চলো রোদ্দুরে পর্ব-৩২+৩৩

0
664

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_32

‘ আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছি যে আমার বন্ধু মহলের দুই প্রান প্রিয় বন্ধু আমাকে দুঃখ দিয়ে প্রেমের সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন।’

রাদের উপস্থাপনা দেখে হাসতে লাগলো সকলেই। সবার আগে ছুটে এলো সুপ্তি। রাদ কে জড়িয়ে ধরে বলল
_স্যরি স্যরি স্যরি। বিশ্বাস কর এই হারামি নাহিদ কে ভালোবাসি না আমি। শুধু মাত্র ওকে জ্বালানোর জন্য এই রিলেশন এর নাটক।

_হয়েছে। আপনি অনেক বলেছেন। দুদিন পর বিয়ে করে নিবেন তারপর ও আমরা জানবো না।

_রাদ।

মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে গেলো সুপ্তির। মেয়েটার হাত ধরে রাদ বলল
_রাগ করার কথা আমার আর রাগ করছিস তুই?

_আমি এমনি।

আবারো হাসির রোল পরে গেল। নাহিদের মন টা ভালো নেই। সবার দিকে তাকিয়ে থেকে ও তেমন হাসি মজা করতে পাচ্ছে না। সুপ্তি এসে ওর মন ভালো করার চেষ্টা করলো। নাহিদ বলল
_আমি তোকে বিয়ে করতে চাই সুপ্তি।

_আমি ও তো চাই।

_কিন্তু আমার মম ড্যাড

নাহিদের মুখ টা কেমন হয়ে গেল। সুপ্তি বলল
_ওনারা আমাকে মেনে নিবেন না?

_সেটা নয়। ওনারা আসতে চায় না এ দেশে।

_কিন্তু নাহিদ তাহলে কি করে হবে?

দম ফেললো ছেলেটা। সুপ্তির অবিন্যস্ত চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে বলল
_আমি ওদের সাথে কথা বলে তোকে জানাবো।

মাথা ঝাঁকালো সুপ্তি। মলিন মুখে সবার সাথে আড্ডা দিতে লাগলো দুজনে। তবে ভেতর থেকে শান্তি অনুভব হলো না। এ যন্ত্রণার বুঝি শেষ নেই।

_রাদ।

_হ্যাঁ রনিত বল।

_ একটু এদিকে আয়।

সকলের থেকে রাদ কে আড়ালে নিয়ে গেল রনিত। ছেলেটা কিছু একটা বলতে চাচ্ছে তবে পারছে না। রাদ আশ্বস্ত করে বলল
_আরে বল।

_ভাই আঙ্কেল আন্টি তোকে নিয়ে মেয়ে দেখতে যাবে বলছে।

_তো সমস্যা কি?

_উফফ রাদ, তুই কি ভুলে গেলি?

_কি ভুলে গেলাম?

_আরে ভাই

_হেয়ালি না করে ভেঙে বল।

_ভোরের কি হবে?

শান্ত চোখে তাকালো রাদ। এই কয়েক বছরে ভোর কে ছোট বোনের স্থান দিয়েছে রনিত। তাই এতো চিন্তিত ছেলেটা। রাদের বাহু ঝাঁকিয়ে বলল
_তোর অনুভূতি কি?

_আমার কোনো অনুভূতি নেই। আমি চেষ্টা করেছি দায়িত্ব পালনের।

_আর বিয়ে টা?

শুকনো ঢোক গিললো ছেলেটা। এই মুহুর্তে কিছু বলার মতো ভাষা নেই ওর। তাই প্রসঙ্গ বদলে আবারো আড্ডা তে মজে গেল।
.

ভোর কে দেখতে এসেছে রনিত আর রাদ। দুজন কে এক সঙ্গে আশা করে নি মেয়েটা। রনিত বলল
_একি মুখ টা এমন কেন? আমরা আশা তে খুশি হও নি?

_খুশি হবো না কেন? অবশ্যই খুশি হয়েছি। তবে দুজন কে এক সাথে আশা করি নি।

মেয়েটির সরল উত্তর দেখে হাসলো রাদ। এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো ভোর। রনিত বলল
_একটা সুসংবাদ রয়েছে। আজ আমরা রাদ এর জন্য পাত্রী দেখতে যাচ্ছি।

_ওহহ এখনি যাবেন?

ভোরের স্বাভাবিকতা দেখে মুখ টা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল রনিতের। এ কেমন মসিবতে পরলো ওহ? এরা দুজন কি সব পানি তে গুলে খেয়েছে?

বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে রাদ আর রনিত বেরিয়ে এলো। রনিতের মাথা কেমন ভন ভন করছে। রনিত বলল
_তোরা কি এই বিয়ে টা ভেঙে দিতে চাচ্ছিস?

_আমাকে কেন বলছিস তুই?

_আজব তো কাকে বলবো?

_জানি না।

পকেটে হাত গুঁজে দিয়ে হাঁটা লাগালো রাদ। রনিতের কাহিল অবস্থা। ছেলেটা এক বাচ্চার বাপ হয়ে ও বুঝতে পারে না এই দুই মানব মানবীর অনুভূতি।

কতো গুলো মেয়ের ছবি পরে আছে রাদ এর কাবাডে। সব গুলোই রামিসা আর ইফতিহারের দেওয়া। ছেলেটা ব্যক্তিত্ব সবাই কেই মুগ্ধ করেছে। সেই কারনে এতো গুলো প্রস্তাব এসেছে।না দেখেই রিজেক্ট করে দিয়েছে রাদ। তাই আজ কোনো এক অপ্সরীর সাথে দেখা করাবে বলে মনস্থির করেছেন রামিসা। রাদ অবশ্য বারন করে নি। নাহিদ আর রনিত ওহ এসেছে। সবার মুখ ই গোমড়া। যেন কেউ ই রাজি নয় এই বিষয়ে।
_তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে রাদ।

_আমি তো তৈরিই।

_এই কস্টিউম পরেই যাবি?

রনিতের প্রশ্নে বিব্রত হলো ছেলেটা। শার্টের গাঁ থেকে সামান্য ঘামের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। তাই শার্ট টা চেঞ্জ করে নিলো ওহ। নাহিদ গেমস খেলায় মত্ত হলো। রনিত এগিয়ে এসে শীতল কন্ঠে বলল
_একটু ভেবে দেখ।

_কি ভাববো?

_হেয়ালি ভালো লাগছে না রাদ।

_কোনো হেয়ালি নেই এতে। যে কোনো সম্পর্কের জন্য দুটো পজিটিভ মনের প্রয়োজন।

_আমি এখানে নেগেটিভ মন খুঁজে পেলাম না।

_এখন এসব বাদ দে রনিত।

চুপ হয়ে গেল রনিত। রাদের মন টা কেমন অস্থির চঞ্চল। ছেলেটা বরাবর ই আফসোস করে কোনো রকম মাদক কিংবা ধূম পান না করতে পারার জন্য। এমন নয় যে চেষ্টা করে নি। বহু দিন চেষ্টা করেছে। তবে কখনোই সম্ভব হয় নি। ভেতর থেকে নাকোচ চলে আসে।
_হয়েছে তোমাদের?

_জি আঙ্কেল অলমোস্ট।

_একি নাহিদ এখনো ফোন ইউজ করছো। রাখো এগুলো , আসো আমার সাথে অনেক কাজ করতে হবে।

হাসি মুখে সম্মতি প্রদান করলো নাহিদ। ইফতিহারের সাথে খোশগল্প হলো কয়েক মুহুর্ত।

‘ মেয়ে দেখতে যাওয়ার জন্য এতো তত্ত্ব নিয়ে আসে কেউ? ‘

_উফফ বেশি কথা বলো না তো।

রামিসার ধমকে সরে আসলেন ইফতিহার। তত্ত্ব দেখে মনে হচ্ছে পাত্রী দেখতে নয় পাত্রী কে তুলে আনার ব্যবস্থা চলছে। অবশ্য মেয়েটা আসলেই সুন্দরী। ইফতিহার নিজেও ছবি দেখেছেন। রামিসার কোনো এক কাজিনের মেয়ে। তিন গাড়ি করে তত্ত্ব পাঠিয়ে দিলেন রামিসা। ড্রয়িং রুমে এসে তাগাদা দিয়ে বললেন
_আরে আসো তোমরা। এমন ভঙ্গিমা করে আছো কেন রাদ? কিছু হয়েছে বেটা?

_আম ওকে মম।

_আচ্ছা দ্রুত আসো। রনিত, নাহিদ রাদ কে নিয়ে আসো তো বেটা।

_জি আন্টি।

রনিতের কোনো আগ্রহ নেই। তাই নাহিদ ই এগিয়ে গেল। রাদ এর পাশে এসে বলল
_কি রে চল।

_যাহ আসছি আমি।

_আন্টি কি বললো শুনলি না?

_একটু পরে যাবো নাহিদ।

_আশ্চর্য হচ্ছি আমি। আরে আয় না রে দোস্ত।

_নাহিদ একটু পর।

_না কোনো পরে নয়।

_ আচ্ছা, আসছি।

নাহিদের সাথে হাঁটা লাগালো রাদ। তখনি ছেলেটার ফোন বেজে উঠলো। সুপ্তি কল করেছে। দুপুর থেকে আট বার কল করেছে মেয়েটা। মাত্র তেরো দিনের রিলেশন ওদের, অথচ তেরো হাজার বার কল করে নিয়েছে সুপ্তি। এমন প্রেমিকা পাওয়া ভাগ্য নয় রাজ ভাগ্যের ব্যাপার।
.

আকাশের পানে তাকিয়ে থেকে চোখের পানি মুছলো ভোর। বুকের ভেতর কষ্ট টা যেন হুরমুরিয়ে বেড়ে চলেছে। ওর কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না। শুধু মাত্র চোখ থেকে নোনা পানির শ্রোত নেমে যাচ্ছে। টুং টাং ম্যাসেজ এর শব্দে ঘোর কাঁটে মেয়েটার। মিসেস মেরিন ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন।
‘ কাল সকাল সকাল আমরা সাত দিনের জন্য একটা ইনভেস্টিগেশন চালাবো। আমি অন্য কারো উপর ভরসা রাখতে পারছি না। বিষয় টা অতিব জরুরি। ‘

ক্রন্দনরত মুখ টা সিরিয়াস হয়ে উঠলো। একজন নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব কে রপ্ত করেছে মেয়েটা। উপলব্ধি করতে পারে নিজের জীবনের ঝামেলা গুলো কাজে প্রভাব পরলে কাজ সঠিক হয় না। লেপটপ নিয়ে বসে পরলো মেয়েটি। প্রচন্ড কাজ করতে হবে ওকে।

সকাল সকাল বের হতে যাচ্ছে ভোর। তাই রাদ দেখা করতে এসেছে। হাই তুলে ছেলেটি বলল
_কাক ভোর এখন, মাত্র সাড়ে চার টা বাজে।পশ্চিমা আকাশে এখনো ঘন কালো আঁধার। রোদ্দুর ছাড়া কোথায় যাবে তুমি?

_বিষয় টা খুব জরুরী ডাক্তার সাহেব। আমাকে যেতেই হবে। ম্যাম আমার উপর ভরসা করে আছেন। আর এতো গুলো মানুষ কে ন্যায় বিচার পাওয়ানোর দাবি তে কাজ করছি আমরা।

_কিন্তু এখন আঁধার ভোর।

মৃদু হাসলো মেয়েটি। হাতে থাকা ব্যাগ টি ফেলে রেখে সামান্য এগিয়ে এসে বলল
_আঁধার কে ভয় পাই না আমি। রোদ্দুর তো আপনিই দেখিয়েছেন তাই না?

নিদ্রাচ্ছন চোখে তাকিয়ে রইলো রাদ। মেয়ে টি বুঝি অনেক বড় হয়ে গেছে? বাচ্চা সেই সতেরো বছরের মেয়েটি আজ তেইশ বছরের যুবতী। কথায় রয়েছে ধারালো সুর। বোঝায় যায় কতো টা সচেতন মেয়েটি।

_ডাক্তার সাহেব।

_হ্যাঁ।

_আমায় যেতে হবে।

_আমি পৌছে দেই?

বারন করার ইচ্ছে থাকলে ও বারন করতে পারলো না ভোর। মন মস্তিষ্ক এক সাথে কাজ করছে না মেয়েটির। প্রচন্ড চিন্তিত হয়ে পরলো। এভাবে চলতে থাকলে বড় সড় ভুল হয়ে যাবে।
রাদ এর ভারী নিশ্বাসের শব্দে তাকালো মেয়েটি। ছেলেটার চোখ বার বার বুঁজে আসছে।
_গাড়ি থামান।

_কেন?

_থামান ই না।

মেয়েটির কথা মতো গাড়ি থামালো রাদ। গাড়ি থেকে নেমে এসে সিট বদল করলো ভোর। রাদ কে উদ্দেশ্যে করে বলল
_ আপনি বড্ড অলস হয়ে গেছেন আজকাল।

_বড্ড বেশি নয় কিছু টা।

_উচিত নয় এগুলো।

_কেন উচিত নয় মেয়ে। জানো না, অলসতা ভালো।

_আশ্চর্য!

_কিসের জন্য?

_জানি না।

ভোর আর কথা বাড়ালো না। স্মৃতির অলি তে গলি তে রাদ ছড়িয়ে আছে। পাঁচ বছর পূর্বে নিজ হাতে ড্রাইভিং শিখিয়েছিলো রাদ। কি সুন্দর সেসব অনুভূতি। চোখের পাতা গুলো নেতিয়ে পরতেই বা হাতে চোখ বুলালো। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে রাদ। বারং বারং মন চাইছে এ সময় যেন পার না হয়।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

চলবে

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_33

মিসেস মেরিন খ্রিস্টীয় ধর্মের অনুসারী এবং সে অর্ধ বাঙালী। তাঁর বাবা বাংলাদেশী হলে ও তাঁর মা একজন বিদেশিনী। সেই কারনে ভদ্র মহিলার মুখের গড়নে বেশ ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। অদ্ভুত লাগে ভোর এর কাছে। মহিলার চঞ্চলতা ওকে হাজার বার বিমোহিত করেছে। প্লেনে বসে ও নানান কথা বার্তা চললো দুজনের মাঝে। একটা সংস্থার নামে গরিব দের থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেই বিষয়েই হাই কোর্ট এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে মিসেস মেরিন আশংকায় আছেন। তাঁর ধারনা কিছু অনৈতিক মানুষ প্রমান সরানোর ব্যবস্থা করতে পারে।

কক্সবাজার এসে মিসেস মেরিন বললেন
_ইনভেস্টিগেশন এর জন্য সেন্ট মার্টিন পাঠিয়েছিলাম চার জন কে।তবে এঁদের কার্যক্রম দেখে মনে হলো বিক্রি হয়ে গেছে ওরা।

_এর জন্য আপনি চিন্তিত ম্যাম?

_হ্যাঁ। আমি চাই না এতো গুলো মানুষের পেটে লাথি মারা হোক।

_ইয়েস ম্যাম আমি বুঝতে পেরেছি।

ছদ্দবেশ ধারন করে দুজনে সেন্ট মার্টিন এর রিসোর্টে প্রবেশ করলো। লক্ষ্য একটাই, দুষ্টের বিনাশ আর ন্যায় বিচার।

এক সপ্তাহের কাজ তিন দিনে হয়ে যাবে তা কেউ ই কল্পনা করে নি। ঢাকার মাটি তে পা ফেলে স্বস্তির নিশ্বাস নিলো ভোর। মিসেস মেরিন কে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলো হোস্টেলে।

রাতে তিন্নির সাথে ডিনার করলো। মেয়েটা বড় ভালো। ভোর নিজের সমস্ত খরচ এখন নিজেই চালায়। মেয়েটার এমন সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করে নি রাদ। বরং দেখে ভালোই লেগেছে মেয়েটা যে স্বনির্ভর কে গুরুত্ব দিচ্ছে।
_একটা কথা বলি ম্যাম?

_অনুমতি নেওয়ার কি দরকার আছে তিন্নি আপু?

সামান্য হাসলো তিন্নি। ভোর কে ছোট বোনের মতোই সমীহ করে ওহ। তিন্নির এমন নিরশ তাকানো দেখে ভোর বলল
_আপনি কি খুব চিন্তিত আপু?

_উহু তেমন নয়। তবে খুব দ্রুত গভীর ভাবনা তে পরে যাবো মনে হচ্ছে।

_নিশ্চিন্তে বলুন না।

_আপনার সাথে রাদ স্যার এর বৈবাহিক সম্পর্ক টা আমাকে ভাবাচ্ছে। সব টা আমি জানি তবু ও এর পরিনতি নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্কে রয়েছি।

শীতল কন্ঠে উত্তর করলো ভোর
_সব কিছু সবার জন্য নয়। ডাক্তার সাহেব আমার কাছে অন্ধকার কাটানো রোদ্দুর স্বরূপ।

_সত্যিই কি আপনারা আলাদা হয়ে যাবেন?

_আমরা তো কখনো এক ছিলাম ই না।

তিন্নি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। কাল থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়েছে মেয়েটা। তাই ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
_বয়সে আমার ছোট আপনি। বড় বোনের মতো একটা উপদেশ দিচ্ছি নিজের অনুভূতি কে গুরুত্ব দিবেন।
.

বিদ্যুৎ চমকানোর মতো বার বার চমকে যাচ্ছেন রামিসা। ডিবাইনে বসে মুখ টিপে হাসছে রাদ আর ইফতিহার। রামিসা বললেন
_এতো বড় ধোঁকা। মেয়ে সুন্দর , শুধু চামড়া সুন্দর হলেই মেয়ে সুন্দর হয়?

আইস ব্যাগ মাথায় দিয়ে ধপ করে বসলেন সোফাতে। ইফতিহার হো হো করে হেসে উঠলেন। রাদের দিকে অসহায় চোখে তাকালেন রামিসা। হাতের ইশারায় রামিসা কে শান্ত হতে বললো রাদ। খবরের কাগজ মেলে দিয়ে ইফতিহার বললেন
_সকাল সকাল খবর এলো দেশের সমস্ত সুন্দরী মেয়ের দাঁত বোকরা।

_তুমি আমাকে শোনাচ্ছো তাই না?

_উহুহ। তোমাকে কেন শুনাবো?

রামিসার চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি ঝরছে। অবস্থা খারাপ দেখে রাদ বলল
_ রিলাক্স মম আমরা মেয়েই তো দেখেছি বিয়ে তো করে ফেলি নি?

_তবু ও এতো বড় কথা আগে কেন বললো না আমাদের? যেদিন দেখতে গেলাম সেদিন ও জানায় নি। কোনো মতে বিদেয় করেছে আমাদের। মেয়েটা তো কথা ও বলে নি। কে জানে বোবা নাকি।

_মম এটা ওনাদের মেন্টালিটির প্রবলেম। এসব ভেবে মন খারাপ করো না তো।

রামিসা বেশ দুঃখ পেয়েছেন। ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে দেখালো তবে মেয়েটার দাঁত সব পোকায় খেয়ে নিয়েছে সেটা বললো না?
চোখের পানি মুছে উপরে উঠে গেলেন তিনি। ইফতিহারের পাশে এসে বসলো রাদ। ইফতিহার বললেন
_তুমি আগে থেকেই জানতে সব টা?

_ইয়েস ড্যাড।

হাসতে হাসতে যা তা অবস্থা হলো। ইফতিহারের সাথে কিছু কথা বলে বেরিয়ে পরলো রাদ। রামিসার রাগ কখন যাবে কেউ বলতে পারে না। বোকরা মেয়ে ডাক্তারের বউ, এটা কি মানা যায়?
গার্ডেনে এসে ফিক করে হেসে উঠলো রাদ। দারোয়ান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রাদ সামান্য হাসার চেষ্টা করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলো।

নদীর পাড়ে এসে বসেছে রাদ আর ভোর। টলটলে পানি তে পা ভেজাতে দারুণ লাগছে। শিরশির রিনি ঝিনি বাতাসে কয়েক গাছি চুল উড়ে যাচ্ছে এলোমেলো হয়ে। মাথার উপর দিগন্ত আকাশের বুকে লেপ্টে আছে কতো গুলো মেঘ। এই সুন্দর পরিবেশের মাঝে খলবিলিয়ে হাসতে লাগলো এক তরুণী। ঝলকানো হাসি তে ঘোর লাগা দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো রাদ। হাসির এক পর্যায়ে রাদের হাত টা স্পর্শ করলো মেয়েটি। বলল
_ মেয়েটি যে বোকরা আপনি জানা সত্য ও আগে কেন বলেন নি?

_আমি বললে বিষয় টা অন্য রকম হতো। তাছাড়া আর্টিফিশিয়াল দাঁত লাগানো ও যেতো, তখন হয়তো মম ইমোশনাল হয়ে যেতো। হায় আফসোস করে বোকরা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিতো। বাট প্রতারিত হয়ে এখন রাগি মুডে আছে, এটাই ভালো হয়েছে।

_আপনি তো ভারী দুষ্টু।

_একটু আর কি।

হাসতে লাগলো ভোর আর রাদ। ভোরের হাত টা বার বার রাদ কে স্পর্শ করছে। মেয়েটার কোনো ধ্যান ই নেই। দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে রাদ বলল
_কেস টা জিতে গেছো শুনলাম।

_হুম অনেক ভালো লাগছে। পুরো ফ্রেস মাইন্ড এখন।

_পত্রিকায় তোমাদের ছবি বের হয়েছে। বেশ প্রশংসনীয় বিষয়।

_হয়তো। তবে সব টা মেরিন ম্যাম এর কারনে সম্ভব হয়েছে। আমি শুধুই তাঁকে সাহায্য করেছি।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতা বিরাজ করলো। আড়চোখে ভোর কে দেখে চলেছে রাদ।বিধ্বস্ত চেহারা কেন মেয়েটার?
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা পরতেই মেয়েটার হাত ধরে টানতে লাগলো রাদ। তবে আশ্চর্য জনক ভাবে ঠায় বসে রইলো মেয়েটি। আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে রাদ বলল
_কি হলো, আসো না কেন?

_না আসলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে কি ডাক্তার সাহেব?

থমকে গেল রাদ। মেয়েটার কথায় এতো ব্যথা কেন? বৃষ্টির পানির সাথে নোনা জলের ধারা একাকার হয়ে গেল। আজ বুক ফাঁটা আর্তনাদ করবে ভোর। অপেক্ষা শুধু মেঘ ডাকার। যেই না মেঘ ডাকলো চিৎকার করে উঠলো। প্রচন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রাদ। বৃষ্টির পানি গুলো যেন একে একে সমস্ত কাঁদা কে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। অন্ধকার ছাপিয়ে এনে দিচ্ছে ভালোবাসার রোদ্দুর। যে রোদ্দুরে রয়েছে প্রেম, প্রেম, আর প্রেম। এই প্রেমময় তৃষ্ণা রাদ কে ও স্পর্শ করেছে।
হয়তো এই প্রথম কিংবা প্রকাশ্যে প্রথম মেয়েটি কে ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরলো রাদ। মেয়েটির মাথায় পর পর চুমু খেয়ে বলল
_এই পাগলী এমন করো কেন? তুমি জানো কতো টা ভালোবাসি তোমায়?

_জানতে চাই না ডাক্তার সাহেব। আমি জানতে চাই না কিছু। আমাকে ছেঁড়ে যাবেন না আপনি। কোথাও যেতে দিবো না আমি। এই বৃষ্টি কে স্বাক্ষী রেখে আমি দাবী জানাচ্ছি। আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে হবে আপনাকে। আমি যেমনি হই না কেন আমাকে মেনে নিতে হবে। কোনো কিছুর বিনিময়ে আপনাকে ছাড়বো না আমি।

মেয়েটার কান্না জড়িত আকুলতা রাদের বুকে ঝড় তুলে দিয়েছে। বৃষ্টির পানি ছুঁইয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে। উহহু সমস্ত আড়ালতা কে ধুঁয়ে মুছে সাফ করে দিচ্ছে। যাঁর ফাঁক ফোকর দিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে প্রেমময় রোদ্দুর। যাঁর বৈধ্যতা সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে গড়েছেন।

ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঠান্ডা লেগে গেল ভোরের। বার বার হাঁচি দিচ্ছে। বিজ্ঞ দের মতো রাদ বলল
_আজব ধাতু তে গড়া তুমি।

_আমি কি করেছি?

_অধিকার চাওয়ার জন্য বৃষ্টি কেই সঙ্গী মনে হলো?

লজ্জা পেলো ভোর। তবে সে লজ্জা কে ছাপিয়ে হাঁচি নেমে এলো। নাকের পাটা লাল হয়ে আছে মেয়েটার। যাঁর ফলে হেসে কুটি কুটি রাদ। মেয়েটার কপালে ভালোবাসার পরস দিয়ে বলল
_সৃষ্টিকর্তা বোধহয় সেদিন আমার কথা শুনেছিলেন। তাই আজ তুমি আমার। শুধু কাগজে কলমেই নয় মন থেকে তুমি আমার।

ছেলেটার কথা বুঝতে পারলো না ভোর। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। এক হাতে মেয়েটি কে জড়িয়ে ধরে বলল
_আজ আমরা ফিরছি না কোথাও।

_তাহলে কোথায় যাবো?

_পাশেই একটা কুটির আছে সেখানে থাকবো।

_কেন?

_আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো কোনো এক বৃষ্টি মাখা রাতে বউ কে জড়িয়ে ভাঙা কুটিরে ঘুমাবো।

_কি অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা!

হেসে কুটি কুটি হলো ভোর। রাদের মোহ মিশ্রিত চাহনি তে হালকা লজ্জা পেল। বার বার নিজেকে ঠিক ঠাক করছে ওহ। তা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসছে রাদ। মেয়েটির কানের কাছে মুখ নিয়ে আসতেই গরম নিশ্বাস এসে পরলো ওর ঘাড়ে।
যাঁর ফলে কেঁপে কেঁপে উঠলো ভোর। রাদ বলল
_আজ এক টা বহু পুরনো গল্প শোনাবো।

চমকায়িত কন্ঠে ভোর বলল
_গল্প?

_হুম গল্প।

মেয়েটার নেতিয়ে পরা চুল গুলো থেকে টপ টপ করে পানি পরছে। গাড়ির কাছে এসে রাদ তোয়ালে বের করলো। অবাক হলো না ভোর। কারন রাদ এর কাছে এমন উদ্ভট জিনিস থাকে যাহ ভাবনার অতীত। মেয়েটির ভেজা চুল গুলো নিজ হাতে মুছে দিলো রাদ। প্রতি টা মানুষের শরীরের একটা আলাদা গন্ধ থাকে। ভোর এর ওহ রয়েছে। রাদ বরাবর ই ভাবে মানুষ কতো পাগল হলে বউ এর গাঁয়ের গন্ধ শোকে। কিংবা লুকিয়ে থাকতে পারে কাবাডের ভেতরে। নিজ ভাবনায় হেসে উঠলো রাদ। ভোর বলল
_কি হলো?

_উহুহ কিছু না।

এতোক্ষন অবাক না হলে ও এবার অবাক হলো ভোর। কারন রাদ একটা শপিং ব্যাগ থেকে শাড়ি বের করে দিলো ওর হাতে। সামান্য হাসতেই ভোর বলল
_এটা কি করে?

_দুটো কপি মিসেস।

_বুঝি নি আমি।

_তোমার জন্মদিনে এই শাড়ি টা দিয়েছিলাম মনে আছে?

_হুম, কিন্তু এখানে কি করে এলো এটা? আমি তো কাবাডে তুলে রেখেছিলাম।

_একি রকমের দুটো শাড়ি ডিজাইন করিয়েছিলাম আমি। একটা কপি জন্মদিনের উপহার স্বরূপ দিয়েছিলাম। শুভ্র সাদা রঙের মিহি শাড়ি।

_আমি কিছুই বুঝলাম না ডাক্তার সাহেব।

_এতো শত বুঝতে হবে না এখন এটা পরে আসো।

ভ্রু জোড়া বেঁকে গেল মেয়েটির। রাদ বলল
_গাড়ি তে বসেই চেঞ্জ করতে হবে। এখানে আর কোনো প্লেস নেই।

মাথা ঝাঁকিয়ে গাড়ি থেকে চেঞ্জ করে আসলো ভোর। রাদ এক পলক দেখে নিয়ে নিজ হাতে কাজল পরিয়ে দিলো ওকে। অবাকের উপর অবাক হচ্ছে ভোর। এ যেন অন্য রকম একজন। ছেলেটার ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি। এতো শতো আয়োজনের কারন কি তবে?

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

চলবে