বলে
_আরে তাকাও।

এবার মুখ তুলে তাকায় ভোর। রাদের দৃষ্টি ধারালো। গলায় পানি শূন্য অনুভব হয়। আদুরে কন্ঠ টা কানে আসতেই গা শিউরে উঠে। মেয়েটা যে পুরো ক্যাম্পাসে একা। রাদ বলে
_ভয় পেলে চলবে বলো। জীবনে কতো কাজ একা করতে হয়। তোমাকে তো সেভাবেই গড়ে উঠতে হবে। এতো টা বড় হতে হবে যাতে আর ও দশ টা মেয়ে তোমার থেকে শিক্ষা গ্রহন করে। কোনো স্বামী তাঁর স্ত্রী কে যৌতুক এর জন্য টর্চার করতে না পারে। কোনো বাবা মা ভবিষ্যত পরিস্থিতির জন্য চিন্তা গ্রস্ত হয়ে মেয়ে কে অবহেলায় না ঠেলে দেয়।

আরো অনেক কথাই বলে রাদ। তবে ভোর আটকে গেছে। মানুষ টির মুখ থেকে স্বামী শব্দ টি শুনে আটকে গেছে ওহ। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টি যে ওর স্বামী। তবে কাগজে কলমের স্বামী, মনের দিক থেকে কারোই তো অনুভূতি নেই। এই সম্পর্ক এক জনের কাছে দায়িত্ব আর আরেক জনের কাছে মাধ্যম। শুধু মাত্র নিজ লক্ষ্যে পৌছানোর মাধ্যম। রাদ ছাড়া সাহায্য করার মতো কেউ নেই ওর কাছে। সৃষ্টিকর্তার এক মাত্র উছিলা হলো রাদ। যেই মানুষ টি পরিস্থিতি অনুযায়ী ওর স্বামী হয়েছে।
_আপনি চলে যান।

_ক্লাস রুমের ভেতরে পৌছে দেই তোমায়।

_উহুহ। পুরো ক্লাস তো আমি একাই করবো, আপনাকে আর নিতে চাচ্ছি না। আপনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন এই মুহুর্তে আপনাকে আর বিপাকে ফেলে দিতে চাই না।

_বিপাক কেন বলছো?

_আপনার জীবন থেকে অনেক টা সময় নিয়ে নিলাম আমি। যে সময় টা আপনি অন্য কোথাও ব্যয় করতে পারতেন।

_এমন করে কেন বলছো তুমি? লুক, তুমি কি আপসেট বা আমার প্রতি বিরক্ত। কোনো ভাবে আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি?

কিছু টা দূরে সরে যায় মেয়েটা। রাদের প্রতি বিরক্ত হওয়া ওর কোনো কালেই সাজে না। যে ছেলে টা ওর জন্য এতো করলো সেই মানুষ টার প্রতি মন থেকে শ্রদ্ধা আসে। পেছন থেকে অনুনয়ের সরে রাদ বলল
_ ভোর।

প্রচন্ড আবেগ এই কন্ঠে। রয়েছে মন মাতানো সুর।সাথে তীব্র ব্যাথা ও মিশ্রিত। আতকে উঠে মেয়েটার হৃদপিন্ড। খন্ডিত করতে চায় বুক। দেখতে চায় মানুষ নামের সেই অদ্ভুত ব্যক্তি টি কে।যে কিনা সবার থেকে আলাদা।বিনা সংকোচে রাদের হাত দুটো স্পর্শ করে বলল
_আপনি মন খারাপ কেন করছেন? আমি তো শুধু বলতে চাচ্ছি বাকি পথ টা তো আমায় একাই চলতে হবে। জীবনে বড় হতে হবে না? আপনি তো সর্বক্ষণ আমার সঙ্গে থাকতে পারবেন না। তাই আমি এই টুকু ও একা চলতে চাচ্ছি।

_আচ্ছা যাও। বাট কাউ কে ভয় পাবে না। তোমার ডাক্তার সাহেব সব সময় তোমার পাশে আছে।

_হুম।

_ফোন অফ করবে না কখনো। ক্লাস শেষ হলে আমাকে জানিয়েও আমি তোমাকে পিক করবো। বেস্ট আফ লাক।

মৃদু হেসে পথ আগায় ভোর। নির্লিপ্ত তাকিয়ে থাকে রাদ।মেয়েটা কে একা ছাড়তে ও ভয় হয়। তবে জীবনের সব টুকু পথ কারো পাশে চলা যায় না। মাধ্যম হলে ও সর্ব সাথী হওয়া কখনোই সম্ভব নয়।তবে হ্যাঁ জীবন কে সুষ্ঠু ভাবে গড়ার জন্য মনোবল ই যথেষ্ট। আর ভোরের মনোবল ই হতে চায় রাদ। এক টা অবহেলিত মেয়ে কে গড়ে তোলায় প্রত্যয় নিয়ে এসেছে। এই দায়িত্ব কে আগলে রাখতে পিছু হটবে না কখনোই।

চলবে

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_13

‘ হেইই সুইট গার্ল ‘
অনাকাঙিক্ষত কারো ডাকে পেছন ফিরে তাকায় ভোর। তিন টে ছেলে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে স্টুডেন্ট তবে পোশাক দেখে মনে হয় মডেলিং করতে এসেছে। এদের কে পাত্তা না দিয়ে সামনে আগায় মেয়েটা। তবে পেছন থেকে কারো দৌড়ে আসার শব্দ কানে আসে। হঠাৎ ই লম্বা করে ছেলেটা কাছে চলে আসে। কোমরে হাত গুঁজে দিয়ে বলে
_ডাক দিলে সাড়া দেও না কেন?

_আমার ক্লাস আছে।

_ কলেজে আবার ক্লাস? আরে রাখো তো সব ই এক।

_দয়া করে পথ ছাড়ুন।

_আরে ছাড়বো তো। আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর দাও।

প্রশ্নের কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় ভোর। ভ্রু দুটো সামান্য বেঁকে ও গেছে। পাশ কাঁটিয়ে চলে যেতেই ছেলেটা হাত ধরে ফেলে। পুরো শরীরে যেন বিদ্যুত চমকে যায়।ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে বলে
_একদম টাচ করবেন না। খুব খারাপ হয়ে যাবে তাহলে।

_ওহ হো কামন ইয়ার, এতো হাইপার কেন হচ্ছো।

_দেখুন আমি আপনার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নই।

গট গট শব্দ তুলে ভোর চলে যায়। পেছন থেকে ছেলে টা চেঁচিয়ে বলে
_লিসেন, নুহাশ এর থেকে কেউ ছাড়া পায় না। প্রতি টা মেয়ে কে জবাব দিহি করতে হয়।

গাঁ ঝম ঝম করে মেয়েটার। ছেলেটার আচারন এক দম সঠিক নয়।দেখেই বোঝা যায় মেয়ে দের উত্ত্যক্ত করাই এর প্রধান কাজ।

_ক্লাস কেমন হলো?

_হুমম কিছু বললেন?

_আরে ক্লাস কেমন হলো?

_ভালো।

_কোনো কিছু নিয়ে টেনশনে আছো তুমি? চোখ মুখ শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

_না তো। এমনি শীতের কারনে হয়তো।

গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকে রাদ। হাতে সময় কম। গাড়ি টা হোস্টেলের দিকে মোর ঘোরাতেই ভোর বলে
_ডাক্তার সাহেব আপনার কাছে সময় হবে?

সময়ের কথা শুনে গাড়ি টা থামিয়ে দেয় রাদ। এবার ভোরের দিকে পূর্ন দৃষ্টি মেলে তাকায়। মেয়েটার চোখ মুখ কেমন অন্ধকার দেখাচ্ছে। কিছু নিয়ে গভীর চিন্তিত দেখাচ্ছে। যদি ও হাতে একদম ই সময় নেই তবু ও রাদ বলে
_হুম আছে বলো।

_একটা নিস্তব্ধ জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন? কোলাহল নেই যেখানে। শুধু গুটি কয়েক পাখির আওয়াজ।

বিস্মিত দুই চোখ অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করেই ভোর কেন এমন চাইছে? তবে কি সে বিরক্ত এই শহরে। গলা টা শুকনো লাগে। পাশ থেকে পানির বোতল টা খুলে মুখে দিতে নিয়ে ও দেয় না। ভোরের দিকে এগিয়ে দেয়। পানি টা যেন খুব করে টানছে ওকে। খপ করে বোতল টা হাতে তুলে নেয়। নিমিষেই পুরো বোতল পানি শেষ করে দেয়। চিন্তিত কন্ঠে রাদ বলে
_কি হয়েছে তোমার? একটু খোলসা করে বলো। না হলে তো প্রবলেম সলভ হবে না।

নাক টা লাল হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই এর কারন বুঝতে পারলো না রাদ। চোখ দুটো ও কেমন দেখাচ্ছে। আলতো হাতে ভোরের বাহু তে স্পর্শ করে রাদ।
_কি হয়েছে বলো আমায়? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

_একটা ছেলে আমার হাত ধরেছিলো। তখন থেকে সব এলোমেলো লাগছে। আমি জানি না কেন আমার এমন লাগছে। প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছে। মনে হচ্ছে হাত টাই কেঁটে ফেলি।

বলতে বলতে কেঁদে ফেলে ভোর। রাদ যেন হতবাক হয়ে যায়। মেয়েটা এমন পাগল কেন?

লেকের ধারে বসে আছে ভোর আর রাদ। শহর থেকে একটু দূরে এই লেক টাই আছে যেটা নিস্তব্ধ আর কোলাহলমুক্ত। গুটি কয়েক পাথর কুরিয়ে নিয়ে আসে রাদ। ভোরের দৃষ্টি লেকের টলটলে পানি তে। হয়তো পুরনো স্মৃতিচারণ করছে সে।
একটা পাথর পানি তে ছুঁড়ে দিতেই ভোরের ধ্যান ভাঙে। রাদ বলে
_শুধু মাত্র হাত স্পর্শ করেছিলো তাই না?

_হুম।

_বাজে কোনো ইনটেনশন ফিল করেছো?

_উহু।

_তাহলে এতো টা হাইপার হয়ে যাচ্ছো কেন?

_জানি না আমি। শুধু মাত্র মনে হলো উচিত হয় নি। আমি অনুভব করেছি আমি অন্য

থেমে যায় ভোর। পুরো কথা শেষ না করেই বলে
_ আমার ভালো লাগে নি। আমি চাই না আমাকে স্পর্শ করুক কেউ। আমার ঘৃনা হয়।

_পুরোই পাগল তুমি। দেখি এর জন্য এতো টা কাঁদে কেউ? পুরো রাস্তা তে কাঁদতে কাঁদতে এসেছো।

ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটায় ভোর। রাদের মনে কিছু একটা অনুভব হয়। সামান্য স্পর্শ কাউ কে এতো টা এট্রাক করতে পারে।
.

রাত নয় টা বেজে গেছে তবে কাজ শেষ হয় নি। হবেই বা কি করে? দুপুরে লাঞ্চ টাইমে গিয়ে অফিসে ফিরেছে সন্ধ্যা তে। প্রায় সবার ছুটি হয়ে গেছে। শুধু মাত্র বসে আছে রাদ আর মুসতাকিম। প্রথম প্রথম হওয়া তে রাদ যেন বিরক্ত হচ্ছে। তবে মুসতাকিম পূর্ন দমে কাজ করছে। একেই বলে দক্ষতা। মানুষ একটা কাজের সাথে যতো বেশি জড়িয়ে যাবে ততো বেশি দক্ষ হবে।
_স্যার ম্যাম ফোন করেছেন।

_উফফ মম আবারো কল করেছে। আচ্ছা ফোন টা রিসিভ করে দাও তো।

রিসিভ করে দূরে চলে যায় মুসতাকিম। ওপাশ থেকে রামিসা বলেন
_এখনো বাসায় ফিরলে না, আবার ডিনার ও করলে না। দুপুরে কথা ছিলো বাসায় এসে লাঞ্চ করবে। কিন্তু তা ও আসলে না। তোমার ড্যাড না থাকাতে বড্ড অনিয়ম করছো তুমি।

_অনেক কাজ মম। আরো কিছু টা সময় লাগবে।

_সে লাগুক। রাত দুটো বেজে যাক, আমার কোনো অসুবিধা নেই। শুধু মাত্র ডিনার টা কমপ্লিট করে আমাকে জানাও।

_ডিনার করার মতো সময় নেই মম।

_তাহলে এখনি বাসায় আসো। দরকার হলে বাসায় বসে সারা রাত কাজ করবে।

_মম।

_মুসতাকিম কে ফোন দাও।

_মুসতাকিম এদিকে আসো, দেখো মম কি বলে।

ফোন নিয়ে চলে যায় মুসতাকিম। আবারো কাজে মনোযোগ দেয় রাদ। ইফতিহারের প্রতি প্রচন্ড ক্ষোভ জমা হয়েছে। মানুষ এভাবে কি করে কাজ করতে পারে?
একটু তেই হাঁপিয়ে গেছে রাদ। আর ইফতিহার তো গত বিশ বছর যাবত এই কোম্পানি ও হসপিটাল সমান তালে সামলাচ্ছেন।এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে বিজনেস এর থেকে মেডিকেল এর মোটা মোটা বই শেষ করা অনেক সহজ। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেই গলা শুকিয়ে যায় রাদের। টেবিলে থাকা গ্লাসের পানি টা শেষ করে দেয়। ডাক্তারি, মেডিকেল আবার বিজনেস এতো সব কি করে সামলাবে ওহ?

_এই আধ ঘন্টা কোথায় ছিলে মুসতাকিম? কতো বার করে ডাকলাম। ইনফেক্ট তোমার ফোন ও অফ।

_স্যরি স্যার। ম্যাম আমাকে যেতে বলেছিলেন সেই কারনেই গিয়েছিলাম।

_মম?

_জি স্যার।

_উফফ আবার কেন?

_ডিনার পাঠিয়েছেন।

_এই রাতের বেলা রান্না করেছে তাই না? ওয়েট আজ মম এর সাথে আমার একটা ঝগড়া হবে।

রামিসা কে কল করে রাদ। অথচ ফোন রিসিভ করেন না তিনি। একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে মুসতাকিম। কয়েক বার ফোন করে শেষ মেশ থম মেরে যায় ছেলেটা। রাদের দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বলে
_ম্যাম বলে দিয়েছেন ফোন রিসিভ করবেন না। আপনার জন্য লেমন রাইস করেছেন। খেয়ে ফেলুন স্যার। ম্যাম এর হাতের রান্না জাস্ট ওয়াও। আমি মিস করতে চাচ্ছি না। আমি গেলাম।

খাবার নিয়ে চলে যায় মুসতাকিম। প্লেটের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে রাদ। রামিসা কে বেস্ট মায়ের উপাধি দিতে চায় ওহ। বাড়ি তে কাজের লোক থাকলে ও স্বামী সন্তানের জন্য নিজ হাতে রান্না করবে। সচরাচর এমন টা দেখা যায় না। আজকাল একটু পয়সা হলেই কিচেনে যেতে চায় না কেউ।আর এদিকে রামিসা পুরোই উল্টো। এতো প্রপার্টিজ থাকতে ও পরিবারের মানুষদের নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবে।সত্যিই তো টাকা তে সুখ কেনা যায় না। সুখ তো হয় ভালোবাসায়।

পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পরে রাদ। রনিত আর ইনায়ার বিয়ের জন্য কথা বলতে হবে। তবে ভোর কে কলেজে পৌছে দিতে হবে। তাই রনিতের সাথে দেখা করে হোস্টেলের কাছে আসে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে বের হয় ভোর। গলায় মোটা করে মাফলার জড়ানো। দাঁতে দাঁত যেন লেগে যায়।
_চলুন ডাক্তার সাহেব।

_হুম যাবো। এতো কাঁপা কাপি করছো কেন?

_প্রচন্ড শীত। আপনার শীত লাগছে না?

_একদম ই নয়।

_কেন?

_আমার শরীরে উষ্ণতা বেশি। দেখো আমি একদম ফিট। আর তুমি শুকনো পাতার মতো।

_শুকনো পাতার মতো?

কথা টা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে ভোর। হেসে ফেলে রাদ। গাড়ি তে উঠতেই হিটার অন করে দেয়। স্টিয়ারিং এ হাত রেখে বলে
_গাড়ি ড্রাইভ শিখবে?

_আমি?

_হুম।

_আমার দ্বারা হবে না।

_অবশ্যই হবে। আজ থেকে গাড়ি ড্রাইভ শিখাবো তোমায়।

খুশি হয় ভোর। গাড়ি চালানো টা ওর ছোট বেলার স্বপ্ন বলা যায়। গ্রামে তখন কাঁচা রাস্তা। ঘন্টায় একটা করে গাড়ি যেতো রাস্তা দিয়ে। আর নির্লিপ্ত তাকিয়ে থাকতো ভোর। এক বার প্রচন্ড বৃষ্টি তে কাঁদা জমে গিয়েছিলো আর গাড়ি আটকে গিয়েছিলো। তখন ওরা সবাই মিলে গাড়ি টা ঠেলে দিয়েছিলো। ভাবতেই হেসে ফেলে ভোর।

_আজ কে যদি ঐ ছেলেটা তোমার কাছে আসে তাহলে আমাকে কল করবে।

_কল করতে হবে না।

_হুস। যা বলছি তাই। কল করবে আমায়। না হলে খবর আছে তোমার।

_আচ্ছা কল করবো।

হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায় রাদ। ভোর ও ক্যাম্পাসে চলে আসে।
.

শুভ্র পাঞ্জাবি তে রনিত যেন রাজকুমার। বেডে আধ শোয়া হয়ে দেখে চলেছে রাদ। রনিত এর চাপ দাঁড়ি অথচ ক্লিন সেভ করে রাখে। এ দিকে রাদ চায় চাপ দাঁড়ি হোক, অথচ ওর চাপ দাঁড়ি নয়। সেই কারনে ক্লিন সেভ করতে হয়। আয়না তে রাদ কে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে
_ কি রে ভাই আমাকে দেখে লাভ কি তোর? আমি তো ইনায়া কে বিয়ে করবো। তাছাড়া আমি গে হতে পারবো না।

_শালা হারামি। তোর দিকে গে এর নজরে তাকিয়ে ছি আমি। মানছি তুই সাদা ফরেনার এর মতো বাট নাক টা দেখেছিস? একদম ই তাল গাছের মতো লম্বা। ছিইই

_উফ আমার নাক নিয়ে এতো সমস্যা কেন তোর? তোর নাক ও তো লম্বা।

_তোর মতো তাল গাছ নয়।

কিছু বলবে তখনি দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হয়। দরজা খুলতেই বিচ্ছু বাহিনী প্রবেশ করে। দু হাত দূরে সরে যায় রাদ। বলে
_রূপ একদম নয়। উল্টো পাল্টা কিছু করলে তোর খবর আছে। আমি অনেক কষ্ট করে গোসল করে এসেছি।

_কামন ভাই একটু রঙ খেললে কি হবে?

_ অনেক কিছু হবে।

_ভাইয়া তোকে একটু লাগাই?

_তুই কি বড় হবি না রূপ? ভারসিটি তে পড়িস, লম্বায় আমাকে ছাড়িয়ে গেছিস। এখনো কি বাচ্চা মি করবি?

_বাসায় বিয়ে লেগেছে আর মজা করবো না। আমরা তিন বন্ধু এসেছি তোমাদের ভূত করার জন্য।

রঙ মাখাবে তখনি ঘরে আসে রনিতের সব বন্ধু রা। সময় কম দেখে রূপ রা ও চলে যায়।

সুপ্তি এসেই রাদ এর সাথে চিপকে গেছে।কিছু একটা নিয়ে চাঁপা হাসির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বার বার চোখ পাকাচ্ছে রাদ। নাহিদ বসে পরেছে ফোন নিয়ে। আর দ্বীপ আর রায়া চলেছে প্রেম নিবেদনে। কেউ যেন রনিত কে পাত্তাই দিচ্ছে না। পরিশেষে ছেলেটা নাহিদের পাশে এসে বসে। বাঁকা হেসে নাহিদ বলে
_সিঙ্গেল ফিল হচ্ছে ব্রো?

_একদম। আজ আমি সিঙ্গেল না হয়ে ও সিঙ্গেল। বিয়ে টা হোক দেখবি তোদের সবাই কে কি পরিমানে জেলাসি ফিল করাই।

_আমি জেলাস হবো না।

_হবি কি করে? তুই তো মেয়ে বাজ।

বিগলিত হাসে নাহিদ। ওর হাসির শব্দে সবাই গোল গোল করে তাকায়। রাদ বলে
_শুরু হয়ে গেল এর পাগলামি।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

চলবে