চায়ের কাপেই জমুক প্রেম পর্ব-০৬

0
156

#চায়ের_কাপেই_জমুক_প্রেম (পর্ব ৬)
সায়লা সুলতানা লাকী

পুরো কাক ভেজা ভিজেছে উর্মি। অফিসের নিচে এসে মৃদুলের নাম্বারে কল দিতেই পেল ওর মোবাইল সুইচ অফ। কি এক যন্ত্রণা! তবে কী মৃদুল ওকে আসতে বলে ফাইজলামি করল?
উঁহু অমন হলে মোটেও ওকে ছেড়ে কথা বলবে না উর্মি। মনের মধ্যে প্রচন্ড রাগ চেপে গড়গড় করে ঢুকে গেল অফিসের ভেতর। মৃদুলের নাম বলতেই দেখিয়ে দিল ওর ডেস্ক। উর্মি ভালোমন্দ চিন্তা না করেই হনহন করে হেঁটে এগিয়ে এল ডেস্কের কাছে। এসে ওটা খালি দেখে তো আরও মেজাজ খারাপ হল। লোকটা কী কারণে তবে ওকে ডেকে পালালো? এমনটা কোনো সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ করতে পারে? প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ডানে বামে ঘুরে তাকাতেই পাশের ডেস্কের হিমু জিজ্ঞেস করল
— এক্সকিউজ মি, কাউকে কী খুঁজছেন?
— জি, মিস্টার মৃদুল…
— ও আচ্ছা, আপনি বসেন। ও একটু বসের রুমে গিয়েছে।
— কতক্ষণ লাগবে?
—- স্যরি?
—- না মানে ওনার ফিরতে কতক্ষণ লাগবে?
—- তা তো বলতে পারব না। বস যখন ছাড়বে তখনই ফিরবে।
—- এমন হলে উনি আমাকে আসতে বললেন কেন?
উর্মি একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বিরবির করে বলল।
— জি, স্যরি? শুনতে পাইনি।
— না, মানে আপনাকে কিছু বলিনি।
বলে একবার অফিসের চারপাশটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল।
অল্প সময় ওখানে বসতেই উর্মির অস্বস্তি শুরু হল। অফিসের সবাই কেমন ঘুরঘুর করে দেখছে ঠিক যেমনটা মানুষ চিড়িয়াখানার চিড়িয়া দেখে। মনে মনে যেই ভাবছে আর অপেক্ষা করবে না উঠবে এখন ঠিক তখনই দেখল মৃদুল ওর ডেস্কের সামনে এসে হাজির।
—- আরে আপনি? ইয়ে মানে…
— কেন অন্য কাউকে আশা করেছিলেন নাকি? ডেকেছেন আমাকে আর….
— রিল্যাক্স, আস্তে… কুল ডাউন…
মৃদুল চারপাশে একবার তাকিয়ে উর্মির দিকে ফিরে দুই হাত দিয়ে ইশারায় শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত দিল। উর্মিও কিছুটা লজ্জা পেল, কারণ ওর বলার ভঙ্গিতে হালকা আক্রমণাত্মক কিছু ছিল যা চারপাশের সবাই বেশ মজা নিয়ে দেখছিল।

এমনিতেই হিমু সহ অফিসের অনেকেই সন্দেহ করছে মৃদুল প্রেম করছে তাই চাচ্ছিলো না উর্মি এখানে আসুক, কিংবা ওকে কেউ দেখুক কিন্তু সিচুয়েশন যে এমন হবে তা বুঝতে পারেনি। উর্মি উঠে দাঁড়াতেই মৃদুল বলল
— ইয়েস, চলেন বাহিরে গিয়েই আলাপ করি। বলে ওকে পথ দেখিয়ে ও সামনে হাঁটতে শুরু করল আর উর্মিও বিশেষ কিছু না বলে মৃদুলের পেছন পেছন বেরিয়ে এল। আজ আর চা-ওয়ালার টং দোকানটায় বসল না বরং অফিসের গা ঘেষা ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকল দুজন।

— ইশশশ আপনি তো দেখছি পুরোই ভিজে গিয়েছেন?
— বৃষ্টির দিনে ডাকবেন আবার ভেঁজার জন্য মায়াকান্নাও করবেন। বাহ! দারুন তো।
—- আমি ডাকলেই আপনি আসবেন?
— হুমম আসব, কারণ প্রয়োজনটা আমার।
— সত্যিই কী শুধু মাত্র অর্নি আপুর জন্য এসেছেন?
— মানে? তবে আর কিসের জন্য আসব? কী সব প্রশ্ন করছেন?
— না মানে… আমি ভাবলাম….
— কী ভাবলেন?
—- ওমমমম এমন ওয়েদারে আমার সাথে বসে ঝগড়া করতে করতে এক কাপ ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে উষ্ণ উষ্ণ চুমুক দিতে….
—- এই থামেন থামেন…. উফফফ কী সব যে ভাবেন? বুঝি না আপনারা এমন কেন? কোনো মেয়ে কী তার দরকারে এই ওয়েদারে বেরোবে না? সবাই শুধু চুটিয়ে প্রেম করতেই বেরোবে? আজব!
— হা হা হা, আপনি দেখছি চরম ক্ষেপেছেন। শান্ত হোন, আমি তেমন কিছুই ভাবিনি।৷ এমনি এমনি বললাম।
—- এমন খাপছাড়া কথা আমার সাথে এমনি এমনি বলবেন না। আমি অভ্যস্ত না।
— ওকে, এখন আসল কথায় আসি।
— জি বলেন, তাই শুনতে চাচ্ছি। মাঝখানে বেহুদা বকবক হচ্ছে বেশি।
— আচ্ছা দাঁড়ান আগে একটু কফির অর্ডার দিয়ে নেই।
মৃদুলের কথাটা শেষ হতেই উর্মির মোবাইল বেজে উঠল। উর্মি ওর মায়ের কল দেখে রিসিভ করল
— হ্যালো আম্মু
— তুই কই? বৃষ্টির মধ্যে এভাবে বেরোলি নাস্তাটা পর্যন্ত করলি না..
— এই তো আম্মু ঠিকঠাক মতো চলে এসেছি, এত ভেবো না। আর নাস্তা করলে লেট হয়ে যেত।
— খবরদার বলে দিলাম,খালি পেটে কিন্তু চা খাবি না।
—- ঠিক আছে খাবো না। এখন রাখো। বাসায় এসে কথা বলব তোমার সাথে।
কলটা কেটে মোবাইলটা টেবিলে রাখতেই মৃদুল বলে উঠল
— আপনি নাস্তা করেননি সকালে?
— উঁহু, সময় পাইনি।
— ওকে, কী খাবেন?
— কিচ্ছু না, আম্মু খালি পেটে চা খেতে নিষেধ করেছেন।
— আপনি খুব নিষ্ঠুর মানুষ, আপনি পারবেন। কিন্তু আমি তো…
— নিষ্ঠুর মানে? কী পারবো?
—- ধরেন যদি কোনোদিন আমি আপনার ডাকে আপনার কাছে যাই আর আমি ক্ষুধার্ত থাকি, আপনি আমাকে ওই অবস্থাতেই ফেরত পাঠাবেন। বলবেন, যান নিজের বাসা থেকে খেয়ে আসেন। এমন ক্ষুধার্ত হয়ে কেন এসেছেন?
— ছি! আমার সম্পর্কে আপনার এই ধারনা? আমি এতটাই অমানবিক?
— জি আপনি তার চেয়েও ভয়ংকর…
—- আপনি একটা অসহ্য মানুষ। আপনার চেয়ে ফয়সাল ভাই হান্ড্রেড টাইম বেটার, অর্নি আপু বেঁচে গেছে।
— কিন্তু আপনি বাঁচতে পারবেন না।
— মানে?
— এভাবে না খেয়ে বোনের ভালো করতে করতে একদিন টুস করে মরে যাবেন।
—- আপনার সামনে আরো কিছুক্ষণ বসলে আমার এমনি এমনিই মরে যেতে ইচ্ছে করবে তখন টুস শব্দ হবে কী না তা জানি না। আমি উঠলাম…
—- কী আশ্চর্য যে কাজের জন্য এত কষ্ট করে বৃষ্টিতে ভিজে এলেন….. ফয়সাল ভাই আসলে ঠিক কথাটাই বলেছেন…
—- কী বলেছেন তিনি?
—- বসেন বলছি… আগে খাবারের অর্ডারটা দেই। বলে একজন ওয়েটারকে ডেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে এবার উর্মির দিকে তাকাল।
— আমি কিন্তু কিছুই খাবো না।
— আপনি খাবেন, এবং আমি এর বিল আন্টির কাছ থেকে নিয়ে নিব। আপনি নিশ্চিন্ত মনে খেতে পারেন।
— আম্মুর কাছ থেকে নিবেন কেন?
— কারণ আপনি তো আর রোজগার করেন না। আপনি দিলেও তো আন্টির থেকে এনেই দিবেন।
আর আন্টির সাথে যেহেতু আমার দেখা করতেই হবে….
— দেখা করতে হবে কেন?
— ফয়সাল ভাইয়ের যে সমস্যা তা কিন্তু অর্নি আপু জানেন, তবে কেন তিনি আন্টিকে জানাননি তাই বুঝতেছি না। তবে কী তিনি নিজেই এই সমস্যাকে লুকাতে চাচ্ছেন? নিজেই এটাকে বড় কোনো সমস্যা ধরে নিয়েছেন মনে প্রাণে? যদি তাই হয় তবে বিয়ের পর এই সমস্যার সাথে এক পরিবারে বসবাস করবেন কীভাবে তিনি?
— সমস্যাটা কী?
— ফয়সাল ভাইয়ের মা… আসলে আমার কাছে মনে হয়েছে এটা কোনো সমস্যাই না।
— আপনার মনে হলে তো আর হবে না। আমাদের আগে জানতে হবে তারপর ডিসিশনটাও আমাদেরই নিতে হবে।
—- হুমমম, কিন্তু এটা আরও সহজ হত যদি অর্নি আপু নিজে বিষয়টা একটু সহজভাবে নিতে পারতেন।
— আপনি বারবার আপুকে ব্লেম দিচ্ছেন কেন? আপনি জানেন আপু কতটা….
— জানি বলেই তো বিষয়টা নিয়ে এত ভাবছি। যে মেয়ে তার পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে শুধু মাত্র কাউকে ভালোবাসে বলে, তাকে নিয়ে মানে তার ভালোবাসা নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। আপনার আপু যে প্রচন্ড এক মানসিক চাপে আছেন তা আমি খুবই বুঝি। তাই তো বিষয়টা নিয়ে এত মেতেছি। এর বিহিত না করে সরবই না এখান থেকে ।
— বাব্বাহ! এখন দেখছি আপুর জন্য ভালোবাসা উতলে উঠেছে—
— উঁহু, ভালোবাসা না। তার ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। ভালোবাসায় আস্থা রাখতে সবাই পারে না। আপু পেরেছেন।
— কচু পেরেছে, অশান্তিতে জীবনটা শেষ….
— হয়েছে, এবার, অশান্তির কথা ভুলি। নাস্তা চলে এসেছে। গুড গার্লের মতো আগে খেয়ে নিন।
— ও এম জি, আমি গুড গার্ল তা আপনি জানলেন কীভাবে?
— হাহাহা, যে মেয়ে তার বড় বোনের জন্য এই বৃষ্টিতে নিজের আরাম ভুলে…
— হয়েছে হয়েছে, আপনাকে আর কথা বানাতে হবে না।৷ আশ্চর্য একটা মানুষ আপনি! প্রচুর কথা বানান। মনে হয় কথা বানানোর একটা মেশিন। কোথায় কী বলে সিচুয়েশন হেন্ডেল করতে হয় সব জানেন।
— তা ফয়সাল ভাইয়ের ওখানে আবার কবে যাবেন?
— দেখি, এর আগে অন্য কাজ সারতে হবে। ফয়সাল সাহেবের বাসাটা কোথায় জানেন?
— অন্য কিছু কি করতে হবে? কি প্ল্যান করছেন? ফয়সাল ভাইয়ের বাসা দিয়ে আপনি কী করবেন?
— উফফ এত প্রশ্ন একসাথে করলে জবাব দিবো কীভাবে? বাদ দেন আপনি খান।
— মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ছাড়াই কিছু প্ল্যান করছেন?
— কেন আপনি বুঝি আমার সব কাজে সাথে থাকতে চান?
— অবশ্যই চাই। আমাকে ছাড়া আপনি একটা চুলও নড়াবেন না বলে দিলাম।
— সত্যি সত্যিই চান? থাকবেন তো সব সময়? শুনতে কিন্তু বেশ লাগছে।
বলে মৃদুল একটু মুচকি হাসল।
— এমন অসভ্যের মতো হাসছেন কেন? এখানে হাসার মতো কী বললাম। অর্নি আপুর বিষয়ে যে কোনো কাজ…..
— ও, আমি ভাবলাম আপনি বুঝি আমার লাইফের…
— উফফ, কিসের মধ্যে কি? পান্তাভাতে ঘি।
আপনি দেখছি ক শুনে, কলা, কমলা,কামরাঙা দুনিয়া শুদ্ধ বুঝতে শুরু করেছেন।
— হা হা হা, এখন বলেন, আমার সাথে অর্নি আপুর সাক্ষাৎ কবে করাচ্ছেন?
— উফফ শান্তিতে একটু খেতেও দিবেন না? আম্মুর সাথে মিট করতে চেয়েছিলেন, এখন আবার অর্নি আপু কেন? তার সাথে আপনার যোগাযোগের কী দরকার?
— রিল্যাক্স, মুখের খাবার আগে শেষ করেন। এত হাইপার হলে কী আর চলে? আমার কাছে যেখানে যেখানে সমস্যা মনে হয়েছে আমি সেখানেই সলভ করতে চাচ্ছি। আপনি কাল বা পরশু একটা ব্যবস্থা করেন আপুর সাথে কথা বলার।
— অসম্ভব! আপুর বাসা থেকে বের হওয়া নিষেধ।
— আমার বিশ্বাস আপনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবেন এক তুরিতে। আজ আর সময় দিতে পারছি না। বস বিশাল এক কাজ দিয়েছে এখন গিয়ে কাজে ডুব দিব।
— ইয়া আল্লাহ আপনি তো কিছুই খাননি!
— ঝগড়া করেই তো হাতের সব সময় শেষ করলেন খাওয়ার সময় দিয়েছেন? বলেই মৃদুল উঠে দাঁড়িয়ে একটু মুচকি হেসে সোজা পেছন ফিরে বেরিয়ে গেল ক্যাফেটেরিয়া থেকে। উর্মি ও কথাটা কী বলল তা বুঝতে বুঝতে দেখল ও চলে গেছে। প্রচন্ড বিরক্ত হল এই মুহুর্তে মৃদুলের উপর। এটা কোনো ম্যানার হল কাউকে ডেকে এনে খাইয়ে এমনভাবে ফেলে যাওয়া যায় কি?

রিকশায় বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে মনটা যেন কেমন হয়ে গেল যখনই মনে হল মৃদুল ওর লাঞ্চের সময়টায় কিছুই খায়নি, হয়ত কাজের চাপে আর কোনো নাস্তাও হবে না ঠিক মতো। মানুষটা শুধু মাত্র ওর পরিবারকে সাহায্য করতে এসে নিজে না জানি কত কত কষ্ট হজম করছে।

বাসায় ফিরতেই ওর মা’কে মৃদুলের বলা সব কথাই বলল। অর্নির সাথে কথা বলতে চাইছে শুনে ওর মা-ও বিষয়টা ঠিক মতো বুঝল না। মনের মধ্যে কেমন একটা দ্বিধা রয়ে গেল। এখন ভাবছে অর্নিকে ছাড়বে কি না মৃদুলের উপর ভরসা করে। সমস্যাটা যদি মেয়ের মধ্যেই থাকে তবে অবশ্যই মেয়েকে সেই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তবেই ও সামনের জীবনে সুখ পাবে নয়ত একটা ধোঁয়াশার মধ্যে জীবন কাটাতে হবে।এমনটা হোক অর্নির জীবনে তেমনটা তিনি কখনোই চান না। মেয়েটা সব জানে কিন্তু তাকে কিছুই জানায়নি তার মানে ও নিজেই আছে চরম সমস্যায়। এসব ভেবে ভেবে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। একবার ভাবলেন অর্নির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন ও কী জানে আর কেন-ইবা তাকে এখনো জানায়নি। কিন্তু পরক্ষণেই থেমে গেলেন। নিজেকে বোঝালেন, মেয়ে যদি বলার হত তবে এতদিন এত প্রেশারেই বলে দিত। উনি যত চেষ্টাই করেন না কেন তার মেয়ে অর্নি ওর ভেতরের সব কথা তাকে বলবেন না।
এখন অপেক্ষায় থাকলেন কবে কখন অর্নি নিজে সমস্যা থেকে বেরিয়ে তাকে সবটা জানায়।

চলবে